নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

চলো আমরা পাখিদের কাছ থেকে ইউক্লিডের নতুন পাঠ নেই জীবনানন্দের পাঠ নেই নিউটনের আপেল গাছটি থেকে।

জসীম অসীম

লেখা হলো কেতকীফুল। ভালোবাসি তাই।

জসীম অসীম › বিস্তারিত পোস্টঃ

মন তার যাযাবর পাখি

২০ শে জুলাই, ২০১৫ দুপুর ২:২০

অক্টোবর ২০০২, কুমিল্লা।
প্রথম পর্ব:
ডিঙডিঙা বিল, ডাহুকে ভরা। আছে অনেক বুনোহাঁস। বিলের পাশের ডুগডুগি বাজারেও পাখি বিক্রি হয়। এলাকার অনেকেই জাল দিয়ে ফাঁদ পেতে পাখি ধরে থাকে। কিন্তু হাশেম পাখি ধরে নিষ্ঠুরভাবে। সিদ্ধ ধানে বিষ মেখে ছড়িয়ে দেয়। তারপর যা করার, তা-ই করে। নলখাগড়ার বনে, হোগলাবনে হাশেমকে দেখলে তাই অনেক পাখিই সাবধানসূচক ডাকাডাকি করতে করতে পালিয়ে যায় দূরে। অথচ আগে এই ডিঙডিঙা বিলের প্রায় প্রতিটি পদ্ম-শাপলার পাতায় পাতায়, কলমি কিংবা কাশেরঝোপে পাখিরা উড়ে ঘুরে খেয়ে নেচে বেড়াতো।
ডুগডুগি বাজার থেকে আরও দশমাইল জেলাসদরের দিকে গেলে সুলতানপুর বাজার। হাশেম ওখানে দর্জির কাজ করতো। বাজারের পাশেই ছিলো হিন্দুদের নমশূদ্র পাড়া। ওখানেই নন্দিনী দাসের সঙ্গে পরিচয় ও প্রেম। তারপর পালিয়ে গিয়েছিল শহরে। মুসলিম মতে বিয়ে করে এখন আবার ফিরে এসেছে নিজের গ্রামে। কিন্তু কাজকর্ম সে করবেটা কী! কারণ বাড়িতে তার পৈতৃক একখন্ড ভিটা ছাড়া আর কিছু নেই। কোনোকিছু পরিকল্পনা না করেই নন্দিনী ওই ভিটায় শুধু গাছ লাগাতে থাকে। সেগুন, শাল, নিম, মেহগিনি ইত্যাদি গাছের চারায় বাড়িটাকে সবুজ করে তোলে। নন্দিনী হাশেমকে বলে, তুমি বাইরে গিয়ে কিছু একটা ধরো। আমি তোমার এই বাড়িটাকে যতেœ যতেœ বাগান করে ফেলবো। কয়েকবছর পরই দেখবে এই পুঁজি দিয়ে তুমি ব্যবসা করতে পারবে।
কিন্তু হাশেম জানে শুধুই দর্জির কাজটা। তবে সেটা সে আর এখন করতে চায় না। ভালো লাগে না তাঁর। অন্যের জমিতেও কাজ করে না। কোথা থেকে হঠাৎ সিদ্ধান্ত নিয়ে পাখি শিকারে নামে। বাজারে যায়, বিক্রি করে।
নমশূদ্র ঘরে জন্ম নিলেও নন্দিনীকে চেহারাসুরতে সুন্দরীই বলতে হবে। তাই তার প্রতি প্রতিবেশীদেরও একটা মায়া জমে ওঠে। কিন্তু হাশেম দিনদিন ওই নন্দিনীর প্রতি বিরক্ত হতে থাকে। সারাদিন একটা মানুষ গাছের পেছনে ব্যয় করতে পারে, যা দিয়ে নগদ পয়সা আসে না। নন্দিনী বলে, আসবে আসবে, হাজার হাজার নয়, লাখ টাকাই আসবে। ধৈর্য ধরো। কিন্তু এত ধৈর্য হাশেমের সহ্য হয় না। সে পাখি শিকার করতে না পারলেও পাঁচ পাখির বাসা থেকে ডিম নিয়ে আসে। বিশেষ করে কোড়ার ডিম। ডিঙডিঙা বিলে হাজার কোড়া পাখি। কিন্তু নন্দিনী কী কাজটা করে ? নন্দিনী বলে, হাশেম, সংসার হলো ঘানি। এ ঘানি তো তোমার একার পে ঘোরানো সম্ভব নয়। আমি তো আর বাপের বাড়ি থেকে তোমাকে কিছু এনে দিতে পারবো না। ধৈর্য ধরো। তোমার জন্য একটা বড় পুঁজির ব্যবস্থা করছি আমি। কিন্তু এ কথায় মন ভরে না হাশেমের। বলে, তুমি এ গাছের চিন্তা বাদ দাও। পারলে...। নন্দিনী বলে, আমি কোনো সাহেবের বেটি নই, দেখে নিয়ো, তোমার সংসার ঠেলাগাড়ির মতো ঠেলতে ঠেলতে কোথায় নিয়ে যাই। কিন্তু তুমি পাখি মারা ছাড়ো। পাখি মারলে মানুষ দানব হয়ে যায়। এ কথায় রাগ করে হাশেম। বলে, পাখি না মারলে, পাখির ডিম না কুড়ালে খাবোটা কী ? এই যে এ বেলা ভাত খেলাম, তিনজোড়া বুনোহাঁসের ডিম না আনলে কী দিয়ে খেতাম ? নন্দিনী বলে, জগতের আর সবাই কি পাখির ডিম