![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
হোসনে আরা মণির জীবনের পেয়ালায় ছোট্ট চুমুক ঃ স্বাদ ও শৈলী
--মিনতি কুমার রায়
অধ্যাপক ও প্রাবন্ধিক
একবিংশ শতাব্দীর মানুষ অষ্টবক্র মানসিকতার সদ্য ভাজ-ভাঙ্গা পোষাকে কেতাদুরস্ত। ‘মানুষের উপর বিশ্বাস হারানো পাপ’Ñ এ আপ্তবাক্য আজ শতধা প্রশ্নবিদ্ধ। আমরা এখন মানসলোকে নানাবিধ অসঙ্গতি ও বিকৃতির কালিমায় অভিশপ্ত। যদিও সমগ্র মানবিক বিশ্বে এর বিপরীতধর্মী সৌন্দর্যলোকও দুর্লক্ষ্য নয়। এ রকম বিসদৃশ্য ভাবনা নিয়েই আমাদের শিল্পজগৎ বিচিত্র বৈদগ্ধ্যের মানসলোকে সমর্পিত। অতএব শিল্প মাত্রেই এ দ্বিমাত্রিক পথরেখায় বিচরণশীল। হোসনে আরা মণি এ রকম একটা পথের গর্বিত তেজদীপ্ত পথচারী।
মণির প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘অপরাজিতা’ এবং দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ ‘জীবনের পেয়ালায় ছোট্ট চুমুক’ গ্রন্থে মানুষের খন্ডিত জীবনকে নিয়ে গেছেন একটা বিশেষ বক্তব্যে, কোনো ঘটনা অথবা কোনো মানসিকতাকে ঐক্য-সংকটের মধ্য দিয়ে সমগ্রতার পথে। জীবনের বিষামৃতের স্বাদ, মনের দুটি কথা নয়-- কেবল একটি মাত্র কথা যার প্রতি বিন্দুতে অতলান্ত গভীরতা এবং অখন্ড পূর্ণ জীবনের ছায়ারূপ সেই জীবনেরই রূপায়ণ ছোটগল্প।
জীবনের পেয়ালায় ছোট্ট চুমুক দশটি গল্পের সমষ্টির একটি গ্রন্থ। প্রথম গল্প একটি সহজ শব্দ। গল্পটির নামকরণের মধ্যেই বিশেষভাবে ব্যঞ্জিত হয়েছে এর মূল বক্তব্য। পুরুষশাসিত সমাজে নারীরা যে তথাকথিত সামাজিক বন্ধনের দ্বারা শৃঙ্খলিত তারই একটি বেদনাসিক্ত চিত্র অঙ্কিত হয়েছে এ গল্পে। গল্পের তেজোদ্দীপ্ত নায়িকা সামিয়ার অতীত জীবন সর্পদ্রষ্ট মানুষের মতই যন্ত্রণাক্লিষ্ট। তারপরও জীবনযুদ্ধে সে পরাজিত ক্ষয়িষ্ণু নয়। বর্তমানে সে একটি সরকারি লাইব্রেরির লাইব্রেরিয়ান। সেই লাইব্রেরিতেই আজ একটি লোকাল এনজিও আয়োজিত ‘জেন্ডার সচেতনতা ও নারী শীর্ষক সেমিনার এবং সেখানে প্রধান অতিথি জেলা প্রশাসক। তাই সে লাঞ্চব্রেকে একটা কাজ সেরে জরুরী ভিত্তিতে রিক্সায় চড়ে কর্মস্থলে ফিরছিল। কিন্তু তার অন্যমনষ্কতার দরুণ কখন যেন বুকের ওড়নাটা হঠাৎ জড়িয়ে আটকে যায়। রিক্সা থামিয়ে তার ওড়নাটা যখন বের করা হল তখন দেখা গেল সেটা ছিন্ন ও শত দাগে পূর্ণ যা গায়ে জড়ানোর অযোগ্য। তাই রিক্সাঅলার গামছাটা বুকে জড়িয়ে সামিয়া কর্মস্থলে প্রবেশ করতে উদ্যত হয়। আব্রু বাঁচানোর এই চেষ্টা তার আজন্ম লালিত সংস্কার ও সামাজিক রীতিকে মান্য করে চলার মনোভাবেরই বহিঃপ্রকাশ। কিন্তু কর্মস্থলের ক্যাম্পাসে প্রবেশের পর কয়েকজন প্রান্তিক নারীর দৃষ্টিতে নিজের হাস্যকর দেখে তার সম্বিৎ ফেরে। আধুনিক বাঙ্গালী নারীরা যে নিছক একটা লোকাচারের প্রতি সম্মান জানিয়ে বুকে ওড়না ধারণ করে এ বোধের পরই আসে মোক্ষম উপলব্ধিঃ ‘ইস্ নারী! কত অকারণ বোঝাই না তুমি বয়ে বেড়াও আর কতভাবেই না নিজের ভেতরটাকে তুমি শৃঙ্খলিত করে রাখ। মুক্তি! সে কি এত সহজ শব্দ!’ এরপর এই অযৌক্তিক লোকাচারের প্রতি তার চূড়ান্ত চ্যালেঞ্জঃ ‘একটানে বুক থেকে গামছাটা খুলে ছুঁড়ে ফেলে সামিয়া এগিয়ে যায়।’ এভাবেই সামিয়া তার ভেতরকার হৃদয়বোধ ও সংস্কারবোধের দ্বন্দ্বযুদ্ধের মধ্য থেকে শেষপর্যন্ত হৃদয়বোধকেই জয়ী করে তোলে। সামিয়া মুক্তি পায় লোকাচার থেকে, মুক্তি পায় তার নারীমননের গভীরে প্রোথিত পুরুষশাসিত শৃঙ্খল থেকে।
নিস্তব্ধ নিক্কণ গল্পের আখ্যানভাগে একদিকে নারীদেহসম্ভোগ, অন্যদিকে শ্রমিক ও মেহনতি মানুষের শোষণ ও বঞ্চনার রেখাচিত্র পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন গল্পকার। গল্পটির প্রথম তিন-চার পৃষ্ঠাব্যাপী কেবল নায়ক রহমালীর ব্যাক্তিগত জীবনে শুন্যতাবোধসহ কোয়েলাকে কেন্দ্র করে তার নারীদেহ লোলুপতা ও প্রজননলিপ্সু মানসিকতাই আবর্তিত হতে দেখি। কিন্তু এ গল্পের মোড়টি নাটকীয়ভাবে বাঁক নেয় যখন কোয়েলাদের পোশাক কারখানার ভবনটি আকস্মিকভাবে ধ্বসে পড়ে। এ গল্পের রহমালী চরিত্রটির অনুভবের বদল ঘটে ঠিক এখানেই। ভবনটি ধ্বসে পড়ার শব্দে রহমালী ছুটে গিয়ে যে নারকীয় দৃশ্য দেখতে পায় তা তার ভাবনার জগতে মানবিকতাবোধের সংযোগ ঘটায়। ধ্বংসস্তুপের গণকবরের ভীড়ে যেসব হতভাগারা তখনো বেঁচে ছিল তাদেরকে উদ্ধারের করুণ চিত্র দেখে রহমালী প্রথম মানুষের সীমাহীন লোভ-লালসা সম্পর্কে সচেতন হয়- ‘পৃথিবীর কান্নাটা যেন হঠাৎই উপলব্ধি করে রহমালী, করে সে চমকে ওঠে। তাইতো! অতি লোভের ফলেইতো আজ এসব ঘটছে।’
সুদীপ্তা গল্পটি ব্যর্থ প্রেমের অভিশপ্ত কাহিনী। গল্পটি ব্যর্থ প্রেমকাহিনী হিসেবে শৈল্পিক ঐশ্বর্যে প্রদীপ্ত না হলেও পাঠককে চমকিত করে।
সোহেলির ঘর-সংসার একটি সামাজিক সমস্যাকেন্দ্রিক গল্প। সোহেলির শ্বশুর আজীবন চেয়ারম্যান হওয়ার স্বার্থে প্রথম জীবনে অসৎ উপার্জনে অর্জিত বিপুল সম্পদের পাহাড়ে চড়ে বর্তমানে হয়েছেন এমনই কট্টর ধার্মিক যে তার পরিবারে টেলিভিশন দেখা নিষিদ্ধ, গান গাওয়া-শোনাও বারণ। এতে করে সোহেলি ও তার মেয়েদের জন্য রুদ্ধ হয়েছে মুক্ত চেতনার সবগুলো দুয়ার। হোসনে আরা মণির এ গল্পের ভেতর দিয়ে নারীর প্রতি সমাজের অবদমন-মানসিকতার চিত্র ও স্বার্থবাদী গোষ্ঠীর মনোভাব অত্যন্ত সুন্দরভাবে উদ্ভাসিত হয়েছে। এসব দিক বিবেচনায় সোহেলির ঘর-সংসার একটি সার্থক সামাজিক ছোটগল্প।
