নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

চলো আমরা পাখিদের কাছ থেকে ইউক্লিডের নতুন পাঠ নেই জীবনানন্দের পাঠ নেই নিউটনের আপেল গাছটি থেকে।

জসীম অসীম

লেখা হলো কেতকীফুল। ভালোবাসি তাই।

জসীম অসীম › বিস্তারিত পোস্টঃ

জীবনশিল্পের সম্রাট মতিন সৈকত

০৭ ই জুলাই, ২০২১ বিকাল ৫:৫০


কালাডুমুর নদীর কাছে
এখন আর কোনো জলমোরগ নেই
====================
একটি বকপাখি ডানা বন্ধ অবস্থায় বসে ছিল বিশাল জলরাশির ধারে। আর আমরা এর পাশ দিয়ে কথা বলতে বলতে যাচ্ছিলাম। আমি আর মতিন সৈকত। বকটি উড়ে অন্যদিকে চলে গেল।
ডানা খোলা অবস্থায় যা চমৎকার দেখা গেল বকটিকে, যার চোখ পারিবারিক, সামাজিক বা সাংস্কৃতিকভাবে সেভাবে নির্মিত হয়নি, মনে হয় না সে বুঝবে এর প্রকৃত নান্দনিকতা।
আমি মুগ্ধ হয়ে গেলাম। অথচ এ দৃশ্য বাংলাদেশের মানুষের কাছে প্রতিক্ষণের জন্যই পরিচিত এক বিষয়।
একবার একটি কমলাটে লাল বর্ণের পাখি দেখলাম। পরের মুহূর্তে দেখার আগেই কোথায় হারিয়ে গেল, অনেক চেষ্টার পরও খুঁজে পেলাম না আর।
অনেক অনেক তালগাছের দেখা পেলাম দাউদকান্দির সেই আদমপুর, পুটিয়া আর বিটমান গ্রামে। মনে হলো আর কিছুদিন পরে গেলেই মাটিতে পড়া পাকা তাল খুঁজে পাবো। খেজুর, সফেদা, লিচু...কী গাছ নেই সেই সচেতন গ্রামে!
তবে আমি মুগ্ধ হলাম বিশেষ করে হিজল গাছ দেখে। কারণ আমি সেই বাবার সন্তান, যে বাবা তাঁর নিজের গ্রামে হিজল গাছ ছিল না বলে শিশু সন্তানকে সেই গাছ দেখাতে কয়েকমাইল দূরের এক গ্রামে নিয়ে যান। তাই আমার সেই শৈশবের পিতৃস্মৃতিজড়িত হিজলগাছ দেখে সত্যিই বিমুগ্ধ হয়ে যাই।
বিশাল জলরাশির মৎস্য প্রকল্পের পাড়ে পাড়ে কোথাও চোখে পড়ে ধেনো ইঁদুরের গর্ত। ইঁদুর আমাদের শত্রু হলেও এটা বুঝতে কারো অসুবিধা হয় না যে, ব্যাঙ ও শামুক আমাদের পরিবেশের জন্য কত আপনজন। কথা বলাবলির ফাঁকেই একবার লক্ষ্য করলাম, অনেক দূরে বসে একটি ঈগল মনে হলো শামুকের ভেতরের মাংসই যেন তৃপ্তি নিয়ে খাচ্ছে।
প্রথমদিকে কথা বলছিলাম মতিন সৈকতের সঙ্গে তাঁর খাল ও নদীর পুনঃখনন আন্দোলন নিয়ে। ‘এই মূহুর্তে দরকার, খাল-নদী সংস্কার’ বিষয়ে। যদিও মতিন সৈকত তিন দশকের বেশি সময় ধরে বিষমুক্ত ফসল ও নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন, নামমাত্র মূল্যে সেচ সুবিধা প্রদান, খাল-নদী পুনঃখনন আন্দোলন, প্লাবন ভূমিতে মৎস্য চাষ সম্প্রসারণ, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ, সামাজিক উন্নয়নসহ দশটি খাতে পরিবর্তনের নেতৃত্ব দিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, কিন্তু আমি তখন তাঁর সঙ্গে কথা বলছিলাম শুধুমাত্র তাঁর খাল ও নদীর পুনঃখনন আন্দোলন নিয়েই।
