নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

নিষাদ

আমি জানি আমি জানি না

ব্যতীপাত

স্থপতি

ব্যতীপাত › বিস্তারিত পোস্টঃ

ইসলামে অসমাপ্ত দীপায়ন কালের স্ফুলিঙ্গ

২৮ শে জানুয়ারি, ২০১৫ সকাল ৮:৫৫

জগৎ বিখ্যাত দার্শনিক আবু রুশদ্ (১১২৭-১১৯৭) কে যে লেখার জন্য স্পেনের তৎকালীন মুসলিম খলীফা ‘মামুন মরক্কোতে নির্বাসিত করেন এবং যে লেখার জন্য এই মহান দার্শণিকের বহুগ্রন্থ জ্বালিয়ে দেয়া হয় , যেই লেখা চোখ খুলেছিল পশ্চিমের,লর্ড বেকন থেকে বিজ্ঞানী কপারনিকাস- যার থেকে ইটালীসহ পশ্চিমে রেনেসাঁ আর দীপায়ন সম্ভব হয়েছিল তারই কিছু সার সংক্ষেপ করেছিলেন বাংলা সাহিত্যের বরণীয় লেখক মোহাম্মদ বরকতুল্লাহ(১৮৯৮-১৯৭৪) তার বিখ্যাত গ‌্রন্থ ‘পারস্য প্রতিভা’তে । বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের আলোকিত মানুষে’ আন্দোলনের পথিকৃত আব্দুল্লাহ আবু সায়দীও এই লেখাটি তাদের সম্পাদিত ‘পারস্য প্রতিভা’ থেকে বাতিল করেছেন ।

সেই নিবন্ধের নির্বাচিত কিছু অংশ ।মূল লেখাটি সাধু ভাষায় ।আমি চলিত ভাষায় রূপান্তরিত করেছি কিছুটা বুঝবার সুবিধার জন্য । বাংলাবাজারের ‘হাওলাদার প্রকাশনা’ ১৯২৪ সালে প্রকাশিত মূল বইটির পুনর্মুদ্রন করেছেন ।

পারস্য প্রতিভা'র -ভুমিকা থেকে নির্বাচিত কিছু অংশ

--‘সকল ধর্মেরই দুইটি অঙ্গ আছে- সত্য ও রূপ । সত্য হচ্ছে ধর্মের প্রাণ ,আর রূপ তার দেহ ।রূপের ভেতর দিয়ে সত্য আপনাকে প্রকাশ করে ।সত্যের অভাবে ধর্মের বাহ্যরূপ আচার পরম্পরা মাত্রে পর্যবসিত হয় , আর রূপের অভাবে ধর্ম কল্পনা বা অব্যবহার্য দর্শণে পরিণত হয় । লৌকিক ধর্ম এই দুয়েরই সমষ্টি । আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস ইসলামের সত্য ; আর নামাজ, রোযা, দান-খয়রাত, ত্যাগ ও সংযম ইত্যাদি বিবিধ প্রচেষ্টা হচ্ছে তার রূপ । সত্য সকল ধর্মেরই এক, বিরোধ শুধু রূপ নিয়ে । সকল নদীই সাগরসঙ্গমে ছুটে চলেছে , বিরোধ শুধু গতি পথে । মুসলমানের মসজিদ, হিন্দুর মন্দির ,ইহুদী বা খৃষ্টানের গির্জা, সকল প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য একই :অথচ এদের বৈশিষ্ট ও গৌরব রক্ষার জন্য কত যুগ যুগ ধরেই না এই সকল জাতি পরস্পরের রক্তে হস্ত কলঙ্কিত করেছে এবং করছে । স্রষ্টাকে সন্তুষ্ট করার অজুহাতে তার এই সুন্দর সৃষ্টির উপর দিয়ে অবলীলাক্রমে নৃশংস ধ্বংসের স্রোত বইয়ে দিয়েছে । যুগে যুগে দেশ কাল ও সভ্যতার পার্থক্য অনুসারে এই যে ধর্মের বিভিন্নরূপ পৃথিবীর বক্ষে প্রস্ফুটিত হয়েছে, এর কোনটি কতদূর সত্য , তা কে নির্ণয় করবে ! নিরপেক্ষ দার্শনিকের সংস্কারহীন চক্ষে হয়ত এর একটি অপরটির অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ প্রতীয়মান নাও হতে পারে । কেননা , এর একটি তেমনভাবে বিধাতার নির্বাচিত হলে অপরগুলির উদ্ভব নিতান্ত অর্থহীন হয়ে পড়ে । পরন্তু প্রত্যেক জাতির ধর্মাচরণের উপর তার যুগ ও সভ্যতার ছাপ আছে । চিন্তাশীল যাজক ও শাস্ত্রকারগণ নিজ নিজ ধর্মকে যেভাবে রূপ ও ব্যখ্যা দান করেন , তা সেভাবেই মূর্ত হয়ে ওঠে ।যীশুর একেশ্বরবাদ রোমান ক্যাথলিকদের কাছে এক রূপ ধারণ করলো, আবার প্রোটেস্টান্টদের হাতে তার রূপ হলো অন্যরকম। ইসলামেই কি রপভেদ অল্প? হযরতের তিরোধানের সঙ্গে সঙ্গেই তার মহান শিক্ষা সুন্নীর কাছে লাভ করলো একরূপ, আর শিয়ার কাছে গ্রহন করলো অন্য রূপ। ক্রমে আরও যে কত রূপ অনুরূপ, প্রতিরূপের সৃষ্ঠি হলো ইতিহাস তার সাক্ষী আছে।

