নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

চলো আমরা পাখিদের কাছ থেকে ইউক্লিডের নতুন পাঠ নেই জীবনানন্দের পাঠ নেই নিউটনের আপেল গাছটি থেকে।

জসীম অসীম

লেখা হলো কেতকীফুল। ভালোবাসি তাই।

জসীম অসীম › বিস্তারিত পোস্টঃ

গুলিবিদ্ধ ডাহুক-(গল্প)

২৭ শে অক্টোবর, ২০১৫ সন্ধ্যা ৭:৫৭

শরৎকালের রঙ কি সাদা? কে দেবে তার উত্তর? তবে এটা বলা যায়, শরৎকালে ফোঁটা শিউলি ফুলের বোঁটা, হলুদ হলেও ফুলগুলো সব সাদা। শরতের কাশফুল সাদা, কাফনের বস্ত্রের রঙ সাদা, সাদা শান্তি এবং মৃত্যুরও প্রতীক। তাই হয়তো শরতের নীল আকাশের মেঘগুলোও সাদা। ‘নীল আকাশে কে ভাসালে সাদা মেঘের ভেলা’। শরৎ যেন শুভ্র মেঘের-কাশফুলগুচ্ছের ঢেউ খেলানো খেলা। কিন্তু সাদা শিউলি ফুলে এত সুগন্ধ আসে কোথা থেকে ?
পাখি শিকারী হরিপদ এই শরতেই সবচেয়ে বেশি পাখি মারে। তার সঙ্গী মাধব তাকে বলে, হরিপদ দা’- যদি সুহাসিনী বৌদি পাখি হতেন, তাহলে তুমি কি তাকে গুলি করতে পারতে? হরিপদ বলে, যারা পাখি মারে না, তারাও কোনো ধোয়া তুলসীপাতা নয়। কেন, সেনাবাহিনীতে কি মানুষ মারারও শিক্ষা দেওয়া হয় না? মাধব বলে, কিন্তু আমি তো শুনেছি গোটা পৃথিবী থেকেই পাখির সংখ্যা কমে যাচ্ছে। হরিপদ বলে, এ নিয়ে তোর না ভাবলেও চলবে। পাখির সংখ্যা কখনো কমবে না। কারণ পাখিরা জন্মনিয়ন্ত্রণের কোনো ব্যবস্থা অবলম্বন করে না। হরিপদ আর মাধব যে মাটির পথে হেঁটে যায়, তার দু’পাশে অসংখ্য লাল-সাদা-নীল বুনোফুল। হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ বুনোফুল ছিঁড়ে হাতে সংগ্রহ করে মাধব। হরিপদ বলে, এভাবে ফুল ছেঁড়াও তো অপরাধ। মাধব বলে, আমি ফুল ভালোবাসি। ফুল না ছিঁড়েও তো ফুলকে ভালোবাসা যায়। হরিপদের উত্তর। মাধব বলে, পাখিদেরও তো না মেরে ভালোবাসা যায়। হরিপদ বলে, আমি যে পাখিদের ভালোবাসি, সেটা তোকে কে বলেছে? আমি পাখিদের মাংস খেতে ভালোবাসি। মাধব আর কথা বাড়ায় না। চুপচাপ হরিপদের পিছু পিছু হাঁটে। শরৎ এলেই হরিপদ পাখি শিকারের জন্য আকুল হয়ে উঠে। গিরিলোক থেকে উমা যখন আসেন, তখনও তাকে পাখিরা ভীষণ ডাকে। ডাকে তাকে নিঃসীম নীলাকাশ, শরতের সোনা রোদ, গুচ্ছ গুচ্ছ কাশফুল এবং লাল নীল সব পদ্মফুল। শিশির ভেজা শত পাখির কলকাকলিতে সে রক্তের ফোঁটা ফেলে। তাহলে কে এই হরিপদ চক্রবর্তী, মানুষ নাকি অসুর? দিগন্তরেখায় মেঘের ঘ্রাণ। গগনবিহারী সাদা মেঘের ভেলা। রাতের শুকতারাও এই সাদা মেঘ ভালোবাসে। আর আছে শরৎশশী-শরতের চাঁদ। যে দেখেনি-সে মরেছে কিংবা তার জন্মই হয়নি। ঘোলা জল নির্মল হয় শরতে। জলচর পাখিরা টলটলে জলে জলবিহারে জলপরী বা জলকন্যা বা জলপুত্র হয়ে উড়ে। ভেজা ভেজা মাটি অনেকটা শুকিয়ে জ্যোৎ¯œা ধরে রাখে। শারদীয় কাশফুলে নদীকূল ভরপুর। এমন শুভদিনে যার যেমন নেশাই থাকুক না কেন, হরিপদের পাখি শিকারের নেশা জেগে ওঠে। এটা তাঁর ঠিক নেশা নাকি ক্ষুধা, তা সে নির্ধারণ করতে পারে না। অন্নক্ষুধাও কখনো এমন তীব্র হয়নি, যেমনটি তাঁর পাখি শিকারে হয়। বর্ষাকে সে তেমন একটা সহ্য করতে পারে না। তাই শরৎ এলেই তাঁর পাখি শিকার শুরু হয়, শেষ হয় তা শীতের অতিথি পাখি মেরে। কত প্রজাতির শত-সহ¯্র পাখির হাড়পাঁজরা যে সে এই জীবনে রান্না করে খেয়েছে, হিসাব নেই তাঁর। তাঁর মাথার খুলির ভিতর ঐ একটি চিন্তাই ঘুরঘুর করে- পাখি শিকার-বন্দুক দিয়ে পাখি শিকার। পদ্মিনী নারীরতেœর দিকেও একদা নেশা ছিল তাঁর। সুন্দরী নারী দেখলে আজও সে তাদের ‘শ্রেষ্ঠা’ কিংবা ‘অপরাজিতা’ বলেই সম্বোধন করে। এখন নারীরতেœর নেশা তাঁর নেই। আছে খানাপিনার প্রতি ভালোলাগা, সঙ্গে রান্না করা পাখির মাংস। পাখির রাজ্যে প্রবেশ করলে সে আর মানুষ থাকে না, হয়ে যায় বিষধর এক নাগ। হরিপদ জানে এই ভাদ্রে, এখন কি ভাদ্র মাস, না হয় আশ্বিন মাস, এই আশ্বিনে কোঁচবক, মানিকজোড়, বালিহাঁস, সারস, মাছরাঙ্গা জাতীয় পাখিদেরই সে বেশি খুঁজে পাবে। আর এই পাখি শিকারে তার সঙ্গে সঙ্গী থাকে আরেকজন, সে হল মাধব। হরিপদ আর মাধব পাখির নেশায় কোথা থেকে যে কোথায় চলে যায়। বন্দুক নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়েই হরিপদের সঙ্গে দেখা হয় অজিত মাস্টারের। তারা উভয়ে বাল্যকালের বন্ধু। ‘আবার খুনের নেশা জাগছে হরিপদ?’ অজিত মাস্টার বলে। হরিপদ হাসতে হাসতে বলে, ভাবছি কিছু পেঙ্গুইন মারবো। মাধব হাসে। তার হাতে হরিপদের শিকার করা রক্তাক্ত পাখি রাখার ব্যাগ। জলের বোতল, চানাচুর-বিস্কুট, সিগারেটের প্যাকেট ... ইত্যাদি। অজিত মাস্টার বলে, পেঙ্গুইন হলো উত্তর মেরুর বাসিন্দা, যদিও তারা উড়তে পারে না। আমাকে তুমি বোকা ভাবো হরিপদ? বন বা বৃক্ষ থেকে কি পাখি সরানো যায়? গুলিবিদ্ধ পাখিও দেখো কতোভাবে বেঁচে থাকতে চায়। হরিপদ বলে, আমিও এক গুলিবিদ্ধ পাখি। যদিও কেউ আমার হৃৎপিন্ডের গাঁথা বুলেট দেখে না। আর ঐ যে বললে পেঙ্গুইন উড়তে পারে না, শুধু পেঙ্গুইনই নয়, পৃথিবীর অনেক পাখিই উড়তে পারে না। যারা উড়তে পারে না, আমি তাদের পাখি মনে করি না। অজিত মাস্টার বলে, তোমার নেশাটা ভাই মাছের দিকে ট্রান্সফার করো। এত বিদ্যা শিখে, এত আইন জেনে তুমি নিষ্ঠুর পাখি ঘাতক, ভেবে পাইনা আমি। শোল, কাতলা, বোয়াল, শিঙ্গি মেরে দেখো কতো মজা পাও। হরিপদ বলে, আপাতত জেলে হওয়ার কোনো শখ নেই আমার। মাছ মারলে একটি মাছই মারবো, সেটা তিমি মাছ। যেমন ইচ্ছে হয় প্রতিদিন দক্ষিণ গোলার্ধের কোনো দ্বীপে গিয়ে কিছু অ্যালবাট্রস পাখি মেরে আনি। এ কথা শুনে অজিত মাস্টার আর কথাই বলে না হরিপদের সঙ্গে। ভাবে অহেতুক সময় নষ্ট। এতক্ষন কথা না বলে পথে হাঁটলে গন্তব্যের কাছাকাছি যেতে পারতো। মাধব একটি রঙিন শার্ট পরে বের হয়েছে। নির্দেশ হরিপদের। মাধব যুবক। হরিপদের যৌবনকাল আর বেশিদিন নেই। বনের মধ্যে রঙিন পোশাক পরে হাঁটলে পাখিরা মানুষদের খুব একটা দেখতে পায় না। রঙিন পালক দিয়ে পাখিরাও নিজেদের লুকিয়ে রাখে পাখিশিকারীদের থেকে । হঠাৎ রাস্তা পার হচ্ছিল দুই বেজি। মাধব চিৎকার করে হরিপদকে বললো, হরি দা, গুলি করো-গুলি করো। হরিপদ মাধবকে ধমক দিয়ে বললো, চুপ কর অসভ্য। বেজি মারা আমার কাজ নয়। বেজি কি তুই খাবি? বন্দুক হাতে থাকলেই যারেতারে গুলি করতে নেই। ধমক খেয়ে হুতোম পেঁচার মতো মুখ করে রাখে মাধব। হরিপদ বুঝে, ভিতরে ভিতরে মাধব রাগ করেছে। একটু এগিয়েই পাশের বাঁশবনে এক হুলোবেড়াল দেখে মাধব। একবার হরিপদের দিকে চায়। মুখে কিছুই বলে না। হরিপদ বুঝে। আপনাআপনিই বলে, গরুকে- ছাগলকে গুলি করার কিছু নেই। যে করে সে নিজেই গরুছাগল। গুলি খুব মূল্যবান বস্তু। কথা শেষ হতে না হতেই পাবদাবিলের কোনায় উলুবনের পাশে জংলি গাছগুলোর সঙ্গেই দুটো সারস পাখিকে কাছাকাছি বসে থাকতে দেখে হরিপদ। চোখ দিয়ে মাধবকে বসে লুকিয়ে যেতে ইঙ্গিত করে। তারপর বন্দুক নিয়ে এগিয়ে যায় বুনোফুলগুলোর আড়ালে, লুকিয়ে লুকিয়ে। গুলি ছুঁড়ে। এক- দুই- তিন...। কিন্তু কাজ হলো না। সারস দুটি পালিয়ে বেঁচে গেল। দূরে। ততদূরের জায়গাটা ঠিক জলেজঙ্গলে একাকার। এমন ব্যর্থতায় হরিপদ যেন নিজেই গুলিবিদ্ধ হয়। পারলে যেন নিজের মুখে নিজেই ঘুষি মারে। দিনের শুরুটা এভাবে ব্যর্থ হলো। আকাশে শরতের সাদা মেঘ... ‘নীল আকাশে কে ভাসালে সাদা মেঘের ভেলা’ অথবা ‘খুব উঁচু দিয়ে পাখি উড়ে গেলে পড়ে না মাটিতে ছায়া, তুমি কি তেমনি দূরে?’ পাখি দেখলে মেঘ আর মেঘ দেখলে পাখির কথা মনে পড়ে হরিপদের। মাধব মুখ খুলে। বলে, দাদা তুমি পাখি মারো কতো বছর হবে? হরিপদ বলে, এক যুগ পার হলো। কেন? মাধব বলে, আমার কিন্তু তোমার সঙ্গে শিকারে যেতে ভালো লাগে। কিন্তু পাখির মাংস খেতে আমার একদম ভালো লাগে না। হরিপদ দা, তুমি কেন পাখি মারো? হরিপদ বলে, এই প্রশ্ন তুই এই জীবনে কয়েকশবার করেছিস। মাধব বলে, এই প্রশ্নটাই তোমাকে আমার বারবার করতে ইচ্ছে করে। হরিপদ বলে, শোন মাধব, বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষই গরীব। এমন গরীব দেশের মানুষ যদি পাখি না খায়, তো কারা খাবে? এমন কথার যুক্তি খুঁজে পায় না মাধব। কারণ গরীবীর কারণে হরিপদ পাখি মারে না বা খায় না। এটা সে বুঝে। এবার রাস্তা থেকে হাঁটুজলের পথে নামে হরিপদ আর মাধব। উলুবন- কাশবনের পাশ দিয়ে যেতে যেতে মাধব কিছু কাশফুল ছিঁড়ে নেয়। হরিপদ বলে, জলের বোতল কই? জলপিপাসা প্রচন্ড। হরিপদের কথা শেষ না হতেই মাধব হৈ চৈ করে ওঠে। দাদা দেখো, অনেকগুলো তিলে ঘুঘু আর কী একটা রং বাহারি পাখিও যেন ছোট গাবগাছটির কাছে বসে আছে। হরিপদ হাত দিয়ে মাধবকে ইশারা দেয়, মাটিতে মিশে থাক। নিজের শ্বাসপ্রশ্বাস প্রায় বন্ধ করে পজিশন নেয়। তারপর ছুঁড়ে গুলি। গুলিবিদ্ধ হয়েও কিছু পাখি দূরে গিয়ে উড়ে পড়ে। মাধব ব্যাগ হাতে দৌড়ে যায় সেখানে। দুইটি রক্তাক্ত তিলে ঘুঘু হাতে তুলে নেয়। হরিপদ এতক্ষণে তার সিগারেটে সুখটান দেয়। ঠিক এই গুলি ছোঁড়ার কাজে মাধবও অনেক প্র্যাকটিস করেছে। হাতযশ তো দূরে থাক, পাখির পালকেও কখনো গুলি লাগাতে পারেনি। হরিপদের পিতা শ্রী শরৎচন্দ্র চক্রবর্তীর এমন পাখির নেশা ছিল না। কোথা থেকে পেল হরিপদ এমন নেশা? হাঁটুজল- কোমরজল ভেঙ্গে সে পাখি মারতে চলে যায়। সঙ্গে থাকে মাধব। মাঝে মাঝে মাধবকে তাত্ত্বিক কথাও বলে হরিপদ। ‘জানিস মাধব, একদিন-এই দেশে স্কুল কলেজে খেলার মাঠ থাকবে না, শহরে তো এখনই স্কুলের মাঠ নেই। শিশুরা খেলা ভুলে যাবে। পাখিরাও উড়তে ভুলে যাবে। তারপর পাখিও সব একে একে বিলুপ্ত হবে। এমন জনপদ কি কল্পনা করা যায়? অথচ এমন একদিন সামনে আমাদের জন্য ধেয়ে আসছে। আগে আমি ছেলেবেলায় যত পাখি দেখেছি, সেসব এখন নেই। বাজপাখি নেই সেইরকম। কালীবকেরও সংখ্যা অনেক কমেছে। পাখির ডাকে-কিচিরমিচিরেই ঘুম ভাঙ্গতো আমাদের। সারাবছরই শকুন থাকতো ডালে ডালে বসে। এখন গরু ছাগল মরলে খেতে আসে, তাও সংখ্যায় খুব কম। নীলকন্ঠ, পানকৌড়ি, মদনিকা, বালিহাঁস, বুনোহাঁস, ধনেশপাখি...বলবো কতো... এখন কোথায়? কীটপতঙ্গও তো নেই আগের মতো। সন্ধ্যা হলেই কলাগাছের বাগানে শত বাদুর ঢুকতো। রাতে একটু বের হলেই জোনাকিপোকাদের ঠেলে ঠেলে সামনে এগিয়ে যেতাম। এখন তো হাঁটতে হাঁটতে মাঝে মধ্যে আমাদের জেলা পার হয়ে কখনো কখনো ভারত-বাংলাদেশের সীমান্তের পাহাড়েও চলে যাই। যেখানে জঙ্গল। কিন্তু সে রকম পাখি কোথায়? মাধব বলে, হরিপদ দা, আমার তো মনে হয় এর জন্য তুমিই দায়ি কিংবা তোমার মতো লোকেরা। জীবনে কতো পাখি মেরেছো? তোমার হাতে বন্দুক দেখলে তো সব পাখিই উড়ে পালায়। হরিপদ বলে, ধর আমি না হয় আমার শরীর-মন সুস্থ রাখতে কিংবা শখে পাখি হত্যা করি। কিন্তু এই দেশের মাছগুলো গেল কোথায়? আমি তো পক্ষী হন্তারক, মৎস্যহন্তারক নই। কিন্তু কোথায় গেল কালাবাউস মাছ? বাঁশপাতুরি মাছ তুই চিনিস? বাইনমাছ, কই মাছ, কানিপাবদা, শোল-মহাশোল, চিতল, সরপুঁটি মাছদের কি রাঘববোয়ালে খেয়েছে? সিলভারকার্প, গ্লাসকার্প মাছে খেয়েছে। এইসব ফিরিঙ্গি মাছ দখলদার মাছ। মাছ ছিল ট্যাংরা, ভেটকি, বাঁশপাতুরি। এখন সব হাওয়া হয়ে গেছে। মাধব বলে, হরিপদ দা, পাখি শিকার করতে করতে তো তুমি পাখি বিশারদ হয়েছো। উঁচু শ্রেণির পাখি বিশারদ। কিন্তু মৎস্য বিষয়ে এত কিভাবে জানো? শোন মাধব, এসএসসি পরীক্ষায় ফেল করে লেখাপড়া ছেড়েছিস, এখন তোরও বিশারদ হওয়ার চান্স রয়েছে। বই পড়ে ইউনিভার্সিটিতে গিয়ে কেউ জ্ঞানী হতে পারে না। রবীন্দ্রনাথ-নজরুল এই জন্যই তো স্কুল-কলেজ ছেড়ে দিয়েছিলেন। আমি বাবার ভীষণ অত্যাচারে বি.