নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ইতিহাসের পাঠশালায়

আসিফ আযহার

শিক্ষার্থী, ইংরেজি বিভাগ, শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়।

আসিফ আযহার › বিস্তারিত পোস্টঃ

ইতিহাসের পাঠশালায়: পর্ব-১৯ | সামন্ততন্ত্রের ইতিবৃত্ত

২৪ শে ডিসেম্বর, ২০১৮ দুপুর ২:৪১


‘সামন্ততন্ত্র’ শব্দটি রোমান পতন পরবর্তী মধ্যযুগীয় ইউরোপের ইতিহাসের সাথে গভীরভাবে জড়িয়ে আছে। সাধারণত রোমান সাম্রাজ্যের পতনের পরবর্তীতে পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলিতে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিকভাবে বিকেন্দ্রিকৃত যে সমাজ ব্যবস্থা গড়ে ওঠে তাকে সামন্ত্রতন্ত্র বলা হয়ে থাকে। তবে সামন্ততন্ত্রের উপস্থিতি বিশ্বসভ্যতায় একবারে গোড়া থেকেই ছিলো। মূলত সামন্ততন্ত্র খুবই সুসংজ্ঞায়িত ধারণা নয় এবং সামন্ততন্ত্রের সার্বজনীন কোনো সংজ্ঞা নেই। সহজ ভাষায় বলা চলে যে, সামন্ততন্ত্র একটি বিকেন্দ্রীকৃত রাষ্ট্রীয় কাঠামোর ওপর নির্ভরশীল আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা এবং এই আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থায় কৃষি জমির মালিকানা থাকে সামন্ত জমিদারের হাতে; ফসল বা অর্থের বিনিময়ে সে জমি প্রজাদের চাষ করতে দেওয়া হয়। এ বিবেচনায় সামন্ততন্ত্রের উপস্থিতি সভ্যতার একেবারে গোঁড়া থেকেই দেখা যায়। প্রাচীন মিসর, মেসোপটেমিয়া ও পারস্য এর উদাহরণ।

এসব সভ্যতায় দাসভিত্তিক উৎপাদনও নগণ্য ছিলো না। তাহলে এসব সভ্যতায় কী ধরণের উৎপাদনের প্রাধান্য ছিলো এবং এসব সভ্যতায় দাসভিত্তিক সমাজব্যবস্থা নাকি সামন্ততান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত ছিলো সে প্রশ্নটি এড়িয়ে যাওয়া চলে না। এ সমস্যার সমাধান সহজেই হয়ে যায় যদি এই প্রবণতার বাইরে থেকে সভ্যতাকে বিচার করা যায় যে, সভ্যতাকে দাসতন্ত্রী অথবা সামন্ততন্ত্রী কোনো একটি নির্দিষ্ট রূপরেখা অনুসরণ করেই গড়ে উঠতে হবে।

বস্তুত সভ্যতার ইতিহাস বহুমাত্রিক এবং বৈচিত্রময়। সভ্যতার ইতিহাসকে একটি মাত্র রূপরেখা অনুযায়ী ব্যাখ্যা করা চলে না। আর বিভিন্ন সভ্যতার বিকাশের ধাপগুলো বিভিন্ন রকম। তাই একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের সভ্যতার ইতিহাসের ভিত্তিতে সমগ্র সভ্যতার ক্রমবিকাশের ধারা ব্যাখ্যা করা খুবই মুশকিল। দক্ষিণ ইউরোপের গ্রিকো-রোমান সভ্যতার ক্রমবিকাশের ধারা আর প্রাচ্য সভ্যতার ক্রমবিবর্তনের ধারা মৌলিকভাবেই ভিন্ন পথে অগ্রসর হয়েছে। এক্ষেত্রে আরেকটি প্রশ্ন হলো সামন্ততন্ত্রের সংজ্ঞা নির্ধারণের ক্ষেত্রে রোম পরবর্তী ইউরোপীয় সমাজ ব্যবস্থাকে আদর্শ বিবেচনা করা হবে নাকি মিসর, ভারত অথবা অন্য কোনো সভ্যতাকে আদর্শ বিবেচনা করা হবে।

এ সমস্যার সমাধান হতে পারে সামন্ততন্ত্রের সংজ্ঞাকে কিছুটা ব্যাপক অর্থে প্রকাশের মধ্য দিয়ে। শুধুমাত্র সামন্তকেই সামন্ততন্ত্রের মূল বিষয় বিবেচনা না করে প্রজাভিত্তিক কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থা - তা সামন্ত নিয়ন্ত্রিতই হোক অথবা অন্য কোনো প্রশাসন নিয়ন্ত্রিতই হোক - যদি সামন্ততন্ত্রের মূল বলে বিবেচিত হয় তাহলে সবগুলো সভ্যতার বিকাশের ইতিহাসে সামন্ততন্ত্রকে চিহ্নিত করা সম্ভব। এক্ষেত্রে সামন্ততন্ত্র অ-ইউরোপীয় সভ্যতার বিকাশের ক্ষেত্রে একটি আলাদা ও স্বতন্ত্র পর্ব না হয়েও অস্তিত্বশীল থাকতে পারে।

সামন্ততন্ত্রের অস্তিত্ব প্রথম দেখা যায় প্রাচীন মিসর ও মেসোপটেমিয়ায়। ৫০০০ থেকে ৩২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত প্রাক রাজবংশীয় যুগে মিসর অনেকগুলো ক্ষুদ্র রাজ্যে বিভক্ত ছিলো। এগুলোকে বলা হতো নোম। এগুলো ছিলো ছোট ছোট সামন্ত রাজ্য। ছোট ছোট একেকজন রাজা এসব রাজ্য শাসন করত। এ ধরনের ত্রিশ থেকে চল্লিশটি রাজ্যে বিভক্ত ছিলো মিসর। বিভিন্ন পশুর নামে ছিলো প্রদেশগুলির নাম। তাই ধারণা করা হয় টোটেম সমাজ থেকেই রাজ্যগুলো প্রথম গড়ে ওঠে। টোটেম সমাজ শিকার ছেড়ে কৃষি আরম্ভ করে।

ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে যৌথ গ্রাম। কিন্তু এতো পরিবর্তন সত্ত্বেও টোটেম নামই থেকে যায়। প্রাচীন যৌথগ্রামগুলি বন্যা নিয়ন্ত্রনের কৌশল আবিষ্কার করে জল ঠেকানোর ব্যবস্থা করে। এগুলোই পরে সামন্তরাজ্যে পরিণত হয়। ধীরে ধীরে প্রদেশগুলি এক হয়। ৩২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে মিনেস (Menes) নামে একজন রাজা সমগ্র মিসরকে একক রাজ্যে পরিণত করতে সমর্থ হন। তখনও এর সামন্ততান্ত্রিক কাঠামোর কোনো পরিবর্তন হয়নি।

মিসরের সামন্ততান্ত্রিক কাঠামোর সকলের উপরে ছিলো রাজা। তারপর সামন্ত জমিদার ও মন্দিরের পুরোহিত। রাজারা প্রচার করত তাদের দৈবসত্ত্বা রয়েছে। তারা স্বয়ং ইশ্বরের প্রতিনিধি। তাই মিসরে শাসক পুজা হতো যা সামন্ততন্ত্রের চিরচেনা অনুষঙ্গ। রাজাকে বলা হতো ‘ফারাও’। ফারাওরা রাজা হলেও ইচ্ছামতো চলতে পারত না। তাদেরকে নির্ভর করতে হতো সামন্ত নৃপতি ও পুরোহিতদের ইচ্ছার ওপর। রাজ প্রতিনিধিরা সাধারণত সীমান্তের দিকের দেশগুলিই শাসন করত। মিসরের বাকি অংশে প্রকৃতপক্ষে সর্বেসর্বা ছিলো সামন্ত ও পুরোহিতরা। সামন্ত ও পুরোহিতরা অনেক সময়ই ফারাওকে সিংহানচ্যুত করত। মিসরে রাজবংশের পরিবর্তন হয়েছে বার বার। সামন্ততান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যে স্বাধীন মিসরে ত্রিশটি রাজবংশের উত্থান পতন হয়েছে।

মিসরের প্রজাদের অবস্থা ছিলো ভূমিদাসের মতো। যদিও তাদের ক্রীতদাস বলা যায় না এই জন্য যে তাদের বিকি-কিনি করা চলত না এবং যতো সামান্যই হোক তাদের নিজস্ব ঘরবাড়ি ছিলো। কিন্তু তারা জমির সাথে এমনভাবে বাঁধা ছিলো যে পরোক্ষভাবে জমির মালিক হয়ে পড়ত তাদেরও মালিক। রাজা পুরোহিতকে জমি দান করলে দানপত্রে উল্লেখ থাকত গরু-মহিষ ও কৃষকসহ জমি দান করা হয়েছে।

