নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

https://www.facebook.com/asadali.ht

মোহাম্মদ আসাদ আলী

সাংবাদিক

মোহাম্মদ আসাদ আলী › বিস্তারিত পোস্টঃ

ধর্মবিশ্বাস: এক বৃহৎ সমস্যার সহজ সমাধান

২১ শে এপ্রিল, ২০১৫ রাত ১০:১৮

আমাদের দেশসহ সমগ্র মানবজাতি আজ ব্যক্তিগত, সামাজিক ও জাতীয় পর্যায়ে ভয়াবহ সঙ্কট অতিক্রম করছে। এ সঙ্কট থেকে বাঁচার জন্য বিভিন্ন উপায় অবলম্বন করা হচ্ছে, একটার পর একটা জীবনব্যবস্থা ও বিধি-বিধান পরিবর্তন করে দেখা হচ্ছে। কিন্তু কোনোভাবেই শান্তি, স্থিতিশীলতা এবং ঐক্য স্থাপিত হচ্ছে না। এ অবস্থার পেছনে প্রচলিত রাজনীতিক সিস্টেমের পাশাপাশি ধর্মের অপব্যবহার একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর বা নিয়ামক হিসাবে কাজ করছে। ধর্মের প্রতি অনুভূতিশীল বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর ধর্মবিশ্বাস বা ঈমানকে এ পর্যন্ত ধর্মব্যবসায়ী শ্রেণি বারবার ভুল পথে পরিচালিত করেছে। ব্যক্তিগতভাবে ব্যতিক্রম কিছু লোক বাদে আমরা অধিকাংশ মানুষই স্রষ্টা, নবী-রসুল, পরকাল, জান্নাত-জাহান্নাম ইত্যাদি বিশ্বাস করি। এ ধর্মবিশ্বাসকে এক শ্রেণির ধর্মব্যবসায়ী রাজনীতিক স্বার্থে ব্যবহার করে থাকে। তারা ধর্মরক্ষার নাম করে মানুষকে সহিংসতার পথে ঠেলে দেয়। কেউবা জেহাদের কথা বলে মানুষকে জঙ্গি কার্যক্রমে উদ্বুদ্ধ করে। আবার কেউ মুর্দা-দাফন, নামায পড়ানো, ওয়াজ করা থেকে শুরু করে পরকালীন মুক্তির অসিলা সেজে অঢেল সম্পদের মালিক বনে যাচ্ছে। কিন্তু এসবের দ্বারা মানুষের আদৌ কি কোনো উপকার হচ্ছে? না। বরং মানুষ ধর্মব্যবসায়ীদের প্রতারণার শিকার হয়ে দুনিয়া ও আখেরাত দুটোই হারাচ্ছে। কীভাবে- ব্যাখ্যা করছি।
ইসলামের সকল আলেম-ওলামা ও ফকীহগণ একমত যে- আকিদা ঠিক না থাকলে ঈমানের কোনো মূল্য নেই। আর স্বভাবতই ঈমানের মূল্য না থাকলে ঐ ঈমানভিত্তিক আমলেরও কোনো মূল্য থাকে না। তাই ইসলাম-শিক্ষা বইগুলোর প্রথমেই থাকে ‘আকায়েদ’ অধ্যায়। সেই মহামূল্যবান আকিদা কী? আকিদা হচ্ছে কোনো বস্তু বা বিষয় সম্পর্কে সম্যক ধারণা (Comprehensive concept)। কোনো কাজ কী উদ্দেশ্যে করা হবে- সেটা জেনে বুঝে করাই আকিদা। ঘড়ির কাজ সময় দেওয়া, কলমের কাজ লেখা। এটা বোঝাই ঘড়ি ও কলম সম্পর্কে সঠিক আকিদা। এটা জানা না থাকলে সেগুলো সঠিকভাবে ব্যবহার করা যাবে না। একইভাবে আমাদেরকে জানতে হবে কেন আমরা ঈমান পোষণ করব, ধর্ম বলতে কী বোঝায়, ধার্মিক কারা, কোন কাজটি প্রকৃত এবাদত, নবী-রসুলদের আগমনের উদ্দেশ্য কী, নামায-রোযা-হজ্ব ইত্যাদি কেন আল্লাহ করতে বলেছেন। এ বিষয়গুলো সম্পর্কে সঠিক ধারণা বিগত ১৩০০ বছর ধরে ক্রমে ক্রমে বিকৃত হয়ে গেছে। তাই মানবজাতির ধর্মবিশ্বাস