নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আলী অয়ন

আলী অয়ন › বিস্তারিত পোস্টঃ

রক্তিম মাটি

২১ শে এপ্রিল, ২০১৫ দুপুর ১২:৩৯

কবর খোড়া শেষ হতেই মুখের ঘাম কাধের গামছা দিয়ে মুছতে মুছতে বাড়ি ফিরছিলো শফিক মিয়া। ঠিক কবর খোড়া নয় গর্ত খোড়া বললেই বেশি ভালো হয়। একটা বড় গর্ত খোড়া হয় আর তার মধ্যে ১০-১২ টা লাশ মাটি চাপা দেয়া হয়। প্রত্যেকটি লাশই থাকে মুক্তিযোদ্ধার। প্রথম প্রথম এই কাজটা যখন করত শাফিক মিয়া তখন তার বুকে কাঁটা বিধত। এখন আর সেই রকম মনে হয় না। একটা অভ্যাসের মত হয়ে গেছে। যেন এটাই তার কাজ। এটাই তার পেশা। মাঝে মধ্যে লাশগুলোর মধ্যে পরিচিত মুখ খোঁজার চেষ্টা করে সে। কিন্তু ব্যর্থ হয় প্রত্তেকবারই। গুলির আঘাত, রুলের বারি আর শক্ত বুটের লাথি খেয়ে এক একটা লাশের যেই অবস্থা হয় তাতে আর কাওকে চেনার উপায় থাকেনা। মাঝে মধ্যে সে ভাবে তার ১৬ বছরের ছেলেটাও হয়ত এরকম কোন গর্তের মধ্যে পড়ে আছে। কিংবা হতে পারে শফিক মিয়া নিজের অজান্তেই তার ছেলের লাশ চাপা দিয়েছে। আবার এটাও হতে পারে তার ছেলে এখনও বীরত্তের সাথে লড়াই করছে। তার যে আর ২টি ছেলে ছিল তারাও বেচে থাকলে হয়ত যুদ্ধ করত।

প্রথম যখন তাদের গ্রামে পাকিস্তানি সেনারা আক্রমন করেছিল তখন সবাই এক যোগে দৌড়িয়ে পালাতে থাকে। কিন্তু ঐ মুহূর্তে তারা যে কোনদিকে যাবে তারা তা জানতো না। শুধু জানতো জীবন বাঁচাতে হলে পালাতে হবে। শফিক মিয়া,তার স্ত্রী আর তাদের ১৬,২৪, আর ২৬ বছরের ছেলে কামাল,মতিন আর হোসেনও দৌড়াচ্ছিল। শফিক মিয়া,তার স্ত্রী আর কামাল একটু পিছিয়ে পড়েছিলো। মতিন আর হোসেন ব্যাপারটা খেয়ালও করেনি। এই সময় এমন অবস্থা ছিল যে কোন কোন মাও তাদের কোলের সন্তানকে ফেলে দৌড়াচ্ছিল। হঠাৎ আকাশ রাঙা করে মর্টারের একটা গোলা শফিক মিয়ার সামনে পড়ল ঠিক মতিন ও হোসেনের ওপর। চোখের সামনে শফিক মিয়া ও তার স্ত্রী তাদের সন্তানকে আর কামাল তার ভাইদেরকে ছিন্নভিন্ন হয়ে যেতে দেখলো। আর সেই সাথে আরও অনেককে। এইবার আর শফিক মিয়া আগাতে পারলোনা। স্ত্রী আর কামালকে নিয়ে ঢুকে পড়ল পাশের একটা বাড়িতে। এই বাড়িটাও ছিল ফাকা। ভয়ে সম্ভবত বাড়ির লোকজন পালিয়ে গিয়েছিল। ফাকা বাড়ি মনে করে কোন পাক সেনা বাড়ির ভেতর ঢুকবে না। তাই সেদিন রাতের মত তারা সেখানেই থেকে গেলো। শফিক মিয়ার ধারনাই ঠিক হল। বেশ কয়েকটা পাকিস্তানি জিপ বাড়ির সামনে দিয়ে গেলো। কিন্তু বাড়ির ভেতর কেওই ঢুকলোনা। কিন্তু সকালে উঠে তারা দেখল যে কামাল নেই। শুধু একটা চিঠি রেখে গেছে। শফিক মিয়া বা তার স্ত্রী কেওই পড়ালেখা জানতো না। কিন্তু তারা ঠিকই বুঝল চিঠিতে কি লেখা আছে। কামাল চলে গেছে দেশের জন্য যুদ্ধ করতে। যেই ছেলে কোনদিন একটা মুরগিও নিজের হাতে জবেহ করেনি আজ সেই ছেলে চলে গেছে যুদ্ধ করতে।
শফিক মিয়া আর তার স্ত্রী চলে আসে নিজেদের বাড়িতে। পাকিস্তানিরা যেহেতু একবার তাদের আক্রমন করে গেছে সেহেতু আবার নিশ্চয় এই গ্রামে আর আসবেনা। শফিক মিয়ার মত আরো অনেকেই এই চিন্তা করে ফিরে আসে গ্রামে। কিন্তু সবার ধারণা ভুল প্রমানিত করে পাকিস্তানিরা গ্রামের স্কুলে একটা ক্যাম্প বসায়। তারপর প্রত্যেক বাড়ি থেকে সকল পুরুষদের ধরে নিয়ে আসে। তারপর কাউকে রান্নার কাজে লাগায় দেয়,কাউকে বা গাছ কাটার জন্য,আবার কাউকে বা কাজে লাগায় ক্যাম্পের চারপাশে গোল করে গর্ত খুঁড়তে। আর শফিক মিয়ার ওপর পড়ে লাশ চাপা দেয়ার জন্য গভীর গর্ত খোঁড়ার দায়িত্ব। রতনের কাছে থেকে শফিক মিয়া জানতে পারে ক্যাম্পের চারপাশে যে গোল নালার মত গর্ত খোঁড়া হয়েছে সেতা হচ্ছে হঠাৎ মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমন ঠেকানোর জন্য।শফিক মিয়া শুধু একবার রতনকে কামালের চিঠি পড়তে বলে। রতন বলে যে কামাল লিখেছে ‘আমি যুদ্ধ করতে গেলাম’। একদিকে কামাল দেশের জন্য যুদ্ধ করছে আর আরেকদিকে শফিক মিয়ার উপর দায়িত্ব পড়েছে রাজাকার আর হানাদার বাহিনীর হাতে নিহত মানুষগুলোর জন্য গর্ত খোঁড়া। রাজাকাররা একজন দুইজন মুক্তিযোদ্ধাকে বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে খাঁচিয়ে এনে পাক সেনাদের হাতে দিয়ে দেয়। পাক সেনারা আবার তাদের মাথায় গুলি করে হত্যা করে। এইভাবে ৮-১০ টা লাশ জমা হলে শফিক মিয়ার ডাক পড়ে গর্ত খোঁড়ার জন্য।

