![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
নৈতিকতার মূল : কেন আমরা ভালো হব ?
এই অধ্যায়ে ডকিন্স জানতে চেয়েছেন যে আমাদের নৈতিকতার কোনো বিবর্তনবাদী উত্স আছে কি না | ডকিন্স আসলে একজন বিবর্তনবাদী জীববিজ্ঞানী | সবকিছুই তিনি বিবর্তনবাদের আলোকে ব্যাখ্যা করেন | আগের অধ্যায়ে ধর্মের উত্সের বিবর্তনবাদী ব্যাখ্যা করেছেন | এই অধ্যায়ে নৈতিকতার উত্সের বিবর্তনবাদী ব্যাখ্যা হবে | দেখা যাক সেটা কতদুর ফলপ্রসু হয় |
এই অধ্যায়ের বিষয় হলো নৈতিকতা : কোথা থেকে এটা এলো ?,আমরা কেন এটাকে নেব ? আর আমাদের নৈতিক হবার জন্য ধর্মের প্রয়োজন আছে কিনা ?
ডকিন্স গোটা বিষয়টাকে তিনভাগে ভাগ করেছেন :
১] আমাদের নৈতিকতার কোনো বিবর্তনবাদী কারণ আছে কিনা
২] নৈতিকতার মূল নিয়ে একটি কেস স্টাডি করেছেন
৩] কেন আমরা নৈতিক হব এইনিয়ে আলোচনা করেছেন |
আমি এক এক করে সবই বলছি | প্রথমে নৈতিকতার বিবর্তনবাদী কারণ :
ডকিন্সের মতে নৈতিকতার কারণ হলো জেনেটিক প্রোগ্রামিং | জিনগুলি প্রাকৃতিক নির্বাচন প্রক্রিয়ায় নির্বাচিত হবার জন্য মানুষের মধ্যে প্রোগ্রামিং করে | সেই প্রোগ্রামিং অনুযায়ী মানুষ ভালো ও মন্দ কাজ করে | কখনো জিনগুলো মানুষকে ভালো করে | এই ভালো করার দুটো দিক আছে : মানুষ নিজের সন্তানদের ভালবাসে | জিনগুলি নিজেদের প্রতিরুপকে বা কপি কে (পড়ুন সন্তান) বাঁচাতে চায় | তাই তারা এমন প্রোগ্রাম করে যেন মানুষ নিজেদের সন্তানদের ভালবাসে |এটা একটা দিক |
আরেকটা দিক হলো পারস্পরিক উদারতা (রেসিপ্রকাল অলট্রুইসম) | এটা হলো তুমি আমার অভাব মেটাও আমি তোমার অভাব মেটাব | এইটা নিজেদের গোষ্ঠির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল |প্রাকৃতিক নির্বাচন সেইসব জীনেদের পছন্দ করে যারা এই পারস্পরিক উদারতা দেখায় আর যারা তা দেখায় না তাদের শাস্তিও দেয় | এই ব্যাপারে অর্থাত পারস্পরিক উদারতার ব্যাপারে জিনগুলির সুনামও নাকি তাদের বেঁচে থাকতে সাহায্য করে |
এই পারস্পরিক উদারতা অন্যান্য গোষ্ঠির প্রতি ছিল না | তাদের প্রতি পারস্পরিক হিংস্রতা ছিল | এটা তখনকার কথা যখন মানুষ বাঁদর ও বেবুনদের মত গোষ্ঠিবদ্ধ জীবন যাপন করত |কিন্তু এখন আমরা শহরে বাস করি | কোনো গোষ্ঠীবদ্ধ জীবন যাপন করি না | প্রায়শই অচেনা লোকেদের সাথে কাটাতে হয় | তাহলে আমরা এইসব অচেনা লোকেদের প্রতি উদার হই কেন ? ডকিন্সের মতে উদারতা, কামনা বাসনা ইত্যাদি প্রাকৃতিক নির্বাচন ক্রিয়ার প্রভাবমুক্ত | তাই অবস্থা পাল্টালেও এগুলো আছে | শুধু তাই নয় , এগুলোর আকার অনেকটা সভ্য হয়েছে | আমরা রোমিও জুলিয়েট গল্পে যে প্রেম, যুদ্ধ ইত্যাদি পাই তা আসলে এইসব বৈশিষ্ট্যের বহিপ্রকাশ |
