নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

চলো আমরা পাখিদের কাছ থেকে ইউক্লিডের নতুন পাঠ নেই জীবনানন্দের পাঠ নেই নিউটনের আপেল গাছটি থেকে।

জসীম অসীম

লেখা হলো কেতকীফুল। ভালোবাসি তাই।

জসীম অসীম › বিস্তারিত পোস্টঃ

‘সতীদাহ’ এবং ‘পতিদাহ’

৩০ শে ডিসেম্বর, ২০১৩ দুপুর ২:২৬


অলংকরণ: জসীম অসীম।

হলিউডের বিখ্যাত অভিনেত্রী এলিজাবেথ টেলরের অভিনয় আমার ভীষণই ভালো লাগে। তার অভিনীত ‘ক্লিওপেট্রা’ ছবিটিও আমার ভীষণ প্রিয়।
সেই এলিজাবেথ টেলর বিয়ে করেছেন 8 থেকে 10 বার পর্যন্ত। জন্ম তাঁর 1932 সালের 27 ফেব্রুয়ারি। তারই মা ছিলেন আবার একজন মঞ্চাভিনেত্রীও। এই এলিজাবেথ টেলরের সব প্রেমকাহিনী ছিল মূলত বিবাহেরই কাহিনী।
ঢাকায় একবার এক মহিলার খোঁজ পেলাম আমি, যিনি রঙ্গ করে নিজেকে ‘টেলর’ নামেই পরিচয় দেন। তিনিও নাকি 5 এর অধিক বিয়ে করেছিলেন। তবে তিনি ‘টেলর’ হতে পারেননি।
আসলে এলিজাবেথ টেলর অমর হয়েছেন তাঁর সৃষ্টিশীল কাজ দিয়েই। অবশ্যই তাঁর বিয়ের সংখ্যা দিয়ে নয়।
অথচ ঢাকার সেই মহিলা: আমার মনে হয় তিনি বিখ্যাত হতে চেয়েছিলেন শুধুমাত্র তাঁর বহুবিবাহ দিয়েই, সৃষ্টিশীল কাজ দিয়ে নয়। তাই তিনি আর সবার মতোই মরনশীল একজন মানুষই । এই বিশ্বের ভুলনশীল মানুষ তাকে নি:সন্দেহেই একদিন ভুলে যাবে।
অথচ যৌবনের শুরুতে আমার কাছেও মনে হতো একজন পুরুষ যদি 5-10টি বিয়ে করে, তাহলে ক্ষতি কী? বিশেষ করে যদি তাঁর অর্থকষ্ট না থাকে।
আমার ওই মনে হওয়াটিকে এখন আর আমি সঠিক বলে কোনোভাবেই মনে করি না। বরং আজকাল অবস্থাভেদে কাউকে কাউকে বিয়ে না করারও পরামর্শ দেই আমি।
অথচ আমারই পরিচিত এক রাজনীতিবিদ আমাকে একবার বলেন, পৃথিবীতে যুদ্ধ ছিল...যুদ্ধ আছে এবং যুদ্ধ থাকবে। আর এই যুদ্ধে অধিকাংশই বলি হয় পুরুষ। তাই যুদ্ধের পর সর্বত্রই পুরুষের সংখ্যাই কমে যায় এবং বেড়ে যায় নারীর সংখ্যা। আর নারীর সংখ্যা তুলনামূলকভাবে এভাবে বেড়ে গেলে ‘বেশ্যা’র সংখ্যাও বাড়ে কিংবা বাড়ে বেশ্যাবৃত্তি। এভাবে ‘বেশ্যা’র সংখ্যা বেড়ে গেলে আবারও যুদ্ধ লাগে এবং আবারও পুরুষের সংখ্যা কমতে থাকে।
আমি বললাম, তাহলে শেষ সমাধানটা কী? উত্তরে তিনি বলেন, একজন পুরুষের তাই 10-20-30টি পর্যন্ত করে বিয়ে করা উচিত: যদিও বর্তমান প্রেক্ষাপটে তা সম্ভবও নয়। তবে পুরুষের বহুবিবাহকে আমি অসমর্থন করি না।
আমি তখন তাঁকে বলি, একজন পুরুষ যদি এত এত বিয়ে করে, তাহলে তো চিরতরেই গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে এবং সে যুদ্ধ তো বিশ্বযুদ্ধকেও হার মানাবে। তখন তিনি আর এ প্রসঙ্গে আমার সঙ্গে নতুন করে কোনো কথাই বললেন না।

যে মেয়েকে আমি প্রথম বিয়ে করি, তাঁর নামে একবার আমি নিজের লেখা কবিতার বই উৎসর্গ করেছিলাম। কবিতার সেই বইয়ের নাম ছিল ‘স্বপ্নের মালা গাঁথার স্বপ্ন’।
কিন্তু অনেকদিন পরে আমি ঠিকই বুঝেছিলাম: সেই মেয়েটির কাছে হয়তো স্বাভাবিকভাবেই কিছু উৎসর্গিত কবিতার চেয়ে শহরে একটি বাড়ির মূল্যই ছিল অনেক অনেকগুণ বেশি। তাই হারামী বাড়ি-গাড়ির স্বপ্ন আমার সংসারে ভীষণই যুদ্ধ লাগিয়ে দিল। সেই যুদ্ধেকে আর কোনোভাবেই বন্ধ করা গেল না।

যেসব স্বামী আর খেলনা পুতুলের মধ্যে কোনোই পার্থক্য থাকে না, আমি তেমন স্বামী ছিলাম না বলে তখন আমার সংসারে প্রতিদিন যুদ্ধ লেগেই থাকতো। এই যুদ্ধকে আরও উস্কে দিল এই সমাজের পরিচিত আরও অনেকেই।

একদা যে মৃত স্বামীর সঙ্গে তার সৎ ও বিশ্বস্ত স্ত্রীর সহমরণে যাওয়াকে ভারতীয় হিন্দুসমাজ ‘সতীদাহ’ বলতো, আমি সেই প্রথাকে চিরকাল ঘৃণা করবো। অথচ সেই আমিই একজন নারীর জীবিত স্বামী এবং একজন মুসলমানের সন্তান হওয়া সত্ত্বেও এক সময় হয়তো নব্য আবিষ্কৃত প্রথা ‘পতিদাহ’-এর শিকার হতে থাকলাম। এমনকি আমার হাতে অগাধ অর্থ ছিল না বলে দিনের পর দিন ওই ‘পতিদাহ’ চলতেই লাগলো। কোনোভাবেই ওই ‘পতিদাহ’ বন্ধ করা গেল না।
অথচ আমি তো সতীদাহও মানি না এবং পতিদাহকেও সহ্য করতে পারি না। তাই অবশেষে কী আর করা? ‘য : পলায়তি স: জীবতি’। পালিয়েই বাঁচলাম আমি।
কারণ ছিলাম আমি ঠিকই আর্থিকভাবে খুবই গরীব একজন মানুষ , তবু কোনো খারাপ নারীতে কখনোই আসক্তি ছিল না আমার। জানেন তো, পতঙ্গ নির্বোধ বটে, কিন্তু ফুল ছাড়া সে বসে না।


মন্তব্য ২৯ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (২৯) মন্তব্য লিখুন

১| ০৮ ই মে, ২০১৮ ভোর ৪:৩৭

জসীম অসীম বলেছেন: (গল্প):
জিরো প্লাস জিরো প্লাস জিরো: ইকুয়েল টু জিরো।
0+0+0=0

জসীম উদ্দিন অসীম

রচনা: সেপ্টেম্বর ১৯৯৬,
পশ্চিমচানপুর, কুমিল্লা।

(1) মঞ্চাভিনেতা এক যুবক: সে মিথুন-কর্কট-সিংহ-কন্যা-তুলা-বৃশ্চিক-ধনু-মকর-কুম্ভ-মীন-মেষ-বৃষ…ইত্যাদি রাশি বিষয়ে কোনো বিশ্বাসই রাখে না। একদিন সেই যুবক স্বপ্নে দেখে, হ্যাঁ স্বপ্নেই দেখে, স্বপ্নে দেখে এক দেশে আছে এক দেশ: সমাজতন্ত্রের দেশ। কিন্তু সেই দেশটা এখনও পৃথিবীতে নেই। তৈরি হয়নি।এখনও স্বপ্নেই আছে সেই দেশ। তবু সেখানে কেউ সমাজতন্ত্রবাদকে ‘ব্যাকডেটেড রাবিশ’ বলে মন্তব্য করে না। সে দেশে যে দু’হাতে মুদ্রা উপার্জন করে, তার পা সবাই চাটে না। অবশ্য দু’হাতে মুদ্রা সে দেশে কেউ উপার্জন করে না। করার দরকারও নেই। এমনকি করার উপায়ও নেই। সেই দেশে সরকারি কারখানা লোকসানে পড়ে বিক্রি হয় না বেসরকারি খাতে। দরপত্র নিয়েও তাই কোনো প্রশ্ন নেই। নেই তাই ‘প্রাইভেটাইজেশন বোর্ড’ কিংবা ‘কমিশন’। এমনকি সরকারি জায়গা কাউকে দরপত্রের মাধ্যমে দেওয়া হয় না ‘লীজ’। সেই দেশে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসদের মতো সাহিত্যিকগণ ন্যায্য সম্মান পান।
সেই দেশে আছে একজন মঞ্চ অভিনেতা, যে কেবল স্বপ্ন দেখে থাকে। বাস্তব জীবনে সে স্নাতক শ্রেণির বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের ছাত্র হলেও থিয়েটার ছাড়া তেমন কোনো বিষয়েই ইদানিং আর লেখাপড়াও তেমন করে না। এ জগৎ-সংসারে সে মঞ্চ ছাড়া আর কিছুই বুঝতে চায় না।
তার মাথায় অনেক স্বপ্ন। অতল অতল উর্বর স্বপ্ন। স্বপ্ন কেবল মঞ্চের। চলচ্চিত্রের এই বিপুল প্রভাবের যুগেও চলচ্চিত্র তাকে টানে না। চলচ্চিত্র নির্মাতা ঋত্বিক কুমার ঘটক-সত্যজিৎ রায় সম্পর্কে সে যথেষ্টই জানে, কিন্তু তার মাথায় একদিকে যেমন শিশির ভাদুরীর মতো ব্যক্তিরা উড়ে বেড়ান, তেমনি তার স্বপ্নে তার মঞ্চে চরিত্র হয়ে আসেন হিমাংশু কুমার দত্ত, মাস্টার দা’ সূর্যসেন, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, অমলেন্দু বিশ্বাসসহ আরও আরও সমাজসচেতন দায়িত্বশীল ব্যক্তিগণ।
আকাশ সংস্কৃতির বাণিজ্যিক প্রবল প্রতাপের কাছেও সে হার মানে না। ‘মিডিয়া’ বা ‘মাধ্যম’ তার কাছে বিষয় নয়, তার কাছে বিষয় হলো ‘সমাজতান্ত্রিক আদর্শ’ অথবা ‘সাম্যবাদ’। আদর্শ না থাকলে মিডিয়ার প্রচার ক্ষমতা দিয়ে কী লাভ হবে? তার কাছে প্রতিটি আদর্শহীন মিডিয়া’ই অর্থহীন। ‘আগে তো আদর্শ, তারপরেই তো মিডিয়া।’
সে দেখে বাংলাদেশে সমাজতান্ত্রিক আদর্শ প্রতিষ্ঠিতও নয়, প্রতিষ্ঠিত হওয়ারও সম্ভাবনা নেই। সে আরও দেখে কেউ সৎ নেই এই দেশে, শুধুমাত্র শিশুগুলো ছাড়া। সবাই দুর্বৃত্ত: কী রাজা আর কী প্রজা।
মঞ্চ অভিনেতা ও বাংলা সাহিত্যের এ ছাত্রটি দেখে দেশে তার পছন্দের মতো কোনো মঞ্চও নেই। তাই সে মনে মনে একটি কল্পনার মঞ্চ গড়ে নেয়। সেই মঞ্চেও কখনো এসে গান গায় রবীন্দ্র-ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরা। রবীন্দ্রজয়ন্তী পালিত হয়, নিউক্লিয়ার বিদ্যুতের সংকট নিয়ে কেউ কথা বলে পাখি, বঙ্গোপসাগর কথা বলে মঞ্চেরই এক সক্রিয় চরিত্র হয়ে।1971 সালের রক্তাক্ত পদ্মা-মেঘনা-যমুনা নদী ইতিহাস বলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের, মঞ্চে উপস্থিত হয়েই। সে মঞ্চে সে কখনো কাক, কখনো বক, কখনো বা কুকুরকে তুলে দিয়ে দারুণ অভিনয় করায়। এমন করে করে সে এ দুর্বৃত্তের দেশে সকল নিরীহকে প্রতিবাদী করে তুলে তার স্বপ্নে।
তার এ রকম খেলাধুলা দেখে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা ড. শিলালিপি চট্টাভট্টাচার্য এবং ‘হায় হায় বিশ্ববিদ্যালয়ে’র চোট্টা উপাচার্য প্রধানমন্ত্রীর কান ভারী করেন। এ বিষয়ে উপদেষ্টাদ্বয় একটি সংবাদ সম্মেলন করতে এসে সাংবাদিকদের নৃশংস প্রশ্নবাণে বিদ্ধ হয়ে পেছনের দরজা দিয়ে দ্রুত পালিয়ে যান।
আর মঞ্চের যুবক অভিনেতা সেই যুবকটি তিন তাসের ম্যাজিক দেখায় না কাউকে, তবে মানুষকে ‘বীর সখিনা’র গল্প শোনায়। আরও শোনায়: কিভাবে বীর প্রীতিলতা বিষ খেয়ে মরে গেলেন অথচ ইংরেজদের হাতে অসম্মানিত হলেন না। যুবক অভিনেতাটি সবাইকে বলে, যুদ্ধাপরাধী গোলাম আজমের ছেলে আবদুল্লাহ হিল আমান আযামীকে কেন সেনাবাহিনীর চাকুরি থেকে বাদ দিয়ে দেয়া উচিত। যেহেতু বাংলাদেশে এখনও রয়েছে কিছু হিজল গাছ, স্বর্ণচাপা, অর্জুন, কদম, কৃষ্ণচূড়া, ছাতিম অথবা বটবৃক্ষ...তাই যুবকটি শ্বাস নিয়ে এখনও বেঁচে আছে।
কিন্তু একসময় থিয়েটার বিরোধী কিছু সংখ্যক মুসলিম উগ্র মৌলবাদী যুবকের হাতে বন্দী হয় মঞ্চের সেই অভিনেতা যুবকটি। বন্দী থাকলেও একদিন রাতের স্বপ্নে, ঘুমে, সে এমনই এক স্বপ্ন দেখতে শুরু করে যে, সে বড় আশ্চর্যময়। সে স্বপ্নে দেখে দেশের চীফ অফ আর্মি ষ্টাফ তার চাকুরি ছেড়ে রীতিমত বেকার জীবনযাপন শুরু করেছেন। এমনকি তিনি ব্যবসাও করছেন না, শুধু বনে বনে ঘুরে ঘুরে ভালোবাসার কবিতা লিখে যাচ্ছেন। আরও দেখেন, সেই আর্মি চীফ তুরস্কের ক্ষুরধার মোল্লা নাসিরুদ্দিনের সঙ্গে বেশ চুটিয়েই আড্ডা মারছেন। মঞ্চাভিনেতা এই যুবকটি যখন স্বপ্ন দেখে, তার সঙ্গে গাছের বড় শিকড়ের সঙ্গে যেন মিল রেখেই স্বপ্ন দেখে। গাছের বড় শিকড় অজস্র ছোট শিকড়ের জাল ছড়িয়েও তলায় অনেকখানি নেমে গিয়ে মাটির ওপর গাছকে খাড়া রাখে। এই যুবকের অজস্র স্বপ্নের জালও ছড়িয়ে ছড়িয়ে ও মাটির গভীরে নেমে গিয়ে কিংবা মহাশূন্যে উঠে গিয়ে তাকে যেন বাঁচার শক্তি সরবরাহ যোগায়। তার কল্পনাশক্তিও তীব্র। একাত্তরের শহীদদের স্মরণে কেউ যদি কখনো কোথাও কিংবা শহীদমিনারে মোমবাতি প্রজ্জ্বলনের ব্যবস্থা করে, তখন সে মনে মনে ওখানে গিয়ে মোমবাতির আলো হয়ে যায়।
তার ঘুমের স্বপ্নে মঞ্চে এসে হাজির হয় কয়েকজন অভিনয়শিল্পী, যাদের পারফরমেন্সে সে দারুণ মুগ্ধ হয়। স্বপ্নবিলাসী এ যুবকটির স্বপ্ন প্রায়ই এসে জীবনেই মিশে যায় কিংবা জীবন গিয়ে স্বপ্নের সঙ্গেই মিশে যায়। জীবন ও স্বপ্ন কিংবা স্বপ্ন ও জীবন, বাস্তব কিংবা পরাবাস্তব কখনো কখনো তার কাছে ঠিক সরলরৈখিকই হয়ে যায়।
এই যুবকটির একটি ডাকনাম আছে ‘অমি’। এ নাম ধরেই এবার তার গল্পটি বলা যাক। বিশ শতকের নব্বই দশকের অনেক চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য তার জীবনে ও মননে, অভিনয়ে ও স্বপ্নে বারবার খুঁজে খুঁজে পাওয়া যায়।
‘অমি’-র ঘুমের স্বপ্নের মঞ্চে, স্বপ্নের থিয়েটারের মঞ্চে এসে হাজির হয় কিছু ছিন্নমূল মানুষ। ছিন্নমূলদের একজন শিক্ষিত প্রতিনিধি মঞ্চে এসে বলে, আমাদের একটি বাড়ি নেই। অথচ বাড়ি আছে অর্থের বিনিময়ে রাতারাতি লাইসেন্স যোগাড় করা একজন অসৎ ড্রাইভারেরও। আমাদের মতো মানুষ কোনো কোনো ঘরে থাকে ধারণ ক্ষমতার চেয়েও বেশি সংখ্যায়: জেলখানার মতোই। অথবা অনেকটা যাত্রী বোঝাই লোকাল বাস গাড়ির মতো। সে আরও বলে, আমাদের কাগজপত্র নেই, ব্যাংক আমাদের ঋণ দেয় না। জমির বর্তমান দর খুব বেশি। বাড়িওয়ালাদের তালিকা থেকে আমাদের নাম তাই বাদ পড়ে যায়। খুব সহজেই । চারদিকে জমির বেআইনী হস্তান্তর প্রক্রিয়া। বিড়ি কোম্পানীর প্রভাবশালী মালিকও ক্রমাগত একটির পর একটি বাড়ি করে চলে। কেউ কেউ তিনটা-চারটা-পাঁচটা...বাড়িও করে যাচ্ছে। অথচ আমাদের জমি পাওয়া কিংবা নিজস্ব বাড়ি হওয়ার ক্ষেত্রে শত শত বাধা। আমরা আজ ভূমিহীন মানুষ। কোনোভাবে মাথাগোঁজার আশায়, দিনরাত একটি জমির, একটি ঘরের রঙিন স্বপ্ন দেখি। তাই সন্ত্রাসীরা যখন কোথাও জ্বালিয়ে দেয় কারো ঘর কিংবা বাড়ি, তখন আমাদের খুবই কষ্ট হয়।
‘অমি’ ছিন্নমূলদের শিক্ষিত প্রতিনিধির ভাষণ শুনতে শুনতে কিছুটা ক্লান্তও হয়ে যায়। মার্কসবাদে তার দারুণ আসক্তি থাকলেও অস্তিত্ববাদ, পরাবাস্তববাদ কিংবা ফিউচারিজম, নিও-রিয়ালিজম ইত্যাদি ইজম এসে অমি-র মাথাটাকে তেতুঁলের চাটনির মতো গুলিয়ে দেয়। অবশ্য তেঁতুলের চাটনির কিছুটা অর্থমূল্য থাকলেও ‘অমি’-র মাথাটার কোনো মূল্যই নেই মানুষের কাছে। কিছু মানুষ অমি-কে পাগল বলে। কখনো কখনো মনে হয় কথাটা যেন একটুও মিথ্যে নয়। কারণ এ জগৎ সংসারে অমি-র মতো এমন ভাবনার মানুষ আমি আর দ্বিতীয়টি খুঁজে পাই না। সুতরাং ‘অমি’ পাগলই। পাগল আসলে ঠিক ‘অমি’ একাই নয়, পাগল আমিও। এই ধরুন: লেখার পাগল।পাগল- লেখক। কারণ গল্পটি আসলে অমি-রও নয়, গল্পটি আমার নিজের। আর আমি নিজেও বাস্তবে হয়তো একটা পাগল। পাগল না হলে কেন এ গল্পের শুরুতে গল্পের মূল চরিত্রটির নাম দিতে পারলাম না? কিংবা বলতে পারলাম না গল্পটি আসলে আমারই। এমন লোককে লোকে কি মাথা খারাপ বলবে না অন্য কিছু বলবে? তবু অমি-র মাধ্যমেই আমি এ গল্পটি বলা শেষ করি।কারণ অনেকেই অমি-র সৃষ্টিকর্ম, নাটক কিংবা মঞ্চ নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করে। আর আমি আমার এ জীবনটাকে নিয়েই পরীক্ষানিরীক্ষা করছি। এটা কি এ সমাজে সুস্থ লোকের কাজ? এ বয়সের যুবকেরা যখন যুবতী নারী আর অর্থের পেছনেই ছোটে, তখন আমি পুঁজিবাদবিরোধী সংগ্রামে উত্তাল দিনের স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসি। আর ভালোবাসি কিংবা স্বপ্ন দেখি মার্কসবাদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য নিজেকে শহীদী আত্মাহুতি দেওয়ার। এ কথা এই রাষ্ট্রের কেউ জানলে আমার মাথা আর আস্ত রাখবে না? মোটরসাইকেল চালক ও আরোহীগণও কখনো কখনো হেলমেট ব্যবহার করেন। অথচ আমি রাষ্ট্রের চালক হওয়ার স্বপ্ন দেখলেও আমার কোনোই হেলমেট নেই। তাইতো অন্যেরা আমাকে মাথা-খারাপ বা উন্মাদ বলে অভিহিত করে। কিন্তু আমি ভাবি যে নিজেকে শহীদী আত্মা‎‎হুতি দেওয়ার স্বপ্ন দেখে, সে কি তার নিজের মাথার কথা কখনো ভাবে? কেন সে হেলমেট যোগাড় করবে? ...ইত্যাদি। তবে আমি হেলমেট যোগাড় না করলেও পকেটে কিন্তু মরিচের গুড়া রাখি। সুযোগমত যদি কখনো যুদ্ধাপরাধীকে পাই, কমপক্ষে তার চোখে তো ছিটিয়ে দিতে পারবো। মরিচের এ গুড়াগুলোই যেন আমার কাছে পিস্তল-বন্দুক-কামান। যখন সংবাদপত্রে কোথাও কোনো শ্রমিককে চাকরিচ্যুত করার খবর পড়ি, তখন আমার ঐ এলাকাকে রণক্ষেত্র বানিয়ে দিতে ইচ্ছে করে। কারণ আমিও নিজেকে একজন শ্রমিকই মনে করি। তাই প্রায়ই আমার কাজের মালিকদের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে তর্কাতর্কি হয়। আমি মালিকদের প্রভু মনে করি না, করি না অহেতুক শ্রদ্ধা। অথচ আমার প্রতিদিন ব্যবহৃত ভাষা কিন্তু শ্রমিকদের ভাষা নয়, কারণ আঞ্চলিক ভাষা আমার মুখে শোভা পায় না। এমনকি আঞ্চলিক ভাষাকে কাব্যিক রূপ দিয়ে বাংলা সাহিত্যে কবি আল মাহমুদ নতুনধারা সৃষ্টির অনবদ্য অবদান রাখলেও সেটা নিয়ে আমি অনেক মন্দ কথাও বলে ফেলি কখনো কোথাও। যাক, স্বপ্নের বিষয়ে আবারও আসি। ছিন্নমূল মানুষদের শিক্ষিত প্রতিনিধি মঞ্চে উঠে আরও বলতে থাকে, আমরা প্রতিদিন ঘর দেখি। আকাশ ছোঁয়া ঘর থেকে শুরু করে নৌকার ছইয়ের মতো ঘর। দেখি মাটির নিচের প্রাসাদ। অথচ আমাদের কোনো ঘরই নেই। নেই একটি গাড়ি। আমরা উচ্চবিত্ত পরিবারের মানুষের মতো এতোটা শৌখিন নই, তাই নকশাখচিত বাড়ির স্বপ্নে বিভোর নই আমরা। তাই কখনো খুব নেশাগ্রস্তও থাকি না। স্বপ্ন দেখি না কবিগুরুর কুঠিবাড়ির মতো বাড়িতে বসে রাশি রাশি কবিতা লেখার।
আমরা চাই ছায়াদার কোনো বৃক্ষের তলে সাধারণ একটি ঘর। সাধারণ একটি আশ্রয়। তারপর মঞ্চের সমস্ত ছিন্নমূল মানুষ সম্মিলিত কিংবা কোরাস কণ্ঠে বলে, আমরা খুব সংকটে আছি। আমরা এখনও ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ের শরণার্থী বাঙ্গালী। আমরা বেঁচে থাকতে চাই, অথচ আমাদের জীবন আজ খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। ঠিক তখনই
মঞ্চের ছিন্নমূল মানুষের মধ্য থেকে একটি নারীকণ্ঠ বলে, এ শহরে এ পৃথিবীতে আমাদের নিজস্ব কোনো জায়গা নেই, বাঁচার একটি চাকরি নেই, নেই নিজস্ব ছোটপুজিঁর কোনো ব্যবসাও। অথচ আমরা বাঁচার জন্য কতো শত রকমের কাজকর্ম করি। আমাদের নেই তাই নির্ধারিত পেশাও। আছে অনাহারে রাত কাটানোর যন্ত্রণা।
আমরা এ অগ্নিদগ্ধ পৃথিবীর মানুষ। তাই যখন চাঁদে পানির সন্ধানে এতো আয়োজন, তখন আমাদের বাড়িঘরের কোনো খবরই নেই। আমরা প্রতিদিন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বেঁচে থাকি। হয়তো নিঃসন্দেহে জীবনবিলাসী আমরা। তা না হলে এতো দুঃখেও কেউ বাঁচতে চায় না। কিন্তু আমরা বাঁচতে চাই। যদি আমরা লটারীতে ১০-৫০ লাখ টাকা পেয়ে যেতাম, তাহলে অনেক ছিন্নমূল মানুষের বাড়িঘরের স্বপ্ন বাস্তবায়নে সকাল-সন্ধ্যা ব্যস্ত হয়ে যেতাম। যেহেতু আমরা নিঃসন্দেহে জীবনবিলাসী মানুষ, তাই এতো অভাব-অনটনেও বাঁচতে ভালোবাসি। তারপর মঞ্চে এক দৃঢ় মৌনতা এবং অন্ধকার নেমে আসে।
আমি তখন প্রায় প্রতিদিনই রোজা রাখা এসব মানুষদের নিয়ে ভাবতে থাকি। রোদে পোড়া ফ্যাকাসে এসব মানুষ কারোর করুণা পায় না। যদিও সব শ্রেণির মানুষই একদিন দাহ হবে কিংবা মাটির বিছানায় মিশে যাবে। কিন্তু সে-তো মৃত্যুর পর। কিন্তু বেঁচে থাকা অবস্থায়তো পার্থক্য কোনোদিনও দূর হবে না।
যারা প্রতিদিন মৃত্যুর প্রহর গুণে বেঁচে থাকে, আমি এখনও মনে করি সমাজতন্ত্রের আদর্শ প্রচারে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় তাদের মুক্তি মিলতে পারে। এ নিয়ে কথা বলতে গেলেই বিভিন্ন মানুষের তোপের মুখে পড়ি আমি। কেউ বলে, যে শিশুর জন্ম হলো বিভিন্ন ক্রটি নিয়ে, তাকে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র কিভাবে ভালো করবে? কেউ বলে সমাজতন্ত্রের গ্রাহক যে বাড়াচ্ছো, কমিশন কতো পাবে? কী পাবে?... এসব শুনলে মাথা গরম হয়ে যায় আমার। কিছু লোক সব কিছুতেই স্বার্থ খুঁজে বেড়ায়।স্বার্থহীন কিছু জগতে রয়েছে বলেও তারা বিশ্বাস করে না।
আরেকটি বিষয়: অনেক ভেবেই দেখেছি আমিও: এই ২৬ বছর বয়সটিই কিন্তু রক্ত গরমেরই বয়স। এই যে আমারও এখন বিয়ে করারই বয়স। কিন্তু আমাদের এই অভাবের জনবহুল সংসারে কি এখন আমার বিয়ে করা সম্ভব? পরিবারের সব্বার স্বার্থ মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে? অথচ সমাজতান্ত্রিক দেশ হলে সম্ভবত রাষ্ট্র আমাকে বিয়ে খাতে নিশ্চয়ই ঋণ দিতো অথবা সহায়তা করতো কোনো না কোনোভাবেই। আমার কাছে এখন কোনো মেয়ের বাবাই তার আদরের মেয়েকে দেবে না। প্রয়োজনে কোনো অর্থে সক্ষম কিন্তু শরীরে অক্ষম বুড়োর সঙ্গেই দেবে: যে বুড়োর ইট-রড-সিমেন্ট কেনার ভালো সামর্থ্য রয়েছে। অথচ কন্যার বাবারা দেখবে না বুড়ো বরটির ঐ (...) ক্ষমতা নেই। আমাকে নিয়ে আমার বাবা-মায়ের অনেক আশা ছিল। কিন্তু দেশ-রাষ্ট্র-সমাজ-সংসার-ধর্ম-দর্শন-সাহিত্য-সংসংস্কৃতি...ইত্যাদি নিয়ে ভেবে ভেবে আমার মাথা খারাপ বলে, বাবা এখন আমার প্রতি খুবই হতাশ। মা বলেন, বাবারে, কী হবে এতোসব ভেবে? আমি মাকে বলি, মানুষের জীবনটা কোনো ডিপফ্রিজ নয় মা, যা এ কালের প্রায় সব যুবতীই ভাবে। এই দেশের সোনার ছেলে ক্ষুদিরাম বসু, সূর্য সেন, শহীদ রফিক, কর্ণেল তাহের, নূর হোসেনরা এই ডিপফ্রিজের জন্য তাদের সোনার জীবন বলি দিয়ে যায়নি মা। জীবনটা ভারতের অমিতাভ বচ্চন অভিনীত বাণিজ্যিক সিনেমা নয়। অথচ এই দেশে লুটপাটের নাম হয়ে গেছে জীবন। না খেয়ে মরে গেলেও এই লুটপাটে অংশ নিতে পারবো না আমি। কোনোদিনও না। মা বলেন, এইভাবে চিন্তা করলে তুই বাঁচবি কোনদেশে? শুধু একজন মানুষ তো এই দুনিয়া ঠিক করতে পারবে না। আমি বলি, আমি একা নই। পৃথিবীতে আমার মতো এমন ভাবনার মানুষ আরো আছেন। হয়তো তাদের সঙ্গে আমার এখন কোনো যোগাযোগই নেই। যোগাযোগ তৈরি করতে হবে। না হলেও দুঃখ নেই। কারণ তারা আমার মৃত্যুর পরে হলেও আমাকে চেনে নেবে। মা এসব শুনলে অবশ্য আর আলাপ চালায় না।
কিন্তু আমি ঘুমের স্বপ্নের মঞ্চে যেসব ছিন্নমূল মানুষের কথা শুনি, তা আমার রক্তে প্রবেশ করে। আমি যেন একাই দর্শক সেই মঞ্চ নাটকের। আমি তাদেরকে কিভাবে ক্ষতিপূরণ দেবো? এই জীবনে আমি কোনোদিন নির্বাচনেও ভোট দেইনি, দেবোও না কোনোদিন। কোনো চোরকে আমি ভোট দিতে পারবো না। প্রার্থীদের কাতারে কাতারে চোরের মুখ দেখে দেখে নির্বাচনের প্রতি ঘৃণাও তৈরি হয়েছে আমার। বমি আসে। তাই ব্যালটে নয়, বুলেটে বিশ্বাসী আমি। লুটেরা কেন নির্বাচনে অংশ নিতে পারে? ছিন্নমূল মানুষের জন্য ওরা কী করবে? বরং ক্ষমতায় গিয়ে লুট করবে আরও বেশি।
তবে আমি স্বপ্নের মঞ্চে দারুণভাবে উপভোগ করি ছিন্নমূলদের অভিনয়। আমার ইচ্ছে করছিল তখন, আমি নিজেই মঞ্চে প্রবেশ করে অভিনয়ের সঙ্গে যুক্ত হই। কিন্তু তার আগেই আলো জ্বলে উঠে মঞ্চে। দেখি মঞ্চে প্রবেশ করেছে চরিত্র হয়ে স্বয়ং ‘বাংলাদেশ’। বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকা আবৃত ‘বাংলাদেশ’ চরিত্রটি দেখে আমি ভেবেই পাই না এ আবার কেমন চরিত্র? একটি দেশ কিভাবে একটি চরিত্রের দায়িত্ব পালন করে এবং কথাও বলছে মানুষেরই মতো? এ কী করে সম্ভব? কিন্তু সম্ভব। মঞ্চে সত্যি সত্যিই এসেছে ‘বাংলাদেশ’। তবে তার মানচিত্রের সবুজ জমিনে বেয়নেটে চার্জ করার দাগ রয়েছে। চোখ রয়েছে কালো কাপড়ে বাঁধা। তারপরও ‘বাংলাদেশ’ কথা বলতে থাকে! ‘সমাজতন্ত্র ফেরৎ চাই আমার সংবিধানে। বিচার চাই সংবিধান ধর্ষণকারীর আজ। যারা এখনও এই আমাকে ধর্ষণের ‎‎হুমকি দেয়, কিংবা চিতায় ধু-ধু করে জ্বালিয়ে দিতে চায়, যারা চাষীর রক্ত করে পান, আমি তাদের মৃত্যুবরণে বাধ্য করতে চাই।'
কতোদিন যেন কোনঠাসা ছিলাম আমি। ‘বাংলাদেশে’র মুখে এমন শব্দগুচ্ছ পেয়ে ‘সাঁওতাল বিদ্রোহে’র কথা মনে পড়ে আমার। বাংলাদেশের মুখে এমন ইস্পাতদৃঢ় রক্তব্য শুনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের (টিএসসি) আড্ডার দিনগুলোর কথা মনে পড়ে আমার। তখনও আমার স্বপ্ন ছিল ঐ একটাই। থিয়েটারের মাধ্যমে দেশের জন্য কিছু একটা করা। পরে আমি সমাজতান্ত্রিক থিয়েটারের স্বপ্ন দেখতে থাকি। তখন থেকেই বিভিন্ন লোক বলতে থাকে, আমাকে নাকি কার্লমার্কস-লেনিন-স্ট্যালিনের ভূতে ধরেছে। আমি বলি, কিউবার ফিদেল ক্যাস্ট্রোকে কার ভূতে ধরেছে? আমি বলি, সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে গেছে ঠিকই। কিন্তু সমাজতন্ত্রের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক এখনও শেষ হয়নি। ঠিক একই রকম বক্তব্য শুনলাম মঞ্চের ‘বাংলাদেশ’ চরিত্রের মুখ থেকেও: ‘সমাজতন্ত্র ফেরৎ চাই আমার সংবিধানে।’ তাহলে আমার আর বাংলাদেশের চাওয়ার মধ্যে তো কোনো ফারাকই নেই। আমি তো কবরের স্বপ্ন দেখি না, জীবনের স্বপ্ন দেখি। আমি যখন ঢাকায় পড়ছিলাম, বাংলা বিভাগের অনার্স কোর্সের ছাত্র, তখন আমার দিনগুলো যেন স্বপ্নেই কেটেছিল। তখন দুঃখময়ী এ দেশের মানুষের মুখে হাসি দেখার স্বপ্নে আচ্ছন্ন ছিল আমার সব দিন। আমার সেই সব কৃতিত্বপূর্ণ দিনগুলোতে আমি মুদ্রার স্বপ্নে বিভোর থাকতে পারতাম। কিন্তু আমি শত দারিদ্রে বসবাস করেও মুদ্রার নেশায় নিজেকে হারিয়ে দেইনি। পাঁচ ফুট দুই ইঞ্চি উচ্চতার ১৭ বছর বয়সী মেয়ে ‘রূপালি’ তখন আমাকে নিয়ে পালাতেও প্রস্তুত ছিলো। কিন্তু আমি ছিলাম মানব-মানবীর প্রেমের নামে জুয়াখেলার বিপক্ষের একজন যুবক। সেই সময়ের থিয়েটারের প্রতি প্রেম আমার, সমাজতন্ত্রের প্রতি প্রেম আমার বারবার প্রত্যাবর্তন করেছে। তাই ঘুমের স্বপ্নে কখনো চড়েছি মধ্যরাতের ট্রেনে। কখনো দেখেছি মঞ্চে এসে কথা বলে ‘বাংলাদেশ’।
‘বাংলাদেশ’ আবারও বলতে থাকে: আর নয় স্বল্পতম মূল্যে মানুষ বেচা। আবার চাই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের জনসমুদ্র এই দেশে। এই উদ্যানে যেমন করে পাকিস্তানীদের মাথা নত করা হয়েছিল ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর, ঠিক সেভাবে শান্তি কমিটির হোতাদেরও আজকে ফাঁসি চাই। ফেরৎ চাই সমাজতন্ত্র আবার, আমার সংবিধানে। যে সংসদ মানে না সমাজতন্ত্র, মশাল ছুঁড়ে আগুন লাগাবো সেখানে। আগুন ধরিয়ে দেবো আমি শোষণের আদিম আইনে। লাল রক্তে রঞ্জিত হবে সংসদভবনের পথ। রক্ত যমুনা বয়ে যাবে শহর থেকে শহরে, যদি না আমার সংবিধানে সমাজতন্ত্র থাকে।
আমার বুকে আর চাই না বিকলাঙ্গ জাতি। আমি আজ হাড্ডিসার এক দেশ। এ দেশটাতে নিজের মাংস বেচার পেশার অবসান হবে কবে? মানুষ শিকারের অবৈধ অধিকার বন্ধ হবে কবে? অনেকবার আন্দোলনে আমার সন্তানের রক্ত ঝরেছে কেবল। যুদ্ধ-বিধ্বস্ত হয়েছি আমি অনেক। মেঘাচ্ছন্ন সংবিধানকে মেনে নেবো না আর। বন্ধ হোক মানুষ শিকারের অবৈধ অধিকার। সমাজতন্ত্র ফেরৎ চাই আমার সংবিধানে। আমি স্নিগ্ধ হয়ে উঠবো নির্মাণে নির্মাণে।
এভাবে বক্তব্য শেষ করে ‘বাংলাদেশ' যেই মঞ্চ ছেড়ে যাবে, ঠিক তখনই আমি মঞ্চে উঠে ‘বাংলাদেশ'কে জড়িয়ে ধরি। দেখি জাতীয় পতাকায় আবৃত ‘বাংলাদেশে’র শরীরে জড়ানো ভারতীয় অবৈধ শাড়ি। একি! তাহলে কি ‘বাংলাদেশ’ও এতক্ষণ মিথ্যেই বলে গেল? তবে কি এ ‘বাংলাদেশ' সমাজতন্ত্র চায়? নাকি আসলে চাওয়ার অভিনয় করে? মঞ্চকে একদা মন্দির-মসজিদ-গীর্জার মতো পবিত্র বলেছিলেন নাট্যকর্মী জন মার্টিন আমাকে। থিয়েটারের ওয়ার্কশপে। সে কথা এখনও আমার স্পষ্ট মনে আছে। জন মার্টিনকে আমি প্রথম বিটিভি-তে দেখি ১৯৮৯ সালে কবি কাজী নজরুল ইসলামের উপন্যাস ‘মৃত্যুক্ষুধা’ অবলম্বনে ধারাবাহিক নাটকে ‘প্যাকালে’ চরিত্রে। কাজী আবু জাফর সিদ্দিকী ছিলেন সেই নাটকের প্রযোজক। আজ এই জন মার্টিনের গীর্জাসম পবিত্র মঞ্চে দাঁড়িয়ে ‘বাংলাদেশ'ও মিথ্যে কথা বলবে? এ কথা সহ্য করবো না আমি।
কিন্তু না, একটু পরেই ‘বাংলাদেশ'কেও খুঁজে পাইনি আমি। যেতে যেতে ‘বাংলাদেশ' বলে, ‘বাংলাদেশ’ যেন এখন একটি চর। এই চরে চলছে লুটপাট। শান্তি অপহৃত। সমাজতন্ত্র কতো শত বছর পরে আসে, তার কোনো নিশ্চয়তাই নেই। এমনও হতে পারে, কোনোদিনও আসবে না কিংবা পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্নই হবে সমাজতান্ত্রিক আদর্শ। তখন তা আর সংবিধানে কী করে স্থান নেবে? তাহলে তুমি কিভাবে বুঝে নেবে তোমার সংবিধান থেকে সেই কাঙ্খিত সমাজের আদর্শিক নীতিমালা? মনে হয় সংবিধানে স্থান পাওয়া নয়, সমাজতন্ত্র সমাহিতই হবে।'
এসব শুনে আবার আমার মাথায় রক্ত উঠে। ছোটবেলায় একবার এক দুর্ঘটনায় আমার মাথা ছিদ্র হয়ে অনেক রক্ত ঝরেছিল। পরে তা জোড়া লাগলে আমার সাহস আবারও বেড়ে যায়। আমি তখন আমার সঙ্গীসাথীদের সঙ্গে ঝগড়া লাগলে মাথা দিয়েই আঘাত করতাম বেশি। বলতাম, এ মাথা আমার পরীক্ষিত মাথা। সেই থেকে এই মাথার ওপর চাপ বাড়ছে আমার। এখনও বিভিন্ন চাপ। সামলানোটাই আমার মাথার জন্য বিরাট চ্যালেঞ্জ হয়ে যায়। আমাকে সেই চ্যালেঞ্জের মুখে আবার ফেলে দিয়েছে এই মঞ্চের চরিত্র ‘বাংলাদেশ'। তার শেষের ভন্ডামি দেখে আমার মাথার শৈশবের সেই ছিদ্রপথে আবারও রক্ত ঝরে। অথচ ‘বাংলাদেশ’ এর মঞ্চে এসে সমাজতন্ত্রের জয়গান শুনে দারুণ রোমাঞ্চ অনুভব করেছিলাম। মঞ্চে এলেই কি ‘রাজনীতিবিদ'দের মতো সবাই মিথ্যেবাদী হয়ে যায় কিংবা হয়ে যায় সৎ চরিত্রাভিনেতা? আমি যদি মরিচচাষী হতাম, তাহলে ভাতের বদলে এমন মিথ্যেবাদীদের কমপক্ষে একমাসকাল শুধু মরিচ খাইয়ে বাঁচাতাম।
তারপর মঞ্চে আসে কৃষক। ততক্ষনে আমি আবার দর্শক সারিতে নেমে আসি। কিন্তু আমি কৃষককে ডেকে বলি, তোমরা কি প্রকৃতই কৃষক নাকি কৃষকের অভিনয় করছো? তোমাদের অভিনয় ভালো হচ্ছে না। থিয়েটার কিন্তু ছেলেখেলা নয়। থিয়েটার ধর্মচর্চার মতো। তাই ঐ মঞ্চে দাঁড়িয়ে মিথ্যে কথা বললে আমি এর প্রতিশোধ নেবো। এ মঞ্চের প্রেমে পড়ে পৃথিবীর অনেক মঞ্চপাগল তাদের জীবনের সব চাওয়া-পাওয়া ছেড়েছিলেন। আমিও আজ সেই পথেরই পথিক। তাই মঞ্চকে মিথ্যুকের মিথ্যার কলঙ্কে কলঙ্কিত হতে দেবো না।
আমার কথা শুনে এবার মঞ্চের কৃষক বলে, কৃষকের এ দেশে সবচেয়ে বেশি কোনঠাসা কৃষকই। এমন হলে কেমন করে এগিয়ে যাবে স্বপ্নের বাংলাদেশ। আপনারা সবাই যখন ঢাকায় বাড়ি করার স্বপ্নে বিভোর, তখন আমাদের জমি-বাড়ি গিলে খায় নদী। ফারাক্কার বাঁধের জন্য কার ক্ষতি হয়েছে বেশি? কৃষকের। জমিখেকো-ভূমিখেকোদের বড় শিকার কারা? কৃষক। আমাদের কেউ স্বেচ্ছায় রক্ত দেয় না। অথচ আমরা পুরো জাতিকে স্বেচ্ছায় খাদ্য-রক্ত দেই। অথচ আজ আমাদের কিছুই করার নেই। হাত-পা বাঁধা আমাদের। বিদ্যুৎ সংকটে আমাদের সেচ বন্ধ থাকলে উৎপাদনে যেমন ধস নামে, তেমনি আমাদের ফসলের দামও যায় কমে। এসব কথা সত্য। আমরা মিথ্যা বলা বুঝি না। নদীমাতৃক বাংলাদেশের কৃষক আমরা-পদ্মা-মেঘনার ভাঙ্গনের সঙ্গে লড়াই করে বাঁচি। নদীতে যখন তলিয়ে যায় জমি, তখনও স্বপ্ন দেখি। এই স্বপ্ন ছাড়া পুঁজি বলতে আজ আর আমাদের কিছুই নেই। পিঁড়িতে বসে ভাত খাই, মিথ্যা বুঝি না ভাই। আমরা যদি মিথ্যা করে বলি, বাংলাদেশে আর সত্য বলবে কারা?
আমি বলি, মিথ্যে কথা বললে মরে যাবে তুমি। পুড়ে যাবে এ মঞ্চ। এইতো সেদিন ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কলকাতার ‘স্টার থিয়েটার’ কেমন করে পুড়ে দগ্ধ হলো। অথচ শত তারকার মধুর স্মৃতিতে এ মঞ্চ ধন্য ছিল। সুতরাং সাবধান। এটা মঞ্চ। বাণিজ্য কমপ্লেক্স নয়। এখানে দাঁড়িয়ে মিথ্যে কথা বললে এ মঞ্চের সব নকশা খসে পড়ে যাবে। আমার কথা শুনে কৃষক বলে, আগুনে পোড়ালেও আমি সত্য বলে যাবো। মিথ্যা বলা বুঝি না ভাই। আগুনে পোড়ালেও আমি সত্য বলে যাবো। মুক্তির চূড়াবিহারী মানুষ আমি: আমরা। দেবতার নাম করে রাক্ষসে ভরেছে সমাজ। স্বৈরাচারী পদ্মা গিলে কৃষক-চত্বর আমার। প্রহৃত হৃদয় নিয়ে তারপরও মুক্তির কথা বলি। আগুনে পোড়ালেও এই মুক্তির কথা বলে যাবো ফ্রান্সের সেই মুক্তির দূত জোয়ান অব আর্কের মতো।
এবার বাংলার কৃষকের এ কথাগুলো শুনে আমার সত্যি ভালো লাগে। সরাসরি সমাজতন্ত্রের কথা সে না বললেও সব সময় অজ্ঞাতকুলশীল হয়ে থাকা এ শ্রেণির কোনো প্রতিনিধির মুখে এমন স্পষ্ট বক্তব্য আমাকে সত্যি আনন্দ দেয়। কারণ আমি প্রেমিক। থিয়েটারের এবং সমাজতন্ত্রের। এ বিষয়ে ভবিষ্যতে আমি অভিসন্দর্ভ রচনা করবো। নাট্যপরিচালক স্তানিস্লাভস্কি তাই এখনো আমার নিয়মিত পাঠের বিষয়। ‘দুর্বার নাট্যচক্রে’র কর্মশালায় এসে অভিনেতা আবুল হায়াৎ বলেছিলেন, ‘দেওয়ান গাজীর কিচ্ছা' একবার নয়, বারবার দেখবে মঞ্চে। তাহলে বুঝবে অনেকদিন পর পর নাটকের প্রোডাকশন। আমি আবুল হায়াতের থিয়েটার প্রেম অনুভব করি। এই পৃথিবীতে কারো ইশক নবীর প্রতি, কারো ইশক নারীর প্রতি। আর আমার ইশক বর্তমানে থিয়েটার ও সমাজতন্ত্রের প্রতি। তাই আমি যাকে পাই, তার কাছেই সমাজতান্ত্রির থিয়েটারের গল্প বলি। আমার বাবা বলেন, এটা সমাজতন্ত্রের দেশ নয়। তাই শেষ পর্যন্ত তুই আপোষ করতে বাধ্য হবি। আমি বলি, না। মরলেও না। বাবা কিছুটা ব্যঙ্গের রসে হাসেন। আমার তখন মনে হয়, তাহলে কি আমার বাবাও এই সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা পছন্দ করেন না? আমি আমার বাসার চে গুয়েভারার পোস্টারটিকে দরজায় এনে লাগাই। ‘অলওয়েজ ফর ভিক্টোরী। হোমল্যান্ড অর ডেথ।' “ইসলামী ব্যাংকে”র একজন কর্মকর্তা সেদিন আমাদের বাসায় এসেছিলেন অন্য কাজে। চে-কে দেখে বলেন, এটা তো কমিউনিস্টের পোস্টার। আমি বলি, এই বাসাটাও কিউবার আরেকটি দূতাবাস। সঙ্গে সঙ্গে আমি ভারতের কমিউনিস্ট নেতা জ্যোতি বসুর জীবনের কিছুটা উদাহরণ নিয়ে আসি। তাকে বলি, যদি পারেন, পশ্চিমবঙ্গের বিশিষ্ট চলচ্চিত্র পরিচালক ঋত্বিক কুমার ঘটক কিংবা মৃণাল সেনের কিছু ছবি দেখবেন। তাহলে বুঝবেন কমিউনিস্টরা কেন এতোটা শ্রদ্ধেয়। আপনারাই তাদের না বুঝে বদনাম করেছেন। সমাজ এখন যেভাবে অর্থবিত্তের দিকে ধাবমান, এটি একটি রাষ্ট্রের সঠিক পন্থা নয়।
কিন্তু এভাবে বলতে বলতে একসময় আমিও ক্লান্ত হই। এভাবে বলাটাতে কি কোনো মুক্তি আছে? একসময় আমার ঘুমও ভাঙ্গে। স্বপ্নও টুটে যায়। স্বপ্নে দেখা মঞ্চ নাটকের চরিত্রেরাও হারিয়ে যায়। যদিও মন থেকে মুছে যায় না তাদের বক্তব্য।
এ কেমন সময়: সবাই কেবল অর্থের পেছনেই দৌড়াবে? আদর্শের কি কোনোই মূল্যই নেই? আদর্শের অনুভূতিতে আঘাতকারী ব্যক্তিরা লুটেপুটে খাচ্ছে সব। এর সমাধানটা কী? শান্তি কমিটির লোকেরা এখন অনেকেই ‘জামায়াত ইসলামী’ করে। কিন্তু আমি দেখেছি।‘জামাতি হামলা’ও কম নৃশংস নয়। ওদের মধ্যেই প্রথম জীবনে সহিংসতা দেখি আমি। কিন্তু আমার প্রায়ই মনে হয় বিশ্ব ইজতেমা অভিমুখে লাখো মুসল্লির স্রোত যেভাবে নামে, সেভাবে যদি সারাদেশের সর্বস্তরের লোক সমাজতান্ত্রিক কোনো সম্মেলনে উপস্থিত হতো, কতো সম্ভাবনা ছিল। আমার এমন মতামত সেদিন আমার বর্তমান বসবাস স্থান কুমিল্লা শহরের পশ্চিমচানপুরের কিছু সংখ্যক লোকের সঙ্গে বিনিময় করার পর এলাকা থেকে আমাকে বহিস্কারের নিরব বিক্ষোভ শুরু হয়েছে। পরিস্থিতি বাবা কিছুটা সামাল না দিলে বিক্ষোভ সরবও হতে পারতো। কেউ কেউ মনে করেছেন, আমার মারাত্মক পতন হয়েছে। বলা চলে এ এলাকায় আমি অনেকটা নি:সঙ্গ হয়ে পড়েছি। ক্ষোভ থেকে কেউ কেউ আমার প্রতি বদলাও নিতে পারে। একজন সেদিন আমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলেছে, আমি মারা গেলে আমার লাশে নাকি সে প্রশ্রাবও করবে। ঠিক এই লোকটিকে এখনই আমি খুন করতে পারি। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে আইন-আদালত হলে আমার অসুস্থ মা আরও বেশি অসুস্থ হয়ে দ্রুতই মারা যাবেন। মাঝে মাঝে মনে হয় বৈষম্যহীন সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র পাওয়ার যোগ্য নয় এ জাতি। লাথি মারতে ইচ্ছে করে জঙ্গিবাদী তৎপরতার মদদদাতাদের বুকে। আমি ভালোবাসি সমাজতন্ত্র। মার্কসীয় নন্দনত্ত্বের আলোকে আমি কবিতা লিখি। টাকা পেলে ঠিক সেই ধারার ফিল্ম বানানোরও স্বপ্ন আছে। আমার এসব ভাবনার জন্য অসংখ্য লোক আমাকে সামনে পিছনে পাগল বলেও মন্তব্য করে। কিন্তু পাগল কি স্নিগ্ধ বকুলতলা ভালোবাসে? ঢাকার যাত্রাবাড়ি মোড় থেকে হাঁটতে হাঁটতে ২৫০ দক্ষিণ যাত্রাবাড়ির আব্বাস উদ্দিন রোডের তার বন্ধু আবিদ হোসেনের বাসার দোতলায় গিয়ে আড্ডা মারে, ভাত খায়? অথবা সেখান থেকে আবারও হেঁটে মতিঝিল জনতা ব্যাংক মোড়ে যায় কোনো প্রয়োজনীয় কাজে? অথবা ঢাকা নিউমার্কেটে যায় মঞ্চ নাটকের পাণ্ডুলিপি ফটোকপি করতে? কিন্তু আমি করি। তাহলে আমি কী রকম পাগল? আমার ইচ্ছে করে বন্ধুদের সঙ্গে বনভোজনে যেতে। কবিতার সবুজ আশ্রয়ে অনেক বড় হতে। কিন্তু আমার মেধার অনেক ফসল অবশ্য পোক্ত হওয়ার অনেক আগেই বিক্রি করে দিতে হয় বিভিন্ন মহাজনের কাছে। এর চেয়ে বড় ট্রাজেডি মানবজীবনে আর কী আছে?
প্রতিদিন হৃদয় আবদ্ধ হয় আরও বেশি সংকটের জালে। তারপরও সমাজতন্ত্রের স্বপ্ন দেখি আমি। ঐতিহাসিক বস্তুবাদ-দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ অধ্যয়নে যে পরিমাণ সময় খরচ হয় আমার, নিজের শরীরের প্রতি যদি তার অর্ধেকও ব্যয় হতো, আমার চেহারা-সুরত আরও ভালো থাকতো। সাহসের অভাবে বাগানে বাগানে ফুল ফোটা বন্ধ হয়ে গেলেও আমি সমাজতন্ত্রের সৈনিক হিসেবে
হলেও বেঁচে থাকতে চাই। আমার এমন নেশা বাস্তবসম্মত? নাকি আমি মিথ্যে কথা বলছি? নাকি দেখছি অলীক স্বপ্ন? অলীক কেন হবে? ভ্লাদিমীর ইলিচ লেনিন তো তা বাস্তবে দেখিয়ে গেছেন। রাশিয়ায় । ১৯১৭ সালে।
আমাদের সমাজ জীবনের কৃষকেরা আজ এতটা সাহসী নয়। দুর্গন্ধযুক্ত সমাজ তাদেরকে যেন কোনো পীড়া দেয় না। তাদের সাহস আজকাল ক্রমাগত শুকিয়ে শুকিয়ে মরু হতে দেখেছি আমি। দেখেছি আরও সব আদর্শের বড় আদর্শ হয়ে গেছে টাকা। কুত্তার বাচ্চা টাকা। টাকা পেতে আর জীবন ধরে রাখতে ঢাকা শহরের দিকে প্রতিদিন মানুষের যেভাবে স্রোত নামে, তা অবাক করার মতো। তাহলে শক্তি বেশি কার? টাকার নাকি আদর্শের? টাকা হলে কি আদর্শও কিনতে পাওয়া যায়? এসব প্রশ্নের সঠিক উত্তর এখনও পাচ্ছি না আমি।
কারণ চোখের সামনেই টাকার কাছে বিক্রি হয়ে গেছে মন্দিরের প্রতিমা, বৌদ্ধমূর্তি। কোথাও কোথাও জন্মভূমির মাটির গন্ধ। টাকার জন্য এ দেশ এখন বাজার, বিভিন্ন গোষ্ঠীর। অথচ এ দেশ লক্ষ শহীদের রক্তে সিক্ত দেশ। আজ হয়েছে টাকার উপনিবেশ। টাকার কাছে বিপন্ন আজ লেখক, লোকগায়কের সুর। বৈপ্লবিক যাবতীয় পদক্ষেপ।
মায়াবী জালের এমন টাকার সঙ্গে লড়াই করে টিকে থাকতে পারবো? টাকার অভাবে কতো পরিবারের জমজমাট আড্ডা মরে গেছে। ফুল ফোটানোর আগেই মরেছে শত গোলাপ গাছ। টাকার কাছে বিক্রি হয়ে পূর্ব পাকিস্তানের বিদ্রোহী আত্মা স্বাধীন বাংলাদেশে আবার হা

