নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আলী অয়ন

আলী অয়ন › বিস্তারিত পোস্টঃ

দ্য মাস্ক অব দ্য রেড ডেথ (অনুবাদ)

২৬ শে মে, ২০১৭ রাত ১১:২২

মুলঃ এডগার অ্যালেন পো
দেশটাকে ‘রেড ডেথ’ সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দিল। আজ পর্যন্ত কোন মহামারীর প্রাদুর্ভাবই এতটা বীভৎস হয়ে উঠেনি, এতটা ভয়ঙ্কর হয়নি। মানুষের রক্ত যেন এই মহামারীকে চিনার সীলমোহর, এর অবতার- চারিদিকে রক্তিম আভার আতঙ্ক, মানুষের মাথার তীব্র বেদনা ও তীক্ষ্ণ চিৎকার। আর তারপর ধীরে ধীরে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ার সাথে সাথে শরীরের প্রতিটি লোমকূপ থেকে বিচ্ছুরিত রক্তের অঢেল স্ত্রোত।
শরীরের সব অংশে বিশেষ করে মুখশ্রীর উপর রক্তিম দাগগুলোর কারণেই মড়কের অভিশাপ হিসেবে দাঁড়িয়েছে আক্রান্ত মানুষগুলো। এই অভিশাপই তাদেরকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে সারা জীবনের সঙ্গী-সাথীদের ভালোবাসা, সহানুভূতি ও আশ্রয় থেকে। তবে মাত্র আধা ঘণ্টা সময়ের মধ্যে ঘটেছে এই মহামারীর আক্রমণ, অগ্রগতি ও পরিসমাপ্তির কেরামতি।
কিন্তু প্রিন্স প্রস্পেরো রয়েছেন একদম হাসি-খুশি, নির্ভীক এবং ধীমান। যখন তার রাজত্ব অর্ধেক মানবশূন্য হয়ে পড়ল, তখন তিনি তার উপস্থিতিতে দরবারের নাইট এবং সম্রান্ত মহিলাদের মধ্য থেকে হাজারের বেশিও বন্ধুবান্ধবদের তার একটি দুর্গে তলব করলেন বলমাস্ক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের জন্য। যাতে তিনি তার নিঃসঙ্গতা দূর করতে পারেন। এই দুর্গটি হচ্ছে প্রিন্সের একটি বিশাল এবং জাকজমকশালী স্থাপনা, যেটা তৈরি করা হয়েছিল শুধুমাত্র তার খামখেয়ালী শখের বসে। পুরো স্থাপনাটি রয়েছে আড়ম্বরপূর্ণ উঁচু দেয়ালে ঘেরা, যার বিভিন্ন স্থানে প্রবেশের জন্য রয়েছে মজবুত লোহার দরজা। রাজসভায় প্রবেশের করিডরে প্রথমেই পড়ে বিশাল একটি অগ্নিকুণ্ড, যুদ্ধে ব্যবহার্য বড় বড় হাতুড়ী যেগুলো দেখে মনে হয় থরের বজ্র হাতুড়ী। একারণে সভায় প্রবেশের সময়ই হোক আর প্রস্থানের সময়ই হোক, যে কারও মনের হতাশা পরিণত হয় উন্মত্ততায়।
দুর্গের পুরো মঠটাই এখন রাজরক্ষীদের দ্বারা কানায় কানায় পূর্ণ। যেন রাজসভাসদের কেউ বাইরের দুনিয়ার ছোঁয়াচে রোগের সংস্পর্শে কোনভাবেই না আসতে পারে, বাইরের দুনিয়া যেন নিজেই এটি সামলিয়ে নিতে পারে। এই সময় এসব নিয়ে দুশ্চিন্তা বা অনুশোচনা করার কোন মানেই হয় না।
প্রিন্স সবার আমোদ-প্রমোদের জন্য সব ধরণের ব্যবস্থাই করে রেখেছেন। এর মধ্যে রয়েছে ভাঁড়, ব্যালে-শিল্পী, সংগীত শিল্পী, রয়েছে অপ্সরীদের আনাগোনা এবং ওয়াইন। সবকিছুই রয়েছে রাজরক্ষীদের নিরাপত্তার মধ্যে, শুধু নেই ‘রেড ডেথ’।