দ্বিতীয়ত নৈতিকতার মূল নিয়ে কেস স্টাডি :
এটাতে আসলে একটা প্রশ্ন করা হয়েছে যে ৫ জন লোককে বাঁচাতে ১ জন লোককে মেরে ফেলা নৈতিক কিনা | আস্তিক ও নাস্তিকের উভয়েই বলেছে নৈতিক | তা দিয়ে ডকিন্স প্রমান করতে চেয়েছেন যে ধর্মের সাথে নৈতিকতার কোনো যোগ নেই | থাকলে আস্তিক ও নাস্তিকেরা আলাদা উত্তর দিত |
তৃতীয়ত আমরা কেন নৈতিক হব এই নিয়ে আলোচনা :
ধর্মের সাথে নৈতিকতার সম্পর্ক নেই | মন্ট্রিলে একবার পুলিস ধর্মঘট করেছিল | চুরি ডাকাতি ছিনতাই খুন ধর্ষণ ইত্যাদি প্রচন্ড হারে বেড়েছিল | মন্ট্রিলে ধার্মিক লোক কম থাকে না, সুতরাং ধর্মের সাথে নৈতিকতার কোনো যোগ নেই | গ্রেগরী এস পল দেখিয়েছেন যে যে দেশ যত বেশি ধার্মিক সে দেশে তত বেশি অপরাধ | অতএব ধর্মের সাথে নৈতিকতার কোনো যোগ নেই |
কিন্তু ধর্ম ছাড়া নৈতিকতার মানদন্ড পাওয়া যাবে না, সবাই তখন নিজের কাজকে নৈতিক বলে চালাতে পারে | এর উত্তরে ডকিন্স বলেন, ধর্ম নৈতিকতাকে স্থান কাল পত্র ভেদে পাল্টাতে দেয় না | একই রকম রাখে | নৈতিকতাকে এক জগদ্দল পাথরের মত করে ফেলেছে ধর্ম | সবার জন্য এক নীতি : এই হলো ধর্মের ঘোষনা | আর এখানেই সমস্যা সবার জন্য সবসময় এক নীতি হতে পারে না | সুতরাং ধর্ম নৈতিকতার উত্স হতে পারে না | এই হলো ডকিন্সের মত |
এবার আসুন ডকিন্সের যুক্তিগুলি একটু বাজিয়ে দেখা যাক | প্রথমে নৈতিকতার কারণ | আমরা নৈতিক কারণ আমাদের জিনগুলি আমাদের সেইরকমভাবে প্রোগ্রাম করেছে যাতে করে প্রাকৃতিক নির্বাচন প্রক্রিয়া সেই জিনগুলিকে নির্বাচন করতে পারে | এইভাবে নাকি জিনগুলি বেঁচে থাকে | একথা যদি সত্যি হয় তাহলে এ থেকে কি বেরিয়ে আসে ? আমরা যা কিছু ভালো বা মন্দ কাজ করি তার সবই জিনগুলি আমাদেরকে করতে বাধ্য করে প্রোগ্রামিং-এর সাহায্যে | তাহলে ভালো কাজের পুরস্কার আমাদের নয় আমাদের সেই জিন গুলিকে দেয়া উচিত যারা এই সব প্রোগ্রামিং করেছে | খারাপ কাজের সাজাও সেইসব জিন গুলিকে দেয়া উচিত যারা খারাপ কাজের প্রোগ্রামিং করেছে | আমরা তাহলে আমাদেরই জীনেদের হাতের পুতুলমাত্র | কিন্তু এ তো আমাদের পুরো সমাজব্যবস্থাই পাল্টে দেয় | বড় বড় আবিষ্কার, সমাজসেবা, বড় বড় কাজ এইসব তাহলে জীনেদের কাজ আমাদের না | আবার খুন ধর্ষণ, চুরি , রাহাজানি ইত্যাদিও