নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলিতে দীর্ঘদিন স্বৈরাচারী আরব বাদশাহগণ শাসন করাতে আরব জনগণ অনেকটা অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। আরব জাগরণের পূর্বেই বিভিন্ন সংস্থা ও বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ এবিষয়ে সতর্কবানী উচ্চারণ করেছিলেন। সেই আরব জাগরণ যাতে ১৯৭৯ সালের ইরানের ইসলামি বিপ্লবের মত না হয় সেজন্য মার্কিন ও ইহুদী লবীরা মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে। এর বাস্তব প্রমাণ হল এখন যেসব দেশে আরব জাগরণ হয়েছে সেসব দেশ নতুন করে আবার ইসরায়েল ও আমেরিকা মুখী হয়েছে। যেমন লিবিয়া, মিশর। আসলে বলা যায়, এই আরবজাগরণ একটা বৃত্তের মত। যাদের কারণে ও যেখান থেকে আরব বসেন্তর শুরু সেই ঢেউ সেখানেই এসে ও তাদের সাথেই আবার মিলিত হয়েছে।
আরব বিশ্ব সংক্রান্ত ধারণা:
নিকটপ্রাচ্য সীমা থেকে পূর্বদিকে ইরানের সীমা পর্য ন্ত মধ্যপ্রাচ্য ধরা হয়। মধ্যপ্রাচ্যের পনেরটি দেশ হচ্ছে- ইরাক, ইসরাইল, জর্ডান, বাহরাইন, ইরান, কুয়েত, লেবানন, ওমান, তুরস্ক, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, সৌদি আরব, সিরিয়া, ইয়েমেন, সাইপ্রাস। এর মধ্যে আরব দেশসমূহ ৭টি হচ্ছে, ওমান, কাতার, সৌদি আরব, কুয়েত, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন ও ইয়েমেন। আর আরব বিশ্ব বলতে ২২টি দেশকে বুঝায়। দেশগুলো হচ্ছে, সংযুক্ত আরব আমিরাত, তিউনিসিয়া, আলজেরিয়া, ওমান, সৌদি আরব, জিবুতি, ইরিত্রিয়া, ইয়েমেন, কুয়েত, কাতার, বাহরাইন, জর্ডান, লেবানন, সোমালিয়া, ইরাক, সিরিয়া, সুদান, মিশর, লিবিয়া, মরক্কো, মৌরতানিয়া, ফিলিস্তিন।
আরব বসন্ত: কে সুফলভোগী?
আরব জাগরণ হাইজ্যাকের সর্বশেষ পিনটা ঠুকে দেওয়া হয়েছে সিরিয়ায় ও তার আগের পিনটা ঠুকে দেওয়া হয়েছিল লিবিয়ায়। এই আরব বসন্তের ঢেউ যাতে আর বাদবাকী আরব দেশগুলিতে না লাগে তার জন্য চুড়ান্ত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। আমেরিকা ও ইসরায়েলের দরকার ছিল পুরাতন বোতলে নতুন মদ। হয়েছেও তাই। আরবরা পারে না ইসরায়েলের একটা লোম ছিড়তে, পারে না গাজায় ত্রাণ পাঠাতে, পারে না একটা বুলেট পাঠাতে, অথচ তারা রণসজ্জায় সেজেছে শিয়া নিধনে! সিরিয়ার যুদ্ধটাকে শিয়া-সুন্নি যুদ্ধে রুপ দেওয়া হল ইসরায়েল আমেরিকার বড় সফলতা।
ইসরায়েলের পথের সবচেয়ে বড় কাটা ছিল সাদ্দামের ইরাক। সেটা অপসারণ হয়েছে কিন্তু সেই সাদ্দামের চেয়েও ইসরায়েলের জন্য আরো ভয়ংকর ও দু:স্বপ্ন হল ইরান। কারণ ইরান আর যাই হোক ইরাক বা লিবিয়ার মত নয়। তাছাড়া ইরান যেভাবে তার নিরাপত্তা বলয় সাজিয়েছে সেই দুর্গে হানা দেওয়া ছিল ইসরায়েল আমেরিকার জন্য একটা দিবা স্বপ্ন! এই আরব বসন্তকে পুজি করে সেটা এখন আর দিবা স্বপ্ন নয়। এটা এখন বলা যায় অনেকটা বাস্তবায়নের পথে। কারণ ইরান, হিজবুল্লাহ ও হামাসকে দুর্বল ও নিস্ক্রিয় করতে হলে তাদের যোগাযোগের মূল মাধ্যম সিরিয়াকে বিচ্ছিন্ন করতে হবে। যখন কোন আরব রাস্ট্রই সাহস পায়নি হামাস নেতাদের আশ্রয় দিতে তখন এই আসাদের সিরিয়ায় তাদের আশ্রয় দিয়েছিল আর হামাস ও হিজবুল্লাহর কাছে ইরানী সহায়তা যায় সিরিয়ার হাত হয়ে। তাই মাথা কাটতে হলে আগে তাদের হাত কাটতে হবে। সৌদি বাদশাহ আব্দুল্লাহ ২০০৮ সালে বুশকে বলেছিলেনও তাই।
তিউনিশিয়া: আরব বসন্ত শুরু
২০১০ সালের ডিসেম্বরে তিউনিশিয়ায় প্রথম স্বৈরশাসন বিরোধী গণআন্দোলন শুরু হয়। ২০১১ সালে জাতীয় সমস্যাকে গুরুত্ব দিয়ে তিউনিশিয়ায় পার্লামেন্ট নির্বাচনে রশীদ ঘানুশির দল আন নাহদা একক সংখ্যা গরিষ্ঠতা লাভ করে কয়েকটি সেক্যুলার দলের সঙ্গে কোয়ালিশন করে সরকার গঠন করে কিন্তু সেখানেও ২ বছরের মাথায় সরকার ভেঙ্গে যায়। আরব বসন্তের সূচনাকারী দেশ তউনিসিয়া। ২০১১ সালে এ দেশটি দিয়েই সমগ্র আরব বিশ্বে গণজাগরণের ঢেউ ওঠে। পতন ঘটে ২৩ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা ক্ষমতাধর প্রেসিডেন্ট জাইন এল আবিদীন বেন আলীর। এরপর দেশটিতে শুরু হয় রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা। ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে অজ্ঞাত বন্ধুকধারীদের গুলিতে বামপন্থী নেতা চোকরি বেলায়েত, আর জুলাইয়ে আরেক বামপন্থী নেতা মোহাম্মেদ ব্রাহিমি নিহত হলে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা প্রকট আকার ধারণ করে। এ দু’হত্যাকান্ডের জন্য বিরোধীরা এন্নাহদা সরকারকে দায়ী করে। বিরোধীরা অভিযোগ করে সরকার সশস্র গ্রুপগুলোকে নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে ১২ ডিসেম্বর ২০১৩ ক্ষমতাসীন উদার ইসলামপন্থী এন নাহদা পার্টি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে সম্মত হয়। এ সরকারই ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনের আগ পর্যান্ত দায়িত্ব পালন করবে। ১৪ ডিসেম্বর ২০১৩ রাজনৈতিক দলগুলো ৬জন প্রার্থী থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মনোনীত করে সাবেক শিল্পমন্ত্রী মেহেদি জুম্মাকে।
ইরান: ইসলামি প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র
ইরানে ব্যাপক গণ আন্দোলনের মাধ্যমে ১৯৭৯ সালে আয়াতুল্লাহ খোমেইনীর নেতৃত্বে বিপ্লব সাধিত হয়েছে ও ইসলামি প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠত হয়েছে। পশ্চিমা যড়যন্ত্রের মোকাবিলা করে ইসলামি আইন ও মূল্যবোধকে সামনে রেখে একটি আধুনিক রাষ্ট্র চালানো সম্ভব বলে প্রমান করেছে ইরান। বিগত ৩৫ বছর ধরে সেখানকার ইসলাম পন্থীরা মোটামুটি সফলতার সাথে সরকার পরিচালনা করছে। আন্দোলন ও সরকার পরিচালনার ইরানী অভিজ্ঞতাকে অনেকে ’ইরানী মডেল’ বলে আখ্যায়িত করে থাকেন। ইরানী মডেল এক সময়ে মুসলিম বিশ্বে খুবই জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। অবশ্য বর্তমানে অবস্থার অনেক পরিবর্তন হয়েছে। বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতি, বিশ্ব জুড়ে ইসলামের বিরুদ্ধে যড়যন্ত্র ও ইরানের শিয়া হওয়া এর প্রধান কারন বলে মনে হয়।
তুরস্ক: গণতান্ত্রিক মুসলিম দেশ
তুরস্কে ইসলামি আন্দোলন ‘৭০ এর দশকে ও ‘৯৬ সালে নির্বাচনে ভালো করে সেক্যুলার দলের সঙ্গে কোয়ালিশন সরকার গঠন করে। নাজমুদ্দিন আরবাকান দুবার ডেপুটি প্রধানমন্ত্রী ও একবার প্রধানমন্ত্রী হন। কিন্তু শেষ বাহিনীর চাপে তাকে পদত্যাগ করতে হয়। তুরস্কে ২০০১ সালে নির্বাচনে প্রথমবারের মতো এরদুগান ও গুলের নেতৃত্বাধীন জাস্টিস এ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি(একেপি) সংখ্যা গরিষ্ঠ আসন পেয়ে সরকার গঠন করে। ২০০৮ ও ২০১২ সালের নির্বাচনেও তারা যথাক্রমে ৪৬% ও ৪৯.৯% শতাংশ ভোট পেয়ে দ্বিতীয় ও তৃতীয়বারের মতো সরকার গঠন করেছে। তাদের পূর্বতন সংগঠন ড. নাজমুদ্দিন আরবাকানের নেতৃত্বাধীন স্যালভেশন, রেফাহ ও ফজিলত পার্টির সঙ্গে ধর্মীয় এজেন্ডা না আর্থ সামাজিক ও উন্নয়নের এজেন্ডা প্রাধান্য পাবে এ মতবিরোধের সুত্র ধরেই এরদুগান ও আব্দুল্লাহ গুল একেপি গঠন করেন। তারা এ পর্যন্ত পরপর তিনটি নির্বাচনে ক্রমান্বয়ে ভালো করে সরকার গঠন করেছে। এখনও একেপি তুরস্কের সবচেয়ে জনপ্রিয় পার্টি। অন্যদিকে ফজিলাত পার্টির সরাসরি উত্তরসুরি ২০০১ সালে গঠিত সাদাত পার্টি প্রতিষ্ঠার পর থেকে নির্বাচনে মোটেই ভালো করতে পারেনি। নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠন ও দেশকে ক্রমান্বয়ে উন্নতির দিকে নিয়ে যাওয়ার নতুন মডেল তুরস্ক। একে তুর্কি মডেলও বলা হয়। বর্তমানে পৃথিবীতে অনেক গণতান্ত্রিক মুসলিম দেশে ’তুর্কি মডেল’ অনুসরণ করার চেষ্টা চলছে।