জমির মালিকরা কৃষককে গরু মহিষের মতোই উৎপাদনের উপায় মনে করত। জমির মালিকানা বদলে গেলে তারা আপনা থেকেই অপর মালিকের হাতে গিয়ে পড়ত। নাগরিক হিসেবে তাদের কতগুলো বিধিসম্মত অধিকার ছিলো বটে; কিন্তু তা কার্যকরি ছিলো না। কৃষকের যদি কিছুটা স্বাধীনতা থাকতও, তা আবার চলে যেতো ঋণের দায়ে। অজন্মার সময় কৃষক মালিকের নিকট থেকে শস্য ধার করত, কিন্তু ঠিক সময়ে শোধ করতে না পারলে তাকে দাসের মতো মালিকের জমিতে খাটতে হতো।

ভূস্বামীরা নিজের জমি কৃষকদের মাঝে বিলি করে দিতো। বিনিময়ে ফসলের মোটা অংশ কৃষককে কর হিসেবে দিতে হতো। এর উপর ছিলো বাধ্যতামূলক শ্রম। প্রাসাদ, মন্দির, সমাধি প্রভৃতির নির্মাণকাজে দিতে হতো এই শ্রম। পিরামিড তৈরিই ছিলো সবচেয়ে শক্ত। ফারাও খুফুর পিরামিড তৈরির জন্য সারা মিসর হতে শ্রমিক সংগ্রহ করা হয়েছিল। চাবুকের মুখে তাদের কাজ করতে বাধ্য করা হয়। অসংখ্য শ্রমিক মারা পড়েছে এ কাজে। এসব পিরামিডের প্রতিটি ভাজে লুকিয়ে আছে শোষণ অন্যায় আর অবিচারের এক করুণ ইতিহাস। ফারাও খুফু পিরামিডের শ্রমিকদের ওপর নির্যাতনের জন্য ইতিহাসে কুখ্যাত হয়ে আছেন, তবে ধর্মব্যবসায়ী পুরোহিতদের কাছে তিনি সে সময়ে খুবই প্রশংসিত ছিলেন।

কৃষকেরা নিপীড়কদের ঘৃণা করত; তাই সুযোগ পেলেই তারা বিদ্রোহ করত। মিসরে কৃষকদের পাশাপাশি কিছু ক্রীতদাসও ছিলো। কিন্তু মিসরের অর্থনীতির ওপর তাদের প্রভাব ছিলো খুবই সামান্য। সমসাময়িক অন্যান্য সভ্যতায় ক্রীতদাসের যে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পাওয়া যায়, তা মিসরের ক্ষেত্রে ছিলো গৌণ। বিদেশী যুদ্ধবন্দীরাই হতো ক্রীতদাস; তারা ছিলো ফারাওয়ের মালিকানাধীন। ব্যক্তিগত ক্রীতদাস ছিলো না বললেই চলে। ফারাওরা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে যে সব যুদ্ধবন্ধী ধরে এনে ক্রীতদাস বানাত তাদেরকে রাজার সম্পত্তি হিসেবে গণ্য করা হতো। তারা রাজার অধীনে তাতী, পাচক বা বিভিন্ন কারিগরি কাজে নিযুক্ত থাকত। এছাড়াও মন্দিরের ভূসম্পত্তির কৃষি কাজেও তাদেরকে নিয়োগ দেওয়া হতো।

রাজা ছিলেন দেবতাদের প্রতিমূর্তি বা কোনো ক্ষেত্রে নিজেই দেবতা। তাই এসব ক্রীতদাসদের বলা হতো দেবতাদের সম্পত্তি। পিরামিডের নির্মাণকাজে প্রচুর শ্রমিকের দরকার পড়ত। তাই দেবতাদের সম্পত্তিতে কুলাত না; বাড়তি শ্রমিক সরবরাহের দায়িত্ব পড়ত সামন্ত নৃপতিদের ঘাড়ে। এতে তারা অসুবিধায় পড়ত কারণ নিজেদের জমিতে কাজের জন্য লোকের অভাব দেখা দিতো। তাই তারা অনেক সময় রাজবংশের পতন ঘটিয়ে সিংহাসন অধিকারের জন্য বিদ্রোহ ঘোষণা করে রাজার বিরুদ্ধে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হতো। এই গৃহযুদ্ধের সুযোগে কৃষকরাও বিদ্রোহ করে বসত। সারা মিসরে অনেক বার কৃষকদের সশস্ত্র বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়েছে। সামন্ততান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার আরেকটি চিরচেনা অনুষঙ্গ হলো এই কৃষক বিদ্রোহ।

আনুমানিক ২৩৫০ থেকে ২১৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে ব্যাপক আঁকারে কৃষক বিদ্রোহ সংঘটিত হয়। দীর্ঘ দুশো বছরের সেই রক্তাক্ত ইতিহাসের কথা আমরা জানতে পারি সে যুগের প্যাপিরাস ও লিপিকারদের মাধ্যমে। নি¤œ মিসর অর্থাৎ দক্ষিণ মিসরের কৃষকেরা সেই বিদ্রোহে তাদের মনিবদের পরাজিত করে। বরাবরের মতোই সে বিদ্রোহও ছিলো শাসকপূঁজারি ধর্মের বিরোধী। প্রধান দেবতা আমন রা’র মন্দিরের কৃষকেরা পুরোহিতের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে।

মৃত রাজাদের আত্মার উদ্দেশ্যে যেসব জমি উৎসর্গ করা হতো অর্থাৎ পিরামিডের সঙ্গে যেসব জমি থাকত কৃষকেরা সেগুলিও অধিকার করে। পুরোহিতদের তারা তাড়িয়ে দেয়। নিম্ন মিসরের কয়েকজন সামন্ত নৃপতিকেও কৃষকেরা তাদের স্বপক্ষে পায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত থিবিসের সামন্তরাজা বিদ্রোহ দমন করে সারা মিসর নিজের দখলে নিয়ে আসেন। তখন থেকে থিবিস হয়ে ওঠে মিসরের রাজধানী। থিবিসের নতুন ফারাওরা ছোট ছোট পিরামিড তৈরি করতেন। এই কাজের জন্য তারা নিজেদের কৃষক ও দাসদের খাটাতেন; অন্য জায়গা থেকে লোক ধরে আনতেন না।

১৮০০ খিস্টপূর্বাব্দের দিকে মিসরে আরো একবার কৃষক বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে। কৃষকদের সাথে যোগ দেয় হস্তশিল্পী কারিগরেরা এবং দাসেরাও। কারিগরেরা ক্ষমতা হাত করে; শাসন নিজেদের হাতে নিয়ে তারা কতগুলো সংস্কারের প্রবর্তন করে। সামন্তরাজা এবং পুরোহিতদের দেশ হতে তাড়ানো হয়। তাদের জমি ও অন্যান্য সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে কৃষকদের মাঝে বণ্টন করা হয়। মজার ব্যাপার হলো মিসরের শোষিত মানুষের এই বিজয়ের কথা আমরা জানতে পারি বিজিতদের মাধ্যমে।

সে দিন যারা বিজয় লাভ করেছিল তাদের পক্ষের কোনো বক্তব্য লিপির মারফত আমাদের কাছে এসে পৌঁছায় নি; এর কারণটাও সুস্পষ্ট। সে সময়ে লেখাপড়া জানত একমাত্র সুবিধাভোগী শ্রেণির মানুষেরা। চাষাভূষোদের লেখাপড়া চর্চার সুযোগ ছিলো না। লিপিকররা ছিলো সাধারণত পুরোহিত। ধর্মীয় বাণী লেখার জন্য তাদের লিপি ব্যবহারের প্রয়োজন পড়ত। তাই রক্তাক্ত বিদ্রোহের দীর্ঘ ইতিহাসের যে সংক্ষিপ্ত বর্ণনাটুকু আমরা পেয়েছি তা বিজিত শ্রেণির কাছ থেকেই পেয়েছি। শোষিত ও নির্যাতিত মানুষ লিপির ব্যবহার থেকে বঞ্চিত হওয়ায় যেভাবে তারা তাদের যন্ত্রণাক্লিষ্ট জীবনের কথা বলে যেতে পারে নি, তেমনি তাদের বিজয়ের গৌরবের কথাও বলে যেতে পারে নি ভবিষ্যতের মানুষের জন্য।

বিজিতপক্ষ তাদের প্রতিকূল অবস্থার যে বিবরণ রেখে গেছে লিপিতে তা অনেকটা স্বর্গ হারানোর বেদনার বিলাপের ভাষার মতো। মিসরের সর্বপ্রাচীন নগরী হোলিওপোলিসের একজন পুরোহিত লিখেছেন: হায়! দেশ আজ হারিয়ে গেছে। সূর্য আর আলো দেয় না। আমাদের নীল নদ আজ শূন্য-বিরান; পার করবে কে? পায়ে হেঁটে তো তাকে পারাপার করা যায় না? মরুভূমির বুনো পশুগুলো নির্ভয়ে এসে তার জলপান করছে। পূর্বদিক থেকে শত্রুরা এগিয়ে আসছে। তাদের দৃষ্টির সামনে আর্তকন্ঠ আর বেদনা বিহ্বল এই দেশ! ওরা সবাই যে যার প্রতিবেশীকে হত্যা করছে। সারা নগর জুড়ে চলছে ঘৃণা আর বিদ্বেষের রাজত্ব। যে মুখগুলো কথা বলতো, তারা সবাই মূক হয়ে গেছে।

