নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
স্বাধীনতা পরবর্তি আওয়ামীলীগ কেমন ছিল সেটা জানতে ও বুঝতে তৎকালীন সময়ের পেপার পত্রিকাগুলোতে প্রকাশিত সংবাদ এবং সম্পাদকীয়গুলো পড়া যেতে পারে। আওয়ামী শাসন আমলে ৭২-৭৫ সালের পত্রিকাগুলো ঢাবির লাইব্রেরীতে পড়া যেত না। কেন যেত না সেই কারণও সহজেই অনুমান করা যায়। নিচে ১৯৭৪ সালের জানুয়ারি মাসে গনকন্ঠে প্রকাশিত একটি সম্পাদকীয় লেখা দিলাম। এটা পড়লেই সেই সময়ের একটা ধারণা পাওয়া যাবে। একই সাথে দেখা যাবে যে বিগত আওয়ামী আমল এবং স্বাধীনতা পরবর্তি আওয়ামী আমলের ভেতরে কতটা মিল রয়েছে।
জনগণের হাত থেকে নিজেদেরকে রক্ষা করার জন্য বাঙলাদেশ সরকার একটি বাহিনী গঠন করেছে। আদর করে তার নাম দিয়েছে রক্ষীবাহিনী। জনগণের হাত থেকে রক্ষার জন্য তাঁদের অন্যান্য বাহিনীও আছে কিন্তু এই আদরের বাহিনীটির সাথে শাসক দলের সম্পর্ক বর্তমানে যতখানি নিবিড় ও গভীর, অন্যদের সাথে ততটা নয়। কারণ, অন্য বাহিনীগুলি মূলত অন্যদের সৃষ্টি। আর এই রক্ষীবাহিনীটি হলো আওয়ামী লীগ সরকারের নিজেদের সৃষ্টি, বড় আদরের সন্তান।
বাঙলাদেশ সরকারের কাছে রক্ষীবাহিনীর এত আদর কেন? এই আদরের কারণ পুলিশ ও মিলিটারি দিয়ে জনগণের ওপর নির্মম নির্যাতন করানো যায় সত্য, কিন্তু সে নির্যাতনের সময়ও কতকগুলি শৃঙ্খলাগত প্রশ্ন 'বেয়াড়াভাবে' দেখা দেয়। বেশি না হলেও বর্তমান অবস্থায় এই সব প্রশ্ন অনেক সময় অসুবিধা সৃষ্টি করতে পারে।
কিন্তু রক্ষীবাহিনীর ক্ষেত্রে সে রকমটি নয়। কারণ এর কোনো নিয়মকানুন নেই, শৃঙ্খলা নেই এবং সর্বোপরি এ বাহিনী আওয়ামী লীগ সরকারেরই সৃষ্টি এবং তাদের সম্পূর্ণ অনুগত। এ বাহিনী প্রকৃতপক্ষে তো বটেই, এমনকি বাহ্যতও পুলিশ বাহিনীর মতো শান্তিরক্ষা অথবা মিলিটারির মতো দেশ রক্ষার জন্যে সৃষ্টি হয়নি। এর সৃষ্টি জনগণকে ঠেঙানোর জন্য। এটা হলো সরকার কর্তৃক সৃষ্ট একটি ঠ্যাঙাড়ে বাহিনী।
রক্ষীবাহিনী নামে পরিচিত এই ঠ্যাঙাড়ে বাহিনীই এখন বাঙলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় 'জনগণকে' বিপ্লবের হাত থেকে উদ্ধার করার নামে জনগণের ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালাচ্ছে। ঘেরাও, দমন ও নির্যাতন চালিয়ে গ্রামকে গ্রাম জ্বালিয়ে দিচ্ছে, শুধু বামপন্থী রাজনৈতিক কর্মীদের নয়, জনগণকেও নির্বিচার হত্যা করছে।