এ পাস পর্যন্ত আসলাম ঠিক, কিন্তু তিনবারেও যখন বি.এ পাস করতে পারলাম না, বাবা বললেন, বাদ দে লেখাপড়া, তখন আমার কী যে আনন্দ...। প্রসঙ্গ পাল্টায় মাধব। বলে, হরিপদ দা’ ঐ দেখো এক ঝাঁক টিয়ে উড়ে যাচ্ছে। ‘কাছে আসবে না। ওরা আমাকে চিনে।’ হরিপদের উত্তর। মাধব বলে, তুমি একবার পালিয়ে যাওয়ার সময় উড়ন্ত পাখিকেও গুলি করে ফেলে দিয়েছিলে। মনে আছে? কিভাবে পারলে তুমি? হরিপদ বলে, পাখির বাসা থেকে ছানা আনতে গিয়ে ছোটবেলায় একবার কমপক্ষে দশটি বোল্লার (বোলতা) কামড় খেয়েছিলাম। এইজন্যই পেরেছিলাম। বাবাকে ফাঁকি দিয়ে কলেজ জীবনেই মদের গ্লাসে চুমুক দেয়া শিখেছিলাম। হয়তো এইজন্য পেরেছিলাম। একটা বিষয়, মদে চুমুক দিলেই আমার চোখজোড়া লাল হয়ে যেতো। বাবা কিন্তু অনুমান করতে পারতেন। মাধব প্রসঙ্গ পাল্টায়। হরিপদ দা, ছোট্ট হিজলের ডালটায় কতগুলো মুনিয়া পাখি। হরিপদ বলে, বুকজল ভেঙ্গে ওদিকে গিয়ে লাভ নেই। ওগুলোতে মাংস নেই। হঠাৎ মাধব চিৎকার করে ওঠে, দাদা দাদা ওই দেখো একটা ডাহুক। কাশফুলগুলোর ধারেই। নিঃশব্দে চুপিসারে বিনা বাক্যব্যয়ে বন্দুক হাতে এগিয়ে যায় হরিপদ। এমন সময় খুক খুক করে কাশতে থাকে মাধব। করমচার মতো চোখ লাল করে হরিপদ। তারপর গুলি ছুঁড়ে। গুলি পড়ে চোখ বের হয়ে যায় ডাহুকটির। মাধব জলে ঝাঁপ দিয়ে সাঁতার কেটে গিয়ে নিয়ে আসে সেই পাখি। মাধব ফেরার পর হরিপদ বলে, খুক করে কাশ দিলি কেন? দারুচিনি সঙ্গে নেই? মাধব বলে, কাশের আর কী দেখেছ। রাতে তো ঘুমাতেও পারি না। সারাদিন জলে পড়ে থাকলে তো এমনই হবে। হরিপদ বলে, জানিস-পাখিরা মানুষের চেয়ে বেশি স্বাধীনতা ভোগ করে। এদেশ-ওদেশ করতে ওদের পাসপোর্ট-ভিসা লাগে না। এ কথার কোনো উত্তর দেয় না মাধব। চিৎকার করে বলে, হরিপদ দা, বীজতলার ঐ ছোট নিমগাছে দেখো একটা বড় কাঁকলাস। ঠিক তোমার দিকেই চেয়ে আছে। সব রক্ত খেয়ে নেবে। গুলি করো। হরিপদ হাসে। বলে, আরে বেকুব কাঁকলাস মানুষের রক্ত খেতে পারে না। কোনো এক হারামী এই কথার প্রচলন করে এই প্রাণীটিকে মারার ব্যবস্থা করে বিলুপ্তির পথে ফেলেছে। মাধব বলে, দাদা চলো শ্যাওড়াগাছটির দিকেই যাই। ওখানের ঝোপঝাড়ে অনেক পাখি থাকে। হরিপদ বলে, ওপথে যাবো কী, যত্তোসব কাঁটাওয়ালা গাছ আর কাঁকড়ায় ভরপুর। মাধব বলে, হরিপদ দা, শ্যাওড়াগাছের তলায় যে ঘাসে ঘাসে সোনালি ফুল দেখতাম, এগুলো কি ফুল- অতসী? হরিপদ ধমক দেয়। অতিরিক্ত প্রশ্ন করিস না তো। দেখ ঐ কচুরিপানার দামের ওপর বসে আছে কয়েকটি কোঁচবক। চুপ হয়ে যায় মাধব। চুপচাপ বসে পড়ে। বহুপাখিদর্শী হরিপদ এগিয়ে যায়। তারপর অতর্কিতে হামলা চালায়। একটি বক পড়ে থাকে। মাধবের জলে ঝাঁপ...। বক নিয়ে ফেরার পর হরিপদ পাখিটার ওজন দেখে। বলে- চমৎকার। মাধবকে বলে, আমাদের বাড়িতে যে স্বর্ণচাপা গাছটা আছে... ওখানে একবার এক গঙ্গাফড়িং খেতে এলো পাখি। মাধব বলে, স্বর্ণচাপা গাছ কোনটা? হরিপদ বলে, ওই যে আমাদের অপরাজিতা নীল ফুলগুলো ফোটে, তার কাছের গাছটা। মাধব প্রসঙ্গ ফেরায়। দাদা, দেখো ঐ। কলমীদামে বসে আছে আরেকটি ডাহুক। হরিপদ বলে, আমার পকেটে গুড়া আদা আছে। ধর। মুখে দিয়ে চুপ মেরে বসে থাক। একদম কাশবি না। কিন্তু হরিপদ পজিশান নিতেই ডাহুকটি উড়ে যায়। রেগে হরিপদ বলে, মাদারচোদ পাখি। মাধব বলে, দাদা তোমার পিছে পিছে একটি ভিমরুল ঘুরঘুর করছে। এখান থেকে সরে এসো ওই ধানিজমিগুলোর দিকেই যাই। পাবদাবিলে পরে আসবো আবার। হরিপদ সায় দেয়। ওদিকে যেতে যেতে মাধব আগাম হওয়া ধানের ছড়া ছিঁড়ে নিয়ে দাঁত দিয়ে পাকা ধানের খোসা ছাড়িয়ে