নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আকাশ ছুঁইনি,কিন্তু আকাশের মাঝে তো মেঘ হয়ে ভেসে আছি...

একুয়া রেজিয়া

একুয়া রেজিয়া

আকাশ তো ছুঁইনি,কিন্তু আকাশের মাঝে তো মেঘ হয়ে ভেসে আছি...বেঁচে আছি,দিব্যি জেগে আছি। রোদ কে আমায় ভেদ করে স্পর্শ করতে দিছি...এই তো আমি....এই তো জীবন...আর বাঁচার সেকি আনন্দ...

একুয়া রেজিয়া › বিস্তারিত পোস্টঃ

কবিতা ও জীবন- প্রেম অথবা কাব্য

৩১ শে মার্চ, ২০১৪ সন্ধ্যা ৭:২৫



ছেলেবেলা থেকেই কবিতার সাথে আমার বড় আপন সম্পর্ক। মন বিষাদ্গ্রস্থ হলে কিংবা মন খুব ভালো থাকলেই বাংলা কবিতার অসাধারণ ভুবন ঘুরে বেড়াই। ছোট্ট কিছু শব্দ, বিচ্ছিন্ন কিছু লাইন অথচ মনের মধ্যে কেমন যেন আলোড়ন তোলে!



"কুড়ি বছর পরে সেই কুয়াশায় পাই যদি হঠাৎ তোমারে !" লাইনটুকু পড়লে মাঝে মাঝে আবেগে দীর্ঘ নিঃশ্বাস আসে। নয়টা-ছয়টা অফিস, বাস্তবতা, আটপৌড়ে জীবনের গ্যাঁড়াকলে আটকে থাকা মন প্রায়শই বড্ড হাঁপিয়ে ওঠে। প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিতে চায়, চিৎকার করে গান গাইতে চায়, অজানা অচেনা কোন কবিতার ভীষণ সুন্দর লাইন আউড়ে নিমিষেই ফুরফুরে হয়ে যেতে চায়। এই চাওয়া-পাওয়ার হিসেব মেলে না। অল ডেবিট নো ক্রেডি্ট।



গল্প, কবিতা, উপন্যাস, গানের সুরে খুঁজে পাওয়া আবেগ হাতড়ে বেরাই। ভাবি, কাল থেকে ঠিক অন্যরকম করে জীবনকে দেখবো। কাল থেকে আর পার্থিব কিছু নিয়ে মগ্ন হবো না। সেই 'কাল' আর আসে না। তবুও যখন কবিতা পড়ি, মন শান্ত হয়ে যায়, বুঁদ হয়ে যায় অজানা কোন এক পৃথিবীতে। তাই---



ব্যস্ত জীবনে প্রাণের স্পর্শ এনে দেওয়া প্রিয় কবিতারা আজ গুছিয়ে নিলাম নিজের এলেবেলে খাতায়।







মনে থাকবে?

____আরণ্যক বসু



পরের জন্মে বয়স যখন ষোলোই সঠিক

আমরা তখন প্রেমে পড়বো

মনে থাকবে?





বুকের মধ্যে মস্ত বড় ছাদ থাকবে

শীতলপাটি বিছিয়ে দেব;

সন্ধে হলে বসবো দু'জন।

একটা দুটো খসবে তারা

হঠাৎ তোমার চোখের পাতায় তারার চোখের জল গড়াবে,

কান্ত কবির গান গাইবে

তখন আমি চুপটি ক'রে দু'চোখ ভ'রে থাকবো চেয়ে...

মনে থাকবে?



এই জন্মের দূরত্বটা পরের জন্মে চুকিয়ে দেব

এই জন্মের চুলের গন্ধ পরের জন্মে থাকে যেন

এই জন্মের মাতাল চাওয়া পরের জন্মে থাকে যেন

মনে থাকবে?



আমি হবো উড়নচন্ডি

এবং খানিক উস্কোখুস্কো

এই জন্মের পারিপাট্য সবার আগে ঘুচিয়ে দেব

তুমি কাঁদলে গভীর সুখে

এক নিমেষে সবটুকু জল শুষে নেব

মনে থাকবে?





পরের জন্মে কবি হবো

তোমায় নিয়ে হাজারখানেক গান বাঁধবো।

তোমার অমন ওষ্ঠ নিয়ে,

নাকছাবি আর নূপুর নিয়ে

গান বানিয়ে__

মেলায় মেলায় বাউল হয়ে ঘুরে বেড়াবো...

মনে থাকবে?



আর যা কিছু হই বা না হই

পরের জন্মে তিতাস হবো

দোল মঞ্চের আবীর হবো

শিউলিতলার দুর্বো হবো

শরৎকালের আকাশ দেখার__

অনন্তনীল সকাল হবো;

এসব কিছু হই বা না হই

তোমার প্রথম পুরুষ হবো

মনে থাকবে?