দিয়ে ভাত খায় ? এ কথায় হাশেমের মাথায় রক্ত ওঠে যায়। চিৎকার করে বলে, তুই আমার সঙ্গে মুখে মুখে ঝগড়া করিস ? তোর জিহবা আমি কেটে দেবো। মাঝবিলের মাঝখানের শেওড়াগাছের পাখির বাসা থেকে ডিম এনে তোরে খাওয়াই। আর তা খেয়ে গায়ের জোর বাড়িয়ে চটাং চটাং কথা ! ফের বকবক করলে তোর জিহবা টেনে কেটে ফেলবো আমি। নন্দিনী বলে, কাটবা না, তোমার বাপদাদারা তো কশাই ছিলো। এ কথা শুনে হাশেমের শরীরের রক্ত লাফিয়ে ওঠে। তবু সে তার বউয়ের সঙ্গে কথা না বাড়িয়ে ডিঙডিঙা বিলের দিকে চলে যায়। বউ তাকে শুনিয়ে শুনিয়ে চিৎকার করে বলে, জগতে মনে হয় আর কোনো কাজ নাই পাখি মারা ছাড়া ? কী সুন্দর চাকরি! দর্জির কাজটা মনে হয় মন্দ ছিলো কেউ বলেছে...! নন্দিনীর কোনো কথাই কানে আসে না হাশেমের। জলভরা পাটের জমির দিকে যাচ্ছিল কয়েকটি বালিহাঁস। শামুক কিংবা পোকা খাবে বলে ডাকতে ডাকতে ঢুকে যায় পাটখেতের ভিতরে। ওগুলোকে ধরা খুব সহজ কাজ নয়। তবু ওদের পিছু নেয় হাশেম। ভাবখানা এমন যে, আজ যেন সে অনেক পাখিই ধরে ফেলবে। অথচ সন্ধ্যার পর কোনো পাখি কিংবা পাখির ডিম ছাড়াই ঘরে ফিরে আসে হাশেম। রাগে হাশেমের মন হিং¯্র সিংহ হয়ে আছে। সারাদিন কিছু সারসের পেছনে কেটেছে। কিন্তু কোনোটাই ধরা পড়েনি। কিভাবে ধরা পড়বে ? তাঁর না আছে একটি বন্দুক, না একটি তালের ডোঙ্গা কিংবা...। এদিকে নন্দিনী ুধায় সারমেয়ী হয়ে আছে। হাশেমের কুঁড়েঘরে তখনও অবশিষ্ট কেরোসিন তেলে সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বলছিল। হাশেম নন্দিনীকে বলে, খাবার কিছু থাকলে দে, তাড়াতাড়ি। নন্দিনী বিষাক্ত সাপের মতো ফোঁস করে বলে, পোলাও খাইবা, নাকি বিরানী ? মুরগীর মাংস খাইবা নাকি পানিখাওরীর (পানকৌড়ি) মাংস ? হাশেম এ কথার অর্থ বুঝে। তাই চিৎকার করে বলে, বটি দিয়ে আজ তোর জিহবা যদি না কাটছি...তো। রাগে কাঁপতে থাকে হাশেম। নন্দিনী বলে, তোমার বংশ যে কশাইয়ের বংশ ছিলো, সেটা তো অনুমান করাই যায়। জিহবা কাইটা কী লাভ ! একেবারে জবাই দিয়া দাও। হাশেম আর সহ্য করতে পারে না। উত্তেজিত হয়ে সত্যি সত্যিই বটি হাতে নেয়। নন্দিনী স্থির থাকে এবং হাসে। একদিকে বটি ছুড়ে হাশেম ঘর থেকে বের হয়ে যায়। নন্দিনী তখন হাসেও না, কাঁদেও না। এমনকি হাশেমের পথ আগলেও দাঁড়ায় না।
বুকজল ধানের মাঠ পার হয়ে ডিঙডিঙা বিলের মাঝখানে চলে যায় সাঁতার কেটে হাশেম। যেতে যেতে আরও দূর যায়, যেখানে লাল-নীল-সাদা শাপলা বিছিয়ে আছে। আকাশে ভরা চাঁদের আলো। সেই আলোতে ডুব দিয়ে দিয়ে অনেকগুলো শাপলা তুলে আনে সে। রাগে তখন সে আর ুধা অনুভব করে না। হঠাৎ ল্য করে, জলজ ধানের মাঠ পার হয়ে, পাটের তেগুলো অতিক্রম করে যেখানে চলে এসেছে সে, এখানে সে কোনোস্থানেই কোনোভাবেই ঠাঁই পাচ্ছে না। আসার সময়ে যত সহজে চলে এসেছে, ফিরতে গিয়ে শাপলা নিয়ে তত সহজে ফিরতে পারছে না। জলজ নানা জাতের ঘাস তাকে বারবার পেঁচিয়ে ধরছে। তারপরও বাড়ির দিকে সাঁতার কাটতে কাটতে গলা জলে এসে দম নিয়ে দাঁড়ায়। তারপর বিস্তীর্ণ সেই পাটেেতর ছায়াটার কাছে এসেই হঠাৎ ভূত-প্রেতের কথা মনে পড়ে তার। ঠিক এমনি সময় আকাশের ভরা চাঁদ মেঘের আড়ালে ঢেকে গেলে চতুর্দিকে যেন পিশাচের নানা শব্দ শুনে হাশেম। তারপরও শাপলা আকড়ে ধরে বাড়ির দিক অনুমান করে সাঁতার কাটতে থাকে।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.