আমারই এক প্রশ্নের জবাবে মতিন সৈকত বলেন, বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থানের কারণেই এখানে নদীকে বাঁচানো দরকার। নদীমাতৃক দেশ হিসেবে বাংলাদেশ পৃথিবীতে একটি উল্লেখযোগ্য দেশ। কিন্তু বিশ্বজুড়ে উষ্ণায়নের ফলে অনেক দেশই বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্থ। অন্যদিকে এ উষ্ণায়নসহ আরও নানা কারণে এমনিতেই আমাদের নদীর সংখ্যা অনেক কমে গিয়েছে। এটা শুভ লক্ষণ নয়।
বিশ্বজুড়ে তাপমাত্রার দ্রুত বিরূপ পরিবর্তনের ফলে প্রায় সব দেশেই পরবাসী হয়ে যাচ্ছে আমাদের পরিবেশবান্ধব নদীরা। এ অবস্থায় আমি মনে করি, প্রত্যেকেই নিজ নিজ অবস্থান থেকে এ বিষয়ে এগিয়ে আসা উচিত। তাই আমিও আমার নিজ নদী কালাডুমুরের কথাই আগে বলে যাচ্ছি। কালাডুমুর আমার নদী। এ নদীর বিপন্ন হওয়ার বিষয়ে আমি কোনোভাবেই ছাড় দিতে পারি না।
আমরা এখন যেমন পরিবেশে বেঁচে আছি, এমন প্রতিকূল পরিবেশে নদী বাঁচতে পারে না। আমার কালাডুমুর নদীরও দুরবস্থার সীমা নেই। আমাদের এখানকার প্লাবনভূমিতে মৎস্য চাষের জন্য কৃষিজমিগুলো এখন বছরের অর্ধেক সময়জুড়েই একধরনের জলাশয়ের ভূমিকা পালন করে। এটা অর্থনৈতিক ও পরিবেশবান্ধব একটি সফল কর্মসূচি। কিন্তু অতীতে সরকারিভাবে যথাযথ ভূমিকা না নেওয়ার কারণে কালাডুমুরসহ দেশের অনেক নদীই আজ বন্ধ্যাত্বের শিকার হচ্ছে। আমরা ঠিক এই অবস্থারই প্রতিবাদ করছি। কারণ অধিকাংশ মানুষই এখন বেপরোয়া।
সবদিকে মানুষ বাড়ার সাথে সাথে খাদ্যের চাহিদাও বাড়ছে। অল্প জমিতে বেশি ফলনের আশায় মানুষ পাগলের মতোই ব্যবহার করছে রাসায়নিক সার আর কীটনাশক। এ লক্ষণ বড়ই ভয়াবহ। আমরা মানুষের কাছে এই বার্তাটিই দিতে নিয়মিত চেষ্টা করছি যে, কৃষিজমিতে এভাবে নির্বিচারে কীটনাশক ব্যবহার করা যাবে না। কারণ এতে শুধু পাখিদেরই খাদ্যসংকট তৈরি হবে না, আমাদের শরীরেও এসব ক্ষতিকারক দ্রব্য ঢুকে পড়ে মৃত্যুর কারণ হবে।
আমি তাঁকে প্রশ্ন করি, আপনার ছোট্ট এই গ্রামে থেকে এত বড় পদক্ষেপের স্বপ্ন কিভাবে এবং কবে বাস্তবায়ন করবেন? মতিন সৈকত বলেন, আমি একটি ছোট্ট গ্রামেই বাস করি, এ কথা ঠিক। কিন্তু আমার চিন্তা বা আমার স্বপ্ন শুধুমাত্র একটি গ্রামেই সীমাবদ্ধ নেই। মানুষের জন্যে আগামী পৃথিবীকে বাসযোগ্য করতে হলে আমাদের প্রত্যেককেই যার যার অবস্থানে থেকে এমন বড় বড় স্বপ্ন দেখতে হবে এবং তা বাস্তবায়নের জন্য নিয়মিত চেষ্টা করতে হবে।