থাকলেও আকিদা ঠিক নেই, ফলে আমলও অর্থহীন হচ্ছে। যেমন- ইসলামকে আজ একটি ব্যক্তিগত ও আনুষ্ঠানিকতার ধর্ম বলে ধারণা করার ফলে নামায, রোযা, ঈদ, কোরবানি, শবে বরাত, আশুরা ইত্যাদি কিছু আনুষ্ঠানিক বিষয় পালন করেই মুসলিমরা মনে করেন যে বুঝি ইসলামের কাজ করা হলো। কিন্তু ইসলাম তো তা নয়। ইসলাম শব্দটি এসেছে সালাম থেকে আর সালাম মানেই শান্তি। অর্থাৎ ইসলাম হচ্ছে সমাজের এমন একটি অবস্থা যেখানে কোনো অন্যায়, অবিচার, মারামারি-কাটাকাটি, দুঃখ-দারিদ্র্য, দুশ্চিন্তা বা আতঙ্ক থাকবে না, সর্বত্র থাকবে কেবল শান্তি, নিরাপত্তা, সর্বপ্রকার স্বাধীনতার অনাবিল আনন্দ। এমন একটি সমাজ সৃষ্টির জন্য কাজ না করে যত নামায, রোযাই করা হোক, সবই অর্থহীন। এজন্যই আজকের দুনিয়ায় মসজিদ, মাদ্রাসা, খানকা, মুসল্লি বা রোযাদারের অভাব নেই, কিন্তু সবচেয়ে অশান্তির মধ্যে আছে মুসলিম নামের এ জনসংখ্যা। তাদের মধ্যে ইসলাম নেই, অর্থাৎ শান্তি নেই।
‘ধর্ম ব্যক্তিগত আর রাষ্ট্র সামষ্টিক’- এমন ধারণা সৃষ্টি হয়েছে মাত্র কয়েক শতাব্দী আগে; যখন ইউরোপে একটি বস্তুবাদী সভ্যতা স্থাপিত হয় যার মূলভাব হচ্ছে, “বর্তমানের এই জ্ঞান-বিজ্ঞান আর প্রযুক্তির যুগে ধর্ম আর প্রযোজ্য নয়। যারা ব্যক্তিগতভাবে স্রষ্টায় বিশ্বাস করতে চায়, উপাসনা করতে চায় করুক, কিন্তু ধর্ম দিয়ে রাষ্ট্র চলবে না, রাষ্ট্র চলবে মানুষের তৈরি জীবনব্যবস্থা দিয়ে।” এই দর্শনকে বাস্তবরূপ দিতে গিয়ে প্রচারমাধ্যম ও শিক্ষা-ব্যবস্থার মাধ্যমে ধর্মকেই মুছে ফেলার প্রয়াস চালানো হয়েছে। ধর্মকে পশ্চাৎপদতা, কুসংস্কার, অন্ধত্ব ইত্যাদি আখ্যা দিয়ে মানুষকে ধর্মহীন করে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু তা সফল হয় নি। কারণ প্রতিটি মানুষের মধ্যে স্রষ্টার আত্মা, রূহ আছে (সুরা হিজর ২৯)। মানুষের হাতে আছে ধর্মগ্রন্থ যা স্রষ্টার স্বাক্ষর বহন করছে। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে সর্বত্র ছড়িয়ে আছে স্রষ্টা, প্রভুর নিদর্শন যার সামনে মানুষের মস্তক অবনত হয়। যখনই তারা বিপদাপন্ন হয় তখন প্রতি নিঃশ্বাসে তাদের স্রষ্টা, প্রভুর কাছেই আশ্রয় চায়। ইউরোপীয়রা ধর্মকে ব্যক্তিজীবনে নির্বাসন দিয়েছিল কারণ ঈসা (আ.) যে শিক্ষা নিয়ে এসেছিলেন সেটা ছিল মূলত ব্যক্তির আত্মিক পরিশুদ্ধির জন্য। জাতীয় জীবন পরিচালনার বিধান তাঁর আনার প্রয়োজন পড়ে নি, কেননা সেটা পূর্বের কেতাব তওরাতেই ছিল। কিন্তু ইউরোপে শুধু খ্রিষ্টধর্মের শিক্ষা দিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার চেষ্টা করা হয়েছিল। ফলে তাতে দণ্ডবিধি, অর্থনীতি ইত্যাদি না থাকায় ধর্মযাজকরা নিজেরাই নিজেদের মনগড়া বিধানকে ঈশ্বরের বিধান বলে চালিয়ে দিতেন। সমগ্র