![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
১.
মুখ ভার করে বসে আছে তিতলী।
তা দেখে অয়ন এগিয়ে এলো। হাতে হুদা মামার বানানো দু’প্যাকেট ঝালমুড়ি। একটা চকোলেট মিল্কও আছে।
‘‘কীরে? আবার তোর ঘরবাড়ি ভাইসা গেসে? মুখ ভোঁতা করে রাখসিস ক্যান?’’
‘‘হার্ট এটাক করেছি দোস্ত।’’
‘‘ক্যান?’’
‘‘ভাবছিলাম এইবার কথাটা বলেই ফেলবো ভাইয়াকে। এসে দেখি আরেকজনের সাথে হয়ে গেছে।’’
‘‘আবীর ভাই ছাড়া দুনিয়াতে আর কোন মানুষ নাই?’’
‘‘আছে তো, কিন্তু সবকিছুর শেষে কেন যেন ওই মানুষটাকেই মনে পড়ে রে।’’
‘‘কি আছে এমন ওনার মধ্যে এমন শুনি? আমাদের চোখে পড়ে না?”
‘‘জানলে তো নিজেই এই অসুখ থেকে বেরিয়ে আসতে পারতাম। আমার এই অপেক্ষার প্রহরের মনে হয় শেষ নাই রে।’’
‘‘নে দোস্ত, আপাতত মুড়ি খা। খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে কোন বেলায় ওয়েট করতে নাই।’’
মুখ কালো করে বলে অয়ন।
২.
বিশাল জ্যাম লেগেছে রাস্তায়। থেমে থেমে বৃষ্টি পড়ছে। গুমোট আবহাওয়া। খবরের কাগজ ছিঁড়ে ছিঁড়ে মিথি একটার পর একটা কাগজের নৌকা বানাচ্ছে আর পেছনের সিটে জমিয়ে রাখছে। হাসপাতাল থেকে বাসায় ফিরে ভাসিয়ে দিবে। শহরটা কেমন একটু ডুবে ডুবে আছে বৃষ্টির পানিতে। আমি একটু পর পর ঘড়ি দেখছি। আজ আমার স্ত্রীর ২৯তম জন্মদিন। একটু পর রাত ১২টা বেজে যাবে। সারাদিনে আমার এইমাত্র মনে পড়লো যে আজ তিতলীর জন্মদিন ছিলো।
আমি আবীর রায়হান।একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীতে সিইও হিসেবে আছি। আমার স্ত্রী তিতলী মাহমুদ। ও আছে একটা মোবাইল কোম্পানিতে। আমাদের অফিস একই এলাকায় পাশাপাশি। সকালবেলা আমরা আমাদের মেয়ে রুদমিলা মিথি কে ওর স্কুলে নামিয়ে দিয়ে পাশাপাশি সিটে বসে একই টাইমে অফিসে ঢুকি, একই টাইমে অফিস থেকে ফিরি। এর মধ্যে দু’চারবার ফোনে নাওয়া-খাওয়ার কথা হয়। মাঝে মাঝে তাও হয় না। আমাদের সম্পর্ক অনেকটা অফিস কর্পোরেটদের মত। শুধু আমরা আপনি না বলে তুমি তুমি বলি।
কললিস্ট থেকে নাজিয়া কে বের করলাম। নাজিয়া আমার স্কুল-বন্ধু। অ্যাপোলোতে আছে। নিউরোলোজিস্ট। তিতলী অ্যাপোলোতে ভর্তি আছে গত এক সপ্তাহ। গত সপ্তাহে ওর পিত্তথলিতে পাথর ধরা পড়েছে। আপাতত সেটার জন্য একটা মাইক্রো সার্জারি হবে। নাজিয়াকে ফোন দিলাম। বললাম তিতলীর নার্স কে অ্যাডভাইস করতে যাতে তিতলী অন্তত রাত ১২টার আগে ঘুমিয়ে না পড়ে।
আমাদের বিয়ের প্রায় সাত বছর হতে চলেছে। এই সাত বছরে আমি কখনোই তিতলীর কোন জন্মদিনে বিশেষ কিছু করিনি। আর ১০টা সাধারণ দিনের মতই কাটিয়েছি। কখনই বলিনি, ‘‘তিতলী,শুভ জন্মদিন।’’ কিংবা ওর হাতে হাত রেখে কেকের ছুরি ধরি নি। সব আনন্দ হয়েছে চারপাশে। আমি থাকতাম নিরাবেগ নিরাসক্ত। আমার বন্ধুরা আমাকে আত্মঅহংকারী ভাবে। আসলে, আমি ভিতরে বেশ খানিকটা গাধা। এবং ইদানীং মনে হচ্ছে আমি একটু উচ্চমানের গাধা। না হয় পৃথিবীর সবচেয়ে চমৎকার মেয়েটাকে এতো কাছে পেয়েও এতো দূরে সরিয়ে রেখেছি?
