নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ইতিহাসের পাঠশালায়

আসিফ আযহার

শিক্ষার্থী, ইংরেজি বিভাগ, শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়।

আসিফ আযহার › বিস্তারিত পোস্টঃ

ইতিহাসের পাঠশালায়: পর্ব-১১ | রোমান গৃহযুদ্ধ: সিজার বনাম পম্পেই

১৫ ই ডিসেম্বর, ২০১৮ রাত ১০:৪১


খ্রিস্টপূর্ব ৪৯ সালে পম্পেই ও সিজারের মধ্যে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। সিজার গলদেশ অর্থাৎ ফ্রান্সে থাকাকালীন সময়ে রোমে তাঁর অনুচরদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতেন। এরা প্রলেতারিয়ানদেরকে সিজারের পক্ষে টানতে সমর্থ হয়। ৪৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সিজার দেশে ফিরে এসে পম্পেইকে হটিয়ে রোম দখল করে নিলেন। বণিক ভজা সিজারের বিজয়ে অভিজাত ভজা পম্পেই তাঁর সমর্থক সিনেটর ও অভিজাতদের নিয়ে বলকান অঞ্চলে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। সেখান থেকে তারা গৃহযুদ্ধ পরিচালনায় নেতৃত্ব দিতে থাকেন। রোম ত্যাগ করার আগেই পম্পেই সামরিক সাহায্যের জন্য তাঁর এক পুত্রকে আলেকজান্দ্রিয়ায় ক্লিওপেট্রার কাছে পাঠান। ক্লিওপেট্রা এ আহ্বানেও সাড়াও দিয়েছিলেন। ৬০টি জাহাজ এবং ৫০০ গেবিনিয়ান সৈন্য পম্পেইকে সাহায্য করার জন্য পাঠানো হয়।

পারিবারিক ভাবে ক্লিওপেট্রা পম্পেইর কাছে কৃতজ্ঞ ছিলেন। কারণ ৫৫-৫৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে পম্পেইর অনুগ্রহপুষ্ট সিরিয়ার রোমান গভর্নর গেবিনিয়াস ক্লিওপেট্রার পিতা দ্বাদশ টলেমি আউলেটসকে মিসরের ক্ষমতায় পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। গেবিনিয়াস মিসর ত্যাগ করার সময়ে তাঁর সৈন্যবাহিনীকে আউলেটসের অধীনে রেখে যান। এরা আউলেটসের ক্ষমতা পুনঃপ্রতিষ্ঠায় সহায়ক হয়েছিলো। এদেরকে বলা হতো গেবিনিয়ান সৈন্য। এ সৈন্যদের থেকেই ৫০০ জনকে ক্লিওপেট্রা পম্পেইর সাহায্যার্থে পাঠিয়েছিলেন। এছাড়া পম্পেইর সেনাবাহিনীর জন্য খাদ্যশস্যও পাঠিয়েছিলেন।


চিত্র: ব্রিটেন জয়ের পর জুলিয়াস সিজারের রোমে ফেরার দৃশ্য

পম্পেইকে সরাসরি সাহায্যদানের জন্য আলেকজান্দ্রিয়ার অধিবাসীরা ক্লিওপেট্রার প্রতি অসন্তুষ্ট ছিলো। কারণ জনসাধারণ রোমানদের প্রতি প্রচন্ড বিরূপ মনোভাব পোষন করতো। এর কারণ ক্লিওপেট্রার পিতার সুবাধে রোমানরা যেভাবে মিসরের সম্পদ লুট করেছিল তাতে অধিকাংশ জনগনই জর্জরিত হয়েছিলো। জনসাধারণের মধ্যে বিভিন্ন স্তর ছিলো। সর্বাধিক শোষিত ছিলো ক্রীতদাসেরা, তারপর কৃষক প্রজারা, উঁচু স্তরে ছিলো নাগরিকরা। নাগরিক মানে হলো অভিজাত ভূস্বামী ও বণিকরা। এরা সকলেই রোমান লুণ্ঠনের ভুক্তভোগী ছিলো।

