নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

চলো আমরা পাখিদের কাছ থেকে ইউক্লিডের নতুন পাঠ নেই জীবনানন্দের পাঠ নেই নিউটনের আপেল গাছটি থেকে।

জসীম অসীম

লেখা হলো কেতকীফুল। ভালোবাসি তাই।

জসীম অসীম › বিস্তারিত পোস্টঃ

জীবনশিল্পের সম্রাট মতিন সৈকত

০২ রা জুলাই, ২০২১ দুপুর ২:১৪

নীলটুনিকে আমিও ভালোবাসি। কিন্তু সে ভালোবাসা প্রকাশ পায় আমার বিভিন্ন গল্পে বা কবিতায়। অথচ এমন একজন মানুষ আমাদের এ অঞ্চলে বাস্তবেই রয়েছেন, যিনি কিছু ক্ষুদ্রকায় মধুপায়ী পাখিকে ভালোবেসে রয়ে গেছেন পাখিদেরই রাজ্যে। যিনি কৃষকের বন্ধু এবং নদী ও পরিবেশ রক্ষায় রাখছেন বিশেষ অবদান। নাম তাঁর মতিন সৈকত। পাখির গাঢ় নীল বা বেগুনী রঙ যাকে সরাসরি গ্রামে বসবাস করতে অনুপ্রাণিত করেছে।
মতিন সৈকত বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় স্নাতকোত্তর করেছেন। কিন্তু নগর ঢাকার চাকচিক্য তাঁকে বেঁধে রাখতে পারেনি। এমন নদীবান্ধব, পাখিবান্ধব, বিষমুক্ত কৃষিবান্ধব মানুষটির সঙ্গে আমার পরিচয় আজকে নয়, সেই 1992 সালে। ঢাকায়।
প্রথম পরিচয় জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র পাঠাগারে। তারপর কেটে গেছে এক যুগ। আমি তখন ‘কুমিল্লার কাগজ’ পত্রিকায় কর্মরত। হঠাৎই একদিন এক সংবাদ এলো আমার হাতে। জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব প্রতিরোধে কাজ করা এক সৈনিকের সংবাদ। বিষমুক্ত ফসল আর নিরাপদ খাদ্যের নিশ্চয়তার লক্ষ্যেও কাজ করেন যিনি।
তারপর আবারও একদিন তাঁর সঙ্গে দেখা হয় আরেক পত্রিকার অফিসেই। কর্মব্যস্ততার ফাঁকে আর তাঁর সঙ্গে তেমন আলাপ করারই সুযোগ হয়নি আমার। তারপর কেটে গেছে কতো কতোদিন।
মাঝে মাঝে পত্রিকায় ও টেলিভিশনে তাঁর সাক্ষাৎকার দেখি। অথচ এতো আগে পরিচয় হওয়ার পরও একান্তে তাঁর সঙ্গে সময় নিয়ে কথা বলার সুযোগই হয় না আমার। তারপর গত শুক্রবারের বৃষ্টিস্নাত বিকেলে গেলাম মতিন সৈকতের বাড়িতে। দাউদকান্দির ইলিয়টগঞ্জ পার হয়ে পুটিয়ায় নেমে তাঁর জন্মস্থান আদমপুর গ্রামে।
তখন বাতাসে ঢেউ খেলিয়ে আকাশে উড়ছিল সাদা কালো মেঘ। আলোর ঝিলিকের মতো এগাছে-ওগাছে ঘুরে বেড়াচ্ছিল বিভিন্ন পাখি। কোথাও একাকি, কোথাও বা জোড়ায় জোড়ায়। আকাশে উড়ছিল পাখিরা তখন ঝাঁকে ঝাঁকে।
ফিঙে বা পাতা বুলবুলিদের দেখতে দেখতে আর মতিন সৈকতের নিজের অভিজ্ঞতার কথা শুনতে শুনতে দেখছিলাম প্লাবনভূমিতে মৎস্যচাষের বিভিন্ন চিত্র। তিনি তাঁর মৎস্য চাষের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন ঐতিহ্যবাহী ঢঙে।
গল্প করেন কালাডুমুর নদের খনন নিয়ে। জমিতে কীটনাশক প্রয়োগ না করেও কিভাবে ফসল ফলানো সম্ভব, সেই অভিজ্ঞতা নিয়ে।
তাঁর এসব গল্প যেমন একদিনের নয়, তেমনি সেসব শোনাও কোনো অল্প সময়ের কাজ নয়। কিভাবে প্লাবনভূমিতে প্রথম প্রথম মৎস্য প্রকল্প চালু করেন, তাঁর সেই গল্প শুনে তাজ্জব হয়ে যাই। ভাবি, বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করে একজন মানুষ কাদা জলে নেমে, রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে জীবনযাপন করার এতো সাহস কোথা থেকে পান?