তিতলী অবশ্য আমাকে এ নিয়ে কখনো দোষারোপ করে নি। এই মেয়ে প্রচন্ড অভিমানী। তার এক কাজিন একবার আমাকে ছাগল বলেছিলো। ভদ্রলোকের মাথা কিছুটা খারাপ। আমার কিছুই মনে হলো না। কিন্তু সেই কাজিন কে তিতলী প্রথমে আমাদের বাসার ত্রিসীমানা থেকে বরখাস্ত করলো। স্টেটসে যাওয়ার সময় সেই কাজিনের সাথে দেখা করলো না। উনি বিশাল পার্টি দিলেন। তিতলী সেখানেও গেলো না। তাতে অবশ্য আমিও পার্টিটা এড়িয়ে যেতে পারলাম। এমন একটা ভাব যে আমার মনেই নাই। আসলে ইশানার সাথে ব্রেক-আপের পর থেকে আমার সামাজিক পারিবারিক কোন দায়বদ্ধতা ভালো লাগতো না।
সেই কাজিনের সাথে তিতলীর কথা হলো দু’বছর পর। তাও ফোনে। আমাদের মিথি হওয়ার পর। ভুলে ফোন রিসিভ করে ফেলেছিলো।
গত সপ্তাহে হাসপাতালের কাগজ পত্র ঘাটতে গিয়ে ওর পার্সোনাল ড্রয়ার থেকে ডায়েরী বেরিয়ে পড়ল। জানি অন্য কারো ডায়েরী পড়া উচিত না কিন্তু অধিকারবশত কৌতুহল নিয়ে পড়ে ফেললাম। মনে হচ্ছিলো ঘোরের মধ্যে আছি। পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা। যেখানে শুধু আমি আর তিতলী আছি। সেই আমাদের কিশোর বয়স থেকে। এই পর্যন্ত। প্রায় প্রতিদিনের তুচ্ছ ঘটনা গুলোও। তিতলী, কী সমস্যা টা ছিলো আগ বাড়িয়ে বলতে? একতরফা গোপন ভালো্বাসায় কী এমন আনন্দ ছিলো তোমার? অত উদার না হলেও তো অন্তত কখনোই ফিরিয়ে দিতাম না তো্মাকে।
৩.
বসে বসে অধৈর্য মনে সামনে জমে থাকা গাড়ির সংখ্যা গুনার চেষ্টা করছি। যতদূর চোখ যায়। হঠাৎই রাস্তার সব জ্যাম ক্লিয়ার হয়ে গেলো। ফ্লাইওভারে গাড়ি নিয়ে উঠে গেলাম। বৃষ্টি থেমে একটা স্নিগ্ধ আবহাওয়া। রাস্তার সারি সারি নিয়ন আলো ছাড়িয়ে যাচ্ছি আমি আর মিথি। অডিও প্লেয়ারে বেজে চলেছে শ্রীকান্ত আচার্য্যের গান। একটার পর একটা দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে উঠছে আমার।
সেই ছোট থেকে তিতলীর বড় হয়ে যাওয়া। আমি ওকে তখন ডাকতাম তেতলী। ছোটবেলায় আমার খেলনা ওকে খেলতে না দিলে ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলা, যেন আমার সমস্ত কিছু ওর অধিকারে। স্কুলের টিফিন-টাইমে টিফিন-বক্স হাতে দৌড়ে দৌড়ে আমার সেকশনে আসা, যদিও আমি ওর চেয়ে বছর দেড়েকের বড়। আমাকে ছাড়া ওর নাকি টিফিন খেতে ভালো লাগতো না। স্কুলসুদ্ধ সবাই জানতো আমরা ভাই-বোন। আর আমি, আমি জানতাম পৃথিবীতে আমার একটাই বন্ধু, তেতলী, যাকে নির্দ্বিধায় আমার পেট খারাপের কথাটা পর্যন্ত বলা যায়।