জিনেদেরই কাজ | আমাদের নয় | খুব বাঁচোয়া ডকিন্স সাহেব , সবাই আপনার মত ভাবে না | ভাবলে তো জগতের রূপই পাল্টে যেত | ভালো কাজের পুরস্কার কেউ পেত না | আর খারাপ কাজের শাস্তিও কেউ পেত না | গোটা দুনিয়াটা জানোয়ারের আস্তাবল , অপরাধীদের মুক্তাঞ্চল হয়ে যেত | এই যদি নৈতিকতার বিবর্তনবাদী কারণ হয় , তাহলে তো বলতে হয় বিবর্তনবাদ মানবজাতির পক্ষে অভিশাপ |
এছাড়াও ডকিন্সের মতে : আমরা নিজেদের আত্মীয় ও গোষ্ঠির প্রতি সহৃদয় এবং অনাত্মীয় ও ভিন্ন গোষ্ঠির প্রতি বিরূপ | আমাদের এই ব্যবস্থা জিনেরাই করেছে প্রোগ্রামিং-এর সাহায্যে | এসব তখনকার কথা যখন আমরা বানর বেবুনদের মত গোষ্ঠিবদ্ধ জীবন কাটাতাম | এখন শহরে আমরা অচেনা মানুষদের মধ্যে কাটাই , কিন্তু এখন আমরা অচেনা লোকেদের প্রতি সহৃদয় আচরণ করি | এইরূপ ব্যতিক্রম কেন ? ডকিন্সের মতে এটা আমাদের জিনগত বৈশিষ্ট্যের মিসফায়ার |
কিন্তু আসল কথা হলো অবস্থা মোটেও পাল্টায় নি | শহরেও আমরা গোষ্ঠীবদ্ধ জীবনই যাপন করি | তারই লক্ষণ দেখা যায় : ব্রাহ্মন পাড়া, কায়েত পাড়া, সাহা পাড়া , তিলি পাড়া, মুসলিম মহল্লা ইত্যাদি পাড়া কালচারের মধ্যে | এমনকি গ্রামেও এই গোষ্ঠিবদ্ধতা দেখা যায় : ব্রাহ্মনগ্রাম, মুসলিম গ্রাম ইত্যাদি | এখানেও কি শহর , কি গ্রাম আমরা নিজের পাড়া বা গ্রামের প্রতি সহৃদয় আর ভিন্ন পাড়া বা গ্রামের প্রতি নির্দয় | ভিন্ন মানুষদের সাথে আমরা যে কখনো সহৃদয় আচরণ করি তা নিতান্তই পেটের দায়ে অর্থাত পেশাগত সুত্রে | ঐটুকু বাধ্যবাধকতা না থাকলে আমরা সেই বানর-বেবুন-গোষ্ঠী কালচারের মধ্যেই জীবন কাটাতে ভালবাসি | এখানে জিনগত বৈশিষ্ট্যের কোনো গল্পই নেই | যেখানে এই দায়বদ্ধতা নেই যেমন বিয়েশাদির ব্যাপারে আমরা আরো বেশি গোষ্ঠিবাদী : সেখানে পাড়াও দেখা হয় না , দেখা হয় জাতি : কোন জাতের মেয়ে অথবা ছেলে | স্বজাতি হলে সহৃদয়তা(বিয়েশাদী) , বেজাতের হলেই নির্দয়তা (অনার কিলিং, পঞ্চায়েত সালিশী-ধর্ষণ-হত্যা ইত্যাদি) | কি পাঠক বন্ধু , চিত্রটা খুব চেনা চেনা লাগছে, তাই না ? নিজের ওপর ঘেন্না হলে খুবই ভালো | উন্নতির চিহ্ন |