আক্রান্ত ফিলিস্তিন: নিজ দেশে পরবাসী
ফিলিস্তিনের জনগণের লড়াই ‘পাশ্চাত্য আধিপত্য’, ‘বর্ণবাদ’ ও ‘সাম্রাজ্যবাদ’ বিরোধী লড়াই। ঔপনিবেশিকতা এবং সাম্রাজ্যবাদ বহু জাতি ও জনগোষ্ঠির অস্তিত্ব দুনিয়া থেকে মুছে দিতে পারলেও লড়াকু ফিলিস্তিনীদের মুছে ফেলতে পারেনি। নিরস্ত্র মানুষ ভয়াবহ ট্যাংক ও মারণাস্ত্রের সামনে দাঁড়িয়েছে। ফিলিস্তিনী জনগণ দেশে দেশে জনগণের মুক্তি সংগ্রামের প্রেরণা জুগিয়ে চলেছে। ইসরাইল শুধু মধ্যপ্রাচ্যের তেলের খনি এবং গণবিরোধী ও একনায়কতান্ত্রিক মুসলমান রাজা-রাজড়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তাবেদার শাসকদের টিকিয়ে রাখার কাজই করেনা; দুনিয়াব্যাপী প্রচার-প্রপাগান্ডার ক্ষেত্রে বিশেষত ইসলাম সম্পর্কে বিকৃত কুৎসা রটনা করে। বায়তুল মোকাদ্দেস বা জেরুজালেম তিনটি একত্ববাদী সেমিটিক ধর্মের কাছে অতি পবিত্র নগরী। কিন্তু এই অতি প্রাচীন পবিত্র নগরকে কেন্দ্র করে তিনটি ধর্মের মধ্যে যে বিরোধ, সংঘাত ও লড়াই তার জের সাম্রাজ্যবাদী লড়াই-সংগ্রামে রূপ নিয়েছে। এই লড়াই শুধু ধর্মের লড়াই নয়, মানবেতিহাসের অনেকগুলো অমীমাংসিত প্রশ্নের লড়াই। ষাট দশকের শেষের দিকে এবং সত্তর দশকের অধিকাংশ সময় জুড়ে মার্কিন শহরগুলোতে যে শ্লোগান দেখা যেত তাতে দেখা যেত কেউ হয়তো দাবি করছে ‘ফিলিস্তিন আছে’ আর কেউ দাবি করছে ‘ফিলিস্তিন নাই’। গোল্ডা মেয়ার ১৯৬৯ সালে সাফ সাফ বলে দিয়েছিলেন ফিলিস্তিন বলে কিছু নাই।
মধ্যপ্রাচ্য ভাবলেই যে চিন্তা মাথায় আসে তা হোল আরব ও ইসরায়েলিদের মধ্যে বিরোধ, দ্বন্দ্ব ও যুদ্ধ। কিন্তু ওর মধ্যে ‘ফিলিস্তিন’ বলে একটা ব্যাপার আছে এই বিষয়টা বোঝাতে ফিলিস্তিনীদের লড়াই করতে হয়েছে এবং এডওয়ার্ড সাঈদের মতো মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মকাণ্ডের বড় একটা সময় ব্যয় করতে হয়েছে এই সত্যটা বোঝাতে যে, ফিলিস্তিন নামে একটা ব্যাপার আসলেই আছে। ২০০৬ সালে ফিলিস্তিনের পার্লামেন্ট নির্বাচনে ফিলিস্তিনী জনগণের আশা আকাঙ্খাকে বেশী গুরুত্ব দিয়ে হামাস জয়লাভ করে সরকার গঠন করে যদিও পশ্চিমা সরকারগুলো তাকে স্বীকৃতি দেয়নি। দীর্ঘ ৬৫ বছর লাঞ্চিত ও নির্যাতিত হওয়ার পর ২০১২ সালের ২৯ নভেম্বর ফিলিস্তিন জাতিসংঘের সদস্যদের দুই-তৃতীয়াংশ সমর্থন পেয়ে জাতিসংঘে অসদস্য পর্যবেক্ষক রাষ্ট্রের মর্যাদা পেয়েছে। ২০১৪ সালকে ‘ফিলিস্তিনি জনগণের সংহতি বর্ষ’ হিসেবে ঘোষণা করেছে জাতিসংঘ। ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরাইলি হামলার ব্যাপারে বাংলাদেশের মন্ত্রিসভায় আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। যুদ্ধ বন্ধের জন্য আন্তর্জাতিক মহলের প্রতি আহবান জানানো হয়েছে। মুসলিম উম্মাহর স্বার্থে এবং শান্তির স্বার্থেই বাংলাদেশের এই অবস্থান।
মধ্যপ্রাচ্য সমস্যার মূল কারণ হল ফিলিস্তিনে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। দীর্ঘ দিন যাবৎ আরব মুসলমানরা ফিলিস্তিনে তাদের শাসন প্রতিষ্ঠা করে রেখেছিল। আরবদের পূর্বে ইহুদিরা এ ভূমিতে বসবাস করত । তাই এ ভূমি হতে চলে যাওয়ার পর তারা বিচ্ছিন্নভাবে বসবাস করছিল। এই বিচ্ছিন্নতার মধ্যে তাদের জীবনে এক ধরনের অস্থিারতা বিরাজমান ছিল। অধিকন্তু ইউরোপের খ্রীষ্টানরা তাদের উপর নির্যাতন করত। সেই তুলনায় মুসলমানরা একটু দয়ালু প্রকৃতির ছিল বলে তারা ফিলিস্তিনে বসবাসে বেশী আগ্রহী ছিল। অধিকন্তু তারা এ ভূমিতে তাদের পূর্ব ঐতিহ্য ও ধর্ম গ্রন্থে বর্ণিত প্রতিশ্র“ত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে উদগ্রীব ছিল। ফিলিস্তিনে ইহুদিদের আধিপত্য দাবীর কারণ হচ্ছে, প্রথমত: Old Tastament এ বিশ্বপ্রভূ তার মনোনীত ব্যক্তির সাথে ইহুদি জাতির জন্য তাদের পবিত্র ভূমি ফিলিস্তিনে একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে সহায়তার জন্য অঙ্গীকার করেন। তাতে বলা হয়েছে- `and I will make of the a great nation……. And they went forth to go to the land of Canaan…… and Canaan was then that the land. And the Lord oppressed to Abraham and said: Unto they said Iwill give this land”.. দ্বিতীয়ত : মল, ডেভিড ও সলেমান কর্তৃক ফিলি¯িতনে এক সমৃদ্ধ ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্মৃতি যুগ যুগ ধরে বিভিন্ন দেশে বসবাসকারী ইহুদিদের অনুপ্রেরণার উৎস হিসাবে কাজ করেছে।
ফিলিস্তিনে আরবদের আধিপত্য দাবীর কারণ হচ্ছে, প্রথমত: ইহুদিদের ঐতিহাসিক স্মৃতির দাবীদার আরবরাও। কেননা বহু মহাপুরুষ উভয় ধর্মাবলম্বীদের নিকট সম্মানিত। এছাড়াও কিছু ঐতিহাসিক স্মৃতি আরবদের নিজস্ব। যেমন: মহানবী (সা) এর মিরাজ গমনের স্মৃতি, হযরত ওমর (রা) এর খেলাফত কালে প্যালেষ্টাইনে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠা, কুরবাত উস-সাখরা ও মসজিদ উল-আকসার ন্যায় ঐতিহ্য মন্ডিত হর্মরাজী নির্মাণ এবং দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে সালাহ উদ্দিন আইয়ুবীর ফিলিস্তিনি উদ্ধার প্রমূখ। দ্বিতীয়ত: আরবরা সপ্তম শতাব্দী হতে বর্তমান পর্যন্ত ( ১০৯৯ খ্রী: হতে১১৯১ খ্রী: বাদে) এ অঞ্চল শাসন করছে যে কারণে এ অঞ্চলের অধিবাসীদের অধিকাংশ আরব মুসলিম ও খ্রীষ্টান। বা¯তবে সংখ্যাধিক্য হেতু আরবরা আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার আলোকে দেশটির উপর তাদের আধিপত্য দাবী করে।
আরবদের দ্বারা ফিলিস্তিন হতে বহিস্কৃত হওয়ার পর ইহুদিরা বিভিন্ন দেশে বসবাস করলেও তাদের জীবন ধারায় কিছুটা ব্যতিক্রমি বৈশিষ্ট লক্ষ্য করা যায়। যেমন: যে কোন দেশেই তারা স্থানীয় জনগনের সাথে মিশে যায়নি। ইহুদিদের নিজেদের স্বাতন্ত্র বজায় রাখার প্রবণতা ও সাধারণ খ্রীষ্টানগন কর্তৃক যীশুর হত্যাকারী হিসাবে চিহ্নিত করার ফলে ইহুদীরা খ্রীষ্টানদের সাথে মিশে এক সমাজ গঠন করতে পারে নাই। খ্রীষ্টানরা সংঘবদ্ধভাবে ইহুদি মহল্লায় আক্রমণ করে বহু জীবন ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি সাধন করত। ভাল ব্যবসায়ী হওয়ায় ও কুসিদ প্রথার মাধ্যমে নিজেদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিল। এ সময়ে তার খ্রীষ্টানদের তুলনায় মুসলমানদের নিকট বেশী সুহৃদ ব্যবহার পায় ও অনেক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় সুবিধা লাভ করে।
