![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
এই বইটা এম এস গোলওয়াল্কর লিখেছেন | উনি গুরুজি নামে পরিচিত | এই প্রবন্ধে আমি ওনাকে গুরুজি বলব | বইটির মুখবন্ধে উনি কিছু বিষয় পরিষ্কার করেছেন যেমন জাতি শব্দের অর্থ কি, রাষ্ট্র শব্দের অর্থ কি, এই বইতে জাতি বলতে কাকে বুঝিয়েছে , বইটার উদ্দেশ্য কি ইত্যাদি | ওনার মতে জাতি হলো সংস্কৃতিক বস্তু আর রাষ্ট্র হলো রাজনৈতিক বস্তু | ওনার এই বইতে জাতি বলতে হিন্দু জাতিকে তথা সংস্কৃতিকে বুঝিয়েছেন | বইটার উদ্দেশ্য হলো হিন্দু সংস্কৃতির বিশ্লেষণ আর তখনকার সমস্যাগুলোতে ওই সংস্কৃতির প্রয়োগ | এখানে উনি জাতি আর রাষ্ট্রকে পৃথক রাখতে স্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছেন |
বইটার প্রথম অধ্যায়ে উনি বলতে চেয়েছেন হিন্দু সংস্কৃতির অবক্ষয়ের ব্যাপারে | উনি আর্যরা বহিরাগত : এই তত্বকে খন্ডন করেছেন এই বলে যে এর স্বপক্ষে কোনো জোরালো প্রমান নেই |দ্বিতীয় অধ্যায়ে তিনি বলেছেন যে যুদ্ধের আগে বিশ্বের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রেরা জাতি (সংস্কৃতি) বলতে কি বুঝত ? তৃতীয় অধ্যায়ে তিনি দেখেছেন যে যুদ্ধের পরে বিশ্বের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রেরা জাতি (সংস্কৃতি) বলতে কি বুঝত ? চতুর্থ অধ্যায়ে তিনি বিদেশী রাষ্ট্রের দেয়া জাতির সংজ্ঞার আলোকে হিন্দু জাতি তথা সংস্কৃতিকে বুঝতে চেয়েছেন এবং এই অধ্যায়ে তিনি সিদ্ধান্ত টেনেছেন যে ভারতবর্ষে শুধু হিন্দু জাতির থাকা উচিত | পঞ্চম অধ্যায়ে তিনি যে প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছেন তা হলো : যদি হিন্দুদেরই বাসভূমি হয় তাহলে অহিন্দুরা কোথায় যাবে ? এবং এই অধ্যায়ের সিদ্ধান্ত হলো ওই ভারতবর্ষ হিন্দুদেরই বাসভূমি | ষষ্ঠ অধ্যায়ে তিনি যে প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছেন তা হলো যে বিদেশের জাতির সংজ্ঞা প্রাচীন হিন্দুদের ঘাড়ে জোর করে চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে কি না ? সপ্তম অধ্যায়ের বিষয় হলো কিভাবে আমরা আমাদের হিন্দু জাতিচেতনা ভুলে গেছি ? এর পরে আছে উপসংহার |এছাড়া দুটো এপেন্ডিক্স আছে | একটা হলো জয়সিংহের কাছে শিবাজীর চিঠি | আরেকটা হলো কিভাবে কংগ্রেসের জন্ম হলো | সংক্ষেপে এই হলো বইটার গঠন (স্ট্রাকচার) |