এই বানর-বেবুন-গোষ্ঠী কালচারের ব্যতিক্রম কি নেই ? আছে | তাকে কসমোপলিটানিসম বা বহুজাতিকতা বলে | এটা খুব কমই দেখা যায় | যে মানুষ নিজের জাতি ভিন্ন অন্য জাতির প্রতি সহৃদয়, তাদেরকে সেকুলার বা উদারপন্থী বলা হয় |আগেই বলেছি যে মানুষ সেকুলার হয় পেশাগত সুত্রে, পেটের দায়ে পড়ে | এটা লোক দেখানো উদারতা| | কিন্তু কিছু মানুষ আছে যারা প্রকৃতিগতভাবে উদার | তাদের উদারতা লোক দেখানো নয় | তারাই বিভিন্ন ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা বা মহাপুরুষ বা তাদের অনুগামী | সমস্ত ধর্ম মানুষকে উদারতার উপদেশ দিয়েছে | ধর্মের মহাপুরুষেরা উদারতার উদাহরণ স্থাপন করে গেছেন | অন্যভাবে বললে সমস্ত ধর্মই মানুষকে সেকুলার হতে বলে | ইসলামও বলে | নবী বহু জাতির মেয়েকে বিয়ে করেছিলেন | তাদের মধ্যে ইহুদি ও খ্রিষ্টান ধর্মের মেয়েরাও ছিল | হাদিসে কথিত আছে যে একবার এক ইহুদির শবযাত্রায় নবী উঠে দাড়িয়ে সম্মান জানিয়েছিলেন | যিশু নিজে সালমা নাম এক বেশ্যাকে দীক্ষিত করেছিলেন | চৈতন্যদেব জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে এক বৈষ্ণব ধর্মের সূচনা করেছিলেন | যবন হরিদাসকে পর্যন্ত দীক্ষা দিয়েছিলেন | বেদ সকল প্রাণীর হিতসাধনের উপদেশ দিয়ে গেছেন | বলেছেন সর্বভূতে ঈশ্বর আছে |
কিছু লোক এখনি জবাব দেবার জন্য তৈরী হচ্ছেন বুঝতে পারছি | তাদের প্রশ্নটাও জানি | যদি ধর্ম মানুষকে উদার হবার শিক্ষায় দেয় তাহলে ধর্মের নাম আমরা এত সংকীর্ণতা, এত ভ্রষ্টাচার দেখি কেন ? কারণ মানুষ নিজে ভ্রষ্ট | সে ধর্মের কদর্থ করে ধর্মকে কালিমালিপ্ত করছে | সে ধর্মের নামাবলী গায়ে দিয়ে নিজের বানর-বেবুন মার্কা ইচ্ছাগুলি পূরণ করছে আর তার ওপর ধর্মের রং চড়িয়ে সেগুলিকে ধর্মসম্মত বলে প্রমান করার চেষ্টা করছে | ধর্মের কোনো দোষ নাই |
বিবর্তনবাদ আমাদের এই বানর-বেবুন-গোষ্ঠী কালচারকেই সমর্থন জানায় | ধর্ম বলে যে এর উপরেও জীবন আছে | গোষ্ঠী নয় , ধর্ম উদারতায় বিশ্বাসী | মানুষই ধর্মগোষ্ঠী তৈরী করেছে | ধর্ম মানুষকে কখনই গোষ্ঠীবদ্ধ হতে শেখায়নি | এখানেই বিবর্তনবাদ আর ধর্মের লড়াই |
বিবর্তনবাদ আমাদের এই বানর-বেবুন-গোষ্ঠী কালচারের কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছে যে এটা জিনগত | আমরা ওই বানর আর বেবুনদের থেকেই এসেছি | তাদের জিনগত বৈশিষ্ট্য আমাদের মধ্যে আছে , তাই আমরা তাদের মত গোষ্ঠিবদ্ধ | কিন্তু এটা সত্যি নয় , কারণ এর বহু ব্যতিক্রম আছে | বড় বড় ধার্মিক মহাপুরুষেরা আর তাদের অনুগামীরা এর ব্যতিক্রম | এঁরা উদারতার কথা বলেছেন | ডকিন্স এর কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন যে ওই জিনগত বৈশিষ্ট্য গুলো মাঝেমধ্যে নাকি মিসফায়ার করে | আর সেই মিসফায়ার হলো এইসব মহাপুরুষেরা | দলাই লামার সহানুভুতি , যিশুর প্রেম, ইসলামের শান্তি , বেদের সর্বভূতে হিত্কার্য : ইত্যাদি সবই জেনেটিক বৈশিষ্ট্যের মিসফায়ার মাত্র | এ বিষয়ে সত্যিই আমার কিছু বলার নেই |
