![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
সারাদিনের ধুলোবালি পড়া গাছগুলো শীতের সকালে সদ্যস্নাত নারীর মত, শিশির জলে গা ধুয়ে সকালের স্নিগ্ধ রোদে দাঁড়িয়ে যেন চুল শুকাচ্ছে আর গল্প করছে পাড়ার মেয়েদের সাথে। সারাদিনের ধুলোবলিতে দিনশেষে তা আবার ঢেকে যায় মলিনতায়। পার্কের বেঞ্চগুলোও শিশির পড়ে ভেজা ভেজা। বেঞ্চে শুয়ে থাকে উদ্বাস্ত আর পথ শিশুরা। মাঝেমাঝে তাড়া খায় পুলিশের। পার্কের বাইরে বেশ কয়েকটা অস্থায়ী ঝুপড়ি। পুলিশের দাবড়ানিতে কখনও কখনও ঝুপড়ি তুলে নিয়ে অন্য কোথাও বসাতে হয়। তার মধ্যে একটা ঝুপড়িতে থাকে আম্বিয়া বেগম।
শীতকাল না আসতেই ঠাণ্ডাটা বেশ জেঁকে বসেছে। এবার মনে হয় শীতটা বেশিই পড়বে। ঝুপড়ির পর্দাটা সরিয়ে বাইরে চোখ রাখে আম্বিয়া বেগম। কুয়াশা পড়াও শুরু হয়ে গেছে। তাই বাইরে আবছা অন্ধকার। বাতাসটাও শিরশিরে। শিশিরও জমে আছে ঘাসগুলোর ডগায়, ঠিক যেন স্বচ্ছ মুক্তার মতন। ঝুপড়ির পর্দাটা উপরে উঠিয়ে দিয়ে গায়ে কাঁথা জড়িয়ে সকাল দেখছে আম্বিয়া বেগম। এখনও তেমন কেউ ঘুম থেকে জাগেনি। সবাই যার যার ঝুপড়িতে নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। আম্বিয়া বেগম ভাবে আহারে সকাল। সূর্যটা কি শান্ত, একটু পরেই যখন রোদ উঠবে তখন এই শান্ত সূর্যের কি দাপট। আবার সন্ধ্যায় সে দাপট যায় কমে। ঠিক যেন মানুষের মত। এখন যেমন তার কোন দাপট নেই। আস্তে আস্তে দিনের আলো ফুটছে। আলোটাও নিস্তেজ।
পেপার বিলি করা হকারগুলো ছুটছে গরম গরম খবর নিয়ে। আম্বিয়া বেগম মনে মনে বলে আহারে কি লেখা থাকে ওই কাগজগুলায়! চোখ থাকতেও আন্ধা বুজিন এইডারেই কয়! রাস্তা পরিষ্কার করা লোকগুলো ঝাড়–দিচ্ছে, কেউবা ময়লা ফেলছে। তারমধ্যে একজন ঝাড়ুদারের সাথে টুকটাক কথা বলে সে। লোকটার নাম লেকু মিয়া। আজ সে আম্বিয়া বেগমকে এত সকালে ঘুম থেকে জেগে উঠে বসে আছে দেখে বললো-কি গো বিটি, এত সকালে উঠেছো কেনে। শরীর খারাপ নাকি!