বইটার গঠন থেকে কতগুলো বিষয়ে মন্তব্য না করে পারছি না | অধ্যায়গুলি যেন একই সুত্রে গাঁথা | কোনো অসঙ্গতি নেই | দুটো অধ্যায়ের মাঝে কোনো অপ্রাসঙ্গিক অধ্যায় হটাত ঢুকে পরে নি | দ্বিতীয়ত আমাদের হিন্দু জাতিচেতনার ভিত্তি হলো আধুনিক পাশ্চাত্য জাতিচেতনা | এটা একটা বড় অনুভব | আজ অব্দি বামুরা আর সেকুলাররা বলে আসছে যে এই হিন্দু রাষ্ট্র , হিন্দু জাতি ব্যাক ডেটেড আইডিয়া | কিন্তু তারা জানে না বা বলে না যে এইটা আধুনিক পাশ্চাত্য জাতি চেতনার ওপর ভিত্তি করে বানানো | অর্থাৎ অতি আধুনিক | লক্ষ্য করুন দ্বিতীয় আর তৃতীয় অধ্যায়ে তিনি পাশ্চাত্য জাতি চেতনার অধ্যয়ন করেছেন আর চতুর্থ অধ্যায়ে উনি বুঝতে চেয়েছেন যে পাশ্চাত্য জাতিচেতনার আলোকে হিন্দু জাতিচেতনার প্রশ্নটি আর সিদ্ধান্ত টেনেছেন যে ভারত হিন্দু জাতির | সুতরাং হিন্দু জাতিচেতনার গল্পটা কি আধুনিক পাশ্চাত্য জাতিচেতনার উপর ভিত্তি করে নয় ? পঞ্চম অধ্যায়ে তিনি সেকুলারদের প্রিয় প্রশ্নটির উত্তর খুঁজেছেন যে তাহলে অহিন্দুরা কোথায় যাবে ? অর্থাৎ কোনটাই বাদ দেন নাই | লেখকের এই ব্যবহার তার অতি সাবধানী মানসিকতারই পরিচয় | অর্থাৎ এই হিন্দু জাতিচেতনার প্রশ্নটা উনি যথেষ্ট সাবধানতার সাথে দেখেছেন | কোনো উপর উপর দেখা নয়, আলগা চিন্তা নয় |অন্তত প্রথম দর্শনে তাই মনে হয় | উপর উপর দেখে বিচার করলে তাই মনে হয় | এবার আমরা প্রতিটি প্রশ্নের মিমাংসা কিভাবে হলো তার অধ্যয়ন করব আর যদি কোনো ত্রুটি খুঁজে পাই তাহলে সেটার উল্লেখ করব |
প্রথম অধ্যায়ে তিনি হিন্দু সংস্কৃতির অবক্ষয়ের কথা বলেছিলেন | উনি এখানে আমাদের আদিপর্ব খুঁজতে চেয়েছেন | কিন্তু নিজে এটা স্বীকার করে নিয়েছেন যে সেটা খুঁজে পাওয়া বৃথা কারণ বেদ-রামায়ন-মহাভারত ইত্যাদির বয়স নির্ণয় করা গেছে | হিন্দু সভ্যতা নিশ্চয় এদের থেকেও প্রাচীন কারণ একদিনে কেউ এমন উন্নত সাহিত্য লিখতে পারে না | কত প্রাচীন সেটা ঠিকমত নির্ণয় করার চেষ্টা করা বৃথা | সুতরাং নিশ্চিতভাবেই আমরা হিন্দুরা হিন্দুস্তানের আদি বাসিন্দা | এছাড়া তিনি আরো বলেছেন যে বৈদিক সাহিত্যে যেসব উন্নত আইডিয়া আছে তা এক সভ্য জাতি ছাড়া কেউ লিখতে পারে না | সুতরাং আমরা নিশ্চই খুব সভ্য জাতি | পাশ্চাত্য জাতি যদিও উন্নতি করেছে কিন্তু তার বর্বর অতীতের কথা এখনো সবারই জানা | সুতরাং ওরা যথেস্ট সভ্য নয় | এছাড়া আমরা হিন্দু তথা আর্যরা নিশ্চয় সভ্য জাতি কারণ ইতিহাসে আমাদের সভ্য বলা আছে তা সে আমরা বহিরাগতই হয় বা দেশীই হই |
এরপর উনি আর্যরা যে বহিরাগত সেই মত খন্ডন করেন | তিনি বলেন
১] এই অপপ্রচার ইংরেজরা বর্ণগর্বে করেছিল |
২] ইংরেজরা এর কোনো প্রমান দেখাতে পারে না |
৩] হিন্দু সভ্যতার উত্কর্ষ খন্ডন করতে না পেরে আর্যজাতির তত্ব খাড়া করা হয়েছে | সেখানে সমগ্র জনতাকে এক আর্যজাতির অংশ বলে দেখিয়ে ইউরোপীয় অংশকে প্রগতিশীল আর ভারতীয় অংশকে পিছিয়ে পড়া দেখানো হয়েছে | এটা যদি সত্যি হয় তাহলে হিন্দু ও ইউরোপিয়ান দুজনেই বহিরাগত হয়ে পড়ে | কে এই দেশে রাজ করবে সেটা শুধু ক্ষমতার প্রশ্ন হয়ে পড়ে | আর আক্রমন কখনই কোনো জাতিকে কোনো দেশে রাজ করার অধিকার দেয় না |
