নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মিম্বারের আহবান

আবু সাঈদ মুহাম্মদ নু’মান

আবু সাঈদ মুহাম্মদ নু’মান › বিস্তারিত পোস্টঃ

আবদুল্লাহ বিন উমর রা.

২৩ শে এপ্রিল, ২০১৮ রাত ৯:০৬

বর্ণাঢ্য এক দীর্ঘ জীবন অতিবাহিত করে আবদুল্লাহ বিন উমর রা. এখন জীবন-সায়াহ্নে উপনীত।
জীবনের এই পড়ন্ত বিকেলে সাথিদের সাথে কথা বলছিলেন হযরত আবদুল্লাহ বিন উমর।
“রাসূলুল্লাহ সা. এর হাতে বাইয়াত গ্রহণ করার পর আজ পর্যন্ত সে বাইয়াতের খেলাফ কোন কাজ করিনি। আজকের এই দিন পর্যন্ত আমি একটুও বদলাইনি।
ফিতনাবাজদের হাতে কখনও হাত রাখিনি।
কোন নিদ্রিত মুমিনের নিদ্রার ব্যাঘাত ঘটাইনি।”
এ শব্দমালার মাঝে সুপ্ত আছে একজন নেককার মানুষের জীবনের সারসংক্ষেপ। যে জীবন আশিটিরও বেশি বসন্ত অতিবাহিত হতে দেখেছে।
ইসলাম ও ইসলামের নবীর সাথে যে জীবনের বন্ধন তৈরী হয়েছিল তের এর কোঠায়। বদরের যুদ্ধে যখন স্বীয় পিতার সাথে মুসলমানদের কাতারে শামিল হতে এসেছিলেন। আশা ছিল মুজাহিদদের সারিতে তিনি নিজের জন্য একটি স্থান তৈরী করে নিতে পারবেন। কিন্তু নবীজি সা. তাকে বয়সের স্বল্পতার কারণে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন।
সে দিন থেকে, বরং তারও আগে যখন তিনি স্বীয় পিতার সাথে হিজরতের পথে সাথি হয়েছিলেন। তখন থেকেই রাসূলুল্লাহ সা. ও ইসলামের সাথে যৌবনের প্রারম্ভেই পৌরুষ জেগে ওঠা এই যুবকের সম্পর্কের সূচনা।
যে দিন থেকে ইসলামের সাথে তাঁর সম্পর্ক তৈরী হয়েছে সেদিন থেকে মৃত্যু পর্যন্ত দীর্ঘ পঁচাশি বছরের বর্ণাঢ্য জীবনের যে অংশের প্রতি নজর দেয়া হোক না কেন, দেখা যাবে তিনি আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তনকারী রূপে অবিচল রয়েছেন। তিনি তাঁর আদর্শ থেকে চুল পরিমাণও সরে আসেন নি। যে কোন বাইয়াতই তিনি গ্রহণ করেছেন তার আদর্শ থেকে সামান্য পরিমাণও সিটকে পড়েন নি।
কাউকে কোন ওয়াদা দিলে তা থেকে কিঞ্চিত পরিমাণও হ্রাস করেন নি।
নিজের প্রতি মানুষের দৃষ্টিকে আকর্ষণ করার মত অগণিত গুণ ও বৈশিষ্ট রয়েছে।
তঁর জ্ঞান ও প্রজ্ঞা, বিনয় ও ন¤্রতা, হৃদয়ের স্থিরতা ও আদর্শের অবিচলতা, তাঁর খোদাভীতি ও তাকওয়া, দানশীলতা ও বদান্যতা, ইবাদাত ও সত্যের উপর তাঁর অটলতা, সুন্নাহকে জীবনের আদর্শরূপে আঁকড়ে ধরা।
এ সকল গুণাবলী দিয়েই ইবন উমর তাঁর পবিত্র জীবনকে রাঙিয়েছেন। তাঁর বিরল ব্যক্তিত্বকে সাজিয়েছেন।
তিনি স্বীয় পিতা উমর রা. থেকে অগণিত কল্যাণের আকর সংগ্রহ করেছেন। পিতার সাথে মহান রাসূলের সোহবতে থেকে কল্যাণ ও মহত্বের সবটুকু আয়ত্ব করে নিয়েছেন।
পিতার মতই নিজের ঈমানকে সৌন্দর্য সুষমায় ফুটিয়ে তুলেছেন। আর এখান থেকেই তার জীবনে রাসূলুল্লাহ সা. এর পদাঙ্ক অনুসরণ এমন একটি পর্যায়ে উপনীত হয়েছে যা বুদ্ধিমানদেরকেও হতবাক করে দিয়েছে।
তিনি দেখতেন, নবীজি সা. কোন কাজটি কিভাবে করেন, এরপর নিজে খুব সতর্কতার সাথে ওই কাজটি ওইভাবে করার চেষ্টা করতেন।
যেমন, নবীজি সা. এখানে নামায আদায় করেছেন, তো ইবন উমরও ওই একই স্থানে নামায আদায় করেছেন।
কোন জায়গায় যদি নবীজি সা. দাঁড়িয়ে দু’আ করেছেন, তো ইবনে উমর ওই একই স্থানে দাঁড়িয়ে দু’আ করেছেন। কোন স্থানে নবীজি সা. যদি বসে দু’আ করেছেন, তো সেখানে সেই একই স্থানে ইবনে উমর বসে দু’আ করেছেন। কোন পথে কোন দিন চলতে গিয়ে নবীজি সা. তার উটনীর পিঠ থেকে নেমেছেন এবং দু’রাকাত সালাত আদায় করেছেন, তো আবদুল্লাহ বিন উমরও সেখানে সেই স্থানে উটনীর পিঠ থেকে নেমেছেন এবং দু’রাকাত সালাত আদায় করেছেন। যদি ওই পথে তিনি সফর করেছেন।
কেবল এতটুকু নয়, তিনি তো এটাও স্মরণ রেখেছেন যে, মক্কায় এ জায়গাটিতে নবীজি সা. এর উটনী নবীজিকে নিয়ে দুইটি চক্কর দিয়েছিল এরপর নবীজি সা. উটনীর পিঠ থেকে নেমেছেন ও দু’রাকাত নামায আদায় করেছেন। অবশ্য উটনী ওই কাজটি নিজের থেকেই করেছিল সহজে সেখানে বসার প্রস্তুতির জন্য।
কিন্তু আবদুল্লাহ বিন উমর রা. একদিন ওই স্থানটিতে পৌঁছলেন এবং নিজের উটনীকে দুইবার চক্কর দেয়ালেন এরপর উটনীর পিঠ থেকে নেমে আসলেন এবং হুবহু ওই রকম দু’রাকাত সালাত আদায় করলেন যেমনটি তিনি রাসূলুল্লাহ সা.কে আদায় করতে দেখেছেন।
রাসূলুল্লাহ সা. এর পদাঙ্ক অনুসরণের এ বিষয়টি উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রা. কে প্রভাবিত করল। একদিন তিনি বললেন, “ইবনে উমর নিজ গৃহে যেভাবে নবীজি সা. এর সূন্নাহর অনুসরণ করেন অন্য কেউ এরূপ করেন না।”
তিনি তাঁর দীর্ঘ জীবন এই দৃঢ় বন্ধুত্বের উপর কাটিয়েছেন। বিষয়টি এ পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে যে, একটা সময় মুসলমানদের উপর এমন আসল যখন তাদের নেককার লোকগুলো এভাবে দু’আ করতেন, “হে আল্লাহ আমাকে যতদিন বাঁচিয়ে রাখবে ততদিন আবদুল্লাহ বিন উমরকেও বাঁচিয়ে রাখ। যাতে আমি তার অনুসরণ করতে পারি। তাকে ছাড়া ভিন্ন কাউকে জানি না যিনি প্রথম যুগের মুসলমানদের আদর্শের উপর রয়েছেন।
রাসূলুল্লাহ সা. ও তাঁর সুন্নাহর এই নিবিড় দৃঢ় অনুসরণের কারণে ইবন উমর রা. রাসূলুল্লাহ সা. থেকে কোন হাদিস বর্ণনা করতে ভয় পেতেন। কেবল তখনই কোন হাদিস বর্ণনা করতেন যদি তিনি নবীজির মুখ নিঃসৃত প্রতিটি বর্ণ ও শব্দ হুবহু মনে রাখতে পেরেছেন।
