![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আবু সাঈদ মুহাম্মদ নু‘মান
অবতরণিকা :
কুরআনুল কারীম হল সকল ইসলামী জ্ঞানের প্রধান উৎস। ইসলামী এ সকল জ্ঞানের অন্তর্গত একটি বিষয় হল ইলমুল ফিকহ। স্বাভাবিক ভাবেই জ্ঞানের এ শাখাটি তার বিধি-বিধান প্রমাণের জন্য উৎসের প্রয়োজন। আর কুরআনুল কারীম হল তার প্রধান উৎস। তবে কুরআনুল কারীমের সবগুলো আয়াত কিন্তু বিধান প্রমাণ করে না। বরং কিছু আয়াত এ সকল বিধান প্রমাণ করে। এ আয়াতগুলোকেই আয়াতুল আহকাম হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
আহকামের আয়াত বলতে ওই সকল আয়াতকে বোঝায় যে সকল আয়াতে শরীয়তের কোন বিধান প্রমাণিত হয়। চাই বিধানটি এ’তেকাদী (বিশ্বাসগত) হোক কিংবা আমলী অথবা আচরণগত ও চারিত্রিক। তবে উলামায়ে কেরাম আহকামুল কুরআন বলতে ওই সকল আয়াতকে বুঝিয়েছেন যে সকল আয়াতে মানব জীবনের কর্মগত বিধি-বিধান বর্ণিত হয়েছে। যা ফিকহী মাসআলা হিসেবে প্রসিদ্ধ। সুতরাং সাধারণভাবে আহকামের আয়াত বলতে ওই সকল আয়াতকে বোঝাবে যাতে ফিকহি মাসআলা বর্ণিত হয়েছে। আয়াতটি হয়ত সরাসরি ওই মাসআলা স্পষ্টভাবে বর্ণনা করবে কিংবা ওই আয়াত থেকে ইজতিহাদের ভিত্তিতে বিধানটি আহরণ করা হবে।
তাফসীরু আয়াতিল আহকাম :
এটিকে আত তাফসীরুল ফিকহীও বলা হয়। অর্থাৎ কুরআনুল কারীমের যে আয়াতগুলোর তাফসীরে ফিকহি মাসআলা পেশ করা হয় এবং এ বিষয়ে দিক নির্দেশনা প্রদাণ করা হয়।
আহকামের আয়াত সংখ্যা :
তবে কুরআনুল কারীমে এ জাতীয় বিধান সম্বলিত আয়াত কতটি? এ বিষয়ে উলামায়ে কেরামের বিভিন্ন মত পাওয়া যায়।
প্রথম মত : ৫০০টি। মুকাতিল বিন সুলাইমান, ইমাম গাজ্জালী. ফখরুদ্দিন রাযি, ইবনে কুদামাহ আল মাকদাসী রহ. প্রমুখ আলেম এ অভিমত পেশ করেন।
ইবনুল জাওযী রহ. বলেন, আয়াতুল আহকাম বলতে ওই সকল আয়াতকে বোঝায় যে সকল আয়াতে আদেশ ও নিষেধ এবং ফিকহি বিষয় বর্ণিত হয়েছে। কোন কোন আলেম বলেন, এর সংখ্যা হল ৫০০টি আয়াত।
দ্বিতীয় মত : ১৫০টি আয়াত।
তৃতীয় অভিমত : ২০০টি আয়াত। এটি আবুত তায়্যিব আল কানুজীর অভিমত। তাকে বলা হল, বিধান সম্বলিত আয়াত হল ৫০০টি, তখন তিনি বললেন, এটি সঠিক নয়, বরং বিধান সম্বলিত আয়াত ২০০ বা এর কাছাকাছি।
চতুর্থ মত : এর সংখ্যা নির্ধারিত নয়। বরং ফকীহ ও মুজতাহিদের ভিন্নতার সাথে এর সংখ্যার ভিন্নতা রয়েছে। এটি ইবনু দাকীকুল ঈদ রহ. এর অভিমত। আল্লামাহ ঝারকাশী, ক্বরাফী, সনআনী, শাওকানী প্রমুখ আলেম তার থেকে বর্ণনা করেন।
আল্লামা ক্বরাফী রহ. বলেন, বিধান সম্বলিত আয়তের সংখ্যা ৫শ’ এর মধ্যে সীমাবদ্ধ করার বিষয়টি ইমাম ফখরুদ্দিনসহ কিছু আলেমের অভিমত। অন্যরা এর মধ্যে সীমাবদ্ধ করেন নি। আর এটাই সঠিক। .............প্রতিটি আয়াত যাতে কোন শাস্তি বা নিন্দা বর্ণিত হয়েছে, ওই আয়াতটি ওই কর্মটি হারাম হওয়ার দলীল। অথবা যে সকল আয়াতে কোন কাজের জন্য প্রশংসা কিংবা প্রতিদানের প্রতিশ্রুতি বিধৃত হয়েছে, ওই আয়াতটি সে কাজ বৈধ হওয়ার দলীল। হোক সেটি আদায় করা ওয়াজিব কিংবা সুন্নাত। অনুরূপভাবে আল্লাহ তায়ালা গুনাবলী উল্লেখ করা, তার প্রশংসা উল্লেখ করা দ্বারা উদ্দেশ্য হল আল্লাহ তায়ালা যে সকল বিষয়ের সম্মান প্রদর্শন করেছেন সেগুলোর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা। এতে দেখা যাবে এমন কোন আয়াত পাওয়া যাবে না, যাতে কোন বিধান বর্ণিত হয়নি। ফলে ৫শ আয়াতের মধ্যে সীমাবদ্ধ করা কিভাবে সঠিক হতে পারে?
