নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

অমি_০৭০৪

undefined

অমি_০৭০৪ › বিস্তারিত পোস্টঃ

ছায়া কথন

০৭ ই মার্চ, ২০১৫ রাত ৯:১৩

মৃত ছারপোকা গুলো আশ্রয় নিয়েছে খাটের তলদেশে, আলো তে ভীষণ বড় দেখায়। সিগারেটের শেষ অংশ জ্বলতে জ্বলতে নিভে যাচ্ছে, নিভতে নিভতে জ্বলে উঠছে। সেপ্টেম্বরের গরম হাওয়ায় ঘামছে নিখিলেশ, কারেন্টও গেছে সেই কখন। ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক, বদ্ধ বাতাস, গুমোট হাওয়া। লাইটারের এক বিন্দু আলোর মত জ্বলতে জ্বলতে উপস্থিত হলো অরিন।

-কিরে, পয়সা হয়েছে বুঝি? মালবোরো ধরেছিস?
-ও, এলি তাহলে, খুব মিসাচ্ছিলাম তোকে। মাসী আজ কি রাঁধলো রে?
-তোর ছোঁচা স্বভাবটা আর গেলো না এই জন্মে। বেড়াল হয়ে জন্ম নিলেই পারতিস।
-হুম, তাহলে আত্মগ্লানির দায়ে ভুগতে হতো না, বেড়ালই তো।
-বাহ, তো কত সহস্র অপরাধের পর তুই ভুগিস রে? জ্বরের বিকারের মত তোর অনুশোচনারা বুঝি খুব দুর্বল? ফিরে ফিরে আসে?
-না রে অরিন। অনুশোচনা একবারই আসে, লক্ষ্য বীরের তেজ নিয়ে, নিভতে চায় না, মানুষ বদলে গেলেও অনুশোচনা বদলায় না। বেড়ালের অনুশোচনা নেই, বারবার মাছ ছুরি করে।
-বাহ, বেশ বলেছিস। কবিতা লিখিস এখন?
-নাহ, আসে না। জানিস অরিন, আমাদের ফুড হাউস গুলো আগের মতই আছে, বাস্কেটবল গ্রাউন্ডের সব বল এখনো কমলাই, রং বদলায় নি, পাড়ার ভূতুড়ে বাড়িটাতে এখনো ঘর পালানো জুড়িরা রাত কাটাতে আসে আর আরেক দল মিথ্যে ভূত সেজে ভয় দেখায়। দৃক গ্যালারীতে শিমুলের তোলা ছবি আসে এক্সিবিশনে। শুধু আমরা নেই, কি এক অভিমান সব উড়িয়ে নিয়ে গেলো, সব।

নিজের জন্য মায়া লাগে অরিনের। নিখিলেশ টা কোন জন্ম আওড়াচ্ছে? রাত হলে বোধ বাড়ে পাগলটার। ফার্নিচার এ ঘরে বড় একটা নেই, তারপরও ঘুণপোকার একঘেয়ে শব্দে কাঠ খেয়ে চলার শব্দ বড় বাজছে। ঘুণপোকার আহারের শব্দ উপভোগ করতে হয় একা একা।

-নিখিল, ছ-সাত বছর বয়সে বানানো আমাদের জাপানীজ ঘুড়িটা কোথায়? আছে না গেছে?

ঝেড়ে হাসে নিখিলেশ। অডিও প্লেয়ারে অনুপমের গান,“আমাকে ঘুড়ি ভেবে ওড়াস না, নরম আঙুল কেটে যাবে, উপড়ে নেবো নিজেকে”

-বন্ধুত্ব ছাড়া কিছুই হারায় নি রে। সব আছে। তোর বাচ্চার জন্মদিনে ওই ঘুড়ি উপহার দেবার কথা, মনে নেই? ছাদে বারবিকিউ করিস তোরা এখন?
-করি, কিন্তু জমে না আগের মত। আয়োজন করে দারোয়ানেরা, আমরা বউ-বাচ্চা নিয়ে এসে খাই।
-তোর লিসবনের গীটারটা কোথায়?
-পড়ে আছে ধুলোয়, তুই নেই, শব্দ নেই, সুরও গেছে থেমে।
-তা দীপু, অয়ন, হিমু, রাফি, মার্থা, রুমকি সব একসাথে বেরোয় এখনো?
-হুম, সেদিনও দল বেঁধে সব অন্নপূর্ণা গেলো, রুমকিটা যেতে পারে নি, বর আটকে দিয়েছে। আগের মত নাকি সূর্য আর রং বদলায় না ওদের কাছে !
-তুই যাস নি?

উচ্চস্বরে হাসে অরিন, ইউপিএস নষ্ট, মোমবাতির আলোয় ঘর কাঁপে। দমকা হাওয়ায় ব্রিটিশ আমলের ডোরবেলটা ভীষণ জোরে জোরে দুলে যেনো। মধু মিছরি গলায় টেনে টেনে ব্যঙ্গ করে বলে,

-সারাজীবন সন্দেশ চুরি করেছি দুজন, এখন কি আর একা একা সূর্য চুরি ভালো লাগে অখিল?
-হাহ হাহ হাহ, চুকলি করিস এখনো চুপা রুস্তমের মত? আহ অরিন, পৃথিবীটা কি তাড়াতাড়ি ঘুরছে এখন না? আহ্নিক গতি নাকি বেড়ে গেছে? এত দ্রুত ঘুরে, আলো-আঁধারের বিরামহীন খেলা, শুধু কষ্ট গুলো বুকের ভেতর স্থির জমে থাকে, ঘুরপাক খায়, বড় হয়, বিস্ফোরণ ঘটে না। কষ্ট এত অদ্ভুত কেনো রে?