আম্বিয়া বেগম বলে- নারে বাপ আর শরীর! ঘুম আহে না।
-হ তোমার কাইম কাইজ নাইতো তাই ঘুমে ধরে না। আর আমাগো ঘুমোনের কপাল নাই। উঠনই লাগবো, তাই ঘুম আর ভাঙবার চাই না। আমি আগায় গেলাম লেকু ভাই, তুমি আহো। বলেই সামনের দিকে আগায়। মেয়েটির নাম মর্জিনা বানু, লেকু মিয়ার সহকর্মী।
লেকু মিয়া আম্বিয়া বেগমকে বলে- ওর কথায় কিছু মনে করো না বিটি। ও একটু ঠোঁটকাটা। কথা বার্তা কওনের কোন আক্কেল ব্যাক্কেল নাই। বলেই কাজে মন দেয় লেকু মিয়া। এগিয়ে যায় সামনের দিকে।
-নারে বাপ কি আর মনে করমু। হাঁচা কথায় কয়ছে। আকাম্মারে আকাম্মা কয়ছে দোষের কি! তয় আমিও একদিন কামের ছিলামরে বাপ। আমিও একদিন কামের ছিলাম... বলতে বলতে ঝুপড়ির ভেতরে ঢুকে পর্দা নামিয়ে দেয় আম্বিয়া বেগম। কাঁথাটা গায়ে দিয়ে শুয়ে শুয়ে ভাবে সেই সাত সকালে আন্ধার থাকতে থাকতেই ঘুম থেকে উইঠে সংসারের সব কাম একহাতে করছি। ফজরের আজান হয়ছে ঘুম ভাঙনের ম্যালা পরে। কখন খাওন খাইছি, কখন গাও গোছল দিছি, তার কুনো ঠিক ঠিকানা নাই। আর হেয় বেটি, দুই পাক ঝাঁটা ঘুরায়, কি না ঘুরায়! আমারে কয় আকাম্মা! ধান ঢেঁকিতে বাইনা, গম যাঁতায় পিইষ্যা খাওন লাগছেরে বেটি। প্রত্যেকদিন দশ বারোডা কামলা লাগছে মাঠে। তাগো খাওন দাওন। বাড়ির পোলা পান এক গণ্ডা, রাখাল, কিষ্ষিন, গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগী। পাঁচ কেজি আটার রুটি বানাইছি। পাঁচ কেজি চালের ভাত একবেলায় লাগছে। এতবড় সংসার সামলায়ছি। আর বেটি আমারে কয় আকাম্মা। আমার বাড়ি-ঘর ওই নদীর পেটে না গেলে কি আর আমার এই দশা হয়রে বেটি! টিনের বেঁকি ঘর আছিলো আমার, বিঘি বিঘি জমি আছিলো। নদীর গেরাসে কপাল পুড়ছে হেয় লাইগাইতো ঝুপড়িতে থাহি। মাইয়াগো সংসারে গিয়া থাকুম কেমনে। তাগোই চলে না। আল্লাহই পোলা দেয় নাই। আর পোলা থাকলেই কি তার ঘরে জায়গা দিতো! কপালে আছে ঝুপড়িতে থাহোন, মরার আগে ভিক্ষে কইরে খাওন! তাই নিজের কপাল নিজেই টানি। সারাদিন ভিক্ষে কইরে যা আনি আমার নিজের চইলা যাই। আর কি লাগে! নিজের মত থাহি। কুনো ঝামেলা নাই। মুন চাইলে খাইলাম, না চাইলে না খাইয়াই শুইয়া থাকলাম। দেখোনোরও নাই, কওনেরও নাই। রান্দোনের মন না চাইলে পাউরুটি কিইন্না খাইয়া লইলাম। মদ্যে মদ্যে মাইয়াগো ঘরেও যাই। খাওন দাওন দেয় না, কমু না। দেয় যতটুকু পারে দেয়।
মনের ভেতর নানা কথা ঘুর পাক খায়। মনে পড়ে গ্রামের কথা। মনে পড়ে বাপের বাড়ির কথা, ছেলে বেলার কথা। বিয়ের কথা। সংসারের কথা। বাপের বাড়ি থেকে বিয়েতে কিছু না দেয়ায় কত কথা শুনতে হয়েছে ভেবে খুব কষ্ট পায় আম্বিয়া বেগম। কি করবে ছোটকালে মা-বাপে মরছে। ভাই বোনের সংসারে মানুষ, কে করবে ভেবে মনকে স্বাস্ত্বনা দেয়। ভাবে ভাইবোনে যা করছে এই ঢের। বিপদে আপদে পাশে দাঁড়াইছে এইতো ম্যালা। এইতো সেবার হালের একখান বলদ কিনা দিলো। উনারে লুঙ্গিতো প্রত্যক ঈদেই দিতো। পোলা পানরে দিছে, আবার কত! পুরানা দিনের কথা ভাবতে চোখ দিয়ে পানি পড়ে আম্বিয়া বেগমের। কাঁথা দিয়ে মুছে বলে- এইডা আমার মায়ের হাতের কাঁথা, কত জায়গায় গেছি। এই কাঁথা হাত ছাড়া করি নাই। কাঁথা খান গায় দিলে মনে কয় মায়েরে জড়ায় ধইরা আছি। এসব ভাবতে ভাবতে বাইরে হট্টোগোল শুনে বাইরে আসে আম্বিয়া বেগম।
