নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ইতিহাসের পাঠশালায়

আসিফ আযহার

শিক্ষার্থী, ইংরেজি বিভাগ, শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়।

আসিফ আযহার › বিস্তারিত পোস্টঃ

ইতিহাসের পাঠশালায়: পর্ব-১৩ | রোমান সভ্যতার বুকে খ্রিস্টধর্মের আবির্ভাব

১৭ ই ডিসেম্বর, ২০১৮ রাত ১০:৫৫


রোমান সম্রাট অগাস্টাস সিজারের সময়ের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা হলো যিসাসের জন্ম। খ্রিস্টধর্মের গ্রন্থ ইনজিলের বর্ণনা অনুসারে অগাস্টাসের সময়ে ফিলিস্তিন অঞ্চলে কয়েকটি রোমান প্রদেশের কথা জানা যায়। ফিলিস্তিনে দক্ষিণে ছিলো ইহুদিয়া ও উত্তরে ছিলো গালিল প্রদেশ। গালিল প্রদেশে ১ সালে যিসাসের জন্ম হয়। এ সময়ে এহুদিয়ার রাজা ছিলেন হেরোদ বংশের একজন রাজা। প্রধান বা বড় হেরোদ নামে তিনি পরিচিত। ইনজিলে মোট তিনজন হেরোদের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

যিসাসের মা মেরির বাড়ি ছিলো গালিল প্রদেশের নাসরত গ্রামে। মেরির বিয়ে ঠিক হয়েছিলো এহুদিয়া প্রদেশের বেথেলহেম গ্রামের ইউসুফের সাথে। রাজা দাউদের জন্মও নাকি এই গ্রামে হয়েছিলো এবং ইউসুফও নাকি দাউদের বংশের লোক ছিলেন (ইনজিল, লূক:২:৪-৬)। অগাস্টাস সিজারের নির্দেশে রোমান সাম্রাজ্যে তখন আদমশুমারী শুরু হয়েছিলো। সিরিয়ার রোমান শাসনকর্তা তখন কুরিনিয়ে।


চিত্র: যিসাসের জন্ম

আদমশুমারীতে নিজের নাম উঠানোর জন্য ইউসুফ গালিল থেকে মেরিকে সংগে নিয়ে নিজের গ্রাম বেথেলহেমে যান। সেখানেই জন্ম হয় যিসাসের। তাঁর জন্মের অষ্টম দিনে ইহুদি নিয়মানুযায়ী খতনা করানো হয়েছিলো। যিসাস বড় হয়েছিলেন গালিল প্রদেশে তাঁর মায়ের গ্রাম নাসরতে। বড় হয়ে যিসাস এহুদিয়ায় নবি ইয়াহইয়ার কাছে যান। ইয়াহইয়া হোরোদের কাছে বন্দী হওয়ার পরে যিসাস গালিল প্রদেশে চলে যান।

১৪ সালে অগাস্টাস সিজারের মৃত্যুর পর রোমান সাম্রাজ্যের সম্রাট হন টিবেরিয়াস সিজার। তাঁর সময়েই আশা ও আলোর বার্তা নিয়ে হাজির হন যিসাস। তিনি একত্ববাদ প্রচার করতেন। তাঁর বাণীর মাঝে গরিব ও অত্যাচিারিত ইহুদিরা জীবন খুঁজে পেল। অত্যাচারী রোমান শাসনের শেকল চেপে বসেছিলো তাঁদের গলায়। দলে দলে তারা যিসাসের অনুসারি হতে লাগল। শোষণের কারাগারে তারা বাঁচার আশা পেল মানুষের প্রতি দয়ালু ও করুণাময় খোদার আশা ও অনুগ্রহের বার্তা শুনে।

প্রায় তিরিশ বছর বয়সে যিসাস তাঁর কাজ শুরু করেন। সমগ্র গালিল প্রদেশের রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে তিনি মানুষের কাছে দয়া, মানবতা, ভালবাসা, ও শান্তির বার্তা নিয়ে হাজির হন। তাঁর আহবানে সাঁড়া দিয়েছিলো মানুষ। সমস্ত সিরিয়ায় তাঁর কথা ছড়িয়ে পড়ে। শহরে শহরে ও গ্রামে গ্রামে গিয়ে ইহুদিদের সভায় তিনি শিক্ষা প্রচার করতেন। তাঁর সার্বক্ষণিক সঙ্গী ছিলেন বারোজন।

