নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

https://www.facebook.com/asadali.ht

মোহাম্মদ আসাদ আলী

সাংবাদিক

মোহাম্মদ আসাদ আলী › বিস্তারিত পোস্টঃ

বাঘ কেন বিড়াল? জাতি কেন নিধনের দর্শক?

২৫ শে মার্চ, ২০১৫ রাত ৮:৫০

মানবসমাজ ও মনুষ্যত্বকে আলাদা করে ভাবার উপায় নেই। অভিধান বলছে, ‘মানবসমাজ হচ্ছে পরস্পর সহযোগিতা ও সহানুভূতির সঙ্গে বসবাসকারী মনুষ্যগোষ্ঠী।’ যে সমাজের প্রতিটি সদস্য একে অপরের সুখ-শান্তি, বিপদ-আপদ সবকিছু ভাগাভাগি করে চলে অর্থাৎ যে সমাজে মনুষ্যত্ব আছে সেটাই হচ্ছে মানবসমাজ। সমাজে বসবাসকারী মানুষের পারস্পরিক এই সহানুভূতিপূর্ণ মানসিক অবস্থাকে সমাজের একটি অলিখিত নিরাপত্তা চুক্তিও বলা যায়। শুধু মানুষের দ্বারাই এমন সমাজ গড়ে তোলা সম্ভব হয়, মানুষের আশারাফুল মাখলুকাত হওয়ার এটা একটি বড় কারণ।
কিন্তু বর্তমানে আমাদের এই সমাজ উল্লিখিত সংজ্ঞা থেকে বহুদূরে অবস্থান করছে। মানুষের মানসিক অবস্থা সমাজের অস্তিত্বের প্রশ্নে বিরাট এক অশনিসংকেত হয়ে দাঁড়িয়েছে। সম্প্রীতি, সহযোগিতা, সৌহার্দ্য, দয়া-ভালোবাসার লেশটুকুও হারিয়ে যেতে বসেছে। জনাকীর্ণ পরিবেশে একজন মানুষকে কুপিয়ে-পিটিয়ে হত্যা করা হচ্ছে, কেউ তার জীবন রক্ষায় এগিয়ে আসছে না। হামলা প্রতিহত করা তো দূরের কথা, হামলাকারীরা চলে যাওয়ার পর আহত লোকটিকে যে হাসপাতালে নেবে, সে ন্যূনতম দায়িত্ববোধও মানুষ দেখাচ্ছে না। একজন ব্রিটিশ প্রশাসক বাঙালি জাতি সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছিলেন, ইবহমধষরং ধৎব রহফরারফঁধষষু পড়ধিৎফং নঁঃ পড়ষষবপঃরাবষু পৎঁবষ. অর্থাৎ বাঙালিরা একা থাকলে ভীরু, সমষ্টিগতভাবে নিষ্ঠুর।’ আমরা দেখেছি পকেট মার বা ছিঁচকে চোর বাগে পেলে কী হিংস্র আক্রোশে তাকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে এই বাঙালি। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাতেও তারা দুর্বলের বিরুদ্ধে ভয়াবহ নিষ্ঠুরতা দেখাতে পারে। কিন্তু যখন জনসমাগমপূর্ণ স্থানে সকলের চোখের সামনে মাত্র দু’- একজন সন্ত্রাসী বোমাবাজী করে মানুষ হত্যা করছে, দেশের সম্পদ ধ্বংস করছে, তাদেরকে প্রতিরোধ না করে আক্রান্ত মানুষগুলোকে অসহায় অবস্থায় ফেলে রেখে শত শত মানুষ ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়াচ্ছে, পালাচ্ছে। এমন দৃশ্য বাঘের আক্রমণে ভেড়ার পালের বেলায় মেনে নেওয়া গেলেও আল্লাহর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানুষের বেলায় কীভাবে মানা যায়? তার তো কথা ছিল নিজের জীবনে ঝুঁকি নিয়ে হলেও অন্যের বিপদে এগিয়ে আসার। কথা ছিল সমাজের একটি মানুষের দুঃখ, দুর্দশায় পুরো সমাজের অন্তরাত্মা কেঁপে উঠার। তাহলে কীসে মানুষকে তাদের দায়িত্ব পালন থেকে বিরত রাখছে?