পাশের ঝুপড়ির মহিলার সাথে রাস্তার এক লোকের ঝামেলা লাগছে। সে লোক নাকি ঝুপড়িতে উঁকি দিছে। তাই নিয়ে বাঁধছে ক্যাঁচাল। ক্যাঁচাল শুনে লাভ নেই বলে নিজের কাজের জন্য বের হয় আম্বিয়া বেগম।
দোকান থেকে চা আর বিস্কুট খেয়ে বের হয় ভিক্ষা করতে। কিছুদূর না যেতেই এক মেয়ে পঞ্চাশ টাকার একটা নোট রাখে আম্বিয়া বেগমের থালায়। মনে মনে ভাবে আজকের দিনটা এত ভালো। রাস্তায় না নামতেই পঞ্চাশ টাকা। তয় এখনতো ঈদ না যে ফেতরা দিবে। মেয়েটার দিকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টি নিয়ে তাকায় আম্বিয়া বেগম! মেয়েটা বুঝতে পারে ভিখারি পঞ্চাশ টাকা পাওয়ায় একটু আশ্চর্য হয়েছে। তাই সে বললো- খালা, আজ আমার বাবার মৃত্যুবার্ষিকী। তুমি আমার বাবার জন্য দোয়া করো। আম্বিয়া বেগম মেয়েটার গায়ে হাত দিয়ে বললো- হগো মা, দোয়া করি, তোমার বাপের লাইগা দোয়া করি। তোমার লাইগা দোয়া করি, আল্লাহ তোমার ভালো করবো। বলেই সামনের দিকে পা বাড়ায় আম্বিয়া বেগম। কিছুদূর এগিয়ে ওভারব্রিজের গোড়ায় গিয়ে বসে সে। এটাই তার বসার জায়গা। এখানেই বসে থাকে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত। মাঝে অবশ্য একবার ঝুপড়িতে গিয়ে গোসল করে, দুপুরের খাবার খেয়ে আবার আসে। কিন্তু আজ তার মনটা খুব চঞ্চল, কাজে মনই বসছে না। কাউকে ভিক্ষা দেয়ার জন্য বলছেও না। যার মন চাচ্ছে দিচ্ছে। না দিলে, না দিচ্ছে। ঘণ্টা কয়েক বসে থাকার পর সে তার ঝুপড়িতে ফিরে গেল। ফিরে গিয়ে সে তার বাক্স থেকে ভালো একটা শাড়ি বের করে পরে আবার বেরিয়ে এলো। পাশের ঝুপড়ির মহিলা বললো- কয় যাও বুড়িমা? বিটির বাড়ি নাকি!
কথার কোন উত্তর না দিয়ে হনহনিয়ে বেরিয়ে গেল আম্বিয়া বেগম। তারপর ওভার ব্রিজ পার হয়ে রাস্তার ওপারে গিয়ে একজন অন্ধ ভিখারিকে সে তার আঁচল থেকে দশ টাকার একটা চকচকে নোট বের করে দিয়ে বললো- আমার মা-বাপ আর স্বামীর লাইগা একটু দোয়া কইরো। তারা যেন্ বেহেশতবাসী হয়। তারা যেন্ বেহেশতবাসী হয়। ভিখারি কি বললো, না শুনেই নিজের মনে কথা বলতে বলতে, আবার ওভার ব্রিজে ওঠে। ওভার ব্রিজটা এখন যেন বড় মনে হচ্ছে, শুধু তাই নয়, ক্রমশ লম্বা হচ্ছে। শেষই হচ্ছে না। পা দুটোও জড়িয়ে যাচ্ছে একটার সাথে আরেকটা। মনের মধ্যে অনেক কথা ঘুরপাক খাচ্ছে। দ্রুত পা চলাতে গিয়ে বারবার হোঁচট খায়। আবার সামলে নেয় নিজেকে। আস্তে আস্তে ওভার ব্রিজ পার হয়ে এসে দেখে তার বসার জায়গায় অন্য এক ভিখারি বসা। তাকে আসতে দেখে পাশের ভিখারি বললো ওই যে বুড়ি আইছে, তুই সইরা বস্ । কইছিলাম না, এইহানে বসিস না। আম্বিয়া বেগম ওদের কথা কানেই তুলে না। হেঁটে হেঁটে ঝুপড়িতে ফিরে আসে। এসে প্লাস্টিকের জগ থেকে স্টিলের একটা গ্লাসে পানি ঢেলে ঢক ঢক করে খায়। সে বড়ই পিপার্সাত। আরো একগ্লাস পানি খায় আম্বিয়া বেগম। তবুও গলাটা ভেজেনা। ভেতরটা খালি খালি লাগে। মনের মধ্যে শূন্যতা খেলা করে। চারপাশটা একেবারে নিঃশব্দ।