আবার দেখুন ,খোদ আল্লাহ সম্পর্কে ধারণা যুগে যুগে কিরূপ পরিবর্তন লাভ করেছে । প্রাচীন বর্বরতার যুগে মানুষ যখন মানুষকে ক্ষমা করতে জানতো না, শুধু প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে লোলুপ থাকত‌ো ,তখনকার শাস্ত্রে আল্লাহ কল্পিত হয়েছেন ভীষণ দন্ডধারী রূপে । তিনি যেন সর্বদা অপরাধীকে চরম দন্ড দিবার জন্যই ব্যগ্র । তাঁর নিয়মের কণামাত্র ব্যত্যয় হলেই তার উপর ভীমবজ্র নিপতিত হবে, এটিই ছিল সেকালের প্রধান শিক্ষা ।ক্রমে মানুষের ভিতর যখন সুকুমার বৃত্তি সমুহের উন্মেষ হলো তখনকার আল্লাহ হলেন দয়াল পিতা। আর তার প্রেরিত পুরুষ যীশু হলেন সেই দয়াল পিতার পুত্র । আরও পরবর্তী যুগে সাম জগৎকে শোনাল আল্লাহ একাধারে দন্ডধারী ও দয়াল, প্রতিপালক ও ন্যায় বিচারক ।

কিন্তু দার্শনিক বলেন,এই যে আল্লাহকে দয়াল, দন্ডদাতা ইত্যাদি ভাবে ধারণা করা-এটাও একপ্রকার সসীমের মাপকাঠি দিয়ে অসীমকে বোঝার চেষ্টা ।এই যে অসীমকে সসীম মানুষের মত করে দেখা এটাই হচ্ছে একরকম রূপ দেয়া ।যিনি সকল মানুষের অতীত তাকে যে কোন প্রকারে ব্যক্ত করার প্রয়াস,এটি হচ্ছে তাঁকে রূপের পিঞ্ছরে পুরা। অথচ মানুষ চিরদিন এই ধৃষ্ঠতা করে আসছে এবং এতেই যত অশান্তি ও বিপ্লবের সূচনা ।

