![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
নিউট্রন তারকা এবং পালসার: মহাবিশ্বের ঘনিষ্ঠ এবং রহস্যময় জগত
মহাবিশ্বের সবচেয়ে রহস্যময় বস্তুগুলোর একটি হলো নিউট্রন তারকা। এটি একটি সুপারনোভা বিস্ফোরণের পর তারার ধ্বংসাবশেষ থেকে তৈরি হয়। নিউট্রন তারকার ঘূর্ণন গতি এবং তীব্র চৌম্বক ক্ষেত্রের কারণে কিছু নিউট্রন তারকা পালসার (Pulsar) নামে পরিচিত হয়। এগুলো মহাবিশ্বের বিস্ময়কর এবং চরম পদার্থবিজ্ঞান বোঝার একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস।
নিউট্রন তারকা কী?
নিউট্রন তারকা হচ্ছে একটি মৃত নক্ষত্রের কেন্দ্রীয় কোর। যখন একটি তারার ভর সূর্যের ভরের ৮ থেকে ২০ গুণের মধ্যে থাকে এবং এটি জীবনের শেষ পর্যায়ে পৌঁছে যায়, তখন তার অভ্যন্তরীণ অংশটি একটি সুপারনোভা বিস্ফোরণের মাধ্যমে ধসে পড়ে। এর ফলে এমন একটি অবিশ্বাস্য ঘন বস্তু তৈরি হয় যা প্রায় পুরোপুরি নিউট্রন কণায় গঠিত।
নিউট্রন তারকার বৈশিষ্ট্য:
ব্যাসার্ধ: প্রায় ১০-২০ কিলোমিটার (একটি শহরের আকার)।
ঘনত্ব: এক চা চামচ নিউট্রন তারকার পদার্থের ওজন হতে পারে প্রায় ১০০ কোটি টন।
গঠন: এটি মূলত নিউট্রন কণা দিয়ে তৈরি, যেখানে ইলেকট্রন এবং প্রোটন মিলিত হয়ে নিউট্রনে পরিণত হয়।
মাধ্যাকর্ষণ: নিউট্রন তারকার পৃষ্ঠের মাধ্যাকর্ষণ পৃথিবীর তুলনায় লক্ষ লক্ষ গুণ বেশি।
পালসার কী?
নিউট্রন তারকার একটি বিশেষ প্রকার হচ্ছে পালসার। পালসার (Pulsating Radio Star) হলো একটি দ্রুত ঘূর্ণায়মান নিউট্রন তারকা, যা নিয়মিত সময় অন্তর রেডিও, এক্স-রে, বা গামা রশ্মি নিঃসরণ করে। এগুলো একটি বাতিঘরের মতো কাজ করে, যেখানে ঘূর্ণনের ফলে আলো একটি নির্দিষ্ট সময়ে পর্যবেক্ষকের কাছে পৌঁছায়।
পালসারের বৈশিষ্ট্য:
স্পিন গতি: পালসার প্রতি সেকেন্ডে কয়েকশোবার ঘুরতে পারে।
চৌম্বক ক্ষেত্র: এর চৌম্বক ক্ষেত্র পৃথিবীর চেয়ে কয়েক ট্রিলিয়ন গুণ শক্তিশালী।
নিয়মিততা: পালসারগুলোর সময়সীমা এতই সুনির্দিষ্ট যে এগুলো প্রাকৃতিক ঘড়ির মতো কাজ করে।
নিউট্রন তারকা কীভাবে তৈরি হয়?