আচ্ছা, বানর বেবুনেরা কি কখনো অন্য গোষ্ঠির প্রানীদের প্রতি উদারতা দেখায় না ? অন্যভাবে বললে তারা কি কখনো মানুষের বন্ধু হয় না ? হয় | কিছুদিন কোনো একটা বাঁদরকে কলা খাইয়ে দেখবেন সে আপনার বন্ধু হয় কিনা | দেখবেন সে আপনাকে দেখলেই দৌড়ে এসে আপনার ঘাড়ে চড়বে | ঐটাই ওদের বন্ধুত্বের বহিপ্রকাশ |বাকি সব জন্তুজানয়াররাও একই রকম | তাহলে এটাও কি জিনগত বৈশিষ্ট্যের মিসফায়ার ? জানি না ডকিন্স এর কি জবাব দেবেন |
এছাড়াও আছে ডকিন্স বলেছেন যে আমরা নিজ গোষ্ঠির লোকেদের ভালবাসি আর অন্য গোষ্ঠির লোকেদের ঘৃনা করি সেটা জেনেটিক প্রোগ্রামিং | জিনরা এইসব প্রোগ্রামিং করে প্রাকৃতিক নির্বাচন ক্রিয়ায় নির্বাচিত হতে চায় | জিনরা যেন পলিটিসিয়ানের মত কাজ করছে | তারা যেমন ভোট এলেই কাজ করে নির্বাচিত হবার জন্য কাজ করে , জিনরাও তেমনি প্রকৃতির ভোটদান কেন্দ্রে নির্বাচিত হবার জন্য প্রোগ্রামিং করে | এটা কি জিনতত্ব বাদিরাও স্বীকার করে নিয়েছেন ? আমি জানি না | পাঠক আপনারা জানেন কি ?
এছাড়াও যদি উদারতা আদি মহান গুনগুলো জিনগত বৈশিষ্ট্যের মিসফায়ার মাত্র তাহলে তো এই গুনগুলি কোনভাবেই শিক্ষা করা যাবে না | কারণ আমাদের জিনগত বৈশিষ্ট্য এর বিপরীত | আর শিক্ষা দ্বারা জিনগত বৈশিষ্ট্য পাল্টানো যায় কিনা তা এখনো বিজ্ঞান জানে না | সুতরাং মহান গুনগুলি শিক্ষাদ্বারা আহরণ করা অসম্ভব ব্যাপার | আমাকে অপেক্ষা করতে হবে কবে আমার কোনো জিনগত বৈশিষ্ট্য মিসফায়ার করবে তবে উদারতা প্রকাশ পাবে | আমাদের সৌভাগ্য যে ধর্মের প্রবক্তাদের জিন মিসফায়ার করেছিল তাই মানবজাতি অমন রত্নদের পেয়েছিল | নাহলে আজও আমরা বানর-বেবুন-গোষ্ঠীতেই কাটাতাম | ডকিন্সের ব্যাখ্যাগুলো সত্যি হলে এইরকমই পরিনাম বেরিয়ে আসে | বিবর্তনবাদ যে কেমন পাঠকরা আপনারাই ঠিক করুন |
নৈতিকতার বিবর্তনবাদী ব্যাখ্যান থেকে আমরা জানলাম যে জিনগুলো আমাদের এমনভাবে প্রোগ্রামিং করে যাতে আমরা নিজের সম্প্রদায়ের প্রতি সদয় আর ভিন্ন সম্প্রদায়ের প্রতি নির্দয় : এককথায় আমরা সাম্প্রদায়িক | এইটাই ঠিক নৈতিকতা কারণ আমাদের পূর্বপুরুষ বাঁদর বেবুনের এইরকমভাবেই থাকে | আর যখন এর ব্যতিক্রম দেখা যায় অর্থাত আমরা সেকুলার হই তখন তা অনৈতিক , জিনগত বৈশিষ্ট্যের মিসফায়ার মাত্র | সুতরাং যা মানবসমাজের ধার্মিক ব্যাখ্যানে নৈতিক তা বিবর্তনবাদী ব্যাখ্যানে অনৈতিক : সেকুলারিসম | আর যা ধার্মিক ব্যাখ্যানে অনৈতিক তা বিবর্তনবাদী ব্যাখ্যানে নৈতিক : সাম্প্রদায়িকতা (কম্মুনালিস্ম)| তাহলে দেখা যাচ্ছে যে ধর্ম আর বিবর্তনবাদ সম্পূর্ণ ভিন্ন দুই মেরুতে অবস্থান করছে | অন্তত নৈতিকতার দিক থেকে |