কারণ আমাদের মাটি, পানি, বাতাস প্রতিনিয়তই বিভিন্নভাবে দূষিত হচ্ছে। এক্ষুনি তার বিপক্ষে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। এ কাজটি কারো একার পক্ষে সম্ভব নয়। এদেশের অনেক নদীই আজ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। সেগুলোকে আর ফিরে পাওয়া যাবে না। তাই বিপন্ন নদীকেই আগে রক্ষা করতে হবে। অথচ আমাদের হাতে তেমন সময়ও নেই। প্রতিকূল অবস্থা প্রতিরোধেরও একটি মোক্ষম সময় থাকে। আমাদের অনেক সময়ই বয়ে চলে গেছে। সময় বা মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে আর অনেক কাজই হবে না। মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ প্রায়ই বিষে রূপান্তরিত হয়। তাই মানুষের জন্যে আগামী পৃথিবীকে বাসযোগ্য করতে হলে আমাদের প্রত্যেককেই বড় বড় স্বপ্ন বাস্তবায়নে কাজ করতে হবে এবং তা এক্ষুনিই। কারণ সময় নেই।
আমি সেই ১৯৯০ সাল থেকেই খাল-নদী পুনঃখনন আন্দোলন করছি। তখন আমার বয়স কত ছিল! বয়স আমাকে আটকে রাখতে পারেনি। তার কারণ আমি আমার অঞ্চলের নদী কালাডুমুরকে নিজেরই নদী মনে করেছিলাম। এমনভাবে সবকিছুকে নিজের মনে করতে হবে। আমি যদি ভাবতাম এটি রাষ্ট্রের দায়িত্ব। এ নিয়ে আমি কেন মাথাব্যথা করবো, তাহলে এতদূর এগিয়ে আসা যেত না।
আমি মনে করেছি আমারও দায়িত্ব রয়েছে। কালাডুমুর নদীটির তলদেশ বালি,পলি জমে ভরাট হয়ে যাওয়ায় আমার তখন খুব খারাপও লাগতো। আরও খারাপ লাগতো যখন দেখতাম কালাডুমুরের পানি শুকিয়ে গেলে এখানকার কৃষকদের বোরোধানের আবাদে মারাত্মক বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিতো।
কালাডুমুর নদীর ইতিবৃত্ত জানতে চাই মতিন সৈকতের কাছে। বলি, এ ছোট্ট নদীটির কেন এত গুরুত্ব আপনার কাছে?
মতিন সৈকত এ বিষয়ে যা বলেন, তা অপূর্ব।
তিনি বলেন, একটি গ্রাম সবুজ আর আরেকটি গ্রাম রোদে পুড়ে অঙ্গার বা না সবুজ। একটি বৃক্ষে কিছু পাখির বাসা রয়েছে এবং আরেকটি বৃক্ষে কোনো পাখির বাসা নেই। কিছু গ্রামে একটি নদী রয়েছে এবং কিছু গ্রামে কোনো নদী নেই: এসবের মধ্যে আসলে বিস্তর পার্থক্য রয়েছে। তাই কালাডুমুর নদীকে আমি এই অঞ্চলের সৌভাগ্য মনে করি।
এ নদী অত্র অঞ্চলের গ্রামগুলোকে কাচা সোনার মতো আকর্ষণীয় করেছে। করেছে বাংলাদেশের পতাকার সবুজ জমিনের মতোই সবুজ। কিন্তু এ নদী এখন বিরল পাখির মতোই বিলুপ্তির মুখে পড়েছে। ভীষন লাজুক স্বভাবের এ নদী। হিংস্রতা এর বৈশিষ্টে নেই।
এ কালাডুমুর নদীর উৎপত্তি হয়েছে কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলার গৌরীপুর এলাকায় গোমতী নদী থেকে। ইলিয়টগঞ্জ পর্যন্ত এর দৈর্ঘ্য ৪,১৮৫০ ফুট। প্রায় ১৩ কিলোমিটার। আমি নিজ উদ্যোগে এবং নিজ খরচেই এ নদীর দৈর্ঘ্য পরিমাপ করে একে পুনরায় খননের জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডে আবেদন জমা দিয়েছি।
একজন মানুষ নিজের খরচে নদীর দৈর্ঘ্য পরিমাপ করেন, এমন মানুষও আমাদের বাংলাদেশে রয়েছেন? আমি প্রশ্ন করি।