ফরাসী বিপ্লবের মাধ্যমে ইউরোপে ইহুদিরা বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা লাভ করে এবং তখন অনেক ইহুদি উক্ত দেশসমূহের জনসাধারনের সাথে মিশে যাওয়ার পক্ষে মত দেয়। কিন্তু এ মুহুর্তেও ইহুদিরা নিজেরে স্বতন্ত্র জীবনধারা বজায় রাখে। এদিকে উনবিংশ শতাব্দীর শেষ পাদে খোদ ফরাসী দেশে ড্রাইফোর্স বিচারে কিছু নির্দোষ ইহুদি জেনারেলকে শাস্তি দিলে ইহুদি বিদ্বেষ আবারও মাথাচারা দিয়ে উঠে। এ সময়ে বহু ইহুদি মনীষী তাদের ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তা ভাবনা শুরু করেন। যাদের মধ্যে মোজেজ ,হেস, হিরস, কালিশার এবং থিওডোর হারজ্জেল অন্যতম। হেস ১৮৬২ সালে প্রকাশিত একটি পুস্তকে ইহুদি সমস্যা সমাধাানের ইঙ্গিত দেন। তিনি বলেন: সম্পূর্ণ নতুন পরিবেশে নতুন সমাজ গঠনের মাধ্যমেই কেবল ইহুদি সমস্যার সমাধান সম্ভব। তিনি ক্রমে ক্রমে ফিলিস্তিনে ইহুদি বসতি স্থাপনের জন্য জোড় সুপারিশ করেন। প্রাশিয়ার দখলকৃত পোল্যান্ডে জন্মগ্রহনকারী কালিশার নামক একজন ইহুদি যাজক প্রচার করেন যে, ধর্মগ্রন্থে বর্ণিত ইহুদিদের মুক্তি প্রচেষ্টা ব্যতীত মুক্তি লাভ করা কঠিন। নিজেদের প্রচেষ্টায় ফিলিস্তিনে নিজেদের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার মধ্যেই মুক্তি নিহিত। ১৮৬০ সালে বুদাপেস্তে জন্মগ্রহনকারী ড. হারজ্জেল বলেন- প্যালেষ্টাইনে ইহুদিদের স্বতন্ত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই চিরন্তন ইহুদি সমস্যা একটি গ্রহনযোগ্য সমাধান সম্ভব। এধরনের একটি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন দেশ হতে কিছ ু কিছু ইহুদি ফিলিস্তিনে আসতে শুরু করে। তবে তখনও কোন রাজনৈতিক সংস্থা বা রাষ্ট্র গঠনের কথা চিন্তা করা হয় নাই। এ সময় ১৮৭০ সালে জাফায় ইহুদিদের সংস্থা Alience Israelite Unverselle একটি আধুনিক কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করে। জার্মান ইহুদিগন কর্তৃক জেরুজালেমে ধর্মনিরপেক্ষ বিদ্যালয় স্থাপনের মাধ্যমেও সফলতা অর্জন করে। ১৮৭৮ সালে পেতা তিকভায় প্রথম ইহুদিদের কৃষি বসতি স্থাপন করে। কিন্তু এভাবে জমি ক্রয় করে ইহুদী বসতি স্থাপনের পরিমাণ খুবই সীমিত ছিল।
১৮৮১ সালে তৃতীয় আলেকজান্ডার রাশিয়ার সিংহাসনে আরোহন করে যে ইহুদি বিরোধী অভিযান আরম্ভ করে তা পূর্ব ইউরোপের অন্যান্য দেশেও ছড়িযে পড়ে। যার ফলে হাজার হাজার ইহুদি পাশ্চাত্য দেশ বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চলে যেতে থাকে। বেশকিছু সংখ্যক ইহুদি তখন ফিলিস্তিনেও আগমন করে। তখন রাশিয়া ও রুমানিয়া হতে প্যালেষ্টাইনে আগত ইহুদিরা স্থানীয় পরিবেশ সম্পর্কে অবগত না হওয়ায় অর্থনৈতিক সমস্যাসহ বিভিন্নমুখী সংকটের সম্মুখিন হয় এবং তাদের অস্তিত্ব বিপন্ন হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়। রাশিয়ার বিভিন্ন স্থানে তখন জাইয়ান (ফিলিস্তিনের একটি অঞ্চল) প্রেমিক ( হোভেনী জাইয়ান সংস্থা) গঠন করে। তারা ফিলিস্তিনে আগত ইহুদিদের অর্থসহ বিভিন্ন জিনিষ দিয়ে সহযোগীতা করতে থাকে। রাশিয়া ও পূর্ব ইউরোপে ইহুদি বিরোধী আন্দোলনের ফলে উনবিংশ শতাব্দীতে ইহুদিদের আগমনকে প্রথম আলিয়া বলা হয়। ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত ইহুদীরা মোট পাঁচটি আলিয়ায় ফিলিস্তিনে আগমন করে।
কিছু সংখ্যক কৃষি বসতি স্থাপনের মাধ্যমে ইহুদিদের সমস্যার সমাধান সম্ভব ছিলনা বরং এ সমস্যাটিকে একটি আন্তর্জাতিক সমস্যায় রূপ দেওয়া প্রয়োজন একথা উপলব্ধি করে ড. হারজ্জেল প্রথম ‘জাইয়ানবাদী আন্দোলন’ শুরু করেন। ১৮৯৭ সালে সুইজারল্যান্ডের ব্রাসেলসে ‘প্রথম বিশ্ব জাইয়ানবাদী সম্মেলন’ অনুষ্ঠিতহয়। এই সম্মেলনে গৃহীত প্রস্তাবাবলীর মধ্যে ছিল প্যালেষ্টাইনে অধিক সংখ্যক কৃষি বসতি ও ইহুদি মালিকানাধীন কল কারখানা স্থাপন এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আন্দোলনকে গ্রহনযোগ্য করবার প্রয়াস পায়। তখন সারাবিশ্বের ইহুদিরা ভৌগোলিক সীমারেখায় আবদ্ধ জাতীয়তাবাদকে ইহুদি ধর্মের আত্মিকতার প্রতি আঘাত বলে মনে করে। জুডীয় ধর্মকে তারা মূলত: আধ্যাত্মিকতার একটি ঐশী বিধান বলে মনে করত। কারণ যে সমস্ত দেশে ইহুদিগন সেইসব দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনধারার সাথে বহুলাংশে একত্রিত হয়ে গেছে সে দেশের ইহুদি নেতৃবৃন্দ জাইয়ানবাদকে একটি ভারসাম্য বিনষ্টকারী আন্দোলন হিসাবে অভিহিত করে। তা সত্ত্বেও হারজ্জেলের জাইয়ানবাদের পক্ষে প্রচারনার ফলে এ আন্দোলন ধীরে ধীরে ইহুদিদের নিকট জনপ্রিয় হয়ে উঠে। যার ফল হিসাবে দেখা যায় শুরুতে জাইয়ানবাদী আন্দোলনের সদস্য সংখ্যা ছিল ৭৫০০০ পরে তা ১৯০৫ বেড়ে দাড়ায় দুই লাখেরও অধিক। এ সময় জাইয়ানবাদী সংস্থার অধীনে গঠিত হয় ‘ইহুদি জাতীয় তহবিল’ এবং ‘প্যালেষ্টাইন গঠন তহবিল’। আর এ সকল তহবিল হতে পরিকল্পিতভাবে জমি ক্রয় করে বসতি স্থাপন করা হতে থাকে। এদিকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় নিজেদের মধ্যে ফিলিস্তিনই নিয়ে গোপন চুক্তি করতে থাকে যে কারণে মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে সংকট ঘণিভূত হতে থাকে। এর মধ্যে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে হোসাইন- ম্যাকমোহন চুক্তিতে সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যেএক বা একাধিক স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা বলা হলেও প্যালেষ্টাইন সম্পর্কে স্পষ্টভাবে কিছু বলা হয় নাই। ব্রিটেন ও রাশিয়ার মধ্যে সাইকসোপিকো নামে যে গোপন চুক্তি হয় তাতে প্যালেষ্টাইনে একটি আন্তর্জাতিক প্রশাসন প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়।
ব্যালফোর ঘোষনা ছিল ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় প্রচেষ্টার উল্লেখযোগ্য দলিল । এই ঘোষণায় লর্ড রথশিল্ডকে লর্ড ব্যলফোর আশ্বস্থ করেন যে, ব্রিটিশ সরকার ইহুদি জনগনের জন্য ফিলিস্তিনে একটি জাতীয় রাষ্ট্র আবাসভূমি প্রতিষ্ঠার প্রশ্নটি আগ্রহ সহকারে বিচার করে। যা ছিল ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে কোন বিশ্ব নেতৃত্বের প্রথম ঘোষনা। এঘোষনার কারণ হিসাবে যেসকল বিষয় কাজ করে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল, বলশেভিক ইহুদী নেতাদের খুশি করে তাদেরকে আরও কিছু দিন প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানীর বিরুদ্ধে যুদ্ধরত রাখা। আমেরিকার ইহুদিদের খুশি করার মাধ্যমে তাদের সহানুভূতি লাভ এবং মার্কিন সরকারকে পূর্ণভাবে যুদ্ধে অংশগ্রহন করানো। পূর্ব ইউরোপের ইহুদিদের পাশ্চাত্যে আসা বন্ধ করে প্যালেষ্টাইনে পাঠিয়ে দিয়ে দায়মুক্ত হওয়া। ইহুদিদেরকে মধ্যপ্রাচ্যে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের প্রতিভূ হিসাবে প্রতিষ্ঠা করা।
এদিকে মিশরে নিযুক্ত ব্রিটিশ হাই কমিশনার ম্যাকমোহন ও সৌদি আরবের রাষ্ট্রদূত শরীফ হোসাইনের মধ্যকার পত্র বিনিময়ে অটোমান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করলে ফিলিস্তিনে একটি আরব রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্র“তি দেয়। কিন্তু যুদ্ধোত্তর কালে তাদের এ অঙ্গীকার ভঙ্গ করে। অপর দিকে ইহুদিরা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ফিলিস্তিনে বসতি স্থাপনের মাধ্যমে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের প্রচেষ্টা চালায়। সেজন্য তারা বহিরাগমনের ব্যাপারে ব্রিটেনের উপর ক্রমবর্ধমান চাপ প্রয়োগ করে। ফিলিস্তিনে ইহুদি বহিরাগমন যত বাড়তে থাকে আরববাসী ও ইহুদিদের মধ্যে দাঙ্গাও তত বাড়তে থাকে। ১৯২১সাল ও ১৯২৯ সালে এ ধরনের দুটি বিরাট দাঙ্গা সংগঠিত হয়। ১৯২৯ সালে অশ্র“ প্রাকারের যুদ্ধে মসজিদ উল আকসায় উপাসনাকে কেন্দ্র করে আরব ইহুদি দাঙ্গা সংগঠিত হয়, যাতে ১৩৩ জন ইহুদি ও ১১৬ জন আরব নিহত হয়। এর পরেও ১৯৩৬ ও ১৯৩৮ সালে দুটি বড় দাঙ্গা সংগঠিত হয়।