স্বামী মরছে সেই কবে, অথচ আজ স্বামীর জন্য আম্বিয়া বেগমের মনটা বড়ই উচাটন। বারবার মনে পড়ছে তার কথা। চেহারাটা ভালো করে মনেই পড়ছে না। মেয়েরাও সংসারের ঝামেলায় ভুলে গেছে বাপরে। এবার মেয়ের বাড়ি গেলে বাপের জন্য দান খয়রাত করতে বলে আসবে বলে ভাবে আম্বিয়া বেগম। ঝুপড়িতে ফিরে শুয়ে শুয়ে ভাবছে আম্বিয়া বেগম। আজকের দিনটা একটু অন্যরকম। কেন জানি তার স্বামীর কথা, মা-বাবার কথা মনে পড়ছে, একটু বেশিই মনে পড়ছে। মনে হচ্ছে সবাই যেন তার খুব কাছে বসে আছে। সবাইকে দেখতে পাচ্ছে কিন্তু বুঝতে পারছে না। চেহারাগুলো ঘোলাটে। মাথাটা ভার হয়ে আসছে, নিঃশ্বাস পড়ছেও যেন অনেক পরে পরে। আকস্মিক চেহারাগুলো আস্তে আস্তে স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে, টের পাচ্ছে প্রিয় মানুষগুলোর উপস্থিতি। কাঁথাটা আরো শক্ত করে জড়িয়ে নেয় গায়ে। আলতো করে কারো ছোঁয়া কপালের উপরে। সে কি মা নাকি স্বামী বোঝা যাচ্ছে না। তবে স্পর্শটা খুব চেনা। আস্তে আস্তে আবছা মুখগুলো আরো স্পষ্ট হয়। আম্বিয়া বেগম পৌঁছে যায় তার প্রিয় মানুষদের কাছে। স্মৃতির আয়নায় যোগ হয় আরো একটি আবছা মুখ।
সারাদিনের ধুলোবালি পড়া গাছগুলো শীতের সকালে সদ্যস্নাত নারীর মত, শিশির জলে গা ধুয়ে সকালের স্নিগ্ধ রোদে দাঁড়িয়ে যেন চুল শুকাচ্ছে আর গল্প করছে পাড়ার মেয়েদের সাথে। সারাদিনের ধুলোবলিতে দিনশেষে তা আবার ঢেকে যায় মলিনতায়। পার্কের বেঞ্চগুলোও শিশির পড়ে ভেজা ভেজা। বেঞ্চে শুয়ে থাকে উদ্বাস্ত আর পথ শিশুরা। মাঝেমাঝে তাড়া খায় পুলিশের। পার্কের বাইরে বেশ কয়েকটা অস্থায়ী ঝুপড়ি। পুলিশের দাবড়ানিতে কখনও কখনও ঝুপড়ি তুলে নিয়ে অন্য কোথাও বসাতে হয়। তার মধ্যে একটা ঝুপড়িতে থাকে আম্বিয়া বেগম।
শীতকাল না আসতেই ঠাণ্ডাটা বেশ জেঁকে বসেছে। এবার মনে হয় শীতটা বেশিই পড়বে। ঝুপড়ির পর্দাটা সরিয়ে বাইরে চোখ রাখে আম্বিয়া বেগম। কুয়াশা পড়াও শুরু হয়ে গেছে। তাই বাইরে আবছা অন্ধকার। বাতাসটাও শিরশিরে। শিশিরও জমে আছে ঘাসগুলোর ডগায়, ঠিক যেন স্বচ্ছ মুক্তার মতন। ঝুপড়ির পর্দাটা উপরে উঠিয়ে দিয়ে গায়ে কাঁথা জড়িয়ে সকাল দেখছে আম্বিয়া বেগম। এখনও তেমন কেউ ঘুম থেকে জাগেনি। সবাই যার যার ঝুপড়িতে নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। আম্বিয়া বেগম ভাবে আহারে সকাল। সূর্যটা কি শান্ত, একটু পরেই যখন রোদ উঠবে তখন এই শান্ত সূর্যের কি দাপট। আবার সন্ধ্যায় সে দাপট যায় কমে। ঠিক যেন মানুষের মত। এখন যেমন তার কোন দাপট নেই। আস্তে আস্তে দিনের আলো ফুটছে। আলোটাও নিস্তেজ।
পেপার বিলি করা হকারগুলো ছুটছে গরম গরম খবর নিয়ে। আম্বিয়া বেগম মনে মনে বলে আহারে কি লেখা থাকে ওই কাগজগুলায়! চোখ থাকতেও আন্ধা বুজিন এইডারেই কয়! রাস্তা পরিষ্কার করা লোকগুলো ঝাড়–দিচ্ছে, কেউবা ময়লা ফেলছে। তারমধ্যে একজন ঝাড়ুদারের সাথে টুকটাক কথা বলে সে। লোকটার নাম লেকু মিয়া। আজ সে আম্বিয়া বেগমকে এত সকালে ঘুম থেকে জেগে উঠে বসে আছে দেখে বললো-কি গো বিটি, এত সকালে উঠেছো কেনে। শরীর খারাপ নাকি!