দু’টি বিষয়। প্রথমত, সাধারণ মানুষ মনে করছে এই কাজ অর্থাৎ সন্ত্রাসী, আক্রমণকারী বা ভাঙচুরকারীদের প্রতিহত করার দায়িত্ব তাদের নয়। এটা পুলিশের কাজ। এ কাজ করার জন্যই তারা রাষ্ট্রকে কর দেয়। এ ধ্যান-ধারণা থেকে যে কোনো ব্যক্তি বা ব্যক্তিসমষ্টি রাষ্ট্রের যে কোনো স্থানে ক্ষতির শিকার হলে মনে করা হয় সে দায়ভার সংশ্লিষ্ট এলাকার সাধারণ মানুষের নয়, বরং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর। সন্ত্রাসীদের শাস্তির আওতায় আনতে না পারলে তাতেও সাধারণ মানুষের কোনো দায়ভার থাকে না, সর্ববিচারে সরকারি বাহিনীকেই দোষারোপ করা হয়।
দ্বিতীয়ত, সন্ত্রাসীদের দ্বারা নিজে আক্রান্ত হওয়ার ভয়। এছাড়াও আইনী ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ার ভয়। সহিংসতার ঘটনা প্রত্যক্ষদর্শীরা প্রায়শই চেপে যান, কারণ ঘটনার সাক্ষী হলে সময় নষ্ট, বিবিধপ্রকার হয়রানি থেকে শুরু করে নিজের জীবনের উপরও বিপদ আসতে পারে ইত্যাদি।
এই দু’টি কারণেই মূলত অন্যের বিপদে এগিয়ে যাওয়ার চেতনা মানুষ হারিয়ে ফেলেছে। সমাজ যেন তার সংজ্ঞা থেকেই সরে যেতে চাইছে। পশ্চিমা বস্তুবাদী ‘সভ্যতা’র প্রভাবে অনাদিকাল থেকে সহযোগিতার ভিত্তিতে পরিচালিত মানবসমাজ এখন পরিচালিত হচ্ছে স্বার্থচিন্তা ও আর্থিক লেনদেনের ভিত্তিতে। কিন্তু সমাজের এই দিক পরিবর্তনের সাথে সাথে যে সকলের ভাগ্যও পরিবর্তিত হচ্ছে, সকলের জীবনও যে অনিরাপদ হয়ে উঠছে সে হিসাব রাখছেন কয়জন?
অন্যায়, অবিচার, হিংসা, বিদ্বেষ, রক্তপাত সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বাসা বেঁধেছে, ভবিষ্যৎকে করছে আরও বিপদজনক। মানবসমাজে পারস্পরিক আস্থা বিকল্পহীন একটি অমূল্য সম্পদ, অথচ আজ কেউ কাউকে বিশ্বাস করে না। বিশ্বাসহীনতা এমন এক হাহাকারের রূপ নিয়েছে যে, রাস্তা-ঘাটে, অলি-গলিতে হেঁটে চলা মাত্র দু’জন মানুষও একে অপরকে ছিনতাইকারী বলে সন্দেহ করতে থাকে। আর যার ব্যবসায়িক বা রাজনীতিক প্রতিপক্ষ আছে তার প্রতিটি মুহূর্তই কাটে আতঙ্কে। একটা মেয়ে কোথাও পথ হারিয়ে ফেললে কাউকে জিজ্ঞেস করতেও ভরসা পায় না। মানুষগুলো যে সুস্থ শরীরে জীবিত আছে, সেটাই যেন তার অনেক বড় পাওয়া। বস্তুত