![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আল্লাহ মানবজাতিকে শ্রমনির্ভর ও সামাজিক জীব হিসাবে সৃষ্টি করেছেন (সুরা বালাদ ৪)। তাই মানুষ যখন শ্রমনির্ভর না হয়ে পরনির্ভর হয়, সামাজিক না হয়ে স্বার্থকেন্দ্রিক হয় তখন অবধারিতভাবে এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয় এবং অপ্রাকৃতিক অবস্থার সৃষ্টি হয়। আর যে কোনো অপ্রাকৃতিক অবস্থাই অশান্তি ও বিপর্যয়ের কারণ হয়ে থাকে। এ কারণেই আমাদের সমাজে শ্রমবিমুখতা, শ্রমের অবমূল্যায়ন ও বেকারত্ব একটি বৃহৎ সমস্যা।
আমাদের সমাজের রাজনীতিকদের অনেকেই শ্রমিকের অধিকার নিয়ে সোচ্চার ভূমিকা পালন করেন। বিশেষ করে মে দিবস এলে তারা বেশি বেশি সভা-সমাবেশ করে নিজেদের নেতৃত্ব ও ক্ষমতাকে শানিয়ে নেন। সে তুলনায় মাদ্রাসা শিক্ষিত আলেম দাবিদার শ্রেণিটিকে আমরা শ্রমিকের অধিকার আদায়ের ক্ষেত্রে নীরব অবস্থানেই দেখতে পাই। তাদের এই নিষ্পৃহতার কারণ হচ্ছে,
প্রথমত, তারা ধর্ম বলতে নামাজ, রোজা, ওয়াজ ও মিলাদ মাহফিল ইত্যাদিকে বুঝে থাকেন। সমাজের অন্যায় অবিচার, বঞ্চিত শ্রেণির দুঃখ যন্ত্রণা লাঘব করার প্রচেষ্টার চেয়ে তসবিহর দানা গুনে গুনে আমলের পাল্লা ভারী করাকেই তারা নাজাতের কার্যকরী পথ বলে বিশ্বাস করেন। তারা শ্রমিকদের কষ্ট দূর করার মতো নিছক দুনিয়াবি কাজের চেয়ে শ্রমিকদের মসজিদে এনে নামাজ পড়াতেই বেশি সচেষ্ট। এবাদত, ধর্ম, আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের পথ ইত্যাদি সম্পর্কে বিকৃত ও বিপরীতমুখী ধারণার কারণে আলেমরা শ্রমিকদের দুঃখ, কষ্ট নিয়ে চিন্তিত নন।
দ্বিতীয়ত, পেশাদার আলেমগণ কেবল মাদ্রাসা-শিক্ষার বদৌলতে, কিছু দোয়া-কালাম, মাসলা মাসায়েল শিখে সেটাকে পুঁজি করে আরাম আয়েশে দিন কাটাতে চান এবং কাটিয়ে যাচ্ছেন। যারা বিনা পরিশ্রমে ঘরে বসে মুরগির রান খেয়ে অভ্যস্ত তারা শ্রমিকের হাড়ভাঙা খাটুনির মূল্য কীভাবে বুঝবেন? যাকে অন্ন সংস্থানের জন্য কখনো মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে হয় না, শ্রমিকের ঘাম শুকানোর আগেই তার মজুরি কেন পরিশোধ করতে হবে সেটা তিনি কী করে বুঝবেন?
তৃতীয়ত, আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস আলেম ওলামাদের দৃষ্টিতে ইসলামের সঙ্গেই সম্পৃক্ত নয়, যেহেতু এর উদ্ভবের সঙ্গে ইসলামের ইতিহাস বা মুসলিম উম্মাহর কোনো যোগসূত্র নেই। তাই মুসলিমদের জন্য মে দিবস পালন করাকে আলেম সাহেবরা কাফের মোশরেকদের অনুসরণ বা বেদাত বা অপ্রয়োজনীয় বলেই জ্ঞান করে থাকেন। সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির কারণে তারা এ মহাসত্যটি বুঝতে অক্ষম যে, ইসলাম এসেছে সমগ্র মানবজাতির জন্য। তাই সমগ্র মানবজাতির সুখ, শান্তি নিয়ে কাজ করা ইসলামেরই কাজ। তারা ভুলে যান যে, সমাজের শ্রমজীবী বঞ্চিত শ্রেণিকে মনুষ্যত্বের মর্যাদা দান করার মধ্যেই রয়েছে ইসলামের মাহাত্ম্য। আল্লাহর শেষ রসুল সেটাই করে গেছেন, মারিয়া কিবতিয়াকে (রা.) নিজের স্ত্রী রূপে বরণ করেছেন, উম্মে আয়মান ও যায়েদকে (রা.) দাসত্বের অবমাননা থেকে মুক্ত করে নিজের পরিবারের অন্তর্ভুক্ত করেছেন, অর্ধনগ্ন বেলালকে (রা.) উঠিয়েছে বায়তুল্লাহর শীর্ষে। সুতরাং বঞ্চিত শ্রেণির মুক্তি জন্য সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া উম্মতে মোহাম্মদীর জন্য অপরিহার্য কাজ, এটাই তাদের এবাদত।
আল্লাহর রসুল পরনির্ভরশীলতার বিরুদ্ধে আজীবন সোচ্চার ছিলেন। তিনি নিজেও জীবিকার জন্য পরিশ্রমের কাজ করতেন, রুটির বিনিময়ে একজন ইহুদির কুয়া থেকে তিনি পানি তুলে দিয়েছেন। তা ছাড়াও জেহাদের প্রয়োজনে সবচেয়ে বেশি কায়িক শ্রমের কাজগুলোতে তিনি সর্বাগ্রে থাকতেন। মসজিদে নববী নির্মাণ, খন্দক খননের সময় আমরা রসুলাল্লাহকে হাতুড়ি দিয়ে পাথর ভাঙতে, মাটি খনন করতে এবং মাথায় করে ইট ও মাটি বহন করতে দেখি। আমাদের আলেম সাহেবরা রসুলের এই সুন্নাহ পালনের প্রতি কতটুকু মনোযোগী?