এ সকল সংঘর্ষের কারণ উদঘাটনে ১৯২০ সালের পর পালিন কমিশন, ১৯২১ সালে হেক্রাকট কমিশন, ১৯৩০সালে শ কমিশন, ১৯৩৬ সালে পীল কমিশন ও ১৯৩৮ সালে উডহেড কমিশন গঠন করা হয়। ১৯৩৬ সালে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ চলাকালীন সময়ে লর্ড পীলের নেতৃত্বে উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন একটি কমিশন গঠন করা হয়। কমিশনের ফিলিস্তিন আগমন করার পর পরিস্থিতি অনুধাবন করতে বেশী বেগ পেতে হয়নি। ১৯৩৭ সালে এই কমিশনের রিপোর্টে বলা হয় ইহুদি ও আরবদের নিকট দেওয়া সরকারের প্রতিশ্র“তি পরস্পর বিরোধী। সরকার কর্তৃক গৃহীত ম্যান্ডেট ব্যবস্থা চলতে পারেনা । আর এ ব্যবস্থা থাকলে হাই কমিশনের বিভিন্ন অঞ্চলে ইহুদিদের জমি ক্রয় বন্ধ করার ক্ষমতা থাকতে হবে। তাই এই ব্যবস্থায় সমস্যা সমাধানের জন্য যথেষ্ঠ নয়। কমিশন ফিলিস্তিনকে বিভক্ত করে একটি আরব ও একটি ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই এ সমস্যার সমাধান সম্ভব বলে সুপারিশ করে।
আরবরা এব্যবস্থার বিরোধিতা করতে থাকে। দেশ বিভাগ পরিকল্পনার অন্যতম উদ্যোক্তা মনে করে তারা গ্যলিলির জেলা প্রশাসককে হত্যা করে। তাই সর্বোচ্চ মুসলিম পরিষদের সভাপতি পদ হতে আমিন আল হোসাইনকে সরিয়ে দেয়। এতে আরব ও ইহুদি সন্ত্রাসবাদীরা সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। আর ১৯৩৮ সালে অনুষ্ঠিত এ সংঘর্ষে ৬৯ জন ব্রিটিশ, ৯২ জন ইহুদি ও ১৬২৪ জন আরব নিহত হয়। এদিকে ব্রিটিশ সরকার এ সংঘর্ষের কারণে পীল কমিশন কর্তৃক প্রস্তাবিত দেশবিভক্তি বাস্তবায়নকে সহজ করার জন্য ১৯৩৮ সালে উডহেড কমিশন গঠন করে। কিন্তু কমিশন প্রাথমিক তদন্তের পর দেশ বিভক্তির বিপক্ষে মত প্রকাশ করে। এজন্য তারা যে সকল কারণ ব্যাখ্যা করেন তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল- প্রস্তাবিত ইহুদি রাষ্ট্রকে নূন্যতম প্রয়োজনীয় এলাকা দিলেও বৃহৎ আরব সম্প্রদায় ও তাদের বৃহত্তম কমলা বাগানের অংশ তাতে পড়বে এবং প্রস্তাবিত আরব রাষ্ট্র অর্থনৈতিক দিক দিয়ে অত্যন্ত দুর্বল থাকবে। উডহেড কমিশনের প্রস্তাবে বলা হয়- দুটি এলাকা স্বায়ত্বশাসিত থাকবে এবং ম্যান্ডেটরী কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে দুটি এলাকার মধ্যে ঘনিষ্ঠ অর্থনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। এ সময়েও জমি কিনে অভিবাসনের সংখ্যা বাড়তে থাকে। ব্রিটিশ সরকার অভিবাসন সমস্যা নিরসনের জন্য কয়েকটি শ্বেত পত্র প্রকাশ করে। এসব শ্বেতপত্রের মাধ্যমে জমি কিনে অভিবাসনের ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রন আরোপ করার চেষ্টা করে। তথাপি ১৯৩২ সালের পর সবচেয়ে বেশী ইহুদি ফিলিস্তিনে আসে।
এ সকল ঘটনা প্রবাহের মধ্য দিয়েই ১৯৪৪ সালে আমেরিকা ও ব্রিটেনে নির্বাচন হয়। নির্বাচনে আমেরিকায় হ্যারি ট্রুম্যান ও ব্রিটেনে লেবার পার্টি বিজয়ী হয়। এতে ইহুদিরা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে যায়। ১৯৪৫ সালে মার্কিন কংগ্রেসের উভয় কক্ষে একটি প্রস্তাব এই মর্মে গৃহীত হয় যে, ফিলিস্তিনে ইহুদি আগমন ও একটি স্বাধীন ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে মার্কিন সরকারের উদ্যোগী হওয়া উচিত। এ ছাড়া বিভিন্ন অঙ্গ রাজ্যের গভর্ণর ও বড় বড় শহরের মেয়র , ব্যবসায়ী সম্পাদক ও ধর্মীয় নেতা বিবৃতি ও বক্তৃতার মাধ্যমে অবিলম্বে ফিলিস্তিনে ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবী করেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট পূর্ব ইউরোপের বিভিন্ন উদ্বাস্তু শিবিরে অবস্থানরত ইহুদিদের মধ্য হতে এক লক্ষ ইহুদি অনতিবিলম্বে ফিলিস্তিনে প্রবেশের ছাড়পত্র দেওয়ার জন্য ব্রিটিশ সরকারকে অনুরোধ করলে সমস্যা জটিল আকার ধারন করে। এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহনের জন্য ছয় জন ব্রিটিশ ও ছয়জন মার্কিন প্রতিনিধির সমন্বয়ে ১৯৪৫ সালে একটি যুক্ত কমিশন গঠন করে। কমিটির রিপোর্টে জমি ক্রয় বিক্রয়ে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার ও এক লক্ষ শরণার্থী প্রবেশের ব্যাপারে অনুমতি দেওয়ার জন্য সুপারিশ করা হয়। রিপোর্টের অন্যান্য দিক উপেক্ষো করে এ অংশ বাস্তবায়নের জন্য মার্কিন সরকার চাপ প্রয়োগ করতে থাকে । এতে ব্রিটিশ সরকার বিশেষত পররাষ্ট্র মন্ত্রী বেভিন ক্ষুব্দ হন। ফলে ব্রিটিশ সরকারের সাথে আমেরিকা ও জাইয়ানবাদীদের সম্পর্কের অবনতি ঘটে।
শ্রমিক দলীয় সরকারের দীর্ঘ সূত্রিতায় জাইয়ানবাদীরা অধৈর্য হয়ে পড়ে ও ইহুদিরা বিভিন্ন সন্ত্রাসবাদী তৎপরতা ব্যাপকভাবে শুরু করে। এদিকে ১৯৪৬ সালের ডিসেম্বর মাসে আন্তর্জাতিক জাইয়ানবাদী সম্মেলনে সমগ্র ফিলিস্তিনে একটি ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সমন্বিত প্রস্তাব গ্রহন করে। ১৯৪৭ সালে সন্ত্রাসবাদী তৎপরতা আরও বৃদ্ধি পায়। সন্ত্রাসবাদী দলগুলি অস্ত্রের মুখে ব্রিটিশ সরকারকে ফিলিস্তিনি ত্যাগ করাইতে বাধ্য করার নীতি গ্রহন করে। ব্রিটিশ মহিলা ও শিশুদের সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। সাথে সাথে ব্রিটিশ সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তাগন নিরাপত্তার জন্য কাটাতারের মধ্যে অবস্থান করতে থাকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সরকারের অসন্তুষ্টি এবং ফিলিস্তিনে আইন-শৃঙ্খলা বজায়া রাখতে ব্যর্থতার জন্য ব্রিটিশ সরকার বিষয়টি জাতিসংঘের নিকট উপস্থাপনের জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহন করে। ১৯৪৭ সালের ফেব্র“য়ারী মাসে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী বেভিন বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে জাতিসংঘের নিকট পেশ করে। এপ্রিল মাসে জাতিসংঘের সাধারন পরিষদের বিশেষ অধিবেশনে এ সমস্যা সমাধানের জন্য ফিলিন্তিনি সম্পর্কিত জাতিসংঘের বিশেষ কমিটি গঠিত হয়। ১১ সদস্যের কমিটির মধ্যে বৃহৎ শক্তিবর্গ অন্তর্ভূক্ত ছিলনা। কমিটি ফিলিস্তিনি পরিদর্শন করে ৩১ শে আগষ্ট রিপোর্ট পেশ করে। কানাডা , চেকোশ্লাভিয়া, গুয়াতেমালা, হল্যান্ড, পেরু, সুইডেন ও উরুগুয়ের প্রতিনিধিবৃন্দ ফিলিস্তিনকে একটি আরব ও একটি ইহুদি রাষ্ট্রে বিভক্ত করার পক্ষে মৃত্যু দেয়। তারা জেরুজালেম ও পার্শ¦বর্তী এলাকা আন্তর্জাাতিক নিয়ন্ত্রনে রাখার পক্ষে মত দেয়। অপরদিকে ভারত ইরান ও যগোশ্লাভিয়ার নেতৃবৃন্দ আরব ও ইহুদি এলাকার স্বায়ত্বশাসন সহ একটি ফেডারেল রাাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করে। জাইয়ানবাদীরা সংখ্যাগরিষ্ঠের প্রস্তাব গ্রহন করে এবং তা বাস্তবায়নে তৎপরতা চালায়। প্রস্তাবিত ইহুদি মালিকানাধীন অঞ্চল সমূহ ছাড়াও আরব অধ্যুষিত বীরশেবা ও পূর্ব গ্যালিলি জেলা অন্তর্ভূক্ত করা হয়।