পরপর সন্নিবেশিত চারটি গল্পÑ ভুল বুঝবেননা প্লিজ, ভাটি দিনের মধুমতি, ঘাতক প্রেমিকের জবানবন্দি ও পিঞ্জিরে বন্দি মূলতঃ প্রেমকেন্দ্রিক গল্প। এরমধ্যে ভুল বুঝবেননা প্লিজ ও ঘাতক প্রেমিকের জবানবন্দি নিতান্তই উত্তরাধুনিককালে ব্যক্তিজীবনে সম্পর্ক- সঙ্কটের খন্ডচিত্র। বাকি দুটো গল্প গ্রামীণ পটভূমিতে রচিত, কিন্তু এখানেও প্রধান হয়ে উঠেছে সম্পর্কের দ্বন্দ্ব। তবে ভাটিদিনের মধুমতি গল্পে জীবনের লালসা ও অর্থলোলুপতার সাথে যে জীবনদাবী, জীবনদর্শন ও জীবনোপলব্ধি উঠে এসেছে তা যেমন পরিবেশনগুনে অনন্য তেমনি তাতে সমাজের বিশেষতঃ নারীজীবনের নানামুখী সমস্যা ও অসহায়তার চিত্র অঙ্কিত হয়েছে। গল্পের কেন্দ্রিয় চরিত্র হাসিনা যখন বলে, ভালবাসার মানুষেরে জোর করি বাঁধতে নেই, যদিনা সে নিজেই বাঁধনে জড়াতে আগায়ে আসে, তখন এক প্রায়অশিক্ষিত, পোড়খাওয়া গ্রাম্য রমনীর মুখের এই শাশ্বত সত্য কথাটি পাঠককে বিস্ময়ে বিমূঢ় করে। গল্পের একবারে শেষেÑ ‘জীবনে এইপ্রথম আমি হাসিনার হাত ধরলাম। তারপর বললাম, বাড়ি চল হাসিনা। রাত হয়ে এল যে।’ আমরা পাঠক তখন জীবন নামের মহাসমুদ্রের দিকে তাকিয়ে যেন বিস্ময়ে নির্বাক হয়ে যাই, শুধুই শিল্পাস্পন্দনে স্পন্দিত হই, হৃদয়ের অতলদেশে কোন অজানা আবেগের অনুরণনে অনুরণিত হই। গল্পটি বেদনা ও আনন্দ রসে, বিষ ও অমৃতে যেন পূর্ণকুম্ভু। অন্যদিকে পিঞ্জিরে বন্দি গল্পটি কাহিনী নির্মানে, ঘটনা সংস্থাপনে এবং চরিত্র সৃষ্টির দক্ষতায় এবং পরিসমাপ্তির ব্যঞ্জনাময়তায় একটি সার্থক ছোটগল্প হিসেবে পাঠককে মুগ্ধ করে।
এ গ্রন্থের শেষ দুটি গল্প পাগলের হাসিকান্না ও বেলা শেষের আহা। এর মধ্যে পাগলের হাসিকান্না গল্পটি এদেশে অতি নিকট অতীতে সংঘটিত সংঘাতময় রাজনৈতিক টানাপোড়েনের সাথে কুসংস্কারের মিশ্রণে উদ্ভূত ঘটনাপ্রবাহের ইঙ্গিত বহন করছে। আর বেলা শেষের আহা গল্পটি গল্পকারের বাস্তব চেতনা ও অভিজ্ঞতাপ্রসূত সৃষ্টিকর্ম বলে মনে হয়। তাই এ গল্পের কেন্দ্রিয় দুটি চরিত্রই দারুণ সজীব, প্রাণবন্ত। ছোটগল্পের ব্যঞ্জনা সায়মা ও খালাম্মা চরিত্র দুটির মাধ্যমে শৈল্পিক কলাকৌশলে রূপায়িত। গল্পের আখ্যান বর্ণনা ও কাহিনীবিন্যাস আকর্ষণীয়। মোটের উপর এটি সার্থক ছোটগল্পের চমৎকার দৃষ্টান্ত।
জীবনের পেয়ালায় ছোট্ট চুমুক গল্পগ্রন্থে অধিকাংশ গল্পই শিল্পীর আত্মসংহত জীবনপ্রত্যয় থেকে উৎসারিত। এই প্রত্যয়ের সত্যকে নিজ বোধের দ্বারা জীবনের যেকোন মুহূর্তের গভীরে ডুব দিয়ে গল্পকার তুলে ধরতে পারেন জীবনবোধের বিচিত্র আস্বাদÑ হোসনে আরা মণি এ গল্পগ্রন্থে তাই করেছেন। মণির শিল্প-আত্মা বস্তুরূপের মধ্য দিয়ে বস্তুস্বরূপের চৈতন্যলোকের অভিসারী। সুতরাং গল্পে বস্তুঘনত্ব থাকলেও গল্পগুলি মানবিক সংবেদ সৃষ্টির বেলায় গতিময় হয়ে উঠেছে।
©somewhere in net ltd.
১|
২৩ শে অক্টোবর, ২০১৪ রাত ৮:০৫
হাসান মাহবুব বলেছেন: শুভকামনা।