![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙামাটি জেলার দুর্গম উপজেলা লংগদু, তারচেয়েও আরো দুর্গম বাঘাইছড়ি উপজেলা। এখানে বসবাসরত অধিকাংশ বাঙালীই শ্রমিক পেশা গাছ-বাঁশ কাটা। হতভাগা এসব কাঠুরিয়াদের বড় অংশ থাকে লংগদুর মাইনীমুখ, গুলশা খালী তেমাথা, কালাপাকুজ্জাসহ বিভিন্ন গ্রামাঞ্চলে। ১৯৯৬ সালের প্রথম দিক থেকেই স্থানীয় গাছ ব্যবসায়ীদের সাথে দ্বন্দ্ব শুরু হয় উপজাতীয় সন্ত্রাসীদের সাথে। দীর্ঘদিন তারা দালালের মাধ্যমে নির্ধারিত হারে চাঁদা নিত। কিন্তু, হঠাৎ করে তৎকালীন শান্তিবাহিনী (জেএসএস) চাঁদার পরিমাণ ৩/৪ গুন বাড়িয়ে দেয়। নতুবা গাছ-বাঁশ-কাঠের ব্যবসা বন্ধ বলেও হুমকি দেয়। ফলে, নিরীহ দরিদ্র বাঙালি কাঠুরিয়াদের পেটে লাথিপড়ে, অনাহারে অর্ধাহারে জর্জরিত জীবনে নেমে আসে অন্ধকারের ঘনছায়া। তদুপরি, জীবন বাজী রেখে মাঝে মধ্যে গহীন জঙ্গলে গিয়ে তারা কাঠ কাটতো, দুর্গম পাহাড় বেয়ে অনেক সময় হাতীর সাহায্যেও বড় বড় গাছের গুড়ি টেনে এনে লেকের পানিতে ভাসিয়ে নৌকার সাহায্যে শহরের বড় বড় কাঠগুদামে আহরণ করা হতো। সেই হতভাগা কাঠুরিয়াদের উপরই ১৯৯৬ সালের সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে নেমে আসে ভয়াবহ দুর্যোগ। উপজাতীয় শান্তিবাহিনী কাঠ ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চাঁদা বৃদ্ধির আবদার মেটাতে ব্যর্থ হয়ে নিরীহ গরীব কাঠুরিয়াদের উপর চরম প্রতিশোধের জাল আটে। বাঙালি কাঠুরিয়াদেরকে আলোচনার ফাঁদে ফেলে দালালের মাধ্যমে জড়ো করা হয় বাঘাইছড়ি থানার পাকুয়াখালীর গহীন অরন্যে।
সেদিন ও সরল বিশ্বাসেও পেটের তাগিদে জীবিকার অন্বেষনে নানারূপ সন্দেহ ও ভয়ভীতি উপেক্ষা করে শতাধিক কাঠুরিয়া জড়িত হয় পাকুয়াখালীতে। বাড়ীতে স্ত্রী, পুত্র-কন্যা ও ছোট শিশুটিও হা করে আছে, অন্নের আশায়। বাবা কাঠ কেটে আসবে, রোজগারের টাকা পেলে তবেই বাজার থেকে চাহিদা মতো কিছু কিনাকাটা হবে। কিন্তু ২, ৩, ৪, ৫, ৬, ৭, ৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কাঠুরিয়াদেরকে চাঁদা নির্ধারনের অজুহাতে নেয়া হলেও কেউই ফেরত আসছেনা। অজানা আশঙ্কায় কাঠুরিয়াদের ঘরে ঘরে কান্নার রোল পড়ে গেল। স্বজনরা কেন জানি আপনহারা ব্যথায় কেঁদে উঠলো। বাঘাইছড়ির লোমহর্ষক ও হৃদয় বিদারক এই হত্যাকান্ড প্রথমে ধামাচাপা দেয়া হয়েছিল। স্থানীয় এমপি দীপংকর তালুকদার ও তার দলীয় আওয়ামী লীগ নেতারা এই হত্যাকান্ড কে গুজব এবং সরকার বিরোধীদের ষড়যন্ত্র বলেও প্রচার করেছিল। এমনকি, এমপি সাহেব, রাঙামাটির ডিসি, এসপি, সেনাবাহিনীসহ সবাইকে গুজবে কান না দিয়ে যারা গুজব ছড়াচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলেছিলেন। কিন্তু মানবতার ডাকে সাড়া না দিয়ে থাকতে পারেনি দেশপ্রেমিক প্রশাসন। তাদেরই একটি অংশ এগিয়ে আসে স্বজনহারা বাঙালিদের ডাকে/দুই/তিনদিন ধরে নিখোঁজ আপনজনের জন্য কোন সন্ধান না পেয়ে থানার ওসি এবং সেনাজোনের কাছে ছুটে যায় তারা। এদিকে খুনী শান্তিবাহিনীর মৃত্যুকূপ থেকে পালিয়ে আসা একজনকে সন্দেহ জনকভাবে আটক করা হয়। কিন্তু ৯ সেপ্টেম্বর সকাল বেলা যখনি দেশপ্রেমিক লংগদু জোনের সেনাবাহিনী গভীর জঙ্গল থেকে ২/৪ টা করে লাশ আনতে শুরু করলো, তখনি বাঘাইছড়ি হত্যাকান্ডের রহস্য বেরিয়ে গেল। কাটা, ছেঁড়া গলিত লাশগুলো ২/৩ দিনে পচে দুর্গন্ধে ভরে গেছে, তাদের চেহারাও চেনা মুশকিল। দা, কুড়াল, বেয়নেট, ছুড়ি ইত্যাদি ব্যবহার করে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে এবং তিল তিল করে অমানুষিক অত্যাচার করে তাদেরকে হত্যা করেছিল হানাদার শান্তি বাহিনী। বর্বর হানাদার পাকিস্তানী সেনাবাহিনীও ১৯৭১ সালে এভাবে পশুর মতো নির্যাতনের মাধ্যমে বাঙালী হত্যা করে নাই। অথচ, সন্তু লারমা বাহিনী তার চেয়েও জঘন্য পাশবিক জানোয়ারের আচরনে বাঙালি হত্যা করেছে। তারপরও রাঙামাটির ডিসি সাহেবকে এমপি দীপংকর তালুকদার বলেছিলেন- “আমি চাই না, এই ঘটনার জন্য পাহাড়ে কোন উপজাতির একটি পশম ও কেউ যাতে ছিড়তে পারে”। প্রশাসনকে কঠোর নির্দেশ দেয়া হয়, যাতে উত্তেজিত বাঙালিদেরকে কঠোর ভাবে দমন করা হয়। অন্যদিকে, প্রতিদিনই ঢাকা থেকে আওয়ামী লীগের বড় বড় নেতারা লংগদু আসতে থাকেন। আমু- তোফায়েল-রাজ্জাক-হাসনাত-মহিউদ্দিনসহ ডজন খানেক মন্ত্রীরা পাহাড়ে ছুটে আসেন। স্তম্ভিত হতবিহবল হয়ে যান এই বীভৎস হত্যাকান্ড দেখে। মানুষ এত বড় নিষ্ঠুর হতে পারে, এত জঘন্য হতে পারে, তা সেদিনের সরেজমিনে প্রত্যক্ষ করে লীগের মন্ত্রীরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে বিশদ বিবরনও তুলে ধরেছিলেন। চীন যাত্রার প্রাক্কালে অশ্র“সজল কন্ঠে সেদিন সাংবাদিকদের কাছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই বর্বরতার তীব্র নিন্দা জানিয়ে খুনীদের বিচার করার ঘোষনা দিয়েছিলেন।
কিন্তু দীর্ঘ ১৭ বছরেও বাঘাইছড়ি কাঠুরিয়া হত্যাকান্ডের বিচার হয়নি। ১৯৯৭ সালের ২রা ডিসেম্বর তথাকথিত শান্তিচুক্তির মাধ্যমে খুনী শান্তিবাহিনীকে পুরস্কৃত করা হয়েছিল। পাহাড়ী সন্ত্রাসীদেরকে কঠোরভাবে দমন না করে বিদেশী চাপের মুখে সন্ত্রাসপূজার অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপিত করেছিল লীগ সরকার। দীর্ঘ ৩৮ বছর পর যদি বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার হতে পারে, তবে ১৭ বছর পরও কেন বাঘাইছড়ি হত্যাকান্ডের বিচার হবে না? খুনী শান্তিবাহিনীর এটা হল গুরুতর ফৌজদারী অপরাধ, যার বিচার যে কোন সময় করা যেতে পারে। এই বিচারে কোন বাধা নাই। হিটলার- মুসোলিনীর বিচার যদি হতে পারে, তবে ঘাতক শান্তিবাহিনীর নেতা সন্তু লারমার বিচার হবে না কেন? আজ তাকে আঞ্চলিক পরিষদ চেয়ারম্যান পদে রেখে জনগণের খাজনা- ট্যাক্সের টাকায় প্রতিমন্ত্রীর মতো বেতন-ভাতা সুবিধাদি দেয়া হচ্ছে। জনগণ কেন এই বেতন দেবে, কেন খুনীকে লালন করা হবে?
বাঘাইছড়ি হত্যাকান্ড আমাদের জাতীয় জীবনে এক বিষফোড়া হয়ে আছে। জাতি এই কলঙ্কের বোঝা কতকাল বহন করবে? নিরীহ মানুষ হত্যাকান্ড এই জাতি কিভাবে সহ্য করছে? দেশের অখন্ডতা, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে গিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রতিটি পাহাড়ে, জঙ্গলে অরন্যে, খালে-বিলে, নদী-নালায়, হাট-বাজারে বহু বাঙালিকে জীবন দিতে হয়েছে। এটা কোন স্বাভাবিক হত্যাকান্ড নয়, এটা হল রাষ্ট্রদ্রোহী সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের ঠান্ডামাথায় বাঙালি হত্যাকান্ড। এটা রাষ্ট্রদ্রোহিতা-এর ন্যূনতম শাস্তি হল মৃত্যুদন্ড।
দেশের প্রচলিত আইনেই বাঘাইছড়ির খুনীদের বিচার করতে হবে। নিরীহ সেসব কাঠুরিয়াদের অশরীরী আত্মা কখনো এই জাতিকে ক্ষমা করবে না। সভ্য সমাজ, সুধী সমাজ, আধুনিক বিশ্বের দাবীদার বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষ সেদিন এই খুনীদের বিচারে জেগে উঠবে, সেদিনই শহীদের আত্মা শান্তি পাবে। জাতি কলঙ্কমুক্ত হবে, পরিশুদ্ধ হবে দেশের জনগোষ্ঠি।
©somewhere in net ltd.