২| ০৮ ই মে, ২০১৮ ভোর ৪:৪৬

জসীম অসীম বলেছেন: আমার বুড়ো হওয়া দেথেননি মা। অথচ মা বলতেন, তুই হারিয়ে গিয়ে বুড়ো হয়ে ফিরে এলেও আমি ঠিক তোকে চিনে নেবো। আমি বললতাম, কিভাবে? মা বলতেন, তোর চোখ দেখে। 'কী আছে আমার চোখে সেই সনাক্তকরণ চিহ্ন?' মা বলতেন, 'শ্যেনদৃষ্টি'। সত্যি। পিতা হওয়ার পর আমিও আমার অনেক ছবি পর্যবেক্ষণ করে দেথেছি, আমার শৈশব থেকে শুরু করে প্রায় প্রতিটি 'রিয়েল ফটো'তেই রয়েছে সেই শ্যেনদৃষ্টি=শকুনদৃষ্টি। অবাক হই একজন মা তার সন্তানকে শুধু গর্ভেই নন, মনে মগজেও কতোটাই না ধারণ করেন।

৩| ০৮ ই মে, ২০১৮ ভোর ৪:৫৮

জসীম অসীম বলেছেন: কবিতা:
জ্বলে লাদেন টাওয়ার
জসীম উদ্দিন অসীম:

আগুন জ্বলে ঐ ইরাকে দারুণ আগুন জ্বলে
আগুন জ্বলে কান্দাহারে ফোরাত নদীর জলে
আগুন জ্বলে টুইন টাওয়ার, কতো মানুষ কাঁদেন
জ্বলেন জঙ্গি নেতা সঙ্গীহারা ওসামা বিন লাদেন
আর জ্বলে হায় অযোধ্যার ঐ রামে
ধর্ম রক্ষার নামে
আগুন জ্বলে পুড়েছিলো গর্ভবতী শস্য সকল
ভীষণ ভিয়েতনামে
জ্বলে আগুন জ্বলে ইরাক আফগানিস্তান
জ্বলবে আবার ঐ পাকিস্তান?
সারাবিশ্ব ছাই হয়ে যায় জ্বলে টু ইন টাওয়ার
জ্বলে লাদেন টাওয়ার
হায়রে কতো 'পাওয়ার'!
ইরাক জ্বলে বুকের ভিতর
ইরাক জ্বালায় মার্কিন ইতর
সবচে’ বেশি জ্বলে ইরাক জ্বলে
তারচে’ বেশি আগুন জ্বলে
একটি মেয়ে অভিমানে একটুকু রাগ হলে।

প্রথম প্রকাশ:
''একুশ আসবেই'' (কবিতা সংকলন),
প্রকাশনায়: কবিতাবাংলা কুমিল্লা,
সম্পাদনায়: ফখরুল হুদা হেলাল, রতন ভৌমিক প্রণয়।
২১ ফেব্রুয়ারী ২০০৯।
ছবি: জসীম উদ্দিন অসীম।

৪| ০৮ ই মে, ২০১৮ ভোর ৫:০১

জসীম অসীম বলেছেন: আমার পিতার অসম্ভব প্রিয় বন্ধু ছিলেন কুমিল্লার দেবিদ্বার উপজেলার বেগমাবাদ গ্রামের অশ্বিনী পাল। তিনি ছিলেন এক সাধক পুরুষ। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরের সর্বধর্ম প্রচারক কবি ও গীতিকার মনোমোহন দত্তের সহযোগী ছিলেন যে ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ'র বড় ভাই 'ফকির আপ্তাবুদ্দিন ও লব চন্দ্র পাল, সেই লব চন্দ্র পালের বংশেরই উত্তরসূরী ছিলেন আমার পিতার সেই প্রিয় বন্ধু অশ্বিনী পাল। আর অশ্বিনী পালের ছেলে এলাকার জনপ্রিয় শিক্ষক অমূল্য চন্দ্র পাল। সেই অমূল্য স্যারেরই সুযোগ্যা কন্যাকে বিয়ে করেছেন কুমিল্লা শহরের ঠাকুরপাড়া নিবাসী ও লাকসাম রোডের 'খাদি জ্যোৎস্না স্টোর' এর শ্রীযুক্ত তপন পাল। তিনিও আমার এক পরম বন্ধু। এবারের শারদীয় দুর্গাপূজার এক মন্ডপে তারই সঙ্গে হঠাৎ দেখা আমার। সঙ্গে তার ছোট্ট সোনামনি।

৫| ০৮ ই মে, ২০১৮ ভোর ৫:০৮

জসীম অসীম বলেছেন: Where are we going today?
=====================
Jashim uddin Ashim

September 1992,
Dhaka.

(বিশেষ নোট:
আমার ইংরেজি ভাষার ভিত সর্বদাই দুর্বল। তারপরও এক ধরনের মোহে অথবা উপনিবেশ যুগের প্রতি দাসত্বের প্রমাণ হিসেবেই কিংবা আন্তর্জাতিক কোনো ভাবপুষ্ট হয়েই একসময় ইংরেজিতে কিছু লেখালেখির চেষ্টা চালিয়েছিলাম। সেটার শুরু 1992 খ্রিস্টাব্দে। ঢাকায়। 2000 খ্রিস্টাব্দের পূর্ব পর্যন্ত আমার এ প্রয়াস প্রায় নিয়মিতই চলে। কিন্তু যেহেতু ইংরেজির ভিত দুর্বল অথবা নিজের ভাষায় না লেখাও এক ধরনের ভন্ডামি, তাই এসব লেখা বরাবরই আড়ালে থেকে গেছে। ছিন্নবিচ্ছিন্ন এসব লেখা একসময় আমার খুব কাছের বন্ধু স্নিগ্ধা রায়কে দিলাম নতুন খাতায় নতুন করে লিখে দিতে। সেটা 2003 সালের কথা। স্নিগ্ধা এই কাজ অনেকটা করে দিলেও সব কাজ শেষ করতে পারেননি। তারপর আমার কবি বন্ধু মাসুদ আশরাফকে দিলাম এগুলো পড়তে। মাসুদ আমাকে ভীষণই উৎসাহ দিলো ইংরেজিতে লিখে যেতে। সে বললো, আপনার প্রকাশিত তিনটি কবিতার পুস্তিকাই আমি পড়েছি। কিন্তু ভালো লাগেনি। অথচ আপনার ইংরেজি লেখা আমার ভালো লেগেছে। তারপর অবশ্য আমার শ্যালিকার এক ধরনের অবহেলায় আমার প্রায় দেড়শ ইংরেজি কবিতা হারিয়েও যায়। 2004 খ্রিস্টাব্দে ''কুমিল্লার কাগজ'' পত্রিকায় চাকুরি করার সময়ে ওই পত্রিকার তখনকার ''গ্রাফিক্সম্যান'' ও কবি ''জহির শান্ত'' আমার 60টি ইংরেজি কবিতা বিনা টাকায় কম্পোজ করে দেয়। পরে আমার ছোট ভাই জামাল উদ্দিন দামালকে দিয়ে আরও 40টি কবিতা কম্পোজ করিয়ে 100 কবিতা নিয়ে আমি একটি গ্রন্থ প্রকাশের বিজ্ঞাপন ছাপি। ''লিভ উইদাউট হসপিটাল''। কিন্তু অর্থের আর যোগান হলো না। তখন একদিন আমার ওসব লেখা দেখাতে আমার বাসায় নিয়ে এলাম মার্কিন যুবতী শিক্ষক বন্ধু লরেন এলুইসকে। লরেন আমাকে বললো, তুমি বাংলাতেই বরং লেখো। কারণ আমি তোমার দেশে এসে এখন 'রবীন্দ্র সংগীত' শিখছি। তবু আমি ২০০৫ সালের নভেম্বরে কুমিল্লা শিল্পকলা একাডেমিতে আমার ইংরেজি কবিতার একটি প্রদর্শনীর আয়োজন করি। সেই প্রদর্শনী উদ্বোধন করেছিলেন কুমিল্লার 'দৈনিক শিরোনাম' পত্রিকার সম্পাদক নীতিশ সাহা। প্রদর্শনী দেখতে এসেছিলেন ''অভিবাদন'' পত্রিকার সম্পাদক আবুল হাসানাত বাবুল, গল্পকার-গবেষক মামুন সিদ্দিকী, কবি পিয়াস মজিদসহ আমার অনেক অনেক ঘনিষ্ঠ বন্ধু। আজ এতো বছর পর আমার উপলব্ধি হলো: ''ইংরেজিতে লেখা? সে কোনোভাবেই আমার কর্ম নয়।'' সেটা বিভিন্ন কারণেই

-জসীম উদ্দিন অসীম)

=====================
Where are we going today?
Jashim uddin Ashim

September 1992,
Dhaka.
=====================

This world is very cruel.
There is nothing to say.
Why is women so angry and unfaithful
or excited?
?
?
?
But this woman is very beautiful,
she is very beautiful
like flowers in the garden.
So, I want to know today
loving women
really have on this planet?
I don’t know at all.
Women don’t have love
Women loves golds, ornaments
and various jewels.
Do they love
only love?
I don’t know at all.

I'm a mad poet
I cann’t live without women.
So i want a woman
that woman understands or feels
my love.
I have nothing to do.
I have some poems
I love poetry
poem of love.
I want to love my poems.
& I want to love this planet.
But now... At this time
what is this planet?
This planet is now
extremely ungrateful.
Now this planet of injustice
or a hell.
So i don’t understand
why I became a mad?
I'm frustrated now.
Where are we going today?
Live or die?
I don’t know. Really i don’t know.
So i don’t understand
why i became a mad?

৬| ০৮ ই মে, ২০১৮ ভোর ৫:১৯

জসীম অসীম বলেছেন: [১৯৮৮ সাল। তখনও আমি পুরোদমেই কবিতা লিখছি। আর কবি কাজী নজরুল ইসলামের অনুরক্ত আরেক কবির সান্নিধ্যেই দিনের অধিকাংশ সময় কাটাচ্ছি। সেই কবির নাম ছিলো 'সাবেরুল ইসলাম'। আমার পিতার জ্যাঠাতো ভাই। তখনই লেখা আমার এই কবিতা। অবশ্য তখনও আমি পাঠ নেইনি বাংলা কবিতার স্বরবৃত্ত-অক্ষরবৃত্ত-মাত্রাবৃত্ত ছন্দের। কিন্তু এ কবিতাটিও আমি লিখেছিলাম সচরাচর পদ্যেই এবং অন্ত্যমিল দিয়েই।অথচ আজকের বিবেচনায় সে ''অন্ত্যমিল'' বড়ই সেকেলে। অনেকদিনই ভেবেছি কবিতাটিকে ‘স্বরবৃত্ত’ ছন্দে ফেলে ঠিকঠাক করবো। কিন্তু সে সময় আর মিলে না। তাই এর ভাবসম্পদ ঠিক রেখে আকস্মিক এ গদ্যে রূপান্তর। এ যেন এক 'কবিতার হত্যাকান্ড'ই। অথচ এ ছাড়া আর বিকল্প কোনো পথও ছিলো না আমার।
২০১২ সালে আমি সেই ''হারেশশারের দিঘী'' দেখতে গিয়েছিলাম। কুমিল্লার দেবিদ্বারের এলাহাবাদে। আমার স্ত্রী 'সাদিয়া পলি' ও ছেলে 'কফিল মোহাম্মদ অপূর্ব'কে সঙ্গে নিয়ে। গিয়ে বড়ই ব্যথিত হলাম। আগের সব বৃক্ষ নেই। দিঘীতে খুব অল্প কিছু পাখি। গৌতমের খোঁজ কেউ তেমন জানেন না। নরেশ স্যার মারা গেছেন। তার ঘন বাঁশঝাড়ের জায়গায় এখন খোলা ঠা ঠা গনগনে রোদের মাঠ। এমনকি নরেশ স্যারের পুরো পরিবারই তাদের ভিটে বাড়ি...গাছপালা...পুকুর ইত্যাদি বিক্রি করে শহরে চলে গেছেন। তারা নাকি আবার ভারতেও চলে যাবেন...এমন খবরও কেউ দিলেন।]
=====================================================
‘হারেশশারের দিঘী’
জসীম উদ্দিন অসীম

রচনা: ডিসেম্বর ১৯৮৮
খয়রাবাদ, জাফরগঞ্জ,
দেবিদ্বার, কুমিল্লা, বাংলাদেশ।
===============
আমাদের ‘দোয়াইর জলা’, আমাদের সবুজ-ঢাকা ‘বুদার বাড়ি’,
আমাদের গ্রামের সবুজ বৃক্ষ
আর আমাদের শীত বিকেলে
পানি কমে যাওয়া ‘হারেশশারের দিঘী’
অথবা ‘আন্ধি দিঘী’ এবং আমার বন্ধু
গৌতমের কাকা নরেশ স্যারের বাড়ি
নিমগ্ন থাকে রূপে অপরূপে।
আর 'হারেশশারের দিঘী'র পূর্ব পাড়ে
ফোটা কাশফুল
আহা কী চমৎকার সাদা
এই কাশের ঝাড়ে বাঁশের ঝাড়ে
'হারেশশার' গ্রামটি কতো কোমল
‘হারেশশারের দিঘী’র থৈ থৈ পানি
আর থৈ থৈ পানিতে
কতো জাতের পাখির বিচরন
পানকৌড়ি, ডাহুক, বালিহাঁস, বক, সারস
এই আমাকে করেছে এক মস্ত বড় কবি
এতো কচ্ছপ সাঁতার কাটে ‘হারেশশারের দিঘী’তে
এখানকার শিশুরাও
বাচ্চা কচ্ছপ নিয়ে সকাল-বিকাল খেলে।
কিন্তু আমি এই ‘হারেশশারের দিঘী’
অথবা ‘উটখাড়ার দিঘী’তে যাই
শুধুমাত্র পাখি আর পরীদের পালক পাবো বলে।
এছাড়া নরেশ স্যারের বাড়ির হিজল, হেলেঞ্চা,
বনতুলশীর গন্ধ আমাকে পাগল করে তোলে।
আর এখানে এতো পাখির ঝাঁক।
শিকারী পাখিও রয়েছে।
গৌতম ডুবুরি পাখির মতোই
পানিতে সারাদিন পড়ে থাকতে পারে
আর ভীষণ ভালো করে
বাজাতে পারে বাঁশের কোমল বাঁশি।
পাখির বাসার খোঁজও সে অনেক বেশিই রাখে।
এই ‘হারেশশারের দিঘী’র জলে
রাতের বেলায় রূপকুমারী, জলকুমারী, ফুলকুমারী
পরীরা সব সাঁতার কাটে
নগ্ন শরীরে তারা দিঘীর জলে স্নানও করে
আর ভোরের আলো ফুটে উঠার আগেই আবার
ঠিক আমাদের ঘরের উপর দিয়েই ‘শো শো’ করে
উড়ে দূরে কোথায় হারিয়ে যায়
আমি একদিন দেখেও ফেলেছিলাম পরীদের।
সেদিন ছিলো ভরা জ্যোৎস্নার রাত।
শীত বিকেলে পানি কমে গেলে
তাই আমি ‘হারেশশারের দিঘী’ তে যাই
পরীদের কোনো একটি বর্ণিল পালক
নিশ্চয়ই খুঁজে পাবো বলে।

৭| ০৮ ই মে, ২০১৮ ভোর ৫:২৮

জসীম অসীম বলেছেন: গল্প:
মন তার যাযাবর পাখি
জসীম উদ্দিন অসীম:

ডিঙডিঙা বিল, ডাহুকে ভরা। আছে অনেক বুনোহাঁসও। বিলের পাশের ডুগডুগি বাজারেও পাখি বিক্রি হয়। এলাকার অনেকেই জাল দিয়ে ফাঁদ পেতে পাখি ধরে থাকে। কিন্তু হাশেম পাখি ধরে নিষ্ঠুরভাবে। সিদ্ধ ধানে বিষ মেখে ছড়িয়ে দেয়। তারপর যা করার, তা-ই করে। নলখাগড়ার বনে, হোগলাবনে হাশেমকে দেখলে তাই অনেক পাখিই সাবধানসূচক ডাকাডাকি করতে করতে পালিয়ে যায় দূরে। অথচ আগে এই ডিঙডিঙা বিলের প্রায় প্রতিটি পদ্ম-শাপলার পাতায় পাতায়, কলমি কিংবা কাশেরঝোপে পাখিরা উড়ে ঘুরে খেয়ে নেচে বেড়াতো।
ডুগডুগি বাজার থেকে আরও দশমাইল জেলাসদরের দিকে গেলে সুলতানপুর বাজার। হাশেম ওখানে দর্জির কাজ করতো। বাজারের পাশেই ছিলো হিন্দুদের নমশূদ্র পাড়া। ওখানেই নন্দিনী দাসের সঙ্গে পরিচয় ও প্রেম। তারপর পালিয়ে গিয়েছিল শহরে। মুসলিম মতে বিয়ে করে এখন আবার ফিরে এসেছে নিজের গ্রামে। কিন্তু কাজকর্ম সে করবেটা কী! কারণ বাড়িতে তার পৈতৃক একখন্ড ভিটা ছাড়া আর কিছুই নেই। কোনোকিছু পরিকল্পনা না করেই নন্দিনী ওই ভিটায় শুধু গাছ লাগাতে থাকে। সেগুন, শাল, নিম, মেহগিনি ইত্যাদি গাছের চারায় বাড়িটাকে সবুজ করে তোলে। নন্দিনী হাশেমকে বলে, তুমি বাইরে গিয়ে কিছু একটা ধরো। আমি তোমার এই বাড়িটাকে যত্নে যত্নে বাগান করে ফেলবো। কয়েকবছর পরই দেখবে এই পুঁজি দিয়ে তুমি ব্যবসা করতে পারবে।
কিন্তু হাশেম জানে শুধুই দর্জির কাজটা। তবে সেটাও সে আর এখন করতে চায় না। ভালো লাগে না তাঁর। অন্যের জমিতেও কাজ করে না। কোথা থেকে হঠাৎ সিদ্ধান্ত নিয়ে পাখি শিকারে নামে। বাজারে যায়, বিক্রি করে।
এদিকে নমশূদ্র ঘরে জন্ম নিলেও নন্দিনীকে চেহারাসুরতে সুন্দরীই বলতে হবে। তাই তার প্রতি প্রতিবেশীদেরও একটা মায়া জমে ওঠে। কিন্তু হাশেম দিনদিন ওই নন্দিনীর প্রতি বিরক্ত হতে থাকে। সারাদিন একটা মানুষ গাছের পেছনে ব্যয় করতে পারে, যা দিয়ে নগদ পয়সা আসে না। নন্দিনী বলে, আসবে আসবে, হাজার হাজার নয়, লাখ টাকাই আসবে। ধৈর্য ধরো। কিন্তু এত ধৈর্য হাশেমের সহ্য হয় না। সে পাখি শিকার করতে না পারলেও পাঁচ পাখির বাসা থেকে ডিম নিয়ে আসে। বিশেষ করে কোড়ার ডিম। ডিঙডিঙা বিলে হাজার কোড়া পাখি। কিন্তু নন্দিনী কী কাজটা করে? নন্দিনী বলে, হাশেম, সংসার হলো ঘানি। এ ঘানি তো তোমার একার পক্ষে ঘোরানো সম্ভব নয়। আমি তো আর বাপের বাড়ি থেকে তোমাকে কিছু এনে দিতে পারবো না। ধৈর্য ধরো। তোমার জন্য একটা বড় পুঁজির ব্যবস্থা করছি আমি। কিন্তু এ কথায় মন ভরে না হাশেমের। বলে, তুমি এ গাছের চিন্তা বাদ দাও। পারলে...। নন্দিনী বলে, আমি কোনো সাহেবের বেটি নই, দেখে নিয়ো, তোমার সংসার ঠেলাগাড়ির মতো ঠেলতে ঠেলতে কোথায় নিয়ে যাই। কিন্তু তুমি পাখি মারা ছাড়ো। পাখি মারলে মানুষ দানব হয়ে যায়। এ কথায় রাগ করে হাশেম। বলে, পাখি না মারলে, পাখির ডিম না কুড়ালে খাবোটা কী? এই যে এ বেলা ভাত খেলাম, তিনজোড়া বুনোহাঁসের ডিম না আনলে কী দিয়ে খেতাম? নন্দিনী বলে, জগতের আর সবাই কি পাখির ডিম দিয়ে ভাত খায়? এ কথায় হাশেমের মাথায় রক্ত ওঠে যায়। চিৎকার করে বলে, তুই আমার সঙ্গে মুখে মুখে ঝগড়া করিস? তোর জিহবা আমি কেটে দেবো। মাঝবিলের মাঝখানের শেওড়াগাছের পাখির বাসা থেকে ডিম এনে তোরে খাওয়াই। আর তা খেয়ে গায়ের জোর বাড়িয়ে চটাং চটাং কথা ! ফের বকবক করলে তোর জিহবা টেনে কেটে ফেলবো আমি। নন্দিনী বলে, কাটবা না, তোমার বাপদাদারা তো কশাই ছিলো। এ কথা শুনে হাশেমের শরীরের রক্ত লাফিয়ে ওঠে। তবু সে তার বউয়ের সঙ্গে কথা না বাড়িয়ে ডিঙডিঙা বিলের দিকে চলে যায়। বউ তাকে শুনিয়ে শুনিয়ে চিৎকার করে বলে, জগতে মনে হয় আর কোনো কাজ নাই পাখি মারা ছাড়া? কী সুন্দর চাকরি! দর্জির কাজটা মনে হয় মন্দ ছিলো কেউ বলেছে...! নন্দিনীর কোনো কথাই কানে আসে না হাশেমের। জলভরা পাটের জমির দিকে যাচ্ছিল কয়েকটি বালিহাঁস। শামুক কিংবা পোকা খাবে বলে ডাকতে ডাকতে ঢুকে যায় পাটখেতের ভিতরে। ওগুলোকে ধরা খুব সহজ কাজ নয়। তবু ওদের পিছু নেয় হাশেম। ভাবখানা এমন যে, আজ যেন সে অনেক পাখিই ধরে ফেলবে। অথচ সন্ধ্যার পর কোনো পাখি কিংবা পাখির ডিম ছাড়াই ঘরে ফিরে আসে হাশেম। রাগে হাশেমের মন হিংস্র সিংহ হয়ে আছে। সারাদিন কিছু সারসের পেছনে কেটেছে। কিন্তু কোনোটাই ধরা পড়েনি। কিভাবে ধরা পড়বে ? তাঁর না আছে একটি বন্দুক, না একটি তালের ডোঙ্গা কিংবা...। এদিকে নন্দিনী ক্ষুধায় সারমেয়ী হয়ে আছে। হাশেমের কুঁড়েঘরে তখনও অবশিষ্ট কেরোসিন তেলে সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বলছিল। হাশেম নন্দিনীকে বলে, খাবার কিছু থাকলে দে, তাড়াতাড়ি। নন্দিনী বিষাক্ত সাপের মতো ফোঁস করে বলে, পোলাও খাইবা, নাকি বিরানী ? মুরগীর মাংস খাইবা নাকি পানিখাওরীর (পানকৌড়ি) মাংস? হাশেম এ কথার অর্থ বুঝে। তাই চিৎকার করে বলে, বটি দিয়ে আজ তোর জিহবা যদি না কাটছি...তো। রাগে কাঁপতে থাকে হাশেম। নন্দিনী বলে, তোমার বংশ যে কশাইয়ের বংশ ছিলো, সেটা তো অনুমান করাই যায়। জিহবা কাইটা কী লাভ ! একেবারে জবাই দিয়া দাও। হাশেম আর সহ্য করতে পারে না। উত্তেজিত হয়ে সত্যি সত্যিই বটি হাতে নেয়। নন্দিনী স্থির থাকে এবং হাসে। তারপর একদিকে বটি ছুঁড়ে হাশেম ঘর থেকে বের হয়ে যায়। নন্দিনী তখন হাসেও না, কাঁদেও না। এমনকি হাশেমের পথ আগলেও দাঁড়ায় না।
বুকজল ধানের মাঠ সাঁতার কেটে পার হয়ে ডিঙডিঙা বিলের মাঝখানে চলে যায় হাশেম। যেতে যেতে আরও দূর যায়, যেখানে লাল-নীল-সাদা শাপলা বিছিয়ে আছে। এই রাতে আকাশে ভরা চাঁদের আলো। সেই আলোতে ডুব দিয়ে দিয়ে অনেকগুলো শাপলা তুলে আনে। রাগে তখন সে আর ক্ষুধা অনুভব করে না। হঠাৎ লক্ষ্য করে, জলজ ধানের মাঠ পার হয়ে, পাটের ক্ষেতগুলো অতিক্রম করে যেখানে এই রাতে চলে এসেছে সে, এখানে সে কোনোস্থানেই কোনোভাবেই ঠাঁই পাচ্ছে না। আসার সময়ে যত সহজে চলে এসেছে, শাপলা নিয়ে ফিরতে গিয়ে তত সহজে ফিরতে পারছে না। জলজ নানা জাতের ঘাস তাকে বারবার পেঁচিয়ে ধরছে। তারপরও বাড়ির দিকে সাঁতার কাটতে কাটতে গলা জলে এসে দম নিয়ে দাঁড়ায়। তারপর বিস্তীর্ণ সেই পাটক্ষেতের ছায়াটার কাছে এসেই হঠাৎ ভূত-প্রেতের কথা মনে পড়ে তার। ঠিক এমনি সময় আকাশের ভরা চাঁদ মেঘের আড়ালে ঢেকে গেলে চতুর্দিকে যেন পিশাচের নানা শব্দ শুনে হাশেম। তারপরও শাপলা আকড়ে ধরে বাড়ির দিক অনুমান করে সাঁতার কাটতে থাকে।
ওদিকে নন্দিনীর ব্যাকুলতা বাড়ে। যদিও সে একটি ডাকও দেয় না হাশেমকে। বাবা গৌরিশঙ্কর দাসের কথা মনে পড়ে তার। এমন জোছনারাতে কখনো কখনো গৌরিশঙ্কর তার তিন মেয়েকে ভূতের গল্প শোনাতেন। হাশেম কি এই শরৎ-নিশিতে ভূতের ভয়ও করে না! এই কথা ভাবামাত্রই নন্দিনীর সামনে ঠিক ভূতের মতোই অন্ধকার ছায়া ভেদ করে শাপলাগুচ্ছ হাতে সামনে এসে দাঁড়ায় হাশেম। নন্দিনীকে বলে, কাল সকালে বাজার থেকে আনবো কিছু ...। নন্দিনী বলে, বোয়াল মাছ আনবা? টাকা পাইবা কই? হাশেম এবার ধীর স্থির থাকে। চুপ করে শুনে। সিদ্ধান্ত নেয়, নন্দিনীর কোনো কথারই আর উগ্র কোনো জবাব দেবে না সে। কারণ এটা কি তার সংসার? নাকি ভূতেরই অদ্ভূত কান্ডকারখানা, বুঝতেই কষ্ট হয় তার। পশ্চিম আকাশে চাঁদ হেলে পড়ে। ক্রমে ক্রমে হাশেমের বিচ্ছিন্ন বাড়িটা ভূতুরেবাড়িতে পরিণত হয়। খানিকবাদে বিছানায় শুয়ে হাশেম নন্দিনীকে বলে, নন্দিনী, আমাদের বাড়ির পশ্চিমদিকে যে তিনটি তালগাছ আছে, ওখানে কক্ষনোই যাবে না তুমি। কারণ তাহারা, মানে মামারা, মানে ঐ... রাতের বেলা ঐ তিন তালগাছ দিয়েই আমাদের এলাকায় নামে। হাশেমের কথা শেষ না হতেই ঘরের পেছনের দিকে পাঁচ-সাতটি কোড়াপাখি একসঙ্গে ডেকে ওঠে। নন্দিনী ভয়ে ঝাঁপ দিয়ে হাশেমকে বুকে আঁকড়ে ধরে।
সমাজ-সংসারে এ জীবনে কোনো সহানুভূতিই পায়নি তেমন হাশেম। শৈশবে পিতামাতার মৃত্যুর পর নানীর কাছেই বড় হয়েছে সে। এখন সেই নানীও বেঁচে নেই। নানীর মৃত্যুর পর দুঃখে অনাহারে অনিশ্চয়তায় তাঁর স্বাস্থ্য যে ভেঙ্গে পড়েছিল, তা আজও আর ফিরে পায়নি সে। নানীকে সে মায়ের মতো করেই পেয়েছিল। মায়ের স্মৃতি অতটা মাথায় নেই। একমাত্র সন্তান হাশেমের জন্ম হওয়ার কয়েক বছরের মধ্যেই হাশেমের মায়ের অসুখে মৃত্যু হয়।
অবশেষে রাত পোহায়। কিন্তু পরদিন থেকেও পাখি শিকার বন্ধ হয়নি হাশেমের। সে বলে, বড় বড় সাপেরাও যদি পাখির ডিম ও পাখির ছানা খেতে পারে, তাহলে আমি ধরলে সমস্যাটা কী! কারো কোনো বারণই শুনে না সে আর। বুঝে না সে এটা কোনো সংসারী পুরুষের স্থায়ী কাজ হতে পারে না। তাছাড়া হাশেমের শৈশবকালের একটি ঘটনা এখনো তাঁর মনে গেঁথে রয়েছে। মামারবাড়ির পাশের বাড়ির রবিউল মামারও এমন পাখি ধরার নেশা ছিল। কিন্তু কিভাবে যে একদিন পুলিশ খবর পেল! তিনজন পুলিশ এসে বাজার থেকে পাখি বিক্রির সময় রবিউল মামাকে হাতেনাতে গ্রেফতার করার পর কেউ আর ভয়ে পুলিশের সঙ্গে দেখা করতে যায়নি। কেউ বলেছে, পুলিশ নিয়ে রবিউল মামাকে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে দিয়েছে। আর ওখান থেকে সোজা জেল। আর কতো মার যে খেয়েছে। তারপর থেকে সেই মামা তার বাপের জন্মে আর পাখি ধরেননি। এমনকি জেল থেকে ছাড়া পেয়েও লজ্জায় আর নিজের গ্রামে না এসে শহরে এক আত্মীয়ের কাছে চলে গিয়েছিলেন। কয়েকমাস পর শহর থেকে গ্রামে আসেন রবিউল মামা। এসব ঘটনাও মাঝে মাঝে হাশেমকে ভাবায়। তারপরও সে মনে করে রবিউল মামার জীবনের বাতাসই তার জীবনে লেগে গিয়েছে। কারণ সে তো ছিল দর্জি। হঠাৎ কেন তার পাখি শিকারের এমন মতিভ্রম হলো! বিশেষ করে হাশেমদের ডিঙডিঙা বিলে এত কালিবক আর কোঁচবক এখনো রয়েছে যে, ওগুলোর কথা মনে হলে আর বিল থেকে মন ফেরাতে পারে না। বাজারের মোবাইল কোর্টকে লোকে বলে ‘মবিল কোর্ট। এই ‘মবিল কোট’ কী, তা সে এতোদিন জানতো না। পুলিশের ও.সি বড়, নাকি ‘মবিলকোটে’র ম্যাজিষ্ট্রেট, এমন প্রশ্ন করে সে বারবার অনেক লোকের হাসির কারণ হয়েছে। তারপরও সেদিন রহমান চাচার কাছ থেকে সে এসবের ব্যাখ্যা বুঝে নিয়েছে। ব্যাখ্যা বুঝে হাশেম মনে মনে বলেছে, ‘আমার বালও ছিঁড়তে পারবে না মবিল কোটের ম্যাজিষ্ট্রেট’।
আমি কি আর বন্দুক দিয়ে পাখি মারি? এমন মনে মনে ভাবার পরই আবার হাশেমের মনে একটি বন্দুকের স্বপ্ন জেগে ওঠে। ‘‘ইস! আমার যদি একটি বন্দুক থাকতো, তাহলে কি আর এভাবে মাছে-ধানে-চালে বিষ মেখে পাখি মারার চেষ্টা করতে হতো! আসলে টাকা না থাকলে কিছুই হতে চায় না। না পাখি শিকার, না বন্দুক কেনা, না সংসার।” আর এসব জানার পরও টাকার সন্ধান পায় না কোনোভাবেই হাশেম। বউ নন্দিনী কোনোভাবেই জাল বানাতে পারে না। আর পারলেও সে পাখি ধরার জন্য হাশেমকে একটি কারেন্ট জাল বানিয়ে দেবে না। কারেন্ট জাল রূপগঞ্জ বাজারে বিক্রি হয়। কিন্তু কেনার পয়সা তো হাশেমের নেই। ও-পাড়ার মোখলেস কারেন্ট জালে মাছ-পাখি সবই ধরে। কিন্তু হাশেমের সেই ভাগ্যের জোর নেই। তবে সে কিনবে। পাখি বিক্রির টাকা দিয়েই পাখি ধরার কারেন্ট জাল কিনবে। এমন স্বপ্নই হাশেমকে আরও এগিয়ে নেয়।
ডিঙডিঙা বিলের যেখানে যেখানে ঠাসা ঘাস রয়েছে, ওসব জায়গায় বড় পাখিদের বাসাও রয়েছে। কিন্তু সমস্যা হলো সাপ। ওদের বিচরণও ভয়ানক। দাঁড়াস সাপকে ভীষণ ভয় পায় হাশেম। ঘাসবনেও ওরা থাকে। আর পাখি ধরার জন্য একটি তালের ঢোঙাও চাই। ডিঙডিঙা বিলের সঙ্গে আর পারে না হাশেম। হোগলা বন পার হয়ে, কচুরিপানা ঠেলে ঠেলে, পাটক্ষেতের মাঠ শেষে হরিবিলের পাশ থেকে অল্পের জন্য একটি তালের ঢোঙা চুরি করতে পারে না হাশেম। কিনতে যখন পারছে না, আপাতত: চুরি ছাড়া পথও নেই তার। এমনটিই মনে করে হাশেম। কিন্তু বউ জানলে? বলবে পাখি বিক্রি করে কিনেছি। বউ যদি বলে, এতো পাখি কবে ধরে কবে বিক্রি করে এতো টাকা পেলে? ধ্যাৎ। যখনের কর্ম, তখন এসব ভাবা যাবে। এতো আগে এতো সব ভেবে কাজ নেই। ডিঙডিঙা বিলে যেই পরিমাণ রাজহাঁসের দেখা মিলে, একটি বন্দুক আর একটি তালের ঢোঙা তার যে কোনোভাবেই হোক চাই। এ দুটি জিনিস ছাড়া তার চলবেই না। কোথায় এক ফায়ারেই পাখি ফেলে দেবে জলে, সেখানে কী না এত রকম কষ্ট ! নৌকা নিয়ে অনেকেই এ বিলে মাছ ধরতে নামে। অনেক পাখি তখন আকাশে উড়ে। জলজ এসব পাখি দেখতে হাশেমের দারুণ ভালো লাগে। বালিহাঁস দেখলে হাশেমের মাথাটা ঠিক খারাপ হয়ে যায়। ‘ইস! ধরা যদি যেত!’ ভাবে হাশেম। কিছু পাখি আছে, ওরা জোড়া ফেলে উড়ে না। স্বামী-স্ত্রী। ওদেরকে দেখলেই হাশেমের নন্দিনীর কথা মনে পড়ে। তবে হাশেমের কাছে অবাক লাগে একটি বিষয়, যত পাখি বিলে দেখে, তত পাখির বাসা খুঁজে পায় না কোথাও। তাহলে ওরা থাকে কোথায়? দূর পাহাড়ে?
ছইওয়ালা একটি নৌকায় করে এক যুবক তার বউকে নিয়ে ডিঙডিঙা বিল পার হচ্ছিল। বউটি তার এতই পরমাসুন্দরী যে, ঠিক যেন আকাশের পরী। যুবকটি সম্ভবত শহরে চাকুরি করে। শহর থেকে এখন নিজের বাড়িতে যাচ্ছে। মাঝি ব্যাটা না থাকলে যুবকটিকে ঠ্যালা মেরে বিলের গভীর জলে ফেলে দিতো হাশেম। মনে মনে ভাবে। এই মুহূর্তে তার নন্দিনীর কথা একটুও মনে পড়ে না। বিলের বুকে একটুখানি চড়ায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুধু ওই পরমাসুন্দরী পরস্ত্রী-র কথাটিই ভাবে এখন হাশেম। এই কাগচড়ায় একদা শত শত কচ্ছপ উঠে বসে থাকতো। আজকাল আর তেমন দেখা যায় না। বিলের এদিকটা বেশ নির্জনও। জলও আশঙ্কাজনক গভীর। তাই হাশেমের মাথায় সুন্দরী পরীর বদচিন্তাটি বারবার ঘুরপাক খায়। কিন্তু সহসাই এ চিন্তায় তার ফাটল ধরে পাখির ডাকে। কিছু কোড়ার ডাক কানে আসে আসে হাশেমের। মাথা ঘুরিয়ে দেখে। দুই-তিনটি পানকৌড়ি চোখে পড়ে। কিন্তু কোড়াদের চোখে পড়ে না। ওইদিকে ছইওয়ালা নৌকাটি দূরে যেতে যেতে ক্রমাগত পাখির বাচ্চার মতো ছোট হতে থাকে। ওইদিকেই স্থির তাকিয়ে থাকে হাশেম। অন্যদিকে তাকিয়ে দেখে ঝাঁক বেঁধেও উড়ছে অনেক পাখি। মগ্ন হয়ে তাকিয়ে থাকে সে। ওদের কিছুই করতে পারে না।
ডিঙডিঙা বিলে আরও অনেকে হাশেমের মতো পাখি ধরে খায় কিংবা বিক্রি করে। কিন্তু তাদের সঙ্গে হাশেমের কোনো সম্পর্ক নেই। হাশেম একা একাই তার কাজ করে যায়। রক্তশাপলার সংখ্যা যত বিলে, তার চেয়েও অনেক বেশি পাখি। হাশেম একদা শুনেছিল, এগুলো শীতের দেশের পাখি। শীত সহ্য করতে না পেরে কিংবা খাদ্যের অভাবেই ওরা চলে আসে এই দেশে। এসব কথা একদা তাকে তার রবিউল মামাই বলেছিলেন। হাশেমের নিজের কাছেই নিজের প্রশ্ন শীতের দেশের পাখি হলে, শীত সহ্য না হলে আবার এসে ওরা ফেরত যায় কেন? রবিউল মামা আরও বলেছিলেন, আগে নাকি কোটি কোটি পাখি ছিল। সেই তুলনায় নেই আর এখন তেমন। কী কারণে পাখিরা হারিয়ে যায় কিংবা কমে যায়, তা জানে না হাশেম। তবে তার লক্ষ্য পাখি ধরে খাওয়া কিংবা বিক্রি করে দেওয়া। এরই মধ্যে হঠাৎই বিশাল এক ফোসফোসফোস শব্দে চিন্তার রেশ কাটে হাশেমের। মাথা ঘুরিয়ে আকাশের দিকে দেখে, চার-পাঁচ ঝাঁক বুনোপাখি উড়ে যাচ্ছে দূরে। নিচে দাঁড়িয়ে হাশেম আফসোস করে, ইস! যদি থাকতো একটা বন্দুক ! ...। হাশেমের কাছে দিনভর নন্দিনীর কোনো খবর নেই । পাখির নেশায় বউয়ের কথাও যেন ভুলে বসে আছে। কী খাবে? কোথা থেকে আনবে খাবার...। মেয়েটার রাগও মারাত্মক। ভয়ও পায় তাকে হাশেম। বেশি চাপ দিলে পাখির জন্য ঘরে রাখা বিষও মুখে দিয়ে দিতে পারে। তাই সে সহজে তর্কেও যায়না নন্দিনীর সাথে। কিন্তু অভাবে নন্দিনী ইদানিং পাগল হয়ে উঠেছে। তারপরও তার নিজের জীবনে হাশেম ভিন্ন দ্বিতীয় কোনো পুরুষের কথা কল্পনা করে না সে। কিন্তু হাশেমের এখন কী অবস্থা! যখন সে বাজারে দর্জির কাজ করতো, তখন তো নন্দিনী ভেবেছিল হাশেম সংসারী হবে। কিন্তু সংসারী পুরুষ কেউ এমন তার নিজের জানা কাজ ফেলে পাখির পেছনে ঘুরে? চট করে ধর্ম ত্যাগ করে নিজের জীবনের জন্য এ কী সিদ্ধান্ত নিল নন্দিনী! এখন আর তার হিসাব মেলাতেই পারছে না। নন্দিনী ভেবেছিল এক-দুইটি সন্তান নিয়ে বাকিটা জীবন সুন্দরভাবে কাটিয়ে দেবে হাশেমের সংসারে। কিন্তু সে নিজেই যেখানে খেতে-পরতে পায় না, সেখানে এক-দুইটি সন্তানের জন্ম দেওয়াই সংসার পোক্ত করার শেষ কথা নয়। এই সংসার যে টিকবে, তার তো কোনো লক্ষণই দেখছে না নন্দিনী।
হাশেমের মাথা থেকে ক্রমে ক্রমে বন্দুকের স্বপ্ন মুছে যায়। আপাতত এক-দুইটি জাল দরকার। জাল ছাড়া পাখি ধরা যাবে না। জাল লাগবেই। এমন যখন ভাবছিল হাশেম, ঠিক তখনই তার চোখে সুখের স্বপ্নের রোদ ঝিলিক দিল। তার বিষ মাখানো পুঁটি মাছগুলো চড়ায় বসে গিলছে কয়েকটি বুনোহাঁস। চুপ মেরে লুকিয়ে থাকল হাশেম। তারপর আরও হাঁস আসতে লাগলো। কিন্তু বিষ মাখানো অত মাছ তো নেই চড়ায়। কী করবে! অপেক্ষা করা ছাড়া তার আর কিছুই করার নেই। আহারে বন্দুক! বন্দুকের এত দাম! ইস যারা বন্দুক বানায়, তারা কতো মগজওয়ালা পুরুষ। কারণ বন্দুক তো সে বানাতে পারে না। ওদিকে মাত্র দুইটি বুনো রাজহাঁস হাশেমের সবগুলো মাছ খেয়ে নিল। অন্য হাঁস বা পাখিদের ওরা কাছেই ঘেঁষতে দিলো না। হাশেমের দুশ্চিন্তা বাড়লো।
এতো বড় বুনোহাঁস তো পুঁটিমাছে মাখানো বিষে মারা পড়বে না। মরলেও কয়েকঘন্টা পরে কোন দূরে গিয়ে মরবে, তা সে বলতে পারে না। তাতে তার কোনো লাভও হবে না। হতাশ হয়ে বসে থাকলো সে। জাল থাকলে দুই-তিনটা পাখিকে আটকানোর অনেক সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু জাল তো নেই।
ওই দূরে আমনের মাঠ। তারপর হাশেমের বাড়ি। ওখানে তার জন্য অপেক্ষা করে আছে নন্দিনী। আর সে এই ডিঙডিঙা বিলের মাঝখানের চড়ায় বসে অপেক্ষা করছে পাখি ধরার। চারদিকে রক্তনীল শাপলাগুলো কার জন্য অপেক্ষা করে আছে, তা সে জানে না। এই চড়ায় একদা সাপেরও উপদ্রব ছিল। এখনও রয়েছে, তবে ততটা নেই। হঠাৎ একটি গুইসাপ সাঁতার কেটে উঠলো চড়ায়। সব পাখি হঠাৎ উড়ে গেল। কিন্তু উড়তে গিয়ে মাথা ঘুরিয়ে জলে পড়ে গেল বড় দুইটি বুনো রাজহাঁস। জলে পড়েও মাথা ঘুরাতে লাগলো। শুধু যেন চরকির মতো ঘুরছে। ছটফট বেড়ে গেল ওদের। মুহূর্তকাল দেরি না করে হাশেম ঝাঁপ দিল জলে। খুব বেশি বেগ পেতে হলো না তাকে। দশ-পনের মিনিট সাঁতার কেটেই খপখপ করে ধরে ফেললো দুই-দুইটি রাজহাঁস-বুনো রাজেশ্বরী। এতক্ষণে নন্দিনীর কথা মনে পড়লো তার, যেখানে সে বসে আছে হাশেমের জন্য।
বুনো রাজহাঁস দুইটি মোট পাঁচশো টাকায় বিক্রি করে প্রথমে একটি জাল কিনে ফেললো হাশেম এবং দেড়শো টাকায় নন্দিনীর জন্য গোলাপী একটি শাড়ি। অন্যের দোকানে দর্জির কাজ করতো যখন, তারপর থেকে সে আর একসঙ্গে এত টাকা দেখেনি।
জাল কেনার পর আর হাশেমকে কে পায়? তার বুদ্ধি আর জালের ফাঁদে কতো বালিহাঁস যে ধরা পড়লো, তার হিসেব নেই। তালগাছের কিংবা মরা আমগাছের কোটর থেকেও পাখি ধরে নিয়ে আসে সে। সারাদিন বিলঝিল ডোবানালায় ঘুরতে ঘুরতে যে তার পায়েও ঘা হয়ে গিয়েছিল, সেটা তার মনে নেই। একদিন, যখন সে দেখছিল নিবিড় হয়ে পাখির সঙ্গম, ঠিক তখনই অল্পের জন্য সে সর্পদংশন থেকে ভাগ্যের জোরে বেঁচে যায়। তারপরও পাখি ধরার নেশা যায় না তার। পাখির বাসা থেকে অনেক মেয়ে পাখিকে ধরে এ পর্যন্ত বাজারে বিক্রি করেছে। একবারও ভাবেনি সঙ্গিনীকে হারিয়ে সঙ্গী পাখিটির দিনরাত কতো কষ্টে কাটবে। একবারও ভাবেনি, তার স্ত্রী নন্দিনী না থাকলে তার জীবনটাও কিভাবে গড়া হবে। সকাল হলেই শুরু হয় তার চিংড়ী-পুঁটিমাছসহ বিভিন্ন ফড়িং ধরার কাজ। ওগুলো ধরার কাজ শেষ হলেই সে বিষের বোতল ও জাল সঙ্গে নিয়ে ডিঙডিঙা বিলের মাঝখানে চলে যাবে। যেতে যেতে উঠবে গিয়ে চড়াটায়। অন্য চড়ায় কবরস্থান আছে। কিন্তু সে যে চড়াটায় গিয়ে উঠে, ওখানে কোনো কবর নেই। আছে কয়েকটি গাছ। চড়ার পাশে কলমী ঝোঁপ। ওখানেই প্রায় স্থায়ী আস্তানা গড়ে হাশেম। নন্দিনী তাকে প্রতি রাতেই পাখি ধরতে বারণ করে। কিন্তু কে শোনে কার কথা ? বালিহাঁসের এতো ছোট ডিম সিদ্ধ করে খেয়ে পেট ভরে তোমার? এই প্রশ্ন অনেকবার হাশেমকে করেছে নন্দিনী। কিন্তু এ কথায় কান দেয় না হাশেম। কার কাছে যেন সে শুনেছে, বালিহাঁসের ডিম খেলে পুরুষের যৌন ক্ষমতার মারাত্মক বৃদ্ধি ঘটে। সুতরাং তাকে আর এ পথ থেকে ফেরাবে কে? কিন্তু সেদিনের ঘটনায় নন্দিনী অনেক চোখের জল ফেলেছে। হাশেম জাল দিয়ে বালিহাঁসের অনেকগুলো অল্প উড়ন্ত ছানা ধরে এনেছে। ওদের মা পাখিটি পালিয়ে বেঁচেছে। মায়ের জন্য এ ছানাগুলোর কান্নার শব্দ শুনে নন্দিনী তার চোখের জল ধরে রাখতে পারেনি। এমনকি রাতের বেলা যখন মনে হয়েছে তার এতগুলো ছানা হারিয়ে আজ মা পাখিটার কী অবস্থা এখন, তখনও সে কেঁদেছে। কিন্তু হাশেমের কাছে এসব আবেগ বোকামি ছাড়া আর কিছু নয়। তাই সে বালিহাঁসের ছানাগুলো বাজারে বিক্রি করে দারুণ সুখ অনুভব করেছে।
সেদিন হঠাৎ কে যেন পাড়ায় রটিয়ে দিলো এলাকার সকল পাখি শিকারীদের ধরতে এসেছে পুলিশ। তখন হাঁটুজলে দাঁড়িয়ে ছোটমাছ ধরছিল হাশেম। কথাটি শোনামাত্রই কোমরজলে ঝাঁপ দিয়ে গলাজল পার হয়ে ডুবজল সাঁতার কেটে উঠলো গিয়ে সেই আদরের আস্তানায়-জলবেষ্টিত চড়ায়। খালবিল পার হয়ে তালদিঘির এই গ্রামে, হাওড়ের এই জলদ্বীপে হঠাৎ কেন পুলিশ ? তবে কি নন্দিনী দাসের কথাই ঠিক ? নন্দিনী প্রায়ই বলে, সরালীর ছানার অভিশাপে একদিন পুড়ে যাবে তুমি। কলস ঝুলিয়ে ফাঁদ পেতে এখন যেমন পাখি ধরো তুমি, ঠিক তেমনি একদিন তুমিও অন্যের কলসে ঢুকে যাবে। এই কথাটি শোনার পর হাশেমের বুকে প্রায়ই ভয় কাজ করে। তবে কি গঞ্জে অন্যের দোকানে দর্জির কাজটিই ভালো ছিলো তার জন্যে? সিলেটের বাইক্কা বিলের কাইক্কা মাছের আর পাখি শিকারের গল্পও সে শুনেছে। কিন্তু এই কিশোরগঞ্জের ডিঙডিঙা বিল এলাকাতেও পাখি কিন্তু কম নেই। এর মোহ ত্যাগ করা বড় কঠিন। পুলিশের হঠাৎ এমন উৎপাতটাই খারাপ লাগে। কিন্তু হাশেমকে পুলিশ ধরে ফেলবে, এত সহজ নয়। কারণ পাখির নেশায় বিভোর থাকা পক্ষীবিশারদ হয়ে যাওয়া হাশেম সব সময়ই পুলিশের গন্ধ পরখ করে করেই বাজারে পা দেয়। কিন্তু ভাগ্য যদি প্রতারণা করে? কোঁচবক-কালিবকগুলো বিক্রি করে সঙ্গে সঙ্গেই বাড়ি ফিরবে ভেবেছিল হাশেম। বাজারের কোথাও পুলিশের গন্ধও ছিলো না। কিন্তু ক্রেতা হয়ে যে ম্যাজিস্ট্রেট তাকে ধরবে, এতো বুদ্ধি তার সরল মাথায় কোথা থেকে আসবে? ম্যাজিস্ট্রেটের পায়ে ধরে অনেক কেঁদেছে হাশেম। তারপরও তার জেল হয়ে যায়। একেবারে কম নয়, ছয় মাসের জেল।
টানা ছয় মাস জেল ভোগ করার পর পাখি শিকারের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে হাশেম। কিন্তু পাখি শিকার ছাড়ার সিদ্ধান্তে এবং ছয় মাসের জেলভোগে হাশেম যত না কষ্ট পেয়েছে, তার চেয়েও শতগুণ বেশি কষ্ট পেয়েছে, যখন বাড়ি ফিরে এসে শুনেছে সে, তার পাশের বাড়ির আকবর আলীর ছেলে কলেজ পড়ুয়া কামালের সঙ্গেই পালিয়েছে তার নন্দী। এ দুঃসংবাদ শুনে হাশেমের কাছে মনে হয়: জেলে সে যেন বন্দী ছিলো না, কষ্টে ছিলো না, বরং বন্দী হয়েছে এখন। এখনই সে বুঝেছে কষ্ট কাকে বলে। হায়! সে এখন পাখি বন্দী পাখি। তার নন্দীই তাকে বন্দী করে রেখেছে। তবু মন তার যাযাবর পাখির ডানা হয়ে মেঘে মেঘে আকাশে আকাশে নন্দিনীর খোঁজই করে।