আরবরা বিভিন্ন কারণে এ প্রস্তাবের বিরোধীতা করতে থাকে তাদের যেসকল যুক্তি ছিল তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল: প্রথমত: ফিলিস্তিনি আরব ভূমি এবং সেই ভূমিকে একটি বহিরাগত জনসমষ্টির রাজ্য স্থাপন করা ন্যায়-নীতি বিরোধি। দ্বিতীয়ত: ফিলিস্তিনে ইহুদি জনসংখ্যা হল মোট জনসংখ্যার ৩৩ ভাগ আর ৬৭ শতাংশ লোকের মতামত উপেক্ষা করে একটি দেশের ভবিষ্যৎ সিদ্ধান্ত গ্রহন গণতান্ত্রিক নীতি বিরোধি। তৃতীয়ত: একটি আন্তর্জাতিক সংগঠন হিসাবে জাতিসংঘের যে কোন প্রস্তাব সুপারিশ মাত্র; কোন দেশের উপর সেই প্রস্তাব চাপাইয়া দেওয়া জাতিসংঘ সনদের পরিপন্থি। আরবগন প্রধানত ন্যায়নীতির দৃষ্টিকোন থেকেই এই প্রস্তাবের সমালোচনা ও বিরোধীতা করছিল। কিন্তু আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ন্যায়নীতিকে দূরে রেখে গোষ্ঠীগত স্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়া হয় তা তাদের জানা ছিলনা। অবশেষে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাপক চাপের মুখে অনেক দেশ ফিলিস্তিনি বিভক্তি প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিতে বাধ্য হয়। ফলে ১৯৪৭ সালের ২৯ শে নভেম্বর প্রস্তাবটি সাধারণ পরিষদে পাশ হয়। ৩৩ টি দেশ বিভক্তির পক্ষে এবং ১৩ টি ভোট বিপক্ষে ও ১০ টি রাষ্ট্র ভোট দান থেকে বিরত থাকে।
আরব নেতৃবৃন্দের হুশিয়ারী সত্বেও বিভক্তি প্রস্তাব পাশ হওয়ার খবর ফিলিস্তিনে পৌছলে পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি ঘটে। আরব ও ফিলিস্তিনের স্বেচ্ছাসেবীরা ফিলিস্তিনে প্রবেশ করলে ব্যাপক সংঘর্ষ ছড়িয়ে পরে। ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে বিভক্তি বাস্তবায়নে ফিলিস্তিনে জাতিসংঘের অসি ব্যবস্থা প্রবর্তনের প্রস্তাব করে । কিন্তু ইহুদিরা এর বিরুদ্ধে হুশিয়ারী উচ্চারন করে। ইহুদিরা নিজেদের এলাকায় অবস্থান সুদৃঢ় করার জন্য ব্যাপক সামরিক তৎপরতা চালায়। এ সময় তারা বিভিন্ন আরব এলাকায় ব্যাপক হত্যাকান্ড চালায়। এমনি পরিস্থিতিতে ব্রিটিশরা সাম্রাজ্যবাদের নীতি অনুসারে কারো কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে ১৪ ই মে ফিলিস্তিন ত্যাগ করে। ফলে এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ঐদিনই ইহুদিরা ইসরাইল নামক স্বাধীন রাষ্ট্রের ঘোষনা করে। ডেভিড বেন গুরিয়ন ঐ সরকারের প্রধানমন্ত্রি এবং ড. ওয়াইজম্যান প্রেসিডেন্ট মনোনিত হন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান ১০ মিনিটের মধ্যে ঐ সরকারকে স্বীকৃতি দেন। অতপর সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ব্রিটেন স্বীকৃতি প্রদান করে।
ইহুদিদের রাষ্ট্র ঘোষণা এবং তার সাথে সাথে আরব অধিবাসীদের উপর নির্বিচারে হামলার ফলে চার লক্ষ বিতাড়িত ফিলিস্তিনি আরব রাষ্ট্রগুলিতে উপস্থিত হয়ে এক মানবিক সমস্যার সৃষ্টি করে। আরব রাষ্ট্র সমূহ ইহুদি রাষ্ট্র মেনে নিতে প্রস্তুত ছিলনা। ফলে ঐ রাষ্ট্রের জন্ম ঘোষণার দিনই সম্মিলিত আরব বাহিনী ফিলিস্তিনে প্রবেশ করে। কিন্তু কৌশলগত কারণে আরবরা যুদ্ধে পরাজিত হয়। এর পর মিশর ও ট্রান্স জর্ডানের সাথে শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর করতে বাধ্য হয়। এ যুদ্ধে পরাজয়ের ফলে জাইয়ানবাদীরা বিভক্তি পরিকল্পনায় তাদের জন্য যে পরিমাণ ভূখন্ডের প্রস্তাব করা হয় তার চেয়ে অনেক বেশী তারা দখল করে নেয়। আরবরা ভবিষ্যতে ইসরাইল রাষ্ট্র ধ্বংস করার পরিকল্পনা করতে থাকে কিন্তু পর পর চারবার যুদ্ধে পরাজিত হয়। ১৯৬৭ সালের আরব ইসরাইল যুদ্ধে লিবিয়া, লেবানন ও ফিলিস্তিন ভূ-খন্ডের অনেক জায়গা ইসরাইল জোড় করে দখল করে নেয়। এভাবেই বিশ্বের বুকে সর্বপ্রথম কোন বাইরের সংখ্যালঘিষ্ঠ সাম্প্রদায়িক শক্তির মাধ্যমে কোন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয় যার সম্পূর্ন প্রক্রিয়াটিই ছিল অবৈধ। আর এ ইউরোপ আমেরিকার জারজ সন্তান নামে খ্যাত দেশটিই দীর্ঘ ৬১ বছর যাবত মধ্যপ্রাচ্যে এক মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি করে রেখেছে। শান্তিকামী মানুষের পক্ষ থেকে শত প্রতিবাদ স্বত্বেও সাম্রাজ্যবাদের প্রতিভূ হিসাবে তারা তাদের এ অপতৎপরতা অব্যাহত রেখেছে।
বাহরাইন: আবারও উত্তাল হবার সম্ভাবনা
বাহরাইনে ‘আরব বসন্ত’ কে চরম ভাবে দমন করা হলেও বিরোধীরা এখন তাদের দাবিতে অনড়। কেননা তাদের মধ্যে দেড় বছর ধরে আলোচনা শুরুর প্রচেষ্টাও সফল হয়নি। ফলে দেশটি আবারও উত্তাল হতে পারে। বাহরাইনের স্বৈরসরকার বিরোধী চলমান গণআন্দোলনকারীদের প্রতি প্রথম দিকে তুরস্কের সমর্থন ছিল। কিন্তু বাহরাইনে পাশ্চাত্যের বিরাট স্বার্থ থাকায় তারা দেশটির বর্তমান সরকার ব্যবস্থায় যে কোনো পরিবর্তনের তীব্র বিরোধিতা করে আসছে। এ কারণে তুরস্ক সরকারও বাহরাইনের জনগণের ওপর নিরাপত্তা বাহিনীর অত্যাচার-নির্যাতনের ব্যাপারে নীরব রয়েছে এবং স্বৈরাচারী আলে খলিফা সরকারের প্রতি সমর্থন দিয়েছে।
মরক্কো: ইসলামপন্থী সরকার
মরক্কোর ২০১১ সালের পার্লামেন্ট নির্বাচনে আবদুল্লাহ বারকিরানের নেতৃত্বাধীন ইসলাম পন্থি ’ জাস্টিস এ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (পিজেডি) ১০৭ আসন পেয়ে সরকার গঠন করেছে।
সুদান: অঙ্গচ্ছেদে দুর্বলতা
সুদানের অঙ্গচ্ছেদ ঘটেছে। দেশটির দক্ষিণ অংশ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। পূর্ব ও পশ্চিমে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সাথে প্রকাশ্য যুদ্ধ চলছে। তেলসহ নানা কারণে বিভিন্ন গ্রুপ তাদেরকে সমর্থনও করছে। এসব কারণে বিশেষ করে নীলনদের পানিবণ্টনের বিষয়টি নিয়ে সুদান এখন মিসরের বোঝায় পরিণত হয়েছে। সুদানে ১৯৯২ সালে হাসান তুরাবীর নেতৃত্বে ন্যাশনাল ইসলামি ফ্রন্ট সামরিক জান্তা জেনারেল বশিরের অধীনে সরকারে যোগ দেয়। কিন্তু মতবিরোধ ও ক্ষমতার দ্বন্ধে শেষ পর্যন্ত ১৯৯৯ সালে জেনারেল বশির তুরাবীকে বহিষ্কার ও বন্দি করে।
লেবানন: অস্থিতিশীল এক জনপদ
লেবাননের প্রেসিডেন্ট ও পার্লামেন্ট নির্বাচন এখন আন্তর্জাতিক সমঝোতার বিষয়। লেবাননে প্রচণ্ড লড়াইয়ের পর হিজবুল্লাহ লেবাননি-সিরীয় সীমান্ত দিয়ে হোমসের পথে যাওয়ার রাস্তাটির নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করেছে। তারা দামেস্ক ও সিরীয় উপকূলের মধ্যকার আন্তর্জাতিক মহাসড়কটির নিয়ন্ত্রণও নিয়েছে। সিরিয়ায় হিজবুল্লাহর লড়াই করার কারণ এই ‘একমাত্র তারাই ইসলামি পতাকাতলে’ সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করছে। এই সংগঠনটিই সিরিয়ার লড়াইকে সরকারের অনুকূলে নিয়ে গেছে। আবার সিরিয়ার প্রতি তাদের সমর্থন দেয়ার কারণ হলো তাদের মতে ইসরাইল ১৯৭৮ থেকে ২০০০ পর্যন্ত লেবাননের যেসব ভূখণ্ড দখল করেছিল সেখান থেকে ইহুদি বাহিনীটিকে হটিয়ে দিতে দামেস্ক সহায়তা করেছে। তা ছাড়া ২০০৬ সালের গ্রীষ্মে ইসরাইলি যুদ্ধের কারণে বাস্তুহারা লাখ লাখ লেবাননিকে আশ্রয় দিয়েছিল সিরিয়া। ‘অপ্রতিরোধ্য’ শত্রুকে পর্যুদস্ত করতে প্রতিরোধ অব্যাহত রয়েছে। তারা শত্রুকে হারাতে সক্ষম হয়েছিল, তাদেরকে লেবাননের সব ভূখণ্ড থেকে সরে যেতে বাধ্য করেছিল। আট বছর আগে তারা এই সামরিক জয় হাসিল করেছিল।