আর কেউ আছেন কী না আমার জানা নেই। তবে তোমাদের দোয়ায় নিজ খরচে আমি এ কালাডুমুর নদীর দৈর্ঘ্য পরিমাপ করেছি। কারণ পানি উন্নয়ন বোর্ডের কাছেও তখন এ নদীর সুস্পষ্ট দৈর্ঘ্যের কোনো তথ্যই ছিল না।
আমি ভাবলাম, এ নদীর পানি কুমিল্লা ও চাঁদপুর জেলার দাউদকান্দি, চান্দিনা, মুরাদনগর, কচুয়া এই চারটি উপজেলার আনুমানিক ৫০ হাজার বিঘা জমির বোরো ধানের সেচের উৎস। প্রায় ১২ লক্ষ্য ৫০ হাজার মণ ধান ফলন এই সেচের সঙ্গে জড়িত। সুতরাং এই নদীর দৈর্ঘ্য পরিমাপের খরচ তাৎক্ষনিকভাবে কে আর কী কারণে বহন করবে! এটি বরং আমিই আমার নিজের খরচে করি।
এ নদীর পানি শুকিয়ে যাওয়ায় ২০০৭ সালে আমার উদ্যোগে প্রথমে ২ কিলোমিটার এবং পরে ২০১৫ সালে আধা কিলোমিটার পুনঃখনন
করে সেচের প্রবাহ সচল রাখি। এ নদীর পানি প্রবাহের প্রয়োজনে আমি বিভিন্ন সময়ে কচুরিপানা পরিস্কার করেছি।
আমি বললাম, আপনার আন্তরিকতা বা শ্রম অথবা এমন অর্থব্যয় কি ফলপ্রসূ হয়েছে?
মতিন সৈকত বলেন, একদিনে কেউ মাউন্ট এভারেস্ট জয় করতে পারেনি। কোনো বিলুপ্তপ্রায় প্রাণী বা নদীকে রক্ষা করাও এত সহজ ঘটনা নয়। এ নিয়ে আমাদের আন্দোলন ও বিভিন্ন পদক্ষেপ অব্যাহত রয়েছে।
এ নদীটি খননের জন্য সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে আমরা ১৪ বার মানববন্ধন, সংবাদ সম্মেলন, প্রতীকী অনশন এবং কোদাল মিছিল করেছি। উপজেলা এবং জেলা প্রশাসন, পানি উন্নয়ন বোর্ডে আবেদন করে চলেছি। দাউদকান্দির মাননীয় এম,পি মহোদয়ের কাছে নদীটি পুনঃখননের জন্য দাবি জানিয়ে আসছি। এ নিয়ে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান এবং কৃষিমন্ত্রীর সাথেও দেখা করে কথা বলেছি। নদীটি খননের জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সাথেও সাক্ষাৎ করে নদী উদ্ধারের দাবি জানিয়েছি।
আর আমার এবং আমাদের এ অঞ্চলের মানুষের দাবী আর এ শ্রম অবশ্যই বৃথা যায়নি। কারণ সুখবর হচ্ছে কালাডুমুর নদীটি পুনঃখননের
জন্য সরকারি বাজেট বরাদ্দ হয়েছে। আগামী সেচ মৌসুমের শুরুতে এটিকে পুনঃখনন
করা হবে।
কিন্তু আপনার নদী রক্ষার এই আন্দোলন আমাদের গণমাধ্যমের কতটা আনুকূল্য পাচ্ছে? আমি প্রশ্ন করি।
মতিন সৈকত বলেন, গমাধ্যমের সহযোগিতা আমরা পাচ্ছি। অনেক গণমাধ্যমই এ বিষয়ে এগিয়ে এসেছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কৃষি মিডিয়া ব্যক্তিত্ব শাইখ সিরাজ ২০১৫ সালে আমাকে নিয়ে একটি অনুষ্ঠান করেন। জনাব শাইখ সিরাজ সেই অনুষ্ঠানে কুমিল্লা জেলার দাউদকান্দির আমাদের এই আদমপুর গ্রাম, মরা নদী কালাডুমুর এবং আমার নদী রক্ষা আন্দোলনসহ বিভিন্ন কর্মসূচি নিয়ে অনেক মূল্যবান কথা বলেন। দীর্ঘদিন ধরে যে কালাডুমুরের কোনো খনন নেই এবং এটা যে পলি জমতে জমতে ভরাট হয়ে গেছে, সে কথাও তিনি তাঁর সেই টি.ভি অনুষ্ঠানে বলেন।