গালিল প্রদেশের যিসাসের কথা শুনে এহুদিয়া, জেরুজালেম, ইদোম, জর্ডান নদীর ওপারের অঞ্চল এবং টায়ার ও সিডন শহর থেকে অনেক লোক তাঁর কাছে এসেছিলো। শিক্ষা প্রচারের একপর্যায়ে যিসাস তাঁর অনুসারিদের নিয়ে জর্ডান নদীর অন্যপাড়ে এহুদিয়া প্রদেশে যান। তাঁর এ আগমনে ইহুদি ধর্মব্যবসায়ী যাজক ও ফরিশীদের টনক নড়ে। জেরুজালেমের ধর্মগৃহে প্রবেশ করে তিনি বলে ওঠেন, ‘‘পাক-কিতাবে খোদা বলেছেন, আমার ঘরকে এবাদতের ঘর বলা হবে, কিন্তু তোমরা এটাকে ডাকাতের আড্ডাখানা করে তুলেছ’’ (ইনজিল: মথি: ২১:১৩)।

শাসক পূঁজারি রোমান ধর্মের স্থলে রোমের প্রজাদের কাছে একত্ববাদী ধর্ম ছিলো অনেক ভাল বিকল্প। গালিলের রোমান শাসনকর্তা হেরোদ কিন্তু একত্ববাদী ধর্মকে ভাল চোখে দেখেননি। এ ধর্মের প্রতি তাঁর একটি আচরণের নমুনা দেয়া যাক। যিসাসের সমসাময়িক নবি ছিলেন ইয়াইইয়া। হেরোদ তাঁর জন্মদিনে পরকীয়া স্ত্রী ও প্রেমিকার কাছে জানতে চেয়েছিলেন সে কী উপহার পেলে খুশী হবে। উত্তরে সে জানাল নবি ইয়াহইয়ার খন্ডিত মাথা। নবি ইয়াহইয়া তখন হোরোদের কারাগারে বন্দী । হেরোদ সত্যি সত্যিই জেলখানার মধ্যে ইয়াহইয়ার মাথা কাটিয়ে সেটা এনে থালায় করে তাঁর প্রেমিকাকে সামনে উপস্থাপন করেছিলেন (ইনজিল: মথি:১৪)।

বাহ্যিকভাবে যিসাসের ধর্ম বিদ্রোহী বা বিপ্লবী ছিলো না। কিন্তু মূলত তা এমন বার্তা প্রচার করছিলো যা শাসক ও ধর্মব্যবসায়ী উভয় শ্রেণির জন্যই ভবিষ্যতে বিপদের কারণ হয়ে ওঠার যথেষ্ট সম্ভাবনা ছিলো। তাই তারা এই ধর্মের ব্যাপারে শংকিত হয়ে ওঠে। ইহুদি ধর্মযাজকদের নিয়ে রোমান শাসকদের কোন মাথাব্যাথা ছিলো না। কারণ তাদের শাসকবিরোধী কোন ভূমিকা আর ছিলো না এবং ধর্মকে তারা ব্যবসায় পরিণত করেছিল। যিসাসের ভাষায় জেরুজালেমের ধর্মগৃহকে তারা ডাকাতের আড্ডাখানায় পরিণত করেছিল। এটি ছিলো তাদের ধর্মব্যবসার প্রাণকেন্দ্র।

যিসাসের ধর্মমত সর্বপ্রথম তাদের জন্যই বিপদের সবচেয়ে বড় কারণ হয়ে দেখা দেয়। ইহুদি যাজকতন্ত্র কঠিন ধর্মীয় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে যিসাসের মতবাদের কারণে। তাই নতুন ধর্মের বিরোধীতায় তারা উঠে পড়ে লেগে যায়। এদের সম্পর্কে যিসাস বলেন, “ভন্ড নবিদের বিষয়ে সাবধান হও। তারা তোমাদের কাছে ভেড়ার চেহারায় আসে, অথচ ভিতরে তারা রাক্ষুসে নেকড়ে বাঘের মতো” (ইনজিল : মথি: ৭: ১৫)।