আল্লামা সানআনী রহ. বলেন, তারা বিধান সম্বলিত আয়াতকে ৫শ’র মধ্যে সীমাবদ্ধ করেছে। কিন্তু এ বিষয়ে কোন দলীল নেই। বরং কুরআনের প্রতিটি আয়াতই কোন না কোন বিধান প্রমান করে।
এ সংখ্যার মধ্যে আয়াতে আহকামকে সীমাবদ্ধ করা এটা কেবল বাহ্যিকতার বিচারে হতে পারে। প্রকৃতপক্ষে কুরআনুল কারীমে বিধান আহরণ করা যেতে পারে এমন আয়াতের সংখ্যা এরচেয়ে অনেকগুণ বেশী। বরং যিনি সঠিক বুঝ ও পূর্ণ চিন্তাশক্তির অধিকারী তিনি তো কেবল উদাহরণ ও ঘটনা বর্ণনার জন্য যে আয়াতগুলো রয়েছে সেখান থেকেও বিধান আহরণ করতে সক্ষম।
মতানৈক্যের ভিত্তি :
০১. কুরআনুল কারীমে বিধান সম্বলিত আয়াত কতটি? এ বিষয়ে রাসূলুল্লাহ সা. ও সাহাবায়ে কেরাম থেকে সুস্পষ্ট কোন নির্দেশনা থাকা। ফলে এটিকে একটি ইজতিহাদি বিষয় হিসেবে গণ্য করা হয়।
০২. মুকাতিল বিন সুলাইমান এ বিষয়ে স্বতন্ত্র গ্রন্থ রচনা করেন, যাতে তিনি আহকামের আয়াতগুলোকে সন্নিবেশিত করেছেন এবং সেখানে তিনি এর সংখ্যা ৫০০ বলে উল্লেখ করেছেন। ফলে যারা এ মতের পক্ষে নিজেদের অভিমত ব্যক্ত করেছেন তারা মূলত এর উপর ভিত্তি করেই বলেছেন।
০৩. অনেক আয়াত বিধান বর্ণনায় এতটাই স্পষ্ট যে সেখান থেকে বিধান আহরণ করতে গিয়ে কোনরূপ ইজতিহাদের প্রয়োজন হয় না। যেমন সূরা বাকারা, নিসা, মায়িদাহ ও আনআমে রয়েছে। এ জাতীয় স্পষ্ট আয়াতের সংখ্যা ৫শ’ এর কম।
০৪. অনেক বিধান এমন রয়েছে যেগুলো ইজতিহাদের মাধ্যমে আহরণ করতে হয়। এ জাতীয় বিধানগুলো আবার দু’প্রকার। (ক) বিধান আহরণে অন্য আয়াতের সাহায্য নেয়ার প্রয়োজন হয় না। (খ) বিধান আহরণে কুরআনের অন্য আয়াতের সহায়তা নেয়া আবশ্যক।
০৫. কুরআন ও সুন্নাহ থেকে বিধান আহরণ করার বিষয়টি মুজতাহিদের ধীশক্তির উপর নির্ভরশীল। সুতরাং যে মুজতাহিদ কেবল সুস্পষ্ট নস থেকে বিধান আহরণ করতে পারেন তার কাছে আহকামের আয়াতের সংখ্যা অবশ্যই ওই মুজতাহিদ থেকে ব্যতিক্রম হবে যিনি ঘটনা ও উদাহরণ সম্বলিত আয়াত থেকে বিধান আহরণ করার ক্ষমতা রাখেন।
তাফসীরু আয়াতিল আহকাম এর ক্রমবিকাশ :
ইসলামের সূচনা লগ্ন থেকেই আত তাফসীরুল ফিকহী এর সূচনা হয়েছে। যেহেতু এটি রাসূলুল্লাহ সা. কর্তৃক প্রদত্ত তাফসীরের ই একটি অংশ। রাসূলুল্লাহ সা. এর উপর কুরআনুল কারীমের যে সকল আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে আয়াতুল আহকাম বা বিধান সম্বলিত আয়াত তারই অন্তর্ভূক্ত। রাসূলুল্লাহ সা. এ সকল