রোমান মদদে দ্বাদশ টলেমির ক্ষমতায় ফিরে আসা এরা ভাল চোখে দেখেনি। রোমানদের শোষণের শিকার ছিলো ক্রীতদাস-প্রজা থেকে শুরু করে অভিজাত ও বণিক পর্যন্ত সকলেই। জাতীয় শোষণ এমন একটি ব্যাপার যাতে শোষিত দেশের অভ্যন্তরীণ শোষক ও শোষিত শ্রেণি উভয়েই ক্ষতিগ্রস্থ হয়। সেজন্য রোমের মিসর সম্পর্কিত নীতি এবং রোমান গৃহযুদ্ধের সাথে মিসরকে জড়িত করায় আলেকজান্দ্রিয়াবাসীরা ক্লিওপেট্রার প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে ওঠে। এই পরিস্থিতির সুযোগ গ্রহণ করলেন ক্ষমতাবঞ্চিত ক্লিওপেট্রার রাজকীয় প্রতিপক্ষ।

মিসরের রাজপ্রাসাদের অন্দরমহলে প্রাসাদ ষড়যন্ত্র ছিলো একটি নিয়মিত ব্যাপার। এ ষড়যন্ত্রে ক্লিওপেট্রা ধরাশায়ী হলেন। জনঅসন্তোষ এবং প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের চাপের মুখে ক্লিওপেট্রা আলেকজান্দ্রিয়া থেকে পালিয়ে দক্ষিণ মিসরে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন। ৪৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে দেশের বাইরে গিয়ে ফিলিস্তিনের কাছাকাছি আরব আদিবাসীদের এলাকায় নিজস্ব সেনাবাহিনী নিয়ে আশ্রয় নেন তিনি। ৫১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ক্লিওপেট্রা সিংহাসনের অংশীদার তার নাবালক ভাই ও স্বামী ত্রয়োদশ টলেমিকে বঞ্চিত করে নিজেই সিংহাসন দখল করে নিয়েছিলেন।


চিত্র: মিসরের টলেমীয় সৈন্য

এবার নাবালক ত্রয়োদশ টলেমিকে একক ভাবে সিংহাসনে বসানো হলো। ক্লিওপেট্রা পালিয়ে যাওয়ার পরে ৪৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে ত্রয়োদশ টলেমিকে সিংহাসনে বসানো হয়। নাবালক টলেমির নামে মূলত রাজ্য শাসন ও ভোগ করছিলেন প্রধানমন্ত্রী পথিনাস। অন্যরাও সুবিধা পাচ্ছিলেন। ত্রয়োদশ টলেমিকে পম্পেই সমর্থক সিনেটররাও গ্রিস থেকে সমর্থন জানালো। রোমান সিনেটের একাংশ তখন সিজারের সমর্থনে রোমে অবস্থান করছে আর বৃহৎ অংশটি পম্পেইর সাথে পালিয়ে গ্রিসে অবস্থান নিয়েছে। সিনেটরদের মাঝে অভিজাতদের সংখ্যা বেশি ছিলো বলে এই অবস্থা।

অতীতের রোমান দখলদারি প্রথা অনুযায়ী পম্পেই ত্রয়োদশ টলেমির অভিভাবক নিযুক্ত হন। তবে পম্পেইর সাথে টলেমির এই সংশ্লিষ্টতা রোমের সাথে ক্লিওপেট্রার ঐক্যবদ্ধ হওয়ার সম্ভাবনাকে জোরদার করে। ইতোমধ্যে রোমের গৃহযুদ্ধে অতি দ্রুত পটপরিবর্তন হতে থাকে। ৪৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মাঝামাঝি থেসালির যুদ্ধে পম্পেই সিজারের বাহিনীর হাতে সম্পূর্ণভাবে পরাজিত হন। নতুন সৈন্যবাহিনী সংগ্রহের জন্য তিনি মিসর যাবেন বলে সিদ্ধান্ত নিলেন। আগের বছর তিনি টলেমিকে স্বীকৃতি দিয়েছেন ও তার অভিভাবক নিযুক্ত হয়েছেন। একদিন টলেমির পিতাকেও তিনি সাহায্য করেছিলেন।