৪] অনেক সময় বলা হয় লোকমান্য তিলক আর্যতত্ব খাড়া করেছিলেন এবং আর্যদের উত্তর মেরুর বাসিন্দা বলেছিলেন | এর পরে উনি দেখিয়েছেন যে প্রাচীন যুগে উত্তর মেরু নাকি আজকের বিহার ও উড়িষ্যায় অবস্থিত ছিল | প্রমান বটানিস্ট ও প্রত্ন-জীববিজ্ঞানীর যুগ্ম সাক্ষ্য |
৫] এর পর উনি বলেছেন যে মানুষ ওই সময় সম্বন্ধে শুধুই অনুমান করতে পারে | সে হাইপোথিসিস শুধু বানাতে পারে | আর হাইপোথিসিস সত্যি নয় | এর পর উনি বলেছেন যে হায়পথেসিসের পাহাড় থেকে আমরা একটা নেব তা হলো আমরা হিন্দুরা এই মাটির বাসিন্দা | আমরা এদেশে কোথাও থেকে আসি নি | আমরা এই দেশের সত্যিকারের রাজা |
৬] আমরা এক জাতি ছিলাম | যথেষ্ট উন্নত ছিলাম | গুরুজীর কথায় আমরা বিজ্ঞান-দর্শন-কলা ইত্যাদিতে নিপুন ছিলাম | আমদের বেদ কেউ অনুকরণ করতে পারত না | আমাদের ধর্ম ছিল এক ধর্ম এবং সত্যিকারের ধর্ম | ওই ধর্ম আমাদের প্রতিটি লোককে মহৎ বানিয়েছিল | কোটি কোটি লোকের মধ্যে একজনও চোর-মিথ্যাবাদী ইত্যাদি ছিল না | আমরা এসব করেছিলাম ইংরেজরা কাঁচা মাংশ সিদ্ধ করে খেতে শেখার আগে |
৭] মহাভারতের পর থেকে বৌদ্ধ যুগ পর্যন্ত একটা ঐতিহাসিক গ্যাপ | গুরুজীর মতে এসময় হিন্দু জাতির মহান জীবনযাত্রা শান্ত অব্যাহত ছিল | তারপর বৌদ্ধরা এলো | গুপ্ত সাম্রাজ্য-অশোক-হর্ষবর্ধন-বিক্রমাদিত্য-পুলোকেশী এরা সব বিরাট রাজা ছিলেন | আলেকজান্ডার বিশ্ববিজেতা ছিলেন না | তারপর সময়ের সাথে সাথে এক বৃহত জাতি ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে গেল | ধর্মের ব্যাক্তিপুজা শুরু হলো | ব্যক্তিপূজাই ধর্ম হয়ে উঠলো | ব্যক্তি ইম্পর্টান্ট হয়ে উঠলো , জাতি নয় | কিন্তু তখনও জাতি সত্তা নষ্ট হয় নি | সেটা হলো মুসলিমরা আসার পর | তারা দেখল জাতিত ভেঙ্গে টুকরো টুকরো | সুতরাং তারা রাজত্ব করতে লাগলো |
৮] তারপরেই এলো হিন্দু পুনর্জাগরণ | শিবাজি আর গুরু গোবিন্দ সিংহের আমলে | তারা জাতিকে একত্রিত করতে চেষ্টা করেছিলেন | কিন্তু একত্রিত হবার আগেই ইংরেজ এলো | ইংরেজদের বিরুদ্ধে সিপাহী বিদ্রহ্টাই শেষ জাতির জন্য বিদ্রোহ | এরপরে দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের কথা | এবং শেষে গুরুজীর হিন্দু রাষ্ট্র-গেরুয়া ধ্বজা ইত্যাদির স্বপ্ন | প্রথম অধ্যায় শেষ |
সমালোচনা
প্রথম কথা হিন্দুরাই যে বৈদিক সাহিত্যের স্রষ্টা তার প্রমান কি ? বৈদিক সাহিত্যে তাহলে ‘হিন্দু’ শব্দটি কেন খুঁজে পাওয়া যায় না ? দ্বিতীয়ত হিন্দুজাতির কোনো বর্বর ইতিহাস নেই : একথা গুরুজি কিভাবে বলতে পারেন যেখানে তিনি বহুবার বলেছেন যে ওই সময়টা সম্বন্ধে কিছুই জানা যায় না ? এটা কি স্ববিরোধ নয় ?
