নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় তৈল বাবাজী যোগ্যতার মাপকাঠি। যে বসকে তৈল দিতে পারে সে খুব সহজে বসের আস্থা ও বিশ্বাস অর্জন করে। যে বেশি পরিশ্রম করে তাঁর খাটুনি বসের চোখে মোটেই গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হয় না যদি না বসকে তৈল দিয়ে তৃপ্ত না করতে পারেন। বাঙালির মনোযোগ কাজের চেয়ে অকাজে, উৎপাদনশীল কাজের চেয়ে যে অনুৎপাদনশীল কাজে বেশি; তারই প্রমাণ তৈল বিদ্যার ব্যাপক ডিমান্ড ও সাপ্লাই। আপনার সার্টিফিকেট আছে কি নেই, অভিজ্ঞতা আছে কি নেই,কাজের কোয়ালিটি আছে কি নেই; তার চেয়ে বড় কথা হলো আপনার তৈল বিদ্যায় পারদর্শিতা আছে কি-না? তৈল বিদ্যা মানে তৈল বাবাজী না থাকলে কোনো বিদ্যায় কাজে আসবে না আর তৈল বিদ্যা থাকলে অন্য সকল কিছুর অবর্তমানেও আপনি ওপরের মানুষদের হাসিয়ে নিজেও আনন্দের হাসি হাসতে পারবেন।
তৈলের ন্যায় মূল্যবান যেনো আর কিছু নয়। তৈল আদান-প্রদান কোনো খারাপ কিছু নয়। কেউ তৈল দিতে পেরে আনন্দিত হয়, আর কেউ তৈল খেয়ে গর্ব অনুভব করেন। আপনি দেখতে কত সুন্দর, জ্ঞানে কত অগ্রগামী, কাজে কত দক্ষ, কত সময় সচেতন, কর্মে কত দায়িত্বশীল তা’ মোটেই প্রমোশনের ক্ষেত্রে বিবেচিত হবে না; বিবেচিত হবে বসকে তৈল প্রদানের ক্ষেত্রে আপনি কতটা পারদর্শিতা অর্জন করেছেন। তৈল এতটাই শক্তিশালী যে ক্রোধান্বিত মালিকের মুখেও হাসি ফোটায়, অহংকারী মনও মোমের মতো গলে যায়, দাপুটে ব্যক্তিত্বও শিশুর মত সহজ-সরল হয়ে ওঠে। তৈল প্রদানে দক্ষতা অর্জন মানে মনে ঘৃণা রেখেও প্রশংসা করতে পারা, দ্বিমত থাকলেও হাসিমুখে মেনে নিয়ে বিপরীত মতকে সাধুবাদ জানাতে পারা, উর্ধ্বতনের সন্তোষ অর্জনে দ্বিধাহীন চিত্তে মিথ্যাকে সত্য এবং সত্যকে মিথ্যা বলা, নিজের ব্যক্তিত্ব-আবেগ-অনুভূতিকে বিসর্জন দিয়ে কোনো ভাবনা-চিন্তা ছাড়াই বসের মত-নির্দেশনাকে সঠিক-যথার্থ-স্বার্থক বলে নিজের মতামত প্রকাশ করতে পারা।
তৈল দিতে পারলে আপনি অধীনস্তদের শ্রদ্ধা অর্জন করতে পারবেন, উর্ধ্বতনদের স্নেহও হাসিল করতে পারবেন। এমন কোনো ক্ষেত্র নেই, যে ক্ষেত্রে তৈলের ভূমিকা মুখ্য নয়। রাজনীতিতে আপনি যতই জোরালো কণ্ঠের অধিকারী হোন, সুদর্শন-স্মার্ট হোন নেতাকে যথাযথভাবে তৈল দিতে অক্ষম হলে বড় দায়িত্ব পাবেন না। আপনি কর্মজীবী হলে যতই ত্যাগী-আন্তরিক হোন না কেনো, বসকে তাঁর কাঙ্ক্ষিত পন্থায় তৈল দিতে না পারলে মিলবে না প্রমোশন-বাড়বে না বেতন। তৈলেই শান্তি, তৈলেই মুক্তি। যে তৈল অস্ত্রের সঠিক ব্যবহার জানে ওপর মহলকে খুশি করে স্বার্থ হাসিল তাঁর জন্য সহজ হয়। আপনি পরিশ্রম করলে ঘাম ঝরবে, নিষ্ঠাবান-নিবেদিত প্রাণ হয়ে দায়িত্ব-কর্তব্য পালনে সময় ব্যয় করলে