প্রাইমারী স্কুল পেরোনোর পর কে যেন স্কুলের গাছে গাছে লিখে দিলো আমার আর তিতলীর নাম। এখন ভাবলে হাসি পায়। আমি তখন এইটে, তিতলী সিক্সে। তিতলীর ভীষণ অপমানবোধ হলো। আমার সেকশনে এসে আমাকে যাচ্ছেতাই বলে গেলো। আমার জ্বর এসে গেলো। সারাদিন আমি শুয়ে শুয়ে ভাবতাম তুমি আমাকে দেখতে আসবে। তিতলী পাগলী, তুই কী জানিস তোর ওই কঠিন দৃষ্টির সামনে আমার কী রকম লেগেছিলো ওই কিশোর বয়সে? জানলে নির্ঘাত আমাকে দেখতে আসতিস। ওই বয়সেও ওইটুকু মেয়ের কত অভিমান ছিলো রে বাবা।
তখন থেকেই তিতলীর ডায়েরী লেখা শুরু হয়তো। প্রতিদিন আমাকে ডায়েরীতে বকা-ঝকা। তার ধারণা গাছে গাছে এই নাম আমি লিখিয়েছি! আমাকে দেখলেই নাকি তার পিত্তি জ্বালা করে। খামচি দিতে মন চায়। ঘুষি মেরে উড়িয়ে দিতে ইচ্ছা করে। স্কুল অথবা কোচিং থেকে ফেরার পথে ডেকে দুটো কথা বলে ওর ভুল ভাঙাবো তারও জো নেই। কখন বাসায় গিয়ে বলে দেয় আমি ওর পথ আটকে দিয়েছি। কোনভাবেই আমি আর তিতলীর সাথে আগের মত হতে পারলাম না। মানুষ তো আর মানুষকে বেঁধে রাখার মন্ত্র জানে না।
বাসা থেকে অবশ্য মায়েরা ভাবলো ছেলে-মেয়ে বড় হয়েছে। তাই দূরত্ব সৃষ্টি হওয়াটাই স্বাভাবিক। আমাদের এ বাপারে ডেকে বলতে হয় নি, এজন্য বোধ করি খুশিই হয়েছিলেন তারা। এর মধ্যে আমার ক্লাস এইটের বৃত্তি পরীক্ষা এসে গেলো। কোচিং,টিউটরস এই করেই আমার কাটে। আর শুধু মনে মনে বলতাম তিতলী তুই আর বছর দুয়েক আগে এলি না কেনো? তাহলেই তো আমরা একসাথে কোচিং করতে পারতাম। তোর ভুলটা অন্তত মুছে দিতে পারতাম। আমাদের এতোগুলো সময় চাপা পড়তো না। আমি আমাদের গোপন বোঝা-পড়াটাকে যে কি মিস করতাম। কিন্তু ওই সময়ে এটা তিতলীর জন্য ভালো্বাসা মনে হলেও আমার কিশোর মন লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছা করতো।
তারপর ক্লাস নাইনে ওঠা আমার। আমরা বদলি হয়ে চলে এসেছি ঢাকায়, তিতলীরা চিটাগাঙ। মাঝে মাঝে আমার মা আর তিতলীর মায়ের ফোনে কথা হত, বাবাদের তো হতোই। আমার যে কি ভীষণ ইচ্ছে হতো মাঝে মাঝে ফোনে তিতলীর কন্ঠ শোনার। আগের মত একটু ঝগড়া করার। অথচ ও আবার রেগে যায় কিনা, আমার প্রতি ওর মন আরো তেতো হয়ে যায় কিনা এই ভয়ে শুধু চৈতী আর আন্টির সাথেই কথা হতো। চৈতী তিতলীর ছোট বোন। ক্লাস এইটে বৃত্তি পাওয়ার সংবাদে চৈতীর পক্ষ থেকে চিঠি এলো। আর তিতলী, যে