তাঁর সমসাময়িক লোকেরা বলেছেন, “নবীজির হাদিসে বাড়ানো বা কমানের ক্ষেত্রে আবদুল্লাহ বিন উমরের চেয়ে অধিক সতর্ক আর কেউ ছিলেন না।
অনুরূপভাবে ফতোয়া প্রদাণের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করতেন।
একদিন এক ব্যক্তি তাঁর কাছে ফতোয়া জিজ্ঞেস করার জন্য এল। লোকটি যখন তাঁর কাছে প্রশ্নটি উত্থাপন করল, তিনি তাকে এ বলে উত্তর দিলেন, তুমি যে বিষয়ে জিজ্ঞেস করছ সে বিষয়ে আমার কোন জ্ঞান নেই।
তখন লোকটি তার গন্তব্যের পথে রওয়ানা হয়ে গেল। লোকটি ইবন উমর থেকে কয়েক কদম দূরে যাওয়ার পর ইবন উমর রা. খুশিতে হাত নাচাতে লাগলেন, আর নিজে নিজে স্বগতোক্তি করলেন, “ইবনে উমরকে এমন এক বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হল যে বিষয়ে তার কোন জ্ঞান, আর সে তখন বলল, আমি জানি না।”
নিজের রায় ও ইজতেহাদের ভিত্তিতে ফতোয়া দেয়ার ব্যাপারে খুব ভয় করতেন, পাছে ইজতেহাদে না জানি ভুল হয়ে যায়। যদিও তিনি মহান দীনের শিক্ষার উপরই জীবন যাপন করতেন। আর এটাও জানতেন যে, ইজতিহাদে ভুলকারীরও আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি আজর রয়েছে। আর যিনি সঠিক রায় পেশ করতে পারলেন তার জন্য রয়েছে দু’টি আজর। কিন্তু আল্লাহর ভয় তার মধ্য থেকে ফতোয়া প্রদাণের সাহসিকতাই যেন ছিনিয়ে নিয়েছিল। অনুরূপভাবে তিনি বিচারকের দায়িত্ব থেকেও দূরে থাকার চেষ্টা করতেন।
সে সময় বিচারকের দায়িত্ব ছিল রাষ্ট্র ও সমাজের শ্রেষ্ঠ একটি পদমর্যাদা। যারা এ দায়িত্বে অভিষিক্ত হন তারা অর্থিক বিশেষ সুযোগ-সুবিধা লাভ করেন। সমাজিক বিশেষ মর্যাদার অধিকারী হন। জনগনের উপর তাদের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত হয়।
কিন্তু আবদুল্লাহ বিন উমর কী প্রয়োজন এসব অর্থের? এ সব ক্ষমতার? এসব সম্মানের?
খলীফা উসমান রা. একদিন তাকে দারুল খেলাফতে ডেকে পাঠালেন। তাঁর কাছে বিচারকের দায়িত্ব পালনের প্রস্তাব পেশ করলেন। সাথে সাথে তিনি অপারগতা প্রকাশ করলেন। হযরত উসমান রা. তাকে বিচারকের দায়িত্ব নেয়ার জন্য পিড়াপীড়ি করলেন। কিন্তু তিনি তাঁর কথার উপর অটল রইলেন।
তখন উসমান রা. তাকে বললেন, আপনি কি খলীফার নির্দেশ অমান্য করবেন?
তখন ইবন উমর রা. উত্তর দিলেন, না, আমি খলীফার নির্দেশ অমান্য করতে যাব কেন? আসল কথা হল, আমি জানতে পেরেছি যে, বিচারকগণ তিন ধরণের হয়ে থাকেন। এক. ওই সকল বিচারক, যারা অজ্ঞতা প্রসুত বিচার করেন, এরা জাহান্নামী। দুই. ওই সকল বিচারক, যারা নিজের খেয়াল-খুশি মত বিচার করেন, এরাও জাহান্নামী। তিন. ওই সকল বিচারক, যারা ন্যায় বিচারের জন্য যথাসাথ্য চেষ্টা করেন এবং সঠিক বিচার করেন, তিনি এমন এক পর্যায়ে থাকেন, তার উপর কোন গুনাহও থাকে না, তবে তিনি প্রতিদানও প্রাপ্ত হন না।
আল্লাহর নামে আপনাকে বলছি, আপনি আমাকে এ বিষয়ে অব্যহতি দান করুন।
হযরত উসমান রা. তাকে অব্যহতি দিলেন, তবে এ বিষয়ে অঙ্গিকার নেয়ার পর যে তিনি বিষয়টি কাউকে বলবেন না।
কারণ জনগনের কাছে ইবনে উমরের কী মর্যাদা ও গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে, হযরত উসমান রা. তা জানতেন । তিনি আশংকা করলেন, সমাজের ভাল ও আল্লাভীরু মানুষগুলো যদি ইবনে উমরের বিচারের দায়িত্ব গ্রহণ না করার বিষয়টি যদি জেনে যান, আর তারাও যদি ইবনে উমরের এ আদর্শকে গ্রহণ করেন, তবে বিচারকের এই মহান দায়িত্ব কে পালন করবে? খলীফা কেথায় পাবেন এর যোগ্য ব্যক্তি।
আবদুল্লাহ বিন উমরের জীবনের এ দিকটি যদিও আপাত দৃষ্টিতে একটি নেতিবাচক দিক হিসেবেই মনে হচ্ছে, তবে বাস্তবে কিন্তু তা নয়।
আবদুল্লাহ বিন উমর রা. এমন পরিস্থিতিতে কিন্তু বিচারকের দায়িত্ব গ্রহণে অসম্মতি জানান নি, যখন তাঁকে ছাড়া এ দায়িত্ব পালনের কেউ ছিল না। বরং সেখানে আল্লাহর রাসূলের অসংখ্য নেককার আল্লাহভীরু সাহাবি ছিলেন। তাদের অনেকেই কার্যক্ষেত্রে বিচারকের দায়িত্ব ও ফতোয়ার দায়িত্ব আঞ্জাম দিতেন।
হযরত আবদুল্লাহ বিন উমর রা. কর্তৃক বিচারকের দায়িত্বভার গ্রহণ না করার কারণে কিন্তু বিচারকের আসন শূন্য পড়ে থাকেনি। অথবা এমন অবস্থাও হয়নি যে বিচারকের এ গুরুত্বপূর্ণ আসনটিতে এমন কাউকে বসাতে হয়েছে যিনি এ আসনের যোগ্য নন।
আসলে ইবনে উমর জনগনকে নিয়ে ব্যস্ত হওয়ার চাইতে নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত হওয়াকে প্রাধান্য দিয়েছেন। আর এ আত্মকেন্দ্রিক ব্যস্ততার মধ্য দিয়ে আল্লাহর সাতে তাঁর সম্পর্কে আরো জোরালা করার প্রয়াসী হয়েছেন। তিনি চেয়েছেন আনুগত্যের মাঝে নিজেকে পূর্বের তুলনায় আরে বেশি আত্মসমাহিত করে দিতে। ইবাদাতে নিজেকে আরো অধিক মশগুল করে রাখতে।
যেমন ইসলামী খেলাফতের সে সময়টাতে আবাদ পৃথিবীর অধিকাংশ অঞ্চল মুসলমানদের অধিনে চলে এসেছিল। মুসলমানদের সামনে অর্থ-বিত্তের পাহাড় জমা হয়েছিল। রাষ্ট্রীয় শাষণ ব্যবস্থার বহু পদ ও পদবী সৃষ্টি হয়েছিল।