তাঁর বাড়ির কাছেই রয়েছে তালগাছের সারি। ওখানে রয়েছে বাবুই পাখির ঝাঁক। বাবুইদের বাসার গড়ন ও সাজসজ্জায় রুচি ও বিলাসের ছাপ নিয়ে কথা বলতে বলতে নিজের জীবনের পাখি উদ্ধারের গল্পও বলতে থাকেন মতিন সৈকত।
ছোট মাছকে রক্ষার জন্য মৎস্য চাষীরা খামারে নেট বা সুতা দিয়ে বেষ্টনি দিয়ে রাখে। এতে অনেক পাখি আহত বা নিহতও হয়।
মতিন সৈকত এসব আহত পাখিদের খুঁজে বের করেন। তিনি এমন প্রায় তিন শতাধিক আহত পাখি উদ্ধার ও অবমুক্ত করেন। পাখিরা শুকনো পাতা, ঘাস, মাকড়সার জাল ও তন্তু দিয়ে কিভাবে তাদের বাসা তৈরি করে, এ নিয়ে তাঁর যে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা রয়েছে, গ্রামে না থাকলে মনে হয় এমন বর্ণনা করা যেন কখনোই সম্ভব নয়।
কোন পাখির বাসার উপরের দিকে এক পাশে গোলাকার প্রবেশ পথ থাকে, প্রবেশপথের মুখের ওপর সানশেডের মতো একটি জিনিস থাকে, এসব তাঁর জানা ঘটনা। বৃষ্টির পানি আটকানোর জন্য তাহলে অনেক পাখিও মানুষের মতো সানশেডের ব্যবস্থা করে!
বাসায় ডিম ও বাচ্চা রক্ষার জন্যও পাখিদের বিশেষ ব্যবস্থা থাকে। কোনো কোনো পাখি তাদের বাসার ভেতরে ডিম রাখার জন্য কোমল বিছানা গড়ে। বাবুই পাখির উদাহরণ দিতে গিয়ে বলেন, বাবুই পাখির বাসা বাতাসে খুবই দোলে। এ থেকে ডিম বা বাচ্চা রক্ষা করার জন্য তাদের থাকে বিশেষ ব্যবস্থা। ... ।
আমি যখন তাঁর কথা শুনছিলাম,
তখনই আমাদের পাশ দিয়ে উড়ে গেল এক কালো মাথা মাছরাঙা। অনেকদিন পর দেখলাম জমিতে কিছু শামুকের খোলও। কিছু ফিঙে যেন ঠিক আমাদের কথাই শুনছিল। এমনই ভাব ছিল ওদের। ডাহুকেরও দেখা পাওয়া গেল এক জায়গায়। আহা কতোদিন পরে আবার এতো তামাটে ঈগল দেখলাম বাংলার আকাশে। বলা চলে মতিন সৈকতের আদমপুরের আকাশ। সেই আদমপুর মতিন সৈকতের গ্রাম।
যে মতিন সৈকতের দেখা পেয়েছিলাম আমি 1992 সালের ঢাকায়, এ যেন সেই মতিন সৈকত নয়। এ মতিন সৈকত কানিবকের বন্ধু। পানকৌড়ির প্রতিবেশি। সারসের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। বালিহাঁসের স্বজন। এ মতিন সৈকত নিজেকে ‘কৃষক’ বলতে বিন্দুমাত্রও কুণ্ঠা বোধ করেন না।
কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতার ‘শঙ্খচিল’ নিয়ে যিনি বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে তাঁর নিজস্ব অনেক কল্পনা আকাশে উড়িয়েছিলেন, তিনি এখন প্লাবনভূমির মৎস্য চাষ এলাকার মৎস্য চাষীদের খামারে আটক অথবা বন্দী কিংবা আহত শঙ্খচিল উদ্ধার করে কল্পনার নয়, বাস্তব আকাশে উড়িয়ে দেন এবং তাঁর নিজের কবি আত্মাকে প্রতিনিয়তই অবমুক্ত করেন। এ যেন এক অসাধ্য সাধনার জীবন। নিজের ব্যক্তিজীবনকে যিনি এমনই কবিত্বময় করতে পারেন, তিনিও কোনো সহজ শিল্পী নন এবং অবশ্যই তিনি এক জীবনশিল্পের সম্রাট। তাই তিনি মানুষের ভালোবাসাকে অনুগত করেই তাঁর সৃষ্টিশীল কাজের আপন রাজ্য পরিচালনা করেন।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.