কিনা ক্লাস ফাইভে বৃত্তি পাওয়ায় আমাকে নিয়ে পুরো পাড়া মিষ্টি বিলিয়েছে সে কিনা আমাকে একটা উইশ পর্যন্ত করলো না। বুঝলাম, অনেক দূরে সরে গিয়েছি ওর কাছ থেকে। কেমন অপমানবোধ হলো ওই বয়সেও। নিজের একটা আলাদা জগৎ তৈরী করলাম। তেতলী নামটা আস্তে আস্তে চাপা পড়ে গেলো আমার রাত জাগার চায়ের কাপের তলায়। শুধু তিতলীর দেয়া গল্পের বইগুলো হঠাৎ হঠাৎ পড়তে গেলে প্রথম পৃষ্ঠার শুভেচ্ছা বাণীতে ওর নামটা চোখের সামনে ভেসে উঠতো।
আর তিতলী, সে তখন আমার থেকে অনেক দূরে গিয়ে কেমন নিশ্চুপ হয়ে গিয়েছে। ওই সময়ে এতো দূরত্বে থেকেও প্রায় প্রতিদিন আমাকে নিয়ে লিখেছে। ফোনের পাশে ঘেঁষে আমার কন্ঠ শুনতে তার যে কি রকম ভয়ানক ইচ্ছা করতো তা তার ডায়েরীতে আছে। অনেক বার নাকি আমাদের বাসার নাম্বার টুকে নিয়ে বাহির থেকে ফোন করত। যদি আমি ফোন ধরি এই আশায়। হ্যালো শুনে রেখে দিবে। আমার উপর সমস্ত রাগ তখন গিয়ে পড়েছে তার নিজের উপর। কি ভয়ঙ্কর ভালো্বাসা রে বাবা। মধ্যযুগীয় ব্যাপার-স্যাপার। এই গোপন ডায়েরী না পড়লে আজও জানতেও পারতাম না আমি কতোটা সৌভাগ্যবান। আমাকে নিয়ে কেও এতটা সুন্দর করে ভেবেছে তার যাপিত জীবনের এতোটা সময়। আর এই গোপন বিরহিণীর কথা জানলে কত আগেই আমি ছুটে যেতাম আমার তিতলীর মনের পাশে ঘুরে বেড়াতে।
তারপর আমি কলেজে, নিজের জগৎটা আরো নিজের মত করে হয়ে গিয়েছে। আমাকে নিয়ে মা-বাবার কত আশা। ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হলাম, তিতলীরা তখন ঢাকায়। আঙ্কেল আমাকে খুব করে ধরলেন তিতলীকে বাসায় গিয়ে পড়াতে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও গেলাম। পড়ানোর সময় মনেও হতো না বহু বছর আগে জীবনের একটা সময়ে এই কিশোরী মেয়েটার অকারণ রাগ ভাঙাতে কত মাথা ঘামিয়েছি আমি। আর ঈশানার সাথে তখন আমার সম্পর্কটা প্রায় হয় হয়। তিতলীর মত আরো তিন-চারটে মেয়ে কে পড়াই আমি। তারা আবীর ভাইয়া বলতে অজ্ঞান, আমার অনভিজ্ঞ চোখও বুঝে তা। আর তিতলী মাথা নিচু করে আসে, পড়া শেষে চুপ করে চলে যায়। কখনও পড়ানো মিস হলে জিজ্ঞেসও করতো না কেনো যাই নি। যেনো এই জন্মে আমার সাথে তার কখনও দেখা হয় নি। তখন কত মনে মনে বলেছি এই ছাত্রী থেকে কবে মু্ক্তি পাবো। এতো অস্বস্তিকর লাগতো ওর অস্বাভাবিক নীরবতা। আমার এক সময়ের বন্ধুত্ব স্বরূপ ভালোবাসা যে তখন মনের কোথায় ঘুমিয়ে পড়েছিলো?
৪.
