ইমাম আ’জম আবু হানিফা রহ. ও ইলমে হাদিস

২৪ শে নভেম্বর, ২০১৭ রাত ১:২৩

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
প্রেক্ষাপট :
জনৈক ব্যক্তি তারিখে বাগদাদের বরাতে উল্লেখ করেন যে ইমাম আবদুল্লাহ বিন মুবারক রহ. বলেন, ইমাম আবু হানিফা রহ. এর ব্যাপারে এ মন্তব্য করেন যে, তিনি ইলমুল হাদিসে ‘ইয়াতিম’ ছিলেন।
তাদের বক্তব্য হলো ইলমুল হাদিসেে যে ব্যক্তি ‘ইয়াতিম’ যার কােন দক্ষতাই নেই সে ব্যক্তির ফিকহ উপর কীভাবে আমল করা যেতে পারে?
একথা সত্য যে তারিখে বাগদাদে ইবনুল মুবারক রহ. থেকে আবু হানিফা রহ. এর ব্যপারে ‘ইয়াতিম’ শব্দের উল্লেখ রয়েছে। তবে এ শব্দটি ইবনুল মুবারক রহ. থেকে ইমাম আ’জম আবু হানিফা রহ. এর প্রশংসায় উল্লেখ হয়েছে। তার নিন্দায় নয়। তবে বিষয়টি বুঝতে খতীব বাগদাদিও ভুল করেছেন।
বিষয়টি হৃদয়ঙ্গম করার জন্য প্রথমে আমরা ‘ইয়াতিম’ শব্দটির ব্যখ্যাা জানার চেষ্টা করবো। তার পর আমাদের ব্যখ্যার স্বপক্ষ্যে যুক্তি ও প্রমাণ তুলে ধরার চেষ্টা করবো। পরিশেষে ইমাম আ’জম আবু হানিফা রহ. এর ইলমে হাদিসে প্রাজ্ঞতা সম্পর্কে দু’একটি বক্তব্য তুলে ধরার চেষ্টা করবো।
‘ইয়াতিম’ শব্দের ব্যখ্যা :
ইলমি পরিভাষায় ইয়াতিম শব্দটি ‘দুর্লভ’, একাকী ও দৃষ্টান্তহীন অর্থেও ব্যবহৃত হয়।
০১. আল্লামা জাওহারি বিরচিত সিহাহ গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে -
وكل شيء مفرد يعز نظيره فهو يتيم يقال
এমন প্রত্যেক বস্তুকে ‘ইয়াতিম’ বলা হয় যার দৃষ্টান্ত খুঁজে পাওয়া যায়না, যা দুর্লভ যেমন বলা হয় (درة يتيمة) দুর্লভ মুক্তা।
(সিহাহ ৫/ ৩৪২, মুখতারুস সিহাহ : ১/৭৪৫)
০২. ইবনুল আম্বারি রহ. বলেন,
البيت يتيم أي منفرد ليس قبله ولا بعده شيء
(يتيم) বলা হয় এমন একক কবিতা পংক্তিকে যার পূর্বে পরে কােন পংক্তি না থাকে।
(আয যাহের ফি মাআনি কালিমাতিন নাস :১/১১৮)
০৩. বিশিষ্ট ভাষাবিদ ও ইমাম আসমায়ি রহ. বলেন,
قال الأصمعي : اليتيمة الرملة المنفردة وكل منفرد ومنفردة عند العرب يتيم ويتيمة.
(يتيم) বলা হয় বালুর একক অনুকে। আরবদের নিকট প্রতিটি একক বস্তুকে ইয়াতিম বলা হয়। (তাহজিবুল লুগাহ, আল আজহুরি, ৫/২৯)
উপরে বর্ণিত ইয়াতিম শব্দের এ ব্যখ্যার আলোকে আমরা বলতে পারি যে ইবনুল মুবারক ‘ইয়াতিম’ বলে আবু হানিফা রহ. সম্পর্কে যা বলতে চেয়েছেন তার সারমর্ম হলো ইমাম আবু হানিফা হাদিস শাস্ত্রে এক দুর্লভ ব্যক্তি। হাদিস শাস্ত্রের তার মতো অভিজ্ঞ ও প্রাজ্ঞ লােক খুজে পাওয়া ভার। ইলমুল হাদিসে ইমাম আ’জম আবু হানিফা রহ. এর অবস্থান অনেক উর্ধ্বে।
প্রদত্ত ব্যখ্যার প্রমাণ :
পাঠক হয়তো প্রশ্ন করতে পারেন যে ‘ইয়াতিম’ শব্দের এ ব্যাখ্যা আমরা কিসের ভিত্তিতে গ্রহণ করেছি? এর উত্তরে বলবো যে, আমরা এ ব্যখ্যাটি ইবনুল মুবারক রহ. এর অন্যবক্তব্য থেকে গ্রহণ করেছি। ইবনুল মুবারক রহ. অনত্র ইমাম আজম আবু হানিফা রহ. সম্পর্কে বলেন,
أفقه الناس أبو حنيفة ، مارأيت في الفقه مثله وقال أيضا لولا أن الله تعالى أغاثني بأبي حنيفة وسفيان كنت كسائر الناس.
লােকদের মধ্যে সবচেয়ে বড় ফকিহ হলেন আবু হানিফা রহ.। ফিকাহ্ শাস্ত্রে তার মতো প্রাজ্ঞ আর কাউকে দেখিনি। তিনি আরও বলেন, আল্লাহ তায়ালা যদি আমাকে ইমাম আবু হানিফা, সুফিয়ান সাওরি রহ. দ্বারা সাহায্য না করতেন, তবে আমার অবস্থান হতো সাধারণ মানুষের মতো। (ইবনে হাজার আসকালানী : তাহজিবুত তাহজিব : ৬/৫৫৯-৫৬০)
অন্যত্র বলেন,
إن كان الأثر قد عرف واحتيج إلى الرأي فرأي مالك وسفيان وأبي حنيفة . وأبو حنيفة أحسنهم وأدقهم فطنة وأغوصهم على الفقه وهو أفقه الثلاثة.
যদি আছার ও হাদিসের মধ্যে ফিকহের প্রয়োজন হয়, তবে ইমাম মালেক, সুফিয়ান সাওরি ও আবু হানিফা রহ. এর মতই গ্রহণযোগ্য হবে। ইমাম আবু হানিফা রহ. এদের মধ্যে সবচেয়ে উত্তম ও সূক্ষ্ম চিন্তার অধিকারী। ফিকহের গভীরে দৃষ্টি দিতে সক্ষম। এ তিনজনের মধ্যে সবচেয়ে বড় ফকিহ। (তারিখে বাগদাদ : ১১/২৪৪)
অন্যত্র বলেন,
هاتوا في العلماء مثل أبي حنيفة وإلا فدعونا ولا تعذبونا
উলমায়ে কেরামের মধ্যে ইমাম আবু হানিফার মতো আরেকজনের নাম বলো, যদি ইমাম আবু হানিফা রহ. এর মতো আরেকজন আলেমের নাম বলো, যদি বলতে না পার তবে আমাদেরকে ছেড়ে দাও, কষ্ট দিওনা। (মানাকিবু মুওয়াফ্ফাক মক্কি : ২/৫২)
আবদুল্লাহ ইবনুল মুবারক রহ. এর উপরোক্ত বক্তব্য থেকে এ কথা স্পষ্ট যে, তার দৃষ্টিতে ইমাম অজম আবু হানিফা রহ. হাদিস ও আছারের ক্ষেত্রে সময়ের দুর্লভ ব্যক্তি। ফিকহের ক্ষেত্রে দৃষ্টান্তহীন ফকিহ, উলামায়ে কেরামের মধ্যে অগাধ পাণ্ডিত্যের অধিকারী। সুতরাং ‘হাদিস শাস্ত্রে ইয়াতিম’ কথা থেকে ইমাম আবু হানিফা রহ. এর ব্যপারে ইবনুল মুবারক রহ. এর ‘জরহ’ এর অর্থ করা খতীব বাগদাদি রহ. এর একটি জলজ্যান্ত ভ্রান্তি বই কিছু নয়।
এ প্রসঙ্গে হাফেজ আবুল হুসাইন আহমদ বিন আইবেক ইবনুদ দামইয়াতি রহ. (মৃত্যু : ৭৪৯ হি.) এর বক্তব্য প্রণিধান যােগ্য। তিনি বলেন,
هذا بالمدح أشبه منه بالذم فإن الناس قد قالوا درة يتيمة إذا كانت معدومة المثل، وهذا اللفظ متداول للمدح لا نعلم أحدا قال بخلاف، وقيل يتيم دهره، وفريد عصره وإنما فهم الخطيب قصر عن إدراك ما لا يجهله عوام الناس.
(يتيم في الحديث) কথাটুকু তার নিন্দার চেয়ে প্রশংসাকে বেশি প্রমাণ করে। সাধারণত যে সকল বস্তুর দৃষ্টান্ত বা অনুরূপ খুঁজে পাওয়া না যায় সেকল বস্তুকে লােকজন (درة يتيمة) দুর্লভ মুক্তা বলে থাকে। আর প্রশংসার ক্ষেত্রে এমন শব্দের ব্যবহার এটা একটি প্রশিদ্ধ ও চলমান ধারা। কেউ এর বিপরীত মত পােষণ করেছেন বলে আমাদের জানা নেই। ঠকি এই শব্দের মতো আরো শব্দ রয়েছে যা এই দুর্লভতাকে বােঝাতে ব্যবহার করা হয়, যেমন (يتيم دهره) যুগের দুর্লভ ব্যক্তি। (وفريد عصره) সময়ের দুর্লভ ব্যক্তি। তবে একথা ঠিক যে, খতীব বাগদাদি বিষয়টি বুঝে উঠতে সক্ষম হন নি। একজন সাধারণ মানুষের কাছেও বিষয়টি স্পষ্ট। (আলমুসতাফাদ মিন জাইলি তারিখি বাগদাদ : ২/৯৩)
ফায়দা : হাদিস শাস্ত্রের পরিভাষায় একই হাদিস যখন ভিন্ন ভিন্ন সনদে বা বর্ণনাকারীেে থেকে বর্ণিত হয় তখন সেটিকে ভিন্ন হাদিস হিসেবে গণ্য করা হয়। হাদিসের মতন বা মূল বক্তব্য এক কিন্তু সেটি পাঁচটি সনদে বর্ণিত হয়েছে বা পাঁচজন বর্ণনাকারী থেকে বর্ণিত হয়েছে তবে মুহাদ্দিসগণের পরিভাষায় তা পাঁচ হাদিস হিসেবে গণ্য হবে। এক হাদিস নয়। কােন কােন মুহাদ্দিস বলেন, যদি একটি হাদিস আমার কাছে কয়েকটি সনদে না পৌছে থাকে তবে এ হাদিসের ক্ষেত্রে আমি নিজেকে ‘ইয়াতিম’ মনে করি। বিশিষ্ট মুহাদ্দিস আবু ইসহাক ইবরাহিম বিন সায়িদ আল জাওহারি আত তাবারি রহ. বলেন,
যে হাদিসটি আমার নিকট একশ’ সনদে পৌছেনি, তবে আমি সে হাদিসের ক্ষেত্রে ‘ইয়াতিম’। (তাজকিরাতুল হুফ্ফাজ : ২/৭৬)
ফায়দা : ইমাম আ’জম আবু হনিফা রহ. হলেন এ উম্মতের খাইরুল কুরুনের অন্তর্ভুক্ত। ৮০ হিজরীতে তার জন্ম এবং ১৫০ হিজরীতে তার মৃত্যু। যেহেতু তার সময়ের মধ্যে সনদের আধিক্যের ধারা শুরুই হয়নি ফলে তাঁর নিকট অধিক সনদে হাদিসের ভাণ্ডার জমাও হয়নি। এ দৃষ্টিকোন থেকে ইবনুল মুবারক রহ. এর বক্তব্য ‘হাদিস শাস্ত্রে ইয়াতিম’ কথাটিকে যদি বিশ্লেষণ করা হয়, তবে যথার্থ বলে প্রমাণীত হয়। তাঁর কাছে তাে হাদিসের ভা-ার জমা ছিলো তবে অধিক সনদে ছিলো না। সুতরাং মুহাদ্দিসগণের পরিভাষার আলোকে (يتيم في الحديث) এর মর্ম স্পষ্ট।
ইলমুল হাদিসে ইমাম আবু হানিফা রহ. এর পাণ্ডিত্য :
ইমাম আ’জম আবু হানিফা রহ. এর ইলমুল হাদিসে কিপরিমান পাণ্ডিত্য ও গভীরতা ছিলো নিম্নের ব্যক্তব্য থেকে আমরা তার কিছু ধারণা লাভ করতে পারি।
০১. ইমাম আবু আবদুল্লাহ আস সামিরি ও ইমাম মুওয়াফ্ফাকুদ্দিন আহমদ মাক্কি রহ. নিজস্ব সনদে ইমাম হাসান বিন সালেহ থেকে বর্ণনা করেন,
كان أبو حنيفة شديد الفحص عن الناسح والمنسوخ فيعمل بالحيدث إذا ثبت عنده عن النبي صلى الله عليه وسلم وعن أصحابه وكان عارفا بحديث أهل الكوفة وفقه أهل الكوفة شديد الإتباع لما كان عليه الناس ببلده وقال كان يقول إن لكتاب الله ناسخا ومنسوخا وإن للحديث ناسخا ومنسوخا وكان حافظا لفعل رسول الله صلى الله عليه وسلم الأخير.
ইমাম আবু হানিফা রহ. ‘নাসেখ ও মানসুখ’ হাদিস জানার ক্ষেত্রে খুবই দ্ক্ষ ছিলেন। যখন কােন হাদিস নবীজি সা. ও সাহাবায়ে কেরাম থেকে প্রমাণীত হয়ে যেতো সেটির উপর আমল করতেন। কূফাবাসিদের হাদিস ( যেহেতু কূফা তখন হাদিসের মারকায হিসেবে গণ্য ছিলো) ও তাদের ফিকহ সম্পর্কে অধিক জ্ঞান রাখতেন। রাসুলুল্লাহ সা. এর সুন্নাহ ও শরীয়তের যে চর্চা ছিলো কঠিনভাবে তার অনুসরণ করতেন। রাসূলুল্লাহ সা. এর সর্বশেষ আমলের হাফেজ ছিলেন। (আখবারু আবি হানিফাহ, পৃষ্ঠা-১১, মানাকিবু মুওয়াফ্ফাক মাক্কি : ১/৮৯-৯০)
০২. ইমাম মুওয়াফ্ফাক বিন আহমদ আল মাক্কি রহ. নিজস্ব সনদে উল্লেখ করেন, ইমাম আবু ইউসুফ রহ. বলেন,
فربما وجدت الحيدثين أو الثلاثة فآتيه بها فمنها ما يقبله و منها ما يرده فيقول هذا ليس بصحيح أو ليس بمعروف .. فأقول له وما علمك بذلك؟ فيقول أنا أعلم بعلم أهل الكوفة.
(একই বিষয়ে) কখনও কখনও আমার কাছে দু’টি বা তিনটি হাদিস পেয়ে যেতাম। তখন আমি সেগুলো নিয়ে ইমাম আবু হানিফা রহ. এর কাছে যেতাম, তিনি সেগুলো থেকে কােনটিকে গ্রহণ করতেন কােনটিকে বাদ দিতেন, বলতেন এটি সহিহ নয়, এটি মারুফ নয়। তখন আমি তাকে বলতাম, আপনি কীভাবে তা নির্নয় করলেন? তখন তিনি বলতেন, আমি কূফাবাসীদের ইলম সম্পর্কে জানি।
(মানাকিবুল মুওয়াফ্ফাক : ২/১৫১-১৫২, মানাকিুব কারদারি : ২/১০৩)
ইমাম ইয়াহিয়া বিন নাসর বিন হাজেব রহ. বলেন,
دخلت على أبي حنيفة في بيت مملوء كتبا فقلت ماهذه؟ قال هذه أحاديث كلها، وما حدثت به إلا اليسير الذي ينتفع به
আমি ইমাম আবু হানিফা রহ. এর দরবারে উপস্থিত হলাম. দেখলাম তার ঘরটি কিতাব দ্বারা ভর্তি। তখন আমি তাকে বললাম, এগুলো কি? তিনি বললেন, এগুলো সব হাদিস। এখান থেকে আমি মানুষদের সামনে ওই সকল হাদিস বর্ণনা করি যাতে সাধারণের কল্যাণ নিহিত।
(মানাকিবু আবি হানিফাহ , আল্লামা নাইশাপুরি রহ. ১/১৫১)

০ টি +০/-০