ইউরোপেই কয়েক শ’ বছর ধরে রাষ্ট্র ও চার্চের মধ্যে স্বার্থ ও কর্তৃত্ব নিয়ে প্রচণ্ড বিরোধ চলেছিল, লক্ষ লক্ষ মানুষ নিহত হয়েছিল, মধ্যযুগীয় বর্বরতার শিকার হয়েছিল কোটি কোটি মানুষ। উপায়ন্তর না পেয়ে ১৫৩৭ সনে ব্রিটিশ রাজা অষ্টম হেনরির সময়ে ধর্মকে ব্যক্তিজীবনে আবদ্ধ করা হয় এবং রাজা হন সার্বভৌম কর্তৃত্বের মালিক। এই রাষ্ট্রনীতি সমগ্র ইউরোপে গৃহীত হয়। কিন্তু ইসলামে যেহেতু মানুষের সামগ্রিক জীবনের বিধান আছে, তাই মুসলিমদের ধর্মকে ব্যক্তি জীবনে সীমাবদ্ধ রাখার কোনো সুযোগ নেই। তবুও ইউরোপীয়রা যে মুসলিম দেশগুলো দখল করে নিয়েছিল সেখানে জাতীয় জীবন থেকে ইসলামকে ছেটে ব্যক্তিজীবনে সীমিত করে ফেলা হলো। আর ইউরোপের রাষ্ট্রব্যবস্থা এখানেও চাপিয়ে দেওয়ার হলো। কিন্তু আল্লাহ যাকে দুটো সুস্থ পা দিয়েছেন সে কেন হুইল চেয়ারে চলাফেরা করবে? তাই ইউরোপের রাষ্ট্রব্যবস্থা বিগত তিনশো বছরে মুসলিমদের উপর যতই চাপানোর চেষ্টা করা হোক সেটা তাদের জীবনে ও চিন্তা-চেতনায় সামগ্রিকভাবে গৃহিত হলো না। তাদের মধ্যে সামষ্টিক জীবনে ইসলাম প্রতিষ্ঠার চেতনা জাগ্রত থাকল। এখানেই ঘটল বিপত্তি। তাদের সামনে যে ইসলামটি আছে সেটা আর প্রকৃত রূপে নেই, সেটা বহু আগেই বিকৃত ও বিপরীতমুখী হয়ে গেছে, সেটা দিয়ে আর শান্তি আসবে না। উপরন্তু সেটা অতিবিশ্লেষণকারী আলেমদের দ্বারা এতটাই জটিল ও দুর্বোধ্য রূপ নিয়েছে যে সেটা সাধারণ মানুষের জ্ঞানের বাইরে চলে গেছে। তাই ধর্মীয় বিষয়ে তারা ধর্মব্যবসায়ীদের উপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল হয়ে পড়ল আর ধর্মব্যবসায়ীরাও মানুষের ঈমানকে ভুল পথে চালিত করে স্বার্থ হাসিল করতে সচেষ্ট হলো। শান্তির ধর্ম হয়ে গেল অশান্তির উৎস।
আমাদেরকে আজ বুঝতে হবে, যে ঈমান দুনিয়াতে নিপীড়িত মানুষের মুক্তি ও শান্তির কাজে লাগে না সে ঈমান আখেরাতেও জান্নাত দিতে পারবে না। এজন্যই আল্লাহ আমাদেরকে দোয়া করতে শিখিয়েছেন, “হে আমাদের প্রভু! আমাদের দুনিয়ার জীবনকে সুন্দর, মঙ্গলময় করো এবং আমাদের আখেরাতের জীবনকেও সুন্দর, মঙ্গলময় করো এবং আমাদেরকে আগুনের শাস্তি থেকে রক্ষা করো (সুরা বাকারা ২০১)।” বর্তমানে এ জাতির ঈমান, আমল সবই পরকালের সুন্দর জীবনের আশায় অথচ তাদের দুনিয়ার জীবন দুর্দশায় পূর্ণ অর্থাৎ অসুন্দর। কারণ তাদের ধর্মবিশ্বাস ধর্মব্যবসায়ীদের দ্বারা মানবজাতির অকল্যাণে ব্যবহৃত হচ্ছে। কাজেই মানুষের ঈমানকে সঠিক পথে (To right track) পরিচালিত করা গেলে তা জাতির উন্নতি-প্রগতি-সমৃদ্ধির কাজে লাগবে। এজন্য প্রথমেই ধর্মের কয়েকটি মৌলিক বিষয় সম্পর্কে প্রতিষ্ঠিত ভুল ধারণা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে।
ধর্ম কী? ধার্মিক কারা?