নিজের মতো করে জীবনটাকে উপভোগ করার স্বাধীনতা কমবে। কিন্তু তৈল যতই প্রয়োগ করবেন ততই বাড়বে, পারস্পরিক তৈল চালাচালিতে হাসিখুশি পরিবেশ নিশ্চিত হবে। কর্মব্যস্ত হয়ে যদি তৈলের গতিপ্রবাহের সাথে তাল মিলানোর ফুরসত না মিলে তবে নিশ্চিতভাবেই আপনি একটি নিশ্চিত ভরসা হারাবেন। যে তৈল পছন্দ করে সে তৈল না পেলেই ছটফট করবে, ঠিক ডাঙ্গায় তোলা মাছের মতো।
বাস্তবিকই তৈল যেভাবে শক্তিকে ধারণ করে সেভাবে যে তা উত্তম ব্যবহার করতে পারে সে অনেকের তুলনায় শক্তিশালী হয়ে ওঠে। যে তৈলের জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন সে সহজে চাকরি পাবে না, চাকরি পেলেও তা টিকে থাকবে না, টিকে থাকলেও বসের মনোরঞ্জন না হওয়ায় প্রত্যাশিত অর্জন হবে না। তৈলের বিভিন্ন রুপ রয়েছে। কখনো উপহারে, কখনো প্রশংসায়, কখনো অন্যায়-অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত-আচরণকে দ্বিধাহীনচিত্তে সমর্থন করার মাধ্যমে প্রকাশ পায়। তৈলের রাজ্যে রাজত্ব করতে ব্যক্তিত্বহীন হবার প্রয়োজন পরে, স্বকীয়তার বিসর্জন দেয়ার দরকার হয়। তবে তৈল দিতে পারলে অপেক্ষার দরকার পরে না, হতাশা-হাহাকার থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। তেলের ব্যবহার সর্বত্রই হতে পারে; তা’ পরিবারে কিংবা সমাজে কিংবা অফিসে-আদালতে। যে তৈল দিতে পারবে তার বংশ-সম্পদ না থাকলেও নেতা হতে পারবে, বিদ্যা ছাড়াই অধ্যাপক হতে পারবে, বোকা হলেও সফল হতে পারবে, সাহস না থাকলেও সামনে থাকতে পারে, বুদ্ধিহীন হলেও বিজয়ী হতে পারবে।
তৈল দিলে তৈল মিলে। তাই তৈল দেয়া-নেয়া চর্চার মাধ্যমে এক তৈলাক্ত জগৎ উন্মোচিত হয়। যেখানে কেউ তৈল উৎপাদনকারী, কেউ গ্রহণকারী, কেউ নিরবে দর্শনকারী। তৈল কারো উপকার করে আবার কারো ক্ষতিও করে। অনেকে তৈল দেয় তৈল বাহির করার জন্যই। আফসোস তাঁদের জন্য যারা আশেপাশে তৈলের ব্যাপক কার্যকারিতা দেখেও নিজেকে উন্নত-মহৎ-ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন-রুচিশীল হিসেবে স্বাতন্ত্রতা ধরে রাখতে নিজেকে বাঁচিয়ে চলেন। নিরব দর্শকরা কাউকে তৈলের কূপে ভাসতে দেখে, কাউকে তৈলের নদীতে সাঁতার কাটতে দেখে, কাউকে তৈলের সাগরের উত্তাল তরঙ্গমালায় মিশে থাকতে দেখে অনেক সময় পুলকিত হন। তবে তাঁদের শান্তনা এখানেই যে, তৈল তাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করে না যেমনিভাবে তৈলপ্রিয়দের করে। তৈলপ্রিয়রা যেমনিভাবে তৈলের সঙ্গে মিলে-মিশে চলায় অভ্যস্ততার কারণে তৈলের নি:স্বরণ বন্ধ হলেই অস্বাভাবিক আচরণ শুরু করে, স্বাদহীন জীবন পায়; তেমনিভাবে তৈল দিতে কিংবা নিতে অক্ষমদের অস্বাভাবিক জীবন-যাপনের আশঙ্কা থাকে না।
©somewhere in net ltd.