লিবিয়া: অস্ত্রের ঝনঝনানি
এই দেশটির বিপর্যয় ভীতি সৃষ্টিকারী। রাষ্ট্রটি ভেঙে পড়েছে। মোয়াম্মার গাদ্দাফির সাথে রাষ্ট্রটিরও পতন ঘটেছে। লিবিয়ার সামরিক বাহিনী, তেল ও ভৌগোলিক সক্ষমতা এখন অনেকের হাতের পুতুল। এক সময়ে লিবিয়ার হাতে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি অস্ত্র ছিল। ওই অস্ত্র এখন যে কেউ ইচ্ছামতো হাতিয়ে নিতে পারে, দেশের বাইরেও পাঠাতে পারে। মিসর, পশ্চিম সাহারা, সুদান বা সিনাই- অনেক স্থানেই যায় এসব অস্ত্র। দেশটির অভ্যন্তরভাগেও অস্ত্রের ঝনঝনানি দেখা যায়। লিবিয়ার অস্ত্র তিউনিসিয়া ও আলজেরিয়াকে হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে। লিবিয়ার বিশৃঙ্খলায় দেশ দু’টির মধ্যে যুদ্ধাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
লিবিয়ায় স্বৈরশাসক গাদ্দাফির পতনের পর সেখানে ইসলাম পন্থী ’জাস্টিস এ্যান্ড কনস্ট্রাকশন পাটি’ ’১২ সালের নির্বাচনে ১০.২৭% ভোট ও ১৭টি আসন পেয়ে দ্বিতীয় স্থান দখল করে। ২০১১ সালের মে মাস পর্যন্ত তুরস্ক লিবিয়ায় সংঘর্ষরত সরকার ও বিরোধী পক্ষের মধ্যে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালনের চেষ্টা করে এবং এ কারণে লিবিয়া ইস্যুতে তুরস্ক সেসময় তার অবস্থান স্পষ্ট করেনি। কিন্তু এরপর থেকে তুরস্ক গাদ্দাফিকে সব সমস্যার জন্য দায়ী করতে থাকে এবং তার পদত্যাগের দাবি জানায়। এমন কি গাদ্দাফিকে ক্ষমতা থেকে হঠানোর জন্য পাশ্চাত্যের সামরিক আগ্রাসনের সময়ও তুরস্ক ন্যাটো বাহিনীকে সহযোগিতা করে। উত্তর আফ্রিকায় গণআন্দোলন শুরর পর থেকে পাশ্চাত্য এসব বিপ্লবকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করছে, আর এ ব্যাপারে তুরস্কের দৃষ্টিভঙ্গীও পাশ্চাত্যের স্বার্থের অনুকূলে।
ইয়েমেন: সঙ্ঘাতে জর্জরিত
ইয়েমেনে ইসলামি দল আল ইসলাহ ২০০৩ সালের নির্বাচনে ২২.৬% ভোট ও ৪৬ টি আসন পেয়ে বিরোধী দলে পরিণত হয়েছে। ইয়েমেনে কেন্দ্রীয় সরকারের হাত ভেঙে দিতে যুদ্ধ চলছে। কৃত্রিমভাবে সৃষ্ট রাষ্ট্রটি যতটুকু হবে বলে মনে করা হয়েছিল তারচেয়েও দুর্বল। কেন্দ্রীয় সরকার এখন উপজাতীয় ও সাম্প্রদায়িক সঙ্ঘাতে জর্জরিত। প্রথমে সৌদি আরব এবং তারপর ইরানসহ অন্যান্য দেশের রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের এসব সঙ্ঘাত রাষ্ট্রটিকে আরো দুর্বল করে দিয়েছে।
সৌদি আরব: অন্তর্বর্তীকালীন অবস্থা
সৌদি আরব এখন অন্তর্বর্তীকালীন অবস্থা অতিক্রম করছে। দেশটিতে সরকারি পদগুলোতে এমন প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন ঘটছে, যার ফলে দেশটির প্রতিষ্ঠাতা আবদুল আজিজ আল সৌদের বংশধরদের মধ্যেই ক্ষমতার ভারসাম্যে পরিবর্তন ঘটে যেতে পারে। দেশটিতে সুদাইরিদের (সৌদ পরিবারের সাত আপন ভাইয়ের মধ্যকার জোট) প্রভাব কমছে। সুদাইরিরা দেশটিকে নিজেদের মধ্যে ভাগ করে পরিচালনা করে আসছিল, যেমন: বাদশাহ হিসেবে ফাহাদ, প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে সুলতান, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে নায়েফ, রাজধানী রিয়াদের গভর্নর হিসেবে সালমান, তেলসমৃদ্ধ পূর্বাঞ্চলের আমির হিসেবে নাওয়াফ প্রমুখ।
কাতার: ভঙ্গুর আরব অবস্থান থেকে দূরে
কাতার উপসাগরীয় এলাকার বাইরেই রয়ে গেছে। তারা ভঙ্গুর আরব অবস্থান থেকে দূরেই থাকতে চাইছে। মুসলিম ব্রাদারহুডের আন্তর্জাতিক সংস্থা কিংবা সংগঠনটির ‘সর্বোচ্চ নেতা’ শেখ ইউসুফ কারজাভির মাধ্যমে কাতার দলটির সাথে তার সম্পর্ক আরো জোরদার করেছে।
আলজেরিয়া: গৃহযুদ্ধে জর্জরিত
আলজেরিয়ায় ’৯০এর দশকে নির্বাচনের প্রম রাউন্ডে ’এফআইএস’ অভূতপূর্ব বিজয় লাভ করলে দ্বিতীয় রাউন্ডে নির্বাচনই হতে দেয়নি সামরিক বাহিনী। দেশে দীর্ঘদিন চলেছে গৃহযুদ্ধ। যাই হোক, সর্বশেষ পার্লামেন্ট নির্বাচনে শত বাধা বিপত্তি সত্ত্বেও ইসলাম পন্থী তিনটি দলের জোট ’গ্রীন এলায়েন্স ১৫.৬% ভোট পেয়ে ৬০টি আসন লাভ করেছে। সেখানকার আরেক ইসলামি দল ’জাস্টিস এ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি ’ পেয়েছে ৩.০৫% ভাগ ভোট ও ৮টি আসন।
ইরাক: স্বার্থের সঙ্ঘাত
সাম্প্রদায়িক ও বর্ণবাদের ভিত্তিতে রাষ্ট্রটি কয়েকটি খণ্ডে বিভক্ত হওয়ার হুমকির মুখে রয়েছে। সুবিধাভোগী বিভিন্ন গ্রুপের মধ্যকার স্বার্থের সঙ্ঘাতের মাধ্যমে নির্ধারিত হবে সেখানে কয়টি রাষ্ট্র হবে। সাদ্দাম হোসেনকে উৎখাতে ২০০৩ সালে ইরাকে অভিযান শুরু করে মার্কিন নেতৃত্বাধীন বাহিনী। আট বছরের মাথায় ইরাক থেকে সব মার্কিন সেনা প্রত্যাহার করা হয়।মাত্র ৫,০০০ বিদেশি মদদপুষ্ট সন্ত্রাসী একদল ইরাকি সেনা কর্মকর্তার সহায়তায় প্রায় ৬০,০০০ ইরাকি সরকারি সেনার কোনো বাধার সম্মুখীন না হয়েই মোসুল ও তিকরিত শহর দখল করতে সক্ষম হয়। সন্ত্রাসীদের কাছে ছিল প্রায় ১,০০০ গাড়ি এবং এইসব গাড়িতে ইরাকি নাম্বার প্লেট ছিল না। প্রধানমন্ত্রী নুরি আল-মালিকি বিনা যুদ্ধে পালিয়ে যাওয়া ইরাকি সেনা কর্মকর্তাদের বিচার করা হবে বলে ঘোষণা করেছেন। আর এইসব সেনা কর্মকর্তার অনেকেই দূরবর্তী নিরাপদ অঞ্চলে আশ্রয় নিয়ে বা আত্মগোপনে থেকে কথিত পরাজয়ের ব্যাপারে নানা সাফাই বা অপব্যাখ্যা দিচ্ছেন।ইরাকি সেনা কর্মকর্তাদের অনেকেই বিশ্বাসঘাতকতা করে সন্ত্রাসীদের কাছে অস্ত্রের গুদাম, ব্যাংক ও কারাগারগুলো ছেড়ে দিয়েছেন বলেও জানা গেছে। অবশ্য এইসব সন্ত্রাসী কুর্দি সুন্নি মুসলমান অধ্যুষিত অঞ্চলে ব্যাপক বাধার মুখে খুব একটা সফল হতে পারে নি। এর আগে সন্ত্রাসীরা ইরাকের শিয়া অধ্যুষিত অঞ্চলেও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে।
ইরাকের উত্তরাংশ কুর্দিস্তান একটি ‘অঞ্চল’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। সেখানে একটি রাষ্ট্র নির্মাণকাজ সম্পূর্ণ করার প্রয়াস চলছে। তবে সেটা বাগদাদের কেন্দ্রীয় সরকারের নেতৃত্বে এবং ‘কনফেডারেল’ শাসনের ছদ্মাবরণে। নূরি আল-মালিকির স্বৈরতন্ত্র এবং ইরাকের শিয়া-সুন্নি বিরোধকে কাজে লাগিয়ে সেখানকার কুর্দি নেতৃত্ব স্বাধীন ‘রাষ্ট্র’ প্রতিষ্ঠার হুমকি দিয়ে যাচ্ছে। শিয়া-সুন্নি বিরোধ রাজনৈতিক বিতর্কের চেয়েও অনেক বেশি গভীর। এই ‘মহা ফিৎনা’ সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে মেসোপটেমিয়া ভূমিকে বিভক্ত করার অজুহাত হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। আরব, কুর্দি এবং অন্যান্য সংখ্যালঘু গোষ্ঠীতে বিভক্ত হওয়ার মূল সূত্র সেখানেই নিহিত।অদূর ভবিষ্যতে স্থিতিশীল এবং অপশক্তিকে মোকাবেলা করার মতো শক্তিশালী দৃঢ় রাষ্ট্র হিসেবে ইরাককে পুনর্গঠন করা সত্যিই কঠিন কাজ। সাদ্দাম হোসেনের কবল থেকে উদ্ধারের লক্ষ্যে ইরাকে মার্কিন দখলদারিত্বের সবচেয়ে কুৎসিত ‘ফল’ হলো এটিই। ইরাকে সংকট অত্যন্ত জটিল। শীয়া সুন্নি দ্বন্ধ ও কুর্দি সমস্যা প্রকট। ব্রাদারহুড সুন্নিদের মধ্যে অত্যন্ত সক্রিয়। অন্যদিকে শীয়াদের মধ্যে আয়াতুল্লাহ বাকের আল সদর প্রতিষ্ঠিত দাওয়া আন্দোলনেরও তৎপরতা লক্ষণীয়।
জর্দান: আসলে কতটা সুরক্ষিত?