আয়াতের তাফসীর সাহাবায়ে কেরাম রাযি. কে তার আচরণ ও উচ্চারণের মাধম্যে, সরাসরি বক্তব্য ও কর্মের মাধ্যমে বর্ণনা করতেন। যে সকল আয়াতে অস্পষ্টতা রয়েছে সেগুলোকে স্পষ্ট করে দিতেন। যেখানে শর্তযুক্ত করা প্রয়োজন সেখানে তা করতেন। যেমন, তিনি সাহাবায়ে কেরামকে নিয়ে নামায আদায় করতেন, তাদেরকে বললেন, صلوا كما رأيتموني أصلي তাদেরকে নিয়ে হজ আদায় করলেন। তাদেরকে বললেন, خذوا عني مناسككمএটা মূলত কুরআনে বর্ণিত নামায ও হজ সংক্রান্ত আয়াতেরই তাফসীর। অনুরূপ আল্লাহ তায়ালা কুরআনুল কারীমের যাকাতের ব্যাপারে কেবল এতটুকু নির্দেশ দিলেন وَآتُوْا الْزَكَاةَ তোমরা যাকাত প্রদাণ কর। এ নির্দেশের বিস্তারিত বিবরণ রাসূলুল্লাহ সা. সাহাবায়ে কেরামকে বুঝিয়ে দিয়েছেন। এর পরিমান, আদায়ের সময়, ওয়াজিব হওয়ার মেকদার, আদায়ের খাত ইত্যাদি রাসূলুল্লাহ সা. বলে দিয়েছেন। অনুরূপভাবে শরীয়তের প্রতিটি বিধানের ক্ষেত্রেই কুরআনের নির্দেশের বাস্তব ব্যখ্যা নবীজি সা. বলে দিয়েছেন।
সাহাবায়ে কেরাম রাযি. ও রাসূলুল্লাহ সা. কে এ সকল বিষয়ে জিজ্ঞেস করতেন। উমর ইবনুল খাত্তাব রাযি. বলেন, আমি নবীজি সা. কে কালালাহ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম। তখন তিনি বললেন, তোমার জন্য আয়াতুস সাইফ’ -ই যথেষ্ট।
রাসূলুল্লাহ সা. এর ওফাতের পর সাহাবায়ে কেরাম বিধান সম্বলিত আয়াতের উপর ইজতিহাদ করতে শুরু করলেন। যে সকল বিষয়ে তারা রাসূলুল্লাহ সা. কে জিজ্ঞেস করেন নি এবং তাদের কাছে ওই বিষয়ে সুস্পষ্ট কোন জ্ঞানও নেই। যেমন আবু বকর রাযি. বলেন, কালালাহ এর ব্যাপারে আমি একটি সিদ্ধান্ত দিয়েছি। যদি এটি সঠিক হয়, তবে তা একমাত্র আল্লাহর পক্ষ থেকে। আর যদি ভুল হয়, তবে তা আমার ও শয়তানের পক্ষ থেকে। আল্লাহ তায়ালা এ থেকে পুতপবিত্র। কালালাহ বলা হয়, যে মৃত ব্যক্তির পিতা ও সন্তান কেউ নেই।
আবু বকর রাযি. তার কুরআনুল কারীমের এ আয়াতের উপর নির্ভর করেই তার মতামত ব্যক্ত করেছেন। وَإِنْ كَانَ رَجُلٌ يُوْرَثُ كَلاَلَةًএ আয়াতের উপর ভিত্তি করে তিনি ইজতিহাদ করেছেন। অনুরূপভাবে মর্ম উপলব্ধি করতে গিয়ে উমর রাযি. ইজতিহাদ করেছেন। তাই তিনি হজ্জে তামাত্তু নিষেধ কতেন। কিন্তু এ বিষয়ে কিবারে সাহাবা, যেমন আলী, ইবনে মাসউদ, আবু মূসা, আবদুল্লাহ বিন উমর রাযি. প্রমুখ তার বিরোধিতা করতেন।
