![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আগের কয়েকটি প্রতিবেদনে ডেসটিনি গ্রুপের বিরুদ্ধে অর্থপাচারের সন্দেহ করা হলেও চূড়ান্ত প্রতিবেদনে বাংলাদেশ ব্যাংক তা নিশ্চিত করতে পারেনি। সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ১৯৫ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনে অর্থপাচার সম্পর্কে কোনো তথ্যের উল্লেখই করা হয়নি। তবে গ্রুপটির শীর্ষ নির্বাহীদের বিরুদ্ধে অর্থ স্থানান্তর ও আত্মসাতের বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। প্রতিবেদনে বলা হয়, ডেসটিনি মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেডের (ডিএমসিএসএল) কেনা বিভিন্ন সম্পত্তির মূল্য বেশি দেখিয়ে দলিল করা হয়েছে। একই সঙ্গে সমবায় আইন ভঙ্গ করে প্রতিষ্ঠানটি ডেসটিনি ২০০০ লিমিটেডকে কমিশন দিয়েছে বলেও মনে করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আর উচ্চ হারে কমিশন দেওয়ার কারণে প্রতিষ্ঠানটি গ্রাহকদের দায়দেনা পরিশোধে ব্যর্থ হয়ে দেউলিয়া হতে পারে বলে আশঙ্কার কথাও বলেছে তারা। তবে সমবায় অধিদপ্তরের অনুমোদন নিয়েই ডেসটিনি মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড সারা দেশে ব্যবসা করেছে বলে উঠে এসেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে।
ডেসটিনি গ্রুপভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর আর্থিক লেনদেনের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি এই চূড়ান্ত প্রতিবেদন তৈরি করে। প্রতিবেদনটি গত ৭ মার্চ ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে পাঠানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা।
ডেসটিনি গ্রুপের বিরুদ্ধে চট্টগ্রামের এক ব্যক্তি অর্থপাচারের অভিযোগ এনে একটি লিখিত আবেদন করেছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে। পরে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন দল তাদের এক প্রতিবেদনেও গ্রুপটির বিরুদ্ধে অর্থপাচারের সন্দেহ করে। পরে ডেসটিনি গ্রুপের আর্থিক লেনদেনের বিবরণ তুলে ধরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এক প্রতিবেদনে সন্দেহ প্রকাশ করে বলে, প্রতিষ্ঠানটি অর্থপাচার করে থাকতে পারে। কিন্তু সর্বশেষ প্রতিবেদনে ডেসটিনি গ্রুপের বিরুদ্ধে অর্থপাচারের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য দেওয়া সম্ভব হয়নি। তবে ডেসটিনি গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও পরিচালকের মধ্যে কম্পানির অর্থ আত্মসাৎ ও অর্থ স্থানান্তরের সুনির্দিষ্ট তথ্য ও ডেসটিনি মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটির কেনা বিভিন্ন সম্পদ মূল্য বাড়িয়ে দেখানোর তথ্য তুলে ধরেছে চূড়ান্ত প্রতিবেদনে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ফিনানশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের একজন কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে জানান, ডেসটিনি মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড মোট ২২১ কোটি টাকার জমি ও দালান কিনেছে। আবার যে দালান ও ভূমিকে মাল্টিপারপাসের সম্পদ হিসেবে দেখানো হয়েছে, তার উল্লেখযোগ্য অংশই সমিতির কার্যকরী পরিষদের সদস্য বা প্রভাবশালী সদস্যদের নামে কেনা। এ ক্ষেত্রে সমিতির পক্ষ থেকে তাঁদের বড় অঙ্কের অর্থ প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে। সমিতির কোষাধ্যক্ষ আকবর হোসেন সুমন, আসাদুজ্জামান আসাদ, আবদুর রাজ্জাক ঢালী, জুবায়ের সোহেল, বিশ্বনাথ পোদ্দার, সুবির ও কামরান এ ধরনের সুবিধা নিয়েছেন বলে উল্লেখ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে বলা হয়েছে, সমিতির ব্যবস্থাপনা কমিটির ঊর্ধ্বতনদের গৃহনির্মাণ ঋণ ও পরিবহন ঋণ খাতে মোট ২৮ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে, যার কিস্তিও নিয়মিত আদায় করা হয়নি।
রাজধানীর পল্টনে ডেসটিনি মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেডের ১৭১ শতাংশ জমি কেনার তথ্য তুলে ধরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছে, এখানে দলিলে জমির পরিমাণ ১০১.০৮ শতাংশ। রেজিস্ট্রেশন খরচের বিল অনুযায়ী জমির ক্রয়মূল্য ১৩ কোটি টাকা। এর সঙ্গে স্ট্যাম্প, রেজিস্ট্রেশন ফি, গেইন ট্যাক্স, দলিল লেখক সমিতির ফি, উৎকোচ ও সাব-রেজিস্ট্রারের আনুষঙ্গিক খরচ বাবদ ছয় কোটি ৬২ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। অথচ দলিলে জমির ক্রয়মূল্য দেখা হয়েছে ৩৮ কোটি ৫০ লাখ টাকা।