আমাদের আদিপিতা আদমকে (আ.) সেই আদিম পৃথিবীর অনাবাদি জমিকে কৃষিজমিতে পরিণত করতে হয়েছে এবং কঠোর পরিশ্রম করে জীবনধারণ করতে হয়েছে। পবিত্র বাইবেলে বর্ণিত আছে, “তারপর প্রভু ঈশ্বর পুরুষকে (আদম) বললেন, “...ভূমি তোমাদের যে খাদ্য দেবে তার জন্যে এখন থেকে সারাজীবন তোমার অতি কঠিন পরিশ্রম করতে হবে। ভূমি তোমার জন্য কাঁটাঝোপ জন্ম দেবে এবং তোমাকে বুনো গাছপালা খেতে হবে। তোমার খাদ্যের জন্যে তুমি কঠোর পরিশ্রম করবে যে পর্যন্ত না মুখ ঘামে ভরে যায়। তুমি মরণ পর্যন্ত পরিশ্রম করবে, তারপর পুনরায় ধূলি হয়ে যাবে। আমি ধূলি থেকে তোমায় সৃষ্টি করেছি এবং মৃত্যু হবে পুনরায় তুমি ধূলিতে পরিণত হবে।”
সুতরাং আদমের সন্তানদেরও এই কাজই কর্তব্য যে তারা পরিশ্রম করে রোজগার করবে এবং পরিবারকে প্রতিপালন করবে। নামাজ (সালাহ) পড়ানোর বিনিময়ে বা অন্য যে কোনো ধর্মীয় কাজের বিনিময়ে অন্ন সংগ্রহ করা আল্লাহ হারাম করেছেন এবং একে আগুন খাওয়ার সঙ্গে তুলনা করেছেন (সুরা বাকারা ১৭৪)। আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছেন যে, ‘হে মো’মেনগণ! জুমার দিনে যখন সালাতের জন্য আজান দেয়া হয়, তখন তোমরা আল্লাহর স্মরণে ত্বরা কর এবং বেচা কেনা বন্ধ কর। এটা তোমাদের জন্য উত্তম, যদি তোমরা বোঝ। অতঃপর সালাহ সমাপ্ত হলে তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড় এবং আল্লাহর অনুগ্রহ তালাশ কর ও আল্লাহ কে অধিক স্মরণ কর, যাতে তোমরা সফলকাম হও (সুরা জুমা ৯, ১০)”। এ আয়াতটিতে (ক) মো’মেনদেরকে ব্যবসা বাণিজ্য ইত্যাদি উপায়ে রেজেক অন্বেষণের প্রতি নির্দেশ করা হয়েছে, (খ) সালাতের সময় ব্যবসা-বাণিজ্য সাময়িকভাবে বন্ধ রেখে সালাহ কায়েম করতে বলা হয়েছে, (গ) সালাহ শেষে আবার রেজেকের অন্বেষণে পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়তে বলা হয়েছে। লক্ষণীয় যে, হুজরাখানায় বসে থেকে মুসল্লিদের বাড়ি থেকে রেজেক আসার জন্য অপেক্ষা করতে বলা হয় নি। এমন কি জুম্মার দিনেও আল্লাহ মো’মেনদের জন্য কর্মবিরতির ঘোষণা দেন নি।
প্রকৃতপক্ষে ইসলামসহ সকল ধর্মই কর্মের প্রতি মানুষকে উৎসাহিত করেছে। বৈরাগ্যবাদ ও আলস্য উভয়ই ইসলাম নিষিদ্ধ করে, কারণ এতে সমাজের ভারসাম্য ধ্বংস হয়ে যায়। ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা যদি মানুষ পায় তবে তারা প্রচণ্ড গতিশীল ও কর্মমুখী হবেই। কোনো ধর্মেই ধর্মব্যবসা বা রাজননীতির নামে ব্যবসা করার করার স্থান নেই। মহানবী বলেছেন, “হে মানুষ! আমি তোমাদের উপদেশ দিচ্ছি, জীবিকা হাসিল করার জন্য সম্ভাব্য সকল উপায়ে জোর চেষ্টা কর এবং তোমাদের প্রচেষ্টার পরিপূর্ণতার জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া কর। এতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই যে, কোনো মো’মেনের সত্তাকে দুনিয়ায় বেকার এবং অনর্থক সৃষ্টি করা হয় নি। বরং তার জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত কর্ম ও কর্তব্যের সঙ্গে সংযুক্ত। কর্ম ও প্রচেষ্টার জন্য তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে। অল্পে সন্তুষ্টি এবং আল্লাহর প্রতি নির্ভরশীলতার অর্থ এ নয় যে, হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকা এবং নিজের বোঝা অন্যের উপর চাপিয়ে দেয়া। নিশ্চয় আল্লাহর উপর ভরসা রাখা আমাদের প্রধান কর্তব্য। কিন্তু রেযেক হাসিল করার জন্য প্রয়োজনীয় প্রচেষ্টা নিতান্তই জরুরি বিষয়।
আমি তোমাদেরকে অবহিত করছি যে, দুনিয়ায় যত নবী-রসুল এসেছেন তাদের সবাই জীবিকা উপার্জনের জন্য চেষ্টা-সাধনা করতেন এবং নিজেদের বোঝা অন্যের চাপিয়ে দিতেন না। অতএব, তোমরাও জীবিকা উপার্জনের জন্য কঠোর প্রচেষ্টা কর। কায়িক শ্রম, কুলির কাজ করা এবং লাকড়ির বোঝা নিজের মাথায় ওঠানো অন্যের কাছে হাত পাতার চেয়ে উত্তম। যার জীবিকা উপার্জনের সামর্থ্য রয়েছে অন্যের কাছে চাওয়া তার জন্য খুবই অপমানজনক। সে দুনিয়াতেও লাঞ্ছিত এবং শেষ বিচারের দিনও তাকে এমন অবস্থায় হাযির করা হবে যে তার চেহারায় গোশত থাকবে না। আমি পরিষ্কারভাবে তোমাদের বলছি, যার কাছে একদিনের খাদ্যও মজুদ রয়েছে তার জন্য হাত পাতা অবশ্যই হারাম। আমি জানি কোন কোন পীর ভিক্ষাবৃত্তিকে জায়েয বলেন, কিন্তু ইসলাম হাত-পা গুটিয়ে বসা এবং ভিক্ষাবৃত্তি গ্রহণ করাকে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করেছে। ইসলাম আমাদের হুকুম দিয়েছে যে, ‘দুনিয়ায় ছড়িয়ে যাও এবং আল্লাহর করুণা সন্ধান করো (সূরা জুমাহ-১০)।’ যে ভিক্ষাবৃত্তি থেকে বাঁচবে, নিজের পরিবার-পরিজনের ভরণপোষণ করা ও প্রতিবেশীর সাহায্য সহযোগিতা করার জন্য হালাল উপায়ে জীবিকা হাসিল করবে সে কেয়ামতের দিন পূর্ণিমার চাঁদের ন্যায় উজ্জ্বল চেহারা নিয়ে আল্লাহর দরবারে উপস্থিত হবে। দুনিয়াতেও তার জন্য সম্মান ও প্রতিপত্তি রয়েছে।” (ইসলামী ফাউন্ডেশন থেকে প্রকাশিত মহানবীর ভাষণ বই থেকে)। সুতরাং ধর্মের কাজ করার বিনিময়ে রোজগার করা একাধারে ভিক্ষাবৃত্তি ও ধর্মব্যসা যা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ তথা হারাম।