গাড়ী সাইড করতে হবে। বৃষ্টি টা বেড়েছে। একটু আগে অর্ডার দেয়া কেকটা নিতে হবে। তারপর নিতে হবে চকলেট আর ফুল। ক্যান্ডেলের ব্যবস্থা আগেই করেছি। কদম ফুল তিতলীর সবচেয়ে পছন্দ জানি, এই বর্ষায় সেটাই ওর প্রথম উপহার হোক। কখনোই মেয়েটাকে ফুল দেয়া হয় নাই তো। কিন্তু চকলেট কী নেই? শুধু এটাই জানি আমার বউ সারাদিনই চকোলেটের উপর থাকে, কিন্তু কোনগুলা বেশী খায় তাও জানি না। ও হ্যাঁ,মনে পড়েছে।
বিয়ের পর প্রতিদিন তিতলী চিঠি লিখেছে আমাকে। সেদিন গুচ্ছে গুচ্ছে বেরিয়ে পড়লো ডায়েরীর ড্রয়ার থেকেই। ডাকবাক্স তিতলীর ড্রয়ার। সেসব চিঠির কোন প্রাপক নেই। তিতলী মনে হয় নিজে চিঠি লিখে নিজেই পড়তো। প্রাপকের কাছে না পৌঁছালে চিঠি লিখে লাভ কি?
সব চিঠি প্রথমদিকে আবেগে ভরপুর, নিত্যদিনের ছোটখাট ঘটনা কাউকে জানানো, শেষদিকে কেমন মন খারাপ করা। না, আমার প্রতি আর কোন অভিযোগ নেই তাতে। শুধু তিতলীর নিজেকে দোষী করে যাওয়া। আমাদের মধ্যে যে এতো ব্যবধান, তা যে ও ভাঙতে পারে নি সেটা যেন ওর দোষ। যেনো এই ব্যবধান ওর সৃষ্টি করা।
তিতলী একটা কথা আমাকে একবার বলেছিলো, কারো সাথে সম্পর্ক করার নাম ই কী ভালো্বাসা? আমরা তো আসলে নিজের মনটাকেও মাঝে মাঝে বুঝি না। ঠিক মোহও না, সম্পর্ক রেখে যাওয়ার জন্যও মাঝে মাঝে কাউকে ভালো্বেসে যেতে হয়, মানে ক্রাইটেরিয়া গুলো পালন করতে হয়। সমাজের আচার-বিচার পালন করার মতই। আসলেই আমরা কাকে সত্যিকার ভাবে ভালো্বাসি তা আমরা নিজেরাও অনেক সময় বুঝতে পারি না। হয়তো খুব ভাগ্যবান না হলে আমরা তার দেখা পাইও না। মেঘ নামলেই কি তা বৃষ্টি হয়ে আসে? মাঝে মাঝে তা ঝড়ও হয়। আড়ালে তার সূর্য নাও হাসতে পারে।
ঈশানার সাথে আমার সম্পর্কটা কিভাবে কিভাবে যেনো হয়ে গেলো। ক্লাসের বন্ধুদেরও প্রভাব ছিলো কিছুটা। চারটা বছর খারাপ কাটেনি আমার। তিতলী কিন্তু আমার ইউনিভার্সিটিতেই ভর্তি হয়েছিলো। বছর দুয়েক বাদে। দূর থেকে আমাকে আর ঈশানাকে দেখে কিরকম একটা মহামানবী টাইপস লুক দিতো। আমার সেটা দেখে আরো অস্বস্তি হতো।
তারপর যা হয়, বাঙালি সমাজের ছেলেদের প্রতি মা-বাবার আকাশ ছোঁয়া প্রত্যাশা। যদিও আমার পরিবার থেকে বরং আব্বু-আম্মু বিয়ের জন্যই চাপ দিচ্ছিলো। ঈশানার কথা আমাদের বাসা থেকেও জানতো। কিন্তু আব্বু সবসময়ই মনে মনে চাইতো আমি তাঁর বন্ধুর মেয়ে তিতলীর বর হই। এমনকি আম্মুও।
হলামও। ঈশানা নিজে থেকে আমার সাথে ব্রেক-আপ করে দিলো। আমি তখন চাকরিতে ঢুকে গেছি। ঈশানার একটা ফান্ডিং এলো,তাও কানাডা থেকে। আমি বললাম তুমি যাও, আমি আসছি। ও গেলোও। গিয়ে নিজ থেকে জানিয়ে দিলো ও সেখানেই বিয়ে করেছে। সমস্ত কিছু কেমন ঘোলা হয়ে গেলো আমার কাছে। সব ফেইক লাগতো। অফিস থেকে ফিরে দরজা বন্ধ করে আমি সারাদিন একমনে ড্রাম বাজাই।