এছাড়া উনি হিন্দু আর আর্যকে এক করেছেন | কি করে ? যদি আর্য আর হিন্দুরা এক জাতিই হত তাহলে সেই আর্যদের লেখা বৈদিক সাহিত্যে হিন্দু শব্দটা পাওয়া যায় না কেন ?
উনি প্রথমে ইংরেজদের ও পরে লোকমান্য তিলককে আর্যতত্ব-এর স্রষ্টা বলেছেন | ইংরেজদের বেলায় প্রমান নেই আর জাতিগর্ব হলো খন্ডনের কারণ | লোকমান্য তিলকের বেলায় উনি প্রমান হাজির করেছেন | কি সেই প্রমান ? উদ্ভিদবিদ্যা ও প্রত্নজিববিদ্যা হলো প্রমান | তিলক বলেছেন আর্যরা উত্তরমেরুর লোক | ওই দুই বিজ্ঞানী, তাদের মধ্যে একজন আবার ইংরাজ তারা নাকি বলেছেন যে উত্তরমেরু একসময় বিহার ও ওড়িশার জায়গায় ছিল | অতএব আর্যরা ভারতেই ছিল , অতএব নিশ্চয় তারা হিন্দু | এই ধরনের ওঁচা যুক্তির কোনো উত্তর হয় না |
তিনি একদিকে বলছেন হাইপোথেসিস সত্যি হতে পারে না , অন্যদিকে তিনি একটা হাইপথেসিসকে সত্য বলছেন যে হিন্দুরা হলো এই দেশের বাসিন্দা | এখানকার মানুষ | এটাও স্ববিরোধী যুক্তির ব্যাপার |
আমাদের গৌরবোজ্জ্বল অতীত নিয়ে গুরুজীর কথা গল্পের গরুকেও হার মানিয়েছে | তিনি বলছেন যে কোটি কোটি লোকের মধ্যে একজনও চোর-মিথ্যাবাদী ছিল না | উনি কি করে জানলেন ? তাহলে গরুড় পুরাণে যে অন্ধকূপ, কুম্ভিপাক, ক্রিমিভোজন ইত্যাদি শাস্তির কথা দেখা যায় সেগুলোর কি দরকার ? ব্যবহার শাস্ত্র আর দন্ডনীতির উপর যে উপদেশ রামায়ন মহাভারতে দেখা যায় সেগুলোরই বা কি প্রয়োজনীয়তা ? আর মহাভারতে যারা অপরাধ করেছিল, তারা কি জাতির লোক ছিল ? তারা কি হিন্দু তথা আর্য ছিল না ? জানি না বাবা | এখানে গুরুজীর কথা বৈদিক সাহিত্যকে মিথ্যা প্রমান করছে |
এছাড়া ইতিহাসে উনি অনেক স্টেপ জাম্প দিয়েছেন | উনি শুধু শিবাজি আর গুরু গোবিন্দ সিংহকে হিন্দু জাতির নবজাগরণের কারিগর মনে করতেন কিন্তু হিন্দুরা তো ভারতের অন্যান্য জায়গাতেও ছিল | তাদের তিনি ধরেননি | এছাড়া মহাভারতের যুগ থেকে বৌদ্ধ যুগ পর্যন্ত সময়ে আর্যজাতির জীবনে কিছুই ঘটেনি এত বড় ধারণা উনি কিভাবে করলেন যেখানে উনি বলেছেন যে ওই অংশ সম্বন্ধে কিছুই জানা যায় না ? এটা কি স্ববিরোধ নয় ?
সুতরাং প্রথম অদ্যায় স্ববিরোধী যুক্তিতে ভর্তি |
©somewhere in net ltd.