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর প্রথম কয়েক বছরে আনসার বাহিনী এবং ১৯৭১ সালে ইয়াহিয়ার আমলে রাজাকার বাহিনীর সাথেই আওয়ামী লীগ সরকারের এই রক্ষীবাহিনীর কিছুটা তুলনা করা চলে। কিন্তু এই তুলনা আংশিক। কারণ, রক্ষীবাহিনী বর্তমানে বাঙলাদেশের মাটিতে জনগণের ওপর হামলা যেভাবে চালাচ্ছে এবং যতখানি ব্যাপকভাবে চালাচ্ছে, সেটা আনসার অথবা রাজাকারদের দ্বারা সম্ভব হয়নি। তবে একদিক দিয়ে এই দুই বাহিনীর সাথে রক্ষীবাহিনীর সম্পূর্ণ মিল আছে। আনসার বাহিনী ও রাজাকার বাহিনী যেমন তৎকালীন শাসক-শোষক শ্রেণির ঠ্যাঙাড়ে বাহিনী ছিল, রক্ষীবাহিনীও তেমনি বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার এবং তাদের ঐক্যজোটের স্বার্থরক্ষায় ও জনগণের ওপর শোষণ নির্যাতন জারি রাখার উদ্দেশ্যে নিয়োজিত একটি ঠ্যাঙাড়ে বাহিনী।
সরকারি এবং বেসরকারি দুই সূত্রেই যে সমস্ত খবর পাওয়া যাচ্ছে, তা থেকে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে যে রক্ষীবাহিনী এখন রাজশাহী, পাবনা, নোয়াখালী, বরিশাল, যশোর, খুলনা, ঢাকা, ফরিদপুর, কুষ্টিয়া অর্থাৎ বাঙলাদেশের একটা বিরাট, ব্যাপক এলাকাজুড়ে তারা ঘেরাও-দমন অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। শত শত হাজার হাজার মানুষকে তারা শুধু যে ঘরবাড়ি ছাড়তে বাধ্য করছে তাই নয়, তাদেরকে তারা নির্বিচার হত্যা করছে। কয়েক দিন পূর্বেই সংবাদপত্রে প্রকাশিত একটি সরকারি হ্যান্ড আউট থেকেই জানা যায় যে মাত্র এক সপ্তাহে রাজশাহীর একটি ছোট্ট এলাকায় দেড় শ জনকে রক্ষীবাহিনী হত্যা করেছে। সরকারি হিসাব এ ক্ষেত্রে যদি দেড় শ হয়, তাহলে তার আসল হিসাব কত সেটা সহজেই অনুমান করা চলে। অন্য একটি সংবাদপত্র সূত্রে প্রকাশ যে একমাত্র সিরাজগঞ্জ এলাকাতেই রক্ষীবাহিনী তার সন্ত্রাসমূলক কার্যকলাপ চালিয়ে পাঁচ শ জনের মতো বামপন্থী রাজনৈতিক কর্মী ও সাধারণ মানুষকে হত্যা করেছে। যাঁরা রাজনৈতিক জ্ঞানসম্পন্ন, তাঁরা জানেন যে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ও জনগণের ওপর এই ধরনের নির্যাতন যে শাসকশ্রেণী ও শাসকদল করে তারা অন্তর্নিহিতভাবে কখনো শক্তিশালী হতে পারে না। উপরন্তু তারা অতিশয় দুর্বল এবং সে দুর্বলতার মূল কারণ জনগণ থেকে তার বিচ্ছিন্নতা। এই বিচ্ছিন্নতার একটি বহিঃপ্রকাশ যেমন রক্ষীবাহিনীর নির্যাতন, তেমনি তার অন্য একটি দিক হলো তাদের ত্রিদলীয় 'দেশপ্রেমিক' ঐক্যজোটের লম্ফঝম্প।
ত্রিদলীয় ঐক্যজোটের এই লম্ফঝম্প এখন যে চরিত্র এবং আকার ধারণ করেছে সে চরিত্র এবং আকারকে ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতার আলোকে বিচার করার ক্ষেত্রে জনগণের কোনো অসুবিধে নেই। এই গণবিরোধী শক্তিসমূহের সাম্রাজ্যবাদের দাসানুদাসদের রাজনৈতিক বক্তব্য এবং রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের প্রতি তাদের হুমকির চরিত্র একটু লক্ষ করলেই এ বিষয়ে ধারণা পরিষ্কার হবে।