৮| ০৮ ই মে, ২০১৮ ভোর ৫:৩৭

জসীম অসীম বলেছেন: তাদের কাছে রকেট চালিত গ্রেনেড
আমাদের সকালের চা- পরোটার মতো
দিনলিপি: এপ্রিল ২০১২, কুমিল্লা।

আমারই লেখার জন্য আমার ক্ষয়ক্ষতি প্রতিদিন আরও বেশি অনুভব করছি। খ্রিস্টান বন্ধু লরেন্স তীমু বৈরাগীকেও লেখা দিয়ে আক্রমণ করলাম। তীমুদা’ মনে কষ্ট পেলেন। কিছুই বললেন না। ক্ষমতাও দেখালেন না। উল্টো একদিন জোর করেই চা খাওয়ালেন। সেদিন বললেন, পত্রিকা চালাতে বেশি অসুবিধায় পড়লে যেন তার কাছে যাই। কিন্তু আমি শিক্ষকের হালাল টাকা এনে পত্রিকা চালাতে ইচ্ছুক নই। অন্যদিকে নষ্ট লোকদের কালো টাকা দিয়েও পত্রিকা করার পক্ষে নই। তাহলে আমি পত্রিকা আসলে চালাবো কার টাকায়? কিন্তু যারা অঢেল উপার্জন করেছে, যাদের অনেকের সন্তানেরা ইচ্ছেমতো টাকা ওড়ায়, তাদের সন্তানদের সঙ্গেও কথা বলে দেখেছি আমি। চিন্তা মিলে না। ব্যবসায়িক হিসাব মিলে না। ওরা মাগীদের পেছনে হাজার টাকা ব্যয় করবে, তাতে ওদের দুঃখ নেই, কিন্তু ভালো কাজে পাঁচ টাকাও ব্যয় করবে না। সব কিছু মিলিয়ে সাংবাদিকতাকে সৎ রেখে নিজে সৎ থাকা কঠিন। এ জন্যই অনেক বন্ধু আমার স্রোতে গা ভাসিয়ে দিয়েছে। আমার বাবা সরকারী চাকুরি করতেন। বেতনও পেতেন। অন্যদিকে বাড়িতে গিয়ে বাবা তার বাবার দিনের জমিও বিক্রি করতেন। বাবার বন্ধুরা ঠিক একই চাকুরি করেও গ্রামে এবং শহরেও জমি কিনতেন। কিন্তু আমার না আছে সরকারী চাকুরি কিংবা ব্যবসা অথবা নিজের নামে কোনো জমি। আমি কী বিক্রি করবো? আমাকে সর্বদা মগজ চালিয়েই বাঁচতে হয়। আর সেই মগজ অন্যের কাছে বিক্রি অথবা বন্ধক না রেখে বেঁচে থাকা গভীরতর কঠিন।
পাকিস্তানে কেনো এতো জঙ্গির উত্থান হলো, কেনো পাকিস্তানের কারাগারে হানা দিয়েও জঙ্গিরা তাদের বন্দী সদস্যদের পলায়নের সুযোগ দেওয়ার দুঃসাহস দেখায়, তা নিয়ে অনেকক্ষণ আলাপ হলো মোহতাসিম প্রীতিমের সঙ্গে। এই শাঈখ মোহাম্মদ মোহতাসিম প্রীতিম ছেলেটা কুমিল্লা শহরের এখনকার অনেক অনেক সম্পাদকের চেয়েও বেশি জ্ঞান রাখে। তাই তার সঙ্গে পাকিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফ কিংবা পাকিস্তানের পাখতুনখোয়ার জঙ্গিদের নিয়ে এতো আলোচনা হয় আমার। পাকিস্তানের ওই এলাকাটি আফগান সীমান্তবর্তী এবং পার্বত্যময়। ওখানে আল- কায়েদার বিভিন্ন সহযোগী সংগঠন বেশ সক্রিয়। তাদের কাছে রকেটচালিত গ্রেনেড হলো আমাদের সকালের চা-পরোটার মতো।

৯| ০৯ ই মে, ২০১৮ রাত ১:৩৬

জসীম অসীম বলেছেন: you are not allowed
to post anything in this blog
===================
সবাই যদি এমন বলেন, তাহলে
আমি এখন কোথায় লিখবো?
==================
জসীম অসীম:
সুকুমার রায় তার ‘বাবুরাম সাপুড়ে’ ছড়ায় লিখেন ‘
...দুটো সাপ রেখে যা,
যে সাপের চোখ নেই,
শিং নেই, নোখ নেই,
ছোটে না কি হাঁটে না,
কাউকে যে কাটে না,
করে না কো ফোঁসফাঁস
মারে নাকো ঢুসঢাস,
নেই কোন উৎপাত,
খায় শুধু দুধভাত...।’
মূলত আমি এমন ধারারই লেখক। কাউকেই তেমন আক্রমণ করি না।কিন্তু তারপরও দিন দিন ক্রমাগত আমার লেখার জায়গা সংকুচিত হয়ে আসছে। আমি somewhereinblog.net-এ লিখতাম। কিন্তু এখন আর লিখতে পারি না।ওই ব্লগে আমার একটি ব্লগ রয়েছে।http://www.somewhereinblog.net/blog/ashimjashim কয়েকবার এই ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ করায় আমাকে ‘ব্লক’ করা হয়েছিলো।আবার একসময় ‘ব্লক’ বাতিলও করা হয়।কিন্তু নভেম্বর 2015 এর পর থেকে আমাকে আর এই ব্লগে ব্লগ লিখতে দেওয়া হয় না। ব্লগ কর্তৃপক্ষকে অনেক মেইল পাঠিয়েও এর সমাধান হয়নি।এই পর্যন্ত আমার এই নিরীহ ব্লগটি ১৭,৯৩৫ বার দেখা হয়েছে। ব্লগে আমার শ্লোগান হলো : ‘আমার লেখা ব্যর্থ লেখা।’
১০ ই নভেম্বর, ২০১৫ বিকাল ৩:৫৪-এ আমি একটি অত্যন্ত নিরীহ লেখা পোস্ট করেছিলাম। লেখার শিরোনাম ছিলো: ‘একদা আমি ছাত্রশিবির করেছি। আর এখন করছি ছাত্র ইউনিয়ন।’ এই লেখা পোস্ট দেওয়ার পরই ব্লগার ‘আব্দুল্লাহ রিফাত’ আমাকে লেখার মতামত হিসেবে লিখেছেন: ‘হায়রে হতভাগা।’ এই ব্লগারের প্রোফাইলে তার নিজের ছবিও নেই।
আমি বিগত 20 বছরে 10 বার কুমিল্লার স্থানীয় পত্রিকার দায়িত্বশীল পদের চাকুরি ছেড়েছি। তারপর ফ্রিল্যান্স সাংবাদিকতা করি।। অতঃপর আমার শ্বাশুড়ির এক পুরনো পত্রিকার সম্পাদনা করতাম। তাও ধরে রাখতে পারিনি। কারণ ওই যে, মার্কের্টিং বচন, তা আমি শিখিনি। আর বাকি জীবনেও এই বচন রপ্ত করার ইচ্ছে আমার নেই।অন্যদিকে কোথাও আর আমার কোনো লেখা ছাপা হয় না বলে কখনো কখনো এখন ‘ফেসবুকে’ই লিখি। ওই লেখাই লিখি: যে সাপের চোখ নেই, শিং নেই, নোখ নেই, ছোটে না কি হাঁটে না, কাউকে যে কাটে না, করে না কো ফোঁসফাঁস মারে নাকো ঢুসঢাস...। কারণ আমি কোনো সাহসী লেখকও নই এবং মূলত আমার সব লেখাই ব্যর্থ।আর এটি আমার কোনো বিনয় বা ভণিতা নয়, চরম সত্য কথা।

১০| ০৯ ই মে, ২০১৮ রাত ১:৫২

জসীম অসীম বলেছেন: কুমিল্লার দুর্নীতিগ্রস্থ বিভিন্ন রাজনীতিবিদের
যাকাত-ফিতরার টাকা খেয়ে ফেলে
এখানকারই অসংখ্য সাংবাদিক
জসীম উদ্দিন অসীম:

কুমিল্লার রাজনীতিবিদদের যাকাত-ফিতরা এবং পশুর চামড়ার টাকা খেয়ে ফেলে এখানকারই অধিকাংশ সাংবাদিক। আর এ বিষয়টি এখানে এখন কোনো নতুন ঘটনা নয়। বছর বছর ধরেই চলছে এ অনিয়ম। (আমার ২২ বছরের সাংবাদিকতার শুরুতে আমি কক্ষনোই এমনটি দেখিনি। কিন্তু এখন এটিই নিয়ম।) আর এই অনিয়মকে নিয়মে রূপান্তরিত করতে গিয়ে সাংবাদিকতার মহান ব্রতকে বিনষ্ট বিভ্রান্ত করে দিচ্ছে কতিপয় দালাল প্রকৃতির সাংবাদিক। তারা তাদের এই অপকর্ম তাদেরই জীবিত বা মৃত সন্তান বা জীবিত বা মৃত বাবা-মায়ের নামে শপথ করে কক্ষনোই অস্বীকার করতে পারবেন না। যদি কেউ কেউ পারেনও বা, তাদের সংখ্যা একেবারেই হাতেগোনা। অথচ সাংবাদিকতাকে দালালি হিসেবে না নিয়ে তারা যদি তাদের পেশাগত দায়িত্বে যথাযথ সাহস ও ঝুঁকি নিয়ে কাজ করে যেতেন, তাহলে দেশ হতো উপকৃত, মানুষও অনেক ক্ষেত্রে পেতেন নিষ্কৃতি। কিন্তু এখানে সাংবাদিক নামের বিড়াল আর দুর্নীতিগ্রস্থ রাজনীতিবিদ নামের ইঁদুর মিলিতভাবে এখন শান্তিচুক্তি করেছে একই সঙ্গে মিলে তারা রাষ্ট্রপতিরূপী কৃষকের ধান এবং ধন লুট করবে বলে।
বিড়ালে আর ইঁদুরে যদি শান্তিচুক্তি করে, তবে সেই শান্তি দেখে সুখবোধ করার কিছুই নেই। এমনই এক অলিখিত অঘোষিত এক শান্তিচুক্তি হয়েছে কুমিল্লার (এই লেখাটি সারা দেশের অন্যান্য দুনীতিগ্রস্থ সাংবাদিকদের অনিয়ম নিয়ে লিখিত নয়।) অসংখ্য সাংবাদিক এবং অনেক পত্রিকার মালিকের মধ্যে। আর তা হলো: এখানকার ক্ষমতাবান বিভিন্ন রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে বছর বছর ধরে বিভিন্ন দান-অনুদান-অনুগ্রহ-খয়রাত নিয়ে স্থানীয় এসব সাংবাদিকদের তথাকথিত সাংবাদিকতা করা। আর এ জন্যই ওই সাংবাদিক গোষ্ঠি কিংবা পত্রিকার মালিকগণ কক্ষনোই স্থানীয় (কুমিল্লার) ক্ষমতাবান বিভিন্ন রাজনীতিবিদদের কারোর কোনো লুটপাটের বিরুদ্ধেই এক কলম লেখার সাহস দেখাতে পারেন না। এখানকার দুর্নীতিগ্রস্থ রাজনীতিবিদদের সঙ্গে দুর্নীতিবাজ সাংবাদিকদের এই `বিড়াল-ইঁদুর’ শান্তিচুক্তির কারণে অধিকাংশ দুর্নীতিগ্রস্থ রাজনীতিবিদগণ দিব্যি তাদের লুটপাটতন্ত্র চালিয়ে যেতে পারছেন। আর এর বিনিময়ে রাজনীতিবিদদের যাকাত-ফিতরার অধিকাংশ টাকাও এখন পেয়ে যাচ্ছেন, খেয়ে যাচ্ছেন স্থানীয় অধিকাংশ কলঙ্কিত এসব সাংবাদিক। বিনিময়ে নেতাদের অনেকের অনেক অপকর্ম বিষয়ে তারা আর কক্ষনোই কলম-ক্যামেরা ধরবেন না বলেই অলিখিত অঘোষিত সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এতে করে সাংবাদিকতার মতো মহান পেশা হচ্ছে ক্রমাগতই কলঙ্কিত। এখানকার প্রায় সকল সাংবাদিকই এই টাকা খাওয়ার তালিকায় তাদের নাম লিখিয়েছেন। তারা তাদের সন্তানের নামে, জীবিত বা মৃত পিতা মাতার নামে, ধর্মগ্রন্থের নামে শপথ করে বলতে পারবেন না যে, ওই টাকা তারা খাননি। (তবে আমি ওই রকম শপথ করে বলতে পারবো যে, আমার গত ২২ বছরের সাংবাদিকতা জীবনে কোনো দলের কোনো দুনীতিগ্রস্থ রাজনীতিবিদদের কাছ থেকেই কখনো টাকা খেয়ে নিজের জীবন বন্ধক রাখিনি।) আর এতে করে সাংবাদিকতার মতো মহান পেশা হচ্ছে কলঙ্কিত। বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এবং অসংখ্য প্রভাবশালী সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে লেখা হচ্ছে না এক কলম সংবাদ। রাষ্ট্র হচ্ছে বিপুল ক্ষতিগ্রস্থ। তাতে রক্তে অর্জিত এই স্বাধীন দেশ অনিয়মের কালো মেঘে আরো গভীরভাবেই ঢেকে যাচ্ছে। আর এখানকার এই সাংবাদিক-রাজনীতিবিদদের বিড়াল-ইঁদুর শান্তিচুক্তির কারণে ব্যক্তিগতভাবে অনেক সাংবাদিক রাতারাতি বাড়ি-গাড়ি-ফ্ল্যাটের মালিক হয়ে গেলেও এই দেশের ক্ষুধার্ত গণমানুষের কথা আর উঠে আসছে না এখানকার তেমন কোনো গণমাধ্যমে। এর চেয়ে লজ্জার আর কী হতে পারে। এর চেয়ে দুর্ভাগ্যের চিত্র আর কী ই বা রচিত হতে পারে। জাতির বিবেক বলে পরিচিত এই পেশার কুমিল্লার অধিকাংশ লোকই এখন তাদের আবেগ-বিবেক-যুক্তিকে বন্ধক দিয়ে মনুষ্যত্বহীন হয়েছেন। তারা ঈদ বা অন্যান্য পার্বণের আগেও রাজনীতিবিদদের চেম্বারে গিয়ে নাম লিখিয়ে ব্যক্তিত্বহীনভাবে লাইন ধরে বসে থাকেন। রাজনীতিবিদদের থেকে ক্ষুধার্ত মানুষের প্রাপ্য জাকাত-ফিতরা-পশুর চামড়ার টাকা খাবেন বলে। বিনিময়ে বিবেক বন্ধক দিয়ে অলিখিত অঘোষিত অঙ্গীকার করে আসেন যে, তাদের প্রভুদের বিরুদ্ধে আর কক্ষনোই কলম চালাবেন না। অথচ তারা সংবাদ-ব্যবসাটি (নিউজ বিজনেস) করলেও সৎ পথে নিজেদের ভাগ্য অনেক পরিবর্তন করতে পারতেন। কিন্তু ওই শ্রমসাধ্য কষ্টসাধ্য ঝুঁকিযুক্ত পথে তারা যেতে রাজি নন। তারা শুধু আরাম-আয়েশও খোঁজ করবেন আবার সাংবাদিকও পরিচয় দেবেন। হায় এর নাম কেনোদিনও সাংবাদিকতা নয়। কারণ দালাল কক্ষনোই সাংবাদিক নয় এবং কক্ষনোই সাংবাদিকতা নয় একজন নিকৃষ্ট মানুষের সৃষ্ট রকমারি দালালি। কুমিল্লার বিবেকবান-সংস্কৃতিবান-নেতৃত্ববান মানুষ: কুমিল্লার গণমানুষ: রাজনীতিবিদদের যাকাত-ফিতরা ও পশুর চামড়ার টাকা খাওয়া এসব সাংবাদিক নামধারীদের ঘৃণা করা শিখুন। শ্রদ্ধা করুন প্রকৃতই যারা সাংবাদিক, তাদের। একদা এই কুমিল্লাই ছিলো মহান সাংবাদিকতার উৎকৃষ্ট ক্ষেত্র। আর এই অঞ্চল এখন তথাকথিত সাংবাদিকতায় নষ্ট আর ভ্রষ্ট হয়ে যাচ্ছে ক্রমাগত। পিষ্ট গণমানুষের কথা আর প্রকাশিত হয় না তাই দালালদের কোনো লেখনিতে। সামান্য ব্যতিক্রমের কিংবা উদাহরণের কথা বাদ দিলে কুমিল্লার সাংবাদিকতার অধিকাংশ চিত্রই এখন এমন ন্যাক্কারজনক। তাই ওদের ধিক্কার জানানো ছাড়া আর কোনো উপায়ই নেই।

১১| ০৯ ই মে, ২০১৮ রাত ১:৫৯

জসীম অসীম বলেছেন: তাদের কাছে রকেট চালিত গ্রেনেড
আমাদের সকালের চা- পরোটার মতো
আমারই দিনলিপি: এপ্রিল ২০১২, কুমিল্লা।

আমারই লেখার জন্য আমার ক্ষয়ক্ষতি প্রতিদিন আরও বেশি অনুভব করছি। খ্রিস্টান বন্ধু লরেন্স তীমু বৈরাগীকেও লেখা দিয়ে আক্রমণ করলাম। তীমুদা’ মনে কষ্ট পেলেন। কিছুই বললেন না। ক্ষমতাও দেখালেন না। উল্টো একদিন জোর করেই চা খাওয়ালেন। সেদিন বললেন, পত্রিকা চালাতে বেশি অসুবিধায় পড়লে যেন তার কাছে যাই। কিন্তু আমি শিক্ষকের হালাল টাকা এনে পত্রিকা চালাতে ইচ্ছুক নই। অন্যদিকে নষ্ট লোকদের কালো টাকা দিয়েও পত্রিকা করার পক্ষে নই। তাহলে আমি পত্রিকা আসলে চালাবো কার টাকায়? কিন্তু যারা অঢেল উপার্জন করেছে, যাদের অনেকের সন্তানেরা ইচ্ছেমতো টাকা ওড়ায়, তাদের সন্তানদের সঙ্গেও কথা বলে দেখেছি আমি। চিন্তা মিলে না। ব্যবসায়িক হিসাব মিলে না। ওরা মাগীদের পেছনে হাজার টাকা ব্যয় করবে, তাতে ওদের দুঃখ নেই, কিন্তু ভালো কাজে পাঁচ টাকাও ব্যয় করবে না। সব কিছু মিলিয়ে সাংবাদিকতাকে সৎ রেখে নিজে সৎ থাকা কঠিন। এ জন্যই অনেক বন্ধু আমার স্রোতে গা ভাসিয়ে দিয়েছে। আমার বাবা সরকারী চাকুরি করতেন। বেতনও পেতেন। অন্যদিকে বাড়িতে গিয়ে বাবা তার বাবার দিনের জমিও বিক্রি করতেন। বাবার বন্ধুরা ঠিক একই চাকুরি করেও গ্রামে এবং শহরেও জমি কিনতেন। কিন্তু আমার না আছে সরকারী চাকুরি কিংবা ব্যবসা অথবা নিজের নামে কোনো জমি। আমি কী বিক্রি করবো? আমাকে সর্বদা মগজ চালিয়েই বাঁচতে হয়। আর সেই মগজ অন্যের কাছে বিক্রি অথবা বন্ধক না রেখে বেঁচে থাকা গভীরতর কঠিন।
পাকিস্তানে কেনো এতো জঙ্গির উত্থান হলো, কেনো পাকিস্তানের কারাগারে হানা দিয়েও জঙ্গিরা তাদের বন্দী সদস্যদের পলায়নের সুযোগ দেওয়ার দুঃসাহস দেখায়, তা নিয়ে অনেকক্ষণ আলাপ হলো মোহতাসিম প্রীতিমের সঙ্গে। এই শাঈখ মোহাম্মদ মোহতাসিম প্রীতিম ছেলেটা কুমিল্লা শহরের এখনকার অনেক অনেক সম্পাদকের চেয়েও বেশি জ্ঞান রাখে। তাই তার সঙ্গে পাকিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফ কিংবা পাকিস্তানের পাখতুনখোয়ার জঙ্গিদের নিয়ে এতো আলোচনা হয় আমার। পাকিস্তানের ওই এলাকাটি আফগান সীমান্তবর্তী এবং পার্বত্যময়। ওখানে আল- কায়েদার বিভিন্ন সহযোগী সংগঠন বেশ সক্রিয়। তাদের কাছে রকেটচালিত গ্রেনেড হলো আমাদের সকালের চা-পরোটার মতো।

১২| ০৯ ই মে, ২০১৮ রাত ২:১৭

জসীম অসীম বলেছেন: কোনো কোনো সাংবাদিক প্রয়োজনে দেশ ছেড়েছেন
কিন্তু সাংবাদিকতাকে খুন করতে পারেননি
জসীম উদ্দিন অসীম:

নিজে বাঁচতে এবং সাংবাদিকতাকে বাঁচাতে কুমিল্লার অনেক সাংবাদিকই এখন বিদেশে চলে গেছেন। এই তালিকায় সর্বশেষ যার নাম লিপিবদ্ধ হয়েছে, তিনি হলেন: কুমিল্লার তো বটেই, বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী পত্রিকা 'সাপ্তাহিক আমোদ' এর বাকীন রাব্বী। আধুনিকতার নামে যুগের হাওয়ায় সব্বাই গা ভাসালেও তিনি ভেসে গেলেন না। তিনি যে পত্রিকা বাঁচাতে এবং নিজে বাঁচতে অবৈধ কালোবাজারী স্রোতে গা ভাসাবেন না, এই বিশ্বাস আমার ছিলোই। তার বুকের যন্ত্রণা আমি একবিন্দু পরিমাণ হলেও উপলব্ধি করি। অনেকেই হয়তো ভাবছেন, সুখের সন্ধানেই তিনি এখন স্বপরিবারে যুক্তরাষ্ট্রে চলে গেছেন। কিন্তু তার সকল সুখ ছিলো তার পিতা মোহাম্মদ ফজলে রাব্বীর প্রতিষ্ঠিত ''সাপ্তাহিক আমোদ'' পত্রিকার প্রকাশনায়। তিনি প্রিন্টিং ব্যবসা করতেন। সেই ব্যবসার লাভের টাকায় ভর্তুকি দিয়ে ওই পত্রিকা নিয়মিত প্রকাশ করতেন এবং একটি নির্ধারিত তারিখে স্টাফদের বেতন দিতেন। আমরা কেউই তার চোখের জল আর বুকের কষ্ট দেখিনি কোনোদিন। হীনস্বার্থের কাছে কোনোদিনও মাথা বিক্রি শিখেননি মোহাম্মদ ফজলে রাব্বীর এই রক্তের উত্তরসূরী। পত্রিকাকে আর সাংবাদিকতাকে তিনি আলু-পটল-ভুট্টা বা খেসারির ডালের মতো পণ্য বানাতে পারেননি। আর আমি ব্যক্তিগতভাবে হিসাব মিলাতে না পেরে বারবারই পত্রিকার চাকুরি ছেড়ে দিয়েছি।
বেকার থেকেও আমি পত্রিকা ভিন্ন অন্য চাকুরি কক্ষনোই করতে পারিনি। আমি কুমিল্লার কাগজ, কুমিল্লা বার্তা, ডাক প্রতিদিন...ইত্যাদি পত্রিকা অফিসে রাতের পর রাত জেগেও ক্লান্তি বোধ করিনি। আমি পত্রিকার চাকুরি ছেড়েছি অনেকবারই। কিন্তু রিপোর্ট করা কিংবা লেখালেখি কিন্তু ছাড়িনি। কোন পত্রিকার, কোন তারিখের কোন রিপোর্টটি আমি করেছি, কিংবা কার কাছে বিক্রি করেছি নিজের গ্রন্থের পান্ডুলিপি, তা উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়ে লিখলেই বিশ্বাস হবে। এই পেশার অনিশ্চয়তার সঙ্কট আমাকে বেশ ভোগান্তিই দিয়েছে। আর এ জন্য এই পেশার আমার অনেক বন্ধুই অনেকদিন ধরে সাংবাদিকতায় লাগাতার কাজ করেও, খুব 'সিরিয়াস' হয়েও বাধ্য হয়ে অন্য পেশায় চলে গেছেন কিংবা গিয়েছেন বিদেশে। কুমিল্লার সাংবাদিকতায় একসময় 'সিরিয়াসলি' কাজ করছিলেন সোহেল আলম মজুমদার শিপন। দৈনিক শিরোনাম পত্রিকার পর তিনি দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় কিছু 'ঝড়ো রিপোর্ট' লিখেন। তখনকার 'সংবাদ' পত্রিকার গ্রহণযোগ্যতা বা পাঠকপ্রিয়তা এখন উদাহরণ দিয়েই বুঝাতে হবে। তারপর মূলত এই পেশার অনিশ্চয়তার কারণে এবং নিজে নষ্ট হয়ে সাংবাদিকতা না করার মানসেই তিনিও বিদেশে চলে যান। কুমিল্লার সাংবাদিকতার পূর্বসূরীদের মধ্যে ''সমাজকণ্ঠ'' পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক দেলোয়ার জাহিদ ও সাংবাদিক নজরুল ইসলাম বাবুলসহ আরও অনেকেই এ পথ অবলম্বন করেন। একসময় খালেদ গোলাম কিবরিয়াও বিদেশে চলে যান। খালেদ যুক্ত ছিলেন ''গ্রন্থ প্রকাশনা ব্যবসা''র সঙ্গে। কিন্তু তিনি বুঝেছিলেন সাংবাদিকতা পেশার চরম অনিশ্চয়তাটুকুও। তাই একসময় তার মূল উদ্দেশ্য হয়ে উঠে বিদেশ যাওয়া। তিনি কুমিল্লার ''সাপ্তাহিক ময়নামতি'' পত্রিকায় প্রথম যোগদান করেন 'সহ-সার্কুলেশন ম্যানেজার' হিসেবে। তারপর 'ফটো সাংবাদিক' এবং সর্বশেষ তিনি ''ময়নামতি'' পত্রিকার ''বার্তা সম্পাদক''ও হন। এমনকি ''সাংবাদিক সমিতি'' কুমিল্লা জেলা কমিটির সহ-সাধারণ সম্পাদকও হয়েছিলেন এই খালেদ। পরে আরও অনেকের মতো সাংবাদিকতাকে হত্যা করে আর এই পেশায় টিকে থাকতে চাননি। চলে যান বিদেশে। যদিও যাওয়ার সময়ে একটি কারণ প্রকাশিত হয়। ২৭ এপ্রিল ২০১০ তারিখের ''দৈনিক কুমিল্লার কাগজ'' পত্রিকায় নিউজ দেখলাম: ‘নিরাপত্তাহীনতায় দেশ ছেড়েছেন সাংবাদিক কিবরিয়া।’ পরে খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম তিনি সত্যি সত্যিই দেশ ছেড়েছেন। তারা সব্বাই প্রয়োজনে কেউ কুমিল্লা ছেড়েছেন, কেউ দেশ ছেড়ে প্রবাসজীবনের কষ্ট বরণ করেছেন, কিন্তু সাংবাদিকতাকে হত্যা করতে পারেননি। বরং সাংবাদিকতাকে ভালোবেসে এখনো তারা কোনো না কোনোভাবে, কোনো না কোনো মাধ্যমে সাংবাদিকতাকে লালনই করছেন। কিন্তু দুঃখ লাগে যখন দেখি, এই দেশে বসেই, এই কুমিল্লায় বসেই কিছু লোক নিয়মিতভাবেই সাংবাদিকতাকে রীতিমত ধর্ষণই করে চলেছেন। তারা যে সাংবাদিকতার কতো বড় শত্রু, সময় একদিন অবশ্যই তা প্রমাণ করবেই।

১৩| ০৯ ই মে, ২০১৮ রাত ২:২৩

জসীম অসীম বলেছেন: আমি এখন 'আমিসিস্ট'
জসীম উদ্দিন অসীম:
প্রফেসর খন্দকার আলী আর রাজী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের 'সাংবাদিকতা' বিভাগের একজন শিক্ষক। ২০০৪ সালে বাংলাদেশের প্রখ্যাত সাংবাদিক নাঈমুল ইসলাম খান সম্পাদিত 'দৈনিক আমাদের সময়’ পত্রিকা বাজারে আসার আগেই সেই পত্রিকার ঢাকা অফিসে রাজী ভাই আমার জন্য 'চাকুরি' ঠিক করেছিলেন। যদিও নাঈম ভাইয়ের সাথে ঢাকায় গিয়ে 'ফাইনাল' কথা বলার পরও সেই চাকুরিটা আমি আর করিনি। প্রফেসর খন্দকার আলী আর রাজী-র সঙ্গে কথা বলার সময়ে এক প্রসঙ্গে তিনি আমাকে বলেন, যেহেতু মার্কসবাদী বাম গণ-রাজনীতির সঙ্গেও আপনি একসময় সংশ্লিষ্ট ছিলেন, তবে কি এখনও আপনি 'মার্কসিস্ট'? আমি বলি, না। 'মার্কসিস্ট' হওয়ার জন্য যতটা যোগ্যতা দরকার, তা আমার নেই। তাই আমি এখন 'আমিসিস্ট'। কারণ অনেক অনেক 'দর্শন' পাঠ করার পরও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আমার নিজ বুদ্ধি দ্বারাই আমি পরিচালিত হই।

১৪| ০৯ ই মে, ২০১৮ রাত ২:৩৫

জসীম অসীম বলেছেন: সৈনিক-অফিসার বৈষম্য আমার কখনোই পছন্দ ছিলো না:
কর্নেল তাহের
(কর্নেল আবু তাহেরের একটি
কাল্পনিক সাক্ষাৎকার):
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বীর সেনানী কর্নেল আবু তাহেরের একটি ‘কাল্পনিক সাক্ষাৎকার’ তার সম্পর্কিত বিভিন্ন পাঠ অবলম্বনে রচনা করেছেন সাংবাদিক জসীম উদ্দিন অসীম।

6. জিয়াকে আপনার ‘বিশ্বাসঘাতক’ বলার মূল কারণ কি?
কর্নেল তাহের: কারণ আমি খালেদ মোশাররফের অভ্যুথ্থানের সময় ছিলাম চট্টগ্রামে। আমি তখন অবসরপ্রাপ্ত একজন কর্নেল। আমি জানলাম জিয়া গৃহবন্দী রয়েছেন। হয়তো তাকে মেরেও ফেলা হতে পারে। আমি জিয়ার এমন অমঙ্গল কামনা করিনি। তাছাড়া আমি ভেবেছিলাম যে, জিয়া বোধ হয় আমার সমাজতান্ত্রিক আদর্শেরই মানুষ। আমার সেই ভাবনা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। সমাজতন্ত্র তো দূরে থাক, জিয়ার কোনো ধরনের কৃতজ্ঞতা বোধই ছিলো না। অন্যদিকে আমাকে হত্যার জন্য জিয়াকে অনেকে প্ররোচিতও করেছিলো। কিন্তু মূলত জিয়া পরে তার বিশ্বাসঘাতকতায় প্রাপ্ত ক্ষমতা নিষ্কন্টক করতেই আমাকে হত্যার সিদ্ধান্তে সম্মত হয়। অথচ আমি জিয়াকে কোনোভাবেই হত্যা করতে চাইনি। আজ লোকে বলে জিয়া নাকি সৈনিকদের মধ্যে অনেক জনপ্রিয় ছিলেন। তিনি তো ক্ষমতায় এসে অনেক আর্মি অফিসার-সৈনিককে কতল করেছেন। অথচ সেনাবাহিনীতে আমিই ছিলাম তখন সর্বোচ্চ জনপ্রিয়। কারণ সৈনিক-অফিসার বৈষম্য আমার কখনোই পছন্দ ছিলো না। আমার এই দৃষ্টিভঙ্গির কথা তখন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অসংখ্য অফিসার-সৈনিকের কাছে পৌঁছে গিয়েছিলো। তাই তখন আমি একজন অবসরপ্রাপ্ত কর্ণেল হয়েও এবং চট্টগ্রামে অবস্থান করেও ঢাকাতে আমার অনুগত ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সিপাহীদের বিদ্রোহের নির্দেশ দেই। তারপর আমি অতি দ্রুতই চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় চলে আসি।

১৫| ০৯ ই মে, ২০১৮ রাত ২:৪৬

জসীম অসীম বলেছেন: বন্ধু আবিদ হোসেন আমার নাট্যকর্মী সংগ্রহের
নান্দনিক সব পোস্টার তৈরি করে দিতো
জসীম উদ্দিন অসীম:

ঢাকায় আমি কয়েক বছর ধরেই মঞ্চনাটকের সঙ্গে জড়িত ছিলাম। পারফর্মিং আর্ট বিষয়ে সে সময়ে আমি কয়েকটি প্রশিক্ষণও গ্রহণ করি। তখন কয়েকজন প্রশিক্ষক আবার আমাদের অভিনয়ের অংশ হিসেবে জাদুবিদ্যাও শেখানো শুরু করলেন। জন মার্টিন আমাদের মঞ্চনাটক বা থিয়েটার বিষয়ে যেসব বিষয় শিখিয়েছিলেন, তা আজও ভুলতে পারিনি। অভিনেতা আবুল হায়াৎ যখন আমাদের পারফর্মিং আর্ট বুঝাতেন, আমরা মুগ্ধ হয়ে সেসব গ্রহণ করেছি। আমাদের বিভিন্ন নাটকের নির্দেশক এস.এম.সিরাজী সৌরভ ভাই দেহভঙ্গি শেখাতে গিয়ে আমাদের রীতিমত ধ্রুপদী নাচ শেখানোও শুরু করলেন। খায়রুল আলম সবুজ যখন প্রাচীন গ্রিসের থিয়েটার নিয়ে কথা বলতেন, তখন ক্লাসে একজন নাট্যকর্মীও কোনো শব্দ করার সাহস পায়নি। বিটিভি প্রযোজক সালেক খান ‘মিশরীয় মিথলজি’ পড়ালেন অনেকদিন। তখনও বুঝিনি অভিনয় শেখার সঙ্গে ‘প্রাচীন মিথলজি’ পড়ার সম্পর্ক কী থাকতে পারে। আমরা প্রথম থিয়েটার করতে গিয়েছিলাম মূলত ‘তারকা’ হওয়ার জন্যই। কিন্তু বিভিন্ন প্রশিক্ষণ গ্রহণের পর আমরা সহজেই বুঝতে পারলাম: ‘তারকা’ হওয়া নয়, প্রয়োজন প্রাতিষ্ঠানিকভাবে এ বিষয়ে প্রশিক্ষিত হওয়া। আমি যখন 1993 সালে টি.এস.সি-তে আমার বন্ধু আবিদ হোসেনের সহযোগিতায় “পেরিস্কোপ নাট্য অধ্যয়ন চক্র” প্রতিষ্ঠা করেছিলাম, তখন আমি প্রাচীন গ্রিক থিয়েটারসহ আরও বিভিন্ন বিষয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা বলার মতো জ্ঞান অর্জন করেছিলাম। আর আমাকে এসব বিষয়ে বিভিন্ন গ্রন্থাদি দিয়ে সর্বসময় সর্বোচ্চভাবেই সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলো আবিদ হোসেন। আবিদ এখন ঢাকায় বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি করে। আবিদ তখন আমার অনুরোধে নাট্যকর্মী সংগ্রহের জন্য নিজ হাতে অনেক পোস্টার তৈরি করে দিতো। সেসব পোস্টারের এক কোনায় যদি থাকতো জাপানি মঞ্চ নাটক কাবুকির ছবি, তো অন্য পাশে থাকতো উইলিয়াম শেকসপিয়রের ক্লোজ মুখ। ‘এরিস্টটলের নাট্যতত্ত্ব’ বিষয়ক সমালোচনামূলক নিবন্ধ "পোয়েটিকস" তো আমাদের পাঠ্যই ছিলো। তাই কোনো কোনো পোস্টারে এরিস্টটলের বিভিন্ন স্কেচ-এর ফটোকপি করা চিত্রও আঠা দিয়ে পেস্ট করা থাকতো। আবিদকে দিয়ে আমার নাট্যকর্মী সংগ্রহের এসব নান্দনিক পোস্টার তৈরিকে এখন আমার আরেকটি অধ্যায়ই মনে হয়। আবিদ রাতের পর রাত জেগে নিজ হাতে আমার জন্য অলঙ্কৃত পোস্টার করে দিলে আমি আমার অধ্যয়ন চক্রের বিভিন্ন ছাত্র বা নাট্যকর্মী নিয়ে টি.এস.সি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা কলেজসহ বিভিন্ন জায়গায় সেসব পোস্টার সেঁটে আসতাম। আর আবিদের ছিলো সর্ব বিষয়ে জ্ঞান। মঞ্চনাটকের নির্মাণ কৌশল থেকে শুরু করে জার্মান নাট্যকার ব্রেশ্ট এর নাটক কিংবা অ্যান্টিগোনে নাটক...সব বিষয়েই ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলতে পারতো সে। কবে যে সে এতো এতো বইপত্র পাঠ করার সুযোগ পেয়েছিলো, ভাবতেও পারিনি। রুশ অভিনেতা ও মঞ্চনাটক পরিচালক কনস্ট্যান্টিন স্তানিস্লাভস্কিসহ আরও বিভিন্ন বিষয়ে আরও অনেক জানতে তখন আমরা বিভিন্ন পাঠাগারের ক্যাটালগ তছনছ করে ফেলতাম। আজকের এই ইন্টারনেটের যুগে বসে সেই কষ্টের কথা কল্পনাও করা যাবে না।