কাঁচা সাদা চাল চিবিয়ে খেতে থাকে। হরিপদ ধমক দেয়। ভাত খাসনি জীবনে? কার ক্ষেতের চাল খাস? তোর বাপের? পাপের বোঝা আর বাড়ানোর দরকার নেই। এমনিতেই পাখি মেরে হাত রক্তাক্ত আমাদের। মাধব বলে, আমি কি পাখি মারি নাকি? মারো তো তুমি? আমি তো পাখি খাইও না। হরিপদ বলে, ওই হলো-পাখি মারা আর পাখি কুড়ানো সমান অপরাধ। মাধব বলে, তাহলে চলে যাই। হরিপদ হাসে। কোথায় যাবি? চল ওই বটগাছের নিচে গিয়ে বসে সঙ্গে আনা বিস্কুট- চানাচুর খাই। বটতলায় বসে মাধব বলে, হরিপদ দা’ এই বটগাছের বয়স কতো হবে? হরিপদ বলে, বয়স আর কী হবে? এ তো বটের বাচ্চা। এটার নাম অশ্বত্থ বট। এই বটতলে যেমন পটপট করে শব্দ হয়, মূল বটবৃক্ষে তেমন হয় না। ছিল আমাদের পাড়ায়। আমরাও ছোটবেলায় দেখেছিলাম। এতবড় বটবৃক্ষ আমি আর জীবনে দেখিনি। সেই বটের ঝুরিগুলিও ছিল এই বটের চেয়ে অনেক মোটা। পুরো আধখানা গ্রাম ছিল তার দখলে। আর পাখি? সেই বটবৃক্ষ থাকলে আজ পাখির জন্য এত জল-জঙ্গলে পড়ে থাকতে হতো না। সেই বটবৃক্ষ ছিল কাঠবিড়ালীর তীর্থস্থান। আজ নেই। সিগারেটের ধোঁয়ার সঙ্গে মনের সব দুঃখ ছাড়তে ছাড়তে এসব কথা বলে হরিপদ। বটবৃক্ষের কথা মনে পড়তেই মায়ের কথা মনে পড়ে হরিপদের। মা গত শরতে দুর্গাপূজার আগেই ইহকাল ছেড়েছেন। ক’দিন পরেই বাজবে আবার দুর্গাপূজার ঢোল। দুর্গাপূজার আলাপ শেষ করে হরিপদ বলে, চল মাধব, পাবদাবিলের অথৈ জলের ধারে ধারে হাঁটি। ওখানে থাকে ঝাঁক ঝাঁক ডুবুরি পাখি। সমস্যা হলো, এসব পাখি একবার গুলির শব্দ পেলে উড়ে দূরে চলে যায়। মাধব বলে, কখনো বা টুপ করে ডুব দিয়েও পালায়। আচ্ছা হরিপদ দা, পাখিদের প্রতি তোমার এমন ক্ষোভের কারণ কী? কেন তুমি পাখিদের মারতে মারতে ওদের বাসা পর্যন্ত চড়াও হও? পাখিরা কোনো প্রতিরোধ করে না বলে? ওদের কোনো পার্টি-টার্টি নেই বলে? কিন্তু তুমি কি জানো ওরা তোমাকে এবং আমাকে ঘৃণা করে খুব। হয়তো আমরা ওদের অভিশাপে অভিশপ্তও হবো। হরিপদ বলে, অভিশাপ? যারা মানুষ খুন করে ফেলে, তাদের অভিশাপে পায় না? শোন, আমি পাখির শত্রু নই। মনে পড়ে ছোটবেলায় আমি দুর্গাপূজার জামাকাপড়ও নিতাম পাখির পালকের মতো রঙিন। পাখির মতো উড়তে তখন ভীষণ ইচ্ছে হতো। মাধব বলে, তাহলে এখন তুমি পাখি মারো কেন? হরিপদ এই প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে আগের কথার রেশ ধরেই বলতে থাকে, তখন খুব ইচ্ছে হতো পৃথিবীর সমস্ত পাখিকে ছুঁয়ে দেখার। কিন্তু পরে বিভিন্ন কারণে আমার হৃদয় হয়ে যায় কষ্টের গুলিতে সেলাই হয়ে যাওয়া এক হৃদয়। মনে হয় এই কষ্ট কমাতেই পাখিকে গুলি করি। এমনকি কখনো বন্দুক নষ্ট হয়ে গেলেও বিভিন্ন ফাঁদ পেতে পাখি শিকার বন্ধ হয় না আমার। পাখি হন্তারক হয়েও আমি প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াই। মনে হয় পাখি হত্যার জন্যই আমি প্রতিদিন বেঁচে থাকি। আমার মননে শুধু পাখি হননের নেশা। সাংসারিক জীবনে নিশ্চিত কোনো পেশাও নেই আমার। মাধব বলে, দাদা তুমি চাকরি করলে না কেন, ব্যবসাও তো করতে পারতে। হরিপদ বলে, আমার কোনো ক্ষুধা নেই মাধব, শত্রুও নেই। বলেই সে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে। বলে, পাখিরা আমাকে খুন করতে পারবে না। আমার ভয়ে ওরা পাবদাবিল, গুগলি হাওড় পার হয়ে ঐ অদূরের পাহাড়ে গিয়ে ওঠে। কখনো বা ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত পার হয়ে যায়। মগজের ভিতর সারাক্ষণই ‘বার্ড হার্ন্টিং’। ঘুমের স্বপ্নেও পাখিকে হঠাৎ আক্রমণের জন্য গোপন জায়গায় লুকিয়ে থাকি, ওঁৎ পেতে থাকি। তোর বৌদিও এসব জানে। মাধব আবার প্রশ্ন করে, দাদা ব্যবসা করলে না কেন? হরিপদ বলে, শোন, আমার পূর্বপুরুষের তো তালুকদারি ছিল, আমার তা নেই। জায়গাজমি