সাথে সাথে এ সম্পদ ও ক্ষমতার আকর্ষণ কিছু কিছু মুমিনের হৃদয়কে প্রতারিত করতে শুরু করেছে। যা অনেক সাহাবিকে বাধ্য করেছিল ক্ষমতা ও সম্পদের এ মোহের বিপরীতে প্রতিরোধের পতাকাকে উচ্চে তুলে ধরতে, যাতে তারা যুহদ ও দুনিয়াবিমুখতায়, তাকওয়া ও খোদাভীতিতে, ক্ষমতার বড় বড় পদমর্যাদায় আসীন না হওয়ার ক্ষেত্রে এবং সম্পদ ও ক্ষমতার মোহকে দমিয়ে রাখার ক্ষেত্রে মানুষের আদর্শ হতে পারেন। তাদের মধ্যে ইবন উমর রা. ছিলেন অন্যতম।
আবদুল্লাহ বিন উমর রা. ছিলেন নিশিথের বন্ধু। আর এ নিশি কাটাতেন নামাযে দাঁড়িয়ে। তিনি ছিলেন শেষরাতের স্বজন। রাতের এ শেষপ্রহর কাটতো রোনাজারি ও ক্ষমাপ্রার্থনায়।
আবদুল্লাহ বিন উমর রা. তার যৌবনে একটি স্বপ্ন দেখেছিলেন। নবীজি সা. সে স্বপ্নের তাবিরও করেছিলেন। নবীজির সে তাবিরে ইবন উমরের জীবনের আশারই প্রতিফলন ঘটেছিল। রাতভর দাঁড়িয়ে নামাজ পড়াকে নবীজি সা. তার জীবনের আশা-আকঙ্খার কেন্দ্র বলে ব্যাক্ত করেছিলেন।
আসুন না শুনে আসি সে স্বপ্নের বিবরণ। স্বপ্নদ্রষ্টার মুখেই শুনি সে সত্য সুন্দর স্বপ্নের কথা।
নবীজি সা এর সময়ের কথা। আমি একটি স্বপ্ন দেখলাম। সুন্দর স্বপ্ন। দেখলাম আমার হাতে একটি রেশমি কাপড়ে টুকরা রয়েছে। এ কাপড়টি আমাকে নিয়ে জান্নাতের যেখানে আমি চাচ্ছি উড়ে যাচ্ছে। ......। আমি আরও দেখলাম দু’জন আগন্তুক আমার কাছে আসল। তারা আমাকে জাহান্নামের দিকে নিয়ে যেতে চায়। তখন সেখানে একজন ফেরেশতা তাদের মুখোমুখী হল। সে ফেরেশতা তাদেরকে বলল, ছেড়ে দাও। তখন তারা আমাকে ছেড়ে চলে গেল।
আমার বোন হাফসা স্বপ্নটি নবীজি সা. কে বর্ণনা করে শোনাল। তখন নবীজি সা. বললেন, আবদুল্লাহ খুব ভাল মানুষ। যদি সে রাতে নামায আদায় করতো তবে তার মর্যাদা আরো বৃদ্ধি পেত।
সেদিন থেকে মাহান প্রভুর সাথে সাক্ষাতের দিন পর্যন্ত রাতের নামাযকে কখনও বাদ দেননি। না হজরে না সফরে। নিজ শহরে যেমন আদায় করেছেন তেমনি দূর সফরেও আদায় করেছেন।
অধিক পরিমাণে নামাজ আদায় করতেন। কুরাআন তেলাওয়াত করতেন। সর্বদা জিকিরে লিপ্ত থাকতেন। পিতার মতই যখন কুরআনুল কারীমের সতর্ককারী আয়াতের তেলাওয়াত শুনতেন, দু’চোখ ভেঙ্গে অশ্রু গড়িয়ে পড়ত।
উবাইদ বিন উমাইর বলেন, একদিন আমি আবদুল্লাহ বিন উমর রা.কে এ আয়াত তেলাওয়াত করে শোনালাম,
فَكَیْفَ اِذَا جِئْنَا مِنْ كُلِّ اُمَّةٍۭ بِشَهِیْدٍ وَّ جِئْنَا بِكَ عَلٰی هٰۤؤُلَآءِ شَهِیْدًا ؕؔ۝۴۱ یَوْمَىِٕذٍ یَّوَدُّ الَّذِیْنَ كَفَرُوْا وَ عَصَوُا الرَّسُوْلَ لَوْ تُسَوّٰی بِهِمُ الْاَرْضُ ؕ وَ لَا یَكْتُمُوْنَ اللّٰهَ حَدِیْثًا۠۝۴۲
অর্থ : আর তখন কি অবস্থা দাঁড়াবে, যখন আমি ডেকে আনব প্রতিটি উম্মতের মধ্য থেকে অবস্থা বর্ণনাকারী এবং আপনাকে ডাকব তাদের উপর অবস্থা বর্ণনাকারীরূপে। (৪২) সেদিন কামনা করবে সে সমস্ত লোক, যারা কাফের হয়েছিল এবং রসূলের নাফরমানী করেছিল, যেন যমীনের সাথে মিশে যায়। কিন্তু গোপন করতে পারবে না আল্লাহর নিকট কোন বিষয়।
তখন ইবন উমর রা. কাঁদতে শুরু করলেন। এ পরিমাণ কাঁদলেন যে চোখের পানিতে তাঁর দাড়ি ভিজে গেল।
আরেক দিনের ঘটনা। বন্ধু-বান্ধবদের সাথে বসে কুরআন তেলাওয়াত শুরু করলেন।
وَیْلٌ لِّلْمُطَفِّفِیْنَۙ۝۱ الَّذِیْنَ اِذَا اكْتَالُوْا عَلَی النَّاسِ یَسْتَوْفُوْنَؗۖ۝۲ وَ اِذَا كَالُوْهُمْ اَوْ وَّ زَنُوْهُمْ یُخْسِرُوْنَؕ۝۳ اَلَا یَظُنُّ اُولٰٓىِٕكَ اَنَّهُمْ مَّبْعُوْثُوْنَۙ۝۴ لِیَوْمٍ عَظِیْمٍۙ۝۵ یَّوْمَ یَقُوْمُ النَّاسُ لِرَبِّ الْعٰلَمِیْنَؕ۝۶
অর্থ : যারা মাপে কম করে, তাদের জন্যে দুর্ভোগ, (২) যারা লোকের কাছ থেকে যখন মেপে নেয়, তখন পূর্ণ মাত্রায় নেয় (৩) এবং যখন লোকদেরকে মেপে দেয় কিংবা ওজন করে দেয়, তখন কম করে দেয়।
(৪) তারা কি চিন্তা করে না যে, তারা পুনরুত্থিত হবে। (৫) সেই মহাদিবসে, (৬) যেদিন মানুষ দাঁড়াবে বিশ্ব পালনকর্তার সামনে।
এ আয়াতে এসে বারবার সেটিকে পড়তে লাগলেন। আার দু’চোখ বেয়ে অঝোর ধারায় অশ্রু প্রবাহিত হতে লাগল। এ পরিমান কাঁদলেন যে একপর্যায়ে যমীনে পড়ে গেলেন।
তাঁর বদান্যতা, খোদাভীতি ও দুনিয়াবিমুখতা একই সাথে এক মহান বিষয়ে কাজ করে চলছে। যাতে এই মহান মানুষটির চমৎকার মর্যাদার একটি আসন তৈরি করতে পারে।
তিনি অঢেল দান করেন, যেহেতু তিনি বদান্য।
কেবল হালাল ও উত্তম জিনিসই দান করেন, যেহেতু তিনি আল্লাহভীরু।
এ দানশীলতা তাকে দরিদ্র বানিয়ে দিতে পারে, এ বিষয়ে তার মোটেও পরওয়া নেয়। কারণ তিনি যে দুনিয়াবিমুখ।
আবদুল্লাহ বিন উমর রা. বেশ ভাল আয়ের লোক ছিলেন। কারণ তিনি তাঁর জীবনের দীর্ঘ একটি অংশ সফল ও বিশ^স্ত ব্যবসায়ী ছিলেন। বায়তুল মাল থেকে তাঁর ভাতাও ছিল প্রচুর। কিন্তু বায়তুল মাল থেকে প্রাপ্ত এ সম্পদ তিনি কখনই নিজের জন্য জমা করে রাখেন নি। তিনি স্বাচ্ছন্দে এ মাল ফকির, মিসকীন ও ভিক্ষুকদেরকে দান করে দিতেন।
আয়্যুব বিন ওয়ায়েল রাসেবি ইবনে উমরের এই বদান্যতার একটি চিত্র তুলে ধরছেন। তিনি বলেন, একবার ইবনে উমরের কাছে চার হাজার দিরহাম ও কিছু মখমলের কাপড় হাদিয়া আসল।
পরদিন আয়্যুব বিন ওয়ায়েল ইবনে উমরকে দেখলেন বাজার থেকে নিজের ঘোড়ার জন্য বাকিতে ঘাস কিনছেন।
তখন ইবন ওয়ায়েল তাঁর বাড়ীতে তাঁর পরিবারবর্গের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, গতকাল কি ইবনে উমরের কাছে চার হাজার দিরহাম ও মখমলের কাপড় হাদিয়া আসেনি?