গীতায় বলা হয়েছে, “তুমি নিয়ত কর্ম কর; কর্মশূন্যতা (বেকারত্ব, কর্মবিমুখতা) অপেক্ষা কর্ম শ্রেষ্ঠ, কর্ম না করিলে তোমার দেহযাত্রাও নির্বাহ হইতে পারে না।” (কর্মযোগ অধ্যায়- শ্লোক-৮)।
ঈসা (আ.) বলেছেন- “আল্লাহ মানুষের শ্রম বিনিয়োগকে কপালের লিখন করে দিয়েছেন। আইয়ুব, যিনি আল্লাহর নবী বন্ধু ছিলেন তাঁর কথায়, ‘পাখির জন্ম যেমন উড়ে বেড়াবার জন্য, সাঁতার কাটার জন্য মৎস্যকুল, ঠিক তেমনি মানুষের সৃষ্টি হয়েছে শ্রমিকরূপে, কর্ম করে যাবার জন্য। অতএব যে মানুষ নয় সেই-ই শুধু এই নির্দেশের ঊর্ধ্বে।” (বার্নাবাসের বাইবেল- অধ্যায়-১১৪)। সুতরাং যে মানুষ শ্রম দিবে না, সে দুনিয়াতেও ক্ষতিগ্রস্ত হবে, আখেরাতেও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
সকল ধর্মগ্রন্থে অর্থাৎ সকল নবী শ্রমের মাধ্যমে জীবিকা অর্জনের জন্য নির্দেশ প্রদান করেছেন। শ্রমিক শ্রেণি আলেমদের দৃষ্টিতে ‘অধার্মিক’ হয়েও ধর্মের সেই শাশ্বত নির্দেশ মান্য করছেন। কিন্তু যারা ধর্মের ধ্বজাধারী তারা সেই নির্দেশকে আজীবন লংঘন করে যাচ্ছেন এবং পরনির্ভরশীলতাকেই ধর্ম বলে কার্যত প্রতিষ্ঠা করতে চাচ্ছেন। শ্রমিকের মর্যাদা বোঝার সাধ্য তার নেই। শ্রমিকের রক্ত যখন ঘাম হয়ে টপ টপ করে ঝরে পড়ে, তখনই যদি তার হাতে তার প্রাপ্য মজুরি তুলে দেওয়া হয়, তার চিত্তে যে আনন্দের ফল্গুধারা বয়ে যায় সেটা কেবল আরেকজন শ্রমিকই অনুভব করতে পারেন। এই হিসাবে একজন শ্রমজীবী কখনোই আরেকজন শ্রমিককে বঞ্চিত করবে না।
দ্বিতীয়ত, শ্রমিককে তার ন্যায্য অধিকার প্রদানের জন্য আল্লাহর প্রদত্ত হুকুম যে মান্য করবে সেও কখনো শ্রমিককে বঞ্চিত করবে না। এই দুটি চেতনার সমন্বয় না হলে কোনোদিন শ্রমিক তার প্রাপ্য অধিকার লাভ করবে না।
কেবল ধর্মজীবীরাই নয়, রাজনীতিজীবীরাও একটি পরনির্ভরশীল শ্রেণি। তাই তারা শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে যে রাজনীতিক বক্তব্য দিয়ে থাকেন সেটাও প্রবঞ্চনামূলক। এর পেছনে নিজেদের স্বার্থই তারা চরিতার্থ করতে চান। শ্রমিকদের হতাশা, বঞ্চনা, দুর্ভোগ, অসহায়ত্ব এই রাজনীতিকদের জীবিকার পুঁজিমাত্র। এই মহাসত্য সর্বাগ্রে শ্রমিকশ্রেণিকে অনুধাবন করতে হবে, যেন তারা আর এই প্রতারকদের ক্রীড়নক হিসাবে ব্যবহৃত না হন। আর পশ্চিমা বস্তুবাদী সভ্যতার অনুসারীদেরও মনে রাখা উচিত যে, তারাই শ্রমিকদেরকে যুগের পর যুগ, শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বঞ্চিত করেছে, শ্রমিদেরকে তাদের প্রাপ্য মর্যাদা ও অধিকার দেয় নি। যখন তাদের যুগসঞ্চিত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে, তারা নিজেদের অধিকার আদায়ের জন্য প্রতিবাদী হয়েছে তখনই তাদের বুকে চালানো হয়েছে গুলি। তাদের রক্তে রঞ্জিত হয়েছে শোষক শ্রেণি ঝকঝকে মেঝে। সেই পশ্চিমা বস্তুবাদী সভ্যতাই আবার মে দিবস পালনের নামে শ্রমিকদের নিয়ে নির্মম রাজনীতির সূচনা করেছে। কিন্তু, কার্যত এতে শ্রমিকদের যে কোনোই লাভ হয় নি, বরং দিন দিন তাদের বঞ্চনা ও হাহাকার বৃদ্ধি পাচ্ছে তা যে কোনো পরিসংখ্যান দেখলেই সুস্পষ্ট হয়ে যাবে।
০৪ ঠা মে, ২০১৫ সন্ধ্যা ৬:২৮
মোহাম্মদ আসাদ আলী বলেছেন: প্রথমেই বলে রাখি আমি অরাজনীতিক আন্দোলন হেযবুত তওহীদের সদস্য। হেযবুত তওহীদের কথা আনলাম এই কারণে যে, আপনি যে দাসপ্রথা নিয়ে আপত্তি তুলেছেন সে ব্যাপারে মুসলিমদের মধ্যেও হীনম্মন্যতা আছে। দাসপ্রথাকে অনেক মুসলিম মনে করে ইসলাম বৈধ করেছে। কিন্তু তা নয়। সেই প্রকৃত সত্যকে তুলে ধরেছে হেযবুত তওহীদ। দাসপ্রথা নিয়ে আমাদের আলাদা একটি বই-ই আছে। এখানে পত্রিকায় প্রকাশিত একটি কলাম পোস্ট করলাম। পড়লে অবশ্যই পরিষ্কার ধারণা পাবেন। আশা করি ইসলাম নিয়ে আপনার মধ্যে যে আপত্তি আছে তা আর থাকবে না। ধন্যবাদ।