রাজমণি ঈশা খাঁর জমি কেনা প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, বিল অনুযায়ী জমিটির ক্রয়মূল্য সাড়ে ১৬ লাখ টাকা। এর সঙ্গে আমমোক্তারনামা, বায়না দলিল বাতিল, নকল ওঠানো ও সাব-রেজিস্ট্রার নিয়ে আসার খরচ এক লাখ টাকা। অথচ রেজিস্ট্রেশন ফি, গেইন ট্যাক্স বাবদ ব্যয় দেখানো হয়েছে এক কোটি ১৫ লাখ টাকা। এর পাশাপাশি ঘুষসহ অন্যান্য খরচ দেখানো হয়েছে ৮২ লাখ ৪৯ হাজার টাকা। একইভাবে গুলশানে ১৮ কাঠা ও বনানী আবাসিক এলাকায় ২০ কাঠা জমি বায়না দলিলের মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার পরও রেজিস্ট্রেশন করেনি সমিতি। অথচ বায়নার বিপরীতে সমিতি দিয়েছে ৭৮ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, 'অনেক ক্ষেত্রেই ভূমি বা দালান ক্রয়ের জন্য রেজিস্ট্রেশন বাবদ প্রদত্ত অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়া-সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় প্রমাণপত্রও সমিতি প্রদর্শন করতে ব্যর্থ হয়েছে। সে কারণে ভূমি ও দালান ক্রয়ের ক্ষেত্রে প্রকৃত ক্রয়মূল্যের চেয়ে প্রদর্শিত ক্রয়মূল্য অনেক স্ফীত করে দেখানো হয়েছে মর্মে প্রতীয়মান হয়েছে।'
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন মতে, গত বছরের ৩১ মার্চের সমিতির ব্যালান্সশিট অনুযায়ী, ঋণ ও বিনিয়োগ খাতে ৭৩৮ কোটি টাকা দেখানো হয়েছে। তবে পরিদর্শন দলের বিবেচনায় এ অঙ্ক ৪৭৩ কোটি টাকার বেশি নয়। উদাহরণ দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, সমিতি তাদের দীর্ঘমেয়াদি ঋণ ও অগ্রিম খাতের আওতায় ডেসটিনি ট্রি প্লান্টেশনকে ১৮৪ কোটি টাকা ও শিল্প প্রকল্প ঋণ খাতে ছয় কোটি টাকা অগ্রিম দেওয়ার কথা উল্লেখ করলেও বাস্তবে এসব খাতে কোনো ঋণ ও অগ্রিম দেওয়া হয়নি। এ ছাড়া ডায়মন্ড বিল্ডার্সকে ৮৪ কোটি টাকা ঋণ দেওয়ার কথা বলা হলেও এখানে প্রকৃত বিনিয়োগ সাড়ে ৯ কোটি টাকা। ডেসটিনি মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটির সারা দেশে কর্মপরিধি পরিচালনা প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রতিষ্ঠানটি ২০০৫ সালের ২৩ এপ্রিল ঢাকা জেলা সমবায় কার্যালয় থেকে নিবন্ধন (নম্বর-২৩০) নেয়। শুরুতে রমনা, মতিঝিল ও খিলগাঁও থানা কর্মপরিধি হিসেবে উল্লেখ করা হয়। তবে ২০০৬ সালের ১৮ মে সংশোধিত নিবন্ধন নম্বর ৩৬-এর মাধ্যমে কর্ম এলাকা সমগ্র ঢাকা মহানগর ও ২০০৮ সালের ৩১ মার্চ সংশোধিত নিবন্ধন নম্বর ৩০-এর মাধ্যমে সমগ্র ঢাকা জেলা কর্ম এলাকা হিসেবে অনুমোদন পায়। সর্বশেষ ২০১০ সালের ১৯ আগস্ট সংশোধিত নিবন্ধনের বলে সমগ্র বাংলাদেশ সভ্য নির্বাচনী ও কর্ম এলাকা হিসেবে সম্প্রসারণের অনুমোদন পায় প্রতিষ্ঠানটি।
ডেসটিনি মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি আমানত সংগ্রহের কমিশন বাবদ ডেসটিনি ২০০০-কে ৭০৯ কোটি টাকা দিয়েছে। এ দুটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে স্বাক্ষরিত তিনটি চুক্তির ভিত্তিতে এ কমিশন দেওয়া হয়েছে বলে উল্লেখ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে এভাবে কমিশন দেওয়া সমবায় আইন বিরোধী বলেও মন্তব্য রয়েছে প্রতিবেদনে। কমিশনের আবরণে মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভের বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছে বলে উল্লেখ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, 'সমিতির মূলধন ও আমানত সংগ্রহ বাবদ সংগ্রহকারীদের ৪৩ শতাংশ কমিশন দেওয়া হয়। বাকি ৫৭ শতাংশ অর্থ বিনিয়োগ করে কিভাবে সমিতির সদস্য ও আমানতকারীদের মুনাফা বা সুদ দেওয়া সম্ভব তা বোধগম্য নয়। তা ছাড়া সংগৃহীত মূলধন বা আমানতের ওপর এরূপ বিশাল অংশ কমিশন দেওয়ার কারণে সমিতির মূলধন বা আমানতে বড় ধরনের ক্ষয় হচ্ছে বিধায় সমিতি যেকোনো সময় বড় ধরনের ঝুঁকির মুখে বিনিয়োগকারী ও আমানতকারীদের দায়দেনা পরিশোধে ব্যর্থ হয়ে দেউলিয়া হতে পারে মর্মে পরিদর্শন দল মনে করে।'
©somewhere in net ltd.