পরের জন্মে তুমিও হবে

নীল পাহাড়ের পাগলা-ঝোরা

গায়ের পোষাক ছুড়ে ফেলে

তৃপ্ত আমার অবগাহন।

সারা শরীর ভ'রে তোমার হীরকচূর্ণ ভালোবাসা।

তোমার জলধারা আমার অহংকারকে ছিনিয়ে নিল।

আমার অনেক কথা ছিল

এ জন্মে তা যায়না বলা

বুকে অনেক শব্দ ছিল__

সাজিয়ে গুছিয়ে তবুও ঠিক

কাব্য করে বলা গেল না!

এ জন্ম তো কেটেই গেল অসম্ভবের অসঙ্গতে

পরের জন্মে মানুষ হবো

তোমার ভালোবাসা পেলে

মানুষ হবোই মিলিয়ে নিও!









শুধু তোমার জন্য

____নির্মলেন্দু গুণ





কতবার যে আমি তোমোকে স্পর্শ করতে গিয়ে

গুটিয়ে নিয়েছি হাত-সে কথা ঈশ্বর জানেন।

তোমাকে ভালোবাসার কথা বলতে গিয়েও

কতবার যে আমি সে কথা বলিনি

সে কথা আমার ঈশ্বর জানেন।



তোমার হাতের মৃদু কড়ানাড়ার শব্দ শুনে জেগে উঠবার জন্য

দরোজার সঙ্গে চুম্বকের মতো আমি গেঁথে রেখেছিলাম

আমার কর্ণযুগল; তুমি এসে আমাকে ডেকে বলবেঃ

‘এই ওঠো,

আমি, আ…মি…।‘

আর অমি এ-কী শুনলাম

এমত উল্লাসে নিজেকে নিক্ষেপ করবো তোমার উদ্দেশ্যে

কতবার যে এরকম একটি দৃশ্যের কথা আমি মনে মনে

কল্পনা করেছি, সে-কথা আমার ঈশ্বর জানেন।

আমার চুল পেকেছে তোমার জন্য,

আমার গায়ে জ্বর এসেছে তোমার জন্য,

আমার ঈশ্বর জানেন- আমার মৃত্যু হবে তোমার জন্য।

তারপর অনেকদিন পর একদিন তুমিও জানবে,

আমি জন্মেছিলাম তোমার জন্য। শুধু তোমার জন্য।







তুলনামূলক হাত

_____নির্মলেন্দু গুণ



তুমি যেখানেই স্পর্শ রাখো সেখানেই আমার শরীর৷

তোমার চুলের ধোয়া জল তুমি যেখানেই

খোঁপা ভেঙ্গে বিলাও মাটিকে;