তো প্রায়ই শেষ। এই একটা শখই বেঁচে আছে। আমার পূর্বপুরুষতো কখনো কখনো বন্দুক দিয়ে মানুষও মারতেন। আমি মারি পাখি। মাধব বলে, শুনেছি তোমাদের বাপদাদারা নাকি খুব ভোগবিলাসে জীবন কাটাতেন। হরিপদ বলে, সেই রমরমা দিন শেষ। এখন শুধুই খরচ, আয় নেই। টাকার দরকার পড়লেই একটু একটু জমি যায়। তাছাড়া অনেকে তো ইন্ডিয়ায়ও চলে গেছে। মাধব বলে, পানকৌড়ি পাখিরা বোধ হয় ডুব দিয়েছে। একটাও চোখে পড়ছে না। হরিপদ পূর্বকথার রেশ ধরে বলে, মাধব শেষ কথাটা শোন, আমি নিশ্চিত যে আমার মৃত্যুর পর আমার উত্তরপুরুষ ভিক্ষে করে তাদের পেট বাঁচাবে। মরেই তো গেছি। সারাদিন ঝিমোই। যেদিন পাখি শিকারে বের হবো, সেদিন সূর্য ওঠার ঠিক আগের সময় থেকেই রক্ত টগবগ করে। মাধব বলে, দাদা দেখো, ঐ কতগুলো পাখি বিলের পানির উপর দিয়ে ডানা ঝাপটিয়ে ভেসে বেড়াচ্ছে। হরিপদ বলে, ওদের মারা খুব সহজ নয়। একটুখানি শব্দ হলেই পানির উপরে থাকবে না। ভীষণ চালাক ওরা। মাধব বলে, দাদা ওই দেখো বনতুলসীটার ডানদিক দিয়ে, দেখতে পাচ্ছো? হরিপদ বলে, নাতো। মাধব বলে, তেলাকুচোর লতাটা দেখেছো, ঐ যে তালগাছটার নিচে? নাতো। হরিপদ পুনরায় একই জবাব দেয়। রেগে যায় মাধব। বলে, তুমি কি চোখেও দেখতে পাওনা? ওফ, লালপিঁপড়ার ঝাঁক আমার পা খেয়ে ফেলছে। সরো সরো এখান থেকে সরো। পিঁপড়ার ভয়ে অনেকটা সরে যায় দু’জন। মাধব বলে, যেই পাখিটা দেখলে না তুমি এতক্ষণ, সেই পাখিটা হয় কোনো ব্যাঙ না হয় কোনো কাঁকড়া খাচ্ছিল। কী পাখি সেটা? ‘না দেখে বলবো কিভাবে?’ হরিপদ বলে। মাধব বলে, দাদা দেখো ঐ একটা মাছরাঙা উড়ন্ত অবস্থায়ও এক জায়গায় স্থির। মনে হয় নিচে কোনো মাছ দেখেছে। হরিপদ বলে। সঙ্গে সঙ্গে নিশানা ঠিক করে হরিপদ গুলি ছুঁড়ে। রক্তে অনেকখানি ভেসে যায় পাবদাবিলের জল। মাধব চেঁচিয়ে ওঠে। দারুণ। দারুণ। আজ থেকে আমাদের ‘জলঢাকা’ গ্রাম এক বিখ্যাত পাখি শিকারীর গ্রাম। মাছরাঙাটি এনে দু’জনে আবার সামনে এগিয়ে যায়। দেখে, কী একটা ছোট পাখি পাতার আড়ালে চুপচাপ লুকিয়ে টুকুসটুকুস পোকা খায়। মারার জন্য আগ্রহ দেখায় না হরিপদ। তারপর আবার সামনে এগিয়ে যায় তারা। ছোট্ট একটি নাগেশ্বরের চারার সরু লম্বা পাতার ফাঁকে দেখে ছোট্ট দুই পাখি শরীর বিনিময় করে। গুলি ছুঁড়ে দেয় সঙ্গে সঙ্গেই হরিপদ। প্রেমিকা পাখিটি বিশ্বাসও করতে পারেনি তার প্রেমিক পাখিটি এক মুহূর্তেই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছে। প্রেমিকা পাখিটি যেই পালাতে যাবে, সেইমাত্র হরিপদ গুলি করে তাকেও। গুলি লেগে মাথা ফেটে যায় প্রেমিকা পাখিটির। প্রথমে গুরুতর আহত হয়। তারপর মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। শরীর থেকে তার নাগকেশর গাছের চারায় ছোপছাপ রক্ত লেগে থাকে। মুহুর্তে অনেক এলাকা পাখিশূন্য হয়ে পড়ে। মাধব বলে, এসব পাখিতে তো মাংস নেই। মারলে কেন দাদা? কাজটা কি ঠিক হলো? জবাব দেয় না হরিপদ। মাধব বলে, দাদা তুমি তো এতটা নিষ্ঠুর ছিলে না। তুমি পাখি হত্যা করলেও বাড়িতে তো অনেক কবুতর পোষো। ওরাও তো পাখি। তোমার বন্দুকের ভয়ে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত পার হয়ে অনেক পাখি অনেকবারই বাংলাদেশের অনেক হিন্দুর মতো ভারতে পালিয়ে গেছে। সেসবের সাক্ষী আমি। মাছ কাটার বটি দিয়ে যারা মানুষ জবাই করে, তুমি তো তাদের মতো নিষ্ঠুর নও দাদা। আজ কেন তুমি আমাকে এমন দৃশ্যটা দেখালে? হরিপদের মুখে কোনো জবাবই নেই। মাধব আবার বলা শুরু করে, তুমি তো দাদা শিকারের শখেই পাখি মারো। তুমি তো বনিক নও। কেন তুমি নিরীহ ছোট দুইটি পাখিকে এভাবে গুলি করে শস্য শ্যামলা বাংলা কাঁপিয়ে দিলে? বলতে বলতে মাধবের মুখে ফেনা ওঠে গেলে ক্ষেপে যায় হরিপদ। তোর ভাষণ শেষ হয়েছে? ১৯৭১ সালের মুক্তিযোদ্ধাদের গুলিতে এই শস্যশ্যামলা বাংলা কাঁপেনি? মাধব বলে, কেঁপেছে। কিন্তু পাখিরা তো আর পাকিস্তানি আর্মি কিংবা রাজাকারের ভূমিকায় নেই। এ কথার যেন জবাব খুঁজে পায় না হরিপদ। বলে, আমি নিজেও জানি না মাধব, কেন যে আমি এমন কাজটা করলাম। বিশ্বাস কর তুই, এই ঘটনার জন্য রাতে আমি ঘুমোতেও পারবো না আজ। চোখ একটু বন্ধ করলেই দেখবো শেষের পাখিটার ছিন্নভিন্ন মাথা। মাধব বলে, চলো আজকের মতো বাড়িতে ফিরে যাই। বেলা তো পড়বে এখনিই। হরিপদ বলে, কিন্তু আমার এখনই যেতে ইচ্ছে করছে না। আসলে আজ আমার মন ভালো নেই। মায়ের কথা খুব মনে পড়ছে। গত বছর এই শরতেই...আর বলতে পারে না হরিপদ। চোখ ভিজে যায় হরিপদের। মাধব বলে, যেতে ইচ্ছে না করলে চলো হাওড়ের ওই দিকটা ধরে হাঁটি। হরিপদ নিজে থেকে কথা বলা শুরু করে। মাধব, আমি ভাবছি খুব তাড়াতাড়ি পাখি শিকার ছেড়ে দেব। বয়েস হয়েছে, মেয়ে বড় হচ্ছে। তা ছাড়া মা কিন্তু বারণ করতো। অথচ শৈশবে এমন নিষ্ঠুর ছিলাম না আমি। মা আমাকে কাগজ দিয়ে কতো পাখি বানিয়ে দিতেন। তখন আকাশ দিয়ে ঝাঁক বেঁধে পাখি উড়ে গেলে সেই পাখিদের পেছন পেছন দৌড়ে আমি কতো দূর চলে যেতাম। মাধব বলে, পাখিকে এমন ভালোবাসার নেশা, পাখি পোষার নেশা কিভাবে পাখি শিকারের নেশায় পরিণত হলো? হরিপদ বলে, জানি নারে মাধব। মাধবের হাতে গুলিবিদ্ধ পাখির ব্যাগ। ওজন মন্দ নয়। বেশিক্ষণ থাকলে পাখি পঁচে যাবে। সেই ভোরে মোরগ ডাক দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘুম থেকে ওঠেছে সে। তাই হয়তো শরীরও ক্লান্ত হয়। মনে মনে ভাবে, হরিপদ দাদার কি তাহলে পাখির প্রতি বিবেক জাগ্রত হয়েছে? জীবনে সে কতো পাখির যে চোখ উপড়ে দিয়েছে, এসবের যন্ত্রণা তো তাকে পুড়ে পুড়ে খাবেই। হঠাৎ মাধব চেঁচিয়ে ওঠে, দাদা ওই যে বাদল চক্রবর্তীর কদমগাছটা, ঠিক ওই বরাবর জলকচু গাছটা, তার ডানে হেলেঞ্চাগুলো, তার মাঝেই, কী দেখছ ওটা? হরিপদ বলে, হুম, বেশ বড়সড় একটা ডাহুক। মাধব বলে, দাদা মারো। এটা নিয়েই ফিরে যাবো। গুলি ছুঁড়ে হরিপদ। কিন্তু পাখিটা গুলি খেয়েও উড়ে গিয়ে কাঁটায় ভরা এক জংলার দিকে চলে যায়। পিছে পিছে দৌড়ে যায় মাধব। পাখি ছাড়াই ফিরে আসে। কাঁটায় তার শরীরের অনেকাংশই ক্ষত বিক্ষত। হরিপদ বলে, পাখিটা কোথায়? ‘পালিয়ে গেছে’। মাধব বলে। অসম্ভব। ক্ষেপে যায় হরিপদ। বলে, কয়েকদিন আগেও আমি ওদিকে চার পাঁচটি বেজি দেখেছি। যেখানে বেজি থাকে, সেখানে সাপ থাকে না। সাপেরা বেজিকে ভীষণ ভয় পায়। কথাটা জেনে রাখিস। মাধব বলে, চোরকাঁটার অত্যাচারে আমার প্যান্টের অবস্থা দেখেছো দাদা? হরিপদ রেগে মাধবের চোখের দিকে চায়। হরিপদের চোখ এখন রক্তজবা ফুল। মাধব বলে, দাদা দেখো ঐ যে কী সুন্দর পদ্মফুল ওখানে ফুটেছে। কয়েকটা তুলে আনি? হরিপদ কথার জবাব দেয় না। মাধব বলে, হরিপদ দা’ ঐ দেখো অর্জুন গাছটার মগডালে একটি হাড়গিলা উড়ে এসে বসেছে। ফোঁস করে ওঠে হরিপদ। আর ঐ গুলিবিদ্ধ ডাহুক পাখিটার কী হবে? মাধব বলে, দাদা আমি শুনেছি ঐ জায়গাটায় অনেক জোঁক রয়েছে। হরিপদ বলে, আজকের পর থেকে তুই কইমাছ, রুইমাছ বা সরপুঁটি মাছ ধরিস। পাখি শিকারে আসার কোনো দরকার নেই। মাধব আর কিছুই বলে না। চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। পাখিটা গেল কোথায়? হরিপদ নিজে নিজে বিড়বিড় করে বলে। ততক্ষনে বেলাও পড়ে গেছে। চারদিকে জলে ঘেরা পরিত্যক্ত ভাঙ্গা মন্দিরটার দিকে এগোয় হরিপদ। পুরো মন্দিরটা ক্ষয়ে ক্ষয়ে মাত্র একটি স্তম্ভের আকার ধারন করেছে। অথচ একদা এ মন্দিরের হিন্দু স্থাপত্যশৈলী মানুষের মুখে মুখে ছিল। পোড়ামাটির কাজগুলোর অবশিষ্টও আর নেই। ওখানে কেউ সহজে যায় না। দিনেদুপুরে মশার ঝাঁক রীতিমত