ধর্ম শব্দের অর্থ ধারণ করা। কোনো বস্তু, প্রাণি বা শক্তি যে বৈশিষ্ট্য বা গুণ ধারণ করে সেটাই হচ্ছে তার ধর্ম। আগুনের ধর্ম পোড়ানো। পোড়ানোর ক্ষমতা হারালে সে তার ধর্ম হারালো। মানুষের ধর্ম কী? মানুষের ধর্ম হচ্ছে মানবতা। অর্থাৎ যে ব্যক্তি অন্যের দুঃখ-কষ্ট হৃদয়ে অনুভব করে এবং সেটা দূর করার জন্য আপ্রাণ প্রচেষ্টা চালায় সে-ই ধার্মিক। অথচ প্রচলিত ধারণা হচ্ছে যে ব্যক্তি নির্দিষ্ট লেবাস ধারণ করে সুরা কালাম, শাস্ত্র মুখস্থ বলতে পারে, নামায-রোযা, পূজা, প্রার্থনা করে সে-ই ধার্মিক।
এবাদত কী?
আল্লাহর এবাদত করার জন্যই মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে (সুরা যারিয়াত ৫৬)। এবাদত হচ্ছে যাকে যে কাজের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে সেই কাজটি করা। গাড়ি তৈরি হয়েছে পরিবহনের কাজে ব্যবহারের জন্য, এটা করাই গাড়ির এবাদত। আল্লাহ মানুষ সৃষ্টি করেছেন তাঁর প্রতিনিধি (Representative) হিসাবে (সুরা বাকারা-৩০)। অর্থাৎ সমগ্র সৃষ্টিকে আল্লাহ যেভাবে সুশৃঙ্খল, শান্তিপূর্ণ রেখেছেন ঠিক সেভাবে এ পৃথিবীকে শান্তিপূর্ণ ও সুশৃঙ্খল রাখাই মানুষের এবাদত। ধরুন আপনি গভীর রাত্রে প্রার্থনায় মগ্ন। হঠাৎ পাশের বাড়ি থেকে ‘আগুন আগুন’ বলে আর্তচিৎকার ভেসে এল। আপনি কী করবেন? দৌড়ে যাবেন সাহায্য করতে নাকি চোখ-কান বন্ধ করে প্রার্থনা চালিয়ে যাবেন। যদি আগুন নেভাতে যান সেটাই হবে আপনার এবাদত। আর যদি ভাবেন- বিপন্ন ব্যক্তি অন্য ধর্মের লোক, তাহলে আপনার মধ্যে মানুষের ধর্ম নেই, আপনার নামায-রোযা, প্রার্থনা সবই পণ্ডশ্রম।
প্রমাণ: আল্লাহ মুসা (আ.) কে বলছেন, ‘আমিই আল্লাহ, আমি ব্যতীত কোন এলাহ (হুকুমদাতা) নেই, অতএব আমার এবাদত কর এবং আমার স্মরণার্থে সালাহ কায়েম কর (সুরা ত্বা-হা: ১৪)। এমনই আরো অনেক আয়াত থেকে সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে এবাদত ও সালাহ আলাদা বিষয়। প্রকৃতপক্ষে এবাদত হচ্ছে আল্লাহ কর্তৃক অর্পিত দায়িত্ব। মুসার (আ.) দায়িত্ব অর্থাৎ এবাদত কী ছিল তা আল্লাহ তাঁকে জানিয়ে দিলেন। বললেন, ‘ফেরাউনের নিকট যাও, সে দারুণ উদ্ধত হয়ে গেছে (সুরা ত্বা-হা: ২৪)। আল্লাহ তাঁকে ফেরাউনের কাছে পাঠালেন অত্যাচারিত, নির্যাতিত, নিষ্পেষিত ইহুদি জাতিকে দাসত্বের কবল থেকে মুক্ত করে তাদের মানবাধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য, মানবতা প্রতিষ্ঠা করার জন্য।
