![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
ফিলিস্তিন মুসলিম বিশ্বে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং গভীরভাবে গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে। এই ভূমির ধর্মীয়, ঐতিহাসিক এবং রাজনৈতিক গুরুত্ব অস্বীকার করা যায় না। ইসলামিক ঐতিহ্য থেকে শুরু করে প্রতিদিনের রাজনৈতিক সংগ্রাম পর্যন্ত, ফিলিস্তিন মুসলিমদের জন্য একটি অতুলনীয় স্থান হয়ে উঠেছে। এই আর্টিকেলে আমরা বিস্তারিতভাবে আলোচনা করব কেন ফিলিস্তিন মুসলিমদের জন্য এত গুরুত্বপূর্ণ, সাথে গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক তথ্য, তারিখ, এবং নামও উল্লেখ করব যা ফিলিস্তিনের গুরুত্ব স্পষ্ট করে।
১. ধর্মীয় গুরুত্ব: আল-আকসা মসজিদ এবং ইসরা ও মিরাজ
ফিলিস্তিন মুসলিমদের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণ হল এর সম্পর্ক আল-আকসা মসজিদ-এর সাথে, যা ইসলামে তৃতীয় পবিত্র স্থান হিসেবে মসজিদুল হারাম (মক্কা) এবং মসজিদে নববি (মদীনা) এর পর অবস্থান করে।
ইসলামিক ঐতিহ্য অনুযায়ী, ইসরা ও মিরাজ—রাতের যাত্রা এবং আসমানী যাত্রা—হলো প্রাণবন্ত ঘটনা যা প্রিয় নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই ঘটনা ৬২১ খ্রিষ্টাব্দ (ইসলামী ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ১ হিজরি) সালে সংঘটিত হয়। নবী মুহাম্মদ (সা.) মক্কা থেকে বায়তুল মুকাদ্দাস (জেরুজালেম)-এ পৌঁছান এবং সেখানকার আল-আকসা মসজিদ-এ সমস্ত নবীর সাথে নামাজ পড়েন। এরপর তিনি আসমানে উঠেন (মিরাজ), যেখানে আল্লাহর কাছ থেকে ওহি গ্রহণ করেন এবং মুসলমানদের জন্য পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের বিধান প্রাপ্ত হন।
এটি ইসলামের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং আল-কুরআনে এ সম্পর্কে উল্লেখ রয়েছে সুরা আল-ইসরা (১৭:১)-এ:
"সর্বশক্তিমান আল্লাহ কৃতজ্ঞতা ও প্রশংসা তাঁর, যিনি তাঁর বান্দাকে এক রাতের মধ্যে পবিত্র মসজিদ থেকে ফার্ষতম মসজিদ পর্যন্ত যাত্রা করিয়েছেন, যার চারপাশে তিনি বরকত রেখেছেন, যাতে তিনি তাঁকে তাঁর কিছু নিদর্শন দেখান। নিশ্চয় তিনি শ্রবণশক্তিসম্পন্ন, দেখাশুনা করার ক্ষমতাসম্পন্ন।"
এই আয়াতটি আল-আকসা মসজিদ এবং জেরুজালেমের ইসলামী গুরুত্ব স্পষ্টভাবে প্রকাশ করে।
২. মুসলিমদের হাতে জেরুজালেমের বিজয় (৬৩৭ খ্রিস্টাব্দ)
ইসলামিক ইতিহাসে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত হল ৬৩৭ খ্রিস্টাব্দ সালে কালিফা উমর ইবনুল খাত্তাব-এর নেতৃত্বে মুসলিম বাহিনীর জেরুজালেম বিজয়। ইসলামের নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর মৃত্যুর পর মুসলিম বাহিনী প্রথমবারের মতো জেরুজালেম শহরটি বিজয় করে এবং এটি ইসলামিক শাসনের অধীনে চলে আসে।
জেরুজালেমের অধিকারীকরণের পর, উমর (র.) খ্রিস্টানদের ধর্মীয় স্বাধীনতা সুরক্ষিত করেন এবং তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেন। উমরের শর্তাবলী (প্যাক্ট অফ উমর) নামক একটি চুক্তি সাইন করা হয়, যেখানে খ্রিস্টানদের ধর্মীয় স্বাধীনতা এবং সুরক্ষা নিশ্চিত করা হয়। খলিফা উমর নিজে আল-আকসা মসজিদ পরিদর্শন করেন এবং সেখানে নামাজ আদায় করেন, যা মুসলিমদের কাছে এর ধর্মীয় গুরুত্ব আরও বৃদ্ধি করে।
৩.ক্রুসেড এবং হাত্তিনের যুদ্ধ (১১৮৭ খ্রিস্টাব্দ)
১০৯৯ খ্রিস্টাব্দ-এ ক্রুসেডাররা জেরুজালেম দখল করে এবং মুসলিম ও ইহুদি জনগণের ওপর সহিংসতা চালায়। তবে, এই দখল দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। ১১৮৭ খ্রিস্টাব্দ-এ সালাহ উদ্দীন আল-আয়ুবি (সলাদিন), মুসলিম সেনাপতি এবং মিশর ও সিরিয়ার সুলতান, হাত্তিনের যুদ্ধ-এ বিজয় লাভ করে জেরুজালেম পুনরুদ্ধার করেন। সলাদিনের বিজয় ইসলামিক ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত হিসেবে বিবেচিত হয়।