কিন্তু কৃষকেরা বেশিদিন সে ক্ষমতা তাদের হাতে ধরে রাখতে পারেনি। পূর্বদিকের আরব থেকে হাইকসস নামে একটি পশুপালক জাতি এগিয়ে এসে মিসর দখল করে নেয়। ১৭৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে পশ্চিম মেসোপটেমিয়া অঞ্চল থেকে এসে মিসর আক্রমণ করে এই যাযাবর জাতিগোষ্ঠী। সম্ভবত যেসব সামন্তরাজা বিদ্রোহের ফলে দেশ থেকে বিতাড়িত হয়েছিল তারাই হাইকসসদের মিসর আক্রমণে প্ররোচিত করেছিল। ‘হাইকসস’ অর্থ বিদেশী রাজা। হাইকসসরা দেড়শ বছর মিসর শাসন করেছিল। শেষ পর্যন্ত দক্ষিণ মিসরের সামন্ত নৃপাতিরা থিবিসের রাজা আহমোসের নেতৃত্বে এক হয়ে মিসর থেকে হাইকসসদের বিতাড়িত করতে সমর্থ হয়।

আহমোসের সময় হতে মিসরের সামন্তব্যবস্থা নতুন আকারে ধারণ করে। আহমোস মিসরের ইতিহাসের সবচেয়ে প্রসিদ্ধ অষ্টাদশ রাজবংশের গোড়াপত্তন করেন। সামন্ত রাজাদের হটিয়ে তিনি তাদের জমিজমা নিজের দখলে নিয়ে আসেন। নতুনভাবে সেনাবাহিনী গড়ে তোলেন। আগে সামন্ত অধিপতিদের অধীনে ছিলো ছোট ছোট সেনাবাহিনী। তারাই নিজেদের সেনাবাহিনী নিয়ে রাজার পক্ষে যুদ্ধ করত; এখন সামন্তরাজার অস্তিত্ব নেই। ফারাও কৃষকদের মধ্য হতে সৈন্য সংগ্রহ করেন। লিবিয়া ও নুবিয়া থেকে নিগ্রো সৈন্যও আমদানি করা হয়।

নতুন ব্যবস্থায় অবশ্য পুরোহিতদের প্রভাব কমেনি। ধর্মব্যবসা আগের মতোই চলতে থাকে। নতুন রাজবংশের দৈব কর্তৃত্ব আরও বেড়ে যায়। ফারাওদের দৈবসত্ত্বা আরও বর্ধিত হয়। সাধারণ মানুষের কাছে ফারাও প্রায় ইশ্বরে পরিণত হন। অন্যদিকে বড়লোক ও পুরোহিতদের নিকট তিনি হয়ে গেলেন তাদের ‘প্রধান সেবক’। সামন্ততন্ত্রের সমস্ত ইতিহাস জুড়েই দেখা যায় এই শাসকপূঁজার মহামারি। শাসকের দৈবকর্তৃত্ব ছিলো শোষণের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। শাসকের দৈব সত্ত্বা ছিলো শোষিতদের দাবিয়ে রাখার সবচেয়ে বড় অস্ত্র। বিদ্রোহ দাবিয়ে রাখার জন্য এর চেয়ে নিপুণ অস্ত্র আর হয় না। তাই সামন্তবাদের ইতিহাসে আমরা দেখি রাজনৈতিক বিদ্রোহের জন্য অনিবার্য হয়ে উঠেছে ধর্মীয় বিদ্রোহও।

সামন্ততন্ত্রের ইতিহাসের আরও একটি বাস্তবতা হলো শাসক ও যাজকতন্ত্রের মধ্যে কর্তৃত্বের সংঘাত। রাজনৈতিক কর্তৃত্ব ও ধর্মীয় কর্তৃত্বের মধ্যে ক্ষমতা নিয়ে টানাপোড়েন দেখা দিতো। ক্ষমতার দৌড়ে কে এগিয়ে থাকবে সেটাই ছিলো সংঘাতের মূল কারণ। যদিও যাজকতন্ত্রের কাজ ছিলো রাজার দেবত্বকে প্রতিষ্ঠিত করা এবং জনগণকে দৈব অনুপানে বশ করে রাজার রাজত্বের খুটি মজবুত রাখা। তবুও তাদের দাপট অনেক ক্ষেত্রে রাজাকেও ছাড়িয়ে যেতো। যাজকতন্ত্রের দাপটের কাছে রাজা অনেক ক্ষেত্রেই হয়ে পড়তেন অসহায়। শাসক তার ক্ষমতার হাতিয়ারের ওপর বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়লে হাতিয়ার নিজেই বিদ্রোহ করে ক্ষমতা দাবি করে বসত।

রাজতন্ত্র যখন যাজকতন্ত্রের দৈব অনুপানের কার্যকারিতার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে তখন যাজকতন্ত্রও সুযোগ নিতে দেরি করেনি। জমি-জমা, সম্পত্তি, ক্রীতদাস সহ অনেক কিছুর মালিকানার ওপর দখল বসিয়েছে যাজকতন্ত্র। প্রাচীন মিসরে মন্দিরের মালিকানায় জমি, ক্রীতদাস ও কৃষকের সংখ্যা কম ছিলো না। যাজকতন্ত্রের এ ক্ষমতা বেড়ে গিয়ে অনেক সময় রাজার ওপরেও দাপট দেখিয়েছে। আহমোস স্বাধীন সামন্তরাজাদের ধ্বংস করলেও যাজকতন্ত্রের দাপট থেকে মুক্ত হতে পারেননি। তাঁর রাজবংশের দশম ফারাও আখেনআতেন এ দাপট থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য ঐতিহাসিক ধর্ম বিপ্লব ঘটিয়ে ছিলেন। এ কারণে তিনিও অষ্টাদশ রাজবংশ ও মিসরের ইতিহাসে বিশেষভাবে আলোচিত।

আখেনআতেন বহু দেবতার উপাসনা নিষিদ্ধ করে একদেবতার উপাসনা চালু করে একত্ববাদের ইতিহাসের অমর হয়ে আছেন। আখেনআতেন মিসরের সিংহাসনে বসেন ১৩৭৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। সে সময়ে আমন-রা’র মন্দির ছিলো মিসরের মধ্যে সবচেয়ে সমৃদ্ধশালী। সাম্রাজ্যের সম্পদ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে আমন দেবের মন্দিরগুলোর জৌলুস যেমন বাড়ছিলো তেমনি পাল্লা দিয়ে বাড়ছিলো আমনদেবের পুরোহিত কুলের ঐশর্য, প্রভাব প্রতিপত্তি আর ক্ষমতা। লক্ষ লক্ষ দাস আর গবাদি পশু ছিলো তাদের সম্পত্তি। সমগ্র মিসরের আবাদি জমিরও এক বিপুল অংশের মালিক ছিলো তারা। এই বিশাল সম্পত্তি আমনদেবের পুরোহিতগোষ্ঠী ভোগ করত আর এর জোরেই তাঁরা হয়ে উঠেছিল ক্ষমতাশালী।

আখেনআতেনের আগের ফারাও তৃতীয় আখেনআতেনের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন আমন মন্দিরের একজন বড় পুরোহিত। আরেক পুরোহিত ছিলো প্রধান কোষাধ্যক্ষ। এতেই বোঝা যায় আমনদেবের পুরোহিতগোষ্ঠী কেমন শক্তিশালী ছিলো। আখেনআতেন যখন আমন রা-কে অস্বীকার করে আতেন দেবতাকে একমাত্র সর্বশ্রেষ্ঠ দেবতা ঘোষণা করলেন তখন আমনের পুরোহিতগোষ্ঠী প্রমাদ শুনল। তারা ফারাওয়ের প্রকাশ্য বিরোধিতা শুরু করে দিলো।

এতে ভয়ানক ক্ষেপে নিয়ে ফারাও আখেনআতেন এক রাজকীয় ফরমান জারি করে সমস্ত দেবতা নিষিদ্ধ ঘোষণা করলেন। সমস্ত দেবমন্দির বন্ধ করে দেওয়া হলো। একমাত্র আতেন মন্দির ছাড়া। একমাত্র আতেন পূঁজাই বৈধ বলে ফারাও আদেশ জারি করলেন। হাজার বছরের জমে থাকা ধর্মীয় আবর্জনা ফারাও এক নির্মম ঝাঁকি দিয়ে ঝেড়ে ফেলতে চাইলেন।

সবচেয়ে বড় ঝড় বয়ে গেলো আমন দেবের পুরাহিত গোষ্ঠীর ওপর দিয়ে। ফারাও সিন্ধান্ত নিলেন সারা মিসর থেকে আমনের চিহ্ন মুছে ফেলবেন। সারা মিসরের মন্দির, সৌধ-প্রাসাদ, শিলালিপি আর দেয়ালচিত্র- সবকিছু থেকে আমনদেবের নাম তুলে ফেলা হলো। এমনকি ফারাওয়ের নিজের প্রাসাদও বাদ গেলো না। আমনের স্মৃতি বিজড়িত শহর থিবিস থেকে রাজধানী সরিয়ে নিলেন দু’শো মাইল ভাটিতে নীল নদের তীরে। নতুন রাজধানীর নাম হলো আখেতাতেন অর্থাৎ আতেনের দিগন্ত।