সমাজের যারা আল্লাহওয়ালা লোক তারা সমাজকে অপশক্তির হাতে ছেড়ে দিয়ে ব্যক্তিগত নাজাতের চিন্তায় মশগুল, আর ধর্মব্যবসায়ীরা ব্যস্ত স্বার্থসন্ধানে। যে ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলো পালন করলে তাদের রোজগার ও ভোজনবিলাসের সম্ভাবনা থাকে সেগুলোকেই তারা জোর দেন। মসজিদে-মাদ্রাসায় দান করার জন্য দানবাক্স-মাইক নিয়ে তাদেরকে ওয়াজ করতে দেখা যায়, কিন্তু ব্রিজ, কালভার্ট, রাস্তাঘাট, হাসপাতাল বা বাসগৃহ নির্মাণ অর্থাৎ কোনো প্রকার জাতীয় উন্নয়নের কাজে অংশ নিতে তারা মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেন না। পুণ্য লাভের আশায় মানুষ মসজিদ মন্দির নির্মাণের ক্ষেত্রে সর্বোত্তম নির্মাণ-সামগ্রী ব্যবহার করে, এগুলো শত শত বছর টিকে থাকে, কিন্তু ব্রিজ, রাস্তাঘাট, আশ্রয়কেন্দ্র ইত্যাদি তৈরির সময় ভেজাল সামগ্রী ব্যবহার করা হয়, ফলে সেগুলো কিছু দিন না যেতেই ভেঙ্গে পড়ে। কিন্তু এই স্থাপনাগুলো নির্মাণ কি এবাদত নয়? এবাদতের সঠিক অর্থ না বোঝার কারণে নির্যাতিতের হাহাকার, ক্ষুধার্তের ক্রন্দন মহা ধার্মিকদের কানে প্রবেশ করে না। এগুলোকে দুনিয়াবি কাজ বলে এড়িয়ে যাবার মত পাশবিক মনোবৃত্তি তাদের তৈরি হয়েছে।
প্রশ্ন উঠতে পারে, তাহলে কি নামায, রোযা, হজ্ব করতে হবে না? হ্যাঁ, অবশ্যই করতে হবে, কিন্তু আকিদা বুঝে। মানুষের কল্যাণে নিঃস্বার্থভাবে কাজ করার শারীরিক সক্ষমতা ও আত্মিক শক্তি ও প্রবণতা সবার থাকে না। এটা সৃষ্টির প্রশিক্ষণ (Training) হচ্ছে নামায, রোযা, হজ্ব ইত্যাদি। এগুলো উদ্দেশ্য অর্জনের প্রশিক্ষণ, উদ্দেশ্য হচ্ছে শান্তি। যে মানবতার কল্যাণে সংগ্রাম করবে না, অন্য মানুষের দুঃখ-দুর্দশা ঘোঁচাতে সম্পদ ব্যয় করবে না, তার তাহাজ্জুদ হবে ঘুম নষ্ট করা, রোযা হবে না খেয়ে থাকা; অন্য আমলের কী দশা হবে ভেবে দেখুন। আল্লাহর রসুল ও তাঁর সাহাবীরা আজীবন মানুষের মুক্তির জন্য সংগ্রাম করে গেছেন, এটা করতে গিয়ে তাঁরা নিঃস্ব হয়ে গেছেন। সকল ধর্মের অবতার ও মহামানবদের জীবনেও রয়েছে শান্তিময় সমাজ বিনির্মাণে নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার ইতিহাস। অথচ আজকের সমাজে মানুষের ধর্মীয় জীবনের নেতৃত্ব দানকারী ধর্মব্যবসায়ী আলেম-পুরোহিতরা মানুষকে কেবল পরকালমুখী হতে শিক্ষা দেন। ফলে দেখা যায় যে যত বড় ধার্মিক সে তত বেশি নির্বিরোধী। অন্যায়ের প্রতিবাদ করার ইচ্ছা বা সাহস কোনোটাই তাদের থাকে না। কারণ অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোকে তারা এবাদত মনে করেন না, এবাদত বলতে কেবল নামায-রোযাই বোঝেন। এ জন্য উপাসনালয়ের চার দেওয়ালের অভ্যন্তরকেই তারা বেছে নিয়েছেন। ইতিহাস বলে, আরবের হানাহানি, রক্তপাত, দাঙ্গা-হাঙ্গামা লিপ্ত, অশিক্ষা, কুসংস্কারে নিমজ্জিত একটি জাতিকে রসুলাল্লাহ এমন একটি সভ্য জাতিতে পরিণত করেছিলেন যারা জ্ঞান-বিজ্ঞানে, শিক্ষা-দীক্ষায়, সামরিক ও