-------------------------------------------------------------------------
মানুষ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে অন্যের উপর নির্ভরশীল। তাই তাকে চলতে হয় সমাজবদ্ধভাবে। একটি সমাজের সব মানুষ এক রকম নয়, তাদের শারীরিক যোগ্যতা, মেধা, দক্ষতার ক্ষেত্র, পছন্দ-অপছন্দ, রুচি, মন-মানসিকতায় প্রচুর বিভিন্নতা রয়েছে। এটি মহান আল্লাহর নিখুঁত সৃষ্টি নৈপুণ্যের স্বাক্ষর। এটা যদি না থাকত তাহলে, ভালো এবং মন্দের কোনো পার্থক্য থাকত না, ন্যায় অন্যায়ের কোনো পার্থক্য থাকত না সর্বোপরি সমাজে কোনো ভারসাম্য থাকত না। আল্লাহ বলেন, দুনিয়ার জীবনে এদের মধ্যে জীবন-যাপনের উপায়-উপকরণ আমি বণ্টন করেছি এবং এদের মধ্য থেকে কিছু লোককে অপর কিছু সংখ্যক লোকের ওপর অনেক বেশি মর্যাদা দিয়েছি, যাতে এরা একে অপরের সেবা গ্রহণ করতে পারে (সুরা যুখরুফ ৩২)। সুতরাং আল্লাহর অভিপ্রায় এমন এক সমাজব্যবস্থায় মানুষ বাস করুক যা গড়ে উঠবে পারস্পরিক আন্তরিক সেবা-বিনিময়ের উপর ভিত্তি করে।
এই সেবা দেয়া বা নেয়া প্রধানত দুই ভাবে হতে পারে। একটা হলো স্বেচ্ছায় বা স্বপ্রণোদিতভাবে, আরেকটি হলো অনিচ্ছায় বা বাধ্য হয়ে। সেবা প্রদানের পেছনে বস্তুগত যে কারণ থাকে তা হলো কর্মসংস্থান, অন্ন-বস্ত্র-আশ্রয় নিয়ে বেঁচে থাকা। দরিদ্র মানুষগুলি অবস্থাসম্পন্ন মানুষদের আনুগত্যে সমর্পিত হয় মূলত এ কারণেই, কিন্তু যখন এই আনুগত্য ও কাজ করে দেওয়ার ক্ষেত্রে আত্মার সংযোগ ঘটে, তখন এই সাহায্য সহযোগিতাগুলিই কর্তব্যবোধ, মানবতাবোধ, ভালোবাসা থেকে উৎসারিত হয়ে ইবাদতে পর্যবসিত হয়। অনাদিকাল থেকে মানুষ প্রধানত দু’টি কারণে অন্যের সেবা করে আসছে – প্রথমত তার প্রয়োজনে এবং দ্বিতীয়টি স্রষ্টার সন্তুষ্টির আশায় এবং দায়িত্ববোধ, কৃতজ্ঞতাবোধ, কর্তব্যবোধ অর্থাৎ আত্মার তাগিদ থেকে। প্রথম প্রকারের সেবা ব্যাখ্যার প্রয়োজন করে না। আর দ্বিতীয় প্রকারের সেবা সে করে এসেছে দায়বদ্ধতা ও কৃতজ্ঞতা বোধ থেকে। যেমন সন্তানকে বাবা-মায়ের তিলে তিলে বড় করে তোলা এবং বার্ধক্যে উপনীত বাবা-মাকে সন্তানদের সেবা। মানুষ কেবল যে তার বাবা-মায়ের কাছেই ঋণী তা নয়, সে তার জীবনে বহু বিষয়ের জন্য বহুজনের কাছে ঋণের জালে আবদ্ধ থাকে। যেমন শিক্ষাগুরু, যার কাছে মানুষ আধ্যাত্মিক ও বৈষয়িক শিক্ষা নিয়ে থাকে তাকে সেবা করা মানবসমাজের একটি চিরন্তন বিষয় ছিল যা এখন প্রায় বিলীয়মান। আত্মিক দায়বদ্ধতা, ভালোবাসা ও কৃতজ্ঞতা থেকে মানুষ মানুষকে এমন সেবা করেছে যা মহত্ত্ব ও উচ্চতায় কখনও কখনও আকাশকেও ছাড়িয়ে গেছে।
জাগতিক প্রয়োজন ও আত্মিক প্রেরণা – এ দু’টির ভারসাম্য বজায় রেখে মানবসমাজে সেবার আদান-প্রদানই ছিল প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর দেওয়া জীবনব্যবস্থার শিক্ষা। কিন্তু মানুষ যুগে যুগে আল্লাহর দেওয়া শিক্ষাকে ভুলে গিয়ে এই ভারসাম্যকে নষ্ট করেছে। ইবলিসের প্ররোচনায় সমাজের একটি শ্রেণি রাজশক্তি, ক্ষমতা, পেশীশক্তি, অর্থ-বিত্ত, প্রভাব-প্রতিপত্তির মালিক হয়ে; দরিদ্র, কমজোর মানুষকে জোর করে বাধ্য করতে আরম্ভ করেছে তাদের সেবা করার জন্য। জোর করে কাজ করানোর প্রক্রিয়া যখন আরম্ভ হলো ঠিক তখনই ভারসাম্য হারিয়ে গেল, সেবক হয়ে গেল দাস বা গোলাম আর সেবা হয়ে গেল দাসত্ব । এই চরম ভারসাম্যহীনতা কখনও কখনও এমন পর্যায়ে পৌঁছে গেল যে ঐ দাসদেরকে আর মানুষ বলেই মনে করা হতো না। তাদের ইচ্ছা অনিচ্ছার কোনো রকম মূল্যই ছিল না, তাদেরকে পণ্যের মত হাটে-বাজারে কেনা বেচা করা হতো, তাদেরকে দিয়ে কাজ আদায়ের জন্য নির্মমভাবে নির্যাতন করা হতো এমনকি তাদেরকে হত্যা করাও কোনো অপরাধ হিসাবে গণ্য হতো না।
আরবের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে ইসলামের নবযুগ সূচনা:
দাস হিসেবে মানুষ বেচা-কেনা মানবসমাজের একটি প্রাচীনতম ব্যবসা। আল্লাহর শেষ রসুল যখন আবির্ভূত হলেন তখনও আরবের একটি বড় ব্যবসা ছিল দাস ব্যবসা। আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ থেকে কৃষ্ণাঙ্গ এবং যুদ্ধবন্দীদেরকে জাহাজ ভর্তি করে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নিয়ে বিক্রি করা হতো। এই দাসদের দুঃখ-দুর্দশা যে কী অবর্ণনীয় তা বর্ণনা করে হাজার হাজার বই লেখা হয়েছে। বস্তুত যে সমাজে সেবাকে দাসত্বে রূপান্তরিত করা হয় সেই সমাজ একটা জাহান্নাম, আর যে সমাজে মানুষ মানুষকে ভালোবেসে সেবা করে যায়, অন্যকে সাহায্য করে, দান করে, খাইয়ে নিজেদেরকে ধন্য মনে করে সেটাই হচ্ছে প্রকৃত ইসলামের সমাজ।