এইসব নানা বিচিত্র জিনিস চিন্তা করতে করতে শফিক মিয়া যখন বাড়ি পৌঁছল ঠিক তখনি একটা পাকিস্তানি জিপ এসে থামল। একজন পাক সেনা জিপ থেকে নামলো। মেজর না জেনারেল এই সব শফিক মিয়া বুঝেনা। সে শুধু বুঝল তার সামনের পাক সেনাটা উচ্চ পদস্থ। ‘কেমন আছেন?’ পরিস্কার বাংলা ভাষায় জিজ্ঞেস করলেও উচ্চারনটা ছিল একটু অন্য রকম। উত্তরে শফিক মিয়া শুধু বলল ‘বাইচ্চা আছি’। উত্তর শুনে পাক সেনাটা একটু হেসে বলল ‘চা খাওয়াবেন’। ‘আহেন ভেতরে আহেন’ হাত বাড়িয়ে অনুরোধ শফিক মিয়া। কিন্তু পাক সেনাটা বলল ‘না বাইরেই বসি। একটা চেয়ার দিন।’ ঘরে একটা মাত্রই চেয়ার ছিল। সেটাতে পাক সেনাকে বসতে দিয়ে শফিক মিয়া নিজে বসে পড়ল মাটিতে। ‘চা হইতে একটু সময় লাগব।’ ‘সাধারাণত গ্রামে তো কারো বাসায় চা থাকেনা,’ একটু অবাক হয়েই বলল পাক সেনাটা। ‘আমার বড় পোলাডা চা খুব পছন্দ করত।’ ‘সে এখন কোথায়?’ ‘আমার বড় আর মাইজ্জা পোলাডা বোমাতে মরছে।’ শীতল কণ্ঠে জবাব দিলো শফিক মিয়া।‘আর ছোট ছেলে?’ একটু কৌতূহলী হয়েই জিজ্ঞেস করল পাক সেনাটা। ‘ছোটডায় পালায়ছে যুদ্ধ করতে’ এইবার আরও শীতল কণ্ঠে জবাব দিলো শফিক মিয়া। পাক সেনাটা অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ শফিক মিয়ার দিকে। শফিক মিয়ার স্ত্রী দুইজনকে চা দিয়ে গেলে চুপচাপ দুজনেই চা শেষ করল। তারপর জিপ নিয়ে চলে গেলো পাক সেনাটা। শফিক মিয়া একটা ব্যাপার খেয়াল করল যে তারা কেওই একজন আর একজনের নাম জিজ্ঞেস করেনি। অবশ্য প্রয়োজনও ছিলোনা।