তারা বলল, হ্যাঁ এসেছে!
ইবন ওয়ায়েল বলল, দেখলাম আজ তিনি বাজার থেকে ঘোড়ার জন্য ঘাস কিনছেন, অথচ তাঁর কাছে এ ঘাস কেনার পয়সাও নেই।
তখন পরিবারের লোকজন বলল, গতরাত তিনি ঘুমাননি। যতক্ষণ না সবগুলো দিরহাম বিতরণ করে শেষ করেছেন। এরপর কাপড়ের বোঝাটি কাঁধে নিয়ে বেরিয়ে পড়েছেন। গৃহে যখন ফিরে এসেছেন, তখন তাঁর কাছে কিছুই ছিলনা। আমরা তাকে জিজ্ঞেস করলাম। বললেন, কাপড় ও দিরহাম ফকিরদেরকে দিয়ে দিয়েছেন।
এরপর ইবন ওয়ায়েল হাতের উপর হাত মারতে বেরিয়ে গেল। সোজা বাজারে গিয়ে একটি উঁচু জায়গায় দাাঁড়লো। এরপর চিৎকার করে বলতে লাগল, হে ব্যবসায়ী সকল! কী করবে তোমরা এ দুনিয়া দিয়ে? এই যে দেখ ইবন উমরের কাছে চার হাজার দিরহাম হাদিয়া এসেছে, এর সব তিনি দান করে দিয়ে আজ তিনি বাকীতে ঘাস কিনছেন।
শোন! মুহাম্মদ সা. যার উস্তাজ, উমর রা. যার পিতা তিনি তো এমন মহান হবেন, এটাই তো স্বভাবিক। এমন মহত্ব ও মহানুভবতা তো তাদেরকেই শোভা পায়।
আবদুল্লাহ বিন উমরের বদান্যতা, দুনিয়াবিমুখতা ও আল্লাহভীতি এ তিনটি বৈশিষ্ট তাঁর কাছে সত্যিকার আদর্শের ও সত্যিকার সন্তানের রূপরেখাকে তুলে ধরে।
যিনি রাসূলুল্লাহ সা. এর আদর্শের অনুসরণ করতে চান তার জন্য এটা তেমন কিছু নয়। আরে তিনি তো এতটুকু পর্যন্ত করেছেন যে, একদিন নিজের উটনী নিয়ে ঠিক ওই স্থানটিতে দাঁড়ালেন, যেখানে একদিন নবীজি সা. কে উটনী নিয়ে দঁড়াতে দেখেছেন। বলছেন, আশা করছি আমার উটনির পা নবীজির উটনীর পায়ের খাপে খাপে হয়ত পড়ে যেতে পারে।
সন্তান সন্ততি ও আত্মীয়-স্বজন তো দূরের বিষয়, বরং একজন শত্রুর কাছে হযরত উমর রা. এর ব্যক্তিত্ব যে পরিমান আনুগত্য ও সম্মান দাবী করে তার চেয়ে অধিক সম্মান ও ভক্তি তিনি নিজ পিতার প্রতি প্রদর্শন করেছেন।
আমি বলি, যিনি নিজেকে এই মহান নবীর অদর্শের ঝা-াবাহীরূপে পরিচয় দেন, যিনি নিজেকে মহান উমরের সন্তান বলে প্রকাশ করেন, তাঁর জন্য সম্পদের গোলাম হওয়া বেমানান। তিনি সম্পদের পেছনে পড়বেন এটা শোভা পায় না।
¯্রােতের মত তার কাছে সম্পদ এসেছে কিন্ত সাথে সাথে তা আবার তাকে ছেড়ে অতিক্রম করে গেছে। তাঁর গৃহ থেকে দ্রুত পার হয়েছে।
তার এই দানশীলতা লোকদেখানোর জন্য ছিল না। তাঁর এই দানশীলতা মানুষের প্রশংসা কুড়ানোর জন্যও ছিল না।
আর এ কারণেই তিনি তাঁর সম্পদে অভাবী ও দরিদ্র লোকদেরকে বিশেষভাবে দান করতেন। একাকী খাবার খেয়েছেন এমন ঘটনা তার জীবনে খুঁজে পাওয়া ভার। যখনই খাবার খেতে বসেছেন কোন ইয়াতীম বা দরিদ্র ব্যক্তিকে সাথে নিয়ে বসেছেন। অনেক সময় নিজ সন্তানদেরকে কেবল এ জন্য ভর্ৎসনা করেছেন যখন দেখেছেন তারা সমাজের স্বচ্ছলশ্রেনীর জন্য কোন খাবারের আয়োজন করেছেন। আর তাতে গরীবদেরকে দাওয়াত করেন নি। তিনি তাদেরকে বলতেন, “তোমরা তৃপ্তদেরকে দাওয়াত করছ, আর ক্ষুধার্তদেরকে বাদ দিচ্ছ।
আর দরিদ্র ব্যক্তিরা তার বদান্যতার পরিচয় পেয়ে গিয়েছিল। তারা তাঁর অনুগ্রহ ও ¯েœহের স্বাদ পেয়ে গিয়েছিল। তাই তারা তাঁর যাওয়ার পথে বসে থাকত। যাতে তিনি তাদেরকে সাথে করে নিজ আলয়ে নিয়ে যান। মৌমাছি যেমন ফুলের উপর ভীড় জমায়, ফুলের উপর বসে তার মধু শুষে নেয় তেমনি তারাও তাকে ঘিরে জমা হত।
ধন-সম্পদকে তিনি তাঁর সেবাদাস হিসেবেই ব্যবহার করেছেন। এ ধন-সম্পদ কখনও তাঁর উপর প্রভুত্ব ফলাতে পারেনি।
অর্থ-বিত্তকে তিনি নিজের জীবনের প্রয়োজন পূরণের উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করেছেন। তাকে কখনও বিলাসী জীবনের উপকরণ বানান নি।
তাঁর সম্পদে কেবল তাঁর একার ছিল না। তাতে গরিব-মিসকিনদেরও একটি নির্ধারিত হিস্সা ছিল। বরং বলতে পার সমান সমান ভাগ ছিল। কারো ভাগ কারো চেয়ে বিশেষ কোন মর্যাদার ছিল না।
তাঁর অসামান্য যুহদ তাঁকে তার এই বদান্যতার ক্ষেত্রে সহায়তা করেছিল। ফলে তিনি দুনিয়ার উপর ঝাঁপিয়ে পড়েন নি। দুনিয়া কামইয়ের পেছনে ছুটেও বেড়ান নি। বরং তাঁর কাছে এটা আশাও করা যায় না। তাঁর মত ব্যক্তি দুনিয়ার পেছনে ছুটবেন। তাঁর কাছে এটাই আশা করা যায় যে যতটুকু কাপড় হলে পোশাকের প্রয়োজনীয়তা মেটে তা নিয়েই তিনি সন্তুষ্ট থাকবেন। যতটুকু খাবার হলে কোমর সোজা রাখা যায়, ইবাদাতে শক্তি অর্জিত হয়, তাতেই তিনি তুষ্ট থাকবেন।
খোরাসান থেকে আগত এক ব্যক্তি তাঁকে একটি মার্জিত রুচিশীল পোশাক হাদিয়া দিল। তাঁকে বলল, এ কাপড়টি আমি খোরাসান থেকে আপনার জন্যই এনেছি। উদ্দেশ্য হল, আপনি আপনার পুরাতন খসখসে জামাটি খুলে এই সুন্দর নরম জামাটি পরবেন। আর তা দেখে আমার দু’চোখ জুড়াব।
তখন ইবন উমর রা. তাকে বললেন, ঠিক আছে, জামাটা আমাকে দেখাও।
এরপর জামাটি হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ নাড়াচাড়া করে বললেন, এটাকি রেশমের?