তাফসীরের এ বিষয়ে সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে যারা অগ্রগামী ছিলেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন, আবদুল্লাহ বিন মাসউদ রাযি. আবদুল্লাহ বিন উমর রাযি. আবদুল্লাহ বিন আব্বাস রাযি.। এদের প্রত্যেকে তাদের ছাত্রদের উপর নিজেদের প্রভাব বিস্তার করেছেন। ফলে দেখা যায় যে, কুফায় ইবনে মাসউদের ছাত্রগণ, মদীনায় ইবনে উমরের শিষ্যগণ এবং মক্কায় ইবনে আব্বাসের শাগরেদগণ কুরআনুল কারীমের তাফসীরে বিশেষ করে বিধান সম্বলিত আয়াতের তাফসীরে তাদের মতাদর্শ অবলম্বন করতেন।
সাহাবায়ে কেরাম ও তাদের শিষ্য তাবেঈগণের মধ্যে তাফসীরের এ ধারাটি কেবল পাঠদান ও পাঠগ্রহনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। এবং এই জানা ও জানোর ধারাটিই চলমান ছিল। অবশেষে ইমাম মুকাতিল বিন সুলাইমান আল খুরাসানী (মৃত্যু-১৫০হি.) ইলমের ময়দানে নেতৃত্বের আসনে বরিত হলেন। তিনিই সর্বপ্রথম এ বিষয়ে কলম হাতে নিলেন। কেবল আহকামের আয়াত নিয়ে কুরআনুল কারীমের তাফসীর সংকলন করলেন। তবে তার তাফসীরটি ছিল প্রথম স্তরের তাফসীর, তাফসীর বিল মা’ছুর। তবে অনেক ক্ষেত্রে তিনি নিজের মতামতও পেশ করেছেন।
এ বিষয়ে মুজতাহিদ ইমামগণের মধ্যে যারা কলম ধরেছেন, তাদের মধ্যে রয়েছেন, ইমাম ইয়াহিয়া বিন যকাারিয়া বিন সুলাইমান আলক্বরশি আল কূফী রহ.। ২০৩হি. তে মৃত্যু বরণ করেন।
এরপর ক্রমান্বয়ে এটি বিকাশের পথে চলতে শুরু করে। এবং এ বিষয়ে প্রসিদ্ধ গ্রন্থসমূহ রচনা হতে থাকে। তবে এ সকল গ্রন্থ রচনার উদ্দেশ্য ও শৈলীতে রয়েছে ব্যাপক পার্থক্য। কারণ অনেকে আহকাম সম্বলিত আয়াতের তাফসীর সংকলণ করেছেন নিজ মাযহাবকে সংহত করার জন্য। যেমন, ইমাম জাস্সাস রহ. তার সুবিখ্যাত গ্রন্থ আহকামুল কুরআনে ইমাম আ’জম আবু হানিফা রহ. এর মাযহাব ও তার ফিকহি মতামতকে সুসংহত করার চেষ্টা করেছেন।
ইমাম ইলকিয়া র্হারাসী রহ. তার সুবিখ্যাত গ্রন্থ আহকামুল কুরআনের ভূমিকায় স্পষ্ট উল্লেখ করেছেন, তিনি বলেন এ গ্রন্থ রচনার উদ্দেশ্য হল ইমাম শাফেয়ী রহ. এর দলীলেল ব্যখ্যা করা। তার মানহাজকে সুস্পষ্ট করা।
আবু বকর মুহাম্মদ আল মাআফিরী আল আন্দালূসী রচনা করলেন আহকামুল কুরআন নামে তার সুবিখ্যাত গ্রন্থ। এতে তিনি ইমাম মালেক রহ. এর মাযহাবকে সুসংহত করার চেষ্টা করেছেন।