মোটামুটি পাঁচ-ছয় মাস পার হয়ে গেছিল প্রিন্সের নিঃসঙ্গ জীবন-যাপনের। কিন্তু বাইরের দুনিয়া যখন প্রবল মহামারীতে আক্রান্ত, তখন প্রিন্স নিজেকে আবদ্ধ করে নিলেন নিজের হাজারও বন্ধু-বান্ধব সহ অপূর্ব জাঁকজমকপূর্ণ বলমাস্ক অনুষ্ঠানে।
বলমাস্ক অনুষ্ঠানে সবার অংশগ্রহণটা যেন রীতিমত ইন্দ্রিয়পরাণতাপূর্ণ। কিন্তু প্রথমে আমাকে বলতে দাও কোন কক্ষে এটি অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এটি একটি কক্ষে নয় বরং অনুষ্ঠিত হচ্ছে সাতটি চ্যাম্বারের একটি রাজকীয় স্যুটে। সাধারণত সব প্রাসাদের দরজাগুলো খুলে দুইপাশে দেয়ালের সাথে লাগিয়ে রাখা যায়, যাতে স্যুটের ব্যপ্তির প্রদর্শন কোনভাবেই ব্যাহত না হয়। কিন্তু এখানে ব্যাপারটা একেবারেই ভিন্ন, যেমনটা ডিউকের উদ্ভট চিন্তা-ভাবনা থেকে আশা করা যায়। এখানে প্রতিটা চ্যাম্বারের অবস্থান এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে, যেন একটা চ্যাম্বার থেকে আরেকটা চ্যাম্বার নজরে না আসে। চ্যাম্বারগুলোর প্রতি বিশ-ত্রিশ গজ দূরে দূরে রয়েছে তীক্ষ্ণ বাঁক, যার মধ্যেও রয়েছে কাব্যিক সৌন্দর্য। প্রতিটা দেয়ালে ভৌতিক দর্শনের একটা করে লম্বা ও সরু জানালা রয়েছে, কিন্তু এর ভেতর দিয়ে স্যুটের বিশালত্ব সহজেই অনুধাবন করা যায়। প্রত্যেকটি জানালা তৈরি স্টেইন্ড গ্লাসে এবং গ্লাসগুলো আবার চ্যাম্বার অনুযায়ী বিচিত্র রঙ্গে রাঙ্গান। যেমন স্যুটের এক প্রান্তসীমার নীল চ্যাম্বার অনুযায়ী জানালার কাঁচও উজ্জ্বল নীলচে। দ্বিতীয় চ্যাম্বারটির সজ্জা ও পর্দা অনুযায়ী জানালার শার্সিগুলো রক্তিম বর্ণের। তৃতীয় চ্যাম্বারটির দেয়াল সবুজ রঙের, সেই সাথে জানালার কাঁচও সবুজ। চতুর্থটি হালকা কমলা রঙ্গে ফার্নিশ করা, পঞ্চমটি সাদা এবং ষষ্ঠতমটি বেগুণী। সপ্তম এবং শেষ চ্যাম্বারটি দেয়াল থেকে মেঝে পর্যন্ত কালো ভেলভেটের পর্দা এবং কার্পেটের আবরণে পরিপূর্ণ। কিন্তু একমাত্র এই চ্যাম্বারটি অন্য চ্যাম্বারের মত ঐতিহ্য বজায় রাখেনি। এই চ্যাম্বারের শার্সিগুলো শরীরের লাল রক্তের ন্যায় রক্তিম।
তবে, সাতটি চ্যাম্বারের কোন চ্যাম্বারেই কেউ মোমবাতি বা ঝাড়বাতিদানের স্থান দেয়ার কথা চিন্তা করেনি-সচরাচর যেমনটা দেখা যায়, কিছু ঝাড়বাতি ইতস্ততভাবে ছাদের সাহায্যে সবসময় ঝুলে। এমনকি স্যুটের কোথাওই কোন মিটমিটে আলোর প্রদীপ বা মোমবাতি নেই। তাই এখানেও আলোর ব্যবস্থাটি ভিন্ন। প্রত্যেকটি করিডরের সবগুলো জানালার বিপরীতে কিন্তু খুবকাছেই একটি করে লম্বা ত্রিপদ রাখা আছে, যার একদম উপরে তাম্রকার আবরণের ভিতর সবসময় অগ্নিকুণ্ড জ্বলছে। আর এই অগ্নিকুণ্ডগুলো এমনভাবে স্থাপন করা যেন আলোগুলোর রেখা সরাসরি শার্সি ভেদ করে চ্যম্বারগুলো উদ্দীপ্ত করে তুলে। আর তাই রাতের পরই চ্যাম্