গোঁড়া ইহুদি অর্থাৎ ফরীশীরা সব সময়ে যিসাসের পেছনে লেগে থাকতো এবং তাকে কথার ফাঁদে আটকানোর চেষ্টা করতো। ইনজিলের বর্ণনা অনুসারে এই ফরীশীদেরকে নবি ইয়াহইয়া বিষাক্ত সাপের প্রজাতি বলে সম্বোধন করেছিলেন। এরা ছিলো বক ধার্মিক; আচার সর্বস্ব ধর্ম পালন করতো। ধর্মের বাইরে দিকটা অর্থাৎ আচার-প্রথা খুব মেনে চলত। কিন্তু মানুষের দুঃখ দুর্দশায় তারা ভাবিত হতো না। বিপন্ন মানুষের মুক্তির জন্য এগিয়ে যাবার ব্যাপারে তাদের কোন উৎসাহ ছিলো না। এদের উদ্দেশ্যে যিসাস বলেন, “ভন্ড আলেম ও ফরীশীরা, ঘৃণ্য আপনারা; আপনারা পুদিনা, মৌরি আর জিরার দশ ভাগের এক ভাগ খোদাকে দিয়ে থাকেন; কিন্তু ন্যায়, দয়া এবং বিশ্বস্ততা - যা মূসার বিধানের আরও দরকারি বিষয় তা আপনারা বাদ দিয়েছেন।” (ইনজিল : মথি: ২৩: ২৩)


চিত্র: খ্রিস্টধর্মের প্রথম যুগের প্রতীক Chi Rho

ফরীশী ও ইহুদি ধর্মযাজকরা যিসাসকে হত্যা করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিলো। তিনি জেরুজালেমের ধর্ম গৃহে যাতায়াত করতেন এবং সেখানে প্রকাশ্যে তাঁর ধর্ম প্রচার করতেন। সেখানে তাকে কথার ফাঁদে আটকাতে ইহুদি ইমামগণ ও ফরীশীরা ব্যর্থ হয়। লোকজন যিসাসের কথা শুনত ও তাকে সমর্থন করতো। উপায়ান্তর না দেখে ইমামগণ ও বৃদ্ধ ইহুদি নেতারা মহাইমাম কাইয়াফার বাড়ীতে একত্র হয়ে যিসাসকে লোক পাঠিয়ে ধরে এনে হত্যার সিদ্ধান্ত নেন। রোমান রাষ্ট্রশক্তি তখনও যিসাসের ধর্ম সম্পর্কে তেমন কিছু জানতো না।

রোমান প্রাদেশিক শাসনকর্তারা এটাকে মনে করেছিলেন অন্যান্য ইহুদি নবিদের মতই ইহুদি সমাজের অভ্যন্তরে চলে আসা ধর্ম প্রচারের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার অংশ। তাই তারা যিসাসকে খুব গুরুত্ব দেননি এবং হত্যার প্রয়োজনও মনে করেন নি তখন পর্যন্ত। কিন্তু ইহুদিরা হত্যা করতে চাইলে তাতে তাদের বাধা দেওয়ারও তেমন কিছু ছিলো না। তাই ইহুদি ইমামগণ ও নেতারা নির্ভয়েই সশস্ত্র লোকজনদের পাঠিয়ে যিসাসকে ধরে আনালেন কাইয়াফার বাড়ীতে। যিসাসের অনুসারিদের পক্ষ হতে যাতে কোন বাধা না আসে সেজন্য তারা তাকে আইনিভাবে হত্যা করাই সুবিধাজনক মনে করলেন।