এভাবেই ক্রমবিকাশের ধারা অব্যহত গতিতে এগিয়ে চলল। তবে মাযাহাবের গ-িতে রচিত হলেও রচনাকারীদের মানহাজ ও শৈলীতে রয়েছে বিস্তর ফরাক। কেউ হয়ত বিস্তারিত বিবরণের পথে অগ্রসর হয়েছেন আবার কেউ সংক্ষিপ্ততার পথ অবলম্বন করেছেন। কেউ হয়ত তাফসীর ও ইসতেম্বাত প্রসংগে একটি কওল উপস্থাপন করেছেন আবার কেউ একাধিক বক্তব্য তুলে ধরেছেন। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিভিন্ন মুজতাহিদের মতামত ও দলীলের পর্যালোচনা করেছেন। আবার কেউ কেউ কেবল দলীল ও অগ্রগণ্য মতটি তুলে ধরেছেন এক্ষেত্রে তারা কোন মাযহাবের প্রতি ভ্রুক্ষেপ করেন নি। তবে এমনও রয়েছেন যারা নিজ মাযহাবের ইমামের উসূল থেকে সরে আসতে পারেন নি।
তাফসীরু আয়াতিল আহকাম বিষয়ক কয়েকটি গ্রন্থ :
কুরআনুল কারীমের তাফসীর করতে গিয়ে উলামায়ে কেরাম যেমন পূর্ণ কুরআনুল কারীমের তাফসীর লিখেছেন তেমনি অনেক উলামায়ে কেরাম কেবল বিধান সম্বলিত আয়াতের তাফসীর লিখেছেন। এ তাফসীর গ্রন্থগুলো দু’ধরনের। (১) কুরআনুল কারীমের সূরা ও আয়াতের তারতীব অনুসারে। (২) ফিকহী অধ্যায় ও বিষয় অনুসারে। হাদীসের গ্রন্থগুলো যে তারতীবে সংকলিত হয়েছে। নি¤েœ এ বিষয়ে রচিত কয়েকটি গ্রন্থের নাম উল্লেখ করা হল।
গ্রন্থের নাম : আহকামুল কুরআন জাস্সাস (৩০৫-৩৭০হি.)
গ্রন্থকারের নাম : আহমদ বিন আলী আবু বকর আর রাযি আল জাস্সাস আল হানাফী। মৃত্যু : ৩৭০
গ্রন্থের বৈশিষ্ট : এটি হানাফি মাযহাবের উলামায়ে কেরামের নিকট একটি গুরুত্বপূর্ণ ফিকহী তাফসীর গ্রন্থ হিসেবে সমাদৃত। গ্রন্থকার
এতে ইমাম আ’জম আবু হানিফা রহ. এর ফিকহি মতামতকে সুসংহত করেছেন। যারা তার মতামতকে ভ্রান্ত ও ভুল
প্রমানের চেষ্টা করেছে তাদের উত্তর দিয়েছেন।
এ গ্রন্থটি রচনায় তিনি যে শৈলী অবলম্বন করেছেন,তা হল- কুরআনুল কারীমের সবগুলো আয়াতই উপস্থাপন করেছেন,
তবে কেবল বিধান সম্বলিত আয়াত নিয়ে কথা বলেছেন।
যদিও তা কুরআনুল কারীমের আয়াতের ধারাবাহিকতা অনুসারে রচিত, তবে তাতে ফিকহি অধ্যায় অনুসারে বিন্যস্ত।
প্রতিটি অধ্যায়ের শিরোনাম রয়েছে। এ শিরোনামের অধিনে তিনি মাসআলা নিয়ে আলোচনা করেছেন।
০২ আহকামুল কুরআন ইলকিয়া র্হারাসী (৪৫০-৫০৪হি.)
আলী বিন মুহাম্মদ বিন আলী আবুল হাসান আত তাবারী। ইলকিয়া আল হাররাসী আশ শাফেয়ী রহ.। মৃত্যু : ৫০৪ এটি শাফেয়ী মাযহাবের উলামায়ে কেরামের নিকট সমাদৃত একটি গ্রন্থ। এতে ইমাম শাফেয়ী রহ. এর ফিকহি মাযহাবের প্রতিনিধিত্ব করা হয়েছে।
তবে তিনি তাফসীরের জন্য কেবল বিধান সম্বলিত আয়াতটি উল্লেখ করেছেন।
০৩ আহকামুল কুরআন ইবনু আরাবী৪৬৮-৫৪৩হি.
