![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
২০০৪/২০০৫ সাল। সময়টি বাংলাদেশের ইতিহাসের একটি কলঙ্কজনক অধ্যায়। বাংলাদেশ তখন বোমাবাজদের অভয়ারণ্য। আদালতে বোমা, রাস্তায় বোমা, বাসে বোমা, ট্রেনে বোমা, মিটিং-এ বোমা, সমাবেশে বোমা; চোরাগোপ্তা বোমার আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত জাতি। শত শত স্বজন হারানো মানুষের নিরূপায় আহাজারি ও কোটি কোটি মানুষের আতঙ্কমিশ্রিত দিনাতিপাত- বাংলাদেশে জঙ্গি-উত্থানলগ্নের সার্বিক চিত্র ছিল এমনই। কিন্তু জাতির সৌভাগ্য যে, সে ভয়াবহতা বেশিদিন স্থায়ী হয় নি। কেন হয় নি সেটা সকলেরই জানা।
ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে দেশবাসী ওই সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠেছিল বিধায় বাংলাদেশ জঙ্গিবাদের ভয়াল থাবা থেকে রক্ষা পেয়েছিল। সারা দেশের মিডিয়া একযোগে জঙ্গিদের বিরুদ্ধে প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে সাধারণ মানুষকে সচেতন করার চেষ্টা করেছিল। অন্যদিকে বুদ্ধিজীবীরাও ওই দুর্যোগময় মুহূর্তে করণীয় সম্পর্কে দিক নির্দেশনা প্রদান করেছিলেন একের পর এক সেমিনার, আলোচনা, কনফারেন্স বা বৈঠকের মাধ্যমে। ছিল আন্তর্জাতিক তৎপরতাও। লাখো মানুষের ক্ষোভ ঘৃণায় রূপান্তরিত হয়েছিল ওই সব মানুষের প্রতি যারা মানবতার কবর রচনা করে জনজীবনকে দুর্বিসহ ও বিপর্যস্ত করে তোলে, বিনা অপরাধে সাধারণ মানুষের ওপর বোমা নিক্ষেপ করে। জঙ্গিদের অমন সন্ত্রাসী কার্যকলাপে দেশের অনেক আলেম-ওলামাকেও তখন রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করতে ও জঙ্গিদের বিচারের শক্ত দাবি ওঠাতে দেখা গেছে। জঙ্গি দমনে সরকারের আন্তরিকতাও ছিল চোখে পড়ার মতো। দেশবাসী দেখেছে প্রশাসনের সার্বিক প্রচেষ্টায় কীভাবে একের পর এক জঙ্গি গ্রেফতার হয় এবং দ্রুত বিচারে দোষীদের শাস্তির আওতায় আনা হয়। খুব অল্প দিনের মধ্যে শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন জঙ্গিকে ফাঁসি দেওয়া হয়।
হ্যাঁ, জঙ্গিদের বিরুদ্ধে যা করণীয় ছিল বাস্তবে আন্তরিকতার সাথে সেটাই করা হয়েছে। এ ব্যাপারে আমাদের প্রশ্ন নেই। আমাদের প্রশ্ন হলো- যে সন্ত্রাসী কাজ করার কারণে জেএমবি জঙ্গিদের বিরুদ্ধে সারাদেশ ফুঁসে উঠেছিল আজকের কথিত গণতান্ত্রিক দলের নেতাকর্মীরা প্রকাশ্য দিবালোকে ও রাতের আঁধারে ওই একই সন্ত্রাসী কাজ করার পরও এদের বিরুদ্ধে সকলে তৎপর নয় কেন? ধর্মের কথা বলে বোমা মারলে সেটা জঙ্গিবাদ, আর রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে চলন্ত গাড়িতে বোমা মেরে জীবন্ত মানুষ পোড়ালে তা নিছক রাজনৈতিক সঙ্কট- এ দ্বিচারিতার কারণ কী?
আজকাল পত্রিকার পাতা খুললে, টেলিভিশনের খবর দেখলে আঁতকে উঠতে হয়। মানুষ কত নির্মম হতে পারে! নৃশংস হতে পারে! পথে-ঘাটে হুটহাট বোমা ফুটছে। যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ছে। ব্যবসা-বাণিজ্যে ধস নামছে। নৃশংসভাবে পুড়িয়ে মারা হচ্ছে নিরীহ ঘুমন্ত পরিবহনকর্মীকে, বাসযাত্রীকে; নির্বিচারে ভেঙ্গে চুরমার করা হচ্ছে কোটি কোটি টাকার যানবাহন। বাচ্চারা স্কুলে যাচ্ছে কিন্তু চেহারায় উচ্ছ্বাস নেই, আছে কেবল ভয় ও শঙ্কা। আগুনের ভয়, বোমার ভয়, ইট-পাটকেলের ভয়। অফিসগামীরা অফিস যাচ্ছে, কিন্তু মনে শঙ্কা- ঠিকঠাক ফিরে আসতে পারবে তো? কেউবা পরিস্থিতি বুঝে অফিস ছুটি নিয়ে গ্রামের পথে রওনা দিচ্ছে, যদিও জানে না কবে এ যুদ্ধাবস্থা পরিবর্তন হবে, শান্তি ও স্বাভাবিক স্থিতিশীলতা আদৌ ফিরে আসবে কি না।