আম্বিয়া বেগম বলে- নারে বাপ আর শরীর! ঘুম আহে না।
-হ তোমার কাইম কাইজ নাইতো তাই ঘুমে ধরে না। আর আমাগো ঘুমোনের কপাল নাই। উঠনই লাগবো, তাই ঘুম আর ভাঙবার চাই না। আমি আগায় গেলাম লেকু ভাই, তুমি আহো। বলেই সামনের দিকে আগায়। মেয়েটির নাম মর্জিনা বানু, লেকু মিয়ার সহকর্মী।
লেকু মিয়া আম্বিয়া বেগমকে বলে- ওর কথায় কিছু মনে করো না বিটি। ও একটু ঠোঁটকাটা। কথা বার্তা কওনের কোন আক্কেল ব্যাক্কেল নাই। বলেই কাজে মন দেয় লেকু মিয়া। এগিয়ে যায় সামনের দিকে।
-নারে বাপ কি আর মনে করমু। হাঁচা কথায় কয়ছে। আকাম্মারে আকাম্মা কয়ছে দোষের কি! তয় আমিও একদিন কামের ছিলামরে বাপ। আমিও একদিন কামের ছিলাম... বলতে বলতে ঝুপড়ির ভেতরে ঢুকে পর্দা নামিয়ে দেয় আম্বিয়া বেগম। কাঁথাটা গায়ে দিয়ে শুয়ে শুয়ে ভাবে সেই সাত সকালে আন্ধার থাকতে থাকতেই ঘুম থেকে উইঠে সংসারের সব কাম একহাতে করছি। ফজরের আজান হয়ছে ঘুম ভাঙনের ম্যালা পরে। কখন খাওন খাইছি, কখন গাও গোছল দিছি, তার কুনো ঠিক ঠিকানা নাই। আর হেয় বেটি, দুই পাক ঝাঁটা ঘুরায়, কি না ঘুরায়! আমারে কয় আকাম্মা! ধান ঢেঁকিতে বাইনা, গম যাঁতায় পিইষ্যা খাওন লাগছেরে বেটি। প্রত্যেকদিন দশ বারোডা কামলা লাগছে মাঠে। তাগো খাওন দাওন। বাড়ির পোলা পান এক গণ্ডা, রাখাল, কিষ্ষিন, গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগী। পাঁচ কেজি আটার রুটি বানাইছি। পাঁচ কেজি চালের ভাত একবেলায় লাগছে। এতবড় সংসার সামলায়ছি। আর বেটি আমারে কয় আকাম্মা। আমার বাড়ি-ঘর ওই নদীর পেটে না গেলে কি আর আমার এই দশা হয়রে বেটি! টিনের বেঁকি ঘর আছিলো আমার, বিঘি বিঘি জমি আছিলো। নদীর গেরাসে কপাল পুড়ছে হেয় লাইগাইতো ঝুপড়িতে থাহি। মাইয়াগো সংসারে গিয়া থাকুম কেমনে। তাগোই চলে না। আল্লাহই পোলা দেয় নাই। আর পোলা থাকলেই কি তার ঘরে জায়গা দিতো! কপালে আছে ঝুপড়িতে থাহোন, মরার আগে ভিক্ষে কইরে খাওন! তাই নিজের কপাল নিজেই টানি। সারাদিন ভিক্ষে কইরে যা আনি আমার নিজের চইলা যাই। আর কি লাগে! নিজের মত থাহি। কুনো ঝামেলা নাই। মুন চাইলে খাইলাম, না চাইলে না খাইয়াই শুইয়া থাকলাম। দেখোনোরও নাই, কওনেরও নাই। রান্দোনের মন না চাইলে পাউরুটি কিইন্না খাইয়া লইলাম। মদ্যে মদ্যে মাইয়াগো ঘরেও যাই। খাওন দাওন দেয় না, কমু না। দেয় যতটুকু পারে দেয়।