৫৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ত্রয়োদশ টলেমির পিতা আউলেটস যখন সাহায্য ভিক্ষার জন্য রোমে পৌঁছেছিলেন তখন কনসাল পম্পেই তাঁকে আদর আপ্যায়ন করেছিলেন এবং মিসরের সিংহাসনে পুনরায় বসার ব্যাপারে সাহায্য করেছিলেন। এর প্রতিদানে পম্পেই ত্রয়োদশ টলেমির সাহায্য পাবেন বলে আশা করলেন। এই সময়ে ক্লিওপেট্রা তাঁর সৈন্যবাহিনী নিয়ে আলেকজান্দ্রিয়া আক্রমণ করার জন্য এগিয়ে আসছিলেন। টলেমি তাঁর সৈন্যবাহিনী নিয়ে ক্লিওপেট্রাকে বাঁধা দেওয়ার জন্য মাউন্ট ক্যাসিয়াসে এসে শিবির স্থাপন করেন।

পম্পেই নৌবহর নিয়ে টলেমির সাথে সেখানেই দেখা করতে যান। ফ্ল্যাগশিপ ছেড়ে একটি ছোট নৌকায় চড়ে তিনি উপকূলের দিকে টলেমির শিবিরের কাছাকাছি পৌঁছান। তীর থেকে আর একটি নৌকা পম্পেইকে অভ্যর্থনা জানাতে এগিয়ে আসে। পম্পেই সে নৌকায় চড়ে তীরে পৌঁছালেন। কিন্তু হায়! তীরে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গেই পম্পেই আক্রান্ত হলেন। গেবিনিয়ান সেনাপতি সেপ্টেমিয়াসের আঘাতে তিনি ঘটনাস্থলেই নিহত হলেন। নিয়তির কি পরিহাস! স্বার্থ কী বিচিত্র জিনিস! একসময় গেবিনিয়াস ও গেবিনিয়ান সৈন্যরা ছিলো পম্পেইর অধীনস্থ।


চিত্র: রোমান রণতরী

পম্পেই সিরিয়া বিজয় করে গেবিনিয়াস ও তার অধীনস্ত সৈন্যদের রেখে গিয়েছিলেন অবাধে লুটে খাওয়ার জন্য। এর ওপরেও তাদের উপরি লাভ ছিলো দ্বাদশ টলেমির মিসরের রাজকোষ লুটে খাওয়ার সুযোগ। মিসরের সম্পদশালী রাজকোষ হতে উচ্চ বেতন পেয়ে গেবিনিয়ান সৈন্যরা পম্পেইর কথা ভুলে যায়। এই গেবিনিয়ান সৈন্যরা ক্লিওপেট্রার সময়ে সিরিয়ার রোমান গভর্নর বিবুলাসকেও বিপদে সাহায্য করতে অস্বীকার করেছিল। কারণ বিবুলাসকে সাহায্য করলে লুটের বখরা যা আসত, তাতে তারা সন্তুষ্ট ছিলো না।

মিসর হতে সিরিয়ার রাজকোষ নিতান্তই অস্বচ্ছল ছিলো। তাই গেবিনিয়ান সৈন্যরা সাহায্যপ্রার্থী বিবুলাসের দুই পুত্রকে হত্যা করেছিল। অবশ্য ক্লিওপেট্রা হত্যাকারীদের গ্রেপ্তার করে বিবুলাসের কাছে পাঠাতে পেরেছিলেন। শোষক মহলে পরস্পরের মধ্যে বিশ্বাসঘাতকতা, ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত ও যুদ্ধ-সংঘাত ছিলো অত্যন্ত স্বাভাবিক ব্যাপার। এতে অবাক হওয়ার কিছুই নেই। একসময়ের পম্পেইর সমর্থনপুষ্ঠ মিসর তাঁর সাথে চরম বিশ্বাসঘাতকতা করে সেটাই প্রমাণ করলো।