জর্দান দেশটি আমেরিকান-পাশ্চাত্য-ইসরাইলি সমর্থনে সুরক্ষিত। দেশটি তেলসমৃদ্ধ রাষ্ট্রগুলোর (সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও কাতার) কাছ থেকেও সমর্থন পাচ্ছে। অথচ সিরিয়ার বিরুদ্ধে সরাসরি লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়ছে না। সিরিয়া যুদ্ধে জর্দান উভয় পক্ষেই ‘সেবা’ দিয়ে চলেছে। জর্দানে ইখওয়ান প্রশাসনের সাথে মোটামুটি সহনশীলতা বজায় রেখে সেখানকার রাজনীতি ও নির্বাচনে ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে।
সিরিয়ায় সংঘাত: রক্তাক্ত অভিজ্ঞতা
সিরিয়া ২৩ আগস্ট ১৫১৬ অটেম্যান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। ১সেপ্টেম্বর ১৯১৮ অটোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর সিরিয়া ফ্রান্সের ঔপনিবেশিক শাসনাধীনে চলে যায়। ১৮এপ্রিল ১৯৪৬ ফ্রান্সের উপনিবেশ থেকে সিরিয়া স্বাধীনতা লাভ করে। ২২ফেব্রুয়ারি ১৯৫৮ দেশটি সংযুক্ত আরব রিপাবলিক-এর অন্তর্ভুক্ত হয়। এরপর সিরিয়া ২৮ সেপ্টেম্বর ১৯৬১ সংযুক্ত আরব রিপাবলিক থেকে পৃথক রাষ্ট্র গঠন করে। ৮ মার্চ ১৯৬৩ সাল থেকে বার্থ পার্টি ক্ষমতা দখল করে সিরিয়ার শাসনভার গ্রহণ করে। ২১ নভেম্বর ১৯৭০ বাশার আল আসাদের পিতা তৎকালিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী হাফিজ আল আসাদ ক্ষমতায় আসেন। ১৯৭১ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতা গ্রহণ করে তিনি একাধারে ৩০বছর রাষ্ট্র ক্ষমতায় ছিলেন। ফ্রান্স থেকে স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনার পর থেকে রাজনৈতিক গতিধারায় স্মরণযোগ্য নিকট অতীত হলো সিরিয়ার প্রয়াত রাষ্ট্রপতি হাফিজ আল-আসাদ পাঁচ বার গনভোটে বিজয়ের মাধ্যমে নিজের কর্তৃত্ব বজায় রেখে শাসন করে গেছেন। বাবার স্বাভাবিক মৃত্যুর পর এক গনভোটে সিরিয়ার রাষ্ট্রপতি পদে বহাল হন বাশার আল আসাদ। ১৭ জুলাই ২০০০ তার ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই সিরিয়ায় সামরিক স্বৈরতন্ত্রের সরকার চলে আসছে। সর্বশেষ ২০০৭ সালে গণভোটে বাশার আল আসাদ নির্বাচিত হন।
সিরিয়া এশিয়ার মধ্যপ্রাচ্যের একটি রাষ্ট্র। ৭১,৪৭৯ হাজার বর্গমাইলের ভূমিতে দুই কোটি ত্রিশ লক্ষ লোকের বাস। সিরিয়ায় মুসলিমদের মধ্যে ৭০% সুন্নি এবং ১৮% শিয়া আর ১০% কুর্দীর বসবাস। সীমান্ত লাগোয়া রাষ্ট্রগুলি হলো- ইসরাইল, লেবানন, জর্ডান, ইরাক ও তুরস্ক আর একদিকে ভুমধ্যসাগর। মধ্যপ্রাচ্যের মানচিত্রে সিরিয়ার অবস্থান ঠিক মাঝখানে। তার চারপাশে আছে ইরাক, তুরস্ক, লেবানন, ইসরাইল, ফিলিস্তিন, জর্ডন, মিশর, সউদি আরব, আর ইরান। এই অঞ্চলের গত দেড় হাজার বছরের উত্থান-পতনের ইতিহাসেও সিরিয়ার অবস্থান একেবারে কেন্দ্রস্থলে। তাই সিরিয়ায় কি হচ্ছে তার প্রভাব প্রতিবেশীদের ওপর পড়বেই – এটা প্রায় অবধারিত। সিরিয়া সংকটকে কেন্দ্র করে ইতিমধ্যেই মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো দু'শিবিরে ভাগ হয়ে গেছে। এই বিভক্তির একটা কারণ নিশ্চয়ই মধ্যপ্রাচ্যের দীর্ঘদিনের পুরোনো শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ্ব, তবে এটা একমাত্র কারণ নয়। অন্য আরো অনেকগুলো কারণ আছে যার হিসেব বেশ জটিল।
আরব বিপ্লবের ঢেউ এসে আঘাত হানে ১৫মার্চ ২০১১। সিরিয়ায় চলছে স্বৈরশাসক বাশারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। যুদ্ধরত গ্রুপগুলোর মধ্যে মুসলিম ব্রাদারহুড সমর্থিত গোষ্ঠি অন্যতম। ২০১২ সালরে ১৯ জুলাই সরিয়িার বৃহত্তম ও বাণজ্যিকি রাজধানী আলপ্পেো শহরে প্রসেডিন্টে বাশার আল আসাদ বাহনিীর সাথে সাধারণ জনগণরে লড়াই শুরু হয়। বিদ্রোহীরা আলেপ্পোর যুদ্ধের নাম দিয়েছে ‘দ্য মাদার অব অল ব্যাটল’। ২১ আগস্ট ২০১৩ সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কের উপকন্ঠে ঘৌতা এলাকায় রাসায়নিক অস্ত্রের হামলায় প্রায় ১৪০০ মানুষ নিহত হয়, যার মধ্যে নারী ও শিশু ছিল। সিরিয়ায় চলা অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সংকট এবং গৃহযুদ্ধ আন্তর্জাতিক সীমান্ত পেরিয়ে আঞ্চলিক সামরিক সংঘাতে পরিণত হতে যাচ্ছে। তুরস্কে সিরিয়ার মর্টার হামলার পর তুরস্কের বিমান বাহিনীর অভিযান এবং তুরস্কের পার্লামেন্ট কর্তৃক সামরিক বাহিনীকে এ ধরণের পাল্টা অভিযান বিষয়ে অনুমোদন দেবার পর এটি বেশ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সিরিয়ার সংকট আন্তর্জাতিক সীমান্ত অতিক্রম করেছে এবং একটি আঞ্চলিক সংকটের বিষয়ে পরিণত হয়েছে। লক্ষাধিক মানুষ মারা গেছে। সিরিয়ার অভ্যন্তরেই বাস্তুচ্যুত হয়েছে ২০লাখেরও বেশি মানুষ। এর বাইরে আরো ৪২ লাখ ৫০হাজার সিরীয় মানবিক সহায়তার জন্য উন্মুখ। ২লক্ষাধিক মানুষ দেশত্যাগে বাধ্য হয়েছেন। ইউএনএইচসিআরের তালিকায় শরণার্থী হিসেবে নাম লিখিয়েছেন বা লেখানোর জন্য অপেক্ষমান অনেকে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সিরীয় আশ্রয় নিয়েছেন তুরস্কে। তা ছাড়া লেবানন, জর্ডান এবং ইরাকের কুর্দি অধ্যুষিত এলাকায়ও গেছেন হাজার হাজার মানুষ।
সিটি ইউনিভার্সিটি লন্ডনের মিডলইস্ট স্টাডিজের অধ্যাপক রোজমেরি হলিস বলছেন, "প্রেসিডেন্ট আসাদের পক্ষে-বিপক্ষে যে বিভক্তি তার একটা কারণ শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ্ব। সুন্নিদের মধ্যে যারা বেশি গোঁড়া - যেমন সালাফিরা - এবং যারা উগ্রপন্থী, তারা আলাওয়াইটদের মনে করে শিয়া। তাদের চোখে তারা কার্যত অমুসলিম। এর পর আছে শিয়া ইরানের ভুমিকা, এবং শিয়া-সুন্নি বিভেদের আড়ালে আরব আর ইরানিদের প্রাচীন শত্রুতা।"সৌদি আরব এতটা সিরিয়ার প্রতি প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়েছে যে ২০১২ইং বছরে সিরিয়ার কোন নাগরিককে হজ্ব পালন করতে দেয়নি।সিরিয়ার সাধারন জনতার প্রশ্নঃ “কোন মুসলমানের হজ্বের অধিকার কেড়ে নেয়ার বৈধতা নিশ্চই আল্লাহ সৌদি সরকারকে দেয়নি”।
মিশরে সেনাশাসন: সিসি নতুন ফারাও
মিসরকে নীল নদের দান বলা হয়। সেই নীল নদ রক্তে রঞ্জিত হয়েছে। মিসরের বর্ণাঢ্য ইতিহাস প্রায় পাঁচ হাজার বছরের পুরনো। মিসর ছিল বাইজাইন্টাইন বা পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যের অংশ।৬৪২ সালে এটি প্রথম আলেক্সান্দ্রিয়া মুসলিম শাসনের অর্ন্তভুক্ত হয়। ১৮৪১ সালে ব্রিটিশরা মিসর আক্রমণ করে এবং সে দেশের শাসক মোহাম্মদ আলীকে মাত্র ১৮,০০০ সৈন্যের প্রতিরক্ষাবাহিনী রাখার চুক্তি করতে বাধ্য করে।১৮৮১ সালে ব্রিটিশরা মিসর দখল করে নেয়। ১৯২২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি ব্রিটিশরা মিসরের স্বাধীনতা ঘোষণা করে। ১৯২৩ সাল থেকে নতুন সংবিধান রচিত হলে দেশটিতে সাংবিধানিক রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯০৭ সালে মোস্তফা কামালের নেতৃত্বে মিসরের প্রথম রাজনৈতিক দল দি ন্যাশনাল পার্টি গঠিত হয়।১৯২৩-১৯৫২ সালের মধ্যে মিসরে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে উন্নত গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির একটা শুভ সূচনা হয়। ১৯৫২সালে সামরিক অভ্যুত্থানের পর একদলীয় শাসন চালু হয়। ১৯৫৩সালের ১৮জুন মুহাম্মদ নাগীব মিসরকে প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করেন। ১৯৫৪ সালের ১৪ নভেম্বর ক্ষমতা গ্রহণ করে জামাল আবদেল নাসের। তার মৃত্যুর পর ১৯৭০সালের ২৮ সেপ্টেম্বর আণোয়ার সা’দাত মিসরের প্রেসিডেন্ট হন। ১৯৮১ সালের ৬ অক্টোবর সা’দাতকে হত্যা করা হলে বিমানবাহিনীর কর্মকর্তা হোসনি মোবারক মিসরের রাষ্ট্রপতি হন। হোসনি মোবারক ১৯৮১ সাল থেকে ৩০ বছরের বেশি স্বৈরশাসন চালিয়ে অবশেষে বিশ্বকাঁপানো এক গণ অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ২০১১ সালের ১১ই ফেব্রুয়ারি ক্ষমতাচ্যুত হন।