আমি এসে পাতি হাত, জলভারে নতদেহ আর

চোখের সামগ্রী নিয়ে ফিরি ঘরে, অথবা ফিরি না ঘরে,

তোমার চতুর্দিকে শূন্যতাকে ভরে থেকে যাই৷



তুমি যেখানেই হাত রাখো, যেখানেই কান থেকে

খুলে রাখো দুল, কন্ঠ থেকে খুলে রাখো হার,

সেখানেই শরীর আমার হয়ে ওঠে রক্তজবা ফুল৷



তুমি যেখানেই ঠোঁট রাখো সেখানেই আমার চুম্বন

তোমার শরীর থেকে প্রবল অযত্নে ঝরে যায়৷

আমি পোকা হয়ে পিচুটির মতো

তোমার ঐ চোখের ছায়ায় প্রতিদিন খেলা করে যাই,

ভালোবেসে নিজেকে কাঁদাই৷



তুমি শাড়ির আঁচল দিয়ে আমাকে তাড়িয়ে দিলে

আমি রথ রেখে পথে এসে তোমারই দ্বৈরথে বসে থাকি

তোমার আশায়৷ তুমি যেখানেই হাত রাখো

আমার উদগ্রীব চিত্র থাকে সেখানেই৷ আমি যেখানেই

হাত পাতি সেখানেই অসীম শূন্যতা, তুমি নেই৷







এবারই প্রথম তুমি

_____নির্মলেন্দু গুণ



ভুলে যাও তুমি পূর্বেও ছিলে

মনে করো এই বিশ্ব নিখিলে

এবারই প্রথম তুমি।



এর আগে তুমি কোথাও ছিলে না

ছিলে না আকাশে, নদী জলে ঘাসে

ছিলে না পাথরে ঝর্ণার পাশে।

এবারই প্রথম তুমি।



এর আগে তুমি কিছুতে ছিলে না।

ফুলেও ছিলে না, ফলেও ছিলে না

নাকে মুখে চোখে চুলেও ছিলে না।

এবারই প্রথম তুমি।



এর আগে তুমি এখানে ছিলে না

এর আগে তুমি সেখানে ছিলে না

এর আগে তুমি কোথাও ছিলে না।

এবারই প্রথম তুমি।



রাতের পুণ্য লগনে ছিলে না

নীল নবঘন গগনে ছিলে না।

এবারই প্রথম তুমি।



এর আগে তুমি তুমিও ছিলে না।

এবারই প্রথম তুমি।







প্রেম বোলে তো

____জয় গোস্বামী



এইখানে এসে প্রেম শেষ হল। শরীর মরেছে।

তোমার হাত ধরে আমি দাঁড়িয়েছি বৃষ্টির ভিতরে

গাছ থেকে জল পড়ছে, বৃষ্টিছাট ছুটে আসছে গা-য়,

"ভিজে যাবে' -তুমি বলছ, "সরে এসো ছাতার তলায়'

আমাদের একটাই ছাতা। তাতে দুজনেরই চলে যায়।



আরও কালো করে এল, গাছে ডানা ঝাপটায়।

দুজনে দাঁড়িয়ে আছি। দুজনে দাঁড়িয়ে থাকব। যতদিন পাশে থাকা যায়।







মালতীবালা বালিকা বিদ্যালয়

_____জয় গোস্বামী



বেণীমাধব, বেণীমাধব, তোমার বাড়ি যাবো

বেণীমাধব, তুমি কি আর আমার কথা ভাবো?

বেণীমাধব, মোহনবাঁশি তমাল তরুমূলে

বাজিয়েছিলে, আমি তখন মালতী ইস্কুলে

ডেস্কে বসে অঙ্ক করি, ছোট্টো ক্লাসঘর

বাইরে দিদিমণির পাশে দিদিমণির বর

আমি তখন নবম শ্রেণী, আমি তখন শাড়ি

আলাপ হলো, বেণীমাধব, সুলেখাদের বাড়ি



বেণীমাধব, বেণীমাধব, লেখাপড়ায় ভালো

শহর থেকে বেড়াতে এলে, আমার রঙ কালো

তোমায় দেখে এক দৌড়ে পালিয়ে গেছি ঘরে

বেণীমাধব, আমার বাবা দোকানে কাজ করে

কুঞ্জে অলি গুঞ্জে তবু, ফুটেছে মঞ্জরী

সন্ধেবেলা পড়তে বসে অঙ্কে ভুল করি

আমি তখন নবম শ্রেণী, আমি তখন ষোলো

ব্রীজের ধারে, বেণীমাধব, লুকিয়ে দেখা হোলো



বেণীমাধব, বেণীমাধব, এতোদিনের পরে

সত্যি বলো, সেসব কথা এখনো মনে পড়ে?

সেসব কথা বলেছো তুমি তোমার প্রেমিকাকে?

আমি কেবল একটি দিন তোমার পাশে তাকে

দেখেছিলাম আলোর নিচেঃ অপূর্ব সে আলো!

স্বীকার করি, দুজনকেই মানিয়েছিলো ভালো

জুড়িয়ে দিলো চোখ আমার, পুড়িয়ে দিলো চোখ

বাড়িতে এসে বলেছিলাম, ওদের ভালো হোক!



রাতে এখন ঘুমোতে যাই একতলার ঘরে

মেঝের উপর বিছানা পাতা, জ্যোৎস্না এসে পড়ে

আমার পরে যে-বোন ছিলো চোরাপথের বাঁকে

মিলিয়ে গেছে, জানি না আজ কার সঙ্গে থাকে

আজ জুটেছে, কাল কী হবে?–কালের ঘরে শনি

আমি এখন এই পাড়ার সেলাই দিদিমণি

তবু আগুন, বেণীমাধব, আগুন জ্বলে কই?

কেমন হবে, আমিও যদি নষ্ট মেয়ে হই?







সাঁকো

____জয় গোস্বামী



একটি বিচ্ছেদ থেকে পরের বিচ্ছেদে

যেতে যেতে

কয়েকদিন মাত্র মাঝখানে পাতা আছে মিলনের সাঁকো



মেঘ করে আসবেই। পথ ঝাপসা হবেই বৃষ্টিতে

পা পিছলে তলিয়ে যাবে, তার আগে যতক্ষণ পারো

আঙুলে আঙুলে আঁকড়ে রাখো।



হৃদি ভেসে যায় অলকানন্দা জলে

___জয় গোস্বামী



অতল, তোমার সাক্ষাৎ পেয়ে চিনতে পারিনি বলে

হৃদি ভেসে গেল অলকানন্দা জলে



করো আনন্দ আয়োজন করে পড়ো

লিপি চিত্রিত লিপি আঁকাবাঁকা পাহাড়ের সানুতলে

যে একা ঘুরছে, তাকে খুঁজে বার করো



করেছো, অতল; করেছিলে; পড়ে হাত থেকে লিপিখানি

ভেসে যাচ্ছিল–ভেসে তো যেতই, মনে না করিয়ে দিলে;