পরদিন ভোরের আলো ফোটার আগেই শফিক মিয়ার ঘুম ভাঙলো হানিফ রাজাকারের ডাকে। ঘর থেকে বের হয়ে দেখল হানিফ রাজাকার,তার দলবল আর দড়িতে বাঁধা একটা ১৬-১৭ বছরের ছেলে। ছেলেটাকে দেখতেই শফিক মিয়ার কামালের কথা মনে পড়ে গেল। দড়িতে বাঁধা ছেলেটার জায়গায় শফিক মিয়া কামালকে দেখতে পেল। যেন কামালকেই ধরে এনেছে তারা। হানিফ রাজাকার বলল,‘শফিক মিয়া একটা কবর খুঁড়তে হবে। এই কুত্তাটাকে জ্যান্ত কবর দিব।’ ‘জিন্দা কবর দিবেন মানে? জিন্দা কবর দিবেন ক্যান?’ রীতিমতো প্রতিবাদ করে উঠল শফিক মিয়া। মুখটা একটু বিকৃত করে হানিফ রাজাকার বলল,‘এই ছোড়া আমার মুখে থুথু ছিটিয়ে বলে যে আমি নাকি বাংলার আরও একটা মীর জাফর।’ ‘কথা তো আর মিছা কয় নাই।’ সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিলো শফিক মিয়া। ‘মুখ কম চালাও,’ ধমকের সুরে বলল হানিফ রাজাকার। এইবার কাতর সুরে ছেলেটা বলল,‘বাবা, আপনাকে যা করতে বলছে তা করুন।’ শফিক মিয়ার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ল আর বলল,‘বাপ আমার,পৃথিবীর কোন বাপ এই কাম তার পোলার জন্য করতে পারবেনা।’ দাঁড়িতে আঙুল বুলাতে বুলাতে হানিফ রাজাকার বলল, ‘দেখ শফিক মিয়া,তুমি কিন্তু ভালো করেই জানো আমার কথা না শুনলে তোমার অবস্থা কি হবে।’ শফিক মিয়া সঙ্গে সঙ্গে হানিফ রাজাকারের সামনে এসে দাঁড়ালো ‘মারবেন? মারেন। এইছাড়া কী করবেন আপনি আর। আমারে মারলে যদি আরও দশটা অপদার্থ বুড়া যুদ্ধে যদি যোগ দেয় তাইলে তো ভালাই।’ ‘তবেরে’ একটা হুঙ্কার দিলো হানিফ রাজাকার। আর সঙ্গে সঙ্গে তার দলবল শফিক মিয়ার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। কিছুক্ষণ ধরে তারা শফিক মিয়াকে পেটাল। তারপর বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে খাঁচিয়ে মেরে ফেলে মাটিতে ফেলে দেয় শফিক মিয়া। আর দড়িতে বাঁধা অল্প বয়সী মুক্তিযোদ্ধাটা নিস্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে শফিক মিয়ার মৃত দেহের দিকে। তার শুধু মনে হল এই লোকটার জন্যই কি সে প্রাণে বেঁচে যেতে পারবে। তার নিজের বাবাও কি এই রকম সংগ্রামী হয়ে গেছেন। তারপর রাজাকারের দল দড়ি ধরে টানতে টানতে নিয়ে যায় ছেলেটাকে।

ঘরের ভেতর শফিক মিয়ার স্ত্রী ভয়ের চোটে নিজের মুখ নিজেই চেপে ধরেছিল। তারপর রাজাকারের দল চলে যেতেই বুক ফাটা আর্তনাদ করে উঠে সে। একে একে তার দুই ছেলে আর তার স্বামী এই পৃথিবী থেকে বিদায় নিল। এই তিনজনের কথা ভেবেই তার আবার মনে পড়ল কামালের কথা। কামাল কি এখনও বেঁচে আছে? সে কি আসবে ফিরে? যদি সে ফিরে এসে তবে শফিক মিয়ার স্ত্রীর একমাত্র আপনজন হবে কামাল।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.