লোকটি বলল, না, এটি সুতার।
কিছু সময় তিনি সেটি পরিধান করলেন। এরপর সাথে সাথে সেটি খুলে লোকটিকে দিয়ে দিলেন। বললেন, না, ভাই না, এটি আমি পরতে পারবো না। আমার খুব ভয় হয়। আমার আশংকা হয়, পাছে এটি আমাকে অহংকারী না বানিয়ে দেয়। আর আল্লাহ অহংকারীকে ভালবাসেন না।
একদিন তাঁর এক বন্ধু তাকে একটি সিপি আঁটা পাত্র হাদিয়া দিল।
ইবন উমর জিজ্ঞেস করলেন, এতে কী?
লোকটি বলল, এটি খুবই মুল্যবান একটি ঔষধ। ইরাক থেকে এটি আনিয়েছি।
- তো এই দাওয়াইতে কোন রোগ সারবে?
- এটা হজমের কাজ করবে।
তখন ইবনে উমর রা. মুচকি হাঁসি দিয়ে বললেন, হজমের কাজ করবে!? আরে আমি তো বিগত চল্লিশ বছর যাবৎ কখনও পেট পুরে খাবারই খাইনি।
কী ভাবছেন পাঠক!? ইনি চল্লিশ বছর পেটভরে তৃপ্তিসহকারে খাবার খান নি। দারিদ্রতার কারণে? অভাবে পড়ে? না, অভাবের তাড়ানায় তিনি পুরে খাননি বিষয়টি এমন নয়। এটি তার দুনিয়া বিমুখতার কারণে। তাঁর খোদাভীতির স্মরণে। রাসূলুল্লাহ সা. ও স্বীয় পিতার পদাঙ্ক অনুসরণে।
তিনি আশংকা করতেন, কেয়ামতের দিন যদি বলা হয়,
اَذْهَبْتُمْ طَیِّبٰتِكُمْ فِیْ حَیَاتِكُمُ الدُّنْیَا وَ اسْتَمْتَعْتُمْ بِهَا ۚ
অর্থ : তোমরা তোমাদের সুখ পার্থিব জীবনেই নিঃশেষ করেছ এবং সেগুলো ভোগ করেছ।
তবে কি উপায় হবে সেদিন? তিনি নিজেকে এই পার্থিব জগতে একজন মেহমানের চেয়ে বেশি কিছু মনে করতেন না। একজন মুসাফিরের চেয়ে বেশি কিছু ভাবতেন না।
তাঁর এই মুসাফির জিন্দেগীর বিবরণ দিতে গিয়ে বলেন, নবীজি সা. এর তিরোধানের পর কোনদিন ইটের উপর ইট গাথিনি। কোন গাছ লাগাইনি।
মাইমুন বিন মিহরান বলেন, একদিন আমি ইবন উমরের গৃহে প্রবেশ করলাম। গৃহের সমুদয় সামগ্রী, বিছানা, লেপ ও অন্যান্য আসবাবপত্র যা কিছু ছিল সবগুলো একত্র করে একটি হিসেব করলাম, কত হতে পারে এর মূল্য। দেখলাম, সবমিলিয়ে একশ’ দিরহামও হবে না।
আচ্ছা পাঠক! এটাকি অভাবের কারণে? না, তাঁর তো অনেক সম্পদ ছিল।
তবে কি কৃপণতার কারণে? না, তাঁর তো দানের হাত অবারিত ছিল।
এ সব কিছু দুনিয়ার প্রতি তার অনাসক্তির কারণেই হয়েছে। জীবনের বাহূল্য ও বিলাসিতা বর্জনের জন্য হয়েছে। সত্যবাদিতা ও আল্লাহভীতির যে আদর্শের উপর তিনি জীবনের মানদ- নির্ধারণ করেছেন, তার উপর থাকতে গিয়েই হয়েছে।
আবদুল্লাহ বিন উমর রা. বেশ লম্বা হায়াত পেয়েছিলেন। উমাইয়্যা খেলাফতের জৌলুস দেখতে পেয়েছিলেন। যখন সম্পদের পাচুর্য্য এসেছিল। সবত্র বিনাশ ছেয়ে গিয়েছিল। অধিকাংশ অঞ্চলে অপচয়ের বন্যা বইয়ে চলছিল। বরং এটা ভালা যে অধিকাংশ প্রাসাদে অপচয়ের বন্যা বইয়ে চলছিল।
এত কিছুর পরও এই মহান পর্বতটি সুউচ্চ ও সুদৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। নিজের আদর্শ থেকে সামান্য চ্যুত হননি। নিজের যুহদ ও আল্লাহভীতি থেকে এতটুকু সরে আসেন নি।
দুনিয়ার যে পাচুর্য থেকে তিনি পালিয়ে বেড়িয়েছেন, সে সম্পর্কে যদি কখনও তাকে জিজ্ঞেস করা হত, বলতেন, ‘আমি ও আমার সাথিরা একটি বিষয়ে একমত হয়েছিলাম। আমার আশংকা হয়, যদি আমি ওই বিষয়ে তাদের আদর্শের বাইরে চলি, তবে তাদের সাথে আর মিলিত হতে পারব না।
এরপর অন্যদেরকে বলতেন, দেখ, অক্ষমতার দরুণ আমি দুনিয়া বর্জন করিনি। এরপর দু’হাত আকাশের দিকে তুলে ধরে বলতেন, হে আল্লাহ! আপনি জানেন, যদি আমার অন্তরে আপনার ভয় না হত, তবে আমরা আমাদের সম্প্রদায় কুরাইশের উপর সম্পদের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়তাম।
সত্যিই আল্লাহর ভয় যদি না হত, তবে দুনিয়ার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়তেন। সম্পদের জন্য লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়তেন। এবং সম্পদ ছিনিয়েও আনতেন।
বরং তার তো সম্পদের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ারও দরকার ছিলনা। বরং পার্থিব এ সম্পদ তাঁর কাছে ছুটে আসত, আর তিনি তা দু’হাতে ঠেলে দিতেন। এর লোভনীয়
আচ্ছা, ক্ষমতার আসনের চেয়ে অধিক বিভ্রান্তকারী আর কোন পদমর্যাদা কি আছে?