প্রমাণ: আম্মা খাদিজা (রা.) জাহেলি যুগে আরবের বাজার থেকে যায়েদ ইবনে হারিসাকে ক্রয় করেছিলেন। হুজুর পাক (দ.) এর সাথে বিয়ের পর তিনি যায়েদকে (রা.) স্বামীর সেবায় নিয়োগ করলেন। সঙ্গে সঙ্গে রসুলাল্লাহ (দ.) যায়েদকে আযাদ করে দিলেন। কিন্তু যায়েদ (রা.) রসুলাল্লাহর সঙ্গ ত্যাগ করতে রাজি হলেন না। যায়েদের (রা.) চাচা-বাবারা তাঁকে খুঁজতে খুঁজতে মহানবীর (দ.) কাছে আসলেন। মহানবী (দ.) বললেন, ‘সে তো এখন মুক্ত, আপনারা তাকে নিয়ে যেতে পারেন।’ কিন্তু যায়েদ (রা.) ফিরতে রাজি হলেন না। কারণ তিনি মহানবীর (দ.) আচরণে ও ব্যবহারে এতটাই মুগ্ধ ছিলেন যে, জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত মহানবীর (সা.) সাথে ছায়ার মতো অনুবর্তী ছিলেন।
আনাস (রা.) যখন বালক ছিলেন তখন তাঁর মা ছেলেকে এই বলে রসুলাল্লাহর (দ.) কাছে তুলে দিলেন যে, ‘ইয়া রসুলাল্লাহ! ও আপনার কাছে থাকবে এবং আপনার সেবা করবে।’ এমন কথা কি কেউ কোনোদিন শুনেছে যে, একজন মা তার সন্তানকে এনে কারও দাসত্বে নিযুক্ত করেছে? ইতিহাস কখনো বলে না যে আনাস (রা.) রসুলাল্লাহর (দ.) দাস ছিলেন, বলা হয় খাদেম অর্থাৎ সেবক। আনাস (রা.) জীবনের একটা পর্যায়ে এসে ধনে, জনে, জ্ঞানে এতো সমৃদ্ধ হলেন মানুষ দূর দূরান্ত থেকে তাঁর কাছ থেকে রসুলাল্লাহর (দ.) জীবন সম্পর্কে, ইসলাম সম্পর্কে শিক্ষা গ্রহণ করতে আসত। তিনি রসুলাল্লাহর (দ.) জুতাগুলো পর্যন্ত পরম শ্রদ্ধায় পরিষ্কার করে দিতেন যা ছিল প্রকৃত সেবা, দাসত্ব নয়। এরপরে আছে ওমর (রা.) এর উদাহরণ। মদিনা থেকে যেরুজালেম প্রায় ১৩০০ কিলোমিটার মরুপথে ওমরের (রা.) সঙ্গী ছিলেন একজন ব্যক্তি যাকে ইতিহাসে দাস বলে উল্লেখ করা হয়। কিন্তু এ কেমন দাস যাকে মনিব উটের পিঠে উঠিয়ে উটের রশি ধরে উত্তপ্ত মরুর বালুকারাশির উপর দিয়ে পথ চলেন? আল্লাহর রসুল বলেছিলেন, ‘তোমাদের অধীনস্থরা তোমাদের ভাই’। তাই দাস শব্দটি ইসলামের ক্ষেত্রে মোটেই প্রযোজ্য নয়। ইসলামে দাস- দাসীর কোনো ব্যবস্থা নেই। ইসলামের আইন হলো, জোরপূর্বক কাউকে কোনো কাজে বাধ্য করা যাবে না, বাধ্য করলে সে দণ্ডিত হবে। আল্লাহ হচ্ছেন মালিকুল মুলক, রাজ্য-সাম্রাজ্যের মালিক, মালিকিন্নাস (মানুষের প্রভু), মা’বুদ (যার দাসত্ব করতে হয়), একমাত্র রাব্বুল আলামীন (সৃষ্টি জাহানের একচ্ছত্র প্রভু)। সুতরাং কোনো মানুষ প্রকৃত অর্থে যেমন কখনও কারও প্রভু বা মালিক (Master, Lord) হতে পারে না, তেমনি কেউ কারও দাস বা গোলামও হতে পারে না। কেবল সেবক, অনুচর, সাহায্যকারী, কর্মচারী (Attendant, Helper, Employee) হতে পারে। এবং সেই সেবক বা অনুচরদের সম্পর্কেই রসুলাল্লাহ বলেছেন, ‘তোমরা যা খাও তাদেরকে তাই খাওয়াবে, তোমরা যা পরো তাদেরকে তাই পরাবে, অসুস্থ হলে তাদেরকে সেবা করবে।’ হুজুরের এই কথাগুলি নিছক উপদেশ ছিল না, এগুলি ছিল উম্মাহর প্রতি তাঁর হুকুম। এবং সকল আসহাবগণ রসুলের এই হুকুম অক্ষরে অক্ষরে পালন করে গিয়েছেন। রসুলাল্লাহর শিক্ষাপ্রাপ্ত উম্মতে মোহাম্মদীর কেউ কোনো সেবককে নির্যাতন করেছেন এমন একটি দৃষ্টান্তও ইতিহাসে পাওয়া যাবে না। কোনো সেবক তার মালিকের দ্বারা নির্যাতিত হয়ে শাসকের কাছে নালিশ জানালে ন্যায়বিচার পেত। ইসলামে সেবকদের ধর্মীয় স্বাধীনতাও ছিল অবারিত।
অপরদিকে পৃথিবীতে যখনই বৈষয়িক উদ্দেশ্য ও মানবিকতার ভারসাম্য নষ্ট হয়েছে তখনই মানুষ নিজেকে মালিক, প্রভু আর অধীনস্থদের দাস মনে করেছে। যখন মানুষ ভেবেছে যে, আমি সকল জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে, বিধানের ঊর্ধ্বে, তখন সে চরম স্পর্ধায় নিজেই প্রভু হয়ে দাঁড়িয়েছে, তখনই সে তার অধীনস্থদের গলায় শিকল লাগিয়ে, চামড়া পুড়িয়ে মার্কা দিয়ে, কথায় কথায় চাবুক পেটা করে, নাক কেটে, বস্ত্রহীন রেখে, দিনের পর দিন অনাহারে রেখে, পশুর খোয়াড়ে বাস করতে বাধ্য করেছে।
২| ০৪ ঠা মে, ২০১৫ রাত ৮:৪৯
সহজপাঁচালি বলেছেন: কিন্তু আপনার উদাহরণ থেকে কি এটা বোঝা যায় যে, দাসপ্রথার মূল ব্যাপারটা ইসলামে নেই? আমি এটা বলছি এ কারণে যে, দাস তথা আপনার ভাষায় খতিবদের প্রতি অত্যাচার করা বন্ধের নির্দেশ করলেও ইসলাম কিন্তু তাদের কেনাবেচার রীতিটা বন্ধ করেনি। সেটা কেন করেনি আপনি কিন্তু তার উত্তর দেননি। সমাজ পরিবর্তনের ব্যাপারে অসংখ্য সাহসি আর দূরদর্শি ভূমিকা আছে ইসলামের। তবে এ ব্যাপারটিতে ইসলাম পিছিয়ে রইল কেন?