সমাজ যখন স্বার্থচিন্তার মোহে অন্ধ হয়ে অনিরাপত্তায় ছেয়ে যায়, নৈতিক শিক্ষার অবমূল্যায়নের ফলে যখন প্রতিটি মানুষ অপরাধপ্রবণ হয়ে পড়ে তখন যে কোনো মানুষই অন্যায়ভাবে আক্রান্ত হতে পারে। প্রতিটি মানুষের জন্য একটি করে বডিগার্ড সরকার কখনোই নিয়োগ দিতে পারবে না। তাই এ সমাজে যারা আক্রান্ত হয় তারা তো হয়-ই, যারা আক্রান্ত হয় না তাদেরও তখন এ কথা বলার উপায় নেই যে, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থার কারণেই সে আক্রান্ত হয় নি। আসলে সে আক্রান্ত হয় নি, কারণ সৌভাগ্যক্রমে সন্ত্রাসীরা তাকে টার্গেট করে নি। যদি টার্গেট করতো মাটির নিচে, বনে-জঙ্গলে, পাহাড়ের গুহায় যেখানেই সে থাকুক না কেন, সে আক্রান্ত হতোই। অপরদিকে কেবল সন্ত্রাসীরাই নয়, সরকারি বাহিনীগুলোর অনেক অসাধু সদস্যও আজকাল পেশাদার খুনির ভূমিকা নিয়ে চুক্তিভিত্তিক খুন, গুম, ক্রসফায়ার করছে, অনেক সন্ত্রাসীও সরকারি বাহিনীর পরিচয় দিয়ে অপকর্মগুলো করছে। অর্থাৎ এক কথায় আমাদের সমাজকাঠামো ধ্বংস হয়ে গেছে। একটি বস্তুর ক্ষুদ্রতম কণা অর্থাৎ অনু-পরমাণুগুলো যদি তাদের বৈশিষ্ট্য হারিয়ে ভিন্ন বৈশিষ্ট্য ধারণ করে তাহলে সেটা আর ঐ বস্তুই থাকে না, অন্য বস্তু হয়ে যায়। যেমন তাপ দেওয়ার কারণে একটি চুম্বকের অনুগুলো যদি আকর্ষণ শক্তি হারিয়ে ফেলে সেটা আর চুম্বক থাকে না। বর্তমানে মানবসমাজের ক্ষুদ্রতম ইউনিট (ব্যক্তি) তাদের চরিত্র বা বৈশিষ্ট্য হারিয়েছে, ফলে সমাজটিও তার ধর্ম হারিয়ে এমন এক বিশৃঙ্খল ভিড়ে পরিণত হয়েছে যার কোনো কল্যাণকর দিকই অবশিষ্ট নেই।
মানবসমাজ বস্তুর অণু-পরমাণুর ন্যায় অনেক মানুষের সমন্বয়ে গঠিত এমন একটি অবস্থা যেখানে প্রতিটি মানুষ একজন অপরজনের উপর নির্ভরশীল থাকে এবং পারস্পরিক ঐক্য, ভ্রাতৃত্ব, সৌহার্দ্য, সহযোগিতা, সহানুভূতির বন্ধনে আবদ্ধ থাকে। সমাজ নামক এই বস্তুতে যখন স্বার্থচিন্তা মহামারির মতো ছড়িয়ে পড়ে, মানুষের মধ্যে থেকে দয়া-ভালোবাসা, সম্প্রীতি, সৌহার্দ্য নামক গুণগুলো ততই শিথিল হতে থাকে। ফলে বৃহৎ সমাজকাঠামোর প্রতিটি ইউনিট অর্থাৎ ব্যক্তিগুলো একে অপর থেকে দূরে সরে যায় আর সমাজও ক্রমশই তার স্বতন্ত্রতা হারাতে থাকে। এরই চূড়ান্ত পরিণতি ভোগ করছি আমরা।