১৬| ১০ ই মে, ২০১৮ রাত ১২:০২

জসীম অসীম বলেছেন: (গল্প)
.............................................
মেলিটারী ভাবী
জসীম উদ্দিন অসীম

চেয়ারম্যানের পুত্রবধূ আজ তার শিশু কন্যাকে নিয়ে অন্যঘরে শুয়েছে। শ্বশুর আজ বাড়ি ফিরবেন না এবং এরই মধ্যে শ্বাশুড়ির সঙ্গে তুমুল ঝগড়া হয়েছে চেয়ারম্যানের পুত্রবধূ শেফালির। শেফালি অবশ্য এই ঘরেই থাকে, যখন তার স্বামী ইব্রাহিম বাড়িতে থাকে। ইব্রাহিম সেনাবাহিনীর চাকুরি করেন এবং এখন আছেন বান্দরবানে। ছোটবেলা থেকেই ইব্রাহিম ছিলেন দুঃসাহসি। পরে এই দুঃসাহসি পেশা বেছে নিয়েছেন নিজেই। এখন তার চেয়েও দুঃসাহসি কাজ করছেন যেন বিয়ে-সংসার করেই। কারণ মা আর বউয়ের রেষারেষিতে চাকুরি করাই কঠিন। ইব্রাহিম বউ-বাচ্চাকে সঙ্গে রাখতে পারছেন না কিংবা চাচ্ছেন না। অন্যদিকে তার মায়ের প্রায় কোনো নির্দেশই মানতে চায় না তার স্ত্রী শেফালি। তাই মাসে মাসে টাকা পাঠালেও বাড়িতে বউ- শ্বাশুড়ির যুদ্ধ ঠিক লেগেই থাকে। শেফালি ও তার শ্বাশুড়ি পিয়ারা বেগম দিনের শুরুতে ঝগড়া শুরু করেছিল শেফালিদের গ্রাম রূপাতালির ‘হাইক্কা চোরা’র প্রসঙ্গ ধরে। হাইক্কা চোরা এখন বেঁচে না থাকলেও রূপাতলি ও তার আশপাশের গ্রামের মানুষের মুখে মুখে এখনও তার চুরির বিভিন্ন গল্প শোনা যায়। কালীগঞ্জের ইব্রাহিমের এক দূর সম্পর্কের আত্মীয়া প্রশ্ন করে জানতে চান বউমার বাড়ি কোথায়? ইব্রাহিমের মা জবাব দেন, ‘রূপাতলি গ্রামে হাইক্কা চোরার বাড়ির পেছনের বাড়ি।’ এই হাইক্কা চোরার নামে বাড়ির পরিচয় দেওয়াতেই শেফালি ক্ষেপে যায়। হাইক্কা চোরার ভাতিজা আবদুল মজিদ এখন কছিম উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। এই মজিদ মাষ্টারের বাড়ির পেছনের বাড়ি বললেই শেফালিদের বাড়িকে চিনে মানুষ। অথচ শ্বাশুড়ি এই হাইক্কা চোরার নাম ধরে পরিচয় দেওয়াতেই দিনের শুরুটা নষ্ট হয়ে গেল। শেফালি বলে, আম্মা আপনি আর কতোদিন হাইক্কা চোরার নাম নিয়া আমারে অপমান করবেন? শ্বাশুড়ি পিয়ারা বেগম বলেন, বউ রাগ করো ক্যান? তোমার মজিদ মাষ্টারকে দুই-তিন গ্রামের মানুষও ভালো করে চিনে না। অথচ হাইক্কা চোরার নাম জানে বিশ গ্রামের মানুষ। শেফালি বলে, তাহলে তো মানুষে চেনার জন্য ভালো কাম ছাইড়া চুরি করনেরই দরকার। বউয়ের এমন কথায় দূর সম্পর্কীয় আত্মীয়ার কাছে লজ্জা পান শ্বাশুড়ি। পরে তাকে পুকুর থেকে ধরা মাছ কাটতে বললে শেফালি সেই মাছ আর বটি এক ঘন্টা ফেলে রাখে। পিয়ারা বেগম আবারও বললে শেফালি এবার মাছ কাটে ঠিকই কিন্তু মাছের উচ্ছিষ্ট ফেলে রাখে আরও ঘন্টাখানেক সময়। এ নিয়ে বউ-শ্বাশুড়ির ঝগড়া বেড়েই চলে। কছিম উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছে শেফালি। তখনই তার বিয়ে হয় এবং বন্ধ হয়ে যায় লেখাপড়াও। শ্বাশুড়ি প্রায়ই বলেন, মেট্রিকও পাশ না, তারপরেও এমন। বি.এÑএম.এ পাশ করলে কী যে করতো মেয়ে। শেফালি জবাব দেয়, আপনার মেট্রিক ফেল ছেলের জন্য কোন দেশ থেকে বি.এ- এম.এ পাশ করা পাত্রী আনতেন? এমন সব বিষয় নিয়ে বউ-শ্বাশুড়ির দূরত্ব বাড়তেই থাকে। অন্যদিকে চেয়ারম্যান তার চেয়ারম্যানগিরি ও ব্যবসা নিয়ে পড়ে থাকেন। তাছাড়া তিনি তার পুত্রবধূকে ধমক দিয়ে কোনো কথাও বলতে পারেন না। এ নিয়েও চেয়ারম্যান আর তার স্ত্রীর সঙ্গে মাঝে মধ্যে ঝগড়া হয়। তবু পুত্রবধূ শেফালিকে কটূ কথা বলা সম্ভব হয় না তার। ইউনিয়নের এতো লোকের বিচার করেন, কিন্তু নিজের পুত্রবধূ বেফাঁস অনেক কথা বললেও কষে একটি ধমক দিতে পারেন না। ইব্রাহিম ও শেফালি দম্পতির এক সন্তানের সংসার তারপরও মন্দ চলছিলো না। কিন্তু ঝামেলা বাঁধলো, যখন ইব্রাহিম তার চাকুরি নিয়ে যত ব্যস্ত থাকলো, তার সিকিভাগও সংসারকে সময় দিতে পারলো না। শ্বাশুড়ির অপমানকে শেফালি তেমন গায়ে মাখলো না। কিন্তু ইব্রাহিমকে সে একেবারেই যেন পাচ্ছে না। শিশুকন্যাটি বেড়ে উঠছে একপ্রকার পিতৃস্নেহ ছাড়াই। ইব্রাহিম বাড়িতে এলেও বউয়ের জন্য কিছু বইপত্র নিয়ে আসেন। স্কুলের লেখাপড়া বন্ধ হয়েছে ঠিকই, তবু যেন বইপত্র পড়ে তার স্ত্রী পৃথিবীকে একটু জানতে পারে। অথচ বাস্তবে তেমন সময়ই হয় না শেফালির। চাকরবাকর বাড়িতে থাকলেও নিজের অনেক কাজ নিজেকেই করতে হয়। কাজ শেষে সারাদিনের ক্লান্তির পর সন্ধ্যা হতেই ঘুমে অচেতন হয়ে পড়ে। বই পড়বে আর কখন? এলাকায় বিদ্যুৎও নেই। রাত হলেই মনে হয় গহীন রাত। এর মধ্যে একাকীত্ব। ইব্রাহিম একবার এক রাতে শেফালিকে বুঝাচ্ছিলেন হারামি ‘রেডক্লিফ’ বাংলার কী ক্ষতি করেছিলেন। বুঝানো শেষ হওয়ার আগেই শেফালি ঘুমিয়ে অচেতন হয়ে পড়ে। বাড়ির সবদিকেই ধানক্ষেত। ওখানে শিয়ালের হুক্কাহুয়া ডাক ওঠে। শেফালির খবরও নেই। আরেকদিন এমন রাতের বেলা ‘মেজর রফিকের কৃতিত্বের গল্প’ বলার সময়ও শেফালি ঘুমিয়ে পড়েছে। ইব্রাহিম বুঝতে পারে তার স্ত্রীর খাটাখাটুনি খুব বেশিই হচ্ছে।
ইব্রাহিমদের বাড়িতে থেকে ঐ গ্রামেরই একটি কলেজে পড়ে ইব্রাহিমের মামাতো ভাই মাহিদুল ইসলাম। মাহিদুলের মা নেই। বাবা খুররমও অসুস্থ। বাড়িতে আছেন তার বড় ভাই ও ভাবী। ভাবী জেসমিন তার শ্বশুরের যত্নে সারাক্ষণই ব্যস্ত থাকেন।
মিলিটারীর চাকুরি করেও ইব্রাহিমের অত তেজ নেই, যত তেজ মাহিদুলের শেফালি ভাবীর। প্রতিবেশি অনেক লোকই শেফালিকে তাই ‘মেলিটারী ভাবী’ বলেও ডাকে। গ্রামের লোক মিলিটারীকে বলে মেলিটারী। সেই থেকেই এই নাম। এক সময় পুরো এলাকাতেই শেফালির এ ‘মেলিটারী ভাবী’ নামটি ছড়িয়ে পড়ে। শুনে ইব্রাহিমও হাসেন। বলেন, মিলিটারীর চাকুরি করেও আমি মিলিটারী হতে পারলাম না। আর তুমি হয়ে গেলে মিলিটারী? শুনে শেফালিও হাসে। বলে, ওটা আমি আমার রাগী স্বভাবের জন্য হইনি গো। হয়েছি মিলিটারীর বউ বলেই।
ইব্রাহিমের একমাত্র বোন পাপড়ি পড়ে অষ্টম শ্রেণিতে। তাকে তার পড়াশোনার জটিল অংশ বুঝিয়ে দেয় মাহিদুল। মাহিদুলের লেখাপড়া শেষ হলে যদি চাকুরিবাকুরি করে, তখন তার সঙ্গে পাপড়ির বিয়ে দেয়া যায় কী না-এ নিয়েও অনেকে হিসেবনিকেষ করে। একসময় এ কথা চেয়ারম্যানের কানেও যায়। চেয়ারম্যান বলেন, সময় হোক, ভেবে দেখা যাবে। ছেলেটা আগে দাঁড়াক। কিন্তু ছেলে দাঁড়াবে কি? সে তো সেনাবাহিনীর পুণ্যরক্তের সঙ্গেই মনে মনে বেঈমানী করে বসে আছে। তার বড় ভাই সমতুল্য সৈনিক ইব্রাহিমের স্ত্রীর দিকেই চোখ পড়েছে তার। এ কথা স্বয়ং ‘মেলিটারী ভাবী’ শেফালিও এখনো বুঝতে পারেনি। এরই মধ্যে ইব্রাহিম স্ত্রীর কাছে ব্যস্ততায় চিঠিও লিখছে কম। ইব্রাহিমের শিশুকন্যা নাফিজাকে সঙ্গ দেয়ার নামে ‘মেলিটারী ভাবী’র খুব কাছে চলে যায় মাহিদুল। কখনো তাকে নিজের পয়সায় খেলনা কিনেও দেয়। এটাকে কেউ সন্দেহের চোখেও দেখে না। কিন্তু ইব্রাহিমের ছোটবোন পাপড়ি মাহিদুলকে একটি প্রেমের চিঠি লিখে বসলে মাহিদুল পাপড়িকে অপমানের স্বরে বলে, প্রেমের বয়স হয়েছে তোমার? আগে মন দিয়ে লেখাপড়া করো। মাথা থেকে ভূত তাড়াও। তারপর যা হওয়ার হবে। লজ্জায় খুব কাঁদে পাপড়ি। নিজেকেই তার খুব অপরাধী মনে হয়। শিশু নাফিজার প্রতি মাহিদুলের দায়িত্ববোধ দেখে তার প্রতি সবার কৃতজ্ঞতা বাড়ে। একদিন রাতে নাফিজার উঠলো ভীষণ জ্বর। সঙ্গে সঙ্গেই সাইকেল আর টর্চলাইট নিয়ে গঞ্জের দিকে ছুটে গেল মাহিদুল। কিছুক্ষণের মধ্যেই ওষুধ নিয়ে ফিরলো। সেই কৃতজ্ঞতায় ‘মেলিটারী ভাবী’ সেদিন রাতের জন্য তার মাহিদুল ভাইকে টু-ব্যান্ড রেডিওটা বাজাতে দিয়েছে। এই রেডিও বাজাতে পাওয়া মাহিদুলের কাছে পূর্ণিমার চাঁদের থেকেও বেশি। ইব্রাহিমদের সারা বাড়িতে দুইটি রেডিও আছে। একটি চেয়ারম্যানের থ্রি-ব্যান্ড রেডিও, অন্যটি টু-ব্যান্ড ‘মেলিটারী ভাবী’র। এই দুই জিনিসে যেন হাত দেওয়ার অধিকার কারোরই নেই। এক বাড়িতে দুই দুইটি রেডিও থাকা কম গর্বের কথা নয়। তাছাড়া গঞ্জের দোকানে চেয়ারম্যানের একটি ১৪ ইঞ্চি সাদাকালো টেলিভিশনও রয়েছে। কোনো ফুটবল ফাইনাল খেলার দিন কিংবা কোনো সিনেমা দেখানো হয় যেদিন, শত শত লোক জড় হয় দেখতে।
মাহিদুলের সুটকেসে ইদানিং তার মৃত মায়ের ছবির সঙ্গে আরেকটি ছবি যুক্ত হয়েছে, সেটা ‘মেলিটারী ভাবী’র। কিভাবে সে এ ছবি সংগ্রহ করেছে, কেউ জানে না। এমনকি তার সংগ্রহে যে শেফালির ছবি রয়েছে, এটা শেফালিও জানে না। যখন মাহিদুল একা থাকে, তখন সে এ ফর্সা নারীর সুন্দরী-স্বাস্থ্যবতী ছবিটা বের করে মনোযোগ দিয়ে দেখে। এ ছবি দেখলেই তার ঘুম আসেনা, দীর্ঘশ্বাস ছড়িয়ে দেয় বিছানায়। অথচ সে আগে অনেক আদর্শবান ছিল। এস এস সি পাশের যোগ্যতায় কোথাও চাকুরির নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি পত্রিকায় দেখলে দরখাস্ত করতো। এখন তার ‘মেলিটারী ভাবী’র চুড়ির ঝনঝন শব্দে আগুন ধরে যায় মগজে। ইদানিং আবার বিকেল বেলায় ‘মেলিটারী ভাবী’ সারা শরীরে সুগন্ধি লাগিয়ে ঘুরে। এমন গন্ধে মাহিদুল কামার্ত হয়ে পড়ে। সারাবাড়িতে জারুল গাছগুলো তাকে যেন তখন কবিতা লেখারও আহবান জানায়। কয়েকমাস হয়ে গেল ইব্রাহিমও বাড়িতে আসছেন না। শুধু চিঠিপত্রই লিখছেন শেফালিকে। এদিকে স্বামীর অপেক্ষা করে করে শেফালি অনেকদিন নিজ গ্রাম রূপাতলিতেও যায়নি। নিজের জীবনটাকে তার এখন জীবন্ত এক আগ্নেয়গিরিই মনে হয়। কখনো কখনো মনে হয়। অনেকগুলো ক্রিমির ওষুধ একসঙ্গে খেয়ে মরে যায়। কিন্তু পারে না নিজ সন্তান নাফিজা এবং এখন তার জীবনে নতুন করে যুক্ত হওয়া পরম বন্ধু মাহিদুলের কারণে। এই মাহিদুল বাজার থেকে এসে ময়দা, ডালডা, লবণ, দুধ, চিনির ব্যাগ রেখে তার শেফালি ভাবীর একটি চুমো না খেয়ে যাবে না। সামনে কেউ হাজির থাকলে পাওনা চুমোটা সে পরে কোনো এক সময়ে হলেও আদায় করে নেবে। এসব কথা শেফালি তার স্কুল জীবনের হিন্দু বান্ধবী সুষমার সঙ্গে ভাগাভাগি করলে সুষমা বলেছিল, শেফালি তুই পাপে জড়িয়ে তোর জীবনটা নষ্ট করিস না। খুবই কষ্ট পাবি। শেফালি মানেনি সুষমার সেই কথা। বরং লুকিয়ে লুকিয়ে প্রায়ই মাহিদুলের হাতে তুলে দেয় ঘিয়ে ভাজা মচমচে চিড়ার লাড্ডু, বিস্কুট ইত্যাদি। এরই মধ্যে ইব্রাহিম বদলি হয়ে যান কক্সবাজার এরিয়ায়। বঙ্গোপসাগরের উপকূল থেকে একদিন একটি চিঠি লিখেন ইব্রাহিম। এই চিঠির পর শেফালিকে লেখা কিছু কিছু চিঠি মেরে দেয় মাহিদুল। এতে স্বামী-স্ত্রীর দূরত্ব আরও বাড়ে। জলদস্যুদের নিয়ন্ত্রণে বিডিআর- নৌবাহিনী- সেনাবাহিনীর- বিমানবাহিনীর ভূমিকা নিয়ে চিঠি লিখেন ইব্রাহিম। সেই চিঠিতে রয়েছে সেন্টমার্টিন দ্বীপ থেকে কুতুবদিয়া পর্যন্ত ভ্রমণের অনেক বৃত্তান্ত। কিন্তু এসব চিঠি হাতে পৌঁছে না শেফালির। মেরে দেয় মাহিদুল। আর ইব্রাহিমের বাবা চেয়ারম্যান ব্যস্ত তার রাজনীতি এবং ব্যবসা নিয়ে। গতকালও তার সম্মানে একটি সংবর্ধনা সভা ছিল। এসব খবর তিনি কখন রাখবেন? তাছাড়া ইদানিং ডাক পিয়নের সঙ্গেও মাহিদুলের গলায় গলায় ভাব। শেফালিকে একা পেলে আর ভাবী ডাকে না মাহিদুল। বলে, প্রিন্সেস শেফালি। নিজেকে পরিচয় দেয় প্রিন্স মাহিদুল। বারণ করে না শেফালিও। অথচ এই শেফালি আবার নিয়মমাফিক প্রতিদিনই ফজর-জোহর-আসর-মাগরিব এবং এশার নামাজও পড়ে। আবার সে-ই মাহিদুলকে এমন প্রশ্রয় দিতে পারে, ভাবাও যায় না। বিষয়টা প্রথমে কিছুটা টের পায় চেয়ারম্যান বাড়িতে বছর বছরব্যাপী থাকা কাজের লোক আবদুল মালেক। সে এটা শেফালির শ্বাশুড়ি পিয়ারা বেগমকে বললে, পিয়ারা মালেকের ডান গালে একটি কষে থাপ্পড় দেয়। থাপ্পড় খেয়ে নিরবে কেঁদেছে আবদুল মালেক। কেঁদেছে এই জন্য যে, থাপ্পড় খাওয়ার জন্য তো নয়ই, বরং গত তিন বছর ধরে এ বাড়িতে অনেক অপরাধ করেও কখনো সে কারো হাতে মার খায়নি। বড়জোর বকা খেয়েছে। বরং আজ দেখা সত্য বলতে গিয়েই মার খেলো পিয়ারার, যাকে সে মায়ের মতোই শ্রদ্ধা করে। পরদিন পিয়ারা বেগমকে আবদুল মালেক বলেছে, তিস্তায় পাঁচবার হামাদের বাড়ি নিছে। না হয় হামার মতো চ্যাংরা এহানে কাজ করি? চোখ দুটি তার লালে লাল হয়েছিলো তখন। তার কথার কোনো জবাব দেননি পিয়ারা বেগম। রংপুরের গঙ্গাচড়ার তিস্তাপাড়েই আবদুল মালেকের বাড়ি। মালেকের বলা বিষয়টাকে উড়িয়ে ফেলে দেন না পিয়ারা বেগম। রাতে স্বামী চেয়ারম্যানের কানে কথাটা দিতে গিয়ে তিনিও এক থাপ্পড় খান স্বামীর। স্বামী তাকে এভাবে কখনো মেরেছে, তার মনে পড়ে না। স্বামী চেয়ারম্যান বলেন, তার অনেক দায়িত্ব মাথায়। এই এখন যেমন এলাকার কালীমন্দিরে কে বা কারা গত রাতে প্রতিমা ভাঙচুর করেছে, এ নিয়ে বসতে হবে। কথা বলতে হবে আবার পুলিশের সঙ্গেও। এ অবস্থায় এসব বাজে নালিশ ভালো লাগে! পুুলিশ প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনায় এখনো কাউকে ধরতে পারেনি। তাই আছে উপজেলা প্রশাসনের চাপ। মন্দিরের পুরোহিত নিরঞ্জন চক্রবর্তী এ নিয়ে চেয়ারম্যান বাড়িতে দুইবার এসেছেন। চেয়ারম্যান প্রথম যখন জানতে চান নিরঞ্জনের কাছে কয়টি প্রতিমা দুুর্বৃত্তরা ভেঙেছে? নিরঞ্জন বলেন, একটি কালী প্রতিমা ও একটি সরস্বতী প্রতিমা ভাঙচুর করেছে ওরা। চেয়ারম্যান পুরোহিত নিরঞ্জনের কাছে আরও জানতে চান কারা এবং কেন ভেঙেছে প্রতিমা? কী মনে হয় আপনার? নিরঞ্জন বলেছেন, আমি এর কোনো কারণও জানি না। শত্রুদেরও দেখিনি। তবু পূজা উদযাপন কমিটির বণিকবাবু ৪/৫ জনের নাম আমার কাছে দিয়েছেন। এদিকে আগে কখনো সিনেমা দেখতো না মাহিদুল। ইদানিং দেখে। দেখে আবার সেই গল্প শেফালি ভাবীর কাছে বলে। শেফালি ভাবী ওরফে ‘মেলিটারী ভাবী’ও সেই সিনেমার গল্প উপভোগ করে। শেফালি ভাবী আরও উপভোগ করে সাপ- মইয়ের লুডু খেলা। আগে রাতে শ্বাশুড়ির সঙ্গেই খেলতো শেফালি। এখন সেখানে নতুন করে আগ্রহ প্রকাশ করে যুক্ত হয়েছে মাহিদুল। এতে শ্বাশুড়ি পিয়ারা বেগম আতঙ্ক অনুভব করেন। ইব্রাহিম লেখাপড়ায় মন না বসাতেই সেনাবাহিনীর সৈনিকের চাকুরিতে নাম লেখায়। এ চাকুরিতে পিয়ারা বেগমের মন ছিলো না। ‘মারা আর মরা’র এ পেশা কোনোদিনও ভালো লাগেনি তার। এখন পুত্রবধূর ভাব বুঝতে পারছেন না তিনি। নিরবে চোখের জল ফেলেন। আরও চোখের জল ফেলেন বিনা অপরাধে কাজের লোক আবদুল মালেককে থাপ্পড় মেরেছেন বলে। এদিকে আবার দুইদিন পর। কালীমন্দিরের পুরোহিত নিরঞ্জনের বাবা স্বর্গীয় নিত্যরঞ্জন চক্রবর্তীর শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠিত হবে। ওখানে চেয়ারম্যানেরও নিমন্ত্রণ রয়েছে। তার আগেই প্রতিমা ভাঙচুরের বিষয়ে কিছু একটা করা না গেলে চেয়ারম্যানেরও মুখ বাঁচবে না। স্বর্গীয় নিত্যরঞ্জন চক্রবর্তী বড় ভালো লোক ছিলেন। চেয়ারম্যানের নির্বাচনেও তার পক্ষে কাজ করেছিলেন। তার বিদেহী আত্মার সদগতি কামনায় দুর্বৃত্তদের ধরতে তাই চেয়ারম্যান থানার ওসির সঙ্গে কয়েকবার কথা বলেছেন। যদিও এখনো পর্যন্ত কাউকে সনাক্ত করা যায়নি। এদিকে শেফালি আর মাহিদুলের মাখামাখি এবার পাপড়ির চোখেও পড়লো। পাপড়ি তবু কাউকে কিছু বললো না, যদি কেউ এর পেছনে আবার মাহিদুলের প্রতি পাপড়ির কোনো দুর্বলতা খুঁজে পায়, তাই। এদিকে এসব কথা ধীরে ধীরে ‘মেলিটারী ভাবী’ শেফালির কানেও আসে। নিজ গ্রাম রূপাতলি থেকে তার এক কাকাতো বোন কয়েকদিনের জন্য বেড়াতে এসেছে তার কাছে। রাতে ঘুমের আগে সেই কাকাতো বোন দিলারা শেফালিকে বললো, তোমার আর মাহিদুলের কথা কিন্তু যেভাবেই হোক আমাদের রূপাতলি পর্যন্ত চলে গেছে। ‘মেলিটারী ভাবী’ শেফালি এ কথা শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর দিলারাকে বলে, একটা কথা শোন দিলারা, আমরা যা খাই তার কিছু অংশ শরীরে রেখে অদরকারী অংশ মলমূত্র করে বের করে দেই। কথার বেলাও এমনই। অদরকারী কথাগুলো কানে না নিলেই হলো। দিলারা বললো, কিন্তু লোকে তো তোমাকে কলঙ্ক দিচ্ছে শেফালি আপা। তাছাড়া এমন ধনী ও গুণি পরিবারে তোমার কিসের অভাব? শেফালি বললো, দিলারা তুইও গ্রামের মেয়ে। দেখেছিস নিশ্চয়ই দোয়েল পাখি কখনো গাছের ডালে বাসা গড়ে না। আরও ভালো ডাল পেলেও দোয়েল বাসা গড়ে গাছের ফোঁকরেই। আমিও তেমনি দোয়েল স্বভাবের মেয়ে। বাকিটা বুঝিয়ে বলতে পারবো না। দিলারা ভাবতেও পারে না এই শেফালিই একদা তাকে রাতের বেলা পড়া দেখিয়ে দিতো। তখন শেফালির কন্ঠে কবি জীবনানন্দ দাশের ‘আবার আসিব ফিরে’ কবিতাটি কতো চমৎকার শোনাতো। দিলারার এখনো যেন সেই স্বর কানে লেগে রয়েছে। ...‘হয়তো দেখিবে চেয়ে সুদর্শন উড়িতেছে সন্ধ্যার বাতাসে; ... দেখিবে ধবল বক; আমারেই পাবে তুমি ইহাদের ভিড়ে।’ হায়! সেই শেফালি যেন আজ সত্যিই হারিয়ে গেছে। শেফালি আজ সত্যি সত্যিই যুদ্ধংদেহী ‘মেলিটারী ভাবী’। যে শেফালি অর্জুন গাছের তলায় বসে আড্ডা দিতো, বর্ষায় গাছে উঠে পেড়ে আনতো কদম ফুল কিংবা অশ্বত্থ বটপাতা দিয়ে বানাতো একধরনের বাঁশি, তার ভিতরটা যেন আজ সিমেন্ট তৈরির কাঁচামাল ক্লিংকার, ফ্লাইক্র্যাশ, জিপসাম ও স্ল্যাগে পরিপূর্ণ।
এদিকে অনেকদিন অসুস্থ থেকে হঠাৎই মারা যান মাহিদুলের বাবা খুররম। এতে শোকের ছায়া সবাইকে ছুঁয়ে গেলেও শেফালিকে যেন একটু বেশিই ছুঁয়েছে। সে তার শ্বাশুড়িকে আবদার করে বসে এ উপলক্ষ্যে মাহিদুলের বাড়িতে যাওয়ার। কিন্তু শ্বাশুড়ি পিয়ারা বেগম অনুমতি দেননি। বলেছেন, নাফিজার কাশিটা বেড়েছে। এখন যাওয়ার দরকার নেই। ওদিকে মাহিদুলদের বাড়ি থেকে এসেই তোমার শ্বশুর আবার ঢাকায় যাবেন। এ বছর হজ্জ্ব করার নিয়ত রয়েছে তার। মক্কা-মদিনায় যাওয়ার জন্য আমারও প্রাণটা জ্বলে। কিন্তু যাওয়ার উপায় নাই। নিজের পোলা নিলো আর্মির চাকরি। দেশের জন্য সময় দিয়ে ঘরের জন্য সময় নাই। আবার বলে কী না, মা আমরা হলাম দেশের অতন্দ্র প্রহরী। ওদিকে দুর্গাবাড়িতে কয়েকদিন পরই নামযজ্ঞ উৎসব। তোমার শ্বশুর আবার ওখানেও ব্যস্ত হবেন। তার পোলার মতো তারও ঘর দেখার সময় নাই। বিপীন বাবু আগেই নিমন্ত্রণ করেছেন। আবার আজ রাতেই গোরস্থানের জমি নিয়েও বসতে হবে সালিসে। দত্তপাড়ার পশ্চিমবাড়িতে। আমার বালের চেয়ারম্যানগিরি তার। কার বালে যে তারে চেয়ারম্যান হইতে কইছিলো। দুনিয়ায় যেন আর কোনো নেশা নাই। শ্বাশুড়ির মুখে এত কথা শুনে একেবারেই চুপ হয়ে যায় ‘মেলিটারী ভাবী’ শেফালি। ঘরে এসে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়ায়। তখন তার কাছে মনে হয়, নিজের জ্বলজ্বলে নাকফুলটিই যেন তাকে বলছে, আমি একজন জ্যোতিষরাজ। আমি বলে দিলাম, তুই আগামীতে অন্ধকারেই নিপতিত হবি। আর এতেই হঠাৎ-ই মন কেঁপে ওঠে শেফালির। তার কানে বাজে স্বামী ইব্রাহিমের কিছু কথা। ইব্রাহিম বলেছিলেন, সেনাবাহিনীর চাকুরি অন্য সব চাকুরি থেকেই ব্যতিক্রম। সকল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েই এ চাকুরি পেতে হয়। বয়স হতে হবে নির্ধারিত। উচ্চতা-ওজন- বুকের মাপ- শিক্ষাগত যোগ্যতা-স্বাস্থ্য পরীক্ষা-লিখিত পরীক্ষা এবং আরও কতোকিছু...! আর নিয়মভঙ্গ করলেও মারাত্মক সাজা...চাকুরি থেকে বরখাস্ত। তেমনিভাবে একজন নারীর জন্যও তার সংসার হলো প্রতি মুহূর্তেই পরীক্ষাক্ষেত্র। নিয়মভঙ্গ করলেই...। কেঁপে ওঠে ‘মেলিটারী ভাবী’ শেফালির মন ও শরীর। তবে কি সে আর মাহিদুলকে কোনো প্রশ্রয়ই দেবে না? ঘর থেকে বের হয়ে আবার বাইরে যায় শেফালি। গিয়ে ঠিক সোনাইল গাছটির নিচে গিয়ে দাঁড়ায়। যেখানে এক সন্ধ্যায় প্রথম মাহিদুলকে শরীরে হাত দিতে দিয়েছিল শেফালি। তখন গ্রীষ্মকাল। হলুদ রঙের ঝুলন্ত ফুলের লম্বা লম্বা ছড়ায় গাছটি কেমন সুগন্ধে ভরে উঠেছিল।
রচনা: সেপ্টেম্বর ১৯৯৬,
কুমিল্লা।
আলোকচিত্র: জসীম উদ্দিন অসীম: ১৯৯৬


১৭| ১০ ই মে, ২০১৮ রাত ১২:২৫

জসীম অসীম বলেছেন: না শিখে নয়
শিখেই সাংবাদিক হন

জসীম উদ্দিন অসীম:

সাংবাদিকতা পেশা আজ অন্য দশটা পেশার চেয়ে বেশি সম্মানজনক। তাই এ পেশায় ক্যারিয়ার গড়তে অনেকেই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু যে কোনো পেশাতেই ভালো ক্যারিয়ার গড়তে হলে প্রয়োজন প্রাতিষ্ঠানিক [ব্যবহারিক ও তাত্ত্বিক] শিক্ষা। দিন দিন বেড়েই চলেছে টিভি ও দৈনিক পত্রিকার সংখ্যা। সেই সঙ্গে হালনাগাদ খবর জানতে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে অনলাইন গণমাধ্যমও। ফলে এসব গণমাধ্যমে প্রয়োজন হচ্ছে দক্ষ সংবাদকর্মীর। এছাড়া দেশি-বিদেশি উন্নয়ন সংস্থায়ও কাজের সুযোগ রয়েছে সাংবাদিকতা বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রিধারীদের। আর এ সাংবাদিকতার প্রাতিষ্ঠানিক পাঠ শুরু হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৬২ সালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও চট্টগ্রাম, রাজশাহী, জগন্নাথ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে সাংবাদিকতা বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি লাভের সুযোগ। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েও খোলা হয়েছে সাংবাদিকতা বিষয়। সাংবাদিকতা পড়ার সুযোগ রয়েছে ঢাকার বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার ‘ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ [আইইউবি]-ধানমন্ডি, সাত মসজিদ রোডের ‘স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ’- ধানমন্ডি, সাত মসজিদ রোডের ‘ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ’ [ইউল্যাব]- ধানমন্ডি, সাত মসজিদ রোডের ‘স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি’- ধানমন্ডি, শুক্রাবাদের ‘ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি’-বনানী, কামাল আতাতুর্ক অ্যাভিনিউ’র ‘আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি’- ধানমন্ডি, সাত মসজিদ রোডের ‘ইউনিভার্সিটি অব ডেভলপমেন্ট অল্টারনেটিভ’ [ইউডা]-বেগম রোকেয়া সরণি’র ‘গ্রিন ইউনিভার্সিটি’-চট্টগ্রামের নিকুঞ্জ হাউজিং সোসাইটি, দক্ষিণ খুলশি’র ‘পোর্ট সিটি ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি’তেও। বর্তমানে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়েও ‘সাংবাদিকতা’ বিষয়টি চালু হয়েছে। ডিপার্টমেন্ট অব মিডিয়া অ্যান্ড কমিউনিকেশন- ডিপার্টমেন্ট অব মিডিয়া স্টাডিজ অ্যান্ড জার্নালিজম - ডিপার্টমেন্ট অব জার্নালিজম, কমিউনিকেশন অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ- ডিপার্টমেন্ট অব জার্নালিজম অ্যান্ড ম্যাস কমিউনিকেশন- ডিপার্টমেন্ট অব মিডিয়া অ্যান্ড কমিউনিকেশন - ডিপার্টমেন্ট অব ফিল্ম, টেলিভিশন অ্যান্ড ডিজিটাল মিডিয়া- ডিপার্টমেন্ট অব ব্রডকাস্ট অ্যান্ড প্রিন্ট জার্নালিজম...ইত্যাদি বিভিন্ন নামে মূলত ‘সাংবাদিকতা’ বিষয়টিকেই বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশের সার্বিক প্রেক্ষাপটে দেশের শিক্ষিত তরুণ সম্প্রদায়ের বিশাল একটি অংশ ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও কখনো মেধা এবং কখনো শুধু আর্থিক কারনেই ‘সাংবাদিকতা’ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি গ্রহণের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। আর এরই ফাঁকে, দেশের শিক্ষিত তরুণ সম্প্রদায়ের বিশাল এই অংশের সাংবাদিকতা করতে চাওয়ার পবিত্র ইচ্ছেকে পুঁজি করে, বিভিন্ন কারনেই শুরু হয় অপসাংবাদিকতা। তাই প্রাতিষ্ঠানিক অন্যান্য বিষয়ের মতো, কমপক্ষে ব্যক্তিগত পর্যায়ে হলেও ‘সাংবাদিকতা’ বিষয়ে ‘ব্যবহারিক ও তাত্ত্বিক শিক্ষা’ প্রদানের জন্য কোনো ব্যবস্থাও চালু হওয়া প্রয়োজন। তবু না শিখে, না বুঝে সাংবাদিকতা করতে গিয়ে, এ অঙ্গনের সমূহ ক্ষতি করতে চাওয়া কারোর জন্যই ঠিক নয়। দেশের প্রথিতযশা সাংবাদিকগণ কিংবা এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞগণ না শিখে, না বুঝে তাদের অবস্থান তৈরি করেননি। সুতরাং না শেখার মানসিকতা বদলাতে হবে। এই না শিখে করতে চাওয়া লোকদের চাপে সাংবাদিকতা পেশা আজ তার নিজস্ব প্রেস্টিজ হারাতে বসেছে। ফলে লোকে সাংবাদিককে আজ ‘সাংঘাতিক’ কিংবা অন্যান্য আপত্তিকর অভিধায় অভিহিত করছে। এটা সকল পেশাদার ও যোগ্য সাংবাদিকের জন্য অপমানজনক। ছাগল দিয়ে হালচাষ করা অসম্ভব, সেটা রামছাগল হলেও। তেমনি সাংঘাতিক পর্যায়ের লোক দিয়েও সাংবাদিকতার পেশাগত দায়পূরণ সম্ভব নয়। যেই যুগে ছাগলতো দূরে থাক, গরু-মহিষ দিয়ে হালচাষও উঠে যাচ্ছে কলের লাঙ্গলের চাপে, সেই যুগে সাংঘাতিক পর্যায়ের এসব লোক দিয়ে সাংবাদিকতার কাজ চালানোও অসম্ভব। অথচ সাংবাদিকতা অঙ্গনে কিছু লোকের ভাব এখন এমনই যে, তা করার জন্য যেন কোনো যোগ্যতারই প্রয়োজন নেই। অথচ প্রাতিষ্ঠানিক-অপ্রাতিষ্ঠানিক যে কোনো পন্থাতেই হোক না কেন, এ বিষয়ে প্রশিক্ষণের কোনো বিকল্পই নেই। তাই ‘সাংবাদিকতা করতে চাওয়া’ দেশের শিক্ষিত তরুণ সম্প্রদায়ের প্রতি অনুরোধ, ‘সাংবাদিকতা’ বিষয়ে পড়তে উৎসাহী হোন।
কারন, আজকের যুগে সাংবাদিকতা করতে হলে জানতে হবে অনলাইন সাংবাদিকতা, ওয়েব হোস্টিং ও ওয়েব সাইটের ধারণাও। ওয়েব ডিজাইন প্রশিক্ষণ এখন এ বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত। আগের যুগে শুধু সংবাদপত্রে লিখন কৌশল জানলেই হতো। এখন সাংবাদিকতা করার জন্য ব্লগ ও ব্লগিং এবং বাংলা ইউনিকোডে লিখন প্রশিক্ষণও জরুরী। জানতে হবে সার্চ ইঞ্জিন ও তথ্য খোঁজার বিভিন্ন কৌশল। অনলাইনে প্রাপ্ত তথ্যের সঠিকতা যাচাইয়ের শর্তাবলী ও রেফারেন্স স্টাইল। ফেসবুক ও টুইটার সাংবাদিকতা। টিভি সংবাদে ক্যামেরার ব্যবহার, ছবির ধরন ও শট পরিচিতি, সংবাদে ক্যামেরার মাইক্রোফোন ব্যবহার। টিভি রিপোর্ট: ইন্টারভিউ টেকনিক, ইন্টারভিউ এডিটিং, নিউজ এডিটিং। সংবাদ: উচ্চারণ সূত্র অনুশীলন। শুদ্ধ উচ্চারণ: প্রণায়াম ও ব্যায়াম। সাংবাদিকতা এখন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর রীতিমত পাঠ্য বিষয়। ‘সাংবাদিকতা’ বিষয়টি এখন প্রাতিষ্ঠানিকভাবেই পড়ানো হয়। তাই অনুরোধ, টাকা দিয়ে কোনো গণমাধ্যম মালিকপক্ষের কাছ থেকে ‘সাংবাদিক পরিচয়পত্র’ কিনবেন না। শুধুমাত্র ‘সাংবাদিক পরিচয়পত্র’ বহন করলেই কেউ সাংবাদিক হয়ে যায় না। কারণ সাংবাদিকতা শেখার কোনো ‘শর্টকার্ট’ পথ নেই। তাই না শিখে নয়, শিখেই সাংবাদিক হন। কারণ, সাংবাদিক পরিচয়ধারী সকলেই সাংবাদিক নয়, খোঁজ নিলেই দেখবেন, হয়তো তাদের কেউ কেউই সাংবাদিক।
সুতরাং না শিখে নয়, বরং শিখেই সাংবাদিকতা করতে হবে। যুগের দাবি পূরণ করতে নতুন নতুন সাংবাদিক যেমন প্রয়োজন, তেমনি এ পেশার বর্তমান প্রতিযোগিতায় যদি কোনো ব্যবহারিক কিংবা তাত্ত্বিক শিক্ষা না থাকে, তাহলে তাও ক্রমাগত বিভিন্ন জটিলতাই সৃষ্টি করে যাবে। তাই আগ্রহীরা সাংবাদিকতা পেশাকে আরও দক্ষ ও পেশাদার করে গড়ে তোলার জন্য প্রশিক্ষণের সিদ্ধান্ত নিন। কারণ সাংবাদিকতা আজ শুধু করার বিষয়ই নয়, বরং করার আগে তা পড়ারও বিষয়। তৃণমূল সাংবাদিক জসীম উদ্দিন অসীমের কাছে ব্যক্তিগতভাবে ‘সাংবাদিকতা’ বিষয়ে ‘ব্যবহারিক ও তাত্ত্বিক শিক্ষা’ গ্রহণে ইচ্ছুকগণ জীবনবৃত্তান্তসহ যোগাযোগ করুন। অংশগ্রহণের কমপক্ষে যোগ্যতা এস.এস.সি-সমমান। বয়স ২৫ বছরের কম।
যোগাযোগ : জসীম উদ্দিন অসীম:
০১৭১১-০২৭৪২৬
আশ্রাফ ম্যানশন তৃতীয় তলা, রাজগঞ্জ
কুমিল্লা।

১৮| ১০ ই মে, ২০১৮ রাত ১:২৪

জসীম অসীম বলেছেন: COMILLA-ও হয়ে যাবে KUMILLA
সেদিন দূরে নয়

জসীম উদ্দিন অসীম:

আমি নিজের দোষের কথা লিখি। কিন্তু আমার অনেক সাংবাদিক-লেখক বন্ধু লিখেন না। নিজ পেশার লোকদের খারাপির বিরুদ্ধেও না-নিজেদের খারাপির বিরুদ্ধেও না। তাদেরকে ঠিক কী থেরাপি দেয়া যায়-এখনো আমি বুঝতে পারছি না। এমন একদিন আসবে-যেদিন লেখক-সাংবাদিকগণ-ও নিজেদের দোষের কথা নির্ভয়ে লিখতে পারবেন। সেদিন দূরে নয়।
ভন্ড লোক হয়ে সাধুর অভিনয় করলে ভীষণ রাগ ওঠে। আমিও সাধু নই। দুর্নীতিমুক্ত নই। জেলখানার রক্ষীরাও অনেক ঘুষ খায় বলে অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু বলতে গেলেই বিপদ। ‘কী প্রমাণ আছে?’
আমার ঘরের বউ খুব সুন্দরী হলেও চোখ পড়ে যায় বাইরের অনেক সুন্দরীর দিকেও। আমি স্বীকার করি বলে অনেকে আমাকে ভন্ড বলে দন্ড দিতে চায়-কিন্তু যে ‘শালা’ এমন বিষয়কে গোপন রাখে মনের ভিতর-সেও কি সৎ রয়েছে?
আমাদের ঘরের সুন্দরী বউয়েরা কি পরিপূর্ণ নয়? কেন আবার আমরা অন্যের সুন্দরী বউ দেখলে হা করে তাকিয়ে থাকি? একদা এক মেয়েকে ভালোবাসতাম আমি। তাকে একদিন পড়তে দিয়েছিলাম ‘কাহলিল জিবরান’। কিন্তু সে সেই বইয়ের বদলে একগুচ্ছ গোলাপফুল পছন্দ করেছিল। ভালো একটি বইয়ের বিকল্প কি একগুচ্ছ গোলাপ? ঘরের বউয়ের বিকল্প কি পথে দেখা সুন্দরী কোনো নারী? কেন মানুষ এমন দ্বন্দ্বে ভিতরে-বাইরে স্পষ্টবাদী হতে পারে না? একজন ‘বদমাশ’কে আমি একবার বলেছিলাম-তুমি কি তোমার স্ত্রী-কে তোমার পতিতাবৃত্তির কথা জানাতে পারো? সেই লোক উত্তরে না বলেছিল। ঠিক। এটাই বাস্তব। ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ হলে বর্তমান সময়ে চীন কার পক্ষে যাবে-তা হিসেব করে দ্রুতই বের করা যায়।
কুমিল­া শহরের একজন যুবতী মেয়ের মা ছিলেন অত্যন্ত ব্যক্তিত্বসম্পন্না মহিলা। তিনি তার মেয়ের সঙ্গে আমার খুব মেশামেশি দেখে একদিন তার মাথায় হাত রেখে আমার মৃত মায়ের নামে শপথ করালেন-আমি যেন মেয়েটির শারীরিক কোনো ক্ষতি না করি। মেয়েটি তখন কাছে ছিল না। আমি তার মাকে দেয়া কথা রেখেছিলাম।
২০০৩ সাল। আমার কুমিল্ল­ার কান্দিরপাড়ের তিনতলার বাসায় একদিন মেয়েটি এসে হাজির। সন্ধ্যায়। বাসায় একজন লোকও ছিল না। এমন সময় লোডশেডিংয়ের কারণে বিদ্যুৎ চলে গেল। মেয়েটি আমার সঙ্গে একা। চতুর্দিকে যেন শহীদ মিনারের নিস্তব্ধতা। মেয়েটি ‘সেক্স’ নিয়ে উত্তেজিত হয়ে পড়লো। আমি আমার মৃত মায়ের নামে করা শপথের কথা মনে করলাম এবং মেয়েটিকে চলে যেতে বললাম। মেয়েটি বললো অন্ধকারে যেতে তার ভয় লাগছে-বিদ্যুৎ এলে যাবে। আমি তখন তাকে বললাম-তুমি অন্ধকারকে ভয় পাও? আমি অন্ধকারের চেয়েও হিংস্র। সুতরাং চলে যাও। মেয়েটি গেল ঠিকই-কিন্তু আমাকে ‘ভীতু’ মনে করে। কিন্তু প্রকৃত ব্যাপারটা কী ছিলো? আমি তো আমার মৃত মাকে ‘নিষিদ্ধ পুরনো গাড়ি’ মনে করতে পারি না। শুধু একটি মেয়ের সঙ্গে শুয়ে যাওয়ার জন্যই কি আমি আমার মাকে টাকার মতো অবমূল্যায়ন করতে পারি? না। কিন্তু তাই বলেই আমি চরিত্রবান নই। যদি আমি যুবতী মেয়েটির মাকে আমার মৃত মায়ের নামে ‘কসম’ না দিতাম-তাহলে কি করতাম কিংবা তাহলে কি অন্য কিছু ঘটতো? যদি তা-ই হয়-তাহলে আমি চরিত্রবান কোথায়?
১৯৯৮ সালে আমার মা মারা গেলেন কিডনী রোগের। খুব বড় রকম চিকিৎসা সম্ভব হলো না। সুখ আমাদের তখন থেকেই নিষিদ্ধ হয়েছিলো। সবার হাতে ভিক্ষের থালা উঠার বাকি ছিল। মাকে আমি এতটাই শ্রদ্ধা করি-আজ পর্যন্ত তার নামে শপথ করে আমি কোনো মিথ্যে কথা বলতে পারি না।
আমার বাবা বাংলাদেশের অনেক ট্রাফিক পুলিশের মতো ছিলেন না-যেসব ট্রাফিক পুলিশের যানজট দেখলে কোনো মাথাব্যথাই হয় না। তাই আমরা অনেক কঠিন নিয়মে বেড়ে উঠেছিলাম। তাই এখন চেষ্টা করেও চোর-বাটপার-টাউট হতে পারছি না। শৈশবে পাওয়া শিক্ষাগুলো কোনোভাবেই জীবন থেকে বাদ দিতে পারি না। জেনারেল জিয়া বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর খাল খনন কর্মসূচিতে মনোযোগ দেন। কোদাল দিয়ে মাটি কেটেও খাল খনন উদ্বোধন করেন জিয়া। সেদিন আওয়ামীলীগের এক নেতা এ বিষয়ে বলেন-এই খাল কেটেই নাকি জিয়া বাংলাদেশে কুমীর এনেছিলেন। আমি বললাম-বন্যা প্রতিরোধে এবং সেচ ব্যবস্থায় খালের কিন্তু গুরুত্ব রয়েছে। কিন্তু তিনি শুধু আমাকে কুমীরের ভয়ই দেখালেন। সেই আওয়ামী নেতার নাম বললে আওয়ামী ধোলাই খাবো-অথচ আমি বিএনপি-কেও দেখতে পারি না।
ডুবুরি যেমন সাগরতলে স্বর্ণ অথবা রত্ন খুঁজে-তেমনি আমি ভালো মানুষের খোঁজ করি। কিন্তু পাই কি? কখনো যদি নয়নলোভা যুবতী খুঁজে পাই-যার কাছে স্বর্ণ-রত্ন কোহিনূর সবই আছে-কাছে গিয়ে তার হয়তো দেখা গেল চরিত্রটাই নেই-তাহলে থাকলো কী আর তবে।
ঢাকার বইপাড়ার বাংলাবাজার আর নাটকপাড়ার বেইলীরোডে একদা আমার অনেক সময় কেটেছে। ডায়নার চোখের আয়নার মতো চোখওয়ালী দেবীতুল্য সুন্দরী নারীও দেখেছি অনেক। তাই কি আমি মন্দ হতে পারি না? পারিনা। ইদানীং চেষ্টাও করি। কিন্তু পারিনা। পারিনি। পারিনি সচিবালয়ে তদবির পার্টির সদস্য হতে। মুক্তিযোদ্ধাকে পঙ্গু করতে। শেরাটন অথবা ক্লিনটন হোটেলে গিয়ে ‘ঘোলা পানি’ খেতে। আর আমাদের সংস্কৃতির কথা বলে তো লাভই নেই। কোনদিকে যে তার গতি-বলাই মুশকিল। জাতীয় পতাকার লাল-সবুজ কাপড়ে এখন বাংলাদেশের ছেলেমেয়েরা জামাকাপড় বানিয়ে বানিয়ে পরে রাস্তায় হাঁটে-সবাই দেখলেও তা প্রশাসন নাকি দেখেনা। জুতা দোকানের সাজানো জুতার নাচেও জাতীয় পতাকা উত্তোলিত হয়-আহারে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা-কে করবে তার তদারকি। সেদিন একজন লোকের নাম শুনলাম-হাক্কু। আরেকজনের নাম কাক্কু। তিনিও এই কুমিল্ল­া শহরেরই বাসিন্দা। কুমিল্ল­­া পৌরসভার (বর্তমানে সিটি কর্পোরেশন) বর্তমান মেয়রের ডাকনাম সাক্কু। চিন্তিত থাকি তার কোনো উত্তরসূরী না আবার নাম রেখে বসে ‘চাক্কু’। দলের নাম ফিলিংস। গানের দল। ব্যান্ডগান। শিল্পীর নাম জেমস। কেন যেন মনে হয় টেমস নদীর তীরে তার বাড়ি। দলের নাম ইংরেজিতে-শিল্পীর নামও ইংরেজিতে। কিন্তু তাকে আবার বলা হচ্ছে বাউল। নগর বাউল। আরও উদাহরণ রয়েছে। কিন্তু বেশি লিখলে খবর আছে। সব অভিজ্ঞতা লেখার মানে নেই। সব চমৎকার অভিজ্ঞতা আসলে চমৎকার নয়। তবু পৃথিবীটা আমার কাছে বড় চমৎকার লাগে। সবাইকে খুব অভিজ্ঞ মনে হয়। একটি নোটিশ বোর্ডে আমি একবার বানানো নোটিশ লাগিয়ে কিছু লোককে যেমন বিভ্রান্ত করতে পেরেছি-তেমনি ডিজাইনার বিবি রাসেলও ডিজাইন দ্বারা কিছু মানুষকে মুগ্ধ ও কিছু মানুষকে বিভ্রান্তও করছেন। অবশ্য যে অন্যকে বিভ্রান্ত করে-সে নিজেও কখনো কখনো বিভ্রান্ত হয়। মায়ের বাবা না হলেও ভারতীয় অভিনেতা নানা পাটেকর নাম শুনেও হঠাৎ কেউ কেউ একটু হলেও বিভ্রাটে পড়েন। কারণ-নামের আগেই নানা। যেমন-বাবা জর্দা। খাজা বাবা। পাগলা বাবা।
একবার আমরা মিছিলে শ্লোগান দিলাম ‘গোলামের চামড়া-তুলে নেবো আমরা’। পরদিন দেখলাম মিছিলেরই এক ছেলে তার বাবার সঙ্গে গোলামের এক শিষ্যের বয়ান শুনতে যায়। জীবন আর পৃথিবী এত বিচিত্র-মাথা ঠিক রাখা কঠিন। ইয়ে আজাদী ঝুট হায়, লাখো ইনসান ভুখা হায়। বন্দে মাতরম। ইনকিলাব-জিন্দাবাদ। গলাকাটা চলছে-চলবে। কতোভাবে-কতো শ্লোগানেই না চলবে আমাদের জীবন। একজন প্রভাবশালী মহিলা একবার আমাকে বাঘের চেয়েও বেশি ভয় দেখিয়েছেন। গডফাদার নন-গডমাদার। শেখ হাসিনার আগের আমলে ‘বঙ্গবন্ধু বাতের মালিশ’ বিক্রি করতেন। যে কোনো মুজিবভক্তই সেটা সহ্য করতে পারতেন না। অথচ পার্টির সঙ্গে কিন্তু তার যোগাযোগ ছিল না। একসময় নারায়নগঞ্জের টানবাজারের দিকেও তার নাকি টান কিছুটা ছিল। তিনি ছিলেন আবার রুহানী সব দরবার শরীফের ভক্ত। ওসব দরবার থেকেই নাকি তিনি যৌনশক্তি বাড়ানোর মন্ত্রতন্ত্র পেতেন। বিস্তারিত লিখলে আমার এ লেখার হাতটাই যেতে পারে। টাক মাথাওয়ালা রূপবান যারা-অর্থ্যাৎ যাদের টাকা আছে তাদের সঙ্গে গভীর রাতে মোবাইল মিতালী করেন। যদি একটা মেয়েকে কয়েকদিন ভাড়ায় খাটানো যায়। তার মুখে বোম্বাইয়ের পতিতালয়ের গল্প শুনলে এক্ষনি আপনার বোম্বে যেতে ইচ্ছে করবে। তার নাকি খুব ইচ্ছে ছিল কোনো স্বৈরশাসকের সঙ্গে তিনি প্রেম করবেন। সেই তিনি চুলে রঙ লাগিয়ে যে সৌন্দর্য চর্চা করেন-তা আমার কাছে প্রায়ই উদ্ভট সাজসজ্জা বলে মনে হয়। তিনি তাকে একবার নিজেকে আন্তর্জাতিক নারী বলেও আমার কাছে দাবী করেন।
প্রাচীন গুহাচিত্র আমার ভীষণ পছন্দ। ‘গুহায় চিত্রচর্চা’র ইচ্ছে হয় আমারও। সৌন্দর্য চর্চায় এই গুহার অবদান অনেক-যেমন অজন্তা। যদিও বোদলেয়ার পড়া ছিলো। কারণ জনকণ্ঠের রিপোর্টার সমুদ্র হকের সমুদ্রের মতো গভীর রিপোর্ট আমি পড়েছি-লেখক রমজান আলী খান মজলিসের সঙ্গে মজলিসে বসার সুযোগ না হলেও কবিতা পড়েছি ম.আলী ও আকবর হায়দার-এর। প্রবন্ধ পড়েছি রাজনীতি বিষয়ে হায়দার আকবর খান রনো’র। স্কুল ভ্যানের খাঁচায় করে কোথাও যাওয়ার দুর্ভাগ্য আমার কখনো হয়নি। তাই লেখক আঁদ্রে জিদের মতো রাগ বা জিদও আমার নেই।
দেশের অবস্থাও এখন খুব ভালো। যদি আপনি পাকিস্তান প্রেমিক হোন-ডোন্ট ওরি বি হ্যাপী। দুই বাংলা এক না হলেও ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে দুই পাকিস্তান এক হওয়ার স্বপ্ন দেখতে পারেন। কারণ এদেশে এখন সব সম্ভব। ঋত্বিক কুমারের দুই বাংলা এক হওয়ার স্বপ্ন সফল এক না হলেও ইরানের প্রেসিডেন্ট খাতামিকে এনে বাংলাদেশের জামায়াতে ইসলামীর আমীর করা যেন সম্ভব। যেমন সম্ভব হয়েছে যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের নাগরিকত্ব লাভ।
প্রয়োজনে আপনি সব করতে পারেন। নাম বড় করতে চান? করুন-যেমন বোরহান উদ্দিন খান জাহাঙ্গীর। দেখুন দু’জনের নাম দিয়ে একজনের নাম রাখা হয়েছে। দুখু মিয়া কবিতা লিখেছিলেন। পরে নজরুল হয়েছেন তিনি। এখনও দুখ বাঙ্গাল নামে একজন কবিতা লিখেন। খাওয়ার নামে নাম রাখতে পারেন। যেমন ওমপুরী। ভারতীয় অভিনেতা।
আপনারা বিভূতিভূষণের ‘পথের পাঁচালী’ পড়লে ‘অপু-দুর্গা’র কাহিনী জানবেন। অপু কিন্তু ছেলে। বিটিভির অভিনেত্রী শিল্পী সরকার অপু হলেন মহিলা। সালমান রুশদী ‘স্যাটানিক ভার্সেস’ লিখে এক প্রকার পলাতক। আবু রুশদ দেশেই আছেন। নামে কতো মিল। একজন মেহেদী কবিতা লিখেন। শফিক আলম মেহেদী। গজল শিল্পী মেহেদী হাসান-কতো বিখ্যাত। অন্যজন মেহেদী হাসান কিন্তু আবৃত্তিকার। ক যে শওকত আলী আর কে যে শওকত ওসমান-তা অনেকেই ঠাহর করতে পারেন না। পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ছিলেন বে’নজীর ভুট্টো। বাংলাদেশের একজন বেনজীর আহমেদ। আরেকজন খুব কাছ দিয়ে গেছেন। ব’নজীর আহমদ। ধাক্কা লাগার উপক্রম। এক বিজ্ঞানলেখকের নাম আব্দুল­াহ আল মুতী। মুতী নামটাকে কেমন মনে হয়? শায়েস্তা খান। এমিল জোলা। ‘জোলা’ বলতে আমাদের গ্রামাঞ্চলে বোকাদের বুঝানো হয়। আকিলা রাব্বী। এক সম্পাদকের মেয়ের নাম। শাকিলা জাফর। সংগীতশিল্পী। ফুলন দেবী। জীবনে অনেকবার ফুলে ফুঁসে দেখেয়েছেন। আরজ আলী মাতুব্বর। কী নতুন রকম নাম। ফটো সাংবাদিকের নাম রফিকুর রহমান রেকু। মীর আহম্মদ মীরু। আমি বলছিনা ওসব জননিন্দিত। অবাক লাগে শুনলে। থমকে দাঁড়াতে হয়। আমার এক শিক্ষক ছিলেন। গবেষক। আবদুল মান্নান সৈয়দ। এক কবির সঙ্গে ১৯৯২ সালে বাংলা একাডেমির একই মঞ্চে বসে কবিতা পাঠ করে গৌরববোধ করেছিলাম। তিনি সৈয়দ শামসুল হক। তিনি ‘সৈয়দ’ আগে নিয়ে এসেছেন। এক কবি সৈয়দ হায়দার। ‘সৈয়দ’ বিশেষ নাম নয়। হায়দারও না। এক প্রকার নামের লেজটেজ। মূল নামই নিখোঁজ। যেমন মোহাম্মদ উল্ল­াহ। আরও সৈয়দ আছেন। হায়দারও। সৈয়দ হায়দার। দাউদ হায়দার। রশিদ হায়দার। মাকিদ হায়দার। জহির হায়দার। জাহিদ হায়দার। মোফাজ্জল হায়দার+ মজুমদার। পত্রিকার নাম আনন্দবাজার পত্রিকা-বাংলাবাজার পত্রিকা। কুমিল্ল­াতে এখনও হিটলার, চার্চিল, রুজভেল্টরা বেঁচে আছেন। স্টালিনতো কবিই। রেজাউদ্দিন স্টালিন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই ভাস্কর্য‘অপরাজেয় বাংলা’র সামনে দাঁড়িয়ে ১৯৯১ সালে এক টোকাইকে বলেছিলাম ভাস্কর্যটির নাম জানো? বললো-জানি। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম-কী?
পাথ্থরের মানুষ। ফিরে এসে এ বিষয়ে একটি কবিতা লিখেছিলাম ‘সমাচার’-পত্রিকার শিশুদের পাতায়। তখন প্রায় নিয়মিত লিখেছি সেই পত্রিকায়। কখনো ‘বাংলার বাণী’তে। জসীম উদ্দিন অসীম নামে। একদিন দেখলাম-প্রত্যয় জসীমের লেখা। কুমিল্ল­ায় ফিরে জসীম উদ্দিন চাষীর দেখাও পাই। এমন আরও অনেক ঘটনা রয়েছে স্মৃতিতে নেই। কফি খাই না বহুদিন। কফি খেলে হয়তো মনে থাকতো। কারণ কফি স্মৃতিশক্তি বাড়ায়। চঞ্চল শাহরিয়ার। গল্প লিখেন। তার চঞ্চলতা আমার চেয়ে বেশি কী না, জানি না। অনেকে তোতলায়ে কথা বলেও নাম বাঁকা করে ফেলে। আমার ছোটবেলার বন্ধু বুদার বাড়ির মতিনের ছেলে মোস্তফা যদি বলতো, স্যার আমাকে ছুটি দিয়ে দেন। শোনা যেত: স্যার আমারে চুইদদা দেন। একে তো আঞ্চলিক ভাষা, তার উপর তোতলা। পরে তার তোতলামি দূর হয়েছিল। বার্মা হয়েছে মিয়ানমার। পিকিং হয়েছে বেইজিং। কেমন যেন বেজি বেজি শোনায়।
DACCA হয়েছে DHAKA. আর এইতো সেদিন CALLCUTTA হলো KOLKATA.আমার বিশ্বাস জ্যোতিষীর ওপেন চ্যালেঞ্জের মতো চ্যালেঞ্জ নিয়ে পৃথিবীর সব পঙ্গু নাম এক সময় ঠিক হয়ে যাবে। এমনকি COMILLAও হয়ে যাবে- KUMILLA-সেদিন দূরে নয়।

১৯| ১০ ই মে, ২০১৮ রাত ১:৫৪

জসীম অসীম বলেছেন: গল্প:
অবনীগুপ্ত কি সত্যিই বাড়ি ফিরেছেন?
জসীম উদ্দিন অসীম

বীণাদি’র কাছে গান শেখে উপেন্দ্র। বীণা সেনগুপ্ত। দশম শ্রেণির ছাত্র। শহরের মধ্যম মানের একটি হাইস্কুলে পড়ে। স্কুলের লেখাপড়ায় তার মন বসে না বলে বিগত তিন বছর ধরেই সে এই দশম শ্রেণির ছাত্র। আগামীতেও যে সে এস. এস. সি পাশ করতে পারবে, সেই ভরসাও কম। অষ্টম শ্রেণিতেও সে পড়েছিল দুই বছর কিন্তু সে সংগীতে খুবই ভালো। তার বাবা মনোমোহনেরও ইচ্ছে সংগীতে ছেলে আরও ভালো করুক। মনোমোহন সরকারি চাকুরি করেন। তবে একমাত্র রবীন্দ্র সংগীতই শিখে উপেন্দ্র। এটা তার বাবার নির্দেশ। বীণাদি আগে একটি কলেজেও পড়াতেন। এখন চাকুরিটা ছেড়ে দিয়েছেন। সকাল-বিকাল শহরে ভাড়া বাসায় ছেলেমেয়েদের সংগীত শেখান। বীণাদি’র স্বামীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি না হলেও স্বামী এখন আর সঙ্গে প্রায় থাকেনই না। খুলনায় চাকুরে করেন। ওখানেই থাকেন। এ শহরে একমাত্র শিশু কন্যা ললিতাকে নিয়েই দিনযাপন করেন বীণাদি’। স্বামী অবনীবাবু আগে ললিতাকে দেখতে আসতেন। এখন টাকা পাঠান মাসে মাসে। মেয়েকে দেখতেও আসেন না। কী হয়েছে বীণাদি আর অবনীবাবুর মধ্যে? এমন প্রশ্ন মাথায় প্রায়ই ঘুরপাক খায় উপেন্দ্র’র। এ বিষয়ে উপেন্দ্রকে অনেকে বলেছিলো বীণাদি’র চরিত্রগত কোনো সমস্যাও থাকতে পারে। উপেন্দ্র এর প্রতিবাদ করেছে। বিগত দুই বছর ধরে বীণাদিকে চেনে সে। দিদির বাসায় একজন পর পুরুষকেও এই দুই বছরে দেখেনি। যখন একা থাকেন, তখন বীণাদি হেডফোনে গান শুনেন। তবে হেডফোনে তিনি কী গান শুনেন, প্রশ্ন করেও এর উত্তর পায়নি উপেন্দ্র। বীণাদি’র ছোটবোন প্রিয়াঙ্কাও কখনো কখনো বেড়াতে আসে বীণাদি’র বাসায়। ভয়ানক সুন্দরী মেয়ে। পড়েও দশম শ্রেণিতে। তার দিকে তাকাতেও পারে না উপেন্দ্র। চোখ ঝলসে যায়। ইদানিং বিয়ে নিয়েই বীণাদি’র বাসায় বেশি কথাবার্তা হয়। গাজীপুরের কালীগঞ্জ থেকে প্রিয়াঙ্কার জন্য একটি বিয়ের প্রস্তাব এসেছে। ছেলে বি আই ডব্লিউ টি সি- র কর্মকর্তা। শুধুমাত্র বীণাদি ছাড়া সবাই- ই এই বিয়েটা হওয়ার শতভাগ পক্ষে। বীণাদি’র কাকা দীপ্তিমান সেনগুপ্ত বলেছেন, এর চেয়ে ভালো বর আর প্রিয়াঙ্কার জন্য সারাজীবনেও জুটবে না। বীণাদি’ বলেন, কাকাবাবু, আমার স্বামী একজন প্রকৌশলী। বলা হয়েছিলো প্রকৌশলীর সঙ্গে সংসার হলে সুখে ভরে যাবে আমার। সুখ তো এখন আমি স্বপ্নেও খুঁজে পাচ্ছি না। সরকারি অফিসার হলেই সংসারে সুখ হয়? বীণাদি’র কন্যা ললিতার দ্বিতীয় জন্মবার্ষিকীর দিনেও যখন তার স্বামী অবনীবাবু আসেননি তখন বীণাদি’র কান্না দেখে কে। সেদিন থেকে উপেন্দ্র অবনীবাবুকে ঘৃণা করা শুরু করলো। একটি শিশুর জন্য যার মায়া নেই, সে কি মানুষ? তার কি ধর্মবোধ কিছু রয়েছে? একবারও সাহস করতে পারে না উপেন্দ্র। এ রকম একটি ফোনের জন্য সে ব্যাকুল হয়ে আছে। কিন্তু লেখাপড়ায় মন দিতে পারে না বলে তার বাবার কাছে এ ব্যাকুলতার কোনো মূল্য নেই। বীণাদি বলেছেন,তার স্মার্টফোনটিতে ৮ মেগাপিক্সেল ক্যামেরার সুবিধাও রয়েছে। এই ফোনটির অপারেটিং সিস্টেমেও বীণাদি’ দারুণ দক্ষ। রয়েছে ওতে অনেক গিগাবাইট অনলাইন স্টোরেজ ব্যবহারের সুযোগও। কিন্তু এ স্মার্টফোনটিতে হাত দেওয়ার অধিকার যেন বীণাদি’র ছোটবোন প্রিয়াঙ্কারও নেই। স্বামীকে কাছে না পাওয়ার দুঃখ বীণাদি’র যেন এ স্মার্টফোনটি অনেকটাই দূর করে। স্মার্টফোনের পর যে বস্তুটি খুব প্রিয় বীণাদি’র, সেটা হলো বিভিন্ন রকমের বডি স্প্রে। একটি বডি স্প্রে- র খুব প্রশংসা করেছিলো উপেন্দ্র। দিদি তাকে এটা গিফটই করে দিয়েছেন। উপেন্দ্র’র বন্ধ শিবাশিস ও গৌতমও সেই বডি স্প্রে- র প্রশংসা করেছে। আর তাতেই আবেগে গদগদ হয়ে উপেন্দ্র বলা শুরু করলো, জানিস শিবাশিস, বীণাদি’র চেহারাটি না বলিউডের রাণী মুখার্জির মতো। উপেন্দ্র’র মুখে তার দিদির এমন প্রশংসা শুনে শিবাশিস বললো, খবরটা কিন্তু দিদির কাছে বলে দেবো আমরা। উপেন্দ্র বলে, বললেই কী! যা সত্য, তা- ই বলেছি। সীমা স্টুডিও- র তোলা দিদির একটা বাঁধানো ছবিও রয়েছে তার বাসায়। যেন অবিকল রাণী মুখার্জি। আর কন্ঠ? মৌসুমি ভৌমিক কিংবা লোপামুদ্রা মিত্রের চেয়ে কম নয়। কিন্তু তিনি তো ঢাকা কিংবা কলকাতাতেও থাকেন না এবং রেকর্ড করান না তার নিজের গাওয়া কোনো গান ও। আগে স্টেজ প্রোগ্রাম করতেন। আজকাল তাও ছেড়েছেন। প্রচারবিমুখ এবং মোহমুত্ত। ভারতীয় শিল্পী অনুপ ঘোষাল নাকি দিদিদের দূর সম্পর্কের কেমন আত্মীয়ও হয়। নজরুল সংগীত- ও দারুণ। কিন্তু বাবা তো আমাকে শুধু রবীন্দ্র সংগীত শেখাতেই দিদিকে বলে দিয়েছেন। দিদি যে বাসায় থাকেন, সেই বাসার তিনতলায় এক বিউটিশিয়ান থাকেন। দিদির চেহারা যে রাণী মুখার্জির মতো, সেদিন ওই বিউটিশিয়ানও স্বীকার করেছেন। সহসা গৌতম উপেন্দ্রকে বললো, আমি শুনেছি বীণাদি’ সুন্দরবন থেকে খাঁটি মধু এনে খান। তাই তাঁর কন্ঠ থেকে এমন মধুর সুর বের হয়। উপেন্দ্র বলে, ওসব বাজে কথা। আসল হলো রেওয়াজ। সাধনা। একদিন তিনি আমাকে নিয়ে কফি শপে গিয়েছিলেন। তখনই বললেন। সেদিন অবশ্য কফি শপে গিয়েছিলেন দিদির ছোটবোন প্রিয়াঙ্কার অনুরোধে। তখন আমাকেও নিয়ে যান। একদিন নিজ বাসায় রাগ করে উপেন্দ্র বীণাদি’র ওখানে গান শিখতে চলে গেল প্রায় দুই ঘন্টা আগেই। তখনও তাঁর কোনো ছাত্রছাত্রী আসেনি। বীণাদি এর কারণ জানতে চাইলেন। উপেন্দ্র বললো, বাসায় রাগ করে আগেই বের হয়ে গেছি দিদি। ভাবলাম পথে সময় নষ্ট না করে বরং আপনার কাছেই চলে আসি। দিদি বললেন, ভালো করেছো। তোমাকে আজ আগে থেকেই শেখাবো আমি। ঠিক সেদিনই গান শেখানোর সময় বীণাদি’ উপেন্দ্রকে বললেন, শুধু শিল্পী হয়ো না উপেন। একনিষ্ঠ রবীন্দ্র সংগীত সাধক হও। মানুষের কন্ঠ ছুঁয়ে লাভ নেই। প্রাণ মন অন্তর ছুঁতে হবে। সংগীত হলো অন্তর ছোঁয়ার মাধ্যম। তুমি সেহেতু স্কুলের লেখাপড়ার চেয়ে সংগীতে অধিক মনোযোগী, তাই তোমাকে এখন থেকে মাঝে মাঝে এককভাবেও রেওয়াজ করাবো আমি। সবার সঙ্গে শেখার স্তর তুমি এখন পারও করেছো। আর এখন থেকে তুমি হারমোনিয়ামে নয়, আমার সঙ্গে তানপুরায় কন্ঠ সাধন করবে। বীণাদি’র এমন বক্তব্যে মুগ্ধ হয় উপেন্দ্র। ভক্তি ভরে পা ছুঁয়ে দিদিকে প্রণাম করে। দিদি বলেন, আমি সবাইকে শেখাই উপেন্দ্র। কিন্তু সবাইকে দেই না। তোমাকে দেবো। তোমার একাগ্রতা আমার মন ছুঁয়েছে। ধ্রুবের মেধা ছিলো। তাকেও দিতে পারতাম। কিন্তু সে অহংকারী ছিলো বিধায় দেইনি। তোমাকে আমার সবটা দিয়ে যাবো। কারণ তুমি যোগ্য এবং বাধ্যগত। তোমার সাধনা এবং ভক্তি, দুটোই আমার কাছে দেখার মতো এক ঘটনা। আমি তোমাকে অবশ্যই এর নিশ্চিত প্রতিদান দেবো। মৃত্যুর গন্ধে আর অন্ধকারে আমি যখন উন্মাদ হয়ে আছি, তখন তুমি আমাকে শান্তিতে বাঁচিয়ে সুশীতল ছায়া এনে দাও। উপেন্দ্র শুধু একবার বলে, দিদি সেটা কিভাবে? দিদি বলেন, চতুর্দিকে শুধুই আমার দুর্নাম ছড়ায় সবাই। আমি পাগল হয়ে স্প্রে করতে থাকি। তারপরও ওদের মুখের দুর্গন্ধ মৃত্যুগন্ধে রূপান্তরিত হয়ে আমার জীবনে লাগে। কিন্তু তুমি শুধু তুমিই আমার প্রশংসা করে বেড়াও। সর্বত্রই। সব সময়। আমার মুখে উজ্জ্বল আলো ফেলতে গিয়েই স্কুলের বিদ্যা ভেস্তে গেছে তোমার। আমি মুগ্ধ। তোমার মতো শিষ্য না পেলে আমি আত্ম ধ্বংসী হতাম। এ কথা শুনে উপেন্দ্র ঠিক দিদির পায়ে মাথা ঠেকিয়ে আবেগের আনন্দে ভীষণ কাঁদতে থাকে। তারপর বীণাদি তাঁকে বুকে তুলে নেন। কিন্তু ঠিক কবে থেকে বীণাদি’ উপেন্দ্র’র হাতে তানপুরা তুলে দেবেন, তা বলেননি এখনো। উপেন্দ্র তানপুরায় সাধন করতে যেন উন্মাদ হয়ে রয়েছে। কিন্তু দিদি মুখ খুলে কিছুই বলেন না। উপেন্দ্র’রও সাহস হয় না কথাটি জিজ্ঞেস করার। তবু একদিন সাহস করেই উপেন্দ্র বীণাদি’কে বলে, দিদি কবে আমাকে তানপুরা হাতে দেবেন? দিদি বলেন, বাছা আরেকটু অপেক্ষা করো। ফুল ফোটানোর জন্য যে বসন্তকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। উপেন্দ্র বিনম্র শিরে দিদিকে প্রণাম করে। এরই মধ্যে একদিন বিকেলে যথারীতি বীণাদি’র বাসায় গেল উপেন্দ্র। একটি বাড়ির চারতলায় ভাড়া থাকেন দিদি। সেদিন কেন যে অন্য ছাত্রছাত্রীরা এলো না। উপেন্দ্র বললো, দিদি মিল্টন আর অমর্ত্যরা এখনো আসেনি! বীণাদি’ বললেন, ওদের আজ ছুটি। আমার শরীরটা ভীষণ খারাপ আজ। প্রিয়াঙ্কাও বাড়িতে চলে গেছে। আজ আমার ভালো লাগছে না কিছুই। উপেন্দ্র বললো, দিদি আমিও তাহলে চলে যাই? বীণাদি’ বললেন, এসেছো যখন কিছুক্ষণ থেকে যাও। উপেন্দ্র বললো, দিদি কিছুক্ষণ রেওয়াজ করি? দিদি বললেন, না। আমার মাথাব্যথা। বিছানায় কিছুক্ষণ শুয়ে থাকবো। মাথাব্যথায় বাদ্যবাজনার আর ভালো লাগছে না। এবার উপেন্দ্র সাহস নিয়ে বীণাদি’কে বলে, দিদি অবনীদা’ আর কেন আসেন না? উপেন্দ্র’র এ প্রশ্নে দিদি অনেকটা থমকে যান। বলেন, এতো কিছু বুঝো তুমি? আমি তো তোমাকে কচি খোকা ভেবেছিলাম। শুনো উপেন্দ্র, আমি হলাম নদী। তাই পেছনে ফিরতে জানি না। তুমি কি আমার মাথাটা টিপে দিতে পারবে! খুব ব্যথা হচ্ছে আজ। উপেন্দ্র মায়ের বাধ্য ছেলের মতোই বীণাদি’র মাথা টিপতে শুরু করে। বীণাদি’র অন্য পাশে শিশু ললিতা নিবিড়ভাবে ঘুমোচ্ছে তখন। সহসা বীণাদি’ উপেন্দ্রকে প্রশ্ন করেন, তুমি কি আমার ছাত্রী নিশাত তাবাস্সুমকে ভালোবাসো উপেন্দ্র? ‘না দিদি।’ এক মুহূর্তেই উত্তর দেয় উপেন্দ্র। দিদি বলেন, তুমি আমার ছাত্রী আনিকাকে এ কথা বলেছো। তাবাস্সুমকে দেয়নি এ চিঠি। এই মোবাইলের যুগে তোমার প্রেমপত্র লেখার কারণটা কী! আমি ভেবেছি তোমার বাবাকে খবর দিয়ে এনে সব খুলে বলবো। তুমি কি এখানে সংগীতের প্রেমে আসো? নাকি তাবাস্সুমকে ভালোবাসতে? মুসলিম মেয়ের প্রতি তোমার এ দুর্বলতা তোমার বাবা জানলে কী হবে ভেবেছো? উপেন্দ্র বীণাদি’র মাথা টেপা বন্ধ করে তাঁর দুই পা জড়িয়ে ধরে কেঁদে দেয়। বলে, দিদি আমাকে ক্ষমা করুন। আমি আর কোনোদিনও এমন ভুল করবো না। দিদি বললেন, পা যেহেতু ধরেই ফেলছো, তাহলে পা- ই টিপে দাও। কারণ আমার মাথার চেয়ে আজ পা ব্যথাই বেশি। ভয়ে ঘর্মাক্ত উপেন্দ্র খুব জোরে জোরে তাঁর দিদির পা টিপতে থাকে। দিদি বলেন, এতো জোরে পা টিপলে আমি পঙ্গু হয়ে যাবো যে। ধীরে ধীরে উপেন্দ্র। আরও ধীরে। উপেন্দ্র এবার তাঁর দিদির পা ধীরে ধীরেই টিপতে থাকে। দিদি বলেন, তোমার অবনীদা’ কী চাকুরি করে তুমি জানো উপেন? উপেন্দ্র বলে, ইঞ্জিনিয়ার। দিদি বলেন, হ্যাঁ ইঞ্জিনিয়ার। কারেন্টের ইঞ্জিনিয়ার। বিদ্যুৎ বিভাগের প্রকৌশলী। অথচ আমার শরীরের ইঞ্জিন কারেন্টে পুড়ে যায়। আমার হেডার ইঞ্জিনিয়ার আগুন নেভাতে পারে না। দিদির মুখে জীবনে এই প্রথম এমন অশ্লীল বাক্য শুনে উপেন্দ্র তাঁর দিদির পা টেপাই বন্ধ করে দেয়। দিদি বলেন, আমার ভয় লাগে, না জানি আমার কন্যা ললিতাও অটিজমের শিকার হয়। ভগবান এমন না করুন। তবে মেয়েটার হাবভাব এখনো কিছুই বুঝি না আমি। বরেণ নামে এক প্রফেসরকে ভালোবাসতাম আমি। আমার আত্মীয়স্বজন বিয়ে দিলো এক প্রকৌশলী খুঁজে এনে। অবশ্য বরেণের সিদ্ধান্তহীনতার রোগও ছিলো। উপেন্দ্র বললো, দিদি আজ আমি আসি? দিদি বললেন, বসো। তোমাকে আজ আমি নিজে চা করে খাওয়াচ্ছি। তুমি আমার স্মার্টফোনের হেডফোনে গান শুনো। উপেন্দ্রের কানে হেডফোন লাগিয়ে দেন দিদি। উপেন্দ্রের বয়স ২২ এর বেশি হবে না। সে তাঁর বীণাদি’র স্মার্টফোনের হেডফোন কানে লাগিয়ে যা শুনে এবং ফোনের স্ক্রিনে যা দেখে, এতদিন এ বিদ্যার একটুও ভাগ দেননি বীণাদি। আদিম রসে ভরপুর নর-নারীর মিলনের ভয়াবহ দৃশ্য। উপেন্দ্র কান থেকে তার হেডফোন খুলে রাখে। দিদি বলেন, যখন বিয়ে করবে উপেন, তখন তোমার স্ত্রী বিশ্বাসই করবে না যে আগে কোনো নারীর সাথে তোমার শরীরের সম্পর্ক হয়নি। যেমন তোমার অবনীদা’ও মনে করে আমি বিয়ের আগেই একাধিক পুরুষের সঙ্গে বিছানায় শুয়েছি। উপেন্দ্র বলে, দিদি আমি আজ যাই? বীণাদি’ উপেন্দ্রকে জড়িয়ে ধরেন। বলেন, উপেন্দ্র তুমি আমাকে মরতে দিয়ো না’। বাঁচাও। প্লিজ। উপেন্দ্র কাঁপতে কাঁপতে বলে, দিদি সন্ধ্যা হয়েছে। আমি যাই। এরই মধ্যে আকস্মিকভাবে বিদ্যুৎ ও চলে যায়। সেই সুযোগে উপেন্দ্রকে রীতিমত ধাক্কা মেরে সোফায় ফেলে দিয়ে তার বুকে চেপে বসেন বীণাদি’। আর সেই মানবীর থাবায় পড়ে উপেন্দ্র বুঝতে পারে না সে ঠিক ময়নামতি পাহাড়ের নিচেই চাপা পড়েছে কী না। পরদিন আর স্কুলেই যায়নি উপেন্দ্র। তাঁর সারাদিনই মনে হয়েছে তাবাস্সুম কি সত্যি ভালো মেয়ে? প্রবল চিন্তার স্রোতের তোড়ে স্বপ্ন যেন ডুবে আর ভাসে। বীণাদি’র বাসায় আবার সবাই এলো। কিন্তু উপেন্দ্র আর আগের মতো তাবাস্সুমের চোখে চোখ রাখতেই পারছে না। অন্যদিকে অবিরাম কাশের উৎপাতে গান শেখাতেই পারছেন না বীণাদি’। লিভোক্সিন ৫০০ এম জি খেয়েও কাশ থামাতে পারছেন না। এর মধ্যে নতুন করে শুরু হয়েছে তাঁর গাঁটের ব্যথা। কিছুক্ষণ গান শেখানো বন্ধ করে শুয়ে পড়লেন বিছানায়। তাবাস্সুমকে বললেন, দিদি আমার শরীরে তুমি মলম মালিশ করতে পারবে? তাবাস্সুম এক বাক্যেই রাজি হলো। উপেন্দ্র এবার কারোর দিকেই তাকাতে পারে না। না তাবাস্সুম এবং না তাঁর বীণাদি’। এরই মধ্যে দুর্গাপূজার লগ্ন এলো। তারই একদিন উপেন্দ্র’র সঙ্গে তাঁর বন্ধু জিতেন্দ্র’র দেখা হয় পথে। জিতেন্দ্র চন্দ্র মজুমদার। পূজা, ছুটি লেখাপড়াসহ উপেন্দ্র’র সংগীত শেখার বিষয় নিয়েও আলাপ হয় দুইজনের মধ্যে। সহসা জিতেন্দ্র উপেন্দ্রকে বলে, আমি শুনেছি বীণাদি’র চরিত্র খুব একটা ভালো না। তুই রূপালি মেম এর কাছে শিখ। ওখানে আমার দিদিও শেখেন। ...। এ কথা শেষ করতে পারেনি জিতেন্দ্র। উপেন্দ্র জিতেন্দ্রের গালে কষে এক থাপ্পড় দেয়। বলে, দিদির চরিত্র নিয়ে আর কোনোদিনও কথা বলবি না জিতেন। তিনি আমার মায়ের মতো। শুদ্ধ-পবিত্র নারী। এরই মধ্যে কালীতলার মন্দিরে হৈ চৈ পড়ে। দুর্গোৎসবে কেন্দ্র করে কোনো একজন রাজনৈতিক নেতা আগাম নির্বাচনি প্রচারে আসছেন। তিনি আবার নাকি পূজামন্ডপ পরিদর্শন শেষে ভালো অর্থের অনুদানও প্রদান করবেন। কিন্তু সোরগোলে কান গেল না উপেন্দ্র’র। সে হনহন করে এগিয়ে যেতে লাগলো তাঁর বীণাদি’র বাসার দিকে। দিদির বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে ইচ্ছেমত কেঁদে জিতেন্দ্র’র ধৃষ্টতা বর্ণনা করবে। এমনই তাঁর মনের অবস্থা এখন। চোখের জল সে কষ্টে ধরে রেখেছে। দিদির বাসার কলিংবেল টিপলো উপেন্দ্র। কিন্তু কেউ সাড়া দিলো না। আগেই পূজার কারণে ছাত্রছাত্রীদের ছুটি দিয়েছেন দিদি। তবে কি দিদি কোথাও বেড়াতে গেলেন! ঠিক এমনই সময় দরজা খুললেন বীণাদি’। প্রশ্ন করলেন, এখন তো ছুটি। কেন এসেছো উপেন? উপেন্দ্র বললো, দিদি আপনার সঙ্গে আমার জরুরী কথা আছে। দিদি বললেন, পরে বলো উপেন। তোমার অবনীদা’ এসেছেন। এতদিনে তার অভিমান শেষ হয়েছে। এতদিনে তাঁর অভিমান শেষ হয়েছে। দুজনে মিলে টিভিতে আবারও ‘পারমিতার একদিন’ দেখছি। তোমার দাদার খুব ভালো লাগছে ছবিটা। পরে এসো একদিন লক্ষীভাই আমার। অবনীবাবুর কথা শুনে কেন যে হঠাৎই উপেন্দ্র তাঁর বুকের ভিতর তীব্র একটি ব্যথা অনুভব করে। এমনকি মনের গভীরে অনুভব করে মনোকম্পও। সে ঠিক জানে না এ শক্তিশালী মনোকম্পের মাত্রা আসলে কতো। সহসা শব্দ বা বাক হারানোর রোগে আক্রান্ত উপেন্দ্র ধীরে ধীরে তাঁর বাসার দিকে হাঁটতে থাকে। বুকের সেই তীব্র ব্যথা বারবার অনুভব করে। কিন্তু তাঁর হাতে না আছে কোনো মলম, না আছে কেউ মালিশ করার জন্য। তাছাড়া বুকের ভিতর কী মলম লাগাবে সে? সহসা উপেন্দ্র’র মনে হয় অবনীগুপ্ত কি সত্যিই বাড়ি ফিরেছেন?
অলংকরণ: জসীম উদ্দিন অসীম।

২০| ১০ ই মে, ২০১৮ রাত ২:২৩

জসীম অসীম বলেছেন: আমার ছবি নেশা
জসীম উদ্দিন অসীম:

ছোটবেলায় সবাই কম বেশি ছবি আঁকে। হয়তো তেমনি আমিও এঁকেছিলাম। কিন্তু এক সময় আমার চিত্রকর হওয়ারও নেশা তৈরি হয়েছিল। কিন্তু দীর্ঘ বছর পর সারা পৃথিবীর সেরা চিত্রকরদের সেরা ছবিগুলো দেখে যখন বুঝতে পারলাম ছবি আঁকার প্রতিভা, ধ্যান, দক্ষতা...এর কিছুই আমার নেই, ঠিক তখন থেকেই আমি সেই পথ ছেড়ে দিলাম। হোর্হে লুই বোর্হেসের মতো শক্তিধর কবিদের কবিতা পড়ে ভাবলাম আমার কবিতা লেখাও ঠিক নয়। তা হলে আমি কী করবো! জে.কে রাউলিং এর হ্যারি পটার পড়ে ও এ কাহিনী অবলম্বনে নির্মিত ছবি দেখে আমার মনে হলো আসলে আমার সারা জীবনভর পড়া আর দেখাই উচিত। লেখালেখি, আঁকাআঁকি আর হবে না আমার দ্বারা। এক যুগ আমি ফটোগ্রাফির সঙ্গেও জড়িত ছিলাম বিভিন্ন ও বিচ্ছিন্নভাবে। কিন্তু যেই প্রেস ফটোগ্রাফি আমার পেশায় পরিণত হচ্ছিল, ঠিক সেই মুহূর্তে আমি একেবারেই ছেড়ে দিলাম সেই ফটোগ্রাফি। ফটোগ্রাফির বিনিময়ে আমার হাতে মাত্র তখন কাঁচা টাকা আসা শুরু হয়েছিল। আমি ছবি তোলাটা ধরে রাখলে এই কুমিল্লা শহরেও লাখ লাখ টাকা কামাই করতে পারতাম। অথচ খাওয়ার কষ্ট ভোগ করেও আমি আর সে পথে ফিরে যেতে পারলাম না। ঠিক তেমনিভাবে আমি একদা ঢাকায় নিয়মিত থাকাটাও ছেড়ে দিলাম, ঢাকায় যে ফারজানা ইসলাম রূপালি আমার তীব্র প্রেমে পড়েছিল, তার সঙ্গে সারাজীবনের জন্য যোগাযোগ ছেড়ে দিলাম, নাট্যচর্চা ছেড়ে দিলাম, প্রথম প্রেমের সংসার ছেড়ে দিলাম...এমনি আরও অনেক কিছুই। আমার প্রথম স্ত্রী ফারজানা কবির ঈশিতাকে বলে একদিন যে আমি নিজের বাসা থেকে বের হয়ে গেলাম, আর ফিরে গেলাম না। ঈশিতাকে বলেছিলাম, আর ফিরে আসবো না। সে মনে করেছিলো, আমি তার সাথে মজা করছি। কিন্তু এ যে আমার ঠান্ডা মাথার চিন্তা ছিলো, সে ভাবতেও পারেনি। বারবার এসেও সে আর আমাকে ফেরৎ নিতে পারেনি। ঠিক তেমনিভাবে আরও অনেক কিছুই আমি ছেড়ে দিয়েছি। যেমন ডান কিংবা বাম রাজনীতি চর্চা এবং...এবং...এবং ছেড়ে দিয়েছি এই ছবি আঁকার চর্চাও। এক সময়ে আমি এই কুমিল্লা শহরে গান শেখানো এবং ছবি আঁকার বিষয়েও টিউশনি করিয়েছি। আমার প্রথম স্ত্রী ফারজানা কবির ঈশিতার ছোটবোন পিয়েলকেও আজ থেকে প্রায় ১৮-২০ বছর আগে ছবি আঁকা শিখিয়ে মাসের পর মাস টাকা নিতাম। আমি ছিলাম পিয়েলের ছবি আঁকার শিক্ষক। পরে দেখলাম এটাও আমার পথ নয়। ছেড়ে দিলাম ওই পথ। এখন আমার ৭ বছরের ছেলে কফিল মোহাম্মদ অপূর্ব অনেক ছবিই আঁকে। এ পর্যন্ত সে প্রায় হাজারখানেক ছবি এঁকেছে। তাকে আমি আঁকা শেখাই না। বলি, পারি না কিংবা ভুলে গিয়েছি এবং আসলেই ভুলে গিয়েছি। তার আঁকার শিক্ষক তার মা সাদিয়া অসীম পলি। তবু অপূর্ব আমার এবং আমার ছোটভাই পিয়াসের অনেক ছবির প্রশংসা করে। আমার আঁকা কিছু ছবি এখনো আমার সংগ্রহে রয়েছে। ভালো হওয়া ছবিগুলো একসময় বিক্রি করে দিয়েছি। বেঁচে থাকার প্রয়োজনে। এমনকি আমার ক্যামেরায় তোলা ছবিগুলোও। একবার আমার কাছে কোনো টাকাই ছিলো না। কয়েকদিন ধরে খাওয়ার কষ্টও পেলাম। পত্রিকার চাকুরি ছেড়ে বেকার। পথে পথে ঘুরি। জীবনের কোনো হিসাবই কারো সঙ্গে আর মেলাতে পারছি না। দুই-তিনটি বাইন্ডিং করা ছবি নিয়ে গেলাম কুমিল্লার সাপ্তাহিক ‘মুক্তকাগজ’ সম্পাদক নিজাম মোল্লা ভাইয়ের কাছে। তিনি আমাকে ছবিগুলো না নিয়েই তাৎক্ষনিকভাবে ১০০০/-(এক হাজার) টাকা দিলেন। তবু আমি তাকে জোরপূর্বক ছবিগুলো দিয়ে টাকা নিয়ে এসে প্রাণ বাঁচাই। সেটা আজ থেকে প্রায় ১৪ বছর আগের কথা। এমনভাবে অনেক আঁকা ছবিও আর আমার সংগ্রহে নেই। বিক্রি করেছি যেসব ছবি, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: সেপারেশান-১৯৯২, এস ডিয়ার এস লাইফ-১৯৯৩, .....। অনেকে ছবি তোলাকে ইসলাম ধর্ম বিরোধী কর্ম বলেন। আমার কাছে তা মনে হয় না। কোরআনে ছবি আঁকা নিষিদ্ধ নয়। এ কথা জোর দিয়ে একবার প্রমাণও করেছেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর ছেলে মূর্তজা বশীর। বিবি আয়েশার একটি ছবি দেখিয়ে ফেরেশতা জিব্রাইল আমাদের নবী হযরত মুহম্মদ (সাঃ) কে বলেছেন, এর সঙ্গেই তোমার বিয়ে হবে। তবে চিত্রকলায় নীতির বিষয়ে ইসলামধর্মে বিধান রয়েছে। কিন্তু শুধু নীতিপ্রচারই ছবির একমাত্র লক্ষ্য নয়। নীতিপ্রচারের জন্য যদি কেউ কবিতা লিখেন, তা হলে তা হবে শুধুমাত্র ছন্দবদ্ধ নীতিবচনই। আমি বেশি এঁকেছি পাখির ছবি। পাখিরা মানুষের অতিথি নয়, বন্ধু। পানকৌড়ি পাখির পেছনে গোটা শৈশব কেটেছে আমার। পানকৌড়ি ডিম দেয় দফায় দফায়। বাচ্চা ফুটাতে না ফুটাতেই আবার ডিম দেয়। এ নিয়ে আমার লেখা গল্প রয়েছে। কিন্তু আমি স্বভাবে ভীষণ অস্থির। এক অজানা লক্ষ্যে আমি প্রতিনিয়তই ছুটে চলি। যেন কবির ভাষায়: ‘সব ঠাঁই মোর ঘর আছে, আমি সেই ঘর মরি খুঁজিয়া। দেশে দেশে মোর দেশ আছে, আমি সেই দেশ লব যুঝিয়া।’ আমার রঙ কেনার পয়সাও থাকতো না বলে অনেক রঙই আমি নিজে তৈরি করতাম। আজ অনেক বছর পর এসব ছবির রঙও নষ্ট হয়েছে। প্রায় ২৫ বছর আগের আঁকা কিছু ছবি সেদিন আমি আমার ছেলেকে দেখাতে গেলে তার হাতেও ছবি থেকে অনেক রঙ লেগে যায়। সে তখন এর কারণ জিজ্ঞেস করলে আমি বলি, এ রঙ ছিলো আমার নিজেরই হাতে তৈরি। ছেলে প্রশ্ন করে, বাবা তুমি রঙও বানাতে পারতে! আমি বললাম, আমি তো মনে করেছিলাম, আমি চিত্রশিল্পী হতে পারবো। পরে দেখলাম, ছবি আঁকা হয় না আমার। আর রঙ তো অনেক শিল্পীই নিজেই তৈরি করতেন। একদা বাংলাদেশের বিখ্যাত চিত্রশিল্পী এস.এম.সুলতান (১৯২৪-১৯৯৪) তাঁর ছেলেবেলায়ও এমন নিজে রঙ তৈরি করেছিলেন। তার পিতা ছিলেন একজন রাজমিস্ত্রী। এক নিম্নবিত্ত পরিবারে তিনি জন্মেছিলেন। তিনি তাঁর ছেলেবেলায় কাঠ-কয়লা-কাঁচা হলুদ-পুঁই শাক ফলের রস দিয়েই ছবি আঁকতেন। তখন এস.এম সুলতানের নাম ছিলো লাল মিয়া। পরে নাম নেন শেখ মুহম্মদ সুলতান। সংক্ষেপে এস.এম সুলতান। সুলতানের ছবিতে বাংলার কৃষক-কৃষানী এসেছে বীর হয়ে। তাদের তিনি এঁকেছেন পেশীবহুল শক্তিশালী নরনারীরূপে। কৃষক সমাজকে বলবান হিসেবে অঙ্কন করে চিত্রকলায় এক নতুনমাত্রা সংযোজন করেছেন তিনি। ছিলেন চিরকুমার। একজন চিত্রশিল্পী কিভাবে সারাজীবন বিয়ে না করে থাকতে পারেন, সেটা আমার মাথায়ই আসে না। এটাও কি সম্ভব! অথচ তিনি এটা তার জীবনে করে দেখিয়েছেন।
গুহার ভিতরে একেবারে শেষপ্রান্তে যেসব আদিম মানুষ নানা জস্তুর ছবি ছবি এঁকেছে, তাদের জীবনও নিয়মিত যৌনতামুক্ত ছিলো না। কিন্তু আমি যখন ফটোগ্রাফিও করেছি, তখনও চিত্রকলাকে মাথায় রেখেই অনেক কাজ করেছি। কিন্তু এই কুমিল্লা শহরে আমার বরাবরই মূল্যায়ন হয়েছে অভাবগ্রস্থ, কিংবা কিছুটা ঋণগ্রস্থ, বেকার, অস্থির, বাড়িঘরহীন এক যুবক হিসেবেই। আমার কিছুসংখ্যক অতি আপন বন্ধুই বরাবর আমার পাশে ছিলেন। হয়তো তাদের জন্যই কখনো এ শহর ছাড়া হয়নি আমার। আমার প্রতিদিনকার দিনলিপিতে তারা উজ্জ্বল হয়ে আছেন। একদিন তারা আমার গ্রন্থে বিভিন্ন অধ্যায় হয়ে আসবেন। আমি যখন ফটোগ্রাফি করেছি, তখন রিকশার পেছনের চিত্রকলারও অনেক ছবি তুলে রেখেছিলাম। ১৯৯৩ সালে বাংলাদেশের সাহিত্য পত্রিকা ‘মাটি’ এবং ১৯৯৫ সালে বাংলাদেশেরই সাহিত্য পত্রিকা ‘শৈলী’সহ অনেক সাহিত্য পত্রিকাতেই রিকশা-পেইন্টিং নিয়ে কখনো কখনো প্রতিবেদন ছাপা হতো। কিন্তু ২০ বছর ধরে সাংবাদিকতার সাথে জড়িত থাকার পরও, এমনকি একটি পত্রিকার মালিকানা থাকার পরও আজ অবধি আমি একটি কম্পিউটার কিনতে পারিনি। অর্থ উপার্জন এবং জমা করার ক্ষেত্রে আমি কতোটা ব্যর্থ সহজেই মানুষ অনুমান করতে পারবে। দুইটি পত্রিকার কাছ থেকে দুইটি কম্পিউটারও এনেছিলাম বাসায়। কিন্তু তাদের মর্জিমাফিক রিপোর্ট দিতে পারিনি বলে ফেরতও দিয়েছি। আর একবার আমার এক বন্ধু আমাকে একটি ল্যাপটপ গিফট করেছিলেন। সেটি কিছুসংখ্যক দুর্বৃত্ত আমার কাছ থেকে জোর করে নিয়ে গেছে। সেটা ফেরৎ চেয়ে বরং আমার আরও ক্ষতি হয়েছে। অথচ এসব ক্ষেত্রে আমি আমার ‘সাংবাদিক পরিচয়’ কোনোক্ষেত্রেই কাজে লাগাতে পারিনি। এই শহরে আমি যেন সাংবাদিক হিসেবে সফল না হই, তার জন্য যেমন আমার বড় ব্যর্থতা ছিলো, অন্যদিকে সে জন্য অনেক ষড়যন্ত্রেরও শিকার হয়েছি বিভিন্ন সময়ে। সময়ে সেসব ফাঁস হবে কোনোদিন। আমার অনেক আঁকা এবং তোলা ছবিও অনেকভাবে হারিয়েছি। অথচ আমাদের দেশের, কলকাতার, ঢাকার শত বছর আগের ছবিও এখনও খুঁজে পাওয়া যায় কলকাতা ও লন্ডনের লাইব্রেরী, আর্কাইভ বা মিউজিয়ামে। জলরঙে ঢাকায় একটি ছবি এঁকেছিলাম ১৯৯২ সালে। নাম দিয়েছিলাম ‘লাভ ফর গ্যাম্বলিং’। পরে মূল ছবিটি হারিয়ে সেই ছবিটিই আবার এঁকেছিলাম মার্কার পেন দিয়ে। এই ছবিটি এখনো রয়েছে। আমার আঁকা ছবি দিয়ে গ্রন্থ প্রকাশ করার বিজ্ঞাপন দিয়েছিলাম ২০০৪ সালে একবার। একজন তা প্রকাশ করে দেবেন বলাতেই বিজ্ঞাপন ছেপে দিলাম। পরে হাস্যকর পরিস্থিতিতে পড়লাম। গ্রন্থ আর প্রকাশ করতে পারলাম না। তেলরঙে আঁকিনি কোনোদিনও। রঙ-তুলি ও কালি-কলমেও এঁকেছিলাম কিছুদিনও। মার্কার পেন দিয়ে আমি কাউকে আঁকতে দেখিনি। আমি যেসব মার্কার পেন দিয়ে ছবি এঁকেছি, সেসবের দাগ একবার পড়লেই আর মোছা যায় না। সুতরাং ওসব মার্কার দিয়ে আঁকা সহজ নয়। প্রথম দিকে নন্দলাল বসুর ছবি থেকে চুরি করতাম। শুধু প্রভাব নয়, রীতিমত ছবির নকল করতাম আমি। আমার এক আঁকা ছবি দেখে তো কুমিল্লার কবি ইসহাক সিদ্দিকী বলেই বসলেন, ‘ওটা কি নন্দলাল বসুর ছবি!’ শুনেছি শিল্পী জয়নুল আবেদিন আঁকার সময় হাত ভাজ করতে দিতেন না। আঁকার সময় হাত একেবারে সোজা রাখার পরামর্শ দিতেন। মার্কার পেন দিয়ে ছবি আঁকতে গিয়ে আমি তার গুরুত্ব অনুভব করেছি। ২৯ ডিসেম্বর ১৯১৪ সালে শিল্পী জয়নুলের জন্ম। তার বাবা দারোগা ছিলেন। জয়নুলরা ছিলেন মোট নয় ভাই-বোন। তাদের পূর্ব পুরুষরা ছিলেন পাবনার। পরে তাদের বাড়ি হয় ময়মনসিংহের দরিরামপুরে। ওখানেই আমাদের জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম তার শৈশবে পড়েছেন কিছুদিন। যদিও লেখাপড়ায় তার মন ছিলো না কোনোদিনও। অনেক চিত্রশিল্পীরও এমন শৈশবে পড়ায় মন ছিলো না। কেউ আবার শহর ছেড়ে চলে গিয়েছেন গ্রামে। রুশ সাহিত্যিক লিও টলষ্টয় মস্কো ছেড়ে নিজ জন্মভূমি ইয়াসনাইয়া পলিয়ানায় ফিরেছিলেন। প্যারিসের চাকচিক্য ফেলে পল গঁগা চলে গিয়েছিলেন তাহিতি দ্বীপে। চিত্রশিল্পী এডল্ফ হিটলারের অনেক ভালো চিত্রকর্ম দেখেছি। ১৯০৯ থেকে ১৯৪৫ সালের মধ্যে হিটলার প্রায় ৩ হাজার ৪ শত চিত্রকর্ম ও স্কেচ আঁকেন। কিন্তু আমি কখনোই বাচ্চাদের ছবি আঁকা শিখিয়ে টাকা কামাই করবো, এভাবে ভাবতে পারিনি কোনোদিনও। অথচ আমার অভাব ছিলো বরাবরই তীব্রতর। কারণ ওসব শিক্ষকগণ পড়েন না পল সেজান। পল সেজান তার আঁকা ছবি দিয়ে আমাদের বুঝিয়ে দেন চিত্রকর্ম বাস্তবের অনুকরণ নয়। তা স্বয়ং নিজেই একটি স্বাধীন বাস্তবতা। আমার যদি ছবি আঁকার প্রতিভা থাকতো, তা হলে হয়তো ছবি আঁকাটা ধরে রাখতামও আমি। কারণ কতো কতো অভাবের দিনেও আমি ‘ক্লোদ মনে’ এর মতো ছবি এঁকেছি আমি। একবার এক মেয়ের বাসায় বেড়াতে গেলাম। কয়েকদিন ধরে যত ছবি আঁকলাম, ফেলে এলাম। তারাও আর সেসব রক্ষা করেননি। ভালো লাগা ছবি হলে রেখে দিতেন নিশ্চয়ই। একবার চান্দিনার কবি মোহাম্মদ আলীর বাসায় আঁকলাম কিছু ছবি। আর আনিনি। তারও এসব সংরক্ষণের কারণ ছিলো না। গেলাম কুমিল্লার গল্পকার ও গবেষক মামুন সিদ্দিকীর ঢাকার বাসায় বেড়াতে। থাকলাম কয়েকদিন। আঁকলাম কিছু ছবি। মামুনের পছন্দ হয়নি। তাই রাখেনি। আমার ছোটভাই গিয়াস উদ্দিন পিয়াস শৈশবে অনেক ছবিই আঁকতো। এক ট্রাঙ্ক ছবি ছিলো তার। কিন্তু একদিন কী এক অভিমানে সে তার অসংখ্য ছবি ছিঁড়ে ফেললো। তারপরে সের দরে কাগজওয়ালার কাছে বিক্রি করে দিলো তার বাকি সব ছবি। এখনো পিয়াসের কোনো ছবি কোথাও পাওয়া গেলে আমি সংগ্রহ করে রাখি। পিয়াস কোনোদিনও আমাকে অর্থহীন এক উদভ্রান্ত যুবক হিসেবে মূল্যায়ন করেনি। কিন্তু পিয়াস আর ছবি আঁকে না এখন। আমাদের পরিবারে এই পিয়াস সবার চেয়ে ছোট। মা’কে সে বেশিদিন পায়নি। এখন আর কোনো ছবিই আঁকে না। আমার ছেলে কফিল মোহাম্মদ অপূর্ব তার তিন-সাড়ে তিন বছর থেকে এ পর্যন্ত যত ছবিই এঁকেছে। কিন্তু এ নিয়ে আমি এখন আর অতি উৎসাহী নই। কোন্দিন আবার আঁকা ছেড়ে দেয় কোনো কারণে, কে জানে! কার সন্তান কী হবে, কতোদূর যাবে, ভবিষ্যৎই বলবে। চিত্রশিল্পী পল গগাঁর বাবা ছিলেন সাংবাদিক। গগাঁ ১৮৮৩ সালে তার নিরাপদ ও লাভজনক একটি চাকুরি ছেড়ে চিত্রশিল্পীর পেশা বেছে নেন। পরে তিনি পানামা খালে একজন শ্রমিক হিসেবেও বেশ কিছুদিন কাজ করেন। পল গগ্যাঁ বলেছেন, সরাসরি প্রকৃতি থেকে খুব বেশি এঁকো না। শিল্প প্রকৃতির সরাসরি অনুসরণ নয়। শিল্প হচ্ছে বিমূর্ততা। পিয়ের অগুস্থ রেনোয়ার নারীদেহের লাবন্য যে কোনো মানুষকেই উন্মাদ করে দিতে পারে। পিয়ের অগুস্থ রেনোয়াকে আমি প্রথমে চিনেছি তার ছেলেকে দিয়েই। ১৯৯২ সালে ঢাকার পাবলিক লাইব্রেরিতে পড়ছিলাম চলচ্চিত্রকার জঁ-রেনোয়াকে নিয়ে। হঠাৎই জানতে পারি, তারই পিতা পিয়ের অগুস্থ রেনোয়া। পরে ১৯৯৫ সালের দিকে বাংলা একাডেমী থেকে কুমিল্লার গল্পকার মামুন সিদ্দিকীকে দিয়ে পিয়ের অগুস্থ রেনোয়া বিষয়ক কিছু বইপত্র কিনিয়ে এনেছিলাম। তখন আমার ঢাকায় যাওয়া কমে গিয়েছিলো। পিয়ের অগুস্থ রেনোয়ার বিষয়ে এতো চমৎকার লিখেছেন কবীর চৌধুরী, পড়লেই মুগ্ধ হতে হয়। অগুস্থ রেনোয়ার বাবা লিওনার্দো রেনোয়া ছিলেন একজন দর্জি। অগুস্থ রেনোয়া এমনই একজন চিত্রশিল্পী ছিলেন, যিনি তার মৃত্যুদিবসেও ছবি আঁকেন। মৃত্যুদিবসের ভোরবেলায়। এসব চিত্রশিল্পীদের এতো অভাব ছিলো, সমকালে অনেকেরই মূল্যায়ন ছিলো না। পল গগ্যাঁ তো অর্থকষ্টে ও ঋণের চিন্তায় আর্সেনিকের গুড়া খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। অনেক চেষ্টায় সে যাত্রায় তাকে বাঁচানো যায়। পিকাসোর কিউবিজম নিয়ে এক সময় আমাদের বন্ধুদের মধ্যে কতো আড্ডা হতো। আফ্রিকা থেকেই পিকাসো এই মতবাদ গ্রহণ করেছিলেন। পিকাসোর কিউবিজম-এর উৎস সেই আফ্রিকা। বিখ্যাত এ চিত্রশিল্পীর জন্ম ১৮৮১ সালের ২৫ অক্টোবরে, স্পেনে। তার কিছু ছবি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় চুরি হয় বা হারিয়ে যায়। আমার বিশ্বাস এগুলো একসময় উদ্ধারও হবে এবং প্রমাণও হবে যে ছবিগুলো পিকাসোর। চিত্রকর্মের ওপর অতিরঞ্জন রশ্মি প্রয়োগের মাধ্যমে বিশেষজ্ঞগণ ছবিটি কার, তা চিহ্নিত করতে পারেন। এভাবে এ পর্যন্ত অনেক শিল্পীরই ছবি সনাক্ত হয়েছে।
ব্যক্তিগতভাবে আমি কোনোদিনও মূর্ত ছবি আঁকিনি তেমন। যার কারণে আমার পারিপার্শ্বিক অনেকজন আমার ছবিকে কখনোই গুরুত্ব দেয়নি। অন্যদিকে আমার খাদ্য ও বাসস্থানের প্রয়োজনে আমি বরাবরই অস্থিরতার মধ্যে দিয়ে সময় কাটিয়েছি। এই অস্থিরতা জীবনের অগ্রযাত্রায় আরও বেশি মাত্রায় বেগবান হয়েছে। আমার বাসায় ১৯৯০ সাল থেকেই আমি ছবি এঁকে টানিয়ে রাখতাম। ১৯৯৬ সালের দিকে একটি ছবি আঁকলাম আমি। ২০ বাই ৩০ সাইজের একটি আর্ট পেপারে আঁকা ছবির নাম দিয়েছিলাম ‘মুক্তিযুদ্ধ’। ওয়ার-১৯৭১। কিন্তু চিত্রকলায় আমার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিলো না বলে এই আঁকা কারোর কাছেই গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। কুমিল্লার সাপ্তাহিক ‘সময়ের পথ’ সম্পাদক বাচ্চু বকাউল ২০০৪ সালে ‘পথ’ নামে একটি সাহিত্য সংকলন করেন। সেটির প্রচ্ছদ করেছিলেন আমার আঁকায়। ছবিটি ছিলো আমার মার্কার পেন-এ করা বরবাদ হয়ে যাওয়া একটি ছবি। কুমিল্লার চান্দিনার সাংবাদিক তাহমিদুর রহমান দিদার ‘দীপিকা’ নামে একটি সাহিত্য সংকলন বের করেন। ২০০৪ সালের দিকেই। আমার একটি আঁকা ছবি প্রচ্ছদ করেছিলেন। আরও অনেক সংকলনের প্রচ্ছদেও আমার ছবি ব্যবহৃত হয়েছিলো। এখন সব মনে নেই। ছোট ভাই পিয়াসও অনেক সংকলনের প্রচ্ছদ করেছিলো। সময়ের গহবরে সেসব হারিয়ে গিয়েছে। ছবি আঁকতে এসে ছবি আঁকা না হলেও পৃথিবীর অনেক বিখ্যাত ছবি ও তার চিত্রকরের সঙ্গে পরিচিত হতে পেরেছি। রুশ চিত্রশিল্পী ভ. প্রাগুয়ের-এর আঁকা কাজান বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ভ. ই. লেনিনের ছবিটার কথা এখনো মনে পড়ে। কতো চমৎকার ছবি ছিলো সেটা। প্রথম দেখেছিলাম ওই ছবিটা ‘উদয়ন’ পত্রিকায়। চিত্র চর্চা করতে এসে আমার কাছে একটি বিষয় পরিষ্কার হয় যে, কোনো শিল্পমাধ্যমই বাস্তবের হুবহু অনুকরণ কিংবা অনুসরন নয়। যখন আমাদের পাঠ্য ছিলো অ্যারিষ্টটল, তখনও দেখেছি যে, অ্যারিষ্টটল কাব্য বা ট্র্যাজেডিকে যে সংজ্ঞা দিয়েছেন, তাতে বাস্তব থেকে দূরত্ব রাখার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেছেন। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে লেখাপড়া করতে গিয়েই দেখলাম, সৌন্দর্যতত্তে¡র নান্দনিক দিক-নির্দেশনাগুলো। রূপকলা বা চিত্রকলার দেহগত সৌন্দর্যই শেষ কথা নয়। ভাবগত সৌন্দর্যই একমাত্র কথা নয়, আরও তাৎপর্য রয়েছে। সেখানে শিল্পীর শক্তিমত্তার বিষয়টিও উল্লেখযোগ্য। লেখার শক্তিতেই রবীন্দ্রনাথ জাতীয়তার সীমা থেকে আন্তর্জাতিক সীমানায় আত্মপ্রকাশ করেন। কিন্তু এ নিয়ে অনেক শিল্প সমালোচকের সঙ্গে আমার মতান্তর রয়েছে। অনেক সমালোচক বলেছেন, চিত্রকলার মূল বৈশিষ্ট্য হলো, বাস্তব প্রয়োজন মেটানোর সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই। স্বার্থসিদ্ধির দুনিয়ায় শিল্পের স্থান নেই। কিন্তু মার্কসবাদী শিল্প সমালোচকগণ এর তীব্র বিরোধীতা করেছেন। তাদেরকে অনেকে তাই জড়বাদী সমালোচকও আখ্যা দিয়েছেন। অনেক সমালোচক শিল্পের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে ‘আনন্দ দান’ এর প্রসঙ্গ এনেছেন। আবার কেউ কেউ আনন্দ দানের শ্রেণি বিভাগ করেছেন। যেমন: এডল্ফ হিটলার ইহুদি নিধন করে এবং পররাজ্য গ্রাস করে আনন্দ পেয়েছেন। একজন বিজ্ঞানী নতুন নতুন আবিষ্কারেও আনন্দ পান। কিন্তু এ আনন্দ লাভের সঙ্গে ছবি আঁকার, ছবি দেখার কিংবা কাব্য পাঠের আনন্দের পার্থক্য কোথায়! একবার আমাদের অভিনয়ের এক ক্লাসে অভিনেতা আবুল হায়াৎ বলেছিলেন, বাঙ্গালি জাতি নাট্য-অন্তপ্রাণ জাতি নয়। তার স্বভাবে নাটকীয়তা কোথায়! সুতরাং কোনো উদাসীন জাতির পক্ষে নাটকীয়তার আনন্দের স্বাদ পাওয়া সম্ভব নয়। তিনি ১৯৯২ সালে আমাদের একটি ওয়ার্কশপে এসে এসব কথা বলেন। আমি নোট রেখেছিলাম বলেই এর উদাহরণ দেওয়া গেল। মূল কথা হলো, শিল্পের যে কোনো শাখাতেই কাজ করতে গেলে এর মৌলিক বিষয়গুলো আগে জেনে নিতে হবে। কোনো কোনো শিল্পী শিল্পের প্রচলিত অনেক ব্যাকরণই ভেঙ্গে দিয়ে নতুন করে ব্যাকরণ গড়েছেন। রঙের বিভিন্ন অর্থ থাকে। উজ্জ্বল লালে অগ্নিশিখা কিংবা অস্তগামী সূর্য বুঝালেও কেউ এর বিপরীত ব্যবহার করেছেন। কমলা রঙে অনেক শিল্পীই হৃদয়াবেগের বদলে বিষাদও বুঝিয়েছেন অথবা অন্যকিছু। নির্মেঘ আকাশকে অনেকে নীলের বদলে নীলের সঙ্গে আরও অন্য রঙ মিশিয়ে শীতলভাবে এঁকেছেন। প্রশান্তিকে অনেক শিল্পীই নীলে প্রকাশ করেননি। বেগুনি রঙের মর্যাদা অনেকে সনাতন নিয়মে রক্ষা করেননি। আমি নিজেও একবার একটি ধানক্ষেত এবং সর্ষেক্ষেতে উজ্জ্বল হলুদের বদলে ধূসর রঙ ব্যবহার করেছিলাম। সবুজ, নীল, পিঙ্গল, সোনালি হলুদ রঙগুলো বিদেশি অনেক ছবিতেই যথাযথভাবে ব্যবহার হতে দেখিনি। ১৯৯২ সালে ঢাকা পাবলিক লাইব্রেরিতে আমি ভবেশ রায়ের ‘মোনালিসার প্রেম’ গ্রন্থটি পাঠ করি। এ গ্রন্থ পাঠ করে তো আমি অবাক হয়ে গেলাম। ভোরেশিওর ষ্টুডিওতে ১২ বছর কাটিয়েছেন লিওনার্দো দা ভিঞ্চি! আমি তো বারো মাসও স্থির থাকতেই পারতাম না। গণিত, ভূ-তত্ত¡, চিকিৎসা শাস্ত্র, যন্ত্র প্রকৌশলসহ অনেক বিষয়েই ভিঞ্চি লেখাপড়া করেন। একে তো তিনি ছবি আঁকতেন কম, তার পরও এমন অনেক ছবিই তিনি অসমাপ্ত রেখে গিয়েছেন। তার সবচেয়ে জনপ্রিয় ছবি ‘মোনালিসা’ও একটি অসমাপ্ত ছবি। এতো অল্প ছবি এঁকেও কেন কোনো কোনো শিল্পী এতো বিখ্যাত হলেন! আমার মনে হয়, এটা এ জন্য যে, তার সৃষ্টির পক্ষে ছিলেন। আজকাল শিল্পীরা তো অধিকাংশই ছবি উৎপাদন করেন। আমিও এমন অনেক বাজে ছবি এঁকেছি। বিভিন্ন পত্রিকায় ওসব ছবি ছাপাও হয়েছে। কিন্তু ওসবের শিল্পমূল্য নেই। কুমিল্লার কাগজ পত্রিকায় চাকুরি করা অবস্থায় একবার কুমিল্লার গল্পকার কাজী মোহাম্মদ আলমগীর একটি প্রবন্ধ নিয়ে এলেন। শিরোনাম: ‘মল্লিকা বাহার’-বাংলা ছোটগল্পে শরীর প্রসঙ্গে’। ২৩-২৯ ডিসেম্বর ২০০৪ সালের এ পত্রিকার সাহিত্য পাতায় প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয়। প্রবন্ধটির সঙ্গে তাৎক্ষনিকভাবে আমি একটি ছবি এঁকে দেই। কম্পিউটারের পেইন্ট প্রোগ্রামের টুলস ব্যবহার করে। ছাপাও হলো সেই ছবি। কিন্তু আমার বারবার মনে হয়েছে, এভাবে যারা ছবি আঁকেন কিংবা লেখা লিখেন, তাদের সৃষ্টি আর কিভাবে অমরত্ব পাবে!
স্নিগ্ধাদের প্রদর্শনী দেখেছিলাম একবার। শারমিন জামান স্নিগ্ধা। শান্তনু মজুমদার, কিউ এইচ. এম ওয়াহিদুজ্জামান ও শারমিন জামান স্নিগ্ধাদের একটি প্রদর্শনী আমি কুমিল্লা টাউন হলে দেখি। তারা সবাই তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের যথাক্রমে গ্রাফিক ডিজাইন, সিরামিক এবং ড্রয়িং এন্ড পেইন্টিং সম্মান তৃতীয় বর্ষের ছাত্রছাত্রী ছিলো। ২০০৫ সালে কুমিল্লা টাউন হলের এক যৌথ শিল্প প্রদর্শনীতে শারমিন জামান স্নিগ্ধার কাজ প্রথম দেখি আমি। দেখে আমার ভীষণ ভালোও লাগে। তারপর পত্রিকায় আমি লিখি: স্নিগ্ধা যদি পারো, তো একটু দালালি শিখে নিয়ো।’ লেখাটি ছিলো এ রকম: ...............ময়মনসিংহের এই মেয়ের মোবাইল নম্বর ছিলো: ০১৭১৮-৫১৪০৪০। কিন্তু আমি কোনোদিনও মোবাইলে কথা বলিনি চিত্রকর স্নিগ্ধার সঙ্গে।
আমার শখের আঁকা ছবিগুলোর অনেকাংশই হারিয়ে গিয়েছে। এসব নিয়ে আর এখন কোনো দুঃখবোধই নেই। কারণ সারা পৃথিবীর সেরা শিল্পীদের অনেক কাজই হারিয়ে গিয়েছে। এ বিষয়ে বিবিসি-র একটি সংবাদ থেকে উদাহরণ দেই। একবার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগের সময়ের কিছু ছবি ইন্টারনেটে প্রকাশ করা হয়েছিল। মিত্র বাহিনী জার্মানীতে বোমা হামলা শুরু করলে হিটলার এসব চিত্রকর্মের ছবি তুলে রাখার নির্দেশ দেন। যাতে এগুলো ধ্বংস করা হলেও এগুলোর অস্তিত্ব বিলীন হয়ে না যায়। তৎকালীন শিল্প বোদ্ধারা জার্মানি, অস্ট্রিয়া, পোলান্ড, রাশিয়া এবং চেকোশ্লোভাকিয়ার বিখ্যাত শিল্পীদের আঁকা চিত্রকর্ম থেকে এসব ছবি বাছাই করে রাখেন। বাছাই করার পর ছবিগুলোকে বিভিন্ন চার্চ, প্রাসাদসহ অন্যান্য জায়গায় স্থানান্তর করা হয়। ১৯৪৩ থেকে ১৯৪৫ সালের মধ্যে আঁকা এসব চিত্রকর্মের ছবি তোলা হয় প্রায় ৬০ হাজার। ছবিগুলো পরবর্তীতে মিউনিখের ‘সেন্ট্রাল ইনস্টিটিউট ফর আর্ট হিস্ট্রি এবং মারবার্গ ফটোগ্রাফিক আর্কাইভে স্থানান্তর করা হয়। ২০০২ সালে আরকাইভ বিশেষজ্ঞরা এসব ছবির ডিজিটাল চিত্র ধারণ করা শুরু করেন। তবে চার্চের ৬০ শতাংশ ছবির কোনো সন্ধান পরে পাওয়া যায়নি। এভাবে পৃথিবীর অসংখ্য চিত্রকর্মই যুগে যুগে হারিয়েছে। সেখানে একজন অখ্যাত ব্যক্তির কিছু শখের আঁকা ছবি হারানোর ঘটনা কোনো উদাহরণেই পড়ে না।
ঢাকায় যখন ছিলাম, তখন প্রায়ই অভিনেত্রী বিপাশা হায়াতের সঙ্গে দেখা হতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের সামনে। কখনো কখনো একটু আধটু কথা হয়েছে তার সঙ্গে। তবে তা তার চিত্রকলার চর্চা নিয়ে নয়। তার অভিনয় নিয়ে। কার্টুন আঁকার চেষ্টা করেছিলাম একসময়। হয়নি আমার দ্বারা। ছোটভাই পিয়াস একদা অনেক কার্টুনই এঁকেছিল। অধিকাংশই মৌলবাদ বিরোধী। হারানো গিয়েছে সব। বাংলাদেশের কার্টুন চর্চার ইতিহাস অত্যন্ত সমৃদ্ধ। রাষ্ট্রভাষা হিসাবে বাংলাকে প্রতিষ্ঠার দাবি স্তব্ধ করে দেওয়ার ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসাবে ১৯৫৩ সালের ‘সৈনিক’ পত্রিকায় আঁকা হয়েছিলো একটি কার্টুন। কার্টুনটি এঁকেছিলেন কাজী আবুল কাশেম। ‘এই জানোয়ারদের হত্যা করতে হবে’ শীর্ষক আইয়ুব খানকে নিয়ে করা কামরুল হাসানের সেই কার্টুনটি ১৯৭১ সালে বাঙ্গালি জাতিকে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিলো। এক সময় আমি গল্প লেখার আগে গল্পটির এক ধরনের ছবিও কাগজে এঁকে নিতাম। সেটা ১৯৯৩ সালের দিকে। আমার অনেক গল্পই আগে খাতায় এঁকেছি। পরে লিখেছি গল্প। এতদিন পর এর অধিকাংশ গল্প রয়েছে, কিন্তু আঁকা সেই ছবিগুলো আর নেই।
১৯৮৯ সালে আব্বার সঙ্গে কুমিল্লা শহরের অশোকতলার একটি বাসায় ছিলাম কিছুদিন। আব্বা ও বড় ভাই তখন কয়েকটি ক্যালেন্ডার এনেছিলেন বাংলাদেশের চমৎকার রূপ নিয়ে। আমি এসব ছবির প্রেমে পড়ে যাই। আমাদের দেশের কতো অখ্যাত শিল্পীদের আঁকা, অথচ কতো চমৎকার সব ছবি। আরেকটি ক্যালেন্ডারে এমন একটি ছবি ছিলো যে, মা ছেলেকে পড়াচ্ছে ‘ট-দিয়ে টিয়ে। ছেলেটির বইয়েও একটি টিয়ের ছবি দেখা যাচ্ছে। অন্যদিকে ঘরের কোনের একটি খাঁচাতেও একটি টিয়ে পাখি রয়েছে। শৈশবে আমিও টিয়ে পোষতাম বিধায় এবং টিয়ে আমার প্রিয় পাখি বলে ক্যালেন্ডারের এ ছবিটির কথা আমি আজও ভুলতে পারিনি। যখন থেকে আমি নবম শ্রেণিতে পড়ি, তখন থেকে বিভিন্ন বন্ধুর বিজ্ঞানের ব্যবহারিক খাতার আঁকাও এঁকে দিতাম। এতেও তখন আমার হাত আঁকার দিকে অনেকটা ঝুকে যায়।
কিছু ছবির কথা আমি কখনোই ভুলে যেতে পারবো না। যেমন-মেক্সিকোর রোজালিন্ডা আলুবর্নির ‘মৌজানা’। ওই হিসেবে শিল্পী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ওই মুখ ওই হাসি’ চিত্রকর্মটি তেমন ভালো লাগেনি। ১৪ এপ্রিল ১৯৯০ তারিখে প্রকাশিত কলকাতার বাংলা সাহিত্যের কাগজ ‘দেশ’ কিনেছিলাম ঢাকার পুরানা পল্টন থেকে মাত্র ২ টাকায়। এর মুদ্রিত মূল্য ছিলো ৭ টাকা। ওই পত্রিকায় শকুন্তলা-র এতো চমৎকার ছবি প্রচ্ছদে আঁকা হয়েছিলো, এক কথায় অসাধারণ। আমাদের কুমিল্লার চিত্রশিল্পী উত্তম গুহের চিত্রকর্ম দেখে তো আমি অবাক। ৬০/এ-১, পুরানা পল্টন ঢাকায় ‘সিলেকশন’ নামে একটি অ্যাডভার্টাইজিং-প্রিন্টিং-ডিজাইন এন্ড মডেলিং এজেন্সির ডিরেক্টর ছিলেন তিনি। তখন মোবাইলের যুগ ছিলো না। সেই অফিসের ফোন নম্বর ছিলো: ২৪৩২৮৯। ’
কাজী আবুল কাশেমের কতো ছবি দেখেছি একসময়। বিভিন্ন বইপত্রে, লাইব্রেরিতে। জীবন যে বর্তমান সময়ে এসে এমন থমকে যাবে, কে আগে ভাবতে পেরেছিলো! চোরচোট্টার হাতে যে সব ক্ষমতা আর রাজ্য চলে যাবে, কোনোদিনও ভাবতে পারিনি। কাজী আবুল কাশেমের একটি চিত্রকর্মের কথা খুবই মনে পড়ে। ল্যাংড়া আমের ছবি। আমাদের গ্রামের মুন্সীবাড়ির কাদের নামে একজন লোকের একটি চা-বিস্কুটের দোকান ছিলো। তার দোকান ছিলো আমার শৈশবের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কাছেই। ওই কাদের সাহেব তার পায়ের সমস্যার কারণে তিনি খুঁড়িয়ে খুড়িয়ে হাঁটতেন। এলাকার লোকজন তাকে ‘ ল্যাংড়া কাদিরা’ বলে সম্বোধন করতো। সারা শৈশব জুড়ে আমি তাই ল্যাংড়া ’ বলতে ওই কাদের সাহেবকেই চিনতাম। পরে দেখলাম আমের নামও ল্যাংড়া আম’। তারও অনেক দিন পরে ল্যাংড়া আম নিয়ে এক কার্টুন দেখলাম কাজী আবুল কাশেমের। যতদূর মনে পড়ে ছবিটি ছিলো এমন: একটি আমের দুটি পা। একটি পা ভাঙ্গা। সেটিতে ব্যান্ডেজ করা হয়েছে। ক্রাচে ভর করে হাঁটছে সেই আমটি। এই হলো কাজী আবুল কাশেমের কার্টুন: ল্যাংড়া আম। মূলত আমি একজন নন্দনতাত্তি¡ক কিংবা চিত্র সমালোচক বা চিত্রকর্ম বিষয়ক বোদ্ধা হতে পারতাম, যদিও হইনি। কিন্তু কখনোই আমার চিত্রকর হওয়ার কোনো কারণ ছিলো না। কারণ যতটুকু পড়েছি চিত্রকলা বিষয়ে, সেই তুলনায় আমার চিত্রকর হওয়ার চিন্তা মাথায় থাকার কোনো কারণই ছিলো না। কেননা আমি তো অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের (১৮৭১-১৯৫১) চিত্রাঙ্কন রীতি বিষয়েও ধারনা নিয়েছিলাম। পাশ্চাত্য চিত্রাঙ্কন রীতি এবং জাপানী চিত্রাঙ্কন রীতি বিষয়ে এতোটাই দক্ষতা অর্জন করেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, তা আমার ধারণাতীত বিষয়। ১৮৯৮-এ কলকাতা আর্ট কলেজের সহ- অধ্যক্ষের পদে চাকুরি করেছেন তিনি। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাগেশ্বরী অধ্যাপকরূপে যোগ দেন ১৯২১-এ। ১৯৪২ এ রবীন্দ্রনাথ প্রতিষ্ঠিত বিশ্বভারতীর আচার্যের পদ গ্রহণ করেন। পাশ্চাত্য রীতিতে সুদক্ষ হয়েও ভারতীয় চিত্রাঙ্কন রীতি পুনরুদ্বারের সাধনা শুরু করেন। ভারতীয় রীতিতে তার প্রথম প্রয়াস কৃষ্ণলীলা বিষয়ক চিত্রাবলী। অবশ্য এগুলো আমি এখনও সব দেখিনি। জাপানী রীতি ছিলো তার অন্যতম প্রিয় রীতি। এ রীতিতে আঁকা ‘ওমর খৈয়াম’ তার অন্যতম শ্রেষ্ঠ চিত্রকর্ম বলে শিল্পবোদ্ধারা মত দিয়েছেন। ১৯০৭ এই অবনীন্দ্রনাথের শিল্পাদর্শ জাতীয় জীবনে প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে ভগিনী নিবেদিতা আত্মনিয়োগ করেন। ১৯১৩-তে তার চিত্র প্রদর্শনী হয় লন্ডন ও প্যারিসে এবং ১৯১৯-এ জাপানে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাগেশ্বরী অধ্যাপকরূপে (১৯২২-১৯২৭) চিত্রকলার উপর যেসব প্রবন্ধ অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর পাঠ করেন, সেগুলো পরে ‘বাগেশ্বরী শিল্প প্রবন্ধাবলী’ নামে সংকলিত হয়ে প্রকাশিত হয়। এই ‘বাগেশ্বরী শিল্প প্রবন্ধাবলী’ আমি এ পর্যন্ত মোট পাঁচবার পড়েছি। তারপরও মনে হয় এটা শিল্পরসিক, শিল্পী, শিল্পসমালোচক এবং যারা শিল্প চর্চা করেন, তাদের বারবারই পড়া উচিৎ। আর অন্নদাশঙ্কর রায়ের ‘আর্ট’ গ্রন্থটিতেও এতো সহজ ভাষায় এতো জটিল বিষয়ের ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে, যে সেই গ্রন্থ পাঠ না করেছে, তার তা বোধগম্য হবে না কোনোদিনও।
কুমিল্লার উত্তম গুহের অনেক কাজই দেখেছি। তিনি এখন আন্তর্জাতিকমানের শিল্পী। কুমিল্লা আর্ট স্কুলে তার প্রথম একক চিত্র প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। কুমিল্লা শহরের প্রাণকেন্দ্রে কুমিল্লা টাউনহলের সামনে কুমিল্লারই কৃতি সন্তানদের ‘স্মৃতিফলক’-যা থেকে বর্তমান প্রজন্ম স্মরণ করতে পারবে পূর্বসূরীদের কথা। এ জন্য সার্বিক সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছিলেন কুমিল্লারই এক সময়ের জনপ্রিয় জেলা প্রশাসক মরহুম সৈয়দ আমিনুর রহমান। ১৯৯২ সালে এই উত্তম গুহ জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ভাস্কর্য ‘চেতনায় নজরুল’ কুমিল্লা শিল্পকলা একাডেমির সামনে নির্মাণ করেন। এটি উন্মোচন করেছিলেন বাংলাদেশের তখনকার প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া। তার সহধর্মিনী চিত্রলেখা গুহ। তার বড় ভাই সুজিত চাঁন গুহ দীর্ঘদিন কুমিল্লায় ‘উদীচী’ করেছেন। পরে এক সময় সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট কুমিল্লা জেলা শাখার সভাপতিরও দায়িত্ব পালন করেন।
কিন্তু আমার ছবি আঁকার কখনোই কোনো কারণে স্বীকৃতি ছিলো না। একসময় আমি অনেক ছবিই এঁকেছি। বিশেষ করে পশ্চিম ইউরোপের চিত্রকলা নিয়ে তখন অনেক পড়েছিও। এ প্রসঙ্গে অশোকমিত্রের ‘পশ্চিম ইউরোপের চিত্রকলা’ গ্রন্থটির কথাই বেশি মনে পড়ছে। আরও গ্রন্থ পড়েছি। কিন্তু এখন নাম মনে পড়ছে না। আজকাল আমার প্রায়ই মনে হয়, আমার কোনো বড় অসুখ হয়েছে। কারণ আমার স্মৃতি ক্রমশই লোপ পাচ্ছে। অর্থাভাবে ডাক্তারের কাছে যেতে পারছি না। আর তা ছাড়া অসুখ হয়েছে জানলে আরও বেশি মনোবল ভেঙ্গে যাবে। কবি পূর্ণেন্দু পত্রীর ছবির কথা মনে পড়ছে। তার কবিতার চেয়েও তাঁর আঁকা আমার কাছে প্রিয়। বাংলাদেশের চিত্রশিল্পী কনকচাঁপা চাকমা’র কাজগুলো পত্রিকাতেই দেখেছি। আজও সরাসরি দেখিনি। তিনি একবার আমেরিকায় শ্রেষ্ঠ মহিলা চিত্রশিল্পীর পুরস্কার পেয়েছিলেন। এক্রেলিক মাধ্যম তার প্রিয় একটি মাধ্যম। আমি সারা জীবনে কমপক্ষে ৫০ টি ভালো ছবি আঁকতে পারতাম। কিন্তু এক্ষেত্রে আমার অ-কাজ হয়েছে বেশি। প্রথমত: এটা আমার কাজের কোনো ক্ষেত্রই ছিলো না। দ্বিতীয়ত: আমার ইচ্ছে ছিলো আমি চিত্রকর হবো। অথচ আমার এক্ষেত্রে আমার কোনো গুরু কিংবা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাই ছিলো না। আর তাছাড়া যে যখন বলেছে, এঁকেছি। এবার সেটা হোক, বা না হোক। যেমন: একবার সাপ্তাহিক কুমিল্লার কাগজ পত্রিকায় কাজ করছিলাম। কুমিল্লার অধ্যাপক ও সাহিত্যিক শান্তিরঞ্জন ভৌমিক এলেন একটি লেখা নিয়ে। সম্ভবত গল্প। শিরোনাম: ‘চিকিৎসা’। এ গল্পের সঙ্গে ছাপা হওয়ার জন্য তাৎক্ষনিকভাবে একটি ছবি এঁকে দিলাম কম্প