ইবনে রুশদ্ বললেন- আমি ধর্মের সত্যকে মাথার মানিক করে তুলে রাখবো , কিন্তু আমি এই বিশেষ আকার বা রূপকে মানতে পারব না । তুমি ইহুদী , সেই তুমি ‘অনন্ত’ কে খুঁজতে যাও তোমার উপাসনা ঘরে ।তুমি বলছো এখানে না এলে কেউ পরিত্রাণ পাবে না । খৃষ্টানও যাচ্ছে সেই অনন্ত’কে পূজা করতে তার গীর্জায় । সে আবার বলছে এখানে না এলে কেউ যীশু’র কৃপা পাবে না । মুসলমানও যাচ্ছে সেই অনন্তকেই অর্চনা করতে তার মসজিদে ।সে বলছে-এই ছন্দোবদ্ধ নামায ব্যতীত তোমার কোন মুক্তি নাই। আবার দেখুন, ওই হিন্দুও তার মন্দিরে শঙ্খ বাজিয়ে সেই পরম ব্রম্মের ভজনা করছে, তার মতে উহাই মুক্তির একমাত্র উপায় । বৌদ্ধ যার কোন উপাস্য নাই-সেও একটা বলবার মত কথা গুছিয়ে নিয়েছে ।তাদেরও হীনযান মহাযান নামে দুই বিশাল গ্রন্থ আছে ।সেও ভাবে মুক্তির সন্ধান সে তোমাকে বলে দিতে পারে যদি তুমি তার পথের পথিক হও ।

ইবনে রুশদ বলছেন-আমি এই বাঁধা বুলি, পাকা পথ চাই না ; আমি কারও গন্ডির সীমানায় আবদ্ধ হতে চাইনা । যে অনন্ত অনাদি পরাৎপরএই বিশ্বের অনুতে অনুতে অবিরাম তরঙ্গায়িত হচ্ছে, প্রতি আত্মার নিভৃত প্রদেশে যার স্পন্দন জাগছে-তার জন্য এই গন্ডীর প্রাচীর দাঁড় করানোর প্রয়োজন কি ?আমি চাই সেই ধর্ম, যা অনাড়ম্বর নিছক সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত- বিরাট,মহীয়ান ও সার্বজনীন । আমার অন্তরের ভিতরে যিনি বিরাজ করছেন,যার চৈতন্যে আমার আত্মা সতত সচেতন, তাকে খোঁজবার জন্য আমার পীর-পুরোহিতের কোন প্রয়োজন নাই ,কোন গীর্জা-মসজিদেরও আমি অপেক্ষা রাখি না । অন্তরের ধন পশ্চাতে রেখে আমি কার ‘পরে সিজদা করবো ?

যে আজীবন একটা ধর্মের ভিতরই নিমজ্জিত, তার চিন্তা তো সেই ধর্মের ভিতরেই থাকে, বাইরে যেতে তার অন্তরাত্মা পাপের ভয়ে শিউরে ওঠে ।

বহু ধর্মের একত্র সমাবেশ যে দেখেছে, সে সীমার লঘূত্ব বুঝেছে ।কোনও একটি ধর্মের মাহাত্য তাকে আর অবিভূত করে রাখতে পারে না ।ক্রসেডে খৃষ্টান,ইহুদী ও মুসলমান এই ত্রিধারার সমন্বয়ে আরবীয় দার্শনিকগন সেই মুক্তির সারা পেয়েই দুসাহসী হয়ে উঠেছিলেন ।

ইবনে রুশদ্ বললেন-এই যে বিপুল ব্রম্মান্ড দেখছো এটা সেই বিশ্ব স্রষ্টারই মূর্ত বিকাশ ।তিনি ব্রম্মান্ড ব্যপিয়া রয়েছেন,এর যা কিছু সবই তাতেই বিরাজিত,তারই জীবনে জীবিত ।এই যে আমাদের আত্মা, এটিও তাঁরই অংশ;দেহের বন্ধন কাটালেই জীব-আত্মা ও পরমাত্মা সব এক হয়ে যায় ।এই যে মিলন , এই মিলনই আমাদের শেষ মিলন,মানব জীবনের এখানেই যবনিকা পতন। তারপর অন্য কিছু থাকতে পারে না ।পাপপূণ্য ধর্ম-অধর্ম সমস্তই ইহজীবন পর্যবসিত হয়, ইহজীবনই এর লীলাক্ষেত্র । সীমা ছাড়িয়ে যে অনন্তে মিশে গেল তার আর সুখদু:খ পাপপুণ্য কি ? সে তখন সকল ভেদ বিচারের অতীত সেই আল্লাহরই অঙ্গীভূত , তাহাতেই বিলীন । ( ক্রমশ:)

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.