বহুবার তাঁকে শাষণভার গ্রহণের জন্য বলা হয়েছে, প্রতিবার তিনি এড়িয়ে গেছেন। এমনকি তাকে এ হুমকিও দেয়া হয়েছে যে, আপনি যদি এ দায়িত্ব গ্রহণ না করেন, তবে আপনাকে হত্যা করা হবে। এ হুমকিতেও কোন কাজে আসেনি। আগের চেয়ে আরো জোরালো ভাবে তিনি তা প্রত্যাক্ষাণ করেছেন।
হযরত হাসান রা. বলেন, উসমান রা. যখন শহীদ হলেন, তখন লোকেরা আবদুল্লাহ বিন উমর রা. এর কাছে এল। তাঁকে বলল, আপনিই জনগনের সরদার। জনগনের নেতার ছেলে। সুতরাং আসুন আমরা আপনার পক্ষে জনগনের বাইয়াত গ্রহণ করি।
তিনি বললেন, আল্লাহর শপথ! এ আমার দ্বারা হবে না। যদি পার চেষ্টা করে দেখ, আমার জন্য যেন জনগনের একফোটা রক্তও না ঝরে।
লোকেরা বলল, হয়ত আপনি বাইয়াতের জন্য বের হবেন, নতুবা আমরা আপনাকে আপনার বিছানার ওপর হত্যা করব।
তিনি তাদেরকে একই কথা বললেন।
তারা তাকে লোভ দেখাল। ভয় দেখাল। কোন কিছুতেই কিছু হল না। তিনি তার সিদ্ধান্তের উপর অনড় রইলেন।
এরপর সময় গড়িয়ে চলল আপন গতিতে। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে ফিতনাও ছড়াতে লাগল।
আবদুল্লাহ বিন উমর রা. সবসময় মানুষের আশার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে অবস্থান করলেন। লোকেরা তাকে বারবার পিড়াপীড়ি করতে থাকল। যাতে তিনি খেলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তারা যেন তাঁর হাতে বাইয়াত গ্রহণ করার জন্য সমবেত হয়। কিন্তু তিনি বরাবরের মত অসম্মতি জানিয়ে গেলেন।
এই অস্বীকার ইবন উমরের জন্য একটি আদর্শিক স্থান তৈরি করে দিল। তবে এর পক্ষে যথাযথ যুক্তি রয়েছে। যৌক্তিক কারণ রয়েছে।
উসমান রা. এর শাহাদাতের পর পরিস্থিতির অবনতি হতে থাকল। অবস্থা এমন হল যে সব বিষয়ে মন্দ ও অনিষ্টের আশংকা হতে থাকল।
ইবন উমর রা. যদিও ক্ষমতার প্রতি অনাগ্রহী ছিলেন, তবুও তিনি খেলাফতের দায়িত্বভার গ্রহণ করতেন, এর জিম্মাদারি নিজ কাঁধে তুলে নিতেন যদি সকল মুসলমান ঐক্যমতের ভিত্তিতে তাঁকে খলীফা হিসেবে নিযুক্ত করত। তিনি এ শর্তে খেলাফতের দায়িত্ব নিতে রাজি হতেন যে সকল মুসলমান স্বেচ্ছায় অনুগত হয়ে তাঁর হাতে বাইয়াত গ্রহণ করবে। কাউকেই তরবারি দেখিয়ে বাইয়াতের জন্য বাধ্য করা হবে না। তিনি কেবল এটাকেই অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। আর এর সাথে সাথে খেলাফতের দায়িত্বভার গ্রহণ করতেও অস্বীকৃতি জানিয়েছেন।
সে সময় এটা সম্ভব ছিল না। তাঁর সকল মর্যাদা সত্ত্বেও, তাঁর সম্মান ও ইয্যতের প্রতি সকল মুসলমানের ভালাবাসা সত্ত্বেও এ ঐক্যমত সম্ভব ছিল না। কারণ, ইসলামী খেলাফতের পরিধি বিস্তৃত হয়েছে। বহু শহর-নগর মুসলিম খেলাফতের অধিনে এসেছে। মুসলমানদের মাঝে বিরোধের যে আগুণ প্রজ্জলিত হয়ে উঠেছে, যা তাদেরকে বিভিন্ন দলে-উপদলে বিভক্ত করে দিয়েছে, তা তাদেরকে অবশ্যম্ভাবী এক যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এক জনের বিরূদ্ধে অপরজনকে তরবারি ধারণের দিকে আহবান করছে। ফলে পরিবেশ এ ঐক্যমতের জন্য কোনভাবে উপযুক্ত ছিল না। ইবনে উমর যে শর্তারোপ করেছেন তা বাস্তবায়নের তখন কোন পথ খোলা ছিল না।
একদিন এক লোক তাঁকে দেখে বলল, ‘উম্মতের মুহাম্মদির মধ্যে আপনার চেয়ে নিকৃষ্ট কোন লোক নেই”।
ইবন উমর রা. বললেন, কেন? আমি তো তাদের রক্ত ঝরাইনি। তাদের ঐক্য বিনষ্ট করিনি। তাদের লাঠিও ভেঙ্গে দেয়নি।
লোকটি বলল, আপনি যদি চাইতেন তবে কেউ আপনার বিরোধিতা করত না।
তিনি বললেন, আমি এটা চাইনি যে, এমন অবস্থায় আমার কাছে খেলাফতের দায়িত্বভার ন্যাস্ত করা হবে যখন কেউ ‘না’ বলবে, আবর কেউ ‘হ্যাঁ’ বলবে।
ঘটনা পরিক্রমা এগিয়ে চলল। কিন্তু তাঁর প্রতি জনগনের ভালাবাসা অক্ষুন্ন রইল। অবশেষে খেলাফতের এ দায়িত্বভার আমিরে মুয়াবিয়া রা. এর কাছে আসল। তারপর তার পুত্র ইয়াযিদ। এরপর ইয়াযিদের পুত্র দ্বিতীয় মুয়াবিয়া খেলাফতের আসনে সমাসীন হওয়ার কিছু দিন পর এর প্রতি অনাগ্রহী হয়ে ওঠে। এবং খেলাফতের দায়িত্ব ছেড়ে দেয়।
এ সময়গুলোতেও ইবন উমর রা. ছিলেন জনগনের আশা-ভরসার স্থল। যদিও তিনি বয়সের ভারে নূজ্য। লোকেরা তখনও আশা করত তিনি খেলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করবেন।
একদিন মারওয়ান তাঁর স্বকাশে উপস্থিত হয়ে বলল, আপনার হাতটি বের করে দিন। আমরা আপনার হাতে বাইয়াত গ্রহণ করি। আপনি আরব-নেতা। আরব নেতার ছেলে।
তখন ইবন উমর রা. তাকে বললেন, পারস্যবাসীকে নিয়ে করব?