এটা খ্রিস্টপূর্বে ১৩৬৯ সালের ঘটনা। নতুন রাজধানী থেকে আখেনাতেন দীর্ঘ এগার বছর রাজ্য শাসন করেছিলেন। এ সময়জুড়ে বিতাড়িত পুরোহিতগোষ্ঠীর ষড়যন্ত্র অব্যাহত ছিলো। শেষ পর্যন্ত ফারাও আখেনআতেনের এ ধর্ম বিপ্লব স্থায়ী হয়নি। তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে এ ধর্মবিদ্রোহেরও অবসান ঘটে। এর পরে আসে পুরোহিতগোষ্ঠীর প্রতিশোধ নেবার পালা। এবার তারা আখেনআতেনের সমস্ত চিহ্ন মুছে ফেলার এক নির্মম প্রচেষ্টায় প্রবৃত্ত হলো। আর বিস্ময়করভাবে তাদের এ কাজই আখেনআতেনকে ইতিহাসে অমর করে দিলো।

তারা আখেনআতেনের সমস্ত স্মৃতিচিহ্নসহ তাকে এমন এক দুর্ভেদ্য অজ্ঞাত স্থানে সমাহিত করেছিল যেনো হাজার চেষ্টাতেও তাঁর সমাধি আর কেউ খুঁজে না পায়। আর একারণেই আখেনআতেন হাজার হাজার বছর ধরে বেঁচে গিয়েছিলেন শবচোরদের হাত থেকে। শেষ পর্যন্ত সুসংরক্ষিত অবস্থায় আখেনআতেনের সমাধি আবিষ্কার করে আধুনিক মানুষ এবং তিনি ইতিহাসে চির অমর হয়ে যান। ২০০৮ সালের দিকে মিসরের বিখ্যাত প্রত্নতত্ত্ববিদ ড. জাহি হাওয়াজের নেতৃত্বে একদল বিজ্ঞানী আখেনআতেনের সমাধিতে পাওয়া সবগুলো মমির পরিচয় শনাক্ত করতে সক্ষম হন এবং ইতিহাসের অন্যতম রহস্যের জট খুলতে সক্ষম হন।

ফারাও তৃতীয় রামেসেসের সময়েও মিসরে রাজশক্তি বনাম যাজকতন্ত্রের অন্তর্দ্বন্দ্বের আরেকটি ইতিহাস খুঁজে পাওয়া যায়। তৃতীয় রামেসেসের প্রায় এক লক্ষ যুদ্ধবন্দী ক্রীতদাস ছিলো। যাজকতন্ত্র যখন রাজ শক্তিকে আর তোয়াক্কা করছিলো না তখন ফারাও আত্মরক্ষার জন্য এই যুদ্ধবন্দীদের নিয়ে একটি নিজস্ব সেনাবাহিনী গড়ে তোলেন। এই ক্রীতদাসদের সন্তানদেরকে রাজসভায় ও সরকারের উচ্চ পদে নিয়োগ করে ফারাও নিজের বাহুকে দৃঢ়তর করে তুলেছিলেন। এভাবে যুদ্ধবন্দী ক্রীতদাস শ্রেণি ফারাওয়ের অনুগ্রহে রাজকীয় মর্যাদায় অধিষ্টিত হওয়ার একটি ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েছিল। ফারাও ক্রীতদাসদের অনেককে করদাতা কৃষকে পরিণত করে সমাজে একটি নতুন শ্রেণিরও সৃষ্টি করেছিলেন।

করদাতা ভূমিদাস বা প্রজার অস্তিত্ব প্রাচীন মেসোপটেমিয়ার ইতিহাসেও খুঁজে পাওয়া যায়। তবে মিসরের ইতিহাস যতোটা নিখুঁতভাবে জানা যায় মেসোপটেমিয়ার প্রাথমিক ইতিহাস ততটা নিখুঁতভাবে জানা যায় না। এর কারণ মিসরীয়রা পরকালের ব্যাপারে যতোটা সচেতন ছিলো মেসোপটেমিয়রা ছিলো ততটাই উদাসীন। পরকালের জন্য মিসরীয়রা যে সমাধিগুলো বানিয়েছে সেগুলোতেই সংরক্ষিত হয়েছে তাদের পুরো ইতিহাস। মিসরীয়রা তাদের সমস্ত ঐশ্বর্য্য ঢেলে দিয়ে যে সমাধিগুলো বানিয়েছে এবং সেগুলোর ভেতরে তারা যে বিপুল ঐশ্বর্য্য ও দলিল সামগ্রী সযতনে সংরক্ষিত রেখে গেছে তা তাদের জন্য পরকালে যায় নি বরং চলে এসেছে আধুনিককালে এবং উদ্ভাসিত করে দিয়েছে তাদের সমস্ত ইতিহাস।

এভাবে পরকালে যাওয়ার প্রচেষ্টা তাদের নিয়ে এসেছে আধুনিককালে। অন্যদিকে মেসোপটেমীয়রা পরকালের ব্যাপারে ছিলো উদাসীন। মিসরীয়রা যেখানে পরকালে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে যাবতীয় শ্রম এবং মেধা ব্যয় করেছে সেখানে মেসোপটেমীয়রা তাদের সমকাল নিয়েই ব্যস্ত থেকেছে এবং মৃত্যুকেই মানব জীবনের চূড়ান্ত অবসান ভেবে সমস্ত কর্মপ্রচেষ্টাকে কঠোর জাগতিকতার মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখেছে। তবে তারা নিরিশ্বরবাদী ছিলো না বরং কতগুলো কাল্পনিক দেব-দেবীর উপাসনা করত। জীবন ছিলো অনেকটাই হতাশাবোধে জর্জরিত ও ম্রিয়মান।

মিসরীয় একত্ববাদের মধ্যে ছিলো বিপ্লব, ভালবাসা ও সাম্যের সুর; অন্যদিকে মেসোপটেমীয় বহুদেবতাবাদের মধ্যে ছিলো আত্মকেন্দ্রিক ভোগবাদী জীবনের স্বার্থপরায়ণতার বহিঃপ্রকাশ। দেবতাদের মন্দির আর পুরোহিতরা দৈব খড়গ ঝুলিয়ে রেখেছিলেন প্রজাদের মাথার ওপর। দৈব চোখ রাঙানি প্রজাদেরকে বিদ্রোহের চিন্তা থেকে দূরে রাখত। প্রজারা চাষের জন্য রাজার জমি পেতো। বিনিময়ে দিতে হতো শ্রম-কর। শ্রম-কর হলো রাজার জন্য চাষের জমিতে বাধ্যতামূলক বেগার খাটুনি। এভাবে প্রজারা ভূমিদাসে পরিণত হতো। সমাজ কাঠামো ছিলো সামন্ততান্ত্রিক। ভূস্বামী, ভূমিদাস, কর, মন্দির, পুরোহিত এবং একপাল দেব দেবী - সামন্ততন্ত্রের চিরচেনা দৃশ্য। এ দৃশ্যের সাথে কিছুটা ব্যবধান রয়েছে দাসতন্ত্রী গ্রিকো-রোমান সভ্যতা পরবর্তী ইউরোপীয় সামন্ততন্ত্রের।

মিসর, মেসোপটেমিয়া, ভারত ও চীনের সভ্যতার ইতিহাসে একেবারে গোড়া থেকেই যেভাবে সামন্ততন্ত্রের উপস্থিতি দেখা যায়, ইউরোপের ইতিহাসে তা সেভাবে দেখা যায় না। ইউরোপে সামন্ততন্ত্রের পূর্বে আরেকটি বিশেষ ব্যবস্থা দেখা যায়; সেটি হলো দাসতন্ত্র। দাসশ্রমের ওপর নির্ভর করে গড়ে উঠেছিল প্রাচীন ইউরোপীয় সভ্যতাগুলো। তাই সে সব সভ্যতার সাথে সে সময়ের পৃথিবীর অন্যান্য সভ্যতার ছিলো বিস্তর ব্যবধান। দাসতন্ত্রের ওপর গড়ে উঠেছিল বিশাল গ্রিক সভ্যতা; যেরকমটি সে সময়ের পৃথিবীতে আর কোথাও দেখা যায় না।

গ্রিক সভ্যতার পতনের পরে মেসোপটেমীয় বীর আলেকজান্ডার যে হেলেনিস্টিক সভ্যতার সূচনা করে যান তা অবশ্য দাসতন্ত্রী ছিলো না; ছিলো অনেকটাই সামন্ততন্ত্রী। কারণ সে সভ্যতার বড় অংশই ছিলো মিসর ও আরব অঞ্চল ভিত্তিক এবং এসব অঞ্চলের অর্থনীতি ছিলো সামন্ততন্ত্রী ধরণের। এসব অঞ্চলের সভ্যতা ইউরোপীয় সভ্যতার মধ্যে পড়ে না। তাই গ্রিক পরবর্তী প্রধান ইউরোপীয় সভ্যতা হলো রোমান সভ্যতা যা আগাগোড়াই ছিলো দাসতন্ত্রী।