–’পড়ে রইল যে!’ পড়েই থাকত–সে-লেখা তুলবে বলে



কবি ডুবে মরে, কবি ভেসে যায় অলকানন্দা জলে।।







পাগলী, তোমার সঙ্গে

______জয় গোস্বামী



পাগলী, তোমার সঙ্গে ভয়াবহ জীবন কাটাব

পাগলী, তোমার সঙ্গে ধুলোবালি কাটাব জীবন

এর চোখে ধাঁধা করব, ওর জল করে দেব কাদা

পাগলী, তোমার সঙ্গে ঢেউ খেলতে যাব দু’কদম।



অশান্তি চরমে তুলব, কাকচিল বসবে না বাড়িতে

তুমি ছুঁড়বে থালা বাটি, আমি ভাঙব কাঁচের বাসন

পাগলী, তোমার সঙ্গে বঙ্গভঙ্গ জীবন কাটাব

পাগলী, তোমার সঙ্গে ৪২ কাটাব জীবন।



মেঘে মেঘে বেলা বাড়বে, ধনে পুত্রে লক্ষ্মী লোকসান

লোকাসান পুষিয়ে তুমি রাঁধবে মায়া প্রপন্ঞ্চ ব্যন্জ্ঞন

পাগলী, তোমার সঙ্গে দশকর্ম জীবন কাটাব

পাগলী, তোমার সঙ্গে দিবানিদ্রা কাটাব জীবন।



পাগলী, তোমার সঙ্গে ঝোলভাত জীবন কাটাব

পাগলী, তোমার সঙ্গে মাংসরুটি কাটাব জীবন

পাগলী, তোমার সঙ্গে নিরক্ষর জীবন কাটাব

পাগলী, তোমার সঙ্গে চার অক্ষর কাটাব জীবন।



পাগলী, তোমার সঙ্গে বই দেখব প্যারামাউন্ট হলে

মাঝে মাঝে মুখ বদলে একাডেমি রবীন্দ্রসদন

পাগলী, তোমার সঙ্গে নাইট্যশালা জীবন কাটাব

পাগলী, তোমার সঙ্গে কলাকেন্দ্র কাটাব জীবন।



পাগলী, তোমার সঙ্গে বাবুঘাট জীবন কাটাব

পাগলী, তোমার সঙ্গে দেশপ্রিয় কাটাব জীবন

পাগলী, তোমার সঙ্গে সদা সত্য জীবন কাটাব

পাগলী, তোমার সঙ্গে ‘কী মিথ্যুক’ কাটাব জীবন।



এক হাতে উপায় করব, দুহাতে উড়িয়ে দেবে তুমি

রেস খেলব জুয়া ধরব ধারে কাটাব সহস্র রকম

লটারি, তোমার সঙ্গে ধনলক্ষ্মী জীবন কাটাব

লটারি, তোমার সঙ্গে মেঘধন কাটাব জীবন।



দেখতে দেখতে পুজো আসবে, দুনিয়া চিত্‍কার করবে সেল

দোকানে দোকানে খুঁজব রূপসাগরে অরূপরতন

পাগলী, তোমার সঙ্গে পুজোসংখ্যা জীবন কাটাব

পাগলী, তোমার সঙ্গে রিডাকশনে কাটাব জীবন।



পাগলী, তোমার সঙ্গে কাঁচা প্রুফ জীবন কাটাব

পাগলী, তোমার সঙ্গে ফুলপেজ কাটাব জীবন

পাগলী, তোমার সঙ্গে লে আউট জীবন কাটাব

পাগলী, তোমার সঙ্গে লে হালুয়া কাটাব জীবন।



কবিত্ব ফুড়ুত্‍ করবে, পিছু পিছু ছুটব না হা করে

বাড়ি ফিরে লিখে ফেলব বড়ো গল্প উপন্যাসোপম

পাগলী, তোমার সঙ্গে কথাশিল্প জীবন কাটাব

পাগলী, তোমার সঙ্গে বকবকম কাটাব জীবন।



নতুন মেয়ের সঙ্গে দেখা করব লুকিয়ে চুরিয়ে

ধরা পড়ব তোমার হাতে, বাড়ি ফিরে হেনস্তা চরম

পাগলী, তোমার সঙ্গে ভ্যাবাচ্যাকা জীবন কাটাব

পাগলী, তোমার সঙ্গে হেস্তনেস্ত কাটাব জীবন।



পাগলী, তোমার সঙ্গে পাপবিদ্ধ জীবন কাটাব

পাগলী, তোমার সঙ্গে ধর্মমতে কাটাব জীবন

পাগলী, তোমার সঙ্গে পুজা বেদি জীবন কাটাব

পাগলী, তোমার সঙ্গে মধুমালা কাটাব জীবন।



দোঁহে মিলে টিভি দেখব, হাত দেখাতে যাব জ্যোতিষীকে