মনের ভেতর নানা কথা ঘুর পাক খায়। মনে পড়ে গ্রামের কথা। মনে পড়ে বাপের বাড়ির কথা, ছেলে বেলার কথা। বিয়ের কথা। সংসারের কথা। বাপের বাড়ি থেকে বিয়েতে কিছু না দেয়ায় কত কথা শুনতে হয়েছে ভেবে খুব কষ্ট পায় আম্বিয়া বেগম। কি করবে ছোটকালে মা-বাপে মরছে। ভাই বোনের সংসারে মানুষ, কে করবে ভেবে মনকে স্বাস্ত্বনা দেয়। ভাবে ভাইবোনে যা করছে এই ঢের। বিপদে আপদে পাশে দাঁড়াইছে এইতো ম্যালা। এইতো সেবার হালের একখান বলদ কিনা দিলো। উনারে লুঙ্গিতো প্রত্যক ঈদেই দিতো। পোলা পানরে দিছে, আবার কত! পুরানা দিনের কথা ভাবতে চোখ দিয়ে পানি পড়ে আম্বিয়া বেগমের। কাঁথা দিয়ে মুছে বলে- এইডা আমার মায়ের হাতের কাঁথা, কত জায়গায় গেছি। এই কাঁথা হাত ছাড়া করি নাই। কাঁথা খান গায় দিলে মনে কয় মায়েরে জড়ায় ধইরা আছি। এসব ভাবতে ভাবতে বাইরে হট্টোগোল শুনে বাইরে আসে আম্বিয়া বেগম।
পাশের ঝুপড়ির মহিলার সাথে রাস্তার এক লোকের ঝামেলা লাগছে। সে লোক নাকি ঝুপড়িতে উঁকি দিছে। তাই নিয়ে বাঁধছে ক্যাঁচাল। ক্যাঁচাল শুনে লাভ নেই বলে নিজের কাজের জন্য বের হয় আম্বিয়া বেগম।
দোকান থেকে চা আর বিস্কুট খেয়ে বের হয় ভিক্ষা করতে। কিছুদূর না যেতেই এক মেয়ে পঞ্চাশ টাকার একটা নোট রাখে আম্বিয়া বেগমের থালায়। মনে মনে ভাবে আজকের দিনটা এত ভালো। রাস্তায় না নামতেই পঞ্চাশ টাকা। তয় এখনতো ঈদ না যে ফেতরা দিবে। মেয়েটার দিকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টি নিয়ে তাকায় আম্বিয়া বেগম! মেয়েটা বুঝতে পারে ভিখারি পঞ্চাশ টাকা পাওয়ায় একটু আশ্চর্য হয়েছে। তাই সে বললো- খালা, আজ আমার বাবার মৃত্যুবার্ষিকী। তুমি আমার বাবার জন্য দোয়া করো। আম্বিয়া বেগম মেয়েটার গায়ে হাত দিয়ে বললো- হগো মা, দোয়া করি, তোমার বাপের লাইগা দোয়া করি। তোমার লাইগা দোয়া করি, আল্লাহ তোমার ভালো করবো। বলেই সামনের দিকে পা বাড়ায় আম্বিয়া বেগম। কিছুদূর এগিয়ে ওভারব্রিজের গোড়ায় গিয়ে বসে সে। এটাই তার বসার জায়গা। এখানেই বসে থাকে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত। মাঝে অবশ্য একবার ঝুপড়িতে গিয়ে গোসল করে, দুপুরের খাবার খেয়ে আবার আসে। কিন্তু আজ তার মনটা খুব চঞ্চল, কাজে মনই বসছে না। কাউকে ভিক্ষা দেয়ার জন্য বলছেও না। যার মন চাচ্ছে দিচ্ছে। না দিলে, না দিচ্ছে। ঘণ্টা কয়েক বসে থাকার পর সে তার ঝুপড়িতে ফিরে গেল। ফিরে গিয়ে সে তার বাক্স থেকে ভালো একটা শাড়ি বের করে পরে আবার বেরিয়ে এলো। পাশের ঝুপড়ির মহিলা বললো- কয় যাও বুড়িমা? বিটির বাড়ি নাকি!