আর্থিক শক্তিতে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জাতিতে পরিণত হয়েছিল। একজন যুবতী সারা দেহে অলঙ্কার পরিহিত অবস্থায় শত শত মাইল পথ অতিক্রম করত, তার মনে কোনো ক্ষয়-ক্ষতির আশঙ্কা জাগ্রত হতো না। মাসের পর মাস আদালতে অপরাধ সংক্রান্ত কোনো অভিযোগ আসতো না। সারাদিন খুঁজেও দান গ্রহণ করার মতো কাউকে পাওয়া যেত না। এটাই ইসলামের সমাজ। সুতরাং নির্দিষ্ট কোনো লেবাস ধারণ করাই ইসলাম নয়, বরং শান্তিপূর্ণ সমাজই হচ্ছে ইসলাম।
আমরা যদি এটা বুঝতে পারি তাহলে বিরাট বিরাট কাজ যেটা রাষ্ট্রের পক্ষে দুরূহ, সেটা ঈমান থেকে উদ্বুদ্ধ হয়ে সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সহজসাধ্য হয়ে উঠতে পারে, প্রয়োজন শুধু সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি অর্থাৎ আকিদা। বর্তমানের রাষ্ট্রব্যবস্থায় নির্দিষ্ট মেয়াদ অন্তর ভোট দিয়েই জনগণ মনে করে যে তাদের দায়িত্ব শেষ। এ রাষ্ট্রব্যবস্থায় যারা অভ্যস্ত হয়ে ওঠেন তারা চোখের সামনে অপরাধ হতে দেখলেও বাধা দেন না, ভাবেন, ‘এগুলো দেখার দায়িত্ব তো আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর। আমি কেন খামাখা নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়াতে যাবো।’ আজকে আমাদের যে জাতীয় সংকট, তা এই আত্মকেন্দ্রিকতা ও স্বার্থপরতার ফল, কারণ এই ধর্মহীন ব্যবস্থাকে আমরাই টিকিয়ে রেখেছি। ধর্মবিশ্বাসকে রাষ্ট্রীয় ও জাতীয় কল্যাণে সম্পৃক্ত না করে এই সংকট থেকে মুক্তির কোনো সম্ভাবনা নেই।
ধর্মের প্রকৃত অর্থ যিনি বুঝবেন তিনি ব্রিজ-কালভার্ট, হাসপাতাল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বনাঞ্চল ইত্যাদি ধ্বংস না করে এগুলো নির্মাণ ও সংরক্ষণের কাজ করবেন। প্রকৃত এবাদত কী এটা বুঝলে মানুষ ধ্বংসাত্মক কাজ তো করবেই না বরং সবাই মিলে দাঙ্গা-হাঙ্গামা সৃষ্টিকারীদের প্রতিরোধ করবে। রাষ্ট্রের ব্যয় নির্বাহের জন্য জনগণের কাছ থেকে কর আদায় করা হয়। সেই কর আদায়ে মানুষের ইচ্ছার প্রতিফলন নাও ঘটতে পারে। কিন্তু আমরা যদি বুঝতে পারি যে, রাষ্ট্রের উন্নয়নে দান করলে সেটাও আমাদের আখেরাতের পাথেয় হবে, তাহলে জাতীয় কর্মকাণ্ডে অর্থ ও শ্রম মানুষ স্বেচ্ছায় প্রদান করবে। এক্ষেত্রে রাষ্ট্র পরিচালনায় সম্পৃক্ত ব্যক্তিদেরকে সত্য ন্যায়ের উপর প্রতিষ্ঠিত হতেই হবে, দুর্নীতিপরায়ণ হলে চলবে না। উচ্চ পর্যায়ে ন্যায় প্রতিষ্ঠিত না হলে সাধারণ মানুষকে ন্যায়ের পথে পরিচালিত করা যায় না।