তখন মারওয়ান বলল, তাদের বিরূদ্ধে তরবারি উঠাবো এবং বাইয়াতের জন্য বাধ্য করব।
তখন ইবন উমর রা. বললেন, আল্লাহর কসম করে বলছি, সত্তর বছর রাজত্ব করার সুযোগ পেলেও, আমার কারণে কোন মানুষ নিহত হবে এটা আমি কস্মিনকালেও চাই না।
তখন মারওয়ান সেখান থেকে নি¤েœর কবিতাটি আওড়াতে আওড়াতে উঠে গেল।
اني أرى فتنة تغلي مراجلها والملك بعد أبي ليلى لمن غلبا
আমি দেখছি একটি ফিতনা ফেটে পড়ার জন্য টগবগ করছে। আবু লাইলার পর রাজত্ব, যে জিতবে তার হাতেই থাকবে।
আবু লাইলা দ্বারা উদ্দেশ্য হল, ইয়াযিদ তনয় মুআবিয়া।
শক্তি ও তরবারি ব্যবহার করাকে এই যে প্রত্যাক্ষাণ করছেন, এটাই তাকে হযরত আলির সমর্থক ও মুয়াবিয়ার সমর্থকদের মাঝে যে সশস্ত্র বিদ্রোহ হল, তাতে তিনি নিরপেক্ষ অবস্থানে এনে দাঁড় করাল।
এক মুসলমান আরেক মুসলমানের বিরূদ্ধে অস্ত্র ধারণ করবে, শক্তি খাটাবে, তরবারি চালাবে এটাকে তিনি অপসন্দ করতেন। আর এই অপসন্দের কারণে তিনি হযরত আলি রা. এর সমর্থক ও মুয়াবিয়া রা. এর সমর্থকদের মাঝে যে সশস্ত্র বিদ্রোহের দাবানল জ¦লে উঠেছিল,তাতে তিনি নিরপেক্ষ অবস্থান গ্রহণ করলেন। সে সময় তাঁর শ্লোগান ও কর্মপদ্ধতি ছিল নি¤েœর কথাগুলো।
যে বলবে, আস, নামাজের দিকে আস। আমি তার আহবানে সাঁড়া দিব।
যে বলবে, আস, সফলতার দিকে আস। আমি তার ডাকে ছুটে আসব।
যে বলবে, আস, তোমার মুসলিম ভাইয়ের রক্ত ঝরাতে আস, তার সম্পদ লুটে নিতে আস, আমি তাকে ‘না’ বলে দিব।
তবে তিনি তাঁর এই নিরপেক্ষ অবস্থানে কোন বাতিলের সহযোগিতা করেন নি।
আমিরে মুয়াবিয়া রা. খেলাফতের দায়িত্ব নেয়ার পর
হাজ্জাজ বিন ইউসুফ একদিন লোকদের মাঝে ভাষণ দিতে গিয়ে বলল, ইবন যুবাইর আল্লাহর কিতাবের বিকৃতি সাধন করেছে।
বাক্যটি শোনামাত্রই ইবন উমর রা. চিৎকার করে তার মুখের উপর বলে উঠলেন, তুমি মিথ্যা বলেছ। তুমি মিথ্যা বলেছ। তুমি মিথ্যা বলেছ।
এতে হাজ্জজ লজ্জিত হয়ে গেল। ঘটনার আকস্মিকতায় হাজ্জাজ দিশেহারা হয়ে গেল। অথচ হাজ্জাজ এমন এক ব্যক্তি যাকে প্রতিটি বস্তু ভয় পায়। তখন হাজ্জাজ ইবন উমরকে দেখে নেয়ার ধমক দেয়।
সাথে ইবন উমর রা. তার বাহু দ্বারা হাজ্জাজের মুখের দিকে ইশারা করে বললেন, আরে তুমি যে ধমক দিচ্ছ, তা যদি বাস্তবায়নও কর, তাতে আমি আশ্চর্য হবনা। কারণ তোমার তরবারি তো সবসময় উত্তোলিতই থাকে।
কিন্তু তিনি তাঁর শক্তি ও সাহস সত্ত্বেও জীবনের শেষ পর্যন্ত এটাই চেয়েছেন, যাতে সশস্ত্র কোন বিদ্রোহে তার কোন অংশ না থাকে। কোন দলই একথা বলতে না পারে ইবন উমর আমাদের সাথে ছিলেন।
আবুল আলিয়া আল বারা বলেন, একদিন আমি ইবন উমরের পেছনে পেছনে হাঁটছিলাম। আমার উপস্থিটি তিনি বুঝতে পারেন নি। আমি তাকে বলতে শোনলাম, তিনি নিজে নিজে বলছেন, তারা তাদের কাঁধে তরবারি নিয়ে একে অপরকে হত্যায় মেতে উঠছে। আর আমাকে বলছে, হে আবদুল্লাহ বিন উমর, আস, আমাদের সাথে হাত মেলাও!?
মুসলমানদের হাতে মুসলমানদের রক্ত প্রবাহিত দেখে তিনি দুঃখ বেদনায় জর্জরিত হতেন।
যেমনটি আমরা আলোচনার শুরুতে বলে এসেছি, যে তিনি কোন ঘুমন্ত মুমিনকে তার নিদ্রা থেকে জাগ্রত করেন নি।
তিনি যদি পারতেন রক্তের এই হোলি খেলা বন্ধ করে দিতে, যদি পারতেন মুসলিম নিধনের এই হত্যাযজ্ঞ থামিয়ে দিতে, তবে তিনি তাই করতেন। কিন্তু পরিস্থিতি এর চেয়ে ভয়াবহ ছিল। সার্বিক পরিস্থিতি তার আওতার বাইরে ছিল। তাই তিনি একাকীত্ব গ্রহণ করেছেন।
আন্তরিকভাবে তিনি হযরত আলি রা. এর পক্ষপাতী ছিলেন। বরং তার মতে হযরত আলী রা. সঠিক অবস্থানে ছিলেন। এটা কেবল তার ধারণাই নয়, বরং তার অন্তরের দৃঢ় বিশ^াসও বটে। তার থেকে এমনও বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি তার জিন্দেগীর শেষ দিকে এসে একদিন আফসোস করে বললেন, “পার্থিব জীবনে যদি আমি কোন কিছু হারিয়ে ফেলেছি, এর জন্য আমার তেমন কোন কষ্ট হয়নি। তবে আমি হযরত আলী রা. এর পক্ষে বিদ্রোহী দলের বিরূদ্ধে অস্ত্র ধারণ করিনি, এজন্য আমার খুব কষ্ট হয়।
বিষয়টি হল, তিনি হযরত আলী রা. এর সাথে লড়াই করতে অসম্মতি জানালেন। যদিও আলী রা. এর অবস্থান সঠিক ছিল।
তবে আবদুল্লাহ বিন উমর রা. এই যে হযরত আলীর সাথে তরবারি ওঠাতে অসম্মতি জানালেন, তা কিন্তু যুদ্ধ থেকে পালিযে বাঁচার জন্য নয়। নয় নিরাপদ অবস্থানে থেকে জান বাঁচানোর জন্য। বরং এ অসম্মতি জ্ঞাপন ছিল সবধরণের বিরোধ থেকে বেঁচে থাকার জন্য। সব ধরণের ফিতনা থেকে নিরাপদ থাকার জন্য। এমন একটি লড়াই থেকে নিজেকে দূরে রাখার জন্য যে লড়াইটি মুসলিম-মুশরিকদের মাঝে না হয়ে বরং দুই দল মুসলমানের মাঝে সংঘটিত হয়েছে। যেখানে একদল মুসলমান আরেক দল মুসলমানকে প্রতিহত করার জন্য লড়াইয়ে লিপ্ত হয়েছে।
তিনি তার এ অবস্থানটিকে পরিস্কার ভাষায় ব্যক্ত করেছেন। হযরত না’ফে রহ. তাকে জিজ্ঞেস করলেন, বললেন, হে আবু আবদুর রহমান, তুমি উমরে পুত্র, তুমি তো আল্লাহর রাসূলের সাহাবি। তোমার তো এ এ বৈশিষ্ট রয়েছে। তোমার তো এ এ গুণ রয়েছে। তবে কেন তুমি হযরত আলীর পক্ষ্যে লড়াই করা থেকে নিবৃত রয়েছ?