ও হ্যাঁ, আমি খুব ভালো ড্রাম বাজাই। তবে তিতলী কবিতা আবৃত্তি বা গান ধরলে আমি ড্রাম বাজানো বন্ধ করে দিই। আমার তখন মনে হয় পৃথিবীর সমস্ত সুর একজনের গলায় এসে জড়ো হয়েছে। ইউনিভার্সিটিতে আমি তিতলীর একটা প্রোগ্রামও মিস করি নি। ঈশানাকে নিয়েই দেখতাম।
সেই ঘোরের মাঝেই তিতলীকে বিয়ে করা। হাজার হাজার মুহূর্ত আমাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখার পর ও যখন আমার স্ত্রী হয়ে এসেছে, আমি তখন ইনসিকিউরিটিতে ভুগছি। নারী-পুরুষের সব সম্পর্কই তখন আমার কাছে খেলা মনে হয়। সবাই তো সবাইকে ছেড়ে চলে যাবার জন্যই এ পৃথিবীতে এসেছে।
ও অবশ্য আমাদের মাঝের এই নীরব দেয়াল কে বারবার ভাঙার চেষ্টা করেছে। কিন্তু আমি আমার বলয় ভেঙে তিতলীর কাছে ধরা দেই নি। আমাদের বন্ধনটা তাই এই ৭ বছরে কেমন নীরবই থেকেছে। তবে সেই নীরব সংসারও তিতলী আর ছোট্ট মিথির ভালো্বাসায় ভরপুর ছিলো, আমি ঠিক ঠিক টের পেতাম।
এর মাঝে দু’দুবার ওর বাইরে যাওয়ার সুযোগ এলো। আমাদের বাসা থেকে বারবার বললো যেতে। ওদের বাসা থেকে তো ওকে প্লেনেই ওঠিয়ে দেয়। ঠিক হলো মিথি কে দাদী-নানী দুজন মিলে দেখে রাখবে। কিন্তু তিতলী গেলো না। তখন এতো আশ্চর্য লেগেছিলো। এখন তার সমস্ত কিছু পড়ে বুঝলাম, সে আমাকে ছেড়ে যেতে চায় নি। এমন কী আমাকে বলেও নি তার সাথে যাওয়ার জন্য। তার ধারনা জন্মে গিয়েছিলো আমি তার কোন আবদারে সাড়া দিবো না।
সেই তিতলী, যার সাথে কোনদিন বৃষ্টিতে ভেজা হয় নি আমার, আজ এই বিশেষ রাতে, মানে তি্তলীর জন্মদিনে, খুব ইচ্ছে হচ্ছে ওর সাথে বৃষ্টিতে ভিজতে। এর আগে তিতলী বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে গান ধরেছে, আমি আড়চোখে চেয়ে চেয়ে দেখেছি। ধরা পড়ে গেলে ও শান্ত চোখের ভাষায় বৃষ্টিতে ভেজার আহবান জানিয়েছে। কিন্তু আমার ভেজা হয়ে উঠে নি। আমি আবারো ঢুকে গিয়েছি আমার খোলসেই।
কিন্তু আজ তিতলীর বৃষ্টিতে ভেজা মানা। ওর গলব্লাডার অপারেশন হচ্ছে আগামীকাল ভোরে। ভোর ৬টায় ওর অপারেশন শুরু। এতদিন তিতলী আমার জন্য অপেক্ষা করেছে, এখন আমি ওর ফেরার অপেক্ষায়।
৫.
রাত ১১টা ২৭ মিনিট। তিতলী চকলেট নিয়ে সামনে বসে আছে। ওকে চকলেট খেতে দিচ্ছি না। ওর যে এখন কিছু খাওয়া মানা আমি বোকা টা তা ভুলেই গিয়েছি। মিথি বারবার কদম ফুলের গন্ধ নিচ্ছে। আর ঘাস-ফড়িংয়ের মত ক্যামেরা হাতে কেবিনের এ মাথা থেকে ও মাথা দৌড়ে বেড়াচ্ছে। তিতলী এখনও হ্যাঁ হয়ে বসে আছে। লাইটার দিয়ে মোমবাতি ধরাচ্ছি। ওর হাতে ছুরি দিয়ে দিয়েছি। কেক কাটতে ওর হাত নড়ছে না। কেমন সন্দেহ আর করুণার চোখে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। সেই মহামানবী লুক।
“তিতলী, প্লিজ কেকটা কাটো।’’
‘‘কেনো?’’