মিসরের যুদ্ধ জাহাজগুলি পম্পেইর নৌবহর আক্রমণ করে কয়েকটি ধ্বংশ করে এবং বাকিগুলি পালিয়ে যায়। কোন কোন ইতিহাসবিদ মনে করেন টলেমির নামে রাজ্য শাসনকারী প্রধানমন্ত্রী পথিনাস যিনি ছিলেন ক্লিওপেট্রা বিরোধী ষড়যন্ত্রের নায়ক, তিনিই এই পরিকল্পনা করেছিলেন। কারণ হয়তো জুলিয়াস সিজারকে খুশি করা। তাছাড়া গৃহযুদ্ধে পম্পেইর বিজয়ের সম্ভাবনা খুবই কমে গিয়েছিল। পম্পেইর মৃত্যুর পরে তাঁর ছেলেরা নেতৃত্ব গ্রহণ করে। পম্পেই নিহত হয়েছিলেন খ্রিস্টপূর্ব ৪৮ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর।

পম্পেই হত্যার মাত্র চার দিন পর জুলিয়াস সিজার ১০টি যুদ্ধ জাহাজ ও ৪০০০ সৈন্য নিয়ে আলেকজান্দ্রিয়ার উপকূলে এসে হাজির হন। এ পরিস্থিতির জন্য আগে থেকেই পম্পেইর মাথা কেটে সংরক্ষণ করা হয়েছিলো। মিসরের রাজপ্রতিনিধি সিজারের জাহাজে গিয়ে পম্পেইর আংটি ও কাটা মাথা থালায় করে সিজারের সামনে পরিবেশন করলেন। হায় পম্পেই! যিনি ছিলেন একসময় রাজনীতিতে সিজারের সবচেয়ে বড় বন্ধু। এখন সিজারকে খুশি করার জন্য তাঁরই কাটা মাথা পরিবেশন করা হলো। কিন্তু এতে খুশি হয়ে সিজার ফিরে গেলেন না।

কারণ তখন সমগ্র বিশ্বের মধ্যে রাজস্ব আয়ে মিসর ছিলো সবচেয়ে বিত্তশালী দেশ। অতএব সেই রাজস্ব আয়ের ভাগ সিজারের চাই। ত্রয়োদশ টলেমি তখনও মিসরের পূর্বাঞ্চলে ক্লিওপেট্রার আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য সেনাবাহিনীর সঙ্গে অবস্থান করছিলেন। সেনাপতি অ্যাকিলাসের নেতৃত্বে সেনাবাহিনীকে রেখে টলেমি সিজারের সঙ্গে দেখা করার জন্য আলেকজান্দ্রিয়ায় এলেন। সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী পথিনাসও ছিলেন। তারা সিজারকে মিসরের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ থেকে বিরত রাখতে ব্যার্থ হলেন। এরই মাঝে সিজারকে হাত করার জন্য লুকিয়ে দেখা করতে চলে আসলেন ক্লিওপেট্রা।


চিত্র: ক্লিওপেট্রা ও জুলিয়াস সিজার

ঐতিহাসিক প্লুতার্কের ‘সিজার’ গ্রন্থ থেকে জানা যায়, ক্লিওপেট্রা লুকিয়ে জাহাজযোগে সমুদ্রপথে এসে টলেমির নৌ-সেনাদের ঘুষ দিয়ে আলেকজান্দ্রিয়া হারবারে প্রবেশ করতে সমর্থ হন। কবি লুকানের রচিত কাহিনী এই ঘটনাকে অমরত্ব দিয়েছে। এই কাহিনী অনুযায়ী একজন সিসিলিয়ান ব্যবসায়ী উপকূলের পাহারাদারদের ফাঁকি দিয়ে ক্লিওপেট্রাকে কম্বলের ভেতরে জড়িয়ে আলেকজান্দ্রিয়ার ভেতরে পৌঁছে দেন। সিজার ও টলেমি তখন আলেকজান্দ্রিয়ায় রাজপ্রসাদে অবস্থান করছিলেন। ক্লিওপেট্রা সেখানে সিজারের সামনে হাজির হলেন।