দেখুন, ভাববেন না আমি তর্ক করবার উদ্দেশ্যে এসব বলছি। তাই আপনার ব্যক্তিগত মতামত দিলেই খুশি হব। সাংগঠনিক পরিচয় বা মতামত কোনটাই আমার প্রয়োজন নেই। তবে এটাও সংগঠন মানুষকে তার নিজস্ব গণ্ডি যাচাই করতে সাহায্য করে এবং এতে মানুষের চিন্তাধারাও দ্রুত শানিত হয়।
আপনাকে ধন্যবাদ।
০৫ ই মে, ২০১৫ সন্ধ্যা ৭:৪৩
মোহাম্মদ আসাদ আলী বলেছেন: আপনি বলেছেন-খাদেমদের প্রতি অত্যাচার করা বন্ধের নির্দেশ করলেও ইসলাম কিন্তু তাদের কেনাবেচার রীতিটা বন্ধ করেনি।
হ্যা, ঠিক বলেছেন। ইসলাম দাসদের কেনাবেচা বন্ধ করে নি। স্পষ্টভাবে বলতে চাইলে বলতে হবে- ইসলাম দাসদের কেনাবেচা শেষ পর্যন্ত বন্ধ করে যেতে পারে নি। আরেকটু গভীরে প্রবেশ করতে হবে।
দাসপ্রথা ইসলামে হারাম এটা একশ ভাগ সত্য কথা, যেমন সত্য হচ্ছে- মদ ইসলামে হারাম। কিন্তু ইসলাম কি হঠাৎ করে মদ হারাম করেছে? ইতিহাস দেখুন। মদ খা্ওয়া হঠাৎ করে নিষেধ করা হয় নি। মক্কা জীবনে তো রসুল মদের বিরুদ্ধে কোনো কথাই বলেন নি। মদীনায় গিয়ে তারপর প্রথমে নির্দেশ এল মাতাল অবস্থায় সালাতে (নামাযে) যোগ দিও না (সুরা নেসা ৪৩)। এতে সুরা পান অনেকটা কমে গেল। এর বেশ পরে আল্লাহর নির্দেশ এল সুরাপানের মধ্যে ভালও আছে, মন্দও আছে কিন্তু ভালোর চেয়ে ওতে মন্দের ভাগ বেশী (সুরা বাকারা ২১৯)। অত্যন্ত মৃদু নিষেধাজ্ঞা, যেন আল্লাহ স্নেহ করে বুঝিয়ে বলছেন। আরও কমে গেল মদ খাওয়া। তারপর এল সরাসরি আদেশ মদ খাবে না (সুরা মায়েদা ৯৩)। ঠিক একই কথা দাসপ্রথার ব্যাপারেও। দাসপ্রথা ইসলামে নিষিদ্ধ। ইসলাম সমর্থন করে স্বেচ্ছাপ্রদত্ত সেবা যা এবাদত হিসেবে করা হয় দায়বদ্ধতা থেকে। আর যদি অর্থের বিনিময়েও সেবা দান করা হয় সেখানেও স্পষ্ট নির্দেশাবলী হচ্ছে- শ্রমিকের ঘাম শুকানোর আগেই তার পারিশ্রমিক প্রদান করা, সাধ্যের অতিরিক্ত কাজ অর্পন না করা ইত্যাদি। তবে মাননিক দায়বদ্ধতা থেকেই হোক, আর অর্থের বিনিময়েই হোক সবই কিন্তু সেবা, দাসত্ব নয়।
এই ভারসাম্যপূর্ণ শ্রমব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করাই ছিল ইসলামের লক্ষ্য। কিন্তু এটা্ও মনে রাখতে হবে দাসপ্রথা একদিনে গড়ে ওঠে নি। হাজার বছরের প্রথাকে রাতারাতি হারাম ফতোয়া দিয়ে বন্ধ করে দেয়া যায় না। দিলে সেটা ইসলাম হতো না। ইসলাম জোরজবরদস্তি স্বীকার করে না। ইসলাম যে বিধান প্রদান করে সে বিধান গ্রহণ করার মতো ক্ষেত্র প্রস্তুত করেই সে বিধান কার্যকর করা হয়। ওই যে মদ হারামের মতো। মদ কি হঠাৎ করে ক্ষতিকর হয়ে গিয়েছিল? না। রসুল যখন মক্কায় তওহীদের দাওয়াত দিচ্ছেন তখনও মদ মানুষের জন্য ক্ষতিকর ছিল। কিন্তু তিনি সে ব্যাপারে কোনো কথা বলেন নি। যখন মদীনায় আসলেন তখন আল্লার নির্দেশে কয়েক স্তরের নসিহত, উপদেশ ও আদেশের মাধ্যমে মদ নিষিদ্ধ করলেন। তখন মানুষ মানসিকভাবেও এই নিষেধাজ্ঞার জন্য প্রস্তুত ছিল। ঠিক এই কারণেই দাস কেনাবেচাকে রাতারাতি বন্ধ করা সম্ভব নয়। রসুলাল্লাহ একের পর এক দাস আজাদ করে ও অন্যদের আজাদ করতে উৎসাহিত করে জাতিকে বোঝাতে চেয়েছেন যে, মানুষকে দাস হিসেবে ব্যবহার করা উচিত নয়। অন্যদেরও তাদেরকে আজাদ করে দেওয়া উচিত। কাবার সম্মান ও মর্যাদা কে না জানে? অথচ মক্কা বিজয়ের দিন আল্লাহর রসুল সেই কাবার চূড়ায় যাকে উঠালেন তিনি হচ্ছে বেলাল (রা.), এক কালের দাস। এটা করে তিনি মক্কাবাসীর সমস্ত গর্বকে চূর্ণ করেছেন। তিনিই বলেছেন- আল্লাহর কাছে একজন মু'মিনের সম্মান তার কাবারও ঊর্ধ্বে। আল্লাহ যাদেরকে এত সম্মান দেন তাদেরকে দাস হিসেবে ব্যবহার করতে পারে এমন স্পর্ধা কার আছে? সর্বশেষে মক্কা বিজয়ের দিনে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণে তিনি যে আদেশ-নিষেধগুলো করেছেন সেগুলো জাতিতে বাস্তবায়িত হলে দাসপ্রথার চিহ্নটুকু্ও থাকার কথা নয়।