চিত্র: শস্যক্ষেতে কাজ করছে সার্ফরা

গ্রিকো-রোমান সভ্যতার মতো দাসতন্ত্রী সভ্যতা আর কোথাও দেখা যায় না। এর কারণ হলো এ সভ্যতাগুলোর সীমানা জুড়ে ছিলো যাযাবরদের বসবাস এবং এসব যাযাবর জাতির লোকেরা যুদ্ধে পরাজিত হলে পরিণত হতো সভ্যদের ক্রীতদাসে। এছাড়াও পরাজিত সভ্য মানুষও পরিণত হতো ক্রীতদাসে। সভ্যতার সীমানার চারদিক জুড়ে বিস্তৃত ছিলো যুদ্ধক্ষেত্র আর এসব যুদ্ধক্ষেত্র থেকে স্রোতের মতো আসতে থাকত যুদ্ধবন্দী ক্রীতদাসের চালান। এসব ক্রীতদাসদের পাঠানো হতো বিশাল বিশাল ল্যাটিফান্ডিয়ায় (কৃষি খামার) অথবা এরগাস্টেরিয়ায় (কারখানা)।

রোমান সভ্যতার পতনের পরে চির অবসান ঘটে এই দাসতন্ত্রী সমাজ ও অর্থব্যবস্থার এবং এসে যায় সামন্ততন্ত্রের যুগ। তবে দাসতন্ত্রের পতন একদিনে ঘটেনি। তা ঘটেছে কয়েক শতাব্দীর পরিক্রমায়। রোমান সভ্যতার সীমান্ত প্রসারিত হতে হতে যখন এমন অবস্থায় এসে পৌঁছাল যে আর কোনো উল্লেখযোগ্য দেশ বিজয়ের বাকী রইল না এবং লুণ্ঠনের মতো আর কোনো সমৃদ্ধ জনপদ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না তখন থেকে শুরু হলো সমৃদ্ধির শিখর থেকে এ সভ্যতার পতনের পালা।

অগাস্টাস সিজারের সময়ে তিন মহাদেশ জুড়ে বিস্তৃত রোমান সাম্রাজ্যের সীমানা যে বিপুলতায় পৌঁছে তা আর বাড়াবার মতো সুযোগ জোটে নি রোমানদের। লাগাতার দেশ দখল ও যুদ্ধজয় রোমানদের ভাসিয়ে নিয়েছিল সমৃদ্ধির জোয়াওে; আর এ সমৃদ্ধিই ডেকে আনে ধন নিয়ে কাড়াকাড়ির অভ্যন্তরীণ সংঘাত অর্থাৎ গৃহযুদ্ধ। গৃহযুদ্ধ আর বহুমাত্রিক শ্রেণি সংগ্রাম রোমান শাসনের ভিতকে নড়েবড়ে করে দেয়। তার ওপর রাজা ও অভিজাতদের প্রবাদ প্রতীম বিলাসীতা অর্থনৈতিক সংকটকে আরও বাড়িয়ে তোলে।

পূর্ববর্তীতে নতুন দেশ লুট করে এরকম অর্থনৈতিক সংকট কাটিয়ে ওঠা যেতো কিন্তু সেই দিন ফুরিয়ে গিয়েছিল। তাই অর্থনৈতিক ও সামরিক ক্ষেত্রে রাষ্ট্র দিন দিন দুর্বল হয়ে পড়ছিল। তার ওপর আবার যাযাবর জার্মানদের আক্রমণ ডেকে নিয়ে আসে নতুন বিপদ। প্রজাতন্ত্রকে সাম্রাজ্যে পরিবর্তিত করে রোমান কনসাল (মূলত সম্রাট) অগাস্টাস সিজার গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটালেও যাযাবর জার্মানদের আক্রমণ ঠেকাতে ব্যর্থ হন। সে সময়ে ইতালির সীমান্তের বাইরে পুরো জার্মেনিয়া জুড়ে ছিলো যাযাবরদের আধিপত্য।

এরা প্রায়ই সীমান্ত অতিক্রম করে ইতালিতে ঢুকে পড়ত। সম্রাট অগাস্টাস নিজে একবার ইতালির সীমান্ত থেকে জার্মানদের বিতাড়িত করার অভিযানে নামেন; কিন্তু ব্যর্থ হন। সম্রাট বুঝতে পারেন পাহাড়ে জঙ্গলে জার্মানদের পরাজিত করা সম্ভব নয়। তাই আক্রমণাত্মক পথ ছেড়ে আত্মরক্ষার পথ ধরলেন। আল্পসের গিরিপথগুলিতে এবং রাইন ও দানিয়ুবের তীরে সম্রাট অগাস্টাস অনেকগুলি দূর্গ তৈরি করেন। এসব দুর্গের অনেকগুলিই পরবর্তীতে বড় বড় শহরে পরিণত হয়।

প্রথম ও দ্বিতীয় শতকে জার্মানদের এভাবে ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু এরপর তাদের চাপ বাড়তে থাকে। অন্যদিকে সাম্রাজ্যের প্রাচ্য অংশে পারসীয় ও আর্মেনিয়ানরাও সীমান্ত অতিক্রম করে সহজেই সাম্রাজ্যের ভিতরে ঢুকে পড়তে শুরু করে। রোমান সাম্রাজ্য অনেকটা অবরোধের মধ্যে পড়ে যায়। অর্থনৈতিক সংকট এমন এক পর্যায়ে পৌঁছে যে আত্মরক্ষার জন্যও সম্রাটরা বড় সেনাবাহিনী গড়ে তোলতে ব্যর্থ হন। জার্মান এবং পারসীয়রা একটি একটি করে রোমান প্রদেশ দখল করতে থাকে। যে রোমানরা কয়েক শতাব্দী ধরে অন্যদের ধরে নিয়ে দাস বানিয়েছে তারাই দাসে পরিণত হতে শুরু করে। এভাবে শাশ্বত রোম ধবংসের কিনারায় পৌঁছে যায়।

দাসশ্রমের ওপর ভিত্তি করে যে রোমান অর্থব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল তাতে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়। দাসতন্ত্রী উৎপাদন ব্যবস্থায় অনবরত দাসের যোগান চাই; কারণ একজন দাস অক্ষম হয়ে পড়লে তার জায়গায় নতুন দাস নিয়োগ করতে হয়। কিন্তু দাসের যোগান তখনই সম্ভব যখন নতুন দেশ জয়ের কাজ চলতে থাকে। রোমের জন্য সে পথ ছিলো রূদ্ধ; ফলে দাসতন্ত্র অচল হয়ে যায়। অন্যদিকে সাম্রাজ্যের ব্যবসা বাণিজ্যেও ধ্বস নামে। রোমানদের সমৃদ্ধির অন্যতম ভিত্তি সামুদ্রিক বাণিজ্য ছিলো বন্ধ হওয়ার পথে। ফলে ল্যাটিফান্ডিয়ায় ক্রীতদাসরা যা উৎপাদন করত তা বিপণনে সমস্যা দেখা দেয়।

বৈদেশিক বাণিজ্যের পথ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় মূল্য-ব্যবস্থায় বিপর্যয় দেখা দেয় এবং কৃষি উৎপাদনের মধ্যে চরম বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। এমতাবস্থায় ল্যাটিফান্ডিয়ার মালিকের পক্ষে দাসদের ভরণপোষণের ব্যবস্থা করা কঠিন হয়ে পড়ে। কৃষির পুর্নগঠনের মাধ্যমে মালিকেরা এ সংকট থেকে উদ্ধার পেতে চেষ্টা করে। অনেক ভূস্বামীই ক্রীতদাসদের ভরণ পোষণের ব্যবস্থা করতে না পেরে তাদেরকে জমি, বীজ ও হাল-গরু দান করে কৃষি কাজের ভার তাদের ওপর ছেড়ে দেয়। ফসলের মালিক হবে দাসই; ভূস্বামী শুধু একটা অংশ পাবে কর হিসেবে। এটাই সামন্ততন্ত্রের প্রথম শর্ত। এ পদ্ধতিতে ক্রীতদাস পরিণত হয় ভূমিদাসে।


চিত্র: মধ্যযুগের একটি চিত্রকর্ম

শুধু ক্রীতদাস নয়, তৃতীয় শতক হতে রোমান প্রলেতারিয়ানদের মধ্যেও এভাবে জমি বিতরণ শুরু হয়। কারণ রাষ্ট্রের খরচে এক সময় প্রলেতারিয়ানদের যে ভরণ পোষণের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল তা বহুদিন থেকেই বন্ধ ছিলো। আবার অন্যদিকে নতুন দাস সরবরাহ বন্ধ থাকায় সকল জমি চাষের জন্য যথেষ্ট ভূমিদাস পাওয়া যাচ্ছিল না। তৃতীয় শতকের মধ্যে রোমান ল্যাটিফান্ডিয়াগুলোর জমি এভাবে ক্রীতদাস ও প্রলেতারিয়ানদের মাঝে ভাগ হয়ে যায়। ভূমিদাসে পরিণত ক্রীতদাস ও প্রলেতারিয়ানদের নতুন নাম হয় কলোন। ল্যাটিফান্ডিয়ার জমি কলোনদের মাঝে ভাগ করে দিয়ে অভিজাত ভূস্বামীরা সামন্ত-জমিদারে পরিণত হয়। সমগ্র ইতালির অর্থ-ব্যবস্থা সামন্ততন্ত্রের আকার ধারণ করে।