বিভিন্ন বিবরণ থেকে জানা যায় ২১ বছর বয়সী ক্লিওপেট্রাকে দেখে ৫২ বছর বয়সী সিজার মোহিত হন। অনেকেই মনে করেন সিজারের সাথে তাঁর মিলনের ঘটনা ঘটেছে। ক্লিওপেট্রা তাঁর পিতার মতই রোমান অনুগ্রহে ক্ষমতায় ফিরে আসার নীতি গ্রহণ করেছিলেন। সিজারের প্রতি তাঁর আনুগত্যের এটাই ছিলো সবচেয়ে বড় কারণ। সিজারের সামনে সৎ বোন ক্লিওপেট্রার এমন উপস্থিতিতে ত্রয়োদশ টলেমি অবাক হয়ে যান। সিজারের সাথে ক্লিওপেট্রার দহরম-মহরম আঁচ করতে পেরে তিনি রাজপ্রসাদ থেকে ছুটে বেরিয়ে গিয়ে আলেকজান্দ্রিয়াবাসীকে সিজার ও ক্লিওপেট্রার বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলেন।

আলেকজান্দ্রিয়াবাসী রোমান আধিপত্য ও ক্লিওপেট্রার রোম ভজা নীতির ঘোর বিরোধী ছিলো আগে থেকেই। তের বছর বয়সী বালক রাজা টলেমির আহ্বানে সাড়া দিয়ে বিক্ষুদ্ধ জনতা রাজপ্রসাদের সামনে ভীড় করে। তারা ক্লিওপেট্রার সিংহাসন দখলের মাধ্যমে মিসরের বুকের ওপর রোমান আধিপত্য চিরস্থায়ীভাবে চেপে বসার আশংকা করছিলো। সিজার রাজপ্রাসাদের সামনে বেরিয়ে এসে জনতাকে বুঝিয়ে সুজিয়ে ঠান্ডা করে আশ্বাস দেন যে, সিংহাসনের বৈধ অধিকারী ভাই-বোন দুজনকেই তিনি ক্ষমতায় বসতে সাহায্য করবেন। সিজার জানতেন ভাই বোনের ক্ষমতার দ্বন্ধ সহজে মিটবে না। তাই তিনি সিদ্ধান্তের ভার তাদের ওপর ছেড়ে দিয়ে অপেক্ষায় থাকলেন।


চিত্র: জুলিয়াস সিজারের আশ্বারোহী সৈন্য

কিন্তু শান্তি প্রতিষ্ঠিত হলো না। ৪৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দের অক্টোবরের শেষদিকে মিসরের পূর্বাঞ্চলে অবস্থানরত টলেমির সৈন্যবাহিনী পথিনাসের গোপন নির্দেশে আলেকজান্দ্রিয়ার দিকে রওনা হলো। সিজারের সৈন্যসংখ্যা স্বল্প হওয়ায় তিনি এদেরকে ঠেকানোর জন্য সিরিয়া থেকে অতিরিক্ত সৈন্য চেয়ে পাঠালেন। তারা এসে পৌঁছার পূর্ব পর্যন্ত আলেকজান্দ্রিয়ায় খন্ডযুদ্ধ চলতে থাকে। এসময় সিজার টলেমিকে রাজপ্রাসাদে আটকে রেখেছিলেন। টলেমির সৈন্যবাহিনীর নেতৃত্বে এসময় বিরোধ ও বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছিলো। কয়েকটি খন্ডযুদ্ধের পর সিজার টলেমিকে আপোষের জন্য ছেড়ে দেন। কিন্তু টলেমি সৈন্যবাহিনীর দায়িত্ব গ্রহণ করে খোলাখুলিভাবে সিজার ও ক্লিওপেট্রার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন।