নিউট্রন তারকা তৈরি হয় তারার জীবনের শেষ পর্যায়ে, বিশেষত একটি সুপারনোভা বিস্ফোরণের মাধ্যমে। নিচে এর ধাপগুলো ব্যাখ্যা করা হলো:
নক্ষত্রের জ্বালানির ফুরিয়ে যাওয়া:
একটি তারার কেন্দ্রে হাইড্রোজেন এবং হিলিয়ামের ফিউশন প্রক্রিয়ায় শক্তি উৎপন্ন হয়। কিন্তু যখন জ্বালানি শেষ হয়ে যায়, তখন তারার অভ্যন্তরীণ চাপ মাধ্যাকর্ষণকে ঠেকাতে ব্যর্থ হয়।
কেন্দ্রের সংকোচন:
তারার কেন্দ্র বা কোর তীব্রভাবে সংকুচিত হয়, এবং প্রোটন ও ইলেকট্রন মিলে নিউট্রন তৈরি করে।
সুপারনোভা বিস্ফোরণ:
সংকোচনের পর তারার বাইরের অংশ প্রচণ্ড বিস্ফোরণে মহাকাশে ছিটকে পড়ে। এর ফলে কেন্দ্রটি একটি নিউট্রন তারকায় পরিণত হয়।
চরম ঘনত্ব:
নিউট্রন তারকা এতটাই ঘন যে এটি প্রায় পুরোপুরি নিউট্রন কণায় গঠিত।
নিউট্রন তারকার ভৌত গঠন
নিউট্রন তারকার গঠন অনেক স্তরে বিভক্ত।
বাহ্যিক স্তর:
নিউট্রন তারকার পৃষ্ঠ একটি শক্ত ক্রাস্ট দ্বারা আবৃত। এটি মূলত ইলেকট্রন এবং আয়ন দিয়ে গঠিত।
ভেতরের স্তর:
ক্রাস্টের নিচে একটি অত্যন্ত ঘন নিউট্রন সমুদ্র রয়েছে, যেখানে নিউট্রনগুলো অত্যন্ত ঘনভাবে জমাট বেঁধে থাকে।
কেন্দ্র:
নিউট্রন তারকার কেন্দ্র বা কোর হলো এমন একটি স্থান যেখানে পদার্থের অবস্থা এখনো পুরোপুরি বোঝা সম্ভব হয়নি। এটি কোর কোয়ার্ক (Quark) দিয়ে তৈরি হতে পারে বলে মনে করা হয়।
পালসার কীভাবে কাজ করে?
পালসারগুলোর কাজ করার পদ্ধতি খুবই জটিল এবং আকর্ষণীয়। এর মূল কার্যপ্রণালী নিচে ব্যাখ্যা করা হলো:
দ্রুত ঘূর্ণন:
নিউট্রন তারকা খুব দ্রুত ঘোরে। এর ঘূর্ণন গতি প্রতি সেকেন্ডে কয়েকশো থেকে কয়েক হাজার হতে পারে।
চৌম্বক ক্ষেত্র:
নিউট্রন তারকার তীব্র চৌম্বক ক্ষেত্র ঘূর্ণনের সাথে সাথে চারপাশে তড়িৎ চুম্বকীয় রশ্মি ছড়ায়।
নিয়মিত পালস:
যখন পালসারের রশ্মি পৃথিবীর দিকে আসে, এটি একটি নির্দিষ্ট সময় অন্তর আলো এবং রেডিও সিগন্যাল পাঠায়।
নিউট্রন তারকা এবং পালসার আবিষ্কার
জোসেলিন বেল বার্নেল (Jocelyn Bell Burnell):
১৯৬৭ সালে জোসেলিন বেল বার্নেল প্রথম পালসারের সংকেত শনাক্ত করেন। এটি একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত ছিল, যা নিউট্রন তারকা ও পালসার গবেষণায় নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে।
পালসারের গুরুত্ব:
পালসারগুলি মহাবিশ্বের বিভিন্ন বিষয় বুঝতে সাহায্য করে:
সময় গণনার জন্য প্রাকৃতিক ঘড়ি।
মহাবিশ্বে মহাকর্ষীয় তরঙ্গ শনাক্ত করতে সাহায্য।
ব্ল্যাকহোল ও অন্যান্য চরম মহাজাগতিক পরিবেশের স্টাডি।
নিউট্রন তারকা এবং পালসারের গুরুত্ব
নিউট্রন তারকা এবং পালসার বিজ্ঞানীদের মহাবিশ্বের অনেক গভীর রহস্য বোঝাতে সাহায্য করে। যেমন:
পদার্থের চরম অবস্থা:
নিউট্রন তারকার ঘনত্ব এবং চাপ পদার্থের চরম অবস্থার অধ্যয়নে সহায়ক।
মাধ্যাকর্ষণ তত্ত্ব:
পালসারগুলোর গতি ও আচরণ আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্ব পরীক্ষার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
মহাবিশ্বের ইতিহাস:
পালসারগুলোর সময়সূচি বিশ্লেষণ করে মহাবিশ্বের গঠন এবং বিবর্তন সম্পর্কে জানা যায়।
শেষ কথা
নিউট্রন তারকা এবং পালসার মহাবিশ্বের এক অদ্ভুত কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এদের সম্পর্কে গবেষণা আমাদের মহাজাগতিক আইন এবং পদার্থবিজ্ঞানের গভীর রহস্য উন্মোচনে সাহায্য করে। এই ক্ষুদ্র, ঘূর্ণায়মান তারাগুলি মহাবিশ্বের প্রকৃত সৌন্দর্য এবং জটিলতাকে আরও গভীরভাবে বুঝতে সাহায্য করে।
©somewhere in net ltd.