চতুর্থ শতকে জার্মানদের অনবরত আক্রমনের ফলে রোমের দুর্বল সামরিক শক্তি ধুলায় মিশে যাওয়ার উপক্রম হয়। অগাস্টাস যে দুর্গশ্রেণি তৈরি করেছিলেন তা ভেদ করে জার্মানরা ইতালির অভ্যন্তরে ঢুকে পড়ে। জার্মানরা তখন যাযাবর জীবন ত্যাগ করতে আরম্ভ করেছে। মধ্য ইউরোপের জঙ্গল ও পাহাড়ে তারা আর আবদ্ধ থাকতে চাচ্ছিল না। উর্বর গল (বর্তমান ফ্রান্স) ও ইতালির ভূমি তাদেরকে আকর্ষণ করছিলো। ইতালি হতে পলাতক দাসদের মুখে তারা ইতালির উন্নত সভ্য জীবন ও ধন-সম্পদের ঐশ্বর্যের কথা শুনত। তাই ইতালি আক্রমণে তারা প্রলুদ্ধ হচ্ছিল। এসব দাসরা ইতালি আক্রমণে জার্মানদের সুপরামর্শ দিয়ে সাহায্য করছিলো।

জার্মানরা উত্তর ইতালির জমি দখল করে পুরনো যৌথগ্রাম ব্যবস্থায় উৎপাদন চালু করে। রোমান ভূস্বামীরা নিজেদের চেষ্টায় জার্মান আক্রমণ প্রতিরোধে উদ্যোগী হয়। তারা নিজেরা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সেনাবাহিনী গড়ে তোলে ও ছোট ছোট দূর্গ নির্মাণ করে আত্মরক্ষার ব্যবস্থা করে। ভূস্বামীরা কখনও জার্মানদের হটিয়ে দিতে সমর্থ হতো; আবার কখনও তাদের সাথে জমি ভাগাভাগি করে সন্ধিচুক্তিতে আবদ্ধ হতো। ভূস্বামীরা শহরের পলাতক দাস ও প্রলেতারিয়ানদেরকেও নিজেদের জমিদারিতে আশ্রয় দিতো। বিনিময়ে এসব আশ্রিতদের কাছ থেকে কর আদায় করত ও নিজেদের কাজে খাটাত। এভাবে ভূস্বামীদের সামন্ত কর্তৃত্ব বাড়তে থাকে।

ভূস্বামীরা সম্রাটের কর্তৃত্বের বাইরে যেভাবে ধীরে ধীরে চলে যাচ্ছিল এবং স্বাধীন সামন্ত রাজায় পরিণত হচ্ছিল তাতে সম্রাটের কিছুই করার ছিলো না। সম্রাট উল্টো ভূস্বামীদের ক্ষমতার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছিলেন। এক পর্যায়ে সম্রাট প্রদেশগুলির ক্ষমতা ভূস্বামীদের হাতে ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। কর আদায় সহ আইন ও বিচার ব্যবস্থা, সেনাবাহিনী গঠন প্রভৃতি মৌলিক রাষ্টীয় কাজ চলে যায় এসব সামন্ত অধিপতিদের হাতে; ফলে এসব সামন্তরা নিজেদের এলাকায় সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী হয়ে যায়। এভাবে অধঃপতিত রোমান সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরে ঘটতে থাকে রাষ্ট্রক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ যা সামন্ততন্ত্রের আরেকটি প্রধান শর্ত।

চতুর্থ শতকের শেষ দিকে জার্মানদের সাথে আপস করতে শুরু করেন রোমান সম্রাট। ৩৭৫ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট জার্মানদের দানিয়ুব নদী অতিক্রম করে রোমান সাম্রাজ্যে প্রবেশের অনুমতি দেন। ৩৭৮ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট এদের সাথে মৈত্রীচুক্তিতে আবদ্ধ হন। ৩৯৫ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট থিওডোসিয়াসের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্রদের মধ্যে সাম্রাজ্য ভাগ হয়ে যায়। কনস্টান্টিনোপল-কেন্দ্রিক সাম্রাজ্যের পূর্বাংশ কিছুটা নিরাপদ থাকলেও রোম-কেন্দ্রিক পশ্চিমাংশ আরও দুর্বল হয়ে যায়। এ সুযোগে ৪১০ সালে জার্মান ভিসিগথরা রোম নগরী অবরোধ ও লুন্ঠন করে।

এর পরবর্তীতে সাম্রাজ্যের বাইরের অংশ যেমন গল, স্পেন এমনকি আফ্রিকান অংশও জার্মানদের দখলে চলে যায়। উত্তর আফ্রিকায় যেসব জার্মানরা আধিপত্য বিস্তার করে তাদের রাজধানী হয় কার্থেজ। এরাই ৪৭৬ সালে চূড়ান্তভাবে রোম দখল করে এবং বালক সম্রাট রেমুলাস অগাস্টুলাসকে সিংহাসন থেকে অপসারণ করে পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্যের অবসান ঘটায়। জার্মানদের শাসনাধীনে সাম্রাজ্যের সর্বত্র সামন্ততন্ত্র পাকাপোক্ত ব্যবস্থা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। গল, স্পেন ও উত্তর আফ্রিকায় সামন্ততন্ত্রী ব্যবস্থায় কৃষি উৎপাদন চলতে থাকে।

এসব দেশেও কলোন প্রথা প্রতিষ্ঠিত ছিলো। গলে কলোনদের পাশাপাশি একসময় কিছু স্বাধীন কৃষকও ছিলো। কিন্তু তাদের সে স্বাধীনতা কোনো কাজে আসল না। সুদখোর, তহশীলদার প্রভৃতি সরকারি কর্মচারীদের শোষণে অতিষ্ঠ হয়ে তারা প্রায়ই একজন বড় ভূস্বামীর আশ্রয় নিতো। কৃষকেরা বিভিন্ন সরকারি কর ও ফি থেকে মুক্তি লাভের জন্য ভূস্বামীর হাতে জমির স্বত্ব তুলে দিতো। বিনিময়ে অবশ্য সারা জীবনের জন্য জমির ভোগ দখলের অধিকার আদায় করত। এসব ভূস্বামীদের বলা হতো পেট্রন। পেট্রন তার আশ্রিত কৃষকদের নিয়ে ছোট সৈন্যদল গঠন করত এবং এদের সাহায্যে প্রতিবেশী দুর্বল ভূস্বামীদের জমি কেড়ে নেয়া সহ নানা ধরণের অত্যাচার ও লুটতরাজ চালাত। পেট্রনরা তাদের সৈন্যদের সাহায্যে ভূমিদাস-কলোনদের ওপরও নিষ্ঠুরতা চালাত। তাই কখনো কখনো ভূমিদাসরা পেট্রনদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করত।

২৮৩ খ্রিস্টাব্দে গলে কৃষক বিদ্রোহ হয়। বিদ্রোহী কলোনরা অনেক পেট্রনের সম্পত্তি হাত করে এবং অনেকগুলি শহর দখল করে। রোম সম্রাট মেক্সিমিয়ান স্বয়ং বিদ্রোহ দমনের জন্য গলে চলে আসেন এবং জল্লাদের নিষ্ঠুরতায় বিদ্রোহ দমন করেন। পেট্রন প্রথা ছিলো ক্ষয়িষ্ণু রাষ্ট্রশক্তি ও সম্রাটের দুর্বলতার একটি নিদর্শন। এটা ছিলো রাষ্ট্রক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের একটি প্রাথমিক ধাপ এভাবে কালক্রমে একদিন ভূস্বামী ও পেট্রনরা স্বাধীন সামন্ত রাজায় পরিণত হয়েছিল।

জার্মানদের আক্রমণে রোমান দাসতন্ত্রের শেষ খোলসটুকুও ঝরে পড়ে। জার্মানরা তাদের স্বকীয় বৈশিষ্ট্য ছাড়ে নাই বটে; কিন্তু তারা রোমান সমাজব্যবস্থার অনেক কিছুই গ্রহণ করেছিল। জার্মান জাতিগুলির মধ্যে যখন রাষ্ট্রের আবির্ভাব হয় তখন তারা সামরিক শক্তিতে অনেক এগিয়ে যায়। তারা দখল করে ফেলে রোমানদের সাম্রাজ্য। ক্ষয়িষ্ণু রোমান সাম্রাজ্য দখলের পর জার্মানরা বিভিন্ন রাজ্যে বিভক্ত হয়ে যায়।