ঔপনিবেশিক যুগ থেকে পাশ্চাত্যের যে ষড়যন্ত্রমূলক জীবনব্যবস্থা (দীন) আমাদের কাঁধে চেপে বসেছে তার মূলনীতিই হচ্ছে Divide & Rule অর্থাৎ ভাগ করে শাসন করো। এখানে সরকারি দলের সঙ্গে বিরোধীদলের শত্র“তা যেমন অনিবার্য তেমনি জাতির মধ্যে হাজারো রাজনীতিক কোন্দল অনিবার্য। এই অপ-সংস্কৃতির কালসাপকে আমরা দুধ-কলা দিয়ে পুষে চলেছি যদিও এর বিষাক্ত ছোবলে আমাদের সর্বাঙ্গ নীল হয়ে গেছে। এই রাজনীতিক সিস্টেমকে আগলে রেখে মুখে শান্তির বাণি প্রচার কেবল ব্যর্থ পরিহাসই নয়, মানুষের সঙ্গে প্রবঞ্চনা। তাই যদি মানবজাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতেই হয়, সেটা হতে হবে সত্যের ভিত্তিতে, মিথ্যা আশ্বাসের ভিত্তিতে নয়। সেই সত্য হচ্ছে সকল মানুষের একই স্রষ্টা, সকল ধর্ম এসেছে তাঁরই পক্ষ থেকে, সকল মানুষ একই বাবা-মা আদম (আ.) ও হাওয়ার সন্তান, সকল ধর্মের মূল উদ্দেশ্য মানবকল্যাণ। এই মহাসত্যের ভিত্তিতে মানবজাতিকে এক পরিবারে পরিণত করা সম্ভব। ঐক্য প্রতিষ্ঠা হলে অন্য সকল সমস্যার সমাধান সহজ হয়ে যাবে। তাই মানবজাতির ঐক্যই স্রষ্টার অভিপ্রায়, এজন্যই জাতির ঐক্য নষ্ট করা কুফর (হাদীস)। অথচ আজ রাজনীতিক দ্বন্দ্ব সংঘাত যেমন চলছে তেমনি ধর্মের নামেও জাতির মধ্যে নানা মত-পথ সৃষ্টি করে দাঙ্গা-হাঙ্গামা ঘটানো হচ্ছে। সেই দাঙ্গা-হাঙ্গামা নিবৃত্ত করার জন্য বল প্রয়োগের পথ অবলম্বন করছে সরকারগুলো। কিন্তু ধর্মের দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে যারা সহিংস কর্মকাণ্ড ঘটায় তাদেরকে কোনোদিনই বল প্রয়োগ করে সম্পূর্ণ নিবৃত্ত করা যায় নি, যাবেও না, বরং এতে তাদের উগ্রবাদী চেতনা বৃদ্ধি পায়। তাই ধর্মবিশ্বাস বিশ্বের রাষ্ট্রনায়কদের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। না পারা যাচ্ছে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর ধর্মবিশ্বাসকে অস্বীকার করতে, না পারা যাচ্ছে অবজ্ঞা করতে। কারণ এরাই ভোটার। এদের ধর্মবিশ্বাস যখন ধর্মব্যবসায়ীদের দ্বারা ভুল পথে পরিচালিত হয়, তখন রাষ্ট্রের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়ে যায়। যদি ধর্মান্ধগোষ্ঠীর হাতে রাষ্ট্রক্ষমতা ছেড়ে দেওয়া হয়, তারা তালেবানি রাষ্ট্র কায়েম করে ফেলে, পশ্চিমা পরাশক্তিগুলো দেশ দখল করে নেওয়ার মওকা পেয়ে যায়, আবার ধর্মকে একেবারে বাদ দেওয়াও যৌক্তিক নয়, সম্ভবও নয়। কেননা মানবসমাজে যেটুকু নীতি-নৈতিকতা আজও অবশিষ্ট আছে সেটা ধর্ম থেকেই উৎসারিত। ইতোমধ্যেই ধর্মকে জাতীয় জীবন থেকে বাদ দেওয়ায় সমাজে সর্বপ্রকার অপরাধ মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। যারা মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রগুলোর কর্ণধার, তাদের অধিকাংশই আল্লাহ-রসুলের প্রতি ঈমান রাখেন, নামায পড়েন, রোযা রাখেন, হজ্ব করেন- কিন্তু ধর্মকে রাষ্ট্রের ঐক্য, শৃঙ্খলা, উন্নতি, প্রগতির কাজে লাগাতে পারছেন না। এর মূল কারণ ঐ আকিদা, যে আকিদা বিকৃত হওয়ায় ধর্মের চেহারাই বিকৃত হয়ে গেছে। ফলে ধর্ম রাষ্ট্রীয় অঙ্গনে উদ্বোধনী তেলাওয়াত, ইফতার মাহফিল, চেহলাম, কবর যেয়ারতের মধ্যেই আটকে আছে।