খ্রিস্টপূর্ব ৪৭ সালের মার্চ মাসে সিজারের সাহায্যার্তে প্রেরিত সেনাদল এসে পৌঁছায়। এদের মধ্যে ছিলো এশিয়ান, সিরিয়ান ও আরব সৈন্যদল। এমনকি জুডিয়া থেকে একটি ইহুদি সৈন্যদলও যোগ দিয়েছিলো। ইহুদি সৈন্যদের উপস্থিতির ফলে আলেকজান্দ্রিয়াবাসী ইহুদিরাও খোলাখুলিভাবে সিজার ও ক্লিওপেট্টার পক্ষ সমর্থন করে। তৎকালীন আলেকজান্দ্রিয়ার অধিবাসীদের পাঁচ ভাগের দুই ভাগই ছিলো ইহুদি। খ্রিস্টপূর্ব ৪৭ সালের ২৭ মার্চ সিজারের সুসজ্জিত বাহিনীর সাথে যুদ্ধে টলেমির বাহিনী সম্পূর্ণভাবে পরাজিত হয়। টলেমি পালাতে গিয়ে নীল নদে নৌকা ডুবে মারা যান।

সিজারের সহায়তায় ক্লিওপেট্রা মিসরের সিংহাসনে পূণর্বহাল হলেন। যথারীতি সিজারও ক্লিওপেট্রার কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ আদায় করলেন। সিজারের মিসর লুটের ইচ্ছা পূর্ণ হলো। টলেমি বংশের প্রথা অনুযায়ী ক্লিওপেট্রা ১২ বছর বয়সী সর্বকনিষ্ঠ সৎভাইকে বিয়ে করে রাণী হিসেবে রাজ্য শাসনের বৈধতা আদায় করেন। সিজার তাঁর চারটি সৈন্যবাহিনীর তিনটি মিসরে রেখে আলেকজান্দ্রিয়া ত্যাগ করেন। সিজার মিসর ত্যাগের কিছুদিন পরে ক্লিওপেট্রার এক পুত্র জন্মগ্রহণ করে। আলেকজান্দ্রিয়ার অধিবাসীরা রসিকতা করে তার নাম রাখে সিজারিয়ন অর্থাৎ ক্ষুদে সিজার বা সিজারের পুত্র। ক্লিওপেট্রা তাঁর নাম দেন টলেমি সিজার। এই নাম থেকে রসিকতার সত্যতা পাওয়া যায়।

৪৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দের জুন মাসের মধ্যে সিজার সিরিয়া পৌঁছান। সেখান থেকে পশ্চিম তুরস্কে যান। ১ আগস্ট তিনি পন্টাসের রাজা দ্বিতীয় ফারনেসেসকে পরাজিত করেন। এই বিজয়ের সাফল্যে উদ্বেলিত হয়ে সিজার দম্ভভরে লিখেছিলেন “ভিনি, ভিডি, ভিসি” অর্থাৎ ‘‘আমি এলাম, আমি দেখলাম, আমি জয় করলাম”। এরপর সিজার ইতালি হয়ে তিউনিসিয়ায় যান। ৪৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দের ৬ এপ্রিল তিনি সেখানে পম্পেই পুত্রদের পরাজিত করেন।

১৫ জুলাই রোমে ফিরে গিয়ে বিজয় উৎসব পালনে মনযোগ দেন সিজার। বিজয় উৎসবের পরে ক্লিওপেট্রা তার ভাই ও স্বামী বালক চতুর্দশ টলেমিকে সঙ্গে নিয়ে রোমে এসে অবস্থান করতে থাকেন। পরের বছর সিজার আবার স্পেনে গিয়ে পম্পেইর পুত্রদের পরাজিত করেন। এ বছর সিজার তাঁর শেষ ইচ্ছা সংবলিত দলিল প্রস্তুত করেন। দলিলে তিনি তার বোনের পৌত্র- গেইয়াস অক্টেভিয়ানকে নিজের পোষ্য-পুত্র হিসেবে উত্তরাধিকারী মনোনীত করেন।