মিসরবাসী স্বৈরশাসনের কবল থেকে মুক্ত হওয়ার প্রায় এক বছর পর অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন মোহাম্মদ মুরসি ঈসা আল আয়াত। ২০১১ সালে মিশরের মুসলিম ব্রাদারহুডের রাজনিৈতক শাখা এফজেপি আর্থ-সামাজিক এজেন্ডাকে প্রাধান্য দিয়ে এককভাবে নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ট আসন লাভ করে। সালাফি সংগঠনের রাজনিৈতক শাখা আল নুর পার্টিও ধর্মীয় এজেন্ডার চেয়ে আর্থ- সামাজিক এজেন্ডাকে প্রাধান্য দিয়ে পালামেন্টে দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ট দলে পরিণত হয়। উভয় দল মিলে দুই-তৃতীয়াংশের বেশী আসন দখল করে নেয় কিন্তু সাংবিধানিক কারন দেখিয়ে আদালত নির্বাচন বাতিল করে দেয়। ২৩ ও ২৪ মে ২০১২ অনুষ্ঠিত প্রথম নির্বাচনে কোনো প্রার্থী ৫০ শতাংশের বেশি ভোট না পাওয়ায় দ্বিতীয় দফায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৬ও১৭জুন ২০১২। এই নির্বাচনে এফজেপির (ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস পার্টি) ড.মুরসি ৫১.৭% ভোট পেয়ে বিজয়ী হন। মিসরের পাঁচ হাজার বছরের ইতিহাসে প্রথম অবাধ ও গণতান্ত্রিক নির্বাচনে নির্বাচিত ইসলামপন্থী প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসি ক্ষমতায় আসেন ২০১২ সালের ৩০শে জুন। মুরসি দুরদৃষ্টিসম্পন্ন পদক্ষেপে সর্বোচ্চ পর্যায়ের সফর বিনিময়ের মাধ্যমে মার্কিন প্রতিদ্বন্ধী রাশিয়া ও চীনের সাথে ঘনিষ্ট সম্পর্ক স্থাপন করে ফেলে। ৫২ শতাংশ ভোটারের ভোটে যে দল ক্ষমতায় এসেছিল সেই দলকে তার পূর্ণ মেয়াদ পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকতে দেয়া হল না। সেনাদের রোষানলে পড়ায় এক বছরের মাথায় ৩জুলাই ২০১৩ সামরিক জান্তা ক্যু করে মুরসি সরকারকে উৎখাত করে।
সেনাপ্রধান জেনারেল আবদুল ফাত্তাহ আল সিসি ঘোষণা দেন, মুরসি এখন মিশরের কোন নেতা নন। তিনি দেশের জনগণের চাহিদা মেটাতে ব্যর্থ হয়েছেন। অন্তর্বতী সরকারের প্রেসিডেন্ট হিসেবে নাম ঘোষণা করা হয় মিশরের সুপ্রিম কনস্টিটিউশনাল কোর্টের প্রধান বিচারপতি আদলি মানসুরের। যথারীতি তাকে শপথ পড়ানো হয়। এর মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে নতুন সরকারের যাত্রা হয় মিশরে।অন্তর্বতী সরকার একটি নতুন সংবিধান রচনার জন্য আরব লীগের সাবেক মহাসচিব আমর মুসার সভাপতিত্বে ৫০ সদস্যের একটি প্যানেল গঠন করে।৩০ নভেম্বর ও ১ডিসেম্বর ২০১৩ প্যানেলের ভোটাভোটিতে একটি খসড়া সংবিধান চূড়ান্ত হয়। খসড়া সংবিধান বিষয়ে ১৪ ও ১৫ জানুয়ারি ২০১৪ গণভোট অনুষ্ঠিত হয়।
২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৩ মিসরের কায়রো কোর্ট ফর আর্জেন্ট ম্যাটার্স মুসলিম ব্রাদারহুডের সব কর্মকান্ড নিষিদ্ধ করেন। একই সাথে ইসলামপন্থী সংগঠনটির সব সম্পদ জব্দ করারও আদেশ দেয়া হয়। মুসলিম ব্রাদারহুডের সাথে সংশ্লিষ্ট বা এর অধীন যে কোনো প্রতিষ্ঠান বা সংস্থাকে নিষিদ্ধ করেন আদালত। ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৩ দেশটির সেনা সমর্থিত সরকার মুসলিম ব্রাদারহুডকে নিষিদ্ধ করে দেয়া আদালতের রায় স্থগিত করে। মিসরে গণ বিক্ষোভের ওপর বিধি নিষেধ আরোপ করে নতুন একটি আইন চালু করা হয়। এ আইনের আওতায় পুলিশের পূর্বানুমতি ছাড়া কেউ বিক্ষোভ করতে পারবে না। আইনটিতে ১৪ নভেম্বর ২০১৩ সই করেন প্রেসিডেন্ট আদলি মনসুর।
২৬-২৮মে ২০১৪ মিসরে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ৩জুন ২০১৪ নির্বাচন কমিশন দেশটির প্রেসিডেন্ট হিসেবে সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ আল সিসিকে আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচিত ঘোষণা করে। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সিসি’র একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন বামপন্থী প্রার্থী হামাদিন সাবাহি। ১৭জুন ২০১৪ প্রধানমন্ত্রী ইব্রাহিম মাহলাবের নেতৃত্বে মিসরের ৩৪ সদস্যের নতুন মন্ত্রীসভা শপথ গ্রহণ করে।
উপসংহার:
১৯৯০ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর Huntington এর Clash of civilization তত্ত্ব অনুযায়ী মুসলিম সভ্যতাই আগামী দিনে আমেরিকান সভ্যতার জন্য চ্যালেঞ্জ হতে পারে । এটি যেমন মুসলিম জনগোষ্ঠীকে অহংকারী করে অন্যদিকে এক অনিবার্য সংঘর্ষকে তাদের দৃশ্যপটে আবির্ভূত করে। ৯/১১ এর টুইন টাওয়ারে হামলার পর পাশ্চাত্যে Islam phobia নামে মুসলিম ভিতি বৃদ্ধি পাচ্ছে। পাশ্চাত্যের চোখে সকল মুসলিমই এখন Terrorist তাই ইঙ্গমার্কিন শক্তির ``War on Terror" কর্মসূচিকে অনেক মুসলিম বুদ্ধিজীবি ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ বলে মনে করেন। অন্যদিকে আফগানিস্তানও ইরাকে অবৈধ অনুপ্রবেশ ,গুয়ান্তানামোবে বন্দি নির্যাতন, ইসরাঈলের ধ্বংসাত্মক কার্যক্রমে সমর্থন দান এবং সাম্প্রতিক সময়ে তালেবান দমনের নামে পাকিস্তানের সার্বভৌমত্ব নিয়ে ছিনিমিনি খেলাকে বিশ্বের ১৫০ কোটি মুুসলিম জনগোষ্ঠী সুনজরে দেখছে না। যুদ্ধ ও রক্ত নয়; আমরা শান্তি চাই। মানুষের লাশ দেখতে চাইনা। সে আরব নাকি অনারব, মুসলিম নাকি হিন্দু, খ্রিস্টান নাকি ইহুদি সেটা বড় কথা নয়। এক্ষেত্রে জাতিসংঘের দায়িত্ব আছে, ওআইসির দায়িত্ব আছে, আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলোর দায়িত্ব আছে। বিশ্ব মানবতা শান্তি চায়, মুক্তি চায়।
তথ্যসূত্র:
১.আধুনিক মধ্যপ্রাচ্য, ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা: ৩৬৬-৪০০ , সফিউদ্দিন জোয়ারদার ২.Genesis, page – 12 , 157 3. Rome and Jernsalam , Hess , Translate by M.W. Waxmar ৪.Judenstaat,, হারজ্জেল ৫.S.N. Eiestadt , Ssraia Society p-11 ৬.জাইয়ানবাদী কার্যকরী সংসদকে লিখিত কালভাস্কির পত্র, জাইয়ানিষ্ট আর্কাইভস ৭.Nisi Dominous , p- 97, Nevil Barbous 8.Charchils speech , Government of Palestine: A Survey of Palestine. 9.The Idea of the Jewish State, Ben Halpern 10. American Zionism and US Foreign Policy , Richard P. Stevens 11. Mohammad Mohsin, Bangladesh and the Muslim World, Bangladesh & world (suppliment), The daily star, 2006. 29.M. Mohsin, Ibid 12. বাংলাদেশ- মুসলিম বিশ্ব সম্পর্ক : অতীত বর্তমান ভবিষ্যৎ, কে এম নিশাত জামান 13. উত্তপ্ত মধ্যপ্রাচ্য: সূচনা যেভাবে, খাদেমুল ইসলাম ১৪.রেডিও তেহরান ১৫. বিবিসি বাংলা, ল্ন্ডন ১৬. ফিলিস্তিন ও জায়নবাদবিরোধী লড়াই ,ফরহাদ মজহার ১৭.আঞ্চলিক সংঘাতের পথে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ?, অধ্যাপক আলী রীয়াজ ১৮. মিশরের গণতন্ত্র ও ষড়যন্ত্র: মধ্যপ্রাচ্য ও আন্তর্জাতিক বিশ্ব, সানাউল হক ১৯. সিরিয়া ও তার প্রতিবেশীরা, পুলক গুপ্ত ২০. ইরান-তুরস্ক সংকটে বন্দি চীনের মধ্যপ্রাচ্য নীতি , তানিম ইশতিয়াক ২১. ষড়যন্ত্রের বেড়াজালে সিরিয়া ( ৩য় পর্ব) , এম আর মিলন ২২. সিরিয়ায় ভন্ড মুসলিম শাসকদের সন্ত্রাসী উম্মাদনা, জেড এ বাবুল পাঠান ২৩. প্রফেসর’স কারেন্ট অ্যাফেয়ার্সের কয়েকটি সংখ্যা ২৪. বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকার কয়েকটি সংখ্যা
©somewhere in net ltd.
১| ১৮ ই জুলাই, ২০১৪ দুপুর ১২:১০
আলম 1 বলেছেন: নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ীরা ফিলিস্তিন / ইস্রায়েল মধ্যে শান্তির জন কিছু একটা করেন প্লিজ