এ গোলকধাঁধা থেকে মুক্তির উপায় অরাজনৈতিক আন্দোলন হেযবুত তওহীদের এমাম জনাব মোহাম্মদ বায়াজীদ খান পন্নী মানবজাতির সামনে উপস্থাপন করেছেন যা কাজে লাগিয়ে আমরা ধর্ম ও রাষ্ট্রের এই যে বিপরীতমুখী পথচলা, এটাকে একমুখী করতে পারি যাতে করে রাষ্ট্রব্যবস্থা ও ধর্মবিশ্বাস হাত ধরাধরি করে পথ চলে জাতিকে উন্নতি অগ্রগতির শীর্ষে নিয়ে যেতে পারে। আমরা সাধ্যমত চেষ্টা করে যাচ্ছি এ বিষয়টি সর্বস্তরের মানুষের সামনে তুলে ধরার জন্য। এ কাজে আমাদের কোনো আর্থিক বা রাজনীতিক স্বার্থ নেই। এ দেশের মাটিতে আমাদের জন্ম, এখানকার আলো-বাতাসে আমরা বড় হয়েছি, এ দেশের কল্যাণে কাজ করা আমাদের সামাজিক, মানবিক ও ঈমানী দায়িত্ব। মানুষের জন্য নিরাপদ ও প্রগতিশীল একটি সমাজ নির্মাণের প্রচেষ্টাকে আমরা এবাদত বলে বিশ্বাস করি। আমরা মনে করি, রাত জেগে তাহাজ্জুদ পড়া যেমন সওয়াবের কাজ, তেমনি মানুষ যেন নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারে তার জন্য পাহারা দেয়াও সওয়াবের কাজ। আল্লাহ মু’মিনের সংজ্ঞার মধ্যেই শান্তি প্রতিষ্ঠার এ প্রচেষ্টাকে স্থান দিয়েছেন (সুরা হুজরাত ১৫)। পক্ষান্তরে যারা শুধু নিজের স্বার্থে জীবন অতিবাহিত করে, সামষ্টিক শান্তির চিন্তা না করে কেবল নিজ সুখ-সমৃদ্ধির কথা ভাবে তারা তো পশুর জীবনযাপন করছে। পশুও খায়, সন্তান জন্ম দেয়, এক পর্যায়ে মারা যায়। স্বার্থপর মানুষও ঠিক ঐ রকম, তাদের আগমনে মানবজাতি কোনো উপকার পায় নি, তাই এদের মানবজনম ব্যর্থ।
আসুন, আমরা আমাদের ধর্মবিশ্বাসকে সঠিক পথে পরিচালিত করি। যে কাজ করলে মানুষ শান্তি পাবে, উপকৃত হবে, তাদের অভাব-অনটন, অশিক্ষা-কুশিক্ষা দূর হবে, অনৈক্য-হানাহানি দূর হবে সেই কাজ করি। তাহলেই আমরা বিশ্বের বুকে একটি সম্মানিত ও পরাশক্তিধর জাতি হিসাবে দাঁড়াতে পারব। আমরা ষোল কোটি মানুষ ন্যায়ের পক্ষে ঐক্যবদ্ধ হলে আমাদের উত্থানকে কেউ রুখে দিতে পারবে না এনশা’আল্লাহ।

হেযবুত তওহীদ, প্রতিষ্ঠাতা: টাঙ্গাইলের ঐতিহ্যবাহী পন্নী পরিবারের সন্তান জনাব মোহাম্মদ বায়াজীদ খান পন্নী।

মন্তব্য ২ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ২১ শে এপ্রিল, ২০১৫ রাত ১০:৩৬

প্রামানিক বলেছেন: লেখা ভাল লাগল। ধন্যবাদ

২| ২২ শে এপ্রিল, ২০১৫ রাত ১২:০১

তানভীরএফওয়ান বলেছেন: ধন্যবাদ

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.