বিগত ১৬ ডিসেম্বর জাতীয় দিবস পালনের সময় ত্রিদলীয় ঐক্যজোটের যে নেতৃবৃন্দ রক্ষীবাহিনীর সাথে পায়ে পা মিলিয়ে ঢাকার রাজপথে মিছিল করেছিল তারা এর কয়েক দিন পর একটি যুক্ত বিবৃতি দিয়ে এ দেশ থেকে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও মাওপন্থী চীনের দালালদের নির্মূল করার আহ্বান জানিয়েছিল এবং এই আহ্বানকে 'জনগণের কাছে' পৌছে দেওয়ার জন্য ২১ ডিসেম্বর তারা বায়তুল মোকাররমে একটি জনসভা আহ্বান করেছিল।
মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ নির্মূল করার কথাটা বর্তমান শাসকশ্রেণির মুখে যে নিতান্তই বেমানান, এ কথা যে চূড়ান্ত ভণ্ডামির পরিচায়ক সে বিষয়ে এখন আর কার সন্দেহ আছে? যে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের কাছে দেশের দৈনন্দিন খরচ চালানোর জন্যে, পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা খাতে প্রয়োজনীয় অর্থ ও সামগ্রীর জন্য সরকারি নেতাদের দৌড়াদৌড়ি করতে হচ্ছে এবং যাদের সাহায্য ছাড়া আওয়ামী লীগের পক্ষে এ দেশে 'সমাজতন্ত্র' কায়েম করা সম্ভব নয়, সেই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদকে উৎখাতের কথা যখন এরা বলছে, তখন সেটা যে বুজরুকিপূর্ণ একটি রাজনৈতিক অপকৌশল, তা বোঝার মতো রাজনৈতিক জ্ঞানবুদ্ধি আমাদের দেশের জনগণের একেবারে হয়নি মনে করা বাতুলতারই নামান্তর মাত্র। এই বাতুলতার নিকেশ যে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ অল্প দিনের মধ্যেই করবে, সে বিষয়েও কোনো সন্দেহ নেই। প্রাণের দায়েই আওয়ামী লীগ সরকারকে তখন এই বাতুলতা বন্ধ করতে হবে।
তাহলে আসল ব্যাপার কী? আসলে তা হলো 'মাওপন্থী চীনাবাদী' বলে যাদেরকে অভিহিত করা হচ্ছে, তাদেরকে নির্মূল করার জন্য বিদেশি সাম্রাজ্যবাদীদের পদানত দেশীয় শাসক শ্রেণির বেপরোয়া অভিযান। এই অভিযান একদিকে যেমন চালাচ্ছে রক্ষীবাহিনী, অন্যদিকে তেমনি তা চালাচ্ছে ত্রিদলীয় ঐক্যজোটের কুখ্যাত রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ। রক্ষীবাহিনীর মতো এই রাজনৈতিক ঐক্যজোটও যে একই চরিত্রের সেটা বিরোধী দলীয় নেতা ও কর্মীদের বিরুদ্ধে এদের হুমকির চরিত্র থেকেই বোঝা যায়।
শাসক-শোষক শ্রেণির ঐক্যজোটের দ্বারা নানাভাবে শোষিত ও নির্যাতিত জনগণ যে প্রতিরোধ আজ দিকে দিকে শুরু করেছেন তাকে সাধারণভাবে 'মাওবাদী' ও 'চীনা' ষড়যন্ত্র বলে আখ্যায়িত করে জনগণকে দমন করার যে পথ আজ সরকারিভাবে নেওয়া হচ্ছে, তার আসল উদ্দেশ্য মার্কিন সাম্রাজ্যবাদবিরোধিতা তো নয়ই, উপরন্তু সাম্রাজ্যবাদী বিশেষত মার্কিন ও সোভিয়েত স্বার্থের মধ্যে একটা সামঞ্জস্য রক্ষা করে এ দেশে দেশি-বিদেশি শোষক শ্রেণির শাসনকে কায়েম রাখা, যথাসাধ্য নিরাপদ করা।