এমতাবস্থায় র‌্যাব-পুলিশ নয়, আইন-আদলত নয়, একমাত্র সমাধান হলো- মানুষের মানসিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটিয়ে তার হারানো গুণগুলো অর্থাৎ সহযোগিতা, সহমর্মিতা, পারস্পরিক সম্প্রীতি, সৌহার্দ্য, ভালোবাসা ইত্যাদি ফিরিয়ে আনা। নিশ্চিত ধ্বংস থেকে সমাজকে রক্ষা করার আর কোনো উপায় নেই। মানুষের চরিত্রের মেরুদণ্ড তার শিক্ষা, তাই তার চরিত্র পরিবর্তন করতে সঠিক শিক্ষা দিতে হবে। সেই নৈতিক ও চারিত্রিক শিক্ষায় ধর্মের গুরুত্ব অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। মানুষের মনে যদি সর্বদা স্রষ্টার উপস্থিতির বোধ জাগ্রত থাকে, আখেরাতে বিচারের সম্মুখীন হওয়ার ভয় জাগ্রত থাকে তাহলে আল্লাহর ভয়ে সে অপরাধ করা থেকে বিরত থাকবে। মানুষের মনে যদি দেশপ্রেম জাগ্রত থাকে তাহলে তার চোখের সামনে দেশ ও জাতির কোনো ক্ষতি কেউ করতে পারবে না। মানুষ যদি বুঝতে পারে যে, দুর্বৃত্তকে বাধা দিতে গিয়ে বা বিপন্ন মানুষকে রক্ষা করতে গিয়ে মৃত্যুবরণ করলেও সেটা শাহাদাত, এর বিনিময়ে সে আল্লাহর কাছ থেকে জান্নাতে আশা করে তাহলে মানুষ অন্যের বিপদে এগিয়ে যাবে। মানুষ যদি বুঝতে পারে যে, রাস্তাঘাট নির্মাণ করার ক্ষেত্রে অর্থদানও সদকায়ে জারিয়া তাহলে জাতির কল্যাণে মানুষের ভূমিকা বৃদ্ধি পাবে। তখন সমাজে ঐ কথাটি প্রতিষ্ঠিত হবে যে, “সকলের তরে সকলে আমরা, প্রত্যেকে মোরা পরের তরে।”
আজ মানুষের ঈমান ধর্মব্যবসায়ীদের দ্বারা ভুলপথে পরিচালিত হওয়ার কারণে তা সমাজ রক্ষায় ভূমিকা রাখতে পারছে না। এখনই সময়, তাদের ঈমানকে ধর্মব্যবসায়ীদের থাবা থেকে মুক্ত করতে হবে, তাকে বোঝাতে হবে, ইসলাম অর্থ শান্তি, তাই সমাজের মানুষ যেন শান্তিতে থাকে সে লক্ষ্যে কাজ করাই ইসলামের মূল কাজ, মুসলিমের মূল এবাদত। মানুষের ঈমানকেই যদি সঠিক পথে প্রবাহিত করা হয় তাহলে তা এই মুমূর্ষু জাতির জন্য মহৌষধের মতো কাজ করবে। মানুষ ও মানবসমাজ উভয়ই নিজ নিজ ধর্ম ফিরে পাবে। তখন তারা এককভাবে হবে সাহসী, সামষ্টিকভাবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে যোদ্ধা জাতি অর্থাৎ রহফরারফঁধষষু ভবধৎষবংং ধহফ পড়ষষবপঃরাবষু ধ সরমযঃ. অন্যথায় যতই প্রচেষ্টা করা হোক, যতই আইন রচনা করা হোক, যতই আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সদস্য সংখ্যা ও তৎপরতা বৃদ্ধি করা হোক সমাজ কেবল ধ্বংসের পথেই এগোবে, মানুষও শান্তি পাবে না।

মন্তব্য ১ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (১) মন্তব্য লিখুন

১| ২৫ শে মার্চ, ২০১৫ রাত ১০:৪২

অন্ধবিন্দু বলেছেন:
মোহাম্মদ আসাদ আলী,
অতি উত্তম কথা। কিন্তু আমরা যে শুনছি না। দেখেও দেখছি না।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.