কাযী মুহাম্মদ বিন আবদুল্লাহ বিন মুহাম্মদ আবু বকর ইবনুল আরারবী রহ. মালেকী মাযহাবের প্রসিদ্ধ তাফসীর গ্রন্থ এটি। এতে ইমাম মালেক রহ. এর ফিকহী মতামতকে সুসংহত করা হয়েছে।
এ গ্রন্থে তার উপস্থাপনা শৈলী চমৎকার। তিনি প্রথমে সূরার নাম, তার তাতে বিধান সম্বলিত আয়াতের সংখ্যা উল্লেখ করেছেন। এরপর আয়াতের মধ্যে কয়টি মাসআলা রয়েছে তা উল্লেখ করে তার ব্যখ্যা উপস্থাপন করেছেন
আয়াত থেকে বিধান প্রমাণের ক্ষেত্রে অধিকাংশ সময় তিনি ভাষার আশ্রয় নিয়েছেন। ইসরাঈলী বর্ণনাকে পরিহার করেছেন। দুর্বল হাদীসও যথাসম্ভব এড়িয়ে চলার চেষ্টা করেছেন।
০৪আহকামুল কুরআন জাহযামী (১৯৯-২৮২হি.)
কাযী আবু ইসহাক ইসমাঈল বিন ইসহাক বিন ইসমাইল বিন হাম্মদ বিন যায়েদ আল আযদী আল বসরী। মৃত্যু : ২৮২হি.
০৫ আহকামুল কুরআন ত্বহাবী (২৩৮-৩২১হি.)
আবু জা‘ফর আহমদ বিন মুহাম্মদ বিন সালামাহ বিন আবদুল মালিক বিন সালামহ আযদী আত তাহাবী রহ. মৃত্যু : ২৩৮-৩২১হি. ফিকহি তারতীবে সাজানো
০৬ আহকামুল কুরআন ইবনুল ফুরুস্
আবু মুহাম্মদ আবদুল মুনঈম বিন আবদুর রহীম ইবনুল ফুরুস আন্দালূসী। মৃত্যু : ৫৯৭হি.
০৭ আহকামুল কুরআন শাফেয়ী (৩৮৪-৪৫৮হি.)
ফিকহি বিষয় সম্বলিত আয়াতের তাফসীর। এতে ইমাম শাফেয়ী রহ. এর মাযহাব ও তার ফিকহী মতামত বিধৃত হয়েছে। ইমাম বায়হাকী রহ. তা সংকলন করেছেন। ৪৫৮হি.
০৮ আল জামিউ লি আহকামিল কুরআন
আবু আবদুল্লাহ মুহাম্মদ বিন আহমদ বিন আবি বকর বিন ফারাহ আনসারী আল খাযরাজী। শামসুদ্দিন আল কুরতুবী। মৃত্যু : ৬৭১হি.
০৯ তাফসীরুল বায়ান লি আহকামিল কুরআন
মুহাম্মদ বিন আলী বিন আবদুল্লাহ বিন ইবরাহীম ইবনুল খতীব আল ইয়ামানী আশ্ শাফেয়ী। ইবনু নূরুদ্দিন মৃত্যু : ৮২৫হি.
১০ শাফিউল আলীল শরহুল খামসি মিআতি আয়াতিম মিনাত তানযীল
ফখরুদ্দিন আবদুল্লাহ বিন মুহাম্মদ ইবনুল কাসিম বিন আলী আল আবাসী আন নজরী। মৃত্যু ৮৭৭হি.
১১ আল ইলমাম বিবা‘দি আয়াতিল আহকাম শায়খ মুহাম্মদ বিন সালেহ আল উসাইমিন
১২ আল মিনহাজুল কুরআনী ফিত তাশরী’ ড. আবদুস সাত্তার ফাতহুল্লাহ সাঈদ
১৩ রওয়াইউল বায়ান ফী তাফসীরি আয়াতিল আহকাম ড. আলী আস সাবুনী
১৪ ফাতহুল আল্লাম ফী তারতীবি আয়াতিল আহকাম সবাহ আবদুল কারীম আল আনাযী ফিকহি তারতীব
১৫ নাইলুল মারাম সিদ্দিক হাসান খান
১৬ মুনতাহাল মারাম ইবনুল কাসিম
১৭ বুলুগুল মারাম ড. আবদুর রহমান আলী আল হাত্তাব ফিকহী তরতীব দারুত তাওহীদ লিন নাশরি
১৮ নাইলুল মারাম মিন আদিল্লাতিল আহকাম তারিক বিন মুহাম্মদ বিন আবদুল্লাহ আল খুওয়াইতার। দরু কুনুয ইশবিলিয়াহ।
১৪২৮হি. ফিকহী তরতীব
১৯ আত্ তাফসীরাতুল আহমাদিয়্যাহ মোল্লা জিউন রহ.