হামলা করে। হঠাৎ দেখে হরিপদ গুলিবিদ্ধ রক্তাক্ত ডাহুকটা স্তম্ভটার দিকে উড়ে গিয়ে লুকায়। হরিপদ মাধবকে ডাকে, মাধব ডাহুকটা পাওয়া গেছে, গুলিটা ঠিকভাবে বিঁধেনি। ঝোপটা লক্ষ্য করে আরও গুলি ছুঁড়ে। কিন্তু পাখিটাকে না দেখে ঠিক কোথায় গুলি করবে হরিপদ? গাছে গাছে কাঠবিড়ালী। পায়ের তলে কোলাব্যাঙ গেড়ি শামুক-বড় শামুক ডিঙ্গিয়ে স্তম্ভটার ঠিক মুখোমুখি হয় হরিপদ। দেখে কিছু গেছোব্যাঙ। এই স্তম্ভের আশেপাশের জমিতেও বর্ষা-শরতে কোনো চাষাবাদ হয় না। তাই ঘন ঝোঁপঝাড়ে পরিপূর্ণ জায়গাটা। ঝোঁপের ভিতর নিজের গুলি করা ডাহুকটিকে খুঁজে বেড়ায় হরিপদ। বন্দুক তাক করে বিভিন্ন গাছের ডালপালায় খুঁজে দেখে। হঠাৎ পায়ের কাছে কী যেন একটা ফোঁস করে ওঠে। সঙ্গে সঙ্গেই আবার ফোঁসফোঁসানি শেষ। কাঁপুনি খায় হরিপদ। গুলিবিদ্ধ ডাহুকের জন্য ছটফটানো হরিপদ টের পায় তার বাম পা দিয়ে রক্ত ঝরছে। যন্ত্রণা অনুভব করে। মাথা ঝিমঝিম করে। দাঁতে দাঁত লেগে যেতে চায়। চোখ উল্টে আসে। হরিপদ বুঝে তাকে বিষধর সাপে কেটেছে। পাখির রাজ্যে প্রবেশ করে সে ভাবেনি কখনোই, এখানেও থাকতে পারে কোনো বিষধর সাপ। কিন্তু তার ভাবনায় কী আসে যায়? সাপের বিষদাঁতের ক্ষত থেকে আরও রক্ত বের হয়। মানসিক ভারসাম্য হারাতে থাকে ক্রমেই। হাঁপাতে হাঁপাতে ঝোঁপঝাড় পার হয় হরিপদ। গোঙাতে গোঙাতে মাধবকে ডাকে, মাধবরে সাপে কেটেছে আমাকে। সর্পদংশন। সাপুড়ে বা বৈদ্য খবর দে। আমি বোধ হয় বাঁচবো না। বলেই হরিপদ মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। দৌড়ে আসে মাধব। দেখে হরিপদের জিব বের হয়ে এসেছে। মুখ থেকে গ্যাজলা বের হয় শুধু। মাধব তার কান্না ধরে রাখতে পারে না। চিৎকার করে লোক ডাকে। গোঙাতে গোঙাতে হরিপদ মাধবকে বলে, তোর বৌদি সুহাসিনী আর আমার মেয়ে চঞ্চলা...। আর বলতে পারে না হরিপদ। শোকার্ত মাধব একবার চিৎকার করে লোক ডাকে আবার হরিপদকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে। গাছে গাছে কাকগুলোও সব কা-কা রবে কাতরাতে থাকে। হরিপদের শরীর হয়ে যায় ক্রমাগত নিস্পন্দনিথর বিষদদ্ধ। দূরে দিগন্তবিস্তৃত পাবদাবিলের জল, অন্যদিকে ধানের ক্ষেতে সবুজের মৃদু ঢেউ। বিলের ধারে শুভ্র কাশফুল গুচ্ছে গুচ্ছে ফুটে আছে। আরও দূরে মাঝিদের কয়েকটি নৌকা। বাতাস ভরা শিউলীফুলের ঘ্রাণ। এই তো আর ক’দিন পরেই বেজে উঠবে দুর্গাপূজার ঢোল... টাক ডুম টাক ডুম..। রচনা: ২০০২ খিস্টাব্দ।

মন্তব্য ২ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ১২ ই জুন, ২০১৮ রাত ৩:০৪

জসীম অসীম বলেছেন: মগজবিহীন খুলিতে
খুনিরা নিত্য চালায় গুলি
===============

হে আমার পুত্র
কঠিন দিনের মুখোমুখি আমি।
আমার আছে মগজবিহীন খুলি
সেখানেও খুনিরা নিত্য চালায় গুলি।
মানুষ আজ কতো কতো কেমোথেরাপি নেয়
তবু মানুষ সুস্থ হয় না এবং মরেই যায়
শুয়ে শুয়ে আজকাল আমার
কতো কথা মনে হয়
হে আমার পুত্রধন
যদিও উরুগুয়ে-প্যারাগুয়ের
লড়াই দেখিনি আমি
দেখেছি এই মানবজীবনের
অভ্যন্তরীণ লড়াই।

1 জানুয়ারি, 2018
খয়রাবাদ, দেবিদ্বার, কুমিল্লা।

২| ১২ ই জুন, ২০১৮ রাত ৩:১৪

জসীম অসীম বলেছেন: মগজবিহীন খুলিতে
খুনিরা নিত্য চালায় গুলি
===============
হে আমার পুত্র
কঠিন দিনের মুখোমুখি আমি।
আমার আছে মগজবিহীন খুলি
সেখানেও খুনিরা নিত্য চালায় গুলি।
মানুষ আজ কতো কতো কেমোথেরাপি নেয়
তবু মানুষ সুস্থ হয় না এবং মরেই যায়
শুয়ে শুয়ে আজকাল আমার
কতো কথা মনে হয়
হে আমার পুত্রধন
যদিও উরুগুয়ে-প্যারাগুয়ের
লড়াই দেখিনি আমি
দেখেছি এই মানবজীবনের
অভ্যন্তরীণ লড়াই।

1 জানুয়ারি, 2018
খয়রাবাদ, দেবিদ্বার, কুমিল্লা।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.