কথার কোন উত্তর না দিয়ে হনহনিয়ে বেরিয়ে গেল আম্বিয়া বেগম। তারপর ওভার ব্রিজ পার হয়ে রাস্তার ওপারে গিয়ে একজন অন্ধ ভিখারিকে সে তার আঁচল থেকে দশ টাকার একটা চকচকে নোট বের করে দিয়ে বললো- আমার মা-বাপ আর স্বামীর লাইগা একটু দোয়া কইরো। তারা যেন্ বেহেশতবাসী হয়। তারা যেন্ বেহেশতবাসী হয়। ভিখারি কি বললো, না শুনেই নিজের মনে কথা বলতে বলতে, আবার ওভার ব্রিজে ওঠে। ওভার ব্রিজটা এখন যেন বড় মনে হচ্ছে, শুধু তাই নয়, ক্রমশ লম্বা হচ্ছে। শেষই হচ্ছে না। পা দুটোও জড়িয়ে যাচ্ছে একটার সাথে আরেকটা। মনের মধ্যে অনেক কথা ঘুরপাক খাচ্ছে। দ্রুত পা চলাতে গিয়ে বারবার হোঁচট খায়। আবার সামলে নেয় নিজেকে। আস্তে আস্তে ওভার ব্রিজ পার হয়ে এসে দেখে তার বসার জায়গায় অন্য এক ভিখারি বসা। তাকে আসতে দেখে পাশের ভিখারি বললো ওই যে বুড়ি আইছে, তুই সইরা বস্ । কইছিলাম না, এইহানে বসিস না। আম্বিয়া বেগম ওদের কথা কানেই তুলে না। হেঁটে হেঁটে ঝুপড়িতে ফিরে আসে। এসে প্লাস্টিকের জগ থেকে স্টিলের একটা গ্লাসে পানি ঢেলে ঢক ঢক করে খায়। সে বড়ই পিপার্সাত। আরো একগ্লাস পানি খায় আম্বিয়া বেগম। তবুও গলাটা ভেজেনা। ভেতরটা খালি খালি লাগে। মনের মধ্যে শূন্যতা খেলা করে। চারপাশটা একেবারে নিঃশব্দ।
স্বামী মরছে সেই কবে, অথচ আজ স্বামীর জন্য আম্বিয়া বেগমের মনটা বড়ই উচাটন। বারবার মনে পড়ছে তার কথা। চেহারাটা ভালো করে মনেই পড়ছে না। মেয়েরাও সংসারের ঝামেলায় ভুলে গেছে বাপরে। এবার মেয়ের বাড়ি গেলে বাপের জন্য দান খয়রাত করতে বলে আসবে বলে ভাবে আম্বিয়া বেগম। ঝুপড়িতে ফিরে শুয়ে শুয়ে ভাবছে আম্বিয়া বেগম। আজকের দিনটা একটু অন্যরকম। কেন জানি তার স্বামীর কথা, মা-বাবার কথা মনে পড়ছে, একটু বেশিই মনে পড়ছে। মনে হচ্ছে সবাই যেন তার খুব কাছে বসে আছে। সবাইকে দেখতে পাচ্ছে কিন্তু বুঝতে পারছে না। চেহারাগুলো ঘোলাটে। মাথাটা ভার হয়ে আসছে, নিঃশ্বাস পড়ছেও যেন অনেক পরে পরে। আকস্মিক চেহারাগুলো আস্তে আস্তে স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে, টের পাচ্ছে প্রিয় মানুষগুলোর উপস্থিতি। কাঁথাটা আরো শক্ত করে জড়িয়ে নেয় গায়ে। আলতো করে কারো ছোঁয়া কপালের উপরে। সে কি মা নাকি স্বামী বোঝা যাচ্ছে না। তবে স্পর্শটা খুব চেনা। আস্তে আস্তে আবছা মুখগুলো আরো স্পষ্ট হয়। আম্বিয়া বেগম পৌঁছে যায় তার প্রিয় মানুষদের কাছে। স্মৃতির আয়নায় যোগ হয় আরো একটি আবছা মুখ।
©somewhere in net ltd.