একুশটা উপোস থাকবে, ছাব্বিশটা ব্রত উদযাপন

পাগলী, তোমার সঙ্গে ভাড়া বাড়ি জীবন কাটাব

পাগলী, তোমার সঙ্গে নিজ ফ্ল্যাট কাটাব জীবন।



পাগলী, তোমার সঙ্গে শ্যাওড়াফুলি জীবন কাটাব

পাগলী, তোমার সঙ্গে শ্যামনগর কাটাব জীবন

পাগলী, তোমার সঙ্গে রেল রোকো জীবন কাটাব

পাগলী, তোমার সঙ্গে লেট স্লিপ কাটাব জীবন।



পাগলী, তোমার সঙ্গে আশাপূর্ণা জীবন কাটাব

আমি কিনব ফুল, তুমি ঘর সাজাবে যাবজ্জীবন

পাগলী, তোমার সঙ্গে জয় জওয়ান জীবন কাটাব

পাগলী, তোমার সঙ্গে জয় কিষান কাটাব জীবন।



সন্ধেবেলা ঝগড়া হবে, হবে দুই বিছানা আলাদা

হপ্তা হপ্তা কথা বন্ধ মধ্যরাতে আচমকা মিলন

পাগলী, তোমার সঙ্গে ব্রক্ষ্মচারী জীবন কাটাব

পাগলী, তোমার সঙ্গে আদম ইভ কাটাব জীবন।



পাগলী, তোমার সঙ্গে রামরাজ্য জীবন কাটাব

পাগলী, তোমার সঙ্গে প্রজাতন্ত্রী কাটাব জীবন

পাগলী, তোমার সঙ্গে ছাল চামড়া জীবন কাটাব

পাগলী, তোমার সঙ্গে দাঁতে দাঁত কাটাব জীবন।



এর গায়ে কনুই মারব রাস্তা করব ওকে ধাক্কা দিয়ে

এটা ভাঙলে ওটা গড়ব, ঢেউ খেলব দু দশ কদম

পাগলী, তোমার সঙ্গে ধুলোঝড় জীবন কাটাব

পাগলী, তোমার সঙ্গে ‘ভোর ভয়োঁ’ কাটাব জীবন।









কুয়ার ধারে

____রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর



তোমার কাছে চাইনি কিছু, জানাই নি মোর নাম,

তুমি যখন বিদায় নিলে নীরব রহিলাম।

একলা ছিলেম কুয়ার ধারে নিমের ছায়াতলে,

কলস নিয়ে সবাই তখন পাড়ায় গেছে চলে।

আমায় তারা ডেকে গেল, ‘আয় গো বেলা যায়।’

কোন্ আলসে রইনু বসে কিসের ভাবনায়।।



পদধ্বনি শুনি নাইকো কখন তুমি এলে,

কইলে কথা ক্লান্তকন্ঠে– করুণচক্ষু মেলে–

‘তৃষাকাতর পান্থ আমি।’শুনে চমকে উঠে

জলের ধারা দিলেম ঢেলে তোমার করপুটে।

মর্মরিয়া কাঁপে পাতা, কোকিল কোথা ডাকে–

বাবলা ফুলের গন্ধ ওঠে পল্লীপথের বাঁকে।।



যখন তুমি শুধালে নাম পেলেম বড়ো লাজ–

তোমার মনে থাকার মতো করেছি কোন্ কাজ!

তোমায় দিতে পেরেছিলাম একটু তৃষার জল,

এই কথাটি আমার মনে রহিল সম্বল।

কুয়ার ধারে দুপুরবেলা তেমনি ডাকে পাখি,

তেমনি কাঁপে নিমের পাতা– আমি বসেই থাকি।।





১০



প্রস্থান

____হেলাল হাফিজ



এখন তুমি কোথায় আছো কেমন আছো, পত্র দিয়ো৷

এক বিকেলে মেলায় কেনা খামখেয়ালী তাল পাখাটা

খুব নিশীথে তোমার হাতে কেমন আছে, পত্র দিয়ো৷

ক্যালেন্ডারের কোন পাতাটা আমার মতো খুব ব্যথিত

ডাগর চোখে তাকিয়ে থাকে তোমার দিকে, পত্র দিয়ো৷

কোন কথাটা অষ্টপ্রহর কেবল বাজে মনের কানে

কোন স্মৃতিটা উস্কানি দেয় ভাসতে বলে প্রেমের বানে

পত্র দিয়ো, পত্র দিয়ো৷



আর না হলে যত্ন করে ভুলেই যেয়ো, আপত্তি নেই৷

গিয়ে থাকলে আমার গেছে, কার কী তাতে?