তাহলে আমাদের এই যে গোষ্ঠীবদ্ধ হয়ে থাকার প্রবণতা যা থেকে ধর্ম আমাদের উদ্ধারের চেষ্টা করছে, এর কারণ কি? জিনগত বৈশিষ্ট্য নয় | এর কারণ হলো আমাদের শিক্ষা | আমাদেরকে শেখানো হয়েছে যে নিজের গোষ্ঠী ভালো আর অন্যের গোষ্ঠী হলো খারাপ | তারই ফল এই গোষ্ঠীবদ্ধ জীবন | এর ফলে দেখা যায় যে যখনই আমরা বুঝতে পারি যে অন্য গোষ্ঠী খারাপ নয় তখনই আমরা অন্য গোষ্ঠির সাথে সম্পর্ক রাখতে চেষ্টা করি | ইন্টার কাস্ট বিয়েশাদী গুলিকে আমরা শুধু এইভাবে ব্যাখ্যা করতে পারি | জিনগত বৈশিষ্ট্য ওভাবে পাল্টানো যায় না | পাল্টাতে গেলে জিনের বিন্যাস পাল্টাতে হবে | জেনেটিক সার্জারী বলে একটা ব্যাপার আছে| তাই করতে হবে | সেরকম কিছু তো দেখা যায় না | এই সাম্প্রদায়িক শিক্ষাই আমাদের গোষ্ঠীবদ্ধ জীবনের মূল | ধর্ম আমাদের এই কুশিক্ষা থেকে মুক্ত করার চেষ্টা করছে |
তাহলে দেখা গেল নৈতিকতার মূল জিনে নয় , শিক্ষায় | ধর্ম এই শিক্ষাকে প্রভাবিত করে |
ডকিন্স এখানেই থেমে থাকে নি | তিনি নৈতিকতার মূল নিয়ে কেস স্টাডি করেছেন | কি সেই কেস ? ৫ জন লোককে বাঁচাতে গেলে ১ জন লোককে মেরে ফেলা কি নৈতিক ? আস্তিক নাস্তিক নির্বিশেষ সবাই বলেছে হ্যা | সুতরাং ধর্ম আর নৈতিকতার মধ্যে কোনো সম্পর্ক নেই | কিন্তু আরো নৈতিক প্রশ্ন আছে | যেমন গর্ভপাত উচিত কিনা, সমকামিতা উচিত কিনা , অনার কিলিং উচিত কিনা ইত্যাদি| এইসব প্রশ্নে আস্তিক ও নাস্তিকেরা একই উত্তর দেবে না ডকিন্স সাহেব | তারা আলাদা উত্তর দেবে | সুতরাং ধর্ম আর নৈতিকতার মধ্যে সম্পর্ক আছে |
তৃতীয়ত আমরা কেন নৈতিক হব এই নিয়ে আলোচনা :
ধর্মের সাথে নৈতিকতার সম্পর্ক নেই | মন্ট্রিলে একবার পুলিস ধর্মঘট করেছিল | চুরি ডাকাতি ছিনতাই খুন ধর্ষণ ইত্যাদি প্রচন্ড হারে বেড়েছিল | মন্ট্রিলে ধার্মিক লোক কম থাকে না, সুতরাং ধর্মের সাথে নৈতিকতার কোনো যোগ নেই | গ্রেগরী এস পল দেখিয়েছেন যে যে দেশ যত বেশি ধার্মিক সে দেশে তত বেশি অপরাধ | অতএব ধর্মের সাথে নৈতিকতার কোনো যোগ নেই | ধর্ম ছাড়া যে নৈতিক সেই আসল নৈতিক |
