![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
উপত্যকা মাড়িয়ে, খাদ ডিঙিয়ে, ঝর্না ধারায় স্নান করে দিগন্ত থেকে ধেয়ে আসে কুয়াশা। এদিকের রাস্তা আবছায়া হতেই ওদিকের রঙিন প্রার্থনা পতাকাসারিতে রোদ গড়ায়। ওদিকের গাছ জবুথবু হতে না হতেই, এদিকের পাহাড়ের আড়ালে উঁকি দেয় চকচকে পাইনসারি। বেয়াড়া মেঘেরাই যেন কুয়াশা হয়ে আসে এই ধরাধামে, এই সিকিমে!
দুপুর নাগাদ বেরিয়ে কুয়াশার চক্করে খাবি খেতে খেতে ছোট্ট শৈলশহর পেলিং পৌঁছতে বিকেল হয়ে গেল। আপার পেলিংয়ে আমাদের হোটেল খুঁজে হাত-মুখ ধুয়ে একটু থিতু হতে না হতেই ঝুপ করে নামল সন্ধে। ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে নজরে এল উল্টোদিকে মোমোর দোকান। তখনই ঠিক করে নিলাম এই ঠান্ডায় রাতের খাবার হবে গরম গরম মোমো আর কফি।
পরদিন সকালে হোটেল ছেড়ে পাহাড়ি রাস্তায় হাঁটতে বেরিয়েছিলাম। আঁকা-বাঁকা রাস্তা ধরে এদিক-সেদিক। পেলিংয়ের উচ্চতা প্রায় সাত হাজার ফুট। ঠান্ডা যথেষ্ট বেশি হলেও সকালের ঠান্ডা বেশ উপভোগ্য। একদিক তখনও অন্ধকার, অন্যদিকে উদীয়মান সূর্য। ধীরে ধীরে কাঞ্চনজঙ্ঘার লাজুক মুখের পর্দা সরাল প্রভাতের সোনালি আলো। বলা হয়, মোটরচালিত পথে কাঞ্চনজঙ্ঘা এবং বাকি কিছু শৃঙ্গ পেলিং থেকেই সবচেয়ে স্পষ্ট। এটাই এখানের ইউ এস পি। হেলিপ্যাড চত্বরকে এখানের ম্যাল মনে করা যেতে পারে। সেখানে কিছুক্ষণ ঢুঁ মেরে হোটেলে ফিরে এলাম। ঘরের পর্দা সরাতেই আমাদের হতবাক করে আকাশের গাঢ় নীলিমায় উদ্ভাসিত হয়ে উঠল ঝকঝকে কাঞ্জনজঙ্ঘা। আশেপাশে তার অন্য তুষারধবল সঙ্গীসাথি - কোকতাং, কুম্ভকর্ণ, রাতোং, কাব্রু ডোম, পান্ডিম, সিনিয়ালচু প্রভৃতি।
দুপুরে পেলিংয়ের আশেপাশে দর্শনীয় স্থান দেখতে চললাম। নিচের দিকে নামতে ১২ কিমি দূরে প্রথমে এল ভারি সুন্দর ঝর্না রিমবি। পাহাড়ের গা বেয়ে ঝিরঝির করে নেমে আসছে জলধারা। বেশ কিছুক্ষণ কাটালাম সেখানে। রিমবি ফল্সের পরের গন্তব্য খেচিপেরি লেক। শব্দার্থ ‘ইচ্ছেপূরণের সরোবর’। গাড়ি থামার পরে কিছু পথ হাঁটতে হল। আশেপাশে এটা–সেটা বিক্রি হচ্ছে। পথের দু’ধারে ঘন গাছপালা। তেমন রোদ ঢোকার উপায় নেই। চতুর্দিকে ভিজে ভিজে ভাব। স্ফটিক স্বচ্ছ জলের পাহাড় ঘেরা লেকটির মধ্যে একটা নিবিড় প্রশান্তি আছে। তা ছাড়া চারদিকের ভাবগম্ভীরতা গোটা পরিবেশে অন্য মাত্রা যোগ করেছে। লেকের চারধারে অজস্র লাল-নীল-হলুদ-সবুজ পতাকা হাওয়ায় পতপত করে উড়ছে। বলা হয়, লেকের জলে পাতা পড়লে নাকি পাখিরা তা ছোঁ মেরে তুলে নেয়। এক ধারে ছোট্ট গুম্ফা। খেচিপেরি দেখে গেলাম কাঞ্চনজঙ্ঘা জলপ্রপাত দেখতে। রাস্তা ভিজিয়ে জল নেমে আসছে এক জায়গায়। ড্রাইভারের কথায় জানালার কাচ তুলে তার তলায় দাঁড়াতেই মুহূর্তে ধূলিমুক্ত হয়ে গেল গাড়ি। প্রায় ৯০ ডিগ্রি বাঁকে মূল প্রপাত। পিছল সিঁড়িপথে ওপরে উঠলাম। ফেনিল জলোচ্ছ্বাস প্রবল গর্জনে নিচে নেমে আসছে। হাওয়ায় ভর করে গায়ে এসে লাগছে বিন্দু বিন্দু জল, সূর্যালোকে যা রামধনু ফুটিয়ে তুলল।
পরদিন সকালে ট্রেক করে গেলাম কিছু দূরের পেমিয়াংসি মনাস্ট্রিতে। তার পরে আরও ঘণ্টাখানেক হেঁটে বনপথ ধরে চলে এলাম ১৬৯৭ সালে তৈরি বর্ণময় সাঙ্গাচোলিং মনাস্ট্রিতে। মূল মনাস্ট্রি পুড়ে যেতে পরবর্তীকালে নতুন মনাস্ট্রি তৈরি হয়। সিকিমের ইতিহাসে এই মঠের আলাদা ঐতিহ্য আছে। মঠের ওপরের অংশ দর্শনার্থীরা দেখতে পারেন। একে ছোটখাটো মিউজিয়াম বলা চলে। অসংখ্য পুঁথি, মূর্তি, শিল্পকলার সংহত সমাহার সেখানে।
দুপুরে খাওয়ার পরে গেলাম এশিয়ার দ্বিতীয় উচ্চতম ঝুলন্ত শিংশোর ব্রিজ দেখতে। ১৯৮ মিটার দীর্ঘ শিংশোর ব্রিজ পেলিং থেকে বেশ কিছুটা দূরে - ঘণ্টাখানেক তো হবেই। এটি একটি কেব্ল স্টেইড ব্রিজ। ব্রিজের ওপর দাঁড়ালে দুলুনি টের পাওয়া যায়। বহু নিচে জল, এতটাই নিচে যে একটা পাথর টুকরোর নিচে পড়তে প্রায় ৮ সেকেন্ড সময় লাগল।
পরদিন ভোর ভোর বেরিয়ে পড়লাম শিলিগুড়ির উদ্দেশে। রাস্তার দু’পাশে ঘন গাছপালায় তখনও অন্ধকার ঝুলে আছে। কিছু বাদে রোদ উঠল। পথের বাঁকে মাঝে মাঝে কাঞ্চনজঙ্ঘা উঁকি মারছে। খাদের ধার থেকে উঠে আসছে খণ্ড খণ্ড মেঘ। যেন মেঘেদের স্বর্গে আগমন। গ্যাংটকের পরে সিকিমের দ্বিতীয় এই জনপ্রিয় গন্তব্য ছেড়ে তখন ক্রমশ এগিয়ে চলেছি সমতলের দিকে।
©somewhere in net ltd.