২১| ১০ ই মে, ২০১৮ রাত ২:৪৪

জসীম অসীম বলেছেন: আমার ছবি অাঁকার নেশা
(পূর্বের লেখার পরের অংশ)
জসীম উদ্দিন অসীম

একবার সাপ্তাহিক কুমিল্লার কাগজ পত্রিকায় কাজ করছিলাম। কুমিল্লার অধ্যাপক ও সাহিত্যিক শান্তিরঞ্জন ভৌমিক এলেন একটি লেখা নিয়ে। সম্ভবত গল্প। শিরোনাম: ‘চিকিৎসা’। এ গল্পের সঙ্গে ছাপা হওয়ার জন্য তাৎক্ষনিকভাবে একটি ছবি এঁকে দিলাম কম্পিউটারের পেইন্ট প্রোগ্রামে। মুদ্রিতও হলো। ২০০৪ সালের ১ জুন প্রকাশিত হয় কুমিল্লার প্রভাষক বাচ্চু বকাউল সম্পাদিত সাহিত্য সংকলন ‘পথ’-এর ১ম সংখ্যা। এটি কুমিল্লার কবি বিজন দাসকে উৎসর্গ করা হয়। আমি অনেক আগে মার্কার পেন-এ করা আমার একটি ছবির প্রতিলিপি দিলাম এর প্রচ্ছদ করার জন্য। জগতে আরও অনেক বিখ্যাত চিত্রকর থাকার পরও কৃষিবিদ-লেখক-সম্পাদক বাচ্চু বকাউল আমাকে চিত্রকর হিসেবে প্রচার দিতে আমার আঁকাই প্রচ্ছদ করলেন। পরে এই ‘পথ’কেই তিনি ‘সময়ের পথ’ নামে সংবাদপত্র হিসেবে কুমিল্লা জেলা প্রশাসন থেকে ‘ঘোষনাপত্র’ বা ডিক্লারেশন নেন। আমার সব ছবির নামই ছিলো ইংরেজিতে। একটি ছবির নাম ছিলো: ডমেস্টিক ওইমেন। সেটি আমার কুমিল্লার চান্দিনার বন্ধু তাহমিদুর রহমান দিদার পছন্দ করলেন না। ২০০৪ সালের জুনেই প্রকাশিত হয় তৃণমূল সাংবাদিক তাহমিদুর রহমান দিদার সম্পাদিত সাহিত্য সংকলন ‘দীপিকা’-এর ১ম সংখ্যা। তার সহযোগী সম্পাদক ছিলেন তখন বর্তমানে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট ইস্পাহানি পাবলিক স্কুলের ইংরেজি শিক্ষক মোহাম্মদ আলী, চান্দিনার সাহিত্যিক প্রদীপ দাস ও চান্দিনার কবি আশরাফ মাহমুদ। তখন চান্দিনায় একটি সাহিত্য সংগঠন গড়ে ওঠেছিলো। ‘দীপিকা সাহিত্য পরিবার’ নামে। আমি প্রায়ই তখন চান্দিনায় নিমন্ত্রিত হতাম। সেই সংগঠনে ছিলেন আবৃত্তিকার সালাহউদ্দিন সুমন, রণবীর ঘোষ কিঙ্কর, মাসুমুর রহমান মাসুদ, পাখি সরকার, নীপা, রত্মা গোস্বামীসহ আরও অনেকে। চান্দিনা হাইস্কুল মার্কেটের তাহমিদুর রহমান দিদার ভাইয়ের ‘চিকিৎসা নিকেতন’ ওষুধের দোকানে, চান্দিনা পশ্চিম বাজারের মাসুম অফসেট প্রেসে, বারী কম্পিউটার সিস্টেম-এ বসে আমাদের আড্ডা হতো। সেই ‘দীপিকা’-র ১ম সংখ্যার প্রচ্ছদ করা হয়েছিলো আমার ১৯৯২ সালে আঁকা একটি ছবির প্রতিচ্ছবি দিয়েই। সংকলনে আমার আর মোহাম্মদ আলীর ইংরেজি কবিতাও ছাপা হয়। তখন আমি প্রায়ই চান্দিনায় চলে যেতাম। কখনো মোহাম্মদ আলীর বাসাতেও থেকেছি। চলে যেতাম বেলাশ্বরের কবি প্রদীপ দাসের বাসাতেও। কখনো কখনো কাদুটি এলাকার ইলাশপুরের নারায়ণ সরকারের মেয়ে পাখি সরকারদের বাড়িতেও। অথবা রামমোহনে প্রবীণ শিক্ষক যতীন্দ্র গোস্বামীর মেয়ে রত্না গোস্বামীদের বাড়িতে। কিন্তু একসময় ইলাশপুরের পাখি সরকারের বাড়িতে যাওয়াকে কেন্দ্র করে বেলাশ্বরের কবি প্রদীপ দাসের সঙ্গে আমার সম্পর্কের অবনতি হয়। তারপর থেকে আর চান্দিনায় যাওয়া হয় না আমার। আমার বন্ধু রাঙ্গামাটির ঝিমি বড়–য়ার সঙ্গেও তখন আর আমার কোনো যোগাযোগ নেই। ঝিমি এক সময়ে প্রতি সপ্তাহে একটি চিঠি লিখতো আমাকে। ঝিমি পাহাড়ি আর বাঙালির সহাবস্থান মেনে নিতো না। বলতো পাহাড় হলো আমাদের নিজস্ব বাসভূমি। এক সময় আরেকটি মেয়ে আমার খুব সন্নিকটে এলো। তারপর আর তার সাথে আমার কোনো যোগাযোগ নেই। আমি তখন কুমিল্লার কাগজে চাকুরি করি। কুমিল্লার কাগজের উদ্বেধনী সংখ্যায় অনেক ছবি ছাপা হয়। ছবিগুলো ছিলো রেবেকা সুলতানা মলি-র আঁকা। তেল রঙ ও এক্রেলিক মাধ্যমে আঁকা এসব ছবি আরেকটি মেয়েকে মুগ্ধ করে। তার নাম ছিলো ইফফাত জাহান লুনা। সেই মেয়ে তখন পড়তো কলেজে। থাকতো কুমিল্লা শহরেরই ঝাউতলা খ্রিস্টানপাড়ায়। কুমিল্লার কাগজের তখনকার স্টাফ রিপোর্টার কাজী উম্মে সালমা সাঞ্জুদের বাসার বিপরীত দিকে। আমি প্রায়ই সাঞ্জুদের বাসায় যেতাম। একদিন গেলাম লুনাদের বাসায়। লুনা তখন নেই। কথা বলা আর হলো না। বাসার পরিবেশ তার খুব বেশি কড়াকড়ি রকমের। তারপর একদিন কুমিল্লার কাগজ অফিসে এলেন লুনা। আমি বললাম, এতো কড়া পরিবেশে থেকে কি চিত্রচর্চা হবে! লুনা যেন আমার কথায় খুবই লজ্জা পেলো। আমি লুনাকে বললাম, উল্টো করে লিখতে পারেন? আমি পারি। উল্টো করে লিখতে পারা একটি আর্ট। উল্টো করে লেখা পড়তে হলে আয়নার মধ্য দিয়ে পড়তে হবে। আমি তখন তাকে আমার আঁকা ‘লাভ ফর গ্যাম্বলিং, বার্ড, লাভ ফর বার্ড...ইত্যাদি ছবির ক্ষুদ্র সংস্করণ দেখালাম। আরও বললাম: ১৯৯৮ সালে আমি কমপক্ষে ২০ রাত জেগে একটি নারীর মুখ এঁকেছিলাম: চাঁদ সুন্দর মুখ’। সেটি হারিয়েছি। লুনা তখন বললেন, তিনি ছবি আঁকা শেখেন ‘আঁকন আর্ট স্কুলে’ মিজানুর রহমান আঁকন স্যারের কাছে। অতীন্দ্র মোহন রায় সড়ক, বাদুরতলায়। তার অনেকদিন পর সেই আঁকন স্যারের সাথেও আমার দেখা হয়। আমি তাঁর প্রদর্শনীও দেখি। তাকে আমি বললাম, কুমিল্লায় ছবি প্রদর্শনীর একটি গ্যালারী নেই। কুমিল্লায় আমি আলোকচিত্র প্রদর্শনী করতে গিয়ে এই গ্যালারীর অভাব অনুভব করি। আমার সঙ্গে একমত প্রকাশ করেন আঁকন স্যার। আমি তার ছাত্রী লুনার প্রসঙ্গেও আলাপ করলাম। সেই সময়ে আমি লুনাকে ছবি আঁকার অনেক কৌশলের কথাও জানালাম। বিশেষ করে এপিডায়োস্কোপের কথা বললাম। এপিডায়োস্কোপে ছোট ছবিকে এনলার্জ করে ক্যানভাসে ফেলে তার ওপর তুলি চালানো হয়। যে কোনো আনাড়ি ব্যক্তিও এটি করতে পারে। আর চারুকলায় দক্ষ হলে সে তো অনেকই এগিয়ে যেতে পারে। আমার মুখে এসব শুনে লুনা অবাকই হয়। একদিন তাকে নিয়ে গেলাম পত্রিকাটির সম্পাদক আবুল কাশেম হৃদয়ের কাছে। হৃদয় তাকে ‘কুমিল্লায় চিত্রশিল্প’ শিরোনামে একটি লেখা তৈরির অ্যাসাইনমেন্ট দেন। মেয়েটি দুইদিন পরেই নিয়ে আসেন সেই লেখা। তারপর আর দেখা নেই সেই ইফফাত জাহান লুনার সঙ্গে। আমি তখন ভেবেছিলাম আমার কিছু আঁকা ছবি দিয়ে একটি গ্রন্থও প্রকাশ করবো। প্রায়ই বিভিন্ন প্রকাশনায় একটি বিজ্ঞাপন দিতাম আমি। ওখানে লেখা থাকতো: ‘পাবলিশিং সুন। লাভ ফর গ্যাম্বলিং: এ কালেকশন অব স্কেচেস বাই জসীম উদ্দিন অসীম।’ কিন্তু সেই গ্রন্থ প্রকাশের অর্থ আমার আর কোনোভাবেই যোগাড় হতো না। আমার বর্তমান স্ত্রী সাদিয়া অসীম পলি বিয়ের পর আমার চেহারার অনেক ছবি এঁকেছিল। সেগুলো এখন সংরক্ষণে নেই। রেখা আর রঙের তাৎপর্যপূর্ণ সমন্বয় যে চিত্রকলা, তা অনেককেই আকর্ষণ করে। আমি যখন হাইস্কুলে পড়ি, তখন আমাদের গেম টিচার ছিলেন রশিদ স্যার। রশিদ স্যার আমাদের স্কাউট অনুসরক চিহ্ন এঁকে আমাদের আঁকা শেখাতেন। সেই চিহ্ন অনেকেই বুঝবেন না। গাছের ডাল, চুন, কালি...ইত্যাদি দিয়ে এসব চিহ্ন দেয়া হয়।
পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর হলো নারী। সুন্দর হলো শিল্প। সেরাদের সেরা আর সুন্দরের চেয়ে সুন্দর হলো এরা উভয়ে। সারাজীবন আমি নারী আর এই শিল্পকর্মের প্রেমে পড়েছি। ছবি আঁকা একসময় খুবই প্রিয় ছিলো আমার। তখনও দেখেছি, পৃথিবীর সকল নারীই তার একুশ বছরে পৃথিবীর সেরা সুন্দরী হয়ে উঠে। যেমন একুশে আমার চোখেও এই পৃথিবী অন্য এক আলোয় উদ্ভাসিত ছিলো। শৈশবে মাটি দিয়ে পাখি বানিয়ে রঙ লাগিয়ে যখন শিক্ষকদের দেখাতাম, তখন যেমন আমার শিল্পপ্রীতি ছিলো, তেমনি এখনও এ নেশা আরও ভয়াবহ হয়েছে। কম্পিউটারের ডিজিটাল ফর্মে ছবি আঁকা সময় সমর্থিত হলেও আমি এতে খুব সুখ বোধ করিনি। রঙ কেনার পয়সার অভাবেই আমি শত শত ছবি কম্পিউটারের পেইন্ট প্রোগ্রামে এঁকেছিলাম। ‘বুকে জ্বলে উল্কাপিন্ড’ নামে আমি, কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের শিক্ষার্থী স্বপ্না দেবনাথ ও স্নিগ্ধা রায়সহ আরও কয়েকজন মিলে ২০০৩ সালে একটি কবিতার সংকলন প্রকাশ করেছিলাম। প্রত্যেকের নিজেদের একগুচ্ছ কবিতা নিয়ে। ৩২ পৃষ্ঠার সেই কবিতার সংকলনের প্রচ্ছদ করেছিলাম একটি বিদেশী চিত্রকর্ম ছবি দিয়ে। এর অলংকরণ করেছিলেন কুমিল্লার কবি সৈয়দ আহমাদ তারেক। কিন্তু এখন সেই ‘বুকে জ্বলে উল্কাপিন্ড’ সংকলনের এক কপিও আর আমার কাছে নেই। যাযাবরের মতো কেটেছে আমার জীবন। কোথায় কখন ঘুমাবো, খাবো, থাকবো...এর কোনো পরিকল্পনাই ছিলো না। মানব সমাজ ক্রমাগতই পরিবর্তনশীল। এই পরিবর্তনের ¯্রােতে আমার অনেক সৃষ্টিকর্ম ও বন্ধুবান্ধব বানের জলের মতোই ভেসে গেল। আমিও ভেসেই যাচ্ছিলাম। যদি আমার দেখা না হতো আমার বর্তমান স্ত্রী সাদিয়া পলির সাথে, তা হলে কোথায় যেতাম আমি, আর কোথায় থাকতো আমার সৃষ্টিকর্ম। কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ, আলোকচিত্র, চিত্রকর্ম, ইংরেজিতে লেখা আমার যত গল্প...ইত্যাদি যত আমার সৃষ্টিকর্ম ছিলো, তার শতকরা প্রায় ৬০ ভাগই আমি হারিয়েছি। আমার বর্তমান স্ত্রী সাদিয়া পলি বিগত ১০ বছর ধরে এসবের অনেকাংশেরই বিভিন্নভাবে উদ্ধার ও সংরক্ষণ করে আমাকে আবার সৃষ্টির পৃথিবীতে ফিরিয়ে এনেছে। মেনে নিয়েছে আমার জীবনে আসা অনেক অনেক হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খিস্টান নারীর বন্ধুত্ব ও সঙ্গ লাভ। তাই আমি এখন আর আমার আগেকার কোনো নারী বন্ধুর সঙ্গেই যোগাযোগ রাখি না। এমনকি যেই ঈশিতার সঙ্গে সংসার ভেঙ্গেছে আমার, তার দ্বিতীয় সংসারও ভেঙ্গে যাওয়ার পর সে গিয়ে ঢাকায় স্থায়ী হয়েছে বলে সেই থেকে আমি ওই ঢাকাও ছেড়ে দিয়েছি। তার দ্বিতীয় সংসার ভেঙ্গে যাওয়ার পর তার সঙ্গে আবারও নিয়মিত যোগাযোগ তৈরি হয়েছিলো আমার। কিন্তু এর পরিণতি খারাপের দিকে যাবে ভেবে আমি আমাকে নিয়ন্ত্রণ করে ফেলি। ঢাকায় এখন আর যাওয়াই হয় না আমার। অথচ ঢাকায় আমি প্রতি সপ্তাহে দুই-তিনবারও যেতাম। এসব কথা পলিও জানে। সে একই সঙ্গে আমার সন্তানের লালনপালনসহ আমার নিত্য অভাবের সংসার দেখেছে। আমার প্রথম স্ত্রী কুমিল্লা মহানগরীর সংরাইশ সাহেববাড়ির হুমায়ুন কবিরের তৃতীয় কন্যা ফারজানা কবির ঈশিতা। তার সঙ্গে যখন আমার প্রেম হয় ১৯৯৮ সালে, তখনও আমি সাংবাদিকতার চাকুরি করি। যখন তাকে বিয়ে করি ২০০০ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারিতে, তখনও আমি পত্রিকার চাকুরি করছি, যখন সংসার ভাঙ্গে ২০০২ সালের ৭ ফেব্রুয়ারিতে, তখনও চাকুরি করছি আমি। কিন্তু আমি যখন পত্রিকার চাকুরি ছেড়ে বেকার, তখনই কুমিল্লার সাপ্তাহিক ‘নিরীক্ষণ’ সম্পাদক মোহাম্মদ উল্লাহর মেয়ে সাদিয়া পলির সাথে আমার প্রেম হয়। তারপর আবার পত্রিকার চাকুরি নিলেও কিছুদিনের মধ্যেই ছেড়ে দেই সেই চাকুরি। কুমিল্লার একটি দৈনিক পত্রিকার সেই কাজ ছেড়ে যখন আবার বেকার হই, ঠিক তখনই তাকে বিয়ে করি আমি। বিয়ের পরেও পত্রিকার চাকুরি ধরেছি এবং ছেড়েছি। অভাবের কথা বর্ণনার অতীত। তবু সাদিয়া পলির সাথে আমার বিগত ১০ বছর ধরে সংসার এগিয়ে এসেছে। আমার সকল সৃষ্টিকর্মের জন্য তার অসম্ভব আবেগ ছড়িয়ে রয়েছে। আমি ভাবতেও পারিনি যে, সাংসারিক সকল কাজকর্ম শেষ করে সে আমার সৃষ্টিসমগ্র সংরক্ষণের জন্যও তার সময়-শ্রম প্রতিনিয়ত ব্যয় করবে। এ জন্য আমি তাকে ধন্যবাদ দেই না। সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ দেই। অথচ পলির সঙ্গে আমার বয়সেরও এক বিশাল ব্যবধান রয়েছে। সে এখন আমার সাড়ে ৭ বছরের ছেলে কফিল মোহাম্মদ অপূর্বকে ছবি আঁকা শেখায়। অপূর্ব আমার চেয়েও অনেক ভালো ছবি আঁকে। মাত্র সাড়ে তিন বছর বয়স থেকে অপূর্ব ছবি আঁকে। ইউরোপের রেনেসা যুগের শিল্পীরা পৃথিবী অবিকল যে রকম, সে ভাবেই তাকে জানবার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু আমি এমন মূর্ত ছবি কোনোদিনও আঁকার পক্ষে ছিলাম না। একসময় আমি কার্টুন আঁকার কথাও ভেবেছিলাম। চিত্রশিল্পী কাজী আবুল কাশেম এ বিষয়ে আমার জীবনে প্রথম প্রভাব ফেলেন। তিনি ২০০৪ সালে ৯২ বছর বয়সে মারা যান। আমার এখনও ইচ্ছে হয়, তার মেয়ে জুলিয়া আখতারকে গিয়ে বলি, আপনি এ জাতির একজন শ্রেষ্ঠ চিত্রকরের সন্তান। চিত্রকর্ম খুব সহজসাধ্য হলে আমি সফল হতাম। কাপড়ে বা ঘরের দেয়ালে যেসব চিত্র একজন শিল্পী আঁকেন, তা সর্বদাই দুই মাত্রার একটি মাধ্যম। দুই মাত্রার সমতল এই মাধ্যমে দৈর্ঘ এবং প্রস্থ রয়েছে। কিন্তু এর গভীরতা নেই। অথচ সব বস্তুই তিন মাত্রার। তিন মাত্রার বস্তুকে শিল্পী দুই মাত্রায় প্রকাশ করেন। রেখা ও রঙের সাহায্যে চিত্রকর বাকি এক মাত্রার সমস্যার সমাধান করেন। এই চিত্রকলা তিন প্রকার। চিত্রকলা-ভাস্কর্য-স্থাপত্য। চিত্রকলা তৈরি হয় আয়তক্ষেত্রের উপর। যেমন-কাগজ, চামড়া...ইত্যাদি। আমি ভাবি চিত্রকর লিওনার্দো দ্যা ভিঞ্চি (১৪৫২-১৫১৯) হয়তো এ জন্যই একই সঙ্গে ভাস্কর ও প্রকৌশলীও হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু তিনি তো দার্শনিকও ছিলেন। সেটা সম্ভব হলো কিভাবে! তার পোর্ট্রটে ‘মোনালিসা’ আজও পর্যন্ত বিশ্বের সবচেয়ে নন্দিত শিল্পকর্ম। আমি কেন বিমূর্ত এঁকেছিলাম অধিকাংশ ছবি, তার সঠিক ব্যাখ্যা নেই। আমার ছেলে ছবি আঁকার কথা বললে আমি বলি, তোমার যা ইচ্ছে আঁকো। যেভাবে ইচ্ছে আঁকো। তবু আঁকো। আমি জানি বিমূর্ত শিল্প বস্তুর আকৃতির যথাযথ প্রতিনিধিত্ব করে না। বাংলাদেশের শহীদ মিনারগুলো বিমূর্ত ভাস্কর্যেরই রূপান্তর। সুতরাং কোনো অঙ্কনই বৃথা নয় আমার কাছে। অভিব্যক্তিবাদ বা এক্সপ্রেশনিজম নিয়ে একসময় কতো পড়েছিলাম। এ ধারার শিল্পীরা মানুষের মনের ধারনা-বাসনাকে ভেঙ্গেচুরে নানাভাবে রূপ দেন। আর ইম্প্রেশনিজম যেহেতু রূপবাদ, সে তো ভিন্ন কথা। কিউবিজম সকল বস্তুকে জ্যামিতিক কয়েকটি আকৃতিতে পর্যবসিত করে উপস্থিত করে। এ হলো তখনকার সর্বোচ্চ আলোচিত ফর্ম। অত্যন্ত দুর্বোধ্য এ স্টাইল। ১৯০৭ সালে স্পেনের পিকাসো এর উদ্ভাবন করেন। বাংলাদেশের অনেকের কাজও আমার মনে থাকে। চিত্রশিল্পী নাঈমা হকের ‘আনটাইটেলড’ যেমন এখন মনে রয়েছে। আমার অনেক ছবি আমি উপহারও দিয়ে ফেলেছি। যেহেতু এগুলো ছিলো বিমূর্ত এবং সাধারণ মানুষ বিমূর্ত ছবি বুঝে না, তাই তারা ওসব সংরক্ষণও করেনি। একবার বাড়িতে গিয়ে আমার বড় দুলাভাইয়ের ছোটভাই শহীদ ভাইয়ের মেয়ে শারমিনকে এ রকম কিছু ছবি দিয়েছিলাম। ২০০৫ সালে। আমি জানি এগুলো আর থাকবে না। কিন্তু আমি বরাবরই বেখেয়ালি। অনেক ভালো কবিতা হয়তো রয়েছে। কেউ একটি প্রকাশনার জন্য চাইলো, তো দিলাম একটি বিবেচনা না করে হাতের কাছে যেটা পেলাম, সেটাই। তেমনি অনেক আঁকা থাকার পরও ১৯৯৭ সালে আমাদের পরিবার থেকে প্রকাশিত সাহিত্য সংকলন ‘সংশপ্তক’-এ দিলাম খুব বাজে কিছু স্কেচ। কিছু আঁকার প্রতিলিপি কম্পিউটারের ফটোশপে কিংবা পেইন্ট প্রোগ্রামে নিয়ে অদক্ষ হাতে চিরতরেই নষ্ট করে ফেলেছি। আমাদের পরিবার থেকে প্রকাশিত সাহিত্য সংকলন ‘সংশপ্তক’-এর প্রচ্ছদ করা হয়েছিলো ছোটভাই পিয়াসের আঁকা ছবি দিয়ে। পিয়াসও তার ছবি সংরক্ষণ করেনি। একবার ২১-এর সংকলন ‘ধানসিঁড়ি’ প্রকাশ করা হলো আমার ছোটভাই জামাল উদ্দিন দামালের সম্পাদনায়। ছাত্র ইউনিয়ন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ শাখা কর্র্তৃক প্রকাশিত এ সংকলনেরও প্রচ্ছদ করেছিলো গিয়াস উদ্দিন পিয়াস। এর পৃষ্ঠা ছিলো-১৬ এবং মূল্য ৫ টাকা। এটা ২০০২ সালের ঘটনা। আরেকবার কুমিল্লার গল্পকার মামুন সিদ্দিকী যুব ইউনিয়ন কুমিল্লা থেকে ‘সুবর্ণ একুশ’ নামে ১৬ পৃষ্ঠার একটি সংকলন বের করে। এর আলোকচিত্র ছিলো আমার। প্রচ্ছদ করেছিলো গিয়াস উদ্দিন পিয়াস। মূল্য ছিলো-১০ টাকা। সেটাও ২০০২ সালের কথা। সেই মামুনের বাসায় গেলেও বিমূর্ত ছবি আঁকতাম আমি। ওগুলো আর সংগ্রহ করা হতো না। ওই আঁকা পর্যন্তই। এক্রেলিকে আঁকা, তেল রঙে আঁকা ছবি অনেকই দেখেছি। কিন্তু আমার প্রিয় মাধ্যম পেন্সিল, কালি-কলম এবং মার্কার পেন। আমার একটি বিমূর্ত ছবির টাইটেল ছিলো: এন ইমেজ ফ্রম অসীম্স লাইফ। নেই এখন আর। অন্য আরো কয়েকটি: ‘লিবারেশান’-ওইমেন: মেইড অব স্টোন-পানিশমেন্ট: গিভেন বাই নেচার। বিষয় হলো এই কুমিল্লা রেলস্টেশনের ওয়েটিং রুমে আমার অনেক রাত কেটেছে। বাউন্ডুলে জীবনও কাটিয়েছি। অর্থাভাবে এই কুমিল্লা শহরে অনেক দিনই আমার কোনো বাসা ছিলো না। অর্থহীন লোক আর সম্রাটদের কেউ থাকে না। তারা আসলে একাই। সেটা ভিন্ন ভিন্ন অর্থে। তাই মাঝে মাঝে আমার মনেও হয়, আমি যে এখনও বেঁচে রয়েছি, সে জন্যই বিধাতার কাছে কৃতজ্ঞ। চিত্রশিল্পী জয়নুল আবেদীন প্রথম কলকাতায় গিয়ে মসজিদে মসজিদে থেকেছিলেন। তার মা তার স্বর্ণের হার বিক্রি করে ছেলেকে কলকাতা পাঠান। খুব ধনী তো আর ছিলেন না। ছেলেবেলায় ছবি এঁকে প্রতিযোগিতায় পাঠানোর পয়সা জয়নুলের থাকতো না। তার বাবার ইচ্ছে ছিলো ছেলে দারোগা হোক। ছেলে হলেন চিত্রশিল্পী। বাড়িতে কাউকে না বলে এই জয়নুল তার শৈশবে কলকাতা আর্ট কলেজ দেখতে চলে গিয়েছিলেন। ১৯১৪ সালের ২৯ ডিসেম্বর তার জন্ম এবং মৃত্যু ১৯৭৬ সালের ২৮ মে। তিনি আজ বিখ্যাত হয়েছেন বলেই আমরা এসব জানি। তিনি হারিয়ে গেলে এসব ত্যাগের কথাও হারিয়ে যেতো। যেমন আমার ব্যর্থতার কারণে আমার ত্যাগ কোনো স্বীকৃতির আওতায় আসেনি।

২২| ১০ ই মে, ২০১৮ রাত ২:৫৩

জসীম অসীম বলেছেন: কবিতা:
‘মহুয়ার দাগ’
জসীম উদ্দিন অসীম

রচনা:
১৬ বৈশাখ ১৪১১
২৯ এপ্রিল ২০০৪
প্রথম প্রকাশ: ''পথ''
(সাহিত্য পত্রিকা)
১ম বর্ষ ১ম সংখ্যা
সম্পাদক: বাচ্চু বকাউল
জুন ২০০৪
কুমিল্লা।
=====
কোনো মানুষের জন্যই আমার
খারাপ লাগে না আর
কারণ আমি এখন আর মানুষ নই
পাথর
কলকব্জা
মেশিন
আজ থেকে দশ বছর আগে
কমপক্ষে দশ মধ্যরাতে
ঢাকার এক প্রাসাদোপম
দশতলা অট্টালিকার ছাদ থেকে
লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা
করতে চেয়েছিলাম
কেনো না
তখনও কিছুটা মানুষ ছিলাম আমি
তারপর এই বুকটাকে
কতোবার যে পেট্রোলওয়াশ করেছি
হায়!
এই বুকে তবু কিছু দাগ থেকেই যায়।
ঠিক গত বৈশাখেই ধর্মসাগরপথের
মহুয়া গাছটির প্রেমে পড়ি আমি
আর এ বৈশাখে মহুয়ার দাগ মুছে দিতে
আমি ঝাড়ুদার
যদিও পাথর আমি
অনুভূতিহীন
তবু বুকে কিছু কিছু দাগ থেকেই যায়
তবে
কোনো মানুষের জন্যই আর তেমন
খারাপ লাগে না আমার
এই এক মানুষ আমি
অনেকবার আত্মহত্যা করে
জীবদ্দশায় হয়ে গেছি লাশ
আজকাল প্রায়ই নেশা করি
করি ''লেট-নাইট''
দু' পেয়ালা দামী মদ
কখনো কখনো জীবন থেকেও
প্রিয় হয়ে যায়
বিপ্লবের স্বপ্ন দেখেও
দিব্যা ভারতীর আত্মহননে আমি
নিরবে খুবই কেঁদেছিলাম ঢাকায়
এখন মনে হয়
দিব্যা খুব ভালোই করেছিলো
এখন আমার প্রায়ই ইচ্ছে করে
রিভলভার দিয়ে নিজেই নিজেকে একবার হলেও
গুলি করে দেখি
মীনাক্ষী মহুয়া
মহুয়া মহাদেবী
আজ থেকে আর দেখতে আসবো না
তোমার কান্তিবতী রূপ
বসবো না আর তোমার সেই
অমরাবতী ছায়ায়
ক্রমাগত বেকার থেকে থেকেও
ডিপ্রেশনে ভুগি না কেনো আমি
কোনোদিনও তার
উত্তর জানবে না তুমি।

২৩| ১০ ই মে, ২০১৮ রাত ৩:০৫

জসীম অসীম বলেছেন: মাধবপুরের শঙ্করী
জসীম উদ্দিন অসীম:

প্রায় প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলায় আড্ডা হতো
মাধবপুরের শঙ্করী পাল তোমার সাথে।
এতো সুন্দরী মেয়ে হয়েও পড়তে তুমি
আইন কলেজেই।
অথচ তোমার পড়ার কথা সাহিত্য বা শিল্পকলা...
আমি তখন সিলেটের সেই
কিশোরীমোহন গার্লস হাইস্কুলের
একটি কাজ করি।
তারপর তো চলে গেছে পুরো একটি যুগ
আর তোমাকে কোথাও খুঁজে
পেলাম না শঙ্করী
তোমার কথা মনে হলেই আজও পুড়ে মরি।