আমি না হয় ভালোবেসেই ভুল করেছি ভুল করেছি,

নষ্ট ফুলের পরাগ মেখে

পাঁচ দুপুরের নির্জনতা খুন করেছি, কী আসে যায়?



এক জীবনে কতোটা আর নষ্ট হবে,

এক মানবী কতোটা আর কষ্ট দেবে!





১১



তোমার চিবুক ছোঁবো, কালিমা ছোঁবো না

______আবুল হাসান



এ ভ্রমণ আর কিছু নয়, কেবল তোমার কাছে যাওয়া

তোমার ওখানে যাবো, তোমার ভিতরে এক অসম্পূর্ণ যাতনা আছেন,

তিনি যদি আমাকে বলেন, তুই শুদ্ধ হ’ শুদ্ধ হবো

কালিমা রাখবো না!



এ ভ্রমণ আর কিছু নয়, কেবল তোমার কাছে যাওয়া

তোমার ওখানে যাবো; তোমার পায়ের নীচে পাহাড় আছেন

তিনি যদি আমাকে বলেন, তুই স্নান কর

পাথর সরিয়ে আমি ঝর্ণার প্রথম জলে স্নান করবো

কালিমা রাখবো না!



এ ভ্রমণ আর কিছু নয়, কেবল তোমার কাছে যাওয়া

এখন তোমার কাছে যাবো

তোমার ভিতরে এক সাবলীল শুশ্রূষা আছেন

তিনি যদি আমাকে বলেন, তুই ক্ষত মোছ আকাশে তাকা–

আমি ক্ষত মুছে ফেলবো আকাশে তাকাবো

আমি আঁধার রাখবো না!



এ ভ্রমণ আর কিছু নয়, কেবল তোমার কাছে যাওয়া

যে সকল মৌমাছি, নেবুফুল গাভীর দুধের সাদা

হেলেঞ্চা শাকের ক্ষেত

যে রাখাল আমি আজ কোথাও দেখি না– তোমার চিবুকে

তারা নিশ্চয়ই আছেন!



তোমার চিবুকে সেই গাভীর দুধের শাদা, সুবর্ণ রাখাল

তিনি যদি আমাকে বলেন, তুই কাছে আয় তৃণভূমি

কাছে আয় পুরনো রাখাল!

আমি কাছে যাবো আমি তোমার চিবুক ছোঁবো, কালিমা ছোঁবো না!





১২



চতুর্দশপদী কবিতাবলী

____শক্তি চট্টোপাধ্যায়



ভালোবাসা পেলে সব লন্ডভন্ড করে চলে যাবো

যেদিকে দুচোখ যায়- যেতে তার খুশি লাগে খুব ।

ভালোবাসা পেলে আমি কেন পায়সান্ন খাবো

যা খায় গরিবে, তাই খাবো বহুদিন যত্ন করে ।

ভালোবাসা পেলে আমি গায়ের সমস্ত মুগ্ধকারী

আবরণ খুলে ফেলে দৌড় ঝাঁপ করবো কড়া রোদে...