চিত্র: মধ্যযুগীয় শহর

নানান ভাঙ্গাগড়ার মধ্য দিয়ে এসব রাজ্য এক সময় পরিণত হয় জার্মানি, ফ্রান্স, স্পেন, পর্তুগাল, ব্রিটেন নামক প্রভৃতি দেশে। জার্মান জাতি অধ্যুষিত সামন্ততান্ত্রিক ইউরোপের দেশগুলো ছিলো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বায়ত্বশাসিত রাজ্যে বিভক্ত। এসব রাজ্যে রাষ্ট্রক্ষমতা ছিলো ধাপে ধাপে বিকেন্দ্রীকৃত। রাজ্যগুলো থেকে কর আদায় ও শাসনকার্য চলত কয়েকটি ধাপে। প্রজাদের কাছ থেকে যে কর আদায় হতো তাতে ভাগ বসাত প্রতিটি ধাপের লোকজন। ধাপগুলোর সবার উপরে ছিলেন রাজা; তার নিচে ডিউক, কাউন্ট, ভাইকাউন্ট, ব্যারন, লর্ড, নাইট ইত্যাদি।

এর পরে আসে প্রজার অবস্থান। তার কাজ শুধু খেটে যাওয়া। হাড়ভাঙ্গা সেই খাটুনি দিয়ে তাকে উপরের পরজীবি শ্রেণিগুলিকে পরিতৃপ্ত করতে হতো। ওপরের শ্রেণির লোকেরা রাজার বেতনভুক্ত কর্মচারি নয়; বরং ছিলো রাজার রাজত্বের অংশীদার। এখানে রাজার একক আধিপত্য ছিলো না। ভোগ দখলের অধিকার শুধু রাজার একার নয়, বরং কয়েকটি শ্রেণির হাতে ছিলো। সামন্ততন্ত্রে শ্রেণি ছিলো প্রধানত দুটি: একদিকে খেটে খাওয়া কৃষক প্রজা আর অন্যদিকে রক্তচোষার দল। তবে রক্তচোষার দল একটি নয়, কয়েকটি ধাপে ছিলো বিভিন্ন উপাধির রক্ত চোষার দল।

মিসরীয় সামন্ততন্ত্রের সঙ্গে ইউরোপীয় সামন্ততন্ত্রের পার্থক্য এখানেই। মিসরীয় সামন্ততন্ত্রে এতগুলো শ্রেণির অস্তিত্ব ছিলো না। সামন্ত রাজারা ছিলো সরাসারি ফারাওয়ের অধীন। কর হতে প্রাপ্ত সামন্ত রাজাদের আয়ের একটি অংশ যেতো ফারাওয়ের কাছে; আবার নিজস্ব সামরিক শক্তি দিয়ে তারা ফারাওকে সহযোগিতা করত বিভিন্ন সময়। মোটকথা ফারাও আর সামন্ত রাজাদের মিলিত শক্তিই ছিলো রাষ্ট্রশক্তি। আবার অনেক সময় মিসর ছিলো সামন্ত রাজাবিহীন। সরাসরি ফারাওয়ের প্রশাসনের অধীনে কর আদায় হতো।

অন্যদিকে ইউরোপীয় সামন্ততন্ত্রে সামন্ত ভূস্বামীরা সাধারণত সরাসরি রাজার অধীনস্ত থাকত না। মাঝখানে কতগুলো ধাপ বজায় ছিলো। অবশ্য দেশের জমির মালিক থাকতেন রাজাই। রাজার কাছ থেকে সাধারণত ভূস্বামীরা সরাসরি জমি পেতো না। রাজার কাছ থেকে হয়ত ডিউক পেতো, ডিউকের কাছ থেকে ব্যারন; ব্যারনের কাছ থেকে নাইট। এসব উপাধিধারী লোক নির্বাচিত হতো রাজার অধীনস্ত বড়লোক বা সামরিক কর্মচারিদের মধ্য হতে। তাদেরকে জমি দেয়া হতো এই শর্ত যে, তারা নিজেদের সৈন্য নিয়ে রাজার পক্ষে লড়বে।

এ ধরণের শর্তাধীনে জমি প্রদানকে বলা হতো ‘ফিউড’। ফিউড থেকে ফিউডালিজম শব্দের উৎপত্তি। এ পদ্ধতিতে ভূস্বামী তার প্রভূর ‘ভাসাল’ বা অনুগত সামন্তে পরিণত হতো। প্রভুর স্বার্থ সংরক্ষণ করা ও প্রভুর দুঃসময়ে তাকে আর্থিক ও সামরিক সাহায্য প্রদান করা ছিলো ভাসালদের দায়িত্ব। প্রভুুর ওপরেও থাকত প্রভু। এভাবে ধাপে ধাপে উঠতে উঠতে পাওয়া যেতো উচ্চতম প্রভু রাজাকে। এটাই ছিলো ইউরোপীয় সামন্ততন্ত্রের গড়ন। ইউরোপে সামন্ততন্ত্রের উৎপত্তির পেছনে যেভাবে রোমানদের ভূমিকা ছিলো সেভাবে জার্মানদেরও ভূমিকা ছিলো। ইউরোপের সামন্ততন্ত্রে রোমান ও জার্মান উপাদান স্পষ্টভাবে লক্ষ করা যায়। অধিকাংশ পন্ডিত এ বিষয়ে একমত যে রোমান ও জার্মান সমাজব্যবস্থার মিশ্রণের মধ্য দিয়েই সামন্ত প্রথার উদ্ভব ও বিকাশ ঘটেছিলো।


চিত্র: ম্যানর হাউস

ইতিহাসবিদ হেনরি পিরেনের মতে, জার্মানরা রোমান ব্যবস্থা ধ্বংস নয় বরং রক্ষা করেছিল। অর্থাৎ ইতালিতে জার্মানরা আক্রমণকারি হলেও সভ্যতা ধ্বংসকারী ছিলো না। তারা দীর্ঘকাল ধরে ধীরে ধীরে অধিকার করেছিল রোমান সাম্রাজ্য। মূলত রোমান সাম্রাজ্যের অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় ভাঙ্গন ধরার ফলেই এর পতন আসন্ন হয়ে পড়েছিল। অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের ফলে সাম্রাজ্যের যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রশাসন, বাণিজ্য, রাজার সবকিছুতেই ভাঙ্গন ধরে। দাসশ্রম নির্ভর অর্থনৈতিক কাঠামো ভেঙ্গে পড়ে। ভূস্বামীরা টিকে থাকার জন্য কৃষির ব্যাপক পুনর্গঠন করতে বাধ্য হয়। এককেন্দ্রিক শাসনের সাম্রাজ্যের বিশাল বাজারব্যবস্থা ভেঙ্গে যাওয়ায় বড় বড় ল্যাটিফান্ডিয়াগুলোর আর উপযোগিতা থাকেনি। কারণ এদের উৎপাদিত দ্রব্যের বাজার সংকুচিত হয়ে গিয়েছিল।

ফলে স্বয়ংসম্পূর্ণ অর্থনৈতিক ইউনিট গঠনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়; অর্থাৎ একটি ক্ষুদ্র এলাকার মধ্যে সব ধরণের দ্রব্য উৎপাদন করে বাজার নির্ভরতা থেকে মুক্তি পাওয়ার চেষ্টা। প্রাচীন ভারতের স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রামের মতোই বড় বড় ল্যাটিফান্ডিয়াগুলো ভেঙ্গে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বনির্ভর কৃষি এলাকায় রূপান্তরের প্রক্রিয়া শুরু হয়। আর এসব কৃষি এলাকার জমিতে প্রজা বসিয়ে ভূস্বামীরা ভূমিদাস প্রথার প্রচলন ঘটায়। ভূস্বামীদের এই জমিদারীকে বলা হতো ভিলা (Villa)। পরবর্তী সময়ে এগুলোই পরিণত হয় ম্যানরে। ম্যানর স্বনির্ভর গ্রাম অর্থনীতির একটি কাঠামো। তবে প্রাচীন আমলের স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রামের সাথে এর মৌলিক ব্যবধান ছিলো। কারণ সেসব গ্রাম কোনো রাষ্ট্রকাঠামোর আওতায় ছিলো না এবং সেখানে কেউ কাউকে কর প্রদান করত না; অর্থাৎ জমি ও ফসলের মূল মালিকানায় সবাই সমান অংশীদার থাকত।

এদিকে ম্যানরের কৃষকদের উৎপন্ন ফসলের একটি বড় অংশের মালিক থাকত পরজীবি সামন্ত প্রভুরা। ম্যানর ছিলো সামন্ত প্রভুদের আয়ের মূল উৎস। ম্যানরের অধিবাসীদের যাবতীয় প্রয়োজনীয় দ্রব্য উৎপাদন হতো ম্যানরের ভেতরেই। এক এক অঞ্চলের ম্যানর এক এক আকারের হতো। ক্ষুদ্র ম্যানরগুলোর জমি সাড়ে তিনশ একরের চেয়ে বড় হতো না। বড় ম্যানরগুলোর জমির আয়তন হতো প্রায় পাঁচ হাজার একর। বড় ম্যানরে সামন্ত প্রভুর দূর্গ সুরক্ষিত প্রসাদ থাকত। এ ছাড়াও ম্যানরে থাকত কারিগরদের কারখানা, রুটি তৈরির বেকারি ইত্যাদি। ম্যানরের কৃষি এবং খাদ্যদ্রব্য উৎপাদন ব্যবস্থা সরাসরি নিয়ন্ত্রিত হতো ম্যানর হাউজ (Manor House) বা সামন্তপ্রভুর বাসগৃহ থেকে।