২০ আহকামুল কুরআন থানভী আল্লামাহ জা‘ফর আহমদ উসমানী রহ.
২১ আত তাফসীরুল মুনীর আল্লামাহ যুহাইলী
আয়াতের প্রমাণ :
এটা বিধিবদ্ধ যে, কুরআনের প্রতিটি আয়াতই অবতরণ ও নাযিলের দিক থেকে অকাট্য। আমরা এটা দৃঢ়ভাবে বিশ^াস করি যে, আমরা কুরআন হিসেবে যে আয়াতগুলো তেলাওয়াত করি এর প্রতিটি আয়াত আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে আমাদের নবী মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ সা. এর উপর অবতীর্ণ হয়েছে। এবং কোনরূপ পরিবর্তণ-পরিবর্ধন-পরিমার্জন ছাড়াই আমাদের নিকট অবিচ্ছিন্ন ধারাবাহিক বর্ণনার মাধ্যমে পৌঁছেছে। রাসূলুল্লাহ সা. এর ওফাতের পূর্বেই তা সাহাবায়ে কেরামের সীনায় ও তাদের লেখায় সংরক্ষিত হয়েছে। তবে ফূকাহায়ে কেরাম কুরআনুল কারীমের আয়াতকে কোন বিধান প্রমাণের দিক থেকে দুই ভাগে ভাগ করেন।
প্রথম প্রকার :ওই সকল আয়াত যার বিধান অকাট্যভাবে প্রমাণিত। যেখানে একাধিক অর্থ গ্রহণের কোন সুযোগ নেই। বর্ণিত বিষয়ে আয়াতটি স্পষ্টভাবেই প্রমাণ বহন করে। যেমন, الزَّانِيَةُ وَالزَّانِي فَاجْلِدُوا كُلَّ وَاحِدٍ مِّنْهُمَا مِائَةَ جَلْدَةٍ ۖ وَلَا تَأْخُذْكُم بِهِمَا رَأْفَةٌ فِي دِينِ اللَّهِ إِن كُنتُمْ تُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ ۖ وَلْيَشْهَدْ عَذَابَهُمَا طَائِفَةٌ مِّنَ الْمُؤْمِنِينَ সুতরাং যদি শর্ত ও রুকন পূর্ণ হয়ে যায় এবং শাস্তি প্রয়োগে কোনরূপ শরয়ী বাধা না থাকে, তবে যিনাকারী অবশ্যই শাস্তিযোগ্য বিবেচিত হবে। এ ক্ষেত্রে তার শাস্তি হবে একশ’ র্দোরা। এটি একটি অকাট্য বিধান এখানে ইজতিহাদ করে শাস্তি বাড়ানোর কিংবা কমানোর কোন সুযোগ নেই।
দ্বিতীয় প্রকার : যার বিধান অকাট্যভাবে প্রমাণিত নয়। একাধিক অর্থ গ্রহণের সুযোগ থাকার কারণে। وَالْمُطَلَّقَاتُ يَتَرَبَّصْنَ بِأَنفُسِهِنَّ ثَلَاثَةَ قُرُوءٍ ۚ
এখানে قُرُوءٍ শব্দটি দ্ব্যর্থবোধক। এর অর্থ যেমন পবিত্রতা রয়েছে তেমনি এর অর্থ হায়েজও রয়েছে। সুতরাং অকাট্যভাবে একথা বলা যাবে না যে এখানে এ অর্থটি নির্ধারিত। কুরআনুল কারীমের এ জাতীয় আয়াত উম্মতের জন্য ইজতিহাদের পথকে উন্মুক্ত করেছে। প্রত্যেক মুজতাহিদ নিজ নিজ ইজতিহাদ অনুসারে এর ব্যখ্যা প্রদানে সচেষ্ট হয়েছেন। আর এখান থেকে ফিকহী মাযহাবের সৃষ্টি হয়েছে।
বিধান উপস্থাপনের শৈলী :
কুরআনুল কারীমে শরয়ী বিধানাবলী উপস্থাপনায় তিনিটি শৈলী ব্যবহৃত হয়েছে।