সেসময় এহুদিয়ার প্রধান রোমান শাসনকর্তা ছিলেন পন্টিয়াস পিলাত। পরদিন সকালে তারা যিসাসকে পিলাতের কাছে নিয়ে যায়। পিলাত তাঁর অপরাধ জানতে চাইলে ইহুদি প্রধান ইমামরা বলল, “আমরা দেখেছি, এই লোকটা সরকারের বিরুদ্ধে আমাদের লোকদের নিয়ে যাচ্ছে। সে সম্রাটকে খাজনা দিতে নিষেধ করে এবং বলে সে নিজেই মসীহ, একজন বাদশাহ’’ (ইনজিল: লূক:২৩:২)। পিলাত যিসাসকে মৃত্যুদন্ড দিতে আগ্রহী ছিলেন না।

তিনি অভিযোগকারীদের কাছ থেকে জানলেন যিসাস গালিল প্রদেশের লোক। সেখানকার শাসনকর্তা তখন হেরোদ। ঘটনার দিন হেরোদ জেরুজালেমে উপস্থিত ছিলেন , যিসাস গালিল প্রদেশের লোক জেনে পিলাত তাকে হেরোদের কাছে পাঠিয়ে দেন। হেরোদ যিসাসকে অনেক প্রশ্ন করে জবাব না পেয়ে তাঁকে পুনরায় পিলাতের কাছে পাঠিয়ে দেন। পিলাত নির্দোষ যিসাসকে ছেড়ে দেয়ায় চেষ্টা করেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ইহুদি ইমাম ও নেতাদের চাপের মুখে বাধ্য হয়ে যিসাসকে হত্যার অনুমতি দিয়ে তাদের হাতে তুলে দেন (ইনজিল: লূক: ২৩:২৪-২৫)।

যিসাসের আবির্ভাব শুধু রোমান সাম্রাজ্যের ইতিহাসে নয়, সমগ্র মানব সভ্যতার ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলোর মধ্যে একটি। ইহুদিদের মধ্যে নবিদের আবির্ভাব ছিলো খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। বলা যায় শত শত বছর ধরে ইহুদি সমাজ কখনোও নবিবিহীন অবস্থায় ছিলো না। এমনকি একই সময়ে ইহুদিদের মধ্যে একাধিক নবির উপস্থিতিও ছিলো স্বাভাবিক ব্যাপার। নবিরা কোন সাংগঠনিক বা প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়ায় ধর্ম প্রচার করতেন না। তাঁরা সরাসরি মানুষকে ধর্মের পথে ডাকতেন। নবিদের কখনও কোন সংগঠন বা নেটওয়ার্ক ছিলো বলে শোনা যায়নি। তারা সরাসরি মানুষের দ্বারে দ্বারে উপস্থিত হয়ে ব্যক্তিগতভাবে মানুষকে শিক্ষা দিয়ে বেড়াতেন। তাদের জীবন যাপন ছিলো খুবই সাদামাটা ও সরল।

এরকমই একজন বৈচিত্রহীন ও সাদামাটা জীবনধারী মানুষ ছিলেন যিসাস। সম্ভবত তিনি কাঠুরে হিসেবে প্রথম জীবনে জীবিকা নির্বাহ করেছিলেন। তাহলে তাঁর মধ্যে কী এমন শক্তি ছিলো যে, তিনি মানব সভ্যতার গতিপথকেই দিলেন বদলে? নবিদের একমাত্র শক্তি ছিলো তাদের কথা, তাদের কাজ, তাদের আদর্শ। অধিকাংশ নবিদের আদর্শই ইতিহাসকে খুব বেশি প্রভাবিত কওেনি। কিন্তু যিসাসের আদর্শ সমগ্র রোমান সভ্যতার বিবেক ও মূল্যবোধের ভিতকে নাড়িয়ে দিয়েছিলো। এর ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটটি বোঝা দরকার।

লেখক: আসিফ আযহার
শিক্ষার্থী, ইংরেজি বিভাগ, শাবিপ্রবি
ই-মেইল: [email protected]
ওয়েবসাইট: http://www.asifajhar.wordpress.com
ফেসবুক: Asif Ajhar, যোগাযোগ: 01785 066 880

মন্তব্য ১ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (১) মন্তব্য লিখুন

১| ১৮ ই ডিসেম্বর, ২০১৮ সকাল ৮:০০

রাজীব নুর বলেছেন: সেই রকম পোষ্ট।
এত আগে যে আদমশুমারী হতো আমি জানতামই না।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.