এক কথায়, ইসলাম দাসপ্রথাকে নিষিদ্ধ করেছে, কিন্তু যেহেতু ইসলাম হচ্ছে প্রাকৃতিক জীবনব্যবস্থা কাজেই রাতারাতি এরকম কোনো নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয় নি। হাজার বছরের একটি প্রথা, যার সাথে অর্থনীতির প্রত্যক্ষ সম্পর্ক, তাকে এক বাক্যে হারাম বলে বন্ধ করতে যাওয়া অপ্রাকৃতিক হতো। কিন্তু এমন পরিবেশ তৈরির চেষ্টা করা হয়েছে যাতে মানুষ স্বেচ্ছায় দাসপ্রথাকে প্রত্যাখ্যান করে। দুঃখজনক বিষয় হলো- এ প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া শেষ হবার পূর্বেই ইসলাম বিকৃত হয়ে
যায়, জাতির উদ্দেশ্যচূতি ঘটে। ফলাফল বর্তমান।
৩| ০৬ ই মে, ২০১৫ রাত ১:৫৮
সহজপাঁচালি বলেছেন: পুরো ব্যাপরটাতে আমি যেটুকু মেনে নিতে পারছি না ওটুকু বলছি।
ইসলামের আবির্ভাবের পর এমন কিছুও ছিল যা হঠাৎ করেই বন্ধ করা হয়েছিল - এমনকি কোন পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই। আমার যদি ভুল না হয়ে থাকে তবে এর একটা উদাহরণ হচ্ছে, জীবন্ত নারী শিশুকে হত্যা করার প্রক্রিয়াকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা। উদাহরণটা ভুলও হতে পারে - আমি রেফারেন্স দিয়ে বলতে পারছি না বলে দু:খিত। তবে, ইসলামের এইসব সংস্কার কাজকে স্বীকার না করা নির্বুদ্ধিতা।
যাহোক, বিভিন্ন সংস্কার কাজগুলোর মধ্যে আপনি মদ্যপান বন্ধের নির্দেশ প্রদানের উদাহরণ দিয়েছেন যেখানে আল্লাহ তার বান্দাকে স্নেহ করে বুঝিয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছেন যে ব্যাপারটা খারাপ এবং এতে বুদ হয়ে থাকলে ভবিষ্যতে ভুগতে তো হবেই জাহান্নামও অবধারিত হয়ে যাবে। তাই শেষমেষ এ জিনিস থেকে পুরোপুরি বিরত থাকার কঠোর আদেশ দিয়েছেন। কিন্তু দাসপ্রথার মানুষ কেনাবেচা নিয়ে আল্লাহ শেষপর্যন্তও এমন কোন আদেশ দেন নি বা আপনার উক্তিমত “স্পষ্টভাবে বলতে চাইলে বলতে হবে- ইসলাম দাসদের কেনাবেচা শেষ পর্যন্ত বন্ধ করে যেতে পারে নি”। আরো কিছু উদাহরণ দিয়ে আপনি বলেছেন, ইসলাম এমন একটি ব্যবস্থা করে গিয়েছে যাতে একটি প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় দাসপ্রথা পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়ে যায়। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে ইসলামের পরবর্তী খলিফাদের হাতেও কি তা পূর্ণাঙ্গ রূপ পেয়েছিল অর্থাৎ দাসপ্রথা পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়েছিল? ইসলাম ধর্মরূপে পূর্ণাঙ্গ হওয়ার পরও এ ব্যাপারে স্পষ্ট নির্দেশ না হওয়া - এ ব্যাপারটির জন্য দায়ি নয় কি?
আপনি আরেকটি কথা বলেছেন “ইসলাম জোরজবরদস্তি স্বীকার করে না। ইসলাম যে বিধান প্রদান করে সে বিধান গ্রহণ করার মতো ক্ষেত্র প্রস্তুত করেই সে বিধান কার্যকর করা হয়।” কিন্তু সবক্ষেত্রেই কি তা করা হয়? তবে যুদ্ধের প্রয়োজন হয়ে পড়ল কেন? অথবা ইসলামের মূল কথাগুলোই কাফেরদের মাঝে প্রচার করবার জন্য ততদিন পর্যন্ত কেন অপেক্ষা করা হল না যতদিন ওই বর্বরজাতি ইসলামের কথাগুলো বুঝতে সক্ষম হয় তথা আরব সমাজে ইসলামের বিধান গ্রহণ করার মত ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়!