চিত্র: জুলিয়াস সিজারকে হত্যার দৃশ্য

৪৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সিজার আজীবন কনসাল নিযুক্ত হলেন। এট্রুস্কানদের বিতাড়নের পর থেকে রাজা শব্দটি রোমানদের অপ্রিয় ছিলো। তাই সিজার রাজা উপাধি না নিয়ে কনসাল নামে থাকতেই পছন্দ করেন। সিজারের জয়ের ইতিহাসে একটি অপূর্ণতা রয়ে গিয়েছিল। এটা হলো পার্থিয়া (পারস্য)। পার্থিয়া তখনও রোমান সাম্রাজ্যের পদানত হয় নি। কয়েক বছর আগে পার্থিয়ার কাছে ক্রাসাস শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছিলেন। এর প্রতিশোধ নিয়ে পার্থিয়া দখল করার জন্য খ্রিস্টপূর্ব ৪৪ সালের ১৭ মার্চ সিজারের সামরিক অভিযানে রওনা হওয়ার তারিখ নির্ধারিত হয়। ১৫ মার্চ সিজার সিনেট অধিবেশন আহ্বান করেন।

সেসময়ে রোমান রাজনীতি ষড়যন্ত্রের খনিতে পরিণত হয়েছিলো। সিজারের ভাগ্যাকাশেও দুর্যোগ ঘনিয়ে আসছিলো। অভিজাতরা তাকে হত্যার চক্রান্ত চূড়ান্ত করে ফেলেছিলো। ১৫ মার্চ সকাল দশটায় সিজার সিনেট অধিবেশনে যোগ দিতে পম্পিয়ান মিলনায়তনের উদ্দেশ্যে রওনা হন। মিলনায়তনে আসন গ্রহণের পর পরই আততায়ীরা তাকে ঘিরে ফেলে। একের পর এক ধারালো ছোরার আঘাতে সিজার রক্তাক্ত হতে থাকেন। ষড়যন্ত্রের অন্যতম নেতা ছিলেন একনায়কত্ব বিরোধী প্রজাতন্ত্রের সমর্থক ও অভিজাতপন্থী মার্কাস ব্রুটাস।

কেউ কেউ বলেন, ছুরি হাতে আঘাত করতে উদ্যত মার্কাস ব্রুটাসকে দেখে, সিজার গ্রিক ভাষায় বলে উঠেছিলেন, ‘বৎস, তুমিও’। হায় সিজার! পম্পেই থেকে সিজারের পরিণতিও কম দুঃখের হয় নি। সিজারের মৃত্যুর পরে রোমান সাম্রাজ্য নতুনভাবে সংঘাতের অন্ধকারে ছেয়ে যায়। স্বার্থ ও ক্ষমতার সংঘাত রোমান সাম্রাজ্যের অনিবার্য অংশে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। সিজারের মৃত্যুর পরে নানা ঘাত প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে রোমান সাম্রাজ্যে পুনরায় ত্রয়ী শাসনের আবির্ভাব ঘটে।

লেখক: আসিফ আযহার
শিক্ষার্থী, ইংরেজি বিভাগ, শাবিপ্রবি
ই-মেইল: [email protected]
ওয়েবসাইট: http://www.asifajhar.wordpress.com
ফেসবুক: Asif Ajhar, যোগাযোগ: 01785 066 880

মন্তব্য ১ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (১) মন্তব্য লিখুন

১| ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০১৮ রাত ৮:০৬

রাজীব নুর বলেছেন: সুন্দর পোষ্ট। কিন্তু কোনো মন্তব্য নেই কেন?
মাত্র ২৩ বার পঠিত!!!

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.