বাঙলাদেশের বিভিন্ন এলাকায়-গ্রাম-গ্রামান্তরে, হাটে-গঞ্জে, শহরে, বন্দরে সরকার ও তাদের তথাকথিত দেশপ্রেমিক ঐক্যজোটের নির্যাতনের বিরুদ্ধে জনগণ যেভাবে বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠছেন, তাকে প্রতিরোধ করার জন্যে দাঁড়াচ্ছেন, সে বিক্ষোভ ও প্রতিরোধকে মোকাবেলার জন্যে শাসক শ্রেণি আজ মরিয়া হয়ে উঠেছে।
এ জন্য একদিকে যেমন তারা রক্ষীবাহিনী নিয়োগ করে ব্যাপক এলাকায় সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করছে, অন্যদিকে তেমনি তারা 'গণ-ঐক্যজোটের' রাজনৈতিক ঠ্যাঙাড়েদেরকে সংগঠিত করে একই উদ্দেশ্যে নিয়োজিত রাখছে। এ জন্যে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন এই রাজনৈতিক ঠ্যাঙাড়েরা বক্তৃতা, বিবৃতি, সভা-সমিতি ও মিছিলের মাধ্যমে রক্ষীবাহিনীর সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ফ্রন্ট হিসেবেই কাজ করছে।
এ কাজ তারা করতে বাধ্য। কারণ, রক্ষীবাহিনী এবং ত্রিদলীয় ঐক্যজোটের নেতৃবৃন্দ দেশি-বিদেশি শাসকশ্রেণির সাথে ক্ষয়িষ্ণু সামন্ত শক্তি, দেশীয় ফড়িয়া টাউট মুৎসুদ্দি চরিত্রের বুর্জোয়া এবং রংবেরঙের সাম্রাজ্যবাদীদের সাথে একই গাঁটছড়ায় বাঁধা আছে। এ কারণেই গাঁটছড়ার এক জায়গায় টান দিলেই সরকার পোষিত রক্ষীবাহিনীর মতো সামরিক ঠ্যাঙাড়ে বাহিনীর লোকজন থেকে আরম্ভ করে বহু প্রাক্তন বিপ্লবীর টনক এক সাথেই নড়ছে। একই কাতারে দাঁড়িয়ে তারা জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে।
এই পরিপ্রেক্ষিতে বিচার করলে উত্তরবঙ্গে গত কয়েক সপ্তাহে রক্ষীবাহিনীর যে ঘেরাও-দমন চলছে তার সাথে ১৬ ডিসেম্বরের পর ত্রিদলীয় ঐক্যজোটের সরকারি বিবৃতি এবং ২১ ডিসেম্বর তারিখে বায়তুল মোকাররমে তাদের তথাকথিত গণ-জমায়েতের মধ্যে একটা ঐক্যসূত্র সহজেই পাওয়া যাবে। হাজার হাজার গ্রামকে গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়ে, হাজার হাজার মানুষকে যারা ঘরছাড়া করছে, হত্যা করছে, তারা তো এই প্রাক্তন বিপ্লবী এবং মার্কিন সাহায্যে 'সমাজতন্ত্রকামীদের' ঐক্যজোটের নির্দেশেই তা করছে।
১০ জানুয়ারি ১৯৭৪
বদরুদ্দীন উমর
গনকন্ঠ পত্রিকা
©somewhere in net ltd.
১| ০৫ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ সকাল ১১:৪০
দেশ প্রেমিক বাঙালী বলেছেন: স্বাধীনতার আগে আওয়ামীলী কিছুটা ভালো ছিল কিন্তু স্বাধীনতার পর আওয়ামীলীগ পুরাই ডাকাত বাহিনীতে পরিনত হয়।