ইসলাম যে সেই বর্বর সময়েও দাসদের প্রতি সুবিচারের সর্বোচ্চ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু আমার প্রশ্নটি হল, ইসলাম কেন ব্যপারটা পূর্ণাঙ্গ করে যেতে পারল না? এ প্রশ্নটিও ভিত্তিহীন হয়ে পড়ত, যদি ইসলামের চার খলিফার রাজত্বকালে ও তৎপরবর্তী সময়ে দাসপ্রথা ধীরে ধীরে বিলুপ্তির পথ ধরত। কিন্তু আইন হিসেবে এটি বিলুপ্তির দৃষ্টান্ত দেখতে পাই আব্রাহাম লিংকনের হাত ধরে।
আপনি বলেছেন “দুঃখজনক বিষয় হলো- এ প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া শেষ হবার পূর্বেই ইসলাম বিকৃত হয়ে যায়, জাতির উদ্দেশ্যচূতি ঘটে।” এ কথাটা কেন বললেন আমি জানি না। আমি যতটুকু জানি ইসলামের দাবি হল, এর মূলগ্রন্থ কখনো বিকৃত হবে না। আর কিছু না থাকলেও অলৌকিক শক্তিবলে এটি টিকে থাকবে।
যাহোক, কথা অন্যদিকে চলে যাচ্ছে।
শেষ কথা হল, এত ভালো কিছুর পরও ইসলামের কাছ থেকে আমি ওই ব্যাপরটাই কেন দাবি করছি অর্থাৎ আমার কথামতই কী ইসলামকে গ্রন্থ বা আইন প্রণয়ন করতে হবে নাকি! না তা হবে না, তা হয়ও নি। কিন্তু আমি যদি তা দাবি করি তবে কি ভুল হবে? কেননা, ইসলামই দাবি করে এটি সবময়ের জন্য প্রণিত একটি ব্যবস্থা। সেই সময়ে কোরআনে উল্লিখিত একটি কথাও আজ কিংবা আজ থেকে লক্ষ্য বছর পরও অমূলক কিংবা অপ্রয়োজনীয় হয়ে যাবে না। কেননা এটি শুধুমাত্র কোরআন নাযীলের সময়কার একটি গ্রন্থ নয় বরং কোরআন নাযীলেরও আগে এ গ্রন্থ লাওহে মাহফুজ নামক একটি স্থানে সংরক্ষিত ছিল যা একজন ফেরেশতা কর্তৃক বহন করে নিয়ে আসা হত এবং পৃথিবীর সর্বশেষ ধ্বংসলীলার আগ পর্যন্ত এটি অবিকৃত থাকবে।
ইসলামে দাস-দাসীদের অত্যাচার না করা, তাদের প্রতি ভালো ব্যবহার করা ইত্যাদি বিষয়ক অসংখ্য বাণী রয়েছে। কিন্তু এমন কিছু বাণীও কি নেই যেখানে দাসদের উদ্দেশ্য করে তাদের দাসত্বকে মেনে নিতেও বলা হয়েছে অথবা এমন কিছু বাণী যেখানে তাদেরকে ভোগ্য দাস হিসেবেই বলা হয়েছে?
আল্লাহ আরেকটি দৃষ্টান্ত বর্ণনা করেছেন, দু’ব্যক্তির, একজন বোবা কোন কাজ করতে পারে না। সে মালিকের উপর বোঝা। যেদিকে তাকে পাঠায়, কোন সঠিক কাজ করে আসে না। সে কি সমান হবে ঐ ব্যক্তির, যে ন্যায় বিচারের আদেশ করে এবং সরল পথে কায়েম রয়েছে। (আল-কোরআন - ১৬:৭৬)
আল্লাহ তোমাদের জন্যে তোমাদেরই মধ্য থেকে একটি দৃষ্টান্ত বর্ণনা করেছেনঃ তোমাদের আমি যে রুযী দিয়েছি, তোমাদের অধিকারভুক্ত দাস-দাসীরা কি তাতে তোমাদের সমান সমান অংশীদার? তোমরা কি তাদেরকে সেরূপ ভয় কর, যেরূপ নিজেদের লোককে ভয় কর? এমনিভাবে আমি সমঝদার সম্প্রদায়ের জন্যে নিদর্শনাবলী বিস্তারিত বর্ণনা করি। (আল-কোরআন - ৩০:২৮)
তবে তাদের স্ত্রী ও মালিকানাভুক্ত দাসীদের ক্ষেত্রে সংযত না রাখলে তারা তিরস্কৃত হবে না। (আল-কোরআন - ২৩:০৬)
আমি অত্যন্ত দু:খিত এইজন্য যে দাস-দাসী সম্পর্কিত অসংখ্য ভালো ও ইতিবাচক বাণী জানা থাকা সত্ত্বেও আমি এখানে উল্লেখ করিনি। কেননা, আমি সবসময়ই মানি, যদিও ইসলাম পুরোপুরি দাসপ্রথার মূলউৎপাটন করতে পারেনি কিন্তু ইসলাম তার প্রতিষ্ঠালগ্নে দাসপ্রথার বিপরীতে যে অসাধারণ ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল তা আর কেউ পারেনি।
০৮ ই মে, ২০১৫ বিকাল ৪:১৮
মোহাম্মদ আসাদ আলী বলেছেন: আপনার এই সকল প্রশ্নের উত্তরই আমার কাছে আছে। আপনাকে আমি একটি ২৪ পৃষ্ঠার বই দিতে চাচ্ছি। বইটির পিডিএফ এখনও রেডি করা হয় নি। তবে আপনার যেহেতু এ ব্যাপারটি নিয়ে জানার প্রবল আগ্রহ আছে কাজেই আমি ওই বইয়ের সফট কপি আপনাকে মেইল করব। বইটি পড়ার পরে আশা করি আপনার কোনো প্রশ্ন থাকবে না। আপনার মেইল অ্যাড্রেসটা দিলে উপকৃত হতাম।
৪| ০৮ ই মে, ২০১৫ রাত ১১:১৫
সহজপাঁচালি বলেছেন: আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
জানতে আমার কোনো দ্বিধা নেই, জ্ঞান আমার কাছে সবসময়ই আগ্রহের। আর ইতিহাস আমার পছন্দের বিষয়গুলোর মধ্যে একটা। তবে আমি চাই ব্যাপারগুলো যেন একটু সহজবোধ্য হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দুর্বোধ্যতার জন্য আমি অনেক বিষয় থেকে আগ্রহ হারিয়ে ফেলি। অবশ্য আমি স্বীকার করি এটা একান্তই আমার নিজস্ব দুর্বলতা।
[email protected]
©somewhere in net ltd.
১|
০৩ রা মে, ২০১৫ রাত ৯:১৮
সহজপাঁচালি বলেছেন: শ্রমিককে নিয়ে সবাই রাজনীতি করে। আসলে আমরা সবাই শ্রমিকের ঘামের ফলেই না স্বাচ্ছন্দে আছি। কিন্তু শ্রমিকদের প্রতি আমাদের জন্মগত মনোভাব খুবই নিচুমানের।
ইসলামে শ্রমিকের ন্যায্য পাওনা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে সত্য। কিন্তু একটা ব্যাপার নিয়ে আমার ঘোরতর আপত্তি আছে যে, ইসলাম সমাজ পরিবর্তনের জন্য দাসপ্রথার মত ব্যবস্থাকে উৎখাত করে যেতে পারেনি।