‘‘তোমার জন্মদিন, তাই!”
‘‘এতোক্ষণে মনে পড়লো? গিফট কী এনেছো? কেক ও তো খেতে পারবো না।’’
“ওহ! তাই তো! আচ্ছা গিফট দিচ্ছি। এখন কেকটা কাটো।’’ বলতে বলতে একটা বেগুনী রঙের খাম এগিয়ে দেই ওর দিকে।
“চিঠি?’’
“হুম, সাড়ে সাতাশ পৃষ্ঠার। বাকী দেড় পাতা পরে লিখবো। সময় হয় নি। আর শুনো, চিঠি লিখে আমাকে দিও এবার থেকে। উত্তর পাবে।’’
আমি বকবক করে যাচ্ছি আর তিতলীর চোখ দিয়ে হঠাৎ করে টপটপ জল গড়িয়ে পড়ছে। আমি ভয় খেয়ে যাই। এই প্রথম আমি ওকে চোখের সামনে কাঁদতে দেখছি। বিয়ের দিন ও তো প্রায় লাফাতে লাফাতে আমার পাশে এসে গাড়ীতে উঠে বসেছিলো।
আমার আবারো মনে হলো এই ভেজালের যুগেও আমি একজন খাঁটি হৃদয়ের মানবীর সামনে দাঁড়িয়ে আছি। হায় আল্লাহ, যার যেটা ধরে রাখার সামর্থ্য নেই তাকে সেই উপহার দেয়া কেনো?
………………………………………………
ভোর হয়ে আসছে। তিতলীকে এখন অপারেশন থিয়েটারের জন্য রেডি করা হচ্ছে। নাজিয়া এসে আমাকে বকাঝকা করছে আমি কেনো কাল তিতলী কে ঘুম না পাড়িয়ে সারা রাত গল্প করলাম।
এই মেয়ে যে কাল আমাকে সারা রাত একা একা হাসপাতালের বারান্দায় বসিয়ে রেখে সাড়ে সাতাশ পৃষ্ঠার চিঠি শেষ করেছে আর দেড় পাতায় আমাকে তার উত্তর দিয়েছে তা আমি কাকে বলি? আমার মত কম কথার ভা্বলেশহীন মানুষ তো আর তিতলীর মত ঝগড়ায় পিএইচডি করা বিদূষিণীর সাথে পেরে ওঠে না।
শেষ:
ভো্র হয়ে আসছে। তিতলী আবীরের কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে। মিথি আবীরের কোলে ঘুমুচ্ছে। ট্রেনের জানালা দিয়ে বাহিরে মুখ রাখে তিতলী। পরনে নীল তাঁতের শাড়ী। কপালে লাল আবীর। সূর্যের লাল রঙ ছড়িয়ে পড়ছে আকাশে। আবীরও চোখ রাখে নীল আকাশে। চারকোণা আকাশের ফুটে ওঠা আলোতে রাতের অন্ধকার মিলিয়ে যেতে থাকে। প্রায় এক সপ্তাহ পর হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছে তিতলী। ওর ডাক্তার বলেছে কিছুদিনের জন্য হাওয়া বদল করতে। আপাতত ওদের গন্তব্য বগুড়া ক্যান্টনমেন্ট। যেখানে ওদের ছোটবেলা কেটেছে। আবীরের পাগলামী। তিতলীর সবকিছু স্বপ্নের মত মনে হয়।
দু’কাপ চায়ের যোগাড় করে তিতলীর পাশে এসে বসে আবীর। ওর ঔষধ এগিয়ে দেয়।
‘‘তো্মাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি, স্যরি বলে তো্মাকে ছোট করবো না তিতলী। কখনও অভিযোগ না জানানোর জন্যও ধন্যবাদ দিবো না।’’ মাথা নীচু করে বলে চলে আবীর।
‘‘আমাকে নীরব ভাবে সহ্য করেছো। তার জন্য অবশ্যই ধন্যবাদ। তোমার কষ্ট কমাতে পারি নি, তার জন্য স্যরি।’’ ভেঙচি কেটে বলে তিতলী।
আবীর উচ্চস্বরে হেসে ওঠে। লোকজনের কৌতূহলী দৃষ্টি তাকে থামায়। মিথি ঘুম থেকে জেগে ওঠে।
‘‘অন্যের দেয়া কষ্ট তুমি কমিয়ে দিবে কী করে তিতলী? বাড়িয়ে দাও নি, তাই অনেক।’’ তিতলীর ছোট হাতটা আস্তে করে নিজের হাতে বন্দী করে আবীর।
“একটা কথা বলবো?”