জার্মান আক্রমণ ধ্রুপদী রোমান ব্যবস্থার অবসান ঘটালেও সামন্ততন্ত্রের উত্থানের পথ করেছিল প্রশস্ত। আর এ সামন্ততন্ত্রী ব্যবস্থা হয়ে উঠেছিল জার্মানদের নিজেদেরই সমাজব্যবস্থা। ম্যানরের ধারণা জার্মানরা পেয়েছিল রোমানদের থেকে। এরপর জার্মানদের অধীনে ইউরোপ জুড়ে ম্যানর প্রথার বিস্তার ঘটে। তবে ইউরোপের সর্বত্রই একই সময়ে ম্যানর প্রথা বিস্তার লাভ করেনি।

জার্মানি ও ইংল্যান্ডের অনেক আগেই ফ্রান্স ও ইতালির কোথাও কোথাও ম্যানর ব্যবস্থার সূচনা হয়েছিল। নবম শতকের মধ্যে ম্যানর প্রথা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল রাইন নদীর তীরবর্তী অঞ্চল, ইতালি ও গলের অধিকাংশ অঞ্চল এবং জার্মানির মধ্য ও দক্ষিণের কিছু অঞ্চলে। ইংল্যান্ড ও ডেনমার্কে ম্যানর প্রথা বিকশিত হয়েছিল দশম শতকে। দক্ষিণ পশ্চিম গল ও স্যাক্সনির সমতলভূমির উপর সরাসরি রাজার নিয়ন্ত্রণ থাকায় ম্যানর ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। নবম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যেই ইউরোপের ম্যানর ব্যবস্থা সর্বাধিক বিকশিত হয়েছিল। এ সময় ইউরোপের গ্রামীন সমাজের উপর ম্যানর ব্যবস্থা দৃঢ়ভাবে চেপে বসেছিল।

ইউরোপের সামন্ততন্ত্রের ইতিহাসে ফ্রান্সের সামন্ততন্ত্রী ব্যবস্থাকে সবচেয়ে আদর্শ বলে ধরা হয়। জার্মান জাতিগোষ্ঠীর অন্যতম শাখা ফ্রাঙ্করা গলে যে শক্তিশালী রাজ্য গড়ে তুলেছিল, সেটাই আজকের ফ্রান্স। ফ্রান্সের সম্রাট শার্লামেন মধ্যযুগীয় ইউরোপের ইতিহাসের সবচেয়ে খ্যাতিমান সম্রাট। শার্লামেনের ফ্রাঙ্ক সাম্রাজ্যের পতনের মধ্য দিয়ে ফ্রান্সে সামন্তপ্রথার পূর্ণাঙ্গ উত্থান ঘটে। তাই মধ্যযুগে সামন্তপ্রথার প্রধান চারণভূমি ছিলো ফ্রান্স। ফ্রান্সে সামন্ততন্ত্রের পরিণত সময় ছিলো দশম ও একাদশ শতাব্দী।


চিত্র: সামন্ততন্ত্রী সমাজের শ্রেণিবিন্যাস

ইউরোপের বিভিন্ন দেশে সামন্তপ্রথার উৎপত্তি পঞ্চম থেকে দশম শতকের মধ্যে। দশম শতকের মধ্যে পশ্চিম ইউরোপের জার্মানদের রাজ্যগুলো ভেঙ্গে খন্ডে খন্ডে বিভক্ত হয়ে পড়ে। খন্ডিত রাজ্যগুলো চলে যায় ভূস্বামীদের নিয়ন্ত্রণে। ফলে এককেন্দ্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার ভাঙ্গন এবং কেন্দ্রীয় সরকারব্যবস্থার পতন ঘটে এবং ধ্রুপদী সামন্ততন্ত্রের যুগ শুরু হয়। ইংল্যান্ডে ধ্রুপদী সামন্ততন্ত্রের প্রবর্তন হয় ১০৬৬ সালে। ১০৬৬ সালে উত্তর ফ্রান্সের নর্মান্ডির ডিউক উইলিয়াম ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিয়ে ইংল্যান্ড দখল করেন এবং সেখানে সামন্ততন্ত্রের প্রবর্তন করেন। পশ্চিম ইউরোপে সামন্ততন্ত্র সবার শেষে প্রবেশ করেছে জার্মানদের আদি ও মূল ভুখন্ড - জার্মানিতে। জার্মানরা ইউরোপজুড়ে অন্যান্য দেশে সামন্ততন্ত্রের বিস্তার ঘটালেও তাদের একসময়ের এই মূল আবাসভূমিতে ধ্রুপদী সামন্ততন্ত্র এসেছে দ্বাদশ শতকে।

সামন্ততন্ত্র কোনো সরল অবস্থার মধ্য দিয়ে বিকশিত হয়নি। সামন্ততন্ত্রের মধ্যে নানা ধরণের ভেরিয়েশন খুঁজে পাওয়া যায়। তাই সামন্ততন্ত্রকে সংজ্ঞায়িত করা খুবই কঠিন কাজ। প্রখ্যাত পন্ডিত মন্টেস্কু সামন্ততন্ত্রকে খুবই সীমাবদ্ধভাবে সংজ্ঞায়িত করেন। তিনি প্রজাতন্ত্র, রাজতন্ত্র ও স্বৈরতন্ত্রের মতো সামন্ততন্ত্রকেও একটি খন্ডিত ও সংকীর্ণ অর্থে ব্যাখ্যা করেন। তিনি সামন্ততন্ত্রকে এগুলোর পাশাপাশি আরেকটি ব্যবস্থা মনে করতেন।

সামন্ততন্ত্রের বৈশিষ্ট্য নির্ধারণে মন্টেস্কু এর রাজনৈতিক দিকটিকেই দেখেছিলেন; অর্থনৈতিক দিকটিকে প্রাধান্য দেননি। সরকারি অধিকার ও ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণকেই তিনি সামন্ততন্ত্রের মূল বিষয় বলে বিবেচনা করেছেন। মন্টেস্কু মনে করতেন সামন্ততন্ত্র শুধু ইউরোপেই গড়ে উঠেছিল; এর বাইরে নয়। সংকীর্ণবাদী দৃষ্টিতে খাটি সামন্ততন্ত্র শুধু ফ্রান্সেই খুঁজে পাওয়া যাবে। কিন্তু অর্থনৈতিক রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিষয়সমূহ বিবেচনায় রেখে সামগ্রিক সমাজ ব্যবস্থার চরিত্র নির্ধারণে সামন্ততন্ত্রকে একটি ব্যাপক অর্থে গ্রহণ করলে মানুষের সমাজ ও সভ্যতার ক্রমবিকাশের ইতিহাসকে সহজে ব্যাখ্যা করা যায়।

মানুষের ইতিহাসকে নিখুতভাবে বিশ্লেষণ করার ক্ষেত্রে আর্থ-রাজনৈতিক তথা সামাজিক পরিস্থিতির বিভিন্ন পর্বের আলাদা নামকরণ জরুরি। তাই সামন্ততন্ত্রকে স্থূল অর্থে গ্রহণ করলে সমগ্র পৃথিবীর ইতিহাসের বিভিন্ন পর্ব বিভাজনে এটি একটি পর্ব হতে পারে। স্থূল অর্থে পৃথিবীর সর্বত্রই আমরা সামন্ততন্ত্রের উপস্থিতি দেখি। প্রাচীন মিসর থেকে শুরু করে চীন ও ভারত পর্যন্ত এর বিস্তৃতি ছিলো। ধ্রুপদী অর্থাৎ বিকেন্দ্রীকৃত রাজনৈতিক ব্যবস্থা হিসেবে সামন্ততন্ত্রকে ইউরোপের বাইরে খুব বেশি সময় পাওয়া যায় না। এ ধরণের ব্যবস্থা চীনে প্রথম দেখা যায় তৃতীয় শতকে, ভারতে চতুর্থ ও পঞ্চম শতকে এবং আরবে নবম ও দশম শতকে।

লেখক: আসিফ আযহার
শিক্ষার্থী, ইংরেজি বিভাগ, শাবিপ্রবি
ই-মেইল: [email protected]
ওয়েবসাইট: http://www.asifajhar.wordpress.com
ফেসবুক: Asif Ajhar, যোগাযোগ: 01785 066 880

বি.দ্র: রকমারিসহ বিভিন্ন অনলাইন মার্কেটে লেখকের সবগুলো বই পাওয়া যায়। এক্ষেত্রে লেখকের নামে সার্চ দিলেই যথেষ্ট।


মন্তব্য ১ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (১) মন্তব্য লিখুন

১| ২৪ শে ডিসেম্বর, ২০১৮ বিকাল ৩:৪৯

রাজীব নুর বলেছেন: জানলাম।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.