২৪| ১০ ই মে, ২০১৮ রাত ৩:১৭

জসীম অসীম বলেছেন: (গল্প):
জিরো প্লাস জিরো প্লাস জিরো: ইকুয়েল টু জিরো।
0+0+0=0

জসীম উদ্দিন অসীম

রচনা: সেপ্টেম্বর ১৯৯৬,
পশ্চিমচানপুর, কুমিল্লা।

(1) মঞ্চাভিনেতা এক যুবক: সে মিথুন-কর্কট-সিংহ-কন্যা-তুলা-বৃশ্চিক-ধনু-মকর-কুম্ভ-মীন-মেষ-বৃষ…ইত্যাদি রাশি বিষয়ে কোনো বিশ্বাসই রাখে না। একদিন সেই যুবক স্বপ্নে দেখে, হ্যাঁ স্বপ্নেই দেখে, স্বপ্নে দেখে এক দেশে আছে এক দেশ: সমাজতন্ত্রের দেশ। কিন্তু সেই দেশটা এখনও পৃথিবীতে নেই। তৈরি হয়নি।এখনও স্বপ্নেই আছে সেই দেশ। তবু সেখানে কেউ সমাজতন্ত্রবাদকে ‘ব্যাকডেটেড রাবিশ’ বলে মন্তব্য করে না। সে দেশে যে দু’হাতে মুদ্রা উপার্জন করে, তার পা সবাই চাটে না। অবশ্য দু’হাতে মুদ্রা সে দেশে কেউ উপার্জন করে না। করার দরকারও নেই। এমনকি করার উপায়ও নেই। সেই দেশে সরকারি কারখানা লোকসানে পড়ে বিক্রি হয় না বেসরকারি খাতে। দরপত্র নিয়েও তাই কোনো প্রশ্ন নেই। নেই তাই ‘প্রাইভেটাইজেশন বোর্ড’ কিংবা ‘কমিশন’। এমনকি সরকারি জায়গা কাউকে দরপত্রের মাধ্যমে দেওয়া হয় না ‘লীজ’। সেই দেশে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসদের মতো সাহিত্যিকগণ ন্যায্য সম্মান পান।
সেই দেশে আছে একজন মঞ্চ অভিনেতা, যে কেবল স্বপ্ন দেখে থাকে। বাস্তব জীবনে সে স্নাতক শ্রেণির বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের ছাত্র হলেও থিয়েটার ছাড়া তেমন কোনো বিষয়েই ইদানিং আর লেখাপড়াও তেমন করে না। এ জগৎ-সংসারে সে মঞ্চ ছাড়া আর কিছুই বুঝতে চায় না।
তার মাথায় অনেক স্বপ্ন। অতল অতল উর্বর স্বপ্ন। স্বপ্ন কেবল মঞ্চের। চলচ্চিত্রের এই বিপুল প্রভাবের যুগেও চলচ্চিত্র তাকে টানে না। চলচ্চিত্র নির্মাতা ঋত্বিক কুমার ঘটক-সত্যজিৎ রায় সম্পর্কে সে যথেষ্টই জানে, কিন্তু তার মাথায় একদিকে যেমন শিশির ভাদুরীর মতো ব্যক্তিরা উড়ে বেড়ান, তেমনি তার স্বপ্নে তার মঞ্চে চরিত্র হয়ে আসেন হিমাংশু কুমার দত্ত, মাস্টার দা’ সূর্যসেন, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, অমলেন্দু বিশ্বাসসহ আরও আরও সমাজসচেতন দায়িত্বশীল ব্যক্তিগণ।
আকাশ সংস্কৃতির বাণিজ্যিক প্রবল প্রতাপের কাছেও সে হার মানে না। ‘মিডিয়া’ বা ‘মাধ্যম’ তার কাছে বিষয় নয়, তার কাছে বিষয় হলো ‘সমাজতান্ত্রিক আদর্শ’ অথবা ‘সাম্যবাদ’। আদর্শ না থাকলে মিডিয়ার প্রচার ক্ষমতা দিয়ে কী লাভ হবে? তার কাছে প্রতিটি আদর্শহীন মিডিয়া’ই অর্থহীন। ‘আগে তো আদর্শ, তারপরেই তো মিডিয়া।’
সে দেখে বাংলাদেশে সমাজতান্ত্রিক আদর্শ প্রতিষ্ঠিতও নয়, প্রতিষ্ঠিত হওয়ারও সম্ভাবনা নেই। সে আরও দেখে কেউ সৎ নেই এই দেশে, শুধুমাত্র শিশুগুলো ছাড়া। সবাই দুর্বৃত্ত: কী রাজা আর কী প্রজা।
মঞ্চ অভিনেতা ও বাংলা সাহিত্যের এ ছাত্রটি দেখে দেশে তার পছন্দের মতো কোনো মঞ্চও নেই। তাই সে মনে মনে একটি কল্পনার মঞ্চ গড়ে নেয়। সেই মঞ্চেও কখনো এসে গান গায় রবীন্দ্র-ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরা। রবীন্দ্রজয়ন্তী পালিত হয়, নিউক্লিয়ার বিদ্যুতের সংকট নিয়ে কেউ কথা বলে পাখি, বঙ্গোপসাগর কথা বলে মঞ্চেরই এক সক্রিয় চরিত্র হয়ে।1971 সালের রক্তাক্ত পদ্মা-মেঘনা-যমুনা নদী ইতিহাস বলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের, মঞ্চে উপস্থিত হয়েই। সে মঞ্চে সে কখনো কাক, কখনো বক, কখনো বা কুকুরকে তুলে দিয়ে দারুণ অভিনয় করায়। এমন করে করে সে এ দুর্বৃত্তের দেশে সকল নিরীহকে প্রতিবাদী করে তুলে তার স্বপ্নে।
তার এ রকম খেলাধুলা দেখে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা ড. শিলালিপি চট্টাভট্টাচার্য এবং ‘হায় হায় বিশ্ববিদ্যালয়ে’র চোট্টা উপাচার্য প্রধানমন্ত্রীর কান ভারী করেন। এ বিষয়ে উপদেষ্টাদ্বয় একটি সংবাদ সম্মেলন করতে এসে সাংবাদিকদের নৃশংস প্রশ্নবাণে বিদ্ধ হয়ে পেছনের দরজা দিয়ে দ্রুত পালিয়ে যান।
আর মঞ্চের যুবক অভিনেতা সেই যুবকটি তিন তাসের ম্যাজিক দেখায় না কাউকে, তবে মানুষকে ‘বীর সখিনা’র গল্প শোনায়। আরও শোনায়: কিভাবে বীর প্রীতিলতা বিষ খেয়ে মরে গেলেন অথচ ইংরেজদের হাতে অসম্মানিত হলেন না। যুবক অভিনেতাটি সবাইকে বলে, যুদ্ধাপরাধী গোলাম আজমের ছেলে আবদুল্লাহ হিল আমান আযামীকে কেন সেনাবাহিনীর চাকুরি থেকে বাদ দিয়ে দেয়া উচিত। যেহেতু বাংলাদেশে এখনও রয়েছে কিছু হিজল গাছ, স্বর্ণচাপা, অর্জুন, কদম, কৃষ্ণচূড়া, ছাতিম অথবা বটবৃক্ষ...তাই যুবকটি শ্বাস নিয়ে এখনও বেঁচে আছে।
কিন্তু একসময় থিয়েটার বিরোধী কিছু সংখ্যক মুসলিম উগ্র মৌলবাদী যুবকের হাতে বন্দী হয় মঞ্চের সেই অভিনেতা যুবকটি। বন্দী থাকলেও একদিন রাতের স্বপ্নে, ঘুমে, সে এমনই এক স্বপ্ন দেখতে শুরু করে যে, সে বড় আশ্চর্যময়। সে স্বপ্নে দেখে দেশের চীফ অফ আর্মি ষ্টাফ তার চাকুরি ছেড়ে রীতিমত বেকার জীবনযাপন শুরু করেছেন। এমনকি তিনি ব্যবসাও করছেন না, শুধু বনে বনে ঘুরে ঘুরে ভালোবাসার কবিতা লিখে যাচ্ছেন। আরও দেখেন, সেই আর্মি চীফ তুরস্কের ক্ষুরধার মোল্লা নাসিরুদ্দিনের সঙ্গে বেশ চুটিয়েই আড্ডা মারছেন। মঞ্চাভিনেতা এই যুবকটি যখন স্বপ্ন দেখে, তার সঙ্গে গাছের বড় শিকড়ের সঙ্গে যেন মিল রেখেই স্বপ্ন দেখে। গাছের বড় শিকড় অজস্র ছোট শিকড়ের জাল ছড়িয়েও তলায় অনেকখানি নেমে গিয়ে মাটির ওপর গাছকে খাড়া রাখে। এই যুবকের অজস্র স্বপ্নের জালও ছড়িয়ে ছড়িয়ে ও মাটির গভীরে নেমে গিয়ে কিংবা মহাশূন্যে উঠে গিয়ে তাকে যেন বাঁচার শক্তি সরবরাহ যোগায়। তার কল্পনাশক্তিও তীব্র। একাত্তরের শহীদদের স্মরণে কেউ যদি কখনো কোথাও কিংবা শহীদমিনারে মোমবাতি প্রজ্জ্বলনের ব্যবস্থা করে, তখন সে মনে মনে ওখানে গিয়ে মোমবাতির আলো হয়ে যায়।
তার ঘুমের স্বপ্নে মঞ্চে এসে হাজির হয় কয়েকজন অভিনয়শিল্পী, যাদের পারফরমেন্সে সে দারুণ মুগ্ধ হয়। স্বপ্নবিলাসী এ যুবকটির স্বপ্ন প্রায়ই এসে জীবনেই মিশে যায় কিংবা জীবন গিয়ে স্বপ্নের সঙ্গেই মিশে যায়। জীবন ও স্বপ্ন কিংবা স্বপ্ন ও জীবন, বাস্তব কিংবা পরাবাস্তব কখনো কখনো তার কাছে ঠিক সরলরৈখিকই হয়ে যায়।
এই যুবকটির একটি ডাকনাম আছে ‘অমি’। এ নাম ধরেই এবার তার গল্পটি বলা যাক। বিশ শতকের নব্বই দশকের অনেক চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য তার জীবনে ও মননে, অভিনয়ে ও স্বপ্নে বারবার খুঁজে খুঁজে পাওয়া যায়।
‘অমি’-র ঘুমের স্বপ্নের মঞ্চে, স্বপ্নের থিয়েটারের মঞ্চে এসে হাজির হয় কিছু ছিন্নমূল মানুষ। ছিন্নমূলদের একজন শিক্ষিত প্রতিনিধি মঞ্চে এসে বলে, আমাদের একটি বাড়ি নেই। অথচ বাড়ি আছে অর্থের বিনিময়ে রাতারাতি লাইসেন্স যোগাড় করা একজন অসৎ ড্রাইভারেরও। আমাদের মতো মানুষ কোনো কোনো ঘরে থাকে ধারণ ক্ষমতার চেয়েও বেশি সংখ্যায়: জেলখানার মতোই। অথবা অনেকটা যাত্রী বোঝাই লোকাল বাস গাড়ির মতো। সে আরও বলে, আমাদের কাগজপত্র নেই, ব্যাংক আমাদের ঋণ দেয় না। জমির বর্তমান দর খুব বেশি। বাড়িওয়ালাদের তালিকা থেকে আমাদের নাম তাই বাদ পড়ে যায়। খুব সহজেই । চারদিকে জমির বেআইনী হস্তান্তর প্রক্রিয়া। বিড়ি কোম্পানীর প্রভাবশালী মালিকও ক্রমাগত একটির পর একটি বাড়ি করে চলে। কেউ কেউ তিনটা-চারটা-পাঁচটা...বাড়িও করে যাচ্ছে। অথচ আমাদের জমি পাওয়া কিংবা নিজস্ব বাড়ি হওয়ার ক্ষেত্রে শত শত বাধা। আমরা আজ ভূমিহীন মানুষ। কোনোভাবে মাথাগোঁজার আশায়, দিনরাত একটি জমির, একটি ঘরের রঙিন স্বপ্ন দেখি। তাই সন্ত্রাসীরা যখন কোথাও জ্বালিয়ে দেয় কারো ঘর কিংবা বাড়ি, তখন আমাদের খুবই কষ্ট হয়।
‘অমি’ ছিন্নমূলদের শিক্ষিত প্রতিনিধির ভাষণ শুনতে শুনতে কিছুটা ক্লান্তও হয়ে যায়। মার্কসবাদে তার দারুণ আসক্তি থাকলেও অস্তিত্ববাদ, পরাবাস্তববাদ কিংবা ফিউচারিজম, নিও-রিয়ালিজম ইত্যাদি ইজম এসে অমি-র মাথাটাকে তেতুঁলের চাটনির মতো গুলিয়ে দেয়। অবশ্য তেঁতুলের চাটনির কিছুটা অর্থমূল্য থাকলেও ‘অমি’-র মাথাটার কোনো মূল্যই নেই মানুষের কাছে। কিছু মানুষ অমি-কে পাগল বলে। কখনো কখনো মনে হয় কথাটা যেন একটুও মিথ্যে নয়। কারণ এ জগৎ সংসারে অমি-র মতো এমন ভাবনার মানুষ আমি আর দ্বিতীয়টি খুঁজে পাই না। সুতরাং ‘অমি’ পাগলই। পাগল আসলে ঠিক ‘অমি’ একাই নয়, পাগল আমিও। এই ধরুন: লেখার পাগল।পাগল- লেখক। কারণ গল্পটি আসলে অমি-রও নয়, গল্পটি আমার নিজের। আর আমি নিজেও বাস্তবে হয়তো একটা পাগল। পাগল না হলে কেন এ গল্পের শুরুতে গল্পের মূল চরিত্রটির নাম দিতে পারলাম না? কিংবা বলতে পারলাম না গল্পটি আসলে আমারই। এমন লোককে লোকে কি মাথা খারাপ বলবে না অন্য কিছু বলবে? তবু অমি-র মাধ্যমেই আমি এ গল্পটি বলা শেষ করি।কারণ অনেকেই অমি-র সৃষ্টিকর্ম, নাটক কিংবা মঞ্চ নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করে। আর আমি আমার এ জীবনটাকে নিয়েই পরীক্ষানিরীক্ষা করছি। এটা কি এ সমাজে সুস্থ লোকের কাজ? এ বয়সের যুবকেরা যখন যুবতী নারী আর অর্থের পেছনেই ছোটে, তখন আমি পুঁজিবাদবিরোধী সংগ্রামে উত্তাল দিনের স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসি। আর ভালোবাসি কিংবা স্বপ্ন দেখি মার্কসবাদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য নিজেকে শহীদী আত্মাহুতি দেওয়ার। এ কথা এই রাষ্ট্রের কেউ জানলে আমার মাথা আর আস্ত রাখবে না? মোটরসাইকেল চালক ও আরোহীগণও কখনো কখনো হেলমেট ব্যবহার করেন। অথচ আমি রাষ্ট্রের চালক হওয়ার স্বপ্ন দেখলেও আমার কোনোই হেলমেট নেই। তাইতো অন্যেরা আমাকে মাথা-খারাপ বা উন্মাদ বলে অভিহিত করে। কিন্তু আমি ভাবি যে নিজেকে শহীদী আত্মা‎‎হুতি দেওয়ার স্বপ্ন দেখে, সে কি তার নিজের মাথার কথা কখনো ভাবে? কেন সে হেলমেট যোগাড় করবে? ...ইত্যাদি। তবে আমি হেলমেট যোগাড় না করলেও পকেটে কিন্তু মরিচের গুড়া রাখি। সুযোগমত যদি কখনো যুদ্ধাপরাধীকে পাই, কমপক্ষে তার চোখে তো ছিটিয়ে দিতে পারবো। মরিচের এ গুড়াগুলোই যেন আমার কাছে পিস্তল-বন্দুক-কামান। যখন সংবাদপত্রে কোথাও কোনো শ্রমিককে চাকরিচ্যুত করার খবর পড়ি, তখন আমার ঐ এলাকাকে রণক্ষেত্র বানিয়ে দিতে ইচ্ছে করে। কারণ আমিও নিজেকে একজন শ্রমিকই মনে করি। তাই প্রায়ই আমার কাজের মালিকদের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে তর্কাতর্কি হয়। আমি মালিকদের প্রভু মনে করি না, করি না অহেতুক শ্রদ্ধা। অথচ আমার প্রতিদিন ব্যবহৃত ভাষা কিন্তু শ্রমিকদের ভাষা নয়, কারণ আঞ্চলিক ভাষা আমার মুখে শোভা পায় না। এমনকি আঞ্চলিক ভাষাকে কাব্যিক রূপ দিয়ে বাংলা সাহিত্যে কবি আল মাহমুদ নতুনধারা সৃষ্টির অনবদ্য অবদান রাখলেও সেটা নিয়ে আমি অনেক মন্দ কথাও বলে ফেলি কখনো কোথাও। যাক, স্বপ্নের বিষয়ে আবারও আসি। ছিন্নমূল মানুষদের শিক্ষিত প্রতিনিধি মঞ্চে উঠে আরও বলতে থাকে, আমরা প্রতিদিন ঘর দেখি। আকাশ ছোঁয়া ঘর থেকে শুরু করে নৌকার ছইয়ের মতো ঘর। দেখি মাটির নিচের প্রাসাদ। অথচ আমাদের কোনো ঘরই নেই। নেই একটি গাড়ি। আমরা উচ্চবিত্ত পরিবারের মানুষের মতো এতোটা শৌখিন নই, তাই নকশাখচিত বাড়ির স্বপ্নে বিভোর নই আমরা। তাই কখনো খুব নেশাগ্রস্তও থাকি না। স্বপ্ন দেখি না কবিগুরুর কুঠিবাড়ির মতো বাড়িতে বসে রাশি রাশি কবিতা লেখার।
আমরা চাই ছায়াদার কোনো বৃক্ষের তলে সাধারণ একটি ঘর। সাধারণ একটি আশ্রয়। তারপর মঞ্চের সমস্ত ছিন্নমূল মানুষ সম্মিলিত কিংবা কোরাস কণ্ঠে বলে, আমরা খুব সংকটে আছি। আমরা এখনও ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ের শরণার্থী বাঙ্গালী। আমরা বেঁচে থাকতে চাই, অথচ আমাদের জীবন আজ খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। ঠিক তখনই
মঞ্চের ছিন্নমূল মানুষের মধ্য থেকে একটি নারীকণ্ঠ বলে, এ শহরে এ পৃথিবীতে আমাদের নিজস্ব কোনো জায়গা নেই, বাঁচার একটি চাকরি নেই, নেই নিজস্ব ছোটপুজিঁর কোনো ব্যবসাও। অথচ আমরা বাঁচার জন্য কতো শত রকমের কাজকর্ম করি। আমাদের নেই তাই নির্ধারিত পেশাও। আছে অনাহারে রাত কাটানোর যন্ত্রণা।
আমরা এ অগ্নিদগ্ধ পৃথিবীর মানুষ। তাই যখন চাঁদে পানির সন্ধানে এতো আয়োজন, তখন আমাদের বাড়িঘরের কোনো খবরই নেই। আমরা প্রতিদিন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বেঁচে থাকি। হয়তো নিঃসন্দেহে জীবনবিলাসী আমরা। তা না হলে এতো দুঃখেও কেউ বাঁচতে চায় না। কিন্তু আমরা বাঁচতে চাই। যদি আমরা লটারীতে ১০-৫০ লাখ টাকা পেয়ে যেতাম, তাহলে অনেক ছিন্নমূল মানুষের বাড়িঘরের স্বপ্ন বাস্তবায়নে সকাল-সন্ধ্যা ব্যস্ত হয়ে যেতাম। যেহেতু আমরা নিঃসন্দেহে জীবনবিলাসী মানুষ, তাই এতো অভাব-অনটনেও বাঁচতে ভালোবাসি। তারপর মঞ্চে এক দৃঢ় মৌনতা এবং অন্ধকার নেমে আসে।
আমি তখন প্রায় প্রতিদিনই রোজা রাখা এসব মানুষদের নিয়ে ভাবতে থাকি। রোদে পোড়া ফ্যাকাসে এসব মানুষ কারোর করুণা পায় না। যদিও সব শ্রেণির মানুষই একদিন দাহ হবে কিংবা মাটির বিছানায় মিশে যাবে। কিন্তু সে-তো মৃত্যুর পর। কিন্তু বেঁচে থাকা অবস্থায়তো পার্থক্য কোনোদিনও দূর হবে না।
যারা প্রতিদিন মৃত্যুর প্রহর গুণে বেঁচে থাকে, আমি এখনও মনে করি সমাজতন্ত্রের আদর্শ প্রচারে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় তাদের মুক্তি মিলতে পারে। এ নিয়ে কথা বলতে গেলেই বিভিন্ন মানুষের তোপের মুখে পড়ি আমি। কেউ বলে, যে শিশুর জন্ম হলো বিভিন্ন ক্রটি নিয়ে, তাকে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র কিভাবে ভালো করবে? কেউ বলে সমাজতন্ত্রের গ্রাহক যে বাড়াচ্ছো, কমিশন কতো পাবে? কী পাবে?... এসব শুনলে মাথা গরম হয়ে যায় আমার। কিছু লোক সব কিছুতেই স্বার্থ খুঁজে বেড়ায়।স্বার্থহীন কিছু জগতে রয়েছে বলেও তারা বিশ্বাস করে না।
আরেকটি বিষয়: অনেক ভেবেই দেখেছি আমিও: এই ২৬ বছর বয়সটিই কিন্তু রক্ত গরমেরই বয়স। এই যে আমারও এখন বিয়ে করারই বয়স। কিন্তু আমাদের এই অভাবের জনবহুল সংসারে কি এখন আমার বিয়ে করা সম্ভব? পরিবারের সব্বার স্বার্থ মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে? অথচ সমাজতান্ত্রিক দেশ হলে সম্ভবত রাষ্ট্র আমাকে বিয়ে খাতে নিশ্চয়ই ঋণ দিতো অথবা সহায়তা করতো কোনো না কোনোভাবেই। আমার কাছে এখন কোনো মেয়ের বাবাই তার আদরের মেয়েকে দেবে না। প্রয়োজনে কোনো অর্থে সক্ষম কিন্তু শরীরে অক্ষম বুড়োর সঙ্গেই দেবে: যে বুড়োর ইট-রড-সিমেন্ট কেনার ভালো সামর্থ্য রয়েছে। অথচ কন্যার বাবারা দেখবে না বুড়ো বরটির ঐ (...) ক্ষমতা নেই। আমাকে নিয়ে আমার বাবা-মায়ের অনেক আশা ছিল। কিন্তু দেশ-রাষ্ট্র-সমাজ-সংসার-ধর্ম-দর্শন-সাহিত্য-সংসংস্কৃতি...ইত্যাদি নিয়ে ভেবে ভেবে আমার মাথা খারাপ বলে, বাবা এখন আমার প্রতি খুবই হতাশ। মা বলেন, বাবারে, কী হবে এতোসব ভেবে? আমি মাকে বলি, মানুষের জীবনটা কোনো ডিপফ্রিজ নয় মা, যা এ কালের প্রায় সব যুবতীই ভাবে। এই দেশের সোনার ছেলে ক্ষুদিরাম বসু, সূর্য সেন, শহীদ রফিক, কর্ণেল তাহের, নূর হোসেনরা এই ডিপফ্রিজের জন্য তাদের সোনার জীবন বলি দিয়ে যায়নি মা। জীবনটা ভারতের অমিতাভ বচ্চন অভিনীত বাণিজ্যিক সিনেমা নয়। অথচ এই দেশে লুটপাটের নাম হয়ে গেছে জীবন। না খেয়ে মরে গেলেও এই লুটপাটে অংশ নিতে পারবো না আমি। কোনোদিনও না। মা বলেন, এইভাবে চিন্তা করলে তুই বাঁচবি কোনদেশে? শুধু একজন মানুষ তো এই দুনিয়া ঠিক করতে পারবে না। আমি বলি, আমি একা নই। পৃথিবীতে আমার মতো এমন ভাবনার মানুষ আরো আছেন। হয়তো তাদের সঙ্গে আমার এখন কোনো যোগাযোগই নেই। যোগাযোগ তৈরি করতে হবে। না হলেও দুঃখ নেই। কারণ তারা আমার মৃত্যুর পরে হলেও আমাকে চেনে নেবে। মা এসব শুনলে অবশ্য আর আলাপ চালায় না।
কিন্তু আমি ঘুমের স্বপ্নের মঞ্চে যেসব ছিন্নমূল মানুষের কথা শুনি, তা আমার রক্তে প্রবেশ করে। আমি যেন একাই দর্শক সেই মঞ্চ নাটকের। আমি তাদেরকে কিভাবে ক্ষতিপূরণ দেবো? এই জীবনে আমি কোনোদিন নির্বাচনেও ভোট দেইনি, দেবোও না কোনোদিন। কোনো চোরকে আমি ভোট দিতে পারবো না। প্রার্থীদের কাতারে কাতারে চোরের মুখ দেখে দেখে নির্বাচনের প্রতি ঘৃণাও তৈরি হয়েছে আমার। বমি আসে। তাই ব্যালটে নয়, বুলেটে বিশ্বাসী আমি। লুটেরা কেন নির্বাচনে অংশ নিতে পারে? ছিন্নমূল মানুষের জন্য ওরা কী করবে? বরং ক্ষমতায় গিয়ে লুট করবে আরও বেশি।
তবে আমি স্বপ্নের মঞ্চে দারুণভাবে উপভোগ করি ছিন্নমূলদের অভিনয়। আমার ইচ্ছে করছিল তখন, আমি নিজেই মঞ্চে প্রবেশ করে অভিনয়ের সঙ্গে যুক্ত হই। কিন্তু তার আগেই আলো জ্বলে উঠে মঞ্চে। দেখি মঞ্চে প্রবেশ করেছে চরিত্র হয়ে স্বয়ং ‘বাংলাদেশ’। বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকা আবৃত ‘বাংলাদেশ’ চরিত্রটি দেখে আমি ভেবেই পাই না এ আবার কেমন চরিত্র? একটি দেশ কিভাবে একটি চরিত্রের দায়িত্ব পালন করে এবং কথাও বলছে মানুষেরই মতো? এ কী করে সম্ভব? কিন্তু সম্ভব। মঞ্চে সত্যি সত্যিই এসেছে ‘বাংলাদেশ’। তবে তার মানচিত্রের সবুজ জমিনে বেয়নেটে চার্জ করার দাগ রয়েছে। চোখ রয়েছে কালো কাপড়ে বাঁধা। তারপরও ‘বাংলাদেশ’ কথা বলতে থাকে! ‘সমাজতন্ত্র ফেরৎ চাই আমার সংবিধানে। বিচার চাই সংবিধান ধর্ষণকারীর আজ। যারা এখনও এই আমাকে ধর্ষণের ‎‎হুমকি দেয়, কিংবা চিতায় ধু-ধু করে জ্বালিয়ে দিতে চায়, যারা চাষীর রক্ত করে পান, আমি তাদের মৃত্যুবরণে বাধ্য করতে চাই।'
কতোদিন যেন কোনঠাসা ছিলাম আমি। ‘বাংলাদেশে’র মুখে এমন শব্দগুচ্ছ পেয়ে ‘সাঁওতাল বিদ্রোহে’র কথা মনে পড়ে আমার। বাংলাদেশের মুখে এমন ইস্পাতদৃঢ় রক্তব্য শুনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের (টিএসসি) আড্ডার দিনগুলোর কথা মনে পড়ে আমার। তখনও আমার স্বপ্ন ছিল ঐ একটাই। থিয়েটারের মাধ্যমে দেশের জন্য কিছু একটা করা। পরে আমি সমাজতান্ত্রিক থিয়েটারের স্বপ্ন দেখতে থাকি। তখন থেকেই বিভিন্ন লোক বলতে থাকে, আমাকে নাকি কার্লমার্কস-লেনিন-স্ট্যালিনের ভূতে ধরেছে। আমি বলি, কিউবার ফিদেল ক্যাস্ট্রোকে কার ভূতে ধরেছে? আমি বলি, সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে গেছে ঠিকই। কিন্তু সমাজতন্ত্রের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক এখনও শেষ হয়নি। ঠিক একই রকম বক্তব্য শুনলাম মঞ্চের ‘বাংলাদেশ’ চরিত্রের মুখ থেকেও: ‘সমাজতন্ত্র ফেরৎ চাই আমার সংবিধানে।’ তাহলে আমার আর বাংলাদেশের চাওয়ার মধ্যে তো কোনো ফারাকই নেই। আমি তো কবরের স্বপ্ন দেখি না, জীবনের স্বপ্ন দেখি। আমি যখন ঢাকায় পড়ছিলাম, বাংলা বিভাগের অনার্স কোর্সের ছাত্র, তখন আমার দিনগুলো যেন স্বপ্নেই কেটেছিল। তখন দুঃখময়ী এ দেশের মানুষের মুখে হাসি দেখার স্বপ্নে আচ্ছন্ন ছিল আমার সব দিন। আমার সেই সব কৃতিত্বপূর্ণ দিনগুলোতে আমি মুদ্রার স্বপ্নে বিভোর থাকতে পারতাম। কিন্তু আমি শত দারিদ্রে বসবাস করেও মুদ্রার নেশায় নিজেকে হারিয়ে দেইনি। পাঁচ ফুট দুই ইঞ্চি উচ্চতার ১৭ বছর বয়সী মেয়ে ‘রূপালি’ তখন আমাকে নিয়ে পালাতেও প্রস্তুত ছিলো। কিন্তু আমি ছিলাম মানব-মানবীর প্রেমের নামে জুয়াখেলার বিপক্ষের একজন যুবক। সেই সময়ের থিয়েটারের প্রতি প্রেম আমার, সমাজতন্ত্রের প্রতি প্রেম আমার বারবার প্রত্যাবর্তন করেছে। তাই ঘুমের স্বপ্নে কখনো চড়েছি মধ্যরাতের ট্রেনে। কখনো দেখেছি মঞ্চে এসে কথা বলে ‘বাংলাদেশ’।
‘বাংলাদেশ’ আবারও বলতে থাকে: আর নয় স্বল্পতম মূল্যে মানুষ বেচা। আবার চাই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের জনসমুদ্র এই দেশে। এই উদ্যানে যেমন করে পাকিস্তানীদের মাথা নত করা হয়েছিল ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর, ঠিক সেভাবে শান্তি কমিটির হোতাদেরও আজকে ফাঁসি চাই। ফেরৎ চাই সমাজতন্ত্র আবার, আমার সংবিধানে। যে সংসদ মানে না সমাজতন্ত্র, মশাল ছুঁড়ে আগুন লাগাবো সেখানে। আগুন ধরিয়ে দেবো আমি শোষণের আদিম আইনে। লাল রক্তে রঞ্জিত হবে সংসদভবনের পথ। রক্ত যমুনা বয়ে যাবে শহর থেকে শহরে, যদি না আমার সংবিধানে সমাজতন্ত্র থাকে।
আমার বুকে আর চাই না বিকলাঙ্গ জাতি। আমি আজ হাড্ডিসার এক দেশ। এ দেশটাতে নিজের মাংস বেচার পেশার অবসান হবে কবে? মানুষ শিকারের অবৈধ অধিকার বন্ধ হবে কবে? অনেকবার আন্দোলনে আমার সন্তানের রক্ত ঝরেছে কেবল। যুদ্ধ-বিধ্বস্ত হয়েছি আমি অনেক। মেঘাচ্ছন্ন সংবিধানকে মেনে নেবো না আর। বন্ধ হোক মানুষ শিকারের অবৈধ অধিকার। সমাজতন্ত্র ফেরৎ চাই আমার সংবিধানে। আমি স্নিগ্ধ হয়ে উঠবো নির্মাণে নির্মাণে।
এভাবে বক্তব্য শেষ করে ‘বাংলাদেশ' যেই মঞ্চ ছেড়ে যাবে, ঠিক তখনই আমি মঞ্চে উঠে ‘বাংলাদেশ'কে জড়িয়ে ধরি। দেখি জাতীয় পতাকায় আবৃত ‘বাংলাদেশে’র শরীরে জড়ানো ভারতীয় অবৈধ শাড়ি। একি! তাহলে কি ‘বাংলাদেশ’ও এতক্ষণ মিথ্যেই বলে গেল? তবে কি এ ‘বাংলাদেশ' সমাজতন্ত্র চায়? নাকি আসলে চাওয়ার অভিনয় করে? মঞ্চকে একদা মন্দির-মসজিদ-গীর্জার মতো পবিত্র বলেছিলেন নাট্যকর্মী জন মার্টিন আমাকে। থিয়েটারের ওয়ার্কশপে। সে কথা এখনও আমার স্পষ্ট মনে আছে। জন মার্টিনকে আমি প্রথম বিটিভি-তে দেখি ১৯৮৯ সালে কবি কাজী নজরুল ইসলামের উপন্যাস ‘মৃত্যুক্ষুধা’ অবলম্বনে ধারাবাহিক নাটকে ‘প্যাকালে’ চরিত্রে। কাজী আবু জাফর সিদ্দিকী ছিলেন সেই নাটকের প্রযোজক। আজ এই জন মার্টিনের গীর্জাসম পবিত্র মঞ্চে দাঁড়িয়ে ‘বাংলাদেশ'ও মিথ্যে কথা বলবে? এ কথা সহ্য করবো না আমি।
কিন্তু না, একটু পরেই ‘বাংলাদেশ'কেও খুঁজে পাইনি আমি। যেতে যেতে ‘বাংলাদেশ' বলে, ‘বাংলাদেশ’ যেন এখন একটি চর। এই চরে চলছে লুটপাট। শান্তি অপহৃত। সমাজতন্ত্র কতো শত বছর পরে আসে, তার কোনো নিশ্চয়তাই নেই। এমনও হতে পারে, কোনোদিনও আসবে না কিংবা পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্নই হবে সমাজতান্ত্রিক আদর্শ। তখন তা আর সংবিধানে কী করে স্থান নেবে? তাহলে তুমি কিভাবে বুঝে নেবে তোমার সংবিধান থেকে সেই কাঙ্খিত সমাজের আদর্শিক নীতিমালা? মনে হয় সংবিধানে স্থান পাওয়া নয়, সমাজতন্ত্র সমাহিতই হবে।'
এসব শুনে আবার আমার মাথায় রক্ত উঠে। ছোটবেলায় একবার এক দুর্ঘটনায় আমার মাথা ছিদ্র হয়ে অনেক রক্ত ঝরেছিল। পরে তা জোড়া লাগলে আমার সাহস আবারও বেড়ে যায়। আমি তখন আমার সঙ্গীসাথীদের সঙ্গে ঝগড়া লাগলে মাথা দিয়েই আঘাত করতাম বেশি। বলতাম, এ মাথা আমার পরীক্ষিত মাথা। সেই থেকে এই মাথার ওপর চাপ বাড়ছে আমার। এখনও বিভিন্ন চাপ। সামলানোটাই আমার মাথার জন্য বিরাট চ্যালেঞ্জ হয়ে যায়। আমাকে সেই চ্যালেঞ্জের মুখে আবার ফেলে দিয়েছে এই মঞ্চের চরিত্র ‘বাংলাদেশ'। তার শেষের ভন্ডামি দেখে আমার মাথার শৈশবের সেই ছিদ্রপথে আবারও রক্ত ঝরে। অথচ ‘বাংলাদেশ’ এর মঞ্চে এসে সমাজতন্ত্রের জয়গান শুনে দারুণ রোমাঞ্চ অনুভব করেছিলাম। মঞ্চে এলেই কি ‘রাজনীতিবিদ'দের মতো সবাই মিথ্যেবাদী হয়ে যায় কিংবা হয়ে যায় সৎ চরিত্রাভিনেতা? আমি যদি মরিচচাষী হতাম, তাহলে ভাতের বদলে এমন মিথ্যেবাদীদের কমপক্ষে একমাসকাল শুধু মরিচ খাইয়ে বাঁচাতাম।
তারপর মঞ্চে আসে কৃষক। ততক্ষনে আমি আবার দর্শক সারিতে নেমে আসি। কিন্তু আমি কৃষককে ডেকে বলি, তোমরা কি প্রকৃতই কৃষক নাকি কৃষকের অভিনয় করছো? তোমাদের অভিনয় ভালো হচ্ছে না। থিয়েটার কিন্তু ছেলেখেলা নয়। থিয়েটার ধর্মচর্চার মতো। তাই ঐ মঞ্চে দাঁড়িয়ে মিথ্যে কথা বললে আমি এর প্রতিশোধ নেবো। এ মঞ্চের প্রেমে পড়ে পৃথিবীর অনেক মঞ্চপাগল তাদের জীবনের সব চাওয়া-পাওয়া ছেড়েছিলেন। আমিও আজ সেই পথেরই পথিক। তাই মঞ্চকে মিথ্যুকের মিথ্যার কলঙ্কে কলঙ্কিত হতে দেবো না।
আমার কথা শুনে এবার মঞ্চের কৃষক বলে, কৃষকের এ দেশে সবচেয়ে বেশি কোনঠাসা কৃষকই। এমন হলে কেমন করে এগিয়ে যাবে স্বপ্নের বাংলাদেশ। আপনারা সবাই যখন ঢাকায় বাড়ি করার স্বপ্নে বিভোর, তখন আমাদের জমি-বাড়ি গিলে খায় নদী। ফারাক্কার বাঁধের জন্য কার ক্ষতি হয়েছে বেশি? কৃষকের। জমিখেকো-ভূমিখেকোদের বড় শিকার কারা? কৃষক। আমাদের কেউ স্বেচ্ছায় রক্ত দেয় না। অথচ আমরা পুরো জাতিকে স্বেচ্ছায় খাদ্য-রক্ত দেই। অথচ আজ আমাদের কিছুই করার নেই। হাত-পা বাঁধা আমাদের। বিদ্যুৎ সংকটে আমাদের সেচ বন্ধ থাকলে উৎপাদনে যেমন ধস নামে, তেমনি আমাদের ফসলের দামও যায় কমে। এসব কথা সত্য। আমরা মিথ্যা বলা বুঝি না। নদীমাতৃক বাংলাদেশের কৃষক আমরা-পদ্মা-মেঘনার ভাঙ্গনের সঙ্গে লড়াই করে বাঁচি। নদীতে যখন তলিয়ে যায় জমি, তখনও স্বপ্ন দেখি। এই স্বপ্ন ছাড়া পুঁজি বলতে আজ আর আমাদের কিছুই নেই। পিঁড়িতে বসে ভাত খাই, মিথ্যা বুঝি না ভাই। আমরা যদি মিথ্যা করে বলি, বাংলাদেশে আর সত্য বলবে কারা?
আমি বলি, মিথ্যে কথা বললে মরে যাবে তুমি। পুড়ে যাবে এ মঞ্চ। এইতো সেদিন ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কলকাতার ‘স্টার থিয়েটার’ কেমন করে পুড়ে দগ্ধ হলো। অথচ শত তারকার মধুর স্মৃতিতে এ মঞ্চ ধন্য ছিল। সুতরাং সাবধান। এটা মঞ্চ। বাণিজ্য কমপ্লেক্স নয়। এখানে দাঁড়িয়ে মিথ্যে কথা বললে এ মঞ্চের সব নকশা খসে পড়ে যাবে। আমার কথা শুনে কৃষক বলে, আগুনে পোড়ালেও আমি সত্য বলে যাবো। মিথ্যা বলা বুঝি না ভাই। আগুনে পোড়ালেও আমি সত্য বলে যাবো। মুক্তির চূড়াবিহারী মানুষ আমি: আমরা। দেবতার নাম করে রাক্ষসে ভরেছে সমাজ। স্বৈরাচারী পদ্মা গিলে কৃষক-চত্বর আমার। প্রহৃত হৃদয় নিয়ে তারপরও মুক্তির কথা বলি। আগুনে পোড়ালেও এই মুক্তির কথা বলে যাবো ফ্রান্সের সেই মুক্তির দূত জোয়ান অব আর্কের মতো।
এবার বাংলার কৃষকের এ কথাগুলো শুনে আমার সত্যি ভালো লাগে। সরাসরি সমাজতন্ত্রের কথা সে না বললেও সব সময় অজ্ঞাতকুলশীল হয়ে থাকা এ শ্রেণির কোনো প্রতিনিধির মুখে এমন স্পষ্ট বক্তব্য আমাকে সত্যি আনন্দ দেয়। কারণ আমি প্রেমিক। থিয়েটারের এবং সমাজতন্ত্রের। এ বিষয়ে ভবিষ্যতে আমি অভিসন্দর্ভ রচনা করবো। নাট্যপরিচালক স্তানিস্লাভস্কি তাই এখনো আমার নিয়মিত পাঠের বিষয়। ‘দুর্বার নাট্যচক্রে’র কর্মশালায় এসে অভিনেতা আবুল হায়াৎ বলেছিলেন, ‘দেওয়ান গাজীর কিচ্ছা' একবার নয়, বারবার দেখবে মঞ্চে। তাহলে বুঝবে অনেকদিন পর পর নাটকের প্রোডাকশন। আমি আবুল হায়াতের থিয়েটার প্রেম অনুভব করি। এই পৃথিবীতে কারো ইশক নবীর প্রতি, কারো ইশক নারীর প্রতি। আর আমার ইশক বর্তমানে থিয়েটার ও সমাজতন্ত্রের প্রতি। তাই আমি যাকে পাই, তার কাছেই সমাজতান্ত্রির থিয়েটারের গল্প বলি। আমার বাবা বলেন, এটা সমাজতন্ত্রের দেশ নয়। তাই শেষ পর্যন্ত তুই আপোষ করতে বাধ্য হবি। আমি বলি, না। মরলেও না। বাবা কিছুটা ব্যঙ্গের রসে হাসেন। আমার তখন মনে হয়, তাহলে কি আমার বাবাও এই সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা পছন্দ করেন না? আমি আমার বাসার চে গুয়েভারার পোস্টারটিকে দরজায় এনে লাগাই। ‘অলওয়েজ ফর ভিক্টোরী। হোমল্যান্ড অর ডেথ।' “ইসলামী ব্যাংকে”র একজন কর্মকর্তা সেদিন আমাদের বাসায় এসেছিলেন অন্য কাজে। চে-কে দেখে বলেন, এটা তো কমিউনিস্টের পোস্টার। আমি বলি, এই বাসাটাও কিউবার আরেকটি দূতাবাস। সঙ্গে সঙ্গে আমি ভারতের কমিউনিস্ট নেতা জ্যোতি বসুর জীবনের কিছুটা উদাহরণ নিয়ে আসি। তাকে বলি, যদি পারেন, পশ্চিমবঙ্গের বিশিষ্ট চলচ্চিত্র পরিচালক ঋত্বিক কুমার ঘটক কিংবা মৃণাল সেনের কিছু ছবি দেখবেন। তাহলে বুঝবেন কমিউনিস্টরা কেন এতোটা শ্রদ্ধেয়। আপনারাই তাদের না বুঝে বদনাম করেছেন। সমাজ এখন যেভাবে অর্থবিত্তের দিকে ধাবমান, এটি একটি রাষ্ট্রের সঠিক পন্থা নয়।
কিন্তু এভাবে বলতে বলতে একসময় আমিও ক্লান্ত হই। এভাবে বলাটাতে কি কোনো মুক্তি আছে? একসময় আমার ঘুমও ভাঙ্গে। স্বপ্নও টুটে যায়। স্বপ্নে দেখা মঞ্চ নাটকের চরিত্রেরাও হারিয়ে যায়। যদিও মন থেকে মুছে যায় না তাদের বক্তব্য।
এ কেমন সময়: সবাই কেবল অর্থের পেছনেই দৌড়াবে? আদর্শের কি কোনোই মূল্যই নেই? আদর্শের অনুভূতিতে আঘাতকারী ব্যক্তিরা লুটেপুটে খাচ্ছে সব। এর সমাধানটা কী? শান্তি কমিটির লোকেরা এখন অনেকেই ‘জামায়াত ইসলামী’ করে। কিন্তু আমি দেখেছি।‘জামাতি হামলা’ও কম নৃশংস নয়। ওদের মধ্যেই প্রথম জীবনে সহিংসতা দেখি আমি। কিন্তু আমার প্রায়ই মনে হয় বিশ্ব ইজতেমা অভিমুখে লাখো মুসল্লির স্রোত যেভাবে নামে, সেভাবে যদি সারাদেশের সর্বস্তরের লোক সমাজতান্ত্রিক কোনো সম্মেলনে উপস্থিত হতো, কতো সম্ভাবনা ছিল। আমার এমন মতামত সেদিন আমার বর্তমান বসবাস স্থান কুমিল্লা শহরের পশ্চিমচানপুরের কিছু সংখ্যক লোকের সঙ্গে বিনিময় করার পর এলাকা থেকে আমাকে বহিস্কারের নিরব বিক্ষোভ শুরু হয়েছে। পরিস্থিতি বাবা কিছুটা সামাল না দিলে বিক্ষোভ সরবও হতে পারতো। কেউ কেউ মনে করেছেন, আমার মারাত্মক পতন হয়েছে। বলা চলে এ এলাকায় আমি অনেকটা নি:সঙ্গ হয়ে পড়েছি। ক্ষোভ থেকে কেউ কেউ আমার প্রতি বদলাও নিতে পারে। একজন সেদিন আমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলেছে, আমি মারা গেলে আমার লাশে নাকি সে প্রশ্রাবও করবে। ঠিক এই লোকটিকে এখনই আমি খুন করতে পারি। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে আইন-আদালত হলে আমার অসুস্থ মা আরও বেশি অসুস্থ হয়ে দ্রুতই মারা যাবেন। মাঝে মাঝে মনে হয় বৈষম্যহীন সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র পাওয়ার যোগ্য নয় এ জাতি। লাথি মারতে ইচ্ছে করে জঙ্গিবাদী তৎপরতার মদদদাতাদের বুকে। আমি ভালোবাসি সমাজতন্ত্র। মার্কসীয় নন্দনত্ত্বের আলোকে আমি কবিতা লিখি। টাকা পেলে ঠিক সেই ধারার ফিল্ম বানানোরও স্বপ্ন আছে। আমার এসব ভাবনার জন্য অসংখ্য লোক আমাকে সামনে পিছনে পাগল বলেও মন্তব্য করে। কিন্তু পাগল কি স্নিগ্ধ বকুলতলা ভালোবাসে? ঢাকার যাত্রাবাড়ি মোড় থেকে হাঁটতে হাঁটতে ২৫০ দক্ষিণ যাত্রাবাড়ির আব্বাস উদ্দিন রোডের তার বন্ধু আবিদ হোসেনের বাসার দোতলায় গিয়ে আড্ডা মারে, ভাত খায়? অথবা সেখান থেকে আবারও হেঁটে মতিঝিল জনতা ব্যাংক মোড়ে যায় কোনো প্রয়োজনীয় কাজে? অথবা ঢাকা নিউমার্কেটে যায় মঞ্চ নাটকের পাণ্ডুলিপি ফটোকপি করতে? কিন্তু আমি করি। তাহলে আমি কী রকম পাগল? আমার ইচ্ছে করে বন্ধুদের সঙ্গে বনভোজনে যেতে। কবিতার সবুজ আশ্রয়ে অনেক বড় হতে। কিন্তু আমার মেধার অনেক ফসল অবশ্য পোক্ত হওয়ার অনেক আগেই বিক্রি করে দিতে হয় বিভিন্ন মহাজনের কাছে। এর চেয়ে বড় ট্রাজেডি মানবজীবনে আর কী আছে?
প্রতিদিন হৃদয় আবদ্ধ হয় আরও বেশি সংকটের জালে। তারপরও সমাজতন্ত্রের স্বপ্ন দেখি আমি। ঐতিহাসিক বস্তুবাদ-দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ অধ্যয়নে যে পরিমাণ সময় খরচ হয় আমার, নিজের শরীরের প্রতি যদি তার অর্ধেকও ব্যয় হতো, আমার চেহারা-সুরত আরও ভালো থাকতো। সাহসের অভাবে বাগানে বাগানে ফুল ফোটা বন্ধ হয়ে গেলেও আমি সমাজতন্ত্রের সৈনিক হিসেবে
হলেও বেঁচে থাকতে চাই। আমার এমন নেশা বাস্তবসম্মত? নাকি আমি মিথ্যে কথা বলছি? নাকি দেখছি অলীক স্বপ্ন? অলীক কেন হবে? ভ্লাদিমীর ইলিচ লেনিন তো তা বাস্তবে দেখিয়ে গেছেন। রাশিয়ায় । ১৯১৭ সালে।
আমাদের সমাজ জীবনের কৃষকেরা আজ এতটা সাহসী নয়। দুর্গন্ধযুক্ত সমাজ তাদেরকে যেন কোনো পীড়া দেয় না। তাদের সাহস আজকাল ক্রমাগত শুকিয়ে শুকিয়ে মরু হতে দেখেছি আমি। দেখেছি আরও সব আদর্শের বড় আদর্শ হয়ে গেছে টাকা। কুত্তার বাচ্চা টাকা। টাকা পেতে আর জীবন ধরে রাখতে ঢাকা শহরের দিকে প্রতিদিন মানুষের যেভাবে স্রোত নামে, তা অবাক করার মতো। তাহলে শক্তি বেশি কার? টাকার নাকি আদর্শের? টাকা হলে কি আদর্শও কিনতে পাওয়া যায়? এসব প্রশ্নের সঠিক উত্তর এখনও পাচ্ছি না আমি।
কারণ চোখের সামনেই টাকার কাছে বিক্রি হয়ে গেছে মন্দিরের প্রতিমা, বৌদ্ধমূর্তি। কোথাও কোথাও জন্মভূমির মাটির গন্ধ। টাকার জন্য এ দেশ এখন বাজার, বিভিন্ন গোষ্ঠীর। অথচ এ দেশ লক্ষ শহীদের রক্তে সিক্ত দেশ। আজ হয়েছে টাকার উপনিবেশ। টাকার কাছে বিপন্ন আজ লেখক, লোকগায়কের সুর। বৈপ্লবিক যাবতীয় পদক্ষেপ।
মায়াবী জালের এমন টাকার সঙ্গে লড়াই করে টিকে থাকতে পারবো? টাকার অভাবে কতো পরিবারের জমজমাট আড্ডা মরে গেছে। ফুল ফোটানোর আগেই মরেছে শত গোলাপ গাছ। টাকার কাছে বিক্রি হয়ে পূর্ব পাকিস্তানের বিদ্রোহী আত্মা স্বাধীন বাংলাদেশে আবার হা

২৫| ১০ ই মে, ২০১৮ রাত ৩:২৬

জসীম অসীম বলেছেন: (গল্প):
জিরো প্লাস জিরো প্লাস জিরো: ইকুয়েল টু জিরো।
0+0+0=0

জসীম উদ্দিন অসীম

রচনা: সেপ্টেম্বর ১৯৯৬,
পশ্চিমচানপুর, কুমিল্লা
(পূর্বের অংশের পরের অংশ)
মায়াবী জালের এমন টাকার সঙ্গে লড়াই করে টিকে থাকতে পারবো? টাকার অভাবে কতো পরিবারের জমজমাট আড্ডা মরে গেছে। ফুল ফোটানোর আগেই মরেছে শত গোলাপ গাছ। টাকার কাছে বিক্রি হয়ে পূর্ব পাকিস্তানের বিদ্রোহী আত্মা স্বাধীন বাংলাদেশে আবার হানা দেয়। পুঁজিপতি এ টাকা দিয়ে প্রতিদিন মানুষে মানুষে বৈষম্যের প্রাচীর গড়ে যায়। তার বিপক্ষে গেলে বুলেটে-বেয়নেটে স্তব্ধ করে দেয় প্রতিবাদী মানুষের কণ্ঠ। টাকার অত্যাচারে গণজীবন আজ ফাঁকা। জীবনে-মরণে-স্বপনে-গগনে কেবলই টাকার খেলা। এই টাকার নেশায় অনেক মানুষ বর্জন করে সত্য-অর্জন করে মিথ্যা। টাকার সৌরভেই পুঁজিপতির এত গৌরব আজ।
এই দেশে সমাজতন্ত্রের সৈনিক কিভাবে হবো, এ নিয়ে দুশ্চিন্তাও রয়েছে। কারণ টাকার কাছে যেভাবে বিক্রি হয়ে যায় শোষিত মানুষের মুক্তির সনদ, নবজন্ম নেয়া স্বৈরাচার, নারী নির্যাতন, বাড়ে নারী পাচার, পিস্তল আর পাইপগান সঙ্গী হয় গরীব বেকার যুবকের, সাংবাদিকের জীবনঝুঁকি বাড়ে, তাতে কিন্তু আমার আশঙ্কা এবং হতাশাও বাড়ে। বন্য মানুষও ধন্য হয় টাকার গন্ধ পেলে। হিসেব করে না সে টাকাতে আদর্শ আছে কী না। আদর্শ থাকা আর না থাকার মাঝে, সাদা আর কালো টাকার ভীড়ে স্থির থাকাটাই তো কঠিন। পুঁজিপতিরা যেভাবে কোটি শোষিত মানুষকে উলঙ্গ নৃত্য দিয়ে আপ্যায়ন করে, তার বিপক্ষে আদর্শ নিয়ে টিকে থাকা বড় কঠিন। টাকায় বাঘের দুধ পাওয়া গেলেও সব মায়ের দুধ বিক্রি হয় না। বিক্রি হয় না দুর্জয় শক্তিতে শক্তিমান বায়ান্নের রক্তে রাঙ্গা ঢাকার রাজপথ, সুহৃদ প্রকাশক, সজ্জন সম্পাদক ও একজন সাহসী কবি। আমি এমনইভাবে বিশ্বাস করি। সত্যি সত্যি কি আমি এভাবে বিশ্বাস করি? তাহলে সত্য কথাটাই বলি। আমি ঠিক জানি না। এতো যে সমাজতন্ত্রের বুলি শোনা গেল আমার মুখে, সেই আমিও কি সমাজতন্ত্রের সৈনিক হওয়ার যোগ্যতা রাখি? না রাখি না কিংবা জানি না। কারণ উদয় হওয়ার আগেই যদি অন্য অনেকের মতো নিজেকেও দেখি অস্তগামী সূর্যের সমান্তরালে, তাহলে এর কী বিশ্লেষণ করবো? কিছু উগ্রবাদী লোক, অবশ্য আমিও উগ্রবাদী তবে ওদের মতাবলম্বী নই। আমাকে যখন সেদিন রাতে পথ আটকে বললো, শুধু তোর জিহবা এবং ডান হাতটিই আমাদের শত্রু। তাই আজ এই রাতে তোর ওই দুইটি অঙ্গ আমরা কেটে নিয়ে যাবো। আমি তখন ভয়ে থরথর করে কাঁপতে শুরু করি। আমার স্বপ্ন থেকে ক্যামেরার শাটার স্পীডের এক সেকেন্ডের এক হাজার ভাগের এক ভাগ সময়ের মধ্যেই হাওয়া হয়ে যায় নীল অপরাজিতা ফুলের রঙ। আমি বলি, আমি আর কক্ষনোই যুবক ছাত্রদের কমিউনিজম বুঝাবো না।
উগ্রবাদীদের একজন বলে, আমরা বলি কী, আর আমাদের সারিন্দা বলে কী।
আমি বলি, আমি আর কক্ষনোই আপনাদের বিরুদ্ধে কথা বলবো না। কোনোদিনই না।
তাদের একজন চোখজোড়া তার লালপদ্মের মতো রং করে বলে, তুই নাকি লেনিনের ভূতের সাহাবী?
এ কথা শুনে তাদেরই কয়েকজন হেসে ফেলে। একজন তার ছুরিটা আমাকে বারবার দেখায়। আমার তখন যীশুর ক্রুশের কথা মনে পড়ে। যদিও যীশুর সাহসের লক্ষভাগের একভাগও পাইনি আমি। হঠাৎই আমার মাথার উপর দিয়ে ‘চৈতার মাগো' টাইপের কী একটা পাখি ডেকে উড়ে গেল। কিন্তু এ পাখি তো চৈত্রমাসে ডাকে। তবে কি আমি ভুল শুনলাম? হয়তো ভয়ে মাথা ঠিক নেই আমার। অবশেষে ওরা আমাকে কিছু শর্ত দিয়ে ছেড়ে দিলো। আমার ভয় পাওয়া নিয়ে ততক্ষনে ওরা তামাশাও জুড়ে দিয়েছে। আমি একবার ফিরেও তাকালাম না ওদের দিকে। ভদ্রছেলের মতো ধীরে ধীরে বাসার দিকে আসতে থাকলাম।
বর্তমানে আমার কোনো স্ত্রী-সন্তানও নেই। অর্থবিত্তও নেই। এই দেশে মন্ত্রী কিংবা রাজা হওয়ারও সম্ভাবনা নেই। তাই হারাবারও কিছু নেই আমার। অথচ সেই আমিই সেদিন মধ্যরাতে বাসায় ফেরার পথে কোনো এক নির্জন স্থানে অঝোর বৃষ্টির লগ্নে একাধিক জঙ্গির কবলে পড়ে জীবনভিক্ষাও চেয়েছি। একবারও ভাবলাম না আমার দেশগড়ার মিশনে ওরাই অন্যতম বাধা। অথচ আমি তো এতদিন ধরে বীরত্ব লালন করেছি। লজ্জাবতী বানরের মতো কেন ফিরে এলাম। কেন আমি প্রতিবাদ করতে গিয়ে মরতেও সাহস দেখালাম না। শুধু কি সেটা নিরস্ত্র ছিলাম বলেই। তবে কি এই দেশ বীরশূন্যই হয়ে যাবে? মনে হয় এখনই বুঝি এই দেশে, এই গ্রহে যুবকদের দালাল হওয়ার সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ সময়?
আমার এতদিনের তুঙ্গ দাপট একাধিক জঙ্গির প্রাণনাশী ‎হুমকিতে পিছিয়ে পড়েছে। বুঝলাম, বাঁশের চেয়ে যেমন কঞ্চি বড়, তেমনি আমার আদর্শের চেয়েও গলাবাজি বড়। শেষ পর্যন্ত আমিও প্রমাণ করলাম আমার জীবনের, সংগ্রামের, স্বপ্নের ফলাফল জিরো। সমাজতন্ত্রের প্রতি কিংবা থিয়েটারের প্রতি আমার যে ভালোবাসা, তার নিরীক্ষা করে আমি বুঝেছি, আমার চেয়ে একটি শিম্পাঞ্জিও আদর্শ প্রেমিক। একটি লেখার খাতা কিংবা বিরল প্রজাতির কোনো কচ্ছপের মূল্যও আমার চেয়ে বেশি। কারণ জীবনের প্রথম প্রান্তেই যদি জীবনের শেষপ্রান্তের চেয়ে বেশি মৃত্যুভয় কাজ করে, তাহলে এ কলঙ্কের বোঝা কোথায় রাখা যায়? সুতরাং এ কথা নিশ্চিত আমি আর সফল হবো না। ফলাফল জিরো। জিরো প্লাস জিরো প্লাস জিরো, ইকুয়েল টু জিরো। বিপ্লবের ফাঁকা বুলি স্রেফ ভন্ডামি মাত্র।

২৬| ১০ ই মে, ২০১৮ রাত ৩:৩৮

জসীম অসীম বলেছেন: I'm not human.
Jashim ashim

I'm not human.
Brick...sand...stone.
I have no regrets.
because I don’t have any feelings.
It’s better to have no feelings.
If you have feelings,
then you have to become human.

২৭| ১০ ই মে, ২০১৮ রাত ৩:৪৮

জসীম অসীম বলেছেন: DO YOU REALLY GET ME
JASHIM UDDIN ASHIM

DECEMBER 1992
SHABAG
DHAKA.

COMPOSITOR: ZAHIR SHANTO: 2004.

''RUPALI
I’LL LOSE ONEDAY
BUT MY LOVE WILL
NEVER LOSE

RUPALI
YOU ARE A PASSPORT
IN MY LIBERATED EARTH.
YOU ARE A FULL MOON
DAY OF THE MONTH OF SHRAVANA.

MY FULL MOON DAY OF PHALGOON
I'M A ORPHAN IN THIS TIME
BUT I CAN CREATING NOISE.

MY PASSPORT RUPALI
YOU ARE MY COSMOS CREATION
& FLAG OF LIFE
BANNER OF TIME
IDENTITY FOR WHOLE LIFE
END OF THE NIGHT.

MY GODDES RUPALI
I’M FIXED DAY AND NIGHT
FOR YOU.
MY WINDOW RUPALI
YOUR NOVELTY
ART AND DUNCING
BLUE LOTUS EYE
VERY BEAUTIFUL
YOU ARE A FERRY WOMAN
IN MY LIFE
SO I WANT YOUR SOFTNESS MIND.

RUPALI
YOUR SWEET VOICE
AS THE SOFT TOUCH OF FLOWERS.
YOU ARE LIGHT
OF THE WORLD IN MY LIFE
& YOU ARE A LOVE OF GODDESS
GODDESS OF LOVE.
BUT I WANT TO KNOW
DO YOU REALLY GET ME ANYTIME?
OR DO I GET YOU?''

২৮| ১০ ই মে, ২০১৮ রাত ৩:৫৬

জসীম অসীম বলেছেন: রেবেকা: পদ্মদিঘির জলে

সাদিয়া অসীম পলি:
==========================================================================
উপন্যাসের মতো শিল্পকর্ম সৃষ্টির ক্ষমতা আমার নেই। কিন্তু একজন লেখক ও সাংবাদিকের কন্যা হিসেবে এবং একজন লেখকের স্ত্রী বলে আমাকে জন্মের পর প্রায় সারাক্ষণই লেখার সঙ্গে থাকতে হয়েছে। বিশেষ করে সংসার জীবনের প্রথম দিকে আমার স্বামী জসীম উদ্দিন অসীমের অনেক লেখা নতুন করে নতুন খাতায় লিখতে গিয়ে আমার হাতে একধরনের গতি আসে। যেমন ছেলেকে আঁকা শেখাতে গিয়ে আমি এখন আঁকতেও ভালোবাসি। সর্বশেষ রয়েছে পাঠের বিষয়টি। অসীমের বিশাল গ্রন্থের ভান্ডার তার ব্যক্তিগত বিভিন্ন দুর্বিপাকে নষ্ট হলেও আমি যা পেয়েছি, তা নিয়েই শুরু হয় আমার পাঠের অন্য এক অভিযান। বিশেষ করে যখন আমরা মা-ছেলে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র এর ভ্রাম্যমান পাঠাগারের সদস্য হই, তখন বুঝি পাঠের রাজ্যের আনন্দ পরম ধন। এই পৃথিবীতে যারা শুধু জন্ম নিয়েছে অর্থের জন্যই, তাদের সঙ্গে আমাদের জীবনের কোনো তুলনাই চলে না। ভোগের এই পৃথিবীতে আমরা স্বামী-স্ত্রী ও আমাদের সন্তান ‘অপূর্ব’ মিলে অন্য এক উপভোগের আনন্দময় জগৎ তৈরি করে নিয়েছি। দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদারের ‘ঠাকুরমার ঝুলি’র অসংখ্য গল্প আমরা মা ও ছেলে রীতিমত পড়তে পড়তে মুখস্থ করে ফেলেছি। শুকপাখির গল্প, ব্রহ্মদৈত্যের গল্প, শাকচুন্নীর গল্প, ডাইনি বুড়ির গল্প থেকে শুরু করে কমিউনিস্ট সোমেন চন্দের লেখা। ফ্যাসিবাদীরা সোমেনকে যেভাবে মারে, তার বিবরণ পড়ে অনেকদিন পর্যন্ত ভুলতে পারিনি। জিম করবেটের ‘কুমায়ুনের মানুষখেকো’ ছিলো আমার শ্বশুরের প্রিয় গ্রন্থ। তারপর তা আমার স্বামীরও প্রিয় হয়ে যায়। সর্বশেষ আমি জিম করবেট পড়তে গিয়ে অন্য রকম রোমাঞ্চ অনুভব করি। আমার শ্বশুর মোহাম্মদ কফিল উদ্দিন যদি আজ বেঁচে থেকে দেখতেন যে, তার পুত্রবধূ তার প্রিয় এমন একটি গ্রন্থ এতো আগ্রহ নিয়ে পড়ছে, তাহলে নিশ্চয়ই আনন্দিত হতেন। যখন নিকোলাই অস্ত্রভস্কির ‘ইস্পাত’ পড়ি আমি অথবা চে গুয়েভারার ডায়েরি, তখন বহির্বিশ্বের লেখার সঙ্গেও কেমন যেন আপন হয়ে মিশে যাই। আমার স্বামী-দেবর-ননদরা মিলে তাদের পরিবার থেকে ‘সংশপ্তক’ নামে একটি সাহিত্য পত্রিকা বের করতেন। সেটা ১৯৯৭ সাল থেকে। যদিও পরে সেই পত্রিকা অনিয়মিত হয়ে পড়ে। আমার দাদাশ্বশুরের পেশা ছিলো দলিল লেখা। কিন্তু সেই বৃটিশভারতের শেষের দিনগুলোতেও তিনি ছিলেন একজন প্রসিদ্ধ পুঁথিপাঠক। আমার শ্বশুরের এলাকায় গেলে এখনো মানুষের মুখে মুখে আমার দাদাশ্বশুরের এবং আমার শ্বশুরের নানা গল্প শুনি। আরও শুনি জ্যাঠাশ্বশুরের কতো গল্প। তাদের পুরো বংশটাই সাধকদের এক বংশ। জ্যাঠাশ্বশুরের নাতি ‘মিরাজ’ তার পুরো জীবনই উৎসর্গ করেছেন লৌকিক এবং পারলৌকিক জ্ঞান অর্জনের জন্য। গ্রামে ঘুরে এলেই আমার আবার দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদারের কথা মনে পড়ে। তার ‘ঠাকুরমার ঝুলি’ ভীতু ভূত, মানুষ খেকো দৈত্য, পোস্তমনির গল্প, মনিমালার গল্প, ব্যাঙ রাজকুমার ... ইত্যাদি গল্প মনে পড়ে। বিদেশি রূপকথাও এরই মধ্যে আমার অনেক পড়া হয়েছে। কিন্তু আমার আর আমার ছেলে অপূর্বের মনে দাগ কেটেছে হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান অ্যান্ডারসেনের বিভিন্ন গল্প। অ্যান্ডারসেনের জন্ম ডেনমার্কে। ওই দেশটিতে জীবনের অনেকগুলো একদা কাটিয়ে এসেছিলেন আমার পিতা ভাষাসৈনিক মোহাম্মদ উল্লাহ। (চলবে)।
================================================
(১)
রেবেকা কি পাখি নাকি ভূত? নাকি রেবেকা রেবেকাই আছে? এই প্রশ্নগুলো এখন গ্রামের মানুষের মুখে মুখে। কারণ রেবেকার এক বৃদ্ধা আত্মীয়া নাকি রেবেকাকে একদিন ভরদুপুরে আস্ত একটি জ্যান্ত পাখি চিবিয়ে খেতে দেখেছে। কিন্তু ঘটনাটি যে দিনের, সেদিন সে সময়ের, রেবেকা সেদিন ছিলো কলেজে এবং সেদিন সে ফিরেছিলো একেবারেই সন্ধ্যের আগে। রেবেকাদের গ্রামে এমনিতেই পাখির কোনো কমতি নেই। কিন্তু ‘রেবেকা পাখি গিলে খেয়েছে’ কথাটি প্রচার হওয়ার পর থেকে গ্রামে যেন হরেক রকম পাখির সংখ্যা আরও বেড়ে গেছে। পদ্মদিঘিতেও মনে হয় আরও অনেক পাখি এসে জুটেছে। আর এরই মধ্যে একদিন রেবেকা গেলো পদ্মদিঘিতে স্নান করতে। স্নান শেষে জল আনতে। কিন্তু কি ছিলো সেই রেবেকার শরীরের ছায়ায়? জলে নামামাত্রই জল থেকে সকল জলচর পাখি উড়ে দূরে চলে গেলো। এমনকি পদ্মদিঘির মাছগুলোও ভয়ানক লাফাতে শুরু করলো। লাফাতে লাফাতে একেবারে জলের উপরেই চলে এলো। কিন্তু যেহেতু মাছেদের পাখিদের মতো পাখা নেই, তাই তারা আর উড়তে পারলো না। আর এই দৃশ্য সকলের চোখে পড়লেও দেখলো না শুধু রেবেকা। তাই সে একেবারেই স্বাভাবিকভাবেই স্নান সেরে, জল নিয়ে বাড়ির পথ ধরলো। কিন্তু বাধ সাধলো এক কালো কুকুর। হিংস্র দৃষ্টিতে রেবেকার পথের ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে সে। সহসা কোথা থেকে উদয় হলো এই জানোয়ার? রেবেকার মনের প্রশ্ন। যেন সে দিঘির জল থেকেই উঠলো মাত্র। কারণ তার সারা শরীরও ভিজে রয়েছে। এমনকি কালো চামড়া বেয়ে টুপ টুপ করে ফোঁটা ফোঁটা জলও পড়ছে। এই কুকুরকে দেখে রেবেকা ভীষণ ভয়ই পেলো। সময়টা তখন একেবারেই ভর দুপুর। এদিকে পদ্মদিঘির জল থেকে রেবেকা উঠামাত্রই আবার জলচর পাখিরা এসে নামলো জলে। কিন্তু রেবেকা যে এখন বাড়ি যাবে, সেই অবস্থাও নেই। ঘাড় ঘুরিয়ে একবার পদ্মদিঘির জলের দিকে তাকালো রেবেকা। কিন্তু ঘাড় ফিরিয়ে আবার বাড়ির পথের দিকে তাকাতেই দেখে কালো কুকুরটি আর নেই। ভয়ে রেবেকার শরীরের সব লোম দাঁড়িয়ে গেলো। কোথায় গেলো কুকুরটি? মুহূর্তেই হাওয়া হয়ে গেলো? কুকুরটি পথে না থাকাটা রেবেকার জন্য একটি শুভ লক্ষণ হলেও রেবেকার বিষাক্ত কৌতুহলই এবার রেবেকাকে বিপদের দিকে টেনে নেয়। এক মুহূর্তেই হাওয়া হয়ে গেলো কালো হিংস্র কুকুরটা? তবে কি এটা কুকুর ছিলো না? রেবেকার এমন কৌতুহল রেবেকাকে ভীষণই তাড়া করে। এমন সময় রেবেকা দেখলো পদ্মদিঘির কোনায় ঘাসের ঘন একটি ঝোপে ঘাসগুলো কেন যে নড়ছে। রেবেকা বুকে সাহস নিয়ে এগিয়ে গেলো সেদিকে। গিয়ে দেখলো কালো হিংস্র কুকুরটা কোনো এক কবর খুঁড়ে শিশু বাচ্চার নতুন লাশ তুলে এনে মচমট করে খাচ্ছে। কিন্তু রেবেকাকে দেখেই খাওয়া বন্ধ করে দিলো কুকুরটা। রেবেকা তখন ভয়ে ‘মাগো’ বলে চিৎকার করে লাফিয়ে গিয়ে পড়লো পদ্মদিঘির জলে। সঙ্গে সঙ্গে জলচর পাখিরা আবার উড়ে দূরে হারিয়ে গেলো। (চলবে)।

২৯| ১০ ই মে, ২০১৮ রাত ৩:৫৯

জসীম অসীম বলেছেন: Rope One Way Two
Jashim uddin Ashim
April: 1993
Dhaka.

When our goal is different
then we became animal.
& then we tell our brothers that
they're our big enemy.
alas!
but why?
If we could stay in peace
but that’s not possible
becase we are animals
always.
& It's never a good sign

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.