ভালোবাসা পেলে জানি সব হবে । না পেলে তোমায়

আমি কি বোবার মতো বসে থাকবো-

ভালোবাসা না পেলে কি আমার এমনি দিন যাবে

চোরের মতন, কিংবা হাহাকারে সোচ্চার , বিমনা--

আমি কি ভীষণ ভাবে তাকে চাই ভালোবাসা জানে।



১৩



প্রেমের কবিতা

______সুবীর সরকার



চোখের জলের কোন গল্প শোনাব না । আমি শুধু

অন্যমনস্ক এক গাছ এঁকে যাবো । এঁকে দেব

লোকাল ট্রেন আর তার পেছন পেছন দৌড়ে যাওয়া

সিগন্যালম্যান

প্রতিটি মৃতদেহ জানে কীভাবে মুখস্থ করেছি

বান্ধবীদের টেলিফোন নম্বর

ওলটানো ঘড়ি নিয়ে কথা বলা শুরু হলে

আমাকে আড়াল করে তোমার উড়ন্ত চুল,

ভিজে যাওয়া রিক্সাচালক



আমার ঠিকানা খুবই ছোট । তুমি সমস্ত নিষেধাজ্ঞা

অমান্য ক'রে

চিঠি দিও, হদৃস্পন্দন পাঠিও





১৪



চোখ নিয়ে চলে গেছে

_____সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়



এই যে বাইরে হু হু ঝড়, এর চেয়ে বেশী

বুকের মধ্যে আছে

কৈশোর জুড়ে বৃষ্টি বিশাল, আকাশে থাকুক যত মেঘ,

যত ক্ষণিকা

মেঘ উড়ে যায়

আকাশ ওড়ে না

আকাশের দিকে

উড়েছে নতুন সিঁড়ি

আমার দু বাহু একলা মাঠের জারুলের ডালপালা

কাচ ফেলা নদী যেন ভালোবাসা

ভালোবাসার মতো ভালোবাসা

দু‘দিকের পার ভেঙে

নরীরা সবাই ফুলের মতন, বাতাসে ওড়ায়

যখন তখন

রঙিন পাপড়ি

বাতাস তা জানে, নারীকে উড়াল দেয়ে নিয়ে যায়

তাই আমি আর প্রকৃতি দেখি না,

প্রকৃতি আমার চোখ নিয়ে চলে গেছে!





১৫



কুড়ি বছর পরে

_____জীবনানন্দ দাশ



আবার বছর কুড়ি পরে তার সাথে দেখা যদি হয়

আবার বছর কুড়ি পরে-

হয়তো ধানের ছড়ার পাশে

কার্তিকের মাসে-

তখন সন্ধ্যার কাক ঘরে ফেরে- তখন হলুদ নদী

নরম নরম শর কাশ হোগলায়- মাঠের ভিতরে !



অথবা নাইকো ধান ক্ষেতে আর,

ব্যস্ততা নাই আর,

হাঁসের নীড়ের থেকে খড়

পাখির নীড় থেকে খড়

ছড়াতেছে; মনিয়ার ঘরে রাত, শীত আর শিশিরের জল !

জীবন গিয়েছে চলে আমাদের কুড়ি, কুড়ি, বছরের পার,-

তখন হঠাৎ যদি মেঠো পথে পাই আমি তোমারে আবার !

হয়তো এসেছে চাঁদ মাঝরাতে একরাশ পাতার পিছনে

সরু- সরু- কালো কালো ডালপালা মুখে নিয়ে তার,

শিরীষের অথবা জামের

ঝাউয়ের-আমের,

কুড়ি বছরের পরে তখন তোমারে নাই মনে !



জীবন গিয়েছে চলে আমাদের কুড়ি-কুড়ি বছরের পার-

তখন আবার যদি দেখা হয় তোমার আমার !

তখন হয়তো মাঠে হামাগুড়ি দিয়ে পেচা নামে-

বাবলার গলির অন্ধকারে

অশথের জানালার ফাকে

কোথায় লুকায় আপনাকে !

চোখের পাতার মতো নেমে চুপি কোথায় চিলের ডানা থামে-

সোনালি সোনালি চিল- শিশির শিকার করে নিয়ে গেছে তারে-

কুড়ি বছর পরে সেই কুয়াশায় পাই যদি হঠাৎ তোমারে !



১৬



আকাশে সাতটি তারা

_____জীবনানন্দ দাশ



ছেলে: আকাশে সাতটি তারা যখন উঠেছে ফুটে আমি এই ঘাসে

ব’সে থাকি; বাংলার নীল সন্ধ্যা-কেশবতী কন্যা যেন এসেছে আকাশে;

আমার চোখের পরে আমার মুখের পরে চুল তার ভাসে;

পৃথিবীর কোনো পথে এ কন্যারে দেখিনিকো-দেখি নাই অত

অজস্রচুলের চুমা হিজলে, কাঁঠালে , জামে ঝরে অবিরত,

জানি নাই এত স্নিগ্ধ গন্ধ ঝরে রূপসীর চুলের বিন্যাসে।



মেয়ে: পৃথিবীর কোনো পথে: নরম ধানের গন্ধ-কলমীর ঘ্রাণ,

কিশোরের পায়ের- দলা মুথাঘাস, – লাল লাল বটের ফলের

ব্যথিত গন্ধের ক্লান্ত নীরবতা- এরই মাঝে বাংলার প্রাণ ।

আকাশে সাতটি তারা যখন উঠেছে ফুটে আমি পাই টের।



ছেলে: আবার আকাশে অন্ধকার ঘন হয়ে উঠেছে :

যে আমাকে চিরদিন ভালোবেসেছে

অথচ যার মুখ আমি কোনোদিন দেখিনি, /সেই নারীর মতো

ফাল্গুন আকাশে অন্ধকার নিবিড় হয়ে উঠেছে।



মেয়ে: ফাল্গুনের অন্ধকার নিয়ে আসে সেই সমুদ্রপারের কাহিনী,

রামধনু রঙের কাচের জানালা,

ময়ূরের পেখমের মতো রঙিন পর্দায় পর্দায়

কক্ষ ও কক্ষান্তর থেকে আরো দুর কক্ষ ও কক্ষান্তরের

ক্ষণিক আভাস-



আয়ুহীন স্তব্ধতা ও বিস্ময়!