“বলো।”
‘‘বিশ্বাস করবে?”
‘‘আগে বলো তো।’’
“ভালো্বাসি। শুধু তোমাকে। কখনো বলতে পারি নি। খুব বেশি পরিচিতা তুমি, পরিচিতদের ভালবাসি বলতে বড় লজ্জা হয়। কেনো বলো নি কখনও?” আবীরের গলা ধরে আসে।
‘‘ইশ! পরিচিতা! কি ডায়লগ রে বাবা। এখন চুপ থাকো। হাসপাতালে কয়েকদিন বেড়িয়ে এসে অনেক কাজ জমে গিয়েছে অফিসের। বস বলেছে হানিমুনের মাঝেও জমানো কিছু কাজ করে নিয়ে যেতে। আপাতত মিথির সাথে কথা বলো।’’ হাত ছাড়িয়ে নিয়ে ব্যাগ থেকে ল্যাপটপ বের করতে করতে খিলখিলিয়ে হেসে উঠে তিতলী।
আবীর সেদিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকে। কিন্তু ভান করে আকাশ দেখার। অনেক বছর পর স্ত্রীর জন্মদিনে প্রথম বারের মত শুভেচ্ছা জানাতে গিয়ে মনের কোণে লুকিয়ে থাকা সত্যিকারের ভালোবাসাটার সন্ধান পেয়েছে সে। তাই কিছুটা সময় এর জন্য হলেও তিতলী কে নিয়ে তার শৈশবে হারিয়ে যেতে ইচ্ছা করছে।
অজানা প্রতীক্ষার শেষ এখানেই। সত্যিকারের গল্প শুরু এবারে।
২| ২১ শে জুলাই, ২০১৩ রাত ১০:২৫
অমি_০৭০৪ বলেছেন: মৃত রাজকন্যা আপু, আমি ভাইয়া নাহ। আপুই।
গল্প পড়ার জন্য ধন্যবাদ। দোয়া রাখবেন।
৩| ২১ শে জুলাই, ২০১৩ রাত ১০:৪৫
মো. ইব্রাহীম হুসাইন বলেছেন: অনেক বড় গল্প। কাল পরীক্ষা, তারপরও এক নিঃশ্বাসে পড়ে শেষ করলাম।
খুব ভালো লিখেছেন।
৪| ২১ শে জুলাই, ২০১৩ রাত ১০:৫৭
অমি_০৭০৪ বলেছেন: হুম। জীবনের অনেকটা সময় নিয়ে এই গল্পের স্মৃতিচারণ এবং শেষ।
পড়ার জন্য ধন্যবাদ। অনেক ভালো হোক আপনার আগামীকালের পরীক্ষা।
৫| ২২ শে জুলাই, ২০১৩ রাত ১২:৫৩
তোমার গল্পের মৃত রাজকন্যা বলেছেন:
ওরে আপু ...ছরি !!!
আর ভুল হবে না , প্রমিজ
৬| ২২ শে জুলাই, ২০১৩ রাত ১০:২২
অমি_০৭০৪ বলেছেন: ব্যাপার না আপু।
অনেকেই আমার নাম দেখে প্রথমে ভাইয়াই ভাবেন।
©somewhere in net ltd.
১|
২১ শে জুলাই, ২০১৩ রাত ১০:০৮
তোমার গল্পের মৃত রাজকন্যা বলেছেন:
অনেক ভালো লিখেছেন ভাইয়া ...
প্লাস!!!
শুভকামনা ...