চুপ করে ঘরের সিলিং এর দিকে তাকায় অরিন। ধীরে ধীরে চোখ নামে দেয়ালে। দেয়াল ছেয়ে আছে বব মার্লে আর জর্জ হ্যারিসনের পোস্টারে। ভিউ কার্ড কিনে কিনে দু’ বন্ধু মিলে নিজে হাতে এঁকেছিলো পোস্টার গুলো, আঠা দিয়ে লাগিয়েছিলো দেয়ালে সেঁটে সেঁটে। যেন বাড়ির দেয়াল ভেঙে পড়লেও বন্ধুত্বে দেয়াল না আসে......

অরিনের ক্লান্ত মুখটা এখন ভালমত দেখতে পাচ্ছে নিখিলেশ। স্বগতোক্তি করার মত আবারো বাতাসের সাথে ভাব জমানোর মত করে গলা ছাড়ে ও,

-কষ্ট পাবার থেকে কষ্ট দেবার কষ্ট বেশি মানুষের, বুঝলি অরিন?
-তোকে পিছু ডাকি নি কখনো। কেনো বুঝিস?
-বুঝি, দুটো ভাঙা কাঁচ পাশাপাশি থাকে না। জোড়া লাগাতে গেলে উভয়ে উভয়ের দিকে করুণার দৃষ্টিতে তাকায়। বন্ধুত্বে করুণা নেই অরিন।
-হুম, তুই না সবসময় বলতিস, এভরি ম্যান শ্যুড মার্ক হিমসেল্ফ এজ অ্যা হিউম্যান বিয়িঙ! তা নিজেকে কত দিস এখন?
-আগের চেয়ে অনেক কমে গেছে। তবে ফেইল করে যাই নি এখন অব্দি। আসলে চাকুরীটা পাবার পর থেকে শালারা খালি বুক ফুলিয়ে মিথ্যে বলতে শেখাচ্ছিলো। বসে বসে কি সব ভুয়া ডকুমেন্ট তৈরি করতে দিতো। তাই করতাম, একশ পিস মালের ভেতর পনের পিস দিতাম ছেঁড়া ফাটা নকল। এভাবে সত্য হয়ে গেলো ঠুনকো। তোর সাথেও বলা শুরু হল, প্রথমে খুব ছোট্ট একটা দিয়ে। সেটা লুকোতে গিয়ে মিথ্যার চক্র হওয়া শুরু করলো। হাহ হাহ হাহ, একদিন এভাবে, সব ভুস করে উড়ে গেলো। এখন মিথ্যে গুলো আমার সামনে ভেসে বেড়ায়, ধরে সত্য বানাবো তার উপায় নেই অরিন! এক মুহূর্তের মিথ্যে কে পরের মুহূর্তেও সত্য করা যায় না, বিকজ মোমেন্টস উইল নট রিটার্ন।

-হুম, সময়ের সাক্ষী বড় কঠিন। বব ডিলানের একটা কথা মিঠু খুব আওড়াতো, মনে পড়ে?
হাত মেলে বলে চলে অরিন। কথার নেশা তাকেও পেয়ে বসেছে। নিখিলেশের সঙ্গ চিরজীবনই মুখ চোরা অরিন কে ঝুম বৃষ্টির মত কথা বলিয়েছে হঠাৎ হঠাৎ।

-All of the thuth in the world adds up to one big lie. প্রতি মুহূর্তে সত্য বলা বড় কঠিন। আমার দাদু বাবা কে মরণকালে পুরো সংসার দিয়ে গিয়েছিলেন। বাবা সেই কথা রাখতে গিয়ে সারা জীবন মা’কে ছোট ছোট সব মিথ্যে দেখাতেন, যার কোনটাই পূরণ হয় নি। ভাই-বোনদের পাশাপাশি সন্তানদের মনে করতেন অতিরিক্ত ভারের মত।

ঘড়ির কাঁটাটা কি খুব আস্তে আস্তে ঘুরছে? সামনের দরজার ছিটকিনিটা খোলা কখন থেকে? চৌকিদার আজ নাক ডাকছে না যে? হাই তুলতে তুলতে নিচু গলায় বলে নিখিলেশ,

-বন্ধুত্ব কি দ্বিতীয়বার জন্ম নেয় অরিন?

এইবার খেপে উঠে অরিন, আলোতে তার মুখ গনগন করছে নিখিলিশের দিকে চেয়ে, ফ্যাসফ্যাসে স্বরে বলে,

-বিশ্বাসের পুনর্জন্ম হয় না রে হারামজাদা, জানিস না? আর বিশ্বাসহীন বন্ধুত্ব দেয়াল ছাড়া অচল বাড়ি।

বলে শূন্যে মিলিয়ে যায় অরিনের ছায়া। দপ করে নিভে যায় নিখিলেশের সিগারেট। কোণের টেবিল থেকে প্রচন্ড বাতাসে জানালার শার্সি ভেঙে পেপার ওয়েটটা উড়ে যায় জানালার বাইরে। তার পেছন উড়ে যায় কালিতে ভরা সাদা কাগজ, উড়ে যায় সব কাল্পনিক কথোপকথন।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.