০১. >مجمل< বা সংক্ষিপ্ততার শৈলী। যেমন কুরআনুল কারীমের নামাযের নির্দেশ প্রদাণ করে বর্ণিত হয়েছে وَأَقِيمُوا الصَّلَاةَ وَآتُوا الزَّكَاةَ وَارْكَعُوا مَعَ الرَّاكِعِينَ কিন্তু নামাযের পদ্ধতি কি হবে? কখন এটি আদায় করতে হবে। কত রাকাত আদায় করতে হবে। এ সম্পর্কে কোন বিধানই কুরআনুল কারীম দেয়নি। অর্থাৎ নামাযের বিস্তারিত বিধান বর্ণিত হয়েছে রাসূলুল্লাহ সা. এর সুন্নায়। রাসূলুল্লাহ সা. উম্মতকে নামাযের আরকান আহকাম, ওয়াজিব, সুন্নাত, মুস্তাহাব, আদায়ের পদ্ধতি, সময়, রাকাত ইত্যাদি বিস্তারিত বিবরণ শিক্ষা দিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে কুরআনুল কারীম কেবল সময় মত নামায আদায়ের নির্দেশ দিয়ে চুপ রয়েছে।
অনুরূপ মুমিনদেরকে পরামর্শ করার নির্দেশ দিয়ে বর্ণিত হয়েছেوَأَمْرُهُمْ شُورَىٰ بَيْنَهُمْ
ইনসাফের নির্দেশ দিয়ে বর্ণিত হয়েছে, إِنَّ اللَّهَ يَأْمُرُ بِالْعَدْلِوَالْإِحْسَانِ
অঙ্গিকার পূরণের নির্দেশ দিয়ে বর্ণিত হয়েছে, يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَوْفُوا بِالْعُقُودِ..)
কিন্তু এর প্রয়োগিক ও আমলী দিকটি মানুষের জন্য ছেড়ে দিয়েছে।
০২। >مفصلالإشارة< বা ইঙ্গিতের শৈলী : বিধানটি কুরআনুল কারীমে ইঙ্গিতে বর্ণিত হয়েছে। রাসূলুল্লাহ সা. তার সুন্নাহ তা স্পষ্ট করে দিয়েছেন। فَإِذَا أُحْصِنَّ فَإِنْ أَتَيْنَ بِفَاحِشَةٍ فَعَلَيْهِنَّ نِصْفُ مَا عَلَى الْمُحْصَنَاتِ مِنَ الْعَذَابِ ۚ
এ আয়াতের মধ্যে এদিকে ইঙ্গিত রয়েছে যে গোলামের শাস্তি স্বাধীন মানুষের শাস্তির অর্ধেক হবে। রাসূলুল্লাহর সুন্নায় কুরআনের এ বিধানটির বিস্তারিত বিবরণ উপস্থাপিত হয়েছে।
বিধান উপস্থাপনের শব্দ :
শুধু মাত্র আদেশ ও নিষেধের উপর বিধানের শব্দাবলী সীমাবদ্ধ নয়। বরং কুরআনুল কারীম বেশ অনেকগুলো শৈলীতে বিধান বর্ণনা করা হয়েছে যা থেকে শরয়ী হুকুম প্রমাণিত হয়। তম্মধ্যে প্রসিদ্ধ কয়েকটি শৈলী হল-
ক্র. শৈলী উদাহরণ
০১ নির্দেশ বাচক শব্দ ﴿ وَأَقِيمُوا الصَّلَاةَ وَآتُوا الزَّكَاةَ وَارْكَعُوا مَعَ الرَّاكِعِينَ
০২ নিষেধ বাচক শব্দ وَلَا تَقْتُلُوا أَوْلَادَكُمْ خَشْيَةَ إِمْلَاقٍ
০৩ فرض শব্দটি উল্লেখের মাধ্যমে قَدْ فَرَضَ اللَّهُ لَكُمْ تَحِلَّةَ أَيْمَانِكُمْ ۚوَاللَّهُمَوْلَاكُمْۖوَهُوَالْعَلِيمُالْحَكِيمُ
০৪ كتابةশব্দটি উল্লেখের মাধ্যমে يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى الَّذِينَ مِن قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ
০৫ الوصية শব্দটি উল্লেখের মাধ্যমে يُوصِيكُمُ اللَّهُ فِي أَوْلَادِكُمْ ۖلِلذَّكَرِمِثْلُحَظِّالْأُنْثَيَيْنِ﴾
০৬ সংবাদ প্রদানের শৈলীতে وَالْوَالِدَاتُ يُرْضِعْنَ أَوْلَادَهُنَّ حَوْلَيْنِ كَامِلَيْنِ ۖ لِمَنْ أَرَادَ أَن يُتِمَّ الرَّضَاعَةَ
©somewhere in net ltd.