সলাদিন শুধু যুদ্ধে জয়ী হননি, বরং শহরের খ্রিস্টানদের সুরক্ষা দেন এবং তাদের ধর্মীয় স্বাধীনতা নিশ্চিত করেন। তার উদার মনোভাব এবং মহানুভবতা আজও মুসলিম বিশ্বে সম্মানিত।
৪. ওসমানি শাসনামল (১৫১৭–১৯১৭)
১৫১৭-এ, ওসমানীয় সাম্রাজ্য ফিলিস্তিন দখল করে এবং ১৯১৭ সাল পর্যন্ত এটি শাসন করে। এই দীর্ঘ শাসনকালে, ফিলিস্তিন এবং জেরুজালেম মুসলিম বিশ্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হয়ে ওঠে। ওসমানীরা আল-আকসা মসজিদ এবং ডোম অফ দ্য রক সহ গুরুত্বপূর্ণ ইসলামী স্থাপনাগুলোর পুনর্নির্মাণ এবং সংরক্ষণে উদ্যোগী হয়।
ওসমানী শাসনকাল পর্যন্ত, ফিলিস্তিন মুসলিমদের একটি ঐতিহাসিক এবং সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ছিল। তবে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর, ১৯১৭ সালে ব্রিটেন ফিলিস্তিনের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে, যা পরবর্তীতে রাজনৈতিক সংঘর্ষের সূচনা হয়।
৫. ব্রিটিশ ম্যান্ডেট এবং ইসরায়েলের সৃষ্টি (১৯৪৮)
১৯১৭ সালে, ব্রিটিশ বালফোর ঘোষণাপত্র প্রকাশিত হয়, যাতে ফিলিস্তিনে একটি ইহুদি প্রদেশ প্রতিষ্ঠার প্রতি সমর্থন জানানো হয়। এর পর, ১৯৪৭ সালে, জাতিসংঘ ফিলিস্তিনকে দুটি রাষ্ট্রে ভাগ করার প্রস্তাব দেয়। ইহুদিরা এই প্রস্তাব গ্রহণ করলেও, আরবরা তা প্রত্যাখ্যান করে।
১৯৪৮ সালের মে মাসের ১৪ তারিখে ইসরায়েলের প্রতিষ্ঠা ঘোষণা করা হয় এবং তার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবেশী আরব দেশগুলো ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। এই যুদ্ধের ফলে বহু ফিলিস্তিনি তাদের বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে যায়, যা নাকবা (অর্থাৎ "বিপর্যয়") নামে পরিচিত।
এর পর, ফিলিস্তিনের রাজনৈতিক সংকট এবং মুসলিম বিশ্বের প্রতি এর প্রভাব একত্রিত হয়ে উঠেছে। ফিলিস্তিনে স্বাধীনতার সংগ্রাম, ভূমি অধিকার এবং সার্বভৌমত্বের প্রশ্ন আজও মুসলিম বিশ্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
৬. ফিলিস্তিন মুক্তির সংগ্রাম এবং মুসলিম বিশ্বের ভূমিকা
১৯৬৪ সালে ফিলিস্তিন মুক্তি সংগঠন (PLO) প্রতিষ্ঠিত হয় এবং তারপর থেকে এটি ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা ও অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। অনেক মুসলিম-majority দেশ, যেমন মিশর, জর্ডান, সৌদি আরব এবং অন্যান্য দেশগুলি ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার পক্ষে সমর্থন জানায় এবং বিভিন্ন স্তরে সহায়তা প্রদান করে।
১৯৭৯ সালে, ইয়াতোল্লাহ খোমেইনি ইরানে আল-কুদস দিবস ঘোষণা করেন, যা প্রতিবছর মুসলিম বিশ্বে পালিত হয় এবং ফিলিস্তিনের সঙ্গে সংহতি প্রদর্শন করা হয়।
আজকাল, ইসরায়েলি দখলদারি, বিশেষ করে পশ্চিম তীর এবং গাজা অঞ্চলে, মুসলিম বিশ্বের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে। মুসলিমরা ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতা এবং মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য একসঙ্গে কাজ করছে।
উপসংহার: ফিলিস্তিন এবং মুসলিম উম্মাহর অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক
ফিলিস্তিন মুসলিমদের জন্য শুধু একটি ভূখণ্ড নয়, এটি ধর্মীয়, ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইসরা ও মিরাজ-এর ঘটনাটি থেকে শুরু করে, সলাদিনের বিজয়, এবং প্যালেসটাইন মুক্তির সংগ্রাম, সবই মুসলিম বিশ্বকে ঐক্যবদ্ধ করেছে। আল-আকসা মসজিদ এবং জেরুজালেমের পবিত্রতা মুসলিমদের হৃদয়ে একটি অবিচ্ছেদ্য স্থান অধিকার করে, যা মুসলিম উম্মাহকে একত্রিত করে।
ফিলিস্তিনের প্রশ্ন শুধু রাজনৈতিক নয়, এটি একটি আধ্যাত্মিক এবং মানবাধিকার বিষয়ও। তাই, ফিলিস্তিনের মুক্তি এবং এই অঞ্চলের জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হলে, মুসলিম বিশ্বের ঐক্য ও সংহতি আরও দৃঢ় হবে।
©somewhere in net ltd.