কিন্তু ধর্ম ছাড়া নৈতিকতার মানদন্ড পাওয়া যাবে না, সবাই তখন নিজের কাজকে নৈতিক বলে চালাতে পারে | এর উত্তরে ডকিন্স বলেন, ধর্ম নৈতিকতাকে স্থান কাল পত্র ভেদে পাল্টাতে দেয় না | একই রকম রাখে | নৈতিকতাকে এক জগদ্দল পাথরের মত করে ফেলেছে ধর্ম | সবার জন্য এক নীতি : এই হলো ধর্মের ঘোষনা | আর এখানেই সমস্যা সবার জন্য সবসময় এক নীতি হতে পারে না | সুতরাং ধর্ম নৈতিকতার উত্স হতে পারে না | এই হলো ডকিন্সের মত | ওনার মতে নৈতিকতার জন্য নৈতিক হওয়া উচিত | ধর্মের জন্য নয় |
আরে মশাই নাস্তিকেরা কি কখনো চুরি ডাকাতি করেনি ? রাশিয়ায় ও চিনে কি কখনো চুরি ডাকাতি হয় নি ? তাহলে নৈতিকতার সাথে নাস্তিকতার কোনো সম্বন্ধ নেই | ধর্মের যে সম্বন্ধ নেই তাতো আপনি দেখালেন | তাহলে কার সম্বন্ধ আছে ? এখানে সেই শিক্ষাই আবার এলো | মন্ট্রিলে যারা চুরি ডাকাতি করেছিল তারা সবাই অল্পশিক্ষিত ছিল : ট্যাক্সি ড্রাইভার, কুলিমালি ইত্যাদি টাইপের লোক | কিন্তু কোনো উচ্চ শিক্ষিত ব্যক্তি ছিল কি ? কোনো প্রফেসর , কনসালটেন্ট বা ডাক্তার বা উকিল এরা কি চুরি করেছিল ? না | সুতরাং এটাই কি আবার প্রমাণিত হলো না যে যারা অল্পশিক্ষিত তারাই অনৈতিক আর যারা উচ্চ শিক্ষিত তারা বেশি নৈতিক ? ডকিন্স বলেছেন যে ধর্ম জগদ্দল পাথরের মত নৈতিকতার সৃষ্টি করে | উদাহরণ: গর্ভপাত, ইচ্ছামৃত্যু আর সমকামিতা | এগুলো সব ক্ষেত্রে নিষিদ্ধ | কে নিষিদ্ধ করেছে ? ডকিন্সের মতে ধর্ম | কিন্তু আমার মতে মানুষ | কারণ বাইবেল , বেদ বা কোরানের যুগে এইসব ব্যাপারগুলি ছিল না | বিষয়গুলি আধুনিক | সুতরাং এবিষয়ে ধর্মগ্রন্থরা নীরব | সরব ধর্মগুরুরা | তারাই এগুলিকে সব ক্ষেত্রে নিষিদ্ধ করে জগদ্দল পাথরের মত নৈতিকতা সৃষ্টি করেছেন | ধর্ম কখনো জগদ্দল পাথরের মত নৈতিকতাকে সৃষ্টি করে না | উদাহরণ : ওল্ড টেস্টামেন্টে ইহুদিদের ঈশ্বর জেহোবা তার নিয়মে বলেছিলেন “ যদি বেশিরভাগ লোক অন্যায়কে সমর্থন করে তাহলে তুমি তাদের সাথে থাকবে না |” কত বড় কথা বলুন তো | লক্ষ্য করার বিষয় হলো জেহোবা এটা বলছেন না যে কোনটা ন্যায় আর কোনটা অন্যায় | সেটা সাধারণ মানুষদের বিচারবুদ্ধির ওপর ছেড়ে দিচ্ছেন | যিশু বলেছিলেন “ যাদের চোখ আছে , তারা দেখুক (let them see that has eyes to see)” এগুলো কি জগদ্দল পাথরের মত নৈতিকতা হলো ? যিশু আরো বলেছেন : “অন্যে তোমার সাথে যা করলে তোমার ভালো লাগে না তুমি অন্যের সাথে তা কোর না |এটাই সব নবীদের শিক্ষার সারকথা” (সারমন অন দা মাউন্ট) এর অর্থ হলো যে তুমি বিচার কর : কোনটা ঠিক কোনটা ভুল , নিজে বিচার করে দেখো | কিন্তু ধর্মগুরুরা এইসব শিক্ষাগুলিকে নিজেদের স্বার্থ অনুযায়ী বিকৃত করে ব্যাখ্যা করেছে | অন্যদের বিচারবুদ্ধি নিজেদের স্বার্থের পরিপন্থী জেনে বিচারবুদ্ধির চর্চাকে নস্যাৎ করেছে | “গুরু ব্যতীত কেউ উদ্ধার করতে পারে না”, “বিশ্বাসে মিলায় বস্তু ,তর্কে বহুদূর”, “গুরুভক্তিই মুক্তির পথ” , ইত্যাদি প্রবাদবাক্য সৃষ্টি করেছে এই ধর্মগুরুরাই , নিজেদের স্বার্থে |
মহাভারতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন “ বেদে সব কথা লেখা নাই | অনেকে বেদকে শেষ কথা মানে না , তাদের দোষ দেই না | ......যেকথা বেদে লেখা নেই তা অনুমান করতে হবে স্বীয় বিচারবুদ্ধি অনুসারে” তিনি অনুমান করার পথ হিসেবে ধর্মের লক্ষণ দেখিয়েছেন “ যা দ্বারা জীব রক্ষা পায় তাই হলো ধর্ম, যা দ্বারা হিংসার নাশ আর অহিংসার স্থাপনা হয় তাই ধর্ম |” অর্থাত এবার এই নিয়ম প্রয়োগ করে আপনি বিচার করে দেখুন বর্তমানে কিভাবে আপনি রক্ষা পাবেন | সেটাই ধর্ম | পুরোপুরি বিচারবুদ্ধির উপর নির্ভরশীল | কিন্তু হিন্দু ধর্মের ব্রাহ্মনেরা নিজেদের স্বার্থের জন্য শ্রীকৃষ্ণের এইসব বাণীগুলিকে তুচ্ছ করে উড়িয়ে দিয়েছে | কখনো জনতাকে বলেনি | সবাই যদি নিজের বিচারবুদ্ধি দ্বারা ধর্ম নির্ণয় করতে থাকে তাহলে তো পুরুত ব্রাহ্মনদের ব্যবসাই লোপাট হয়ে যাবে | সেই কারণেই আজ ধর্ম জগদ্দল পাথরের মত হয়ে গেছে | এর জন্য ধর্মগ্রন্থ নয় বন্ধু , ধর্মগুরু দায়ী | সুতরাং ডকিন্স সাহেবের এই কথাও ভুল যে ধর্ম জগদ্দল পাথরের মত নৈতিকতা সৃষ্টি করে |
আর নৈতিকতার জন্য নৈতিক হওয়া ? ডকিন্স সাহেব এসব শুধুই কথার কথা |এমনটা দেখা যায় না | আমাদের মনটা এতটাই স্বার্থপর করে তৈরী করা যে বিনা কিছু লাভের আশায় আমরা নৈতিক হতে পারব না | ইহলোক বা পরলোকে লাভের আশা থাকলেই তখনই আমরা নৈতিক হব |
সুতরাং আমাদের চারটি সিদ্ধান্ত হলো : নৈতিকতার কারণ জিন নয় , মানুষের শিক্ষা | নৈতিকতা ধর্মের সঙ্গে সম্পর্কিত এবং ধর্ম বিচারবুদ্ধির উপর নির্ভর করে, এটা জগদ্দল পাথরের মত নৈতিকতা দেয় না | ধর্মের আজ যা কিছু অবনতি সবই ধর্মগুরুদের স্বার্থপ্রণোদিত কাজ | এরাই নিজেদের বানর বেবুন মার্কা স্বার্থ সিদ্ধির জন্য ঈশ্বর তথা ধর্মের মুখে কালিমালিপ্ত করছে | ধর্মের কোনো দোষ নাই | নৈতিকতার জন্য নৈতিক হওয়া যায় না | বরংচ নৈতিক হলে আমরা ইহলোকে ও পরলোকে সুখী হব তাই আমরা নৈতিক |
©somewhere in net ltd.