সাধারণ মানুষের কথা থাক, যে বিচারালয়ে আইনের প্রয়োগ ঘটানো হয় মানুষের আস্থার প্রতীক সেই বিচারালয়েরই বইয়ের ভেতর থেকে যখন বোমা উদ্ধার করা হয়, বাথরুম থেকে গুলিসহ পিস্তল উদ্ধার করা হয় তখন আর বুঝতে বাকি থাকে না যে, ওই জাতির নিরাপত্তার খুঁটি কতটা নড়বড়ে। জেলা প্রশাসকদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার অনেক জেলাতে বিজিবি মোতায়েন করেছে অনেক আগেই। ওদিকে ব্যাপক সন্ত্রাসের সামনে র্যাব-পুলিশের অবস্থা লেজে-গোবরে। সাত দিনের মধ্যে দেশের পরিস্থিতি শান্ত হবার কথা শোনা যাচ্ছিল মাসখানেক ধরে। সেই সাত দিন আর অতিবাহিত হচ্ছে না। সহিংসতার দেড় মাস অতিক্রান্ত হলেও আজও দেশের অচলাবস্থা অপরিবর্তিত। অবস্থাটা বিবেচনা করুন। সারা দেশ নিরাপত্তহীনতায়। হয় হরতাল-অবরোধ, নয়তো সমাবেশ, মিছিল, বিক্ষোভ, সংঘর্ষ- প্রতিদিনই দেশে কিছু না কিছু ঘটেই চলেছে। ঘটছে কোনো নির্দিষ্ট জায়গায় নয়, দেশজুড়ে, এক সাথে, এক দিনে। কিন্তু আশ্চর্য্যরে বিষয় হলো এই যে, এ সহিংসতা-সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জাতি ঐক্যবদ্ধ নয়, মিডিয়া দায়িত্বশীল নয়, বুদ্ধিজীবী-সুশীলরাও এই সহিংসতা-সন্ত্রাসকে দেখছেন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে, ভিন্ন প্রিজমে। তাদের অনেকে কৌশলে সন্ত্রাসকে এক প্রকার সমর্থনই করছেন। ওদিকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনও থাকছে আড়ালে-আবডালে।
এমনটা হবার কারণ কী? জেএমবি বোমা মারায় যারা তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করল, সকলে মিলে একযোগে জঙ্গিবাদকে রুখে দিল, সেই তারাই গণতান্ত্রিক বোমাবাজদের বিরুদ্ধে শৈথিল্য প্রদর্শন করছেন কেন? এর কারণ কি এই যে, চলমান সন্ত্রাস ধর্মের নাম হচ্ছে না, হচ্ছে গণতন্ত্রের নামে?
আমি বলছি না যে, ধর্মান্ধতাকে পুঁজি করে যারা সন্ত্রাস করে তাদেরকে শাস্তি দেওয়া যাবে না। তারা অবশ্যই আইনানুগ শাস্তির যোগ্য। অন্যায় করলে তার শাস্তি তাকে পেতে হবে, তা যেই করুক না কেন, যে উদ্দেশ্যেই করুক না কেন। ধর্মের জন্য করেছে তাই সে জঙ্গি, উগ্রবাদী, আর গণতন্ত্র আনয়নের জন্য করেছে তাই সে উদারবাদী-সম্মানিত- তা তো হতে পারে না। উভয়ক্ষেত্রেই একই দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োজন। আজ কি জেলায় জেলায় বোমা ফুটছে না? পুলিশ মরছে না? আদালতে, সম্মানিত ব্যক্তির বাসায় বোমা ফুটছে না? বাস-ট্রাক, ট্রেনে নাশকতা হচ্ছে না? জনমনে আতঙ্ক, ভয়, ভীতির উদ্রেক হচ্ছে না? ছেলে-মেয়েদের শিক্ষায় বাধা আসছে না? ব্যবসা-বাণিজ্যে বিঘœ ঘটছে না? আন্তর্জাতিকভাবে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হচ্ছে না? এসব যদি ন্যায় হয়, উচিত কাজ হয় তাহলে তো জঙ্গিদেরও কোনো দোষ দেয়া যায় না। তারা তাহলে কী দোষ করেছিল? কোন দোষে তাদেরকে শাস্তি দেওয়া হলো? আর যদি এসব কাজকে অন্যায় ও সন্ত্রাস বলা হয় তাহলে যারা এসব করছে তাদেরকেও সন্ত্রাসী বা উগ্রপন্থী বলতে হবে। এদের বিরুদ্ধেও সারা দেশের ফুঁসে ওঠা উচিত।
শুধু আজ নয়, বছরের পর বছর ধরে আমাদের রাজনীতিক টাইমলাইনে এ ধরনের কর্মকাণ্ডেরই পুনরাবৃত্তি ঘটে চলেছে। অতীতে হয়েছে, আজ হচ্ছে, ভবিষ্যতেও হবে না তা বলা যাচ্ছে না। কোনো নির্দিষ্ট দল নয়, গণতন্ত্রের বুলি আওড়ানো প্রায় সব দলকেই আমরা কোনো না কোনো সময় এ ধরনের সন্ত্রাসী কাজ-কর্মে লিপ্ত হতে দেখেছি। কিন্তু তাদেরকে সন্ত্রাসী হিসেবে ঘৃণার চোখে দেখা তো দূরের কথা মানুষ হাসিমুখে ভোট দিয়েছে, নির্বাচিত করেছে, প্রকারান্তরে আরেকটি যুদ্ধাবস্থা সৃষ্টির পথ তৈরি করে দিয়েছে। কেন এ জনবিরোধী কাজ অনায়াসে চলে আসছে আর আমরা ষোল কোটি বাঙালি তা মাথা পেতে নিচ্ছি? গণতন্ত্রের নামে এ প্রতারণা আর কতকাল দেখব?
©somewhere in net ltd.