তখন তিনি উত্তর দিলেন, আমি কেবল এ কারণে নিবৃত রয়েছি যে, আল্লাহ আমার উপর কোন মুসলমানের রক্ত প্রবাহিত করাকে হারাম করে দিয়েছেন। আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন,
وَ قٰتِلُوْهُمْ حَتّٰی لَا تَكُوْنَ فِتْنَةٌ وَّ یَكُوْنَ الدِّیْنُ لِلّٰهِ ؕ
অর্থ : আর তোমরা তাদের সাথে লড়াই কর, যে পর্যন্ত না ফেতনার অবসান হয় এবং আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠিত হয়।
আমরা তা করেছি। আমরা মুশরিকদের সাথে লড়াই করেছি। অবশেষে আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু আজ! কোন বিষয়ে লড়াই করব?
আমি তো এমন অবস্থায় লড়াই করেছি, যখন পুরো হারাম মূর্তি দ্বারা ভরপুর ছিল। রুকন ইয়ামানী থেকে দরজা পর্যন্ত। অবশেষে সমগ্র আরব থেকেই এই মূর্তিকে বের করে দিয়েছেন।
তবে কি আজ তাহলে মুসলমানদের বিরূদ্ধে লড়াই করব? যারা লা ইলাহা ইল্লাহর স্বীকৃতি দেয় তাদের বিরূদ্ধে তরবারি ওঠাব?
এভাবেই তিনি তার যুক্তি তুলে ধরলেন। তার অবস্থানকে স্পষ্ট করলেন।
সুতরাং তিনি কোন লড়াই থেকে পালিয়েও যান নি, তেমনি কোন লড়াইয়ে অংশও নেন নি। মুসলমানদের এই ক্রান্তিকালে তার নিরপেক্ষ অবস্থান যুদ্ধ থেকে পলায়নের উদ্দেশ্যেও নয়। বরং তা ছিল মুসলিম উম্মাহর মাঝে গৃহ যুদ্ধের স্বীকৃতি প্রদাণকে অসম্মতি জানানোর জন্য। একজন মুসলমান আরেক মুসলমানের বিরূদ্ধে তরবারি ওঠানো থেকে রক্ষা করার জন্য।
আবদুল্লাহ বিন উমর রা. দীর্ঘ একটি হায়াত লাভ করেছিলেন। ওই সময়টাও তিনি দেখেছেন যে সময়টাতে মুসলমানদের সামনে পৃথিবীর দিগ-দিগন্তের দ্বার উম্মোচিত হয়েছে। সম্পদের প্রাচুর্যতা এসেছে। রাষ্ট্রীয় পদ ও পদবী সৃষ্টি হয়েছে। পার্থিব লোভ-লালসার প্রসার ঘটেছে।
কিন্তু তাঁর অসম্ভব আত্মিক শক্তি দিয়ে সময়ের গতিধারাকেই পাল্টে দিয়েছেন। লোভ-লালসার এ সময়কে, সম্পদ ও ক্ষমতার, ফিতনা ও দন্দ্বের এ ক্রান্তিকালকে নিজের জন্য যুহদ, খোদাভীতি, নিরাপত্তার সময়ে রূপান্তর করেছেন। আল্লাহর দিকে প্রর্ত্যাবতনকারী হিসেবেই তিনি তার সময় অতিবাহিত করেছেন। নিজের সম্পূর্ণ বিশ^াস, সকল ইবাদাতে নিজ আদর্শের উপর অবিচল থেকেছেন। জীবনের শুভ সূচনায় ইসলাম যেভাবে তাকে ঘসে-মেঝে পরিস্কার করেছে, তার জীবনের চলার পথ নির্ধারণ করে দিয়েছে, তার স্বভাব-বৈশিষ্টকে যে আদলে সাজিয়ে তুলেছে, তার থেকে সামান্য পরিমানও সরে আসেন নি।
উমাইয়্যা শাষনের সূচনা থেকেই মানুষের জীবন ও স্বভাবের মধ্যে ব্যাপক পরিবর্তন আসতে থাকে। এবং এ পরিবর্তন থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকারও কোন সুযোগ ছিল। এর সয়লাব সকলক গ্রাস করে নেয়। চতুর্দিক থেকে প্রাচুর্যতার ঢেউ আসতে থাকে। সম্প্রসারিত হতে থাকে মুসলিম শাষনের সীমানা। রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে যেমন এই সম্প্রসারণ ও পাচুর্যতার কামনা করা হত, তেমনি জনগনের মধ্যেও ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক পর্যায়ে এর তীব্র আকাঙ্খা বিদ্যমান ছিল।
বিভ্রান্তির আকাশসময় ঢেউগুলো যখন প্রমত্ত দাপটে নাচানাচি করছিল, মুসলিম সালতানাতের সীমানা সম্প্রসারণ, মালে গণিমতের পাচুর্যতা ও জীবনের বিলাস ব্যাসনের আধিক্যের মধ্য দিয়ে যে সময়টা ফিতনা-ফাসাদের প্রমোত্ত উত্তেজনায় টগবগ করছিল, এমন কঠিন সময়েও আবদুল্লাহ বিন উমর রা. ছিলেন নিজের আদর্শের উপর স্থির-অবিচল। নিজেকে রেখেছিলেন এ ঢেউ থেকে যোজন যোজন দূরে। মহান প্রভুর সাথে আত্মার বন্ধনকে আরো মজবুত করার ধারাবাহিক অধ্যবসায় লিপ্ত থেকে। তার এই পবিত্র জীবনে তিনি যা কিছু চেয়েছেন এর সবই তিনি লাভ করেছেন। যাঁরা তাকে দেখেছেন, তার সাথে জীবনের সময়গুলো অতিবাহিত করেছেন, কাছে থেকে কিংবা দূরে থেকে তাঁর জীবনের রহস্য জানতে পেরেছেন, তারা বলেছেন, “হযরত উমর যে সম্মান ও মর্যাদার আসনে অধিষ্টিত হয়ে এই পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন একই সম্মান ও মর্যাদায় ইবন উমরও অধিষ্টিত হয়েছেন। আর এভাবেই দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন।
বরং তারা যখন তাঁর প্রশংসা করতেন তখন তারা পিতা ও পুত্রের মাঝে তুলনা করতেন। উমর ও ইবন উমরের মাঝে তুলনা করতেন। তখন তারা বলতেন, উমর তো এমন একটা সময় পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন যখন তার মত আরো বহু মানুষ পৃথিবীতে ছিল। কিন্তু ইবন উমর এমন একটা সময়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন যখন তার মত আর কেউ পৃথিবীতে ছিল না।
পাঠক হয়ত এটাকে বাড়াবাড়ি মনে করতে পারেন। তবে আমি নিশ্চিত ইবন উমরের মাকাম ও মর্যাদা এই বাড়াবাড়ি হক আদায় করে দিবে। তবে হযরত উমরের সাথে কারো তুলনা চলে না। আহ্ প্রতি যুগে যদি এক একজন উমর ও ইবন উমর জন্ম নিত!

হিজরি তিহাত্তর সাল। রবিকর দিন শেষে অস্তাচলে ঢলে পড়েছে। অনন্ত জীবনের মহা সফরের জাহাজ তার নোঙ্গর তুলে দিল। আখেরাতের পথে, মহান প্রভুর প্রেমময় সান্নিধ্যের উদ্দেশ্য মহা সমুদ্রে যাত্রা শুরু করল। এ জাহাজ বয়ে চলছে এমন একটি শবদেহ যা ছিল মক্কা ও মদীনার সেই ওহির নূরানী দিনগুলোর বাস্তব নমুনা। আবদুল্লাহ বিন উমর বিন খাত্তাব।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.