তোমার নগ্ন নির্জন হাত ।



ছেলে: রাতের বাতাস আসে

আকাশের নক্ষত্রগুলো জ্বলন্ত হয়ে ওঠে

যেন কারে ভালোবেসেছিলাম-

সমস্ত শরীর আকাশ রাত্রি নক্ষত্র-উজ্জ্বল হয়ে উঠছে তাই

আমি টের পাই সেই নগ্ন হাতের গন্ধের

সেই মহানুভব অনিঃশেষ আগুনের

রাতের বাতাসে শিখানীলাভ এই মানবহৃদয়ের

সেই অপর মানবীকে।

সে কে এক নারী এসে ডাকিল আমারে, বলিল:



মেয়ে: তোমারে চাই :

বেতের ফলের মতো নীলাভ ব্যথিত তোমার দুই চোখ

খুঁজেছি নক্ষত্রে আমি- কুয়াশার পাখনায়-

সন্ধ্যার নদীর জলে নামে যে আলোক

জোনাকির দেহ হতে- খুঁজেছি তোমারে সেইখানে-



ছেলে: নতুন সৌন্দর্য এক দেখিয়াছি- সকল অতীত

ঝেড়ে ফেলে- নতুন বসন্ত এক এসেছে জীবনে ;

শালিখেরা কাঁপিতেছে মাঠে মাঠে- সেইখানে শীত

শীত শুধু- তবুও আমার বুকে হৃদয়ের বনে

কখন অঘ্রান রাত শেষ হ’ল- পৌষ গেল চ’লে

যাহারে পাইনি রোমে বেবিলনে, সে এসেছে ব’লে।



মেয়ে: তুমি এই রাতের বাতাস ,বাতাসের সিন্ধু-ঢেউ

তোমার মতন কেউ নাই আর।

অন্ধকার নিঃসাড়তার মাঝখানে

তুমি আনো প্রাণে .সমুদ্রের ভাষা,

ব্যথিত জলের মতন,

রাতের বাতাস তুমি,- বাতাসের সিন্ধু- ঢেউ,

তোমার মতন কেউ নাই আর।



ছেলে: তোমার মুখের দিকে তাকালে এখনো

আমি সেই পৃথিবীর সমুদ্রের নীল,

নক্ষত্র, রাত্রির জল, যুবাদের ক্রন্দন সব-

শ্যামলী, করেছি অনুভব।

তোমার সৌন্দর্য নারি, অতীতের দানের মতন।

ধর্মাশোকের স্পষ্ট আহ্বানের মতো

আমাদের নিয়ে যায় ডেকে

তোমার মুখের স্নিগ্ধ প্রতিভার পানে।



মেয়ে: আমরা কিছু চেয়েছিলাম প্রিয়;

নক্ষত্র মেঘ আশা আলোর ঘরে

ঐ পৃথিবীর সূর্যসাগরে, ভেবেছিলাম,

পেয়ে যাবে প্রেমের স্পষ্ট গতি

সত্য সূর্যালোকের মতন;-



ছেলে: সবার ওপর তোমার আকাশপ্রতিম মুখে রয়েছে

সফল সকালের রৌদ্র।

সৃষ্টি ও সমাজের বিকেলের অন্ধকারের ভিতর

সকালবেলার প্রথম সূর্য-শিশিরের মতো সেই মুখ ;

জানে না কোথায় ছায়া পড়েছে আমার জীবনে,

সমস্ত অমৃতযোগের অন্তরীক্ষে।



আমাদের ভালোবাসা পথ কেটে নেবে এই পৃথিবীতে ;-

আমরা দুজনে এই বসে আছি আজ-ইচ্ছাহীন ;-

শালিক পায়রা মেঘ পড়ন্ত বেলার এই দিন

চারিদিকে ;-

এখানে গাছের পাতা যেতেছে হলুদ হ’য়ে- নিঃশব্দে উল্কার মতো ঝ’রে

একদিন তুমি এসে তবু এই হলুদ আঁচল রেখে ঘাসের ভিতরে শান্তি পাবে।

মন্তব্য ২ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ১৫ ই আগস্ট, ২০১৪ রাত ১১:০০

আশরাফুল ইসলাম দূর্জয় বলেছেন:
অনেকগুলো পছন্দের কবিতা আছে এখানে।
পোস্টে ভালোলাগা।

২| ২০ শে নভেম্বর, ২০১৪ বিকাল ৪:৫২

দুঃখী_কাঠপেন্সিল বলেছেন: সবগুলো কবিতায় খুব প্রিয়। ধন্যবাদ আপু শেয়ার করার জন্য।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.