2007 সালে আমার নেতৃত্বে স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে স্থানীয় কৃষকরা সংগঠিত হয়ে যে এই কালাডুমুর নদীটি খনন করেন এবং এতে করে যে গোটা এলাকার কৃষিচিত্রও পাল্টে যায়, সে কথাও জনাব শাইখ সিরাজ বলেন।
আমাদের সাহিত্যেও বিভিন্ন নদীর নানারকম বিবরণ রয়েছে। মাইকেল মধুসূদন দত্তের কপোতাক্ষ নদের কথা আমরা কে না জানি! মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যেও ভাগীরথী নদীর অনেক উদার প্রশস্তি করা হয়েছে। পদ্মাপুরাণ, কবিকঙ্কণ চণ্ডী এমনকি মুসলমান কবিদের রচনাতেও গঙ্গার স্তুতি দেখা যায়। বিপ্রদাস পিপলাই এর মনসামঙ্গল কাব্যে অজয় নদ থেকে গঙ্গাসাগর পর্যন্ত ভাগীরথী-হুগলির প্রবাহপথের এক মনোজ্ঞ বর্ণনা পাওয়া যায়। এই কালাডুমুর তার অস্তিত্ব রক্ষা করতে পারলে নিশ্চয়ই ভবিষ্যতের অনাগত কোনো কবির বা গল্পকারের রচনায় নতুন মাত্রা পেতেও পারে। হোক সে ছোট নদী, অবহেলা করা যাবে না। আমাদের যে ছোট নদীর বৈশাখ মাসে হাঁটুজল থাকে, সেই নদীকে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ কতো মহীয়ান করে তুলেছেন।
বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে মতিন সৈকত আমাদের সঙ্গে নন্দনতত্ত্বও পড়েছেন। এসথেটিকস্ বা নন্দনতত্ত্ব মূলত দর্শনের একটি শাখা, যেখানে শিল্পের রূপ-রস-সৃষ্টি এবং সৃষ্টির উপভোগ নিয়ে আলোচনা করা হয়। এ নন্দনতত্ত্ব শিল্প ও সংস্কৃতির প্রকৃতি নিয়ে সমালোচনামূলকভাবে অনেক আলোচনা করলেও তা মানুষের আবেগ ও অনুভূতির মূল্য নিয়েও গভীর আলোচনা করে। মতিন সৈকতের নান্দনিক এ আন্দোলনের অভিজ্ঞতাগুলো বৈচিত্র্যময়। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের কোনো অধ্যাপকের বক্তব্যের চেয়ে তাঁর কথাগুলো আমার কাছে কোনো অংশেই গুরুত্বপূর্ণ নয়।
একজন মানুষের আবেগ এবং অনুভূতি কতোটা পরিশুদ্ধ হলে পরে ব্যক্তিগত প্রয়াসে একটি নদীর দৈর্ঘ্য পরিমাপে উদ্যোগী হোন, তা হাবল স্পেস টেলিস্কোপে দেখার বিষয় নয়, শুধুমাত্র তা অনুভবেরই বিষয়। তবে সেই মানুষটির মনের উচ্চতা আর তাঁর আবেগ এবং অনুভূতি পরিমাপ করা শিল্পকলার বা নন্দনতত্ত্বের বিষয়। এমন আবেগী মানুষ যুগে যুগেই ছিলেন। না হলে মানবসংস্কৃতি এগিয়ে যেত না।
সাহিত্যের ক্ষেত্রে মহাকবি গ্যেটে বলেছিলেন যে, শিল্পের বা সাহিত্যের উৎস হলো মানুষ এবং তার বাস্তব জীবন। আমার মনে হয়, কালাডুমুর নদীকে বাস্তবেই এমন ভালোবেসে যাওয়া মতিন সৈকত বিনা দ্বিধায়ই হতে পারেন কোনো মহৎ সাহিত্যিকের উপন্যাসের বিষয়। তাঁর জীবনের এ গল্পে রয়েছে অপ্রচলিত গল্প আর বৈচিত্র্যময় কাহিনী। তাই এ কথা বলতে কোনো দ্বিধা নেই আমার।
এই সমাজের সবাই যে নদীপ্রেমিক, তা কিন্তু নয়। এদেশের অনেক আগ্রাসী মানুষ ছোট ছোট কতো খরস্রোতা নদী গিলে খেয়েছে। ছবির মতো সুন্দর অনেক নদী আমাদের মানচিত্র থেকেও এখন হারিয়ে গেছে। সেসব নিয়ে আজও নানা জনশ্রুতি শোনা যায় মানুষের মুখে মুখে। তাই অনাব্যতার করাল গ্রাস থেকে মতিন সৈকতের কালাডুমুরকে রক্ষার আন্দোলনে আমাদেরও সমর্থন জানানো উচিত।
যে মানুষটি তাঁর বাস্তব জীবনে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে দীর্ঘসময় ধরে এমনভাবে কাজ করে যাচ্ছেন, যিনি হাজারো আহত পাখি, বিরল প্রজাতির বন বিড়ালের ছানা, বেজি ও গুইঁসাপ ... ইত্যাদিকে উদ্ধার ও বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা প্রদান করে প্রাকৃতিক পরিবেশে অবমুক্ত করেন, সমাজের হাজারো মানুষ থেকে তাঁর ভূমিকা নিঃসন্দেহে ব্যতিক্রম। কারণ আমাদের সমাজের হাজারো লক্ষ কোটি মানুষের মধ্যে সব্বাই আইজাক নিউটন, জীবনানন্দ দাশ বা অ্যালিস মানরো হয়ে উঠেন না। কেউ কেউই ফিওদোর দস্তয়েভস্কি হোন।
তাই মনে করি জীবদ্দশাতেই মতিন সৈকতকে তাঁর প্রাপ্য সম্মানটুকু দেওয়া উচিত। শুধুমাত্র পদক, সনদ বা প্রচারণাই নয়, তার চিন্তাচেতনাকে গতিশীল করতে তাকে রাষ্ট্রের অর্থ দিয়েও সহযোগিতা করা উচিত। সক্রেটিস বা মির্জা গালিবসহ এ পৃথিবীর শত শত মনীষী জীবদ্দশায় তাদের প্রাপ্য সম্মানটুকু পাননি। তাই কোনো প্রতিভাবান ব্যক্তিই মরে গেলে আর এ কথা বলে কোনো লাভ নেই যে, লোকটি মিষ্টি আলুর হালুয়া আর পায়েস পছন্দ করতেন।
কেননা মতিন সৈকতের শেষ কথাগুলো অত্যন্ত হৃদয়বিদারক। তিনি বলেন, আমি আমার শৈশবে দেখতাম বিভিন্ন এলাকা থেকে কালাডুমুরের আশেপাশে বিভিন্ন প্রজাতির পাখি এসে পাড়ি জমাতো। অনেক পাখি। এখানে তাদের বাচ্চা জন্ম দিতো। কিন্তু যখন কালাডুমুর শুকিয়ে যেত, তখন সেই পাখিরা কোথায় যেন আবার হারিয়েও যেত।
আমি কবি ছিলাম। কবিতা লিখতাম। বড় হয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে লেখাপড়া করেছি। কালাডুমুরের জন্য আমার অন্তরাত্মা সব সময়ই কেঁদে উঠতো।
কালাডুমুর নদীর আশপাশটা জলমোরগ পাখির আস্তানা ছিল। আমাদের পূর্ব পুরুষদের কাছে শুনেছি। আমার শৈশবেও কালাডুমুরের কাছে কখনো কখনো জলমোরগ পাখি দেখেছি। এখন তুমি আর এখানে একটি জলমোরগও খুঁজে পাবে না।
এতেই প্রমাণিত হয় আমাদের পরিবেশ কিংবা আমাদের কোনো নদীই আসলে এখন আর ভালো নেই। আমার শৈশবের আমনের মাঠগুলো ভাদ্র-আশ্বিনে মুখরিত থাকত বিভিন্ন জলজ পাখির ডাকে। সেই পাখিগুলো এখন কোথায়! কেন আমাদের দিনগুলো এভাবে বদলে গেল দ্রুত। কারণ আমরা আমাদের মাঠ ঘাট নদী জলাশয়সহ বিভিন্ন জলাধারগুলোকে কোনোভাবেই নিরাপদ-নিরুপদ্রব রাখতে পারিনি।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.