নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মিম্বারের আহবান

আবু সাঈদ মুহাম্মদ নু’মান

আবু সাঈদ মুহাম্মদ নু’মান › বিস্তারিত পোস্টঃ

মৃত্যু সম্পর্কে জাহেলী দৃষ্টিভঙ্গী ও কুরআনুল কারীমের সংশোধন

২৪ শে নভেম্বর, ২০১৭ রাত ১১:২৭

মৃত্যু সম্পর্কে কুরআনুল কারীমের দৃষ্টিভঙ্গি জাহেলি দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ও আলাদা। জাহেলি সমাজ মৃত্যুকে যেভাবে চেনে কুরআন তাকে সেভাবে পরিচিত করে না। এ ক্ষেত্রে কুরআনুল কারীমের দৃষ্টিভঙ্গি সম্পূর্ণ বাস্তবমুখী। পক্ষান্তরে জাহেলি দৃষ্টিভঙ্গি কাল্পনিক ও ধারণাপ্রসুত। আর তাই সমাজ সংস্কারের ধারাবাহিকতায় মৃত্যুর জাহেলি ধারণাকেও কুরআনুল কারীম পাল্টে দিয়েছে।
কুরআনুল কারীমের ভাষ্য ও আরবদের কবিতাসমূহে ব্যবহৃত শব্দদ্বারা মৃত্যু সম্পর্কে তাদের ধারণাগুলোর যে চিত্র আমরা দেখতে পাই তা মােটামুটি এরূপ-
ক. মৃত্যু হলো কেবল, শরীরের সাথে রূহের বিচ্ছেদের নাম। আর এটি একটি অস্তিত্বহীন বিষয়।
খ. তাদের বিশ্বাস মৃত্যুর মধ্য দিয়ে শরীর ও রূহ উভয়টি নিঃশেষ হয়ে যায়। কােন কিছুরই অস্তিত্ব বাকী থাকে না।
গ. মৃত্যু সংঘটিত হওয়ার পর পুণঃরায় শরীর ও আত্মার মিলন এক অসম্ভব বিষয়।
জাহেলি সমাজে বিদ্যমান এই ধারণার প্রতিনিধিত্বকারী কিছু শব্দের একটি তালিকা ইবন সায়্যিদুন নাস আন্দালুসী রহ. আলমুখাস্সাস গ্রন্থে পেশ করেছেন এবং প্রতিটি শব্দের প্রমাণ হিসেবে জাহেলি আরবদের রচিত কবিতা দিয়ে উদাহরণ পেশ করেছেন।
জাহেলি সমাজে প্রচলিত ‘মৃত্যু’র কিছু নাম :
الهميغ والنيط والرهر والمنون والشعوب والفود والحمام والسام والمقدار وقتيم وجباز وحلاق والقاضية والطلاطل والعول والذام والكفت والجداع والحذرة والحتف والخالج .......وغيرها.
জাহেলি সমাজে প্রচলিত এ সকল শব্দের মধ্যে ‘মৃত্যু’র কুরআনিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিনিধিত্বকারী শব্দ (تُوُفِّيَ) রয়েছে। তবে মজার বিষয় হলো এ শব্দের প্রমাণ পেশ করতে গিয়ে তিনি আরবদের কবিতার পরিবর্তে কুরআনুল কারীমের আয়াত পেশ করেছেন। যা থেকে বােঝা যায় যে শব্দটি যদিও জাহেলি সমাজে প্রচালিত ছিলো, তবে তা কুরআনে বর্ণিত অর্থে নয়। এবং এটাও স্পষ্ট যে মুত্যুর ধারণা সম্পর্কে জাহেলি সমাজের সাথে এ মতপার্থক্য কুরআন নাযিলের সময় থেকে শুরু হয়েছে। এ প্রসঙ্গে খাতিমাতুল মুহাদ্দিসিন সায়্যিদ আনওয়ার শাহ কাশমিরী রহ. বলেন,
“ জাহেলি বিশ্বাসে মৃত্যু’র উপর (تُوُفِّيَ) শব্দের ব্যবহার সঠিক নয়। কেননা, তাদের বিশ্বাসে না শরীরের বাকী থাকার ধারণা ছিলো, না রূহ বাকী থাকার ধারণা। অথচ (تُوُفِّيَ) শব্দের অর্থ হলো উসুল করা, যার জন্য শরীর ও আত্মার বাকী থাকা অপরিহার্য্য। তাদের বিশ্বাসে মুত্যুর মধ্যে (تُوُفِّيَ) হতে পারে না। কুরআনুল কারীম মৃত্যু’কে বােঝাতে (تُوُفِّيَ) শব্দকে ব্যবহার করেছে এবং পরোক্ষভাবে একথা বলে দিয়েছে যে মৃত্যুর মাধ্যমে প্রাপ্তি ঘটে, কেবল নিরেট ধ্বংস নয়। এই বাস্তবতাকে এই একটি শব্দে প্রকাশ করেছে। এ শব্দটিকে তার প্রকৃত অর্থ থেকে আত্মার সংমিশ্রণে দেহের প্রাপ্তি লাভ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।”
আল্লামা রাগেব ইস্পাহানী রহ. বলেন,
كل نفس ذائقة الموت فعبارة عن زوال القوة الحيوانية وإبانة الروح عن الجسد.
অর্থ : প্রতিটি আত্মাই মৃত্যুর স্বাদ আস্বাদন করবে। সুতরাং এখানে ‘মৃত্যু’ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো (ক) জীবন-শক্তি নিঃশেষ হওয়া (খ) এবং শরীর থেকে রূহ আলাদা হওয়া।
সুতরাং কুরআনুল কারীম মৃত্যুকে কেবল শরীর ও আত্মার বিচ্ছেদ হিসেবে উল্লেখ করেনি, এর সাথে সাথে ‘জীবনী-শক্তির বিলুপ্তিও বর্ণনা করেছে।
জাহেলি ধারণায় আমরা মৃত্যুর যে বাস্তবতা দেখতে পাই তা হলো, إبانة الروح عن الجسد শরীর থেকে রূহের পৃথক হয়ে যাওয়া। কিন্তু কুরআনুল কারীম আমাদের সামনে সঠিক তার বিপরীত একটি বাস্তবতা তুলে ধরছে যে, শরীর থেকে রূহের বিচ্ছেদের কারণেই মানুষের মৃত্যু ঘটে না। বরং মৃত্যুর জন্য আত্মা ও শরীরের বিচ্ছেদের সাথে সাথে জীবনী শক্তির বিলুপ্তিও আবশ্যক। যেমনটি আমরা আল্লামা রাগেব ইস্পাহানীর সংজ্ঞা থেকে জানতে পেরেছি। এর প্রমাণ হিসেবে আমরা কুরআনুল কারীমের নিম্নের আয়াতটিও দেখতে পারি।

অর্থ : আল্লাহ জীবসমূহের প্রাণ হরণ করেন তাদের মৃত্যুর সময় এবং যারা মরেনি তাদের নিদ্রার সময়। তারপর যার জন্য তিনি মৃত্যুর ফয়সালা করেন তার প্রাণ তিনি রেখে দেন এবং অন্যগুলো ফিরিয়ে দেন একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত। নিশ্চয় এতে চিন্তাশীল কওমের জন্য অনেক নিদর্শন রয়েছে।
এ আয়াতে ঘুমন্ত ব্যক্তির অবস্থা তুলে ধরা হয়েছে। কুরআনুল কারীম বলছে যে, ঘুমন্ত ব্যক্তির রূহ কবয করে নেয়া হয়, অথচ তার পরও তার মাঝে জীবনের চিহ্ন বিদ্যমান থাকে। তার শ্বাস-প্রশ্বাস চলতে থাকে। রক্তের সঞ্চালণ হতে থাকে। দীর্ঘ সময় রূহ শরীর থেকে বাইরে থাকা সত্ত্বেও তার শরীর ঠাণ্ডা হয়ে যায় না। কেউ তাকে দাফন করার জন্য নিয়ে যায় না।
সুতরাং বােঝা গেলো যে কেবল ‘শরীর থেকে রূহ বেরিয়ে যাওয়ার অর্থ মৃত্যু নয়। মৃত্যুর জন্য আত্মাও শরীরের বিচ্ছেদের সাথে সাথে এমন কিছু প্রয়োজন যার মাধ্যমে মৃত্যুর বাস্তবতা প্রতিষ্ঠিত হবে। আর সেটিই হলো ‘জীবনী-শক্তির বিলুপ্তি।
কিন্তু কেউ যদি এ বলে কুরআনিক এ বাস্তবতা থেকে দূরে সরে থাকতে চান যে, কুরআনুল কারীমের এ আয়াতটি মুতাশাবিহাতের অন্তর্ভূক্ত। যার সঠিক মর্ম উদ্ধার করা আমাদের সাধ্যের বাইরে। তবে এটা হবে বাংলা প্রবাদ বাক্য ‘শাক দিয়ে মাছ ঢাকা’র মতো। প্রকৃত অর্থে এটি যদি মুতাশাবিহ এর অন্তর্ভূক্তই হতো তবে নবীজী সা. এর যবানে এমন দু’আ উচ্চারিত হতো না। ইমাম বুখারি রহ. কিতাবুত দাওয়াতে রাসূল সা. এর ঘুমের সময়ের একটি দু’আ উল্লেখ করেন,
بِاسْمِكَ رَبِّيْ وَضَعْتُ جَنْبِيْ وَبِكَ أرْفَعُهُ إنْ أمْسَكْتَ نَفْسِيْ فَارْحَمْهَا وَإنْ أرْسَلَتَهَا فَاحْفَظْهَا بِمَا تَحَفْظُ بِهِ الصَّالِحِيْنَ .
অর্থ : তােমার নামেই হে আমার রব, আমি আমার পার্শ্বদেশ রাখলাম। তােমার সাহায্যেই তাকে উঠাবো। যদি তুমি আমার রূহকে আটকে রাখো তবে তার প্রতি রহম করো। আর যদি তাকে ফেরত পাঠিয়ে দাও তবে তার হেফাযত করো। যেমনি তুমি তােমার নেক বান্দাদের হেফাযত করে থাকো।
এ হাদিস থেকে যে বিষয়টি স্পষ্ট হলো, তা এই যে, বাস্তবিক অর্থেই ঘুমের সময় রূহ দেহের খাঁচা ছেড়ে বেরিয়ে যায় এবং আবার সময় মতো ফিরে আসে। তবে যার মৃত্যুর নির্ধারিত সময় উপস্থিত তার রূহ ফিরিয়ে দেয়া হয় না। বরযখে ও হাশরে শরীরে রূহ ফিরে আসা না আসা এ আয়াতের আলোচ্য বিষয় নয় এবং তার বিরোধিও নয়। এখানে কেবল দুনিয়ার বাস্তবতাকে তুলে ধরা হয়ছে। এটা স্পষ্ট যে ঘুমন্ত ব্যক্তির আত্মা শরীরে ফিরে আসার এ ঘটনাটি এ পৃথিবীতেই সংঘটিত হয় অন্য কােন জগতে নয়।
সূনান নাসঈর এক বর্ণনায় (إرسال) ‘ফেরত পাঠানোর’ পরিবর্তে (إحياء) ‘জীবিত’ শব্দের উল্লেখ রয়েছে,
اَللهُمَّ أنْتَ خَلَقْتَ نَفْسِيْ وأنْتَ تَتَوَفَّاهَا ، لَكَ مَمَاتُهَا وَمَحْيَاهَا إنْ اَحْيَيْتَهَا فَاحْفَظْهَا وَإنْ أمَتْتَهَا فَاغْفِرْلَهَا.
অর্থ : হে আল্লাহ! আপনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন আপনিই আমাকে মৃত্যু দান করবেন। আমার মৃত্যু ও জীবন সবই আপনারই জন্য। আপনি যদি আমাকে জীবন দান করেন, তবে তাকে হেফাযত করুন। আর যদি মৃত্যু দান করেন তবে আমাকে ক্ষমা করুন।
আল্লামাহা হাফেয ইবন হাজার আসকালানী রহ. ফতহুল বারীতে এ বর্ণনাটি উল্লেখ করেছেন। ইবনে হিব্বান ও এটিকে সহিহ বলে উল্লেখ করেছেন।
হযরত আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত এক রেওয়ায়েতে (إحياء/إرسال) এই জাগ্রত হওয়ার পরিবর্তে (إعادة الروح) রূহ ফিরিয়ে দেয়ার উল্লেখ রয়েছে।
اَلْحَمْدُ لِلهِ الَّذِيْ عَافَانِيْ فِيْ جَسَدِيْ وَرَدَّ عَلَيَّ رُوْحِيْ .
অর্থ : সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য যিনি আমার শরীরকে অক্ষত রেখেছেন এবং আমার রূহকে ফিরিয়ে দিয়েছেন।
ইমাম তিরমিযি এ বর্ণনার সনদকে সহিহ বলেছেন। ইমাম নবভী রহ. এর সনদকে সহিহ বলেছেন। আর ইবনে হাজার রহ. এটিকে ‘হাসান’ বলে উল্লেখ করেছেন।
এই বিস্তারিত বিবরণ থেকে যে বিষয়টি আমরা জানতে পারি যে ইসলাম ‘মৃত্যু’র একটি স্বতন্ত্র অর্থ নির্ধারণ করে দিয়েছে এবং এ নির্ধারণ করার মধ্য দিয়ে জাহেলি সমাজের ধারণাকে সম্পূর্ণ পাল্টে দিয়েছে। এ বাস্তবতাকে প্রমাণ করার জন্য ইসলাম জাহেলি আরবের কবিতার উপর নির্ভরশীল নয়।
কুরআনিক দৃষ্টিভঙ্গিতে মৃত্যুর স্বরূপ :
মৃত্যু একটি গুণ যা জীবন নামক গুণের পরিবর্তনের মাধ্যমে শরীরের উপর আপতিত হয়। দেহের খাঁচা আত্মা বেরিয়ে যাওয়ার নাম মৃত্যু নয়; বরং মৃত্যু একটি অস্তিত্বশীল জিনিস। আল্লাহর এক সৃষ্টি মাখলুক।

অর্থ : যিনি মৃত্যু ও জীবন সৃষ্টি করেছেন যাতে তিনি তােমাদেরকে পরীক্ষা করতে পারেন যে, কে তােমাদের মধ্যে আমলের দিক থেকে উত্তম। আর তিনি মহাপরাক্রমশালী, অতিশয় ক্ষমাশীল।
সুতরাং মৃত্যু যখন একটি মাখলুক তখন তাকে কেবল ‘শরীর থেকে আত্মার বিচ্ছেদ’ বলে ব্যক্ত করা, এক অস্তিত্বহীন বিষয় বলে আখ্যা দেয়া কীভাবে যুক্তি সংগত হতে পারে?
ইমাম নাসির উদ্দীন আহমদ বিন মুহাম্মদ ইবনুল মুনির ইস্কান্দারী মালেকি রহ. বলেন,
إن الموت عدم وهو خطأ صراح ومعتقد أهل السنة أنه أمر وجودي يضاد الحياة ، وكيف يكون العدم بهذه المثابة ولو كان العدم مخلوقا حادثا ، وعد الحوادث مقررا أزلا للزم قطع الحوادث.
অর্থ : মৃত্যুকে একটি অস্তিত্বহীন জিনিস হিসেবে আখ্যায়িত করা স্পষ্ট ভ্রান্তি। আহলুস সুন্নাহর আকিদা মতে এটি একটি অস্তিত্বশীল জিনিস, যা জীবনের বিপরীত। অস্তিত্বহীন জিনিস এ পর্যায়ের হতে পারে না, (অর্থাৎ অস্তিত্বহীন জিনিস কােন অস্তিত্বশীল জিনিসের বিপরীত হতে পারে না।) যদি অনস্তিত্বও কােন সৃষ্টি হতো, এবং সৃষ্টির আদি থেকেই তা প্রমাণিত হতো, তবে এর দ্বারা সৃষ্টি ব্যহত হতো।
তাফসীরে রূহুল মাআনিতে রয়েছে,
والموت على ما ذهب إليه الكثير من أهل السنة صفة وجودية تضاد الحياة واستدل على وجوديته بتعلق الخلق به وهو لا يتعلق بالعدمي لأزلية الإعدام.
অর্থ : জমহুর আহলে সুন্নাতের মতে মৃত্যু এক অস্তিত্বশীল জিনিস, যা হায়াতের বিপরীত। মৃত্যু একটি অস্তিত্বশীল জিনিস হওয়ার প্রমাণ আমরা এর সাথে ‘সৃষ্টি’ কথার সম্পর্ক থেকে পেয়ে থাকি। কেননা, সৃষ্টি কর্ম কােন অস্তিত্বহীন জিনিসের সাথে সম্পৃক্ত হতে পারে না। কেননা অস্তিত্বহীনতা একটি আদি গুণ।
ইমাম রাযি রহ. বলেন,
واختلفوا في الموت فقال قوم إنه عبارة عن هذه الصفة وقال أصحابنا إنه صفة وجودية مضادة للحياة واحتجوا على قولهم بأنه تعالى قال الذي خلق الموت والحياة والعدم لا يكون مخلوقا هذا هو التحقيق. والموت عند أصحابنا صفة وجودية مضادة للحياة
অর্থ : মৃত্যুর ধারণা সম্পর্কে বহু পূর্ব থেকেই মতবিরোধ চলে আসছে। অনেকে এটিকে ‘জীবনের বিলুপ্তি’ দ্বারা ব্যক্ত করেছেন। আহলে সুন্নাতের রায় হলো, মৃত্যু একটি অস্তিত্বশীল জিনিস যা হায়াতের পিরীত। আহলে সুন্নাত আল কুরআনুল কারীমের এ আয়াত দ্বারা প্রমাণ পেশ করেন, (الذي خلق الموت والحياة)। কেননা, অস্তিত্বহীন জিনিস সৃষ্টি হওয়ার কােন প্রশ্ন আসে না। সুতরাং এটাই প্রামাণীত যে, মৃত্যু কােন অস্তিত্বহীন গুণ নয়; বরং তা একটি অস্তিত্বশীল জিনিস।
মৃত্যু যদি অস্তিত্বহীনতার নাম হয় তবে তার সাথে (خلق) সৃষ্টি করা ক্রিয়াটি কিসের উপর প্রতিষ্ঠিত হবে?
মৃত্যু আল্লাহ তায়ালার সৃষ্ট মাখলুক : অস্তিত্বশীল জিনিস : অস্তিত্বহীন নয়
মৃত্যু আল্লাহ পাকের সৃষ্ট একটি মাখলুক। একটি অস্তিত্বশীল জিনিস যা কােন শরীরের উপর আপতিত হয়। মৃত্যুকে ‘রূহ ও শরীরের বিচ্ছেদ’ অথবা ‘জীবনী শক্তির বিলুপ্তি’ দিয়ে ব্যখ্যা করার মাঝে মৃত্যুর প্রকৃত বাস্তবাতা উঠে আসেনা। বরং এ থেকে মৃত্যু একটি অস্তিত্বহীন বিষয় হওয়াটা বেরিয়ে আসে।
অস্তিত্বহীন অর্থে মৃত্যুকে অর্থ্যাৎ ‘জীবনী শক্তির বিলুপ্তি’ বলার মধ্যে কিছু সমস্যাও রয়েছে। কেননা এর দ্বারা এটা আবশ্যকীয় হয়ে দাঁড়ায় যে, যার উপর মৃত্যু আপতিত হবে পূর্ব থেকে তার মাঝে জীবন বিদ্যমান থাকতে হবে। এ অবস্থায় মূর্তিকে মৃত বলার কােন সুযোগ থাকে না। কেননা প্রতিমার মাঝে কখনই তাে জীবনের অস্তিত্ব বিদ্যামান ছিলো না। ফলে কুরআনে বর্ণিত, (لا يسمع) এর অর্থ হবে যারা এক সময় শুনতো এখন শুনে না। (لا يرى) যারা এক সময় দেখতো এখন দেখে না ।
আমরা যদি প্রথম সংজ্ঞার আলোকে মৃত্যুকে বিশ্লেষণ করি তবে দেখতে পাবো (إبانة الروح عن الجسد) শরীর থেকে রূহের বিচ্ছেদের কারণে সর্বক্ষেত্রে মৃত্যু অবধারিত হয় না। যেমন কুরআন কারিমের সূরা যুমারের ৪২ নং আয়াতের আলোকে জানতে পারি যে ঘুমন্ত ব্যক্তির রূহ ও ঘুমের সময় শরীর থেকে হরণ করে নেয়া হয়, অথচা তার উপর মৃত্যু আসে না। তাকে কেউ মৃত বলে না।
পক্ষান্তরে যদি দ্বিতীয় সংজ্ঞার আলোকে বিশ্লেষণ করি তবে এর সমস্যা আরো বিকট আকৃতিতে ধরা পড়ে। কারণ মৃত্যকে যদি আমরা ‘জীবনী শক্তির বিলুপ্তি দ্বারা সংজ্ঞায়িত করি তবে এর জন্য পূর্ব থেকে তার মাঝে জীবন থাকা আবশ্যক। যে বস্তুর মাঝে কখনও জীবন সঞ্চার হয়নি তার উপর মৃত্যু আসতে পারে না। কারণ মৃত্যু আসতে হলে তাে জীবন লাগবে। সুতরাং এ সংজ্ঞার আলোকে প্রতিমাকে মৃত বলে আখ্যায়িত করার কােন যুক্তি থাকে না। কারন মাটি-পাথরের এই প্রতিমার মাঝে কােন কালেই জীবন সঞ্চার হয়নি। তবে তাদেরকে মৃত বলার কােন যুক্তি নেই। অনুরূপ মুশরিকগণ চন্দ্র-সূর্য, গাছ-পাথরসহ যা কিছুর পুজা করে তার উপর মৃত শব্দটির প্রয়োগ কােনভাবে প্রযোজ্য হতে পারে না। যার অবশ্যম্ভাবি ফল এই দাঁড়াবে যে কুরআনুল কারিমে যেখানে এ সকল প্রতিমাকে মৃত বলে তার পুজা করার ক্ষেত্রে ভর্ৎসনা করা হয়েছে, তার কােন অর্থ থাকে না। এ সকল প্রতিমার গুণ হিসেবে তারা শােনে না, দেখে না বলে যা কিছু উল্লেখ করা হয়েছে তার যর্থার্থতাও আর বাকি থাকে না।
এবার কুরআনুল কারীমের এ আয়াতটির দিকে দৃষ্টি দেয়া যাক।
()
আয়াতে মৃত্যুকে জীবনের বিপরীতে উল্লেখ করা হয়েছে। এখানে মৃত্যুর জন্য পূর্ব থেকে জীবন থাকার কােন আবশ্যকীয়তা বােঝা যায় না। এখানে মৃত্যুর অর্থই হলো অনস্তিত। জীবনী শক্তির বিলুপ্তি নয়। হযরত আবদুল্লাহ বিন আব্বাস রা. হযরত আবদুল্লাহ বিন মাসউদ রা. বিশিষ্ট তাবেঈ হযরত মুজাহিদ রহ. থেকে অনুরূপ বর্ণিত হয়েছে। যা থেকে বােঝা যায় যে মৃত্যুর অর্থ () জীবনী শক্তির বিলুপ্তি নয়। প্রকৃত বিষয় হলো মৃত্যু একটি অস্তিত্বশীল জিনিস যার জন্য ‘জীবনী শক্তির বিলুপ্তি’ আবশ্যক নয়, অনুরূপ, রূহ ফিরিয়ে দেয়ার কারণে মৃত শব্দটির বিলুপ্তি জরুরি নয়। শামসুদ্দিন মুহাম্মদ বিন আহমদ আবদুল হাদি আলহাম্বলি (মৃ.৭৪৪হিজরী) বলেন,
إن هذه الإعادة ليست مستلزمة لإثبات حياة مزيلة لاسم الموت بل هي نوع حياة برزخية.
নিশ্চয় এই ফিরিয়ে দেয়া হায়াতকে প্রমাণ করার জন্য আবশ্যক নয় এবং মৃত শব্দটির বিলুপ্তি জরুরি নয়। বরং এটি একধরণের বারযাখি হায়াত।
পৃথিবীর জ্ঞানী-গুণি-বুদ্ধিজীবিগণ মৃত্যুর সংজ্ঞা দিতে বহু কথা বলেছেন এবং বহু কথা বলতে থাকবেন।
শরীর জন্য জীবন যেমন একটি বৈশিষ্ট তেমনি মৃত্যুও একটি বৈশিষ্ট। জীবন-মরণ উভয়টি শরীরের গুণ। একটি অপরটির বিপরীত। জীবনের অন্তার্ধানে মৃত্যুর আগমন ঘটে। জীবন নামক বৈশিষ্টের পরিবর্তনের মাধ্যমে শরীরের উপর আপতিত হয়। যদি জীবন নামক বৈশিষ্টটি ব্যক্তির সত্ত্বাগত গুন না হয় তবে ব্যক্তি থেকে এ গুণ দূর হয়ে যাওয়ার মাধ্যমে মৃত্যু আপতিত হয়। পক্ষান্তরে যদি জীবনের এ বৈশিষ্টটি ব্যক্তির সত্ত্বাগত গুণ হয় তবে এ ক্ষেত্রে দুটি অবস্থা রয়েছে। (ক) পরিবর্তন গ্রহণকারী (খ) পরিবর্তণ গ্রহণ কারী নয়। যদি পরিবর্তণ গ্রহণকারী হয় তবে জীবনের এ বৈশিষ্ট লুকিয়ে যাওয়ার পরই মৃত্যু আপতিত হয়। আর যদি পরিবর্তণ গ্রহণ কারী না হয় তার জন্য মৃত্যু এক অসম্ভব বিষয়।
এ বিস্তারিত বিবরণ থেকে আমাদের দাবি হলো, মৃত্যুর এমন সূক্ষ্মাতি সূক্ষ্ম বিশ্লেষণের পিছনে পড়া এবং সেটিকে বাকবিত-ার বিষয়ে পরিণত করা এমন কােন বিষয় নয় যার উপর আমাদের পরকালীন মুক্তি নির্ভর করছে।
তবে এটা মনে রাখা দরকার যে রূহ শরীরের খাচায় বন্দি থাকার নামই কেবল জীবন নয়। রূহ যদি শরীরের খাঁচা ছেড়ে বেরিয়েও যায় এবং শরীরের সাথে কােনরূপ সম্পর্ক বা প্রভাব বিদ্যমান থাকে এমতাবস্থায়ও জীবন নামক বৈশিষ্ট শরীরে বিদ্যমান থাকে। ইবনে হুমামের বক্তব্য থেকে এ কথা বােঝা যায় যে রূহ ও হায়াতের জন্য একটি অপরটির সাথে সংযুক্ত থাকা কােন জরুরি বিষয় নয়; বরং সম্পর্ক ও প্রভাব থাকলেও জীবনের অস্তিত্ব প্রমাণীত হয়। ফিকহুল আকবারের এ বক্তব্য থেকেও এর দিকে ইঙ্গিত পাওয়া যায়, إعادة الروح إلى العبد حق এখানে فيপরিবর্তে (إلى) শব্দটি এ বাস্তবতার দিকে ইঙ্গিত করছে যে, রূহ শরীরে মধ্যে ফিরিয়ে দেয়া জরুরি নয়; বরং শরীরের দিকে ফিরিয়ে দেয়া দ্বারাই কবরের জীবনের জন্য যথেষ্ট হয়ে যায়। যার মাধ্যমে বান্দা মুনকার নাকিরের প্রশ্নের জবাব দিতে সক্ষম হয়, এবং কবরের শাস্তি ও নেয়ামত ভােগ করতে পারে।
মৃত্যুর শরয়ী মাফহুম :
মৃত্যু কেবল ধ্বংসের নাম নয়। মৃত্যু হলো এ জগত থেকে অন্য জগতে স্তানান্তরের নাম। মানুষ মৃত্যুর মাধ্যমে এ দুনিয়ার জগত থেকে অন্য জগতে চলে যায়। আল্লামা বদরুদ্দিন আইনি রহ. বলেন,
الموت ليس بعدم إنما هو انتقال من دار إلى دار.
মৃত্যু কেবল অস্তীত্বহীন হয়ে যাওয়ার নাম নয়; বরং মৃত্যু হলো এক জগত থেকে অন্য জগতে স্থানান্তরিত হওয়া।
ليس بعدم محض ولا فناء صرف
মৃত্যু অস্তীত্বহীণ কােন জিনিস নয়, নিরেট কােন ধ্বংসের নাম নয়।
হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম গাজ্জালি রহ. মতে মৃত্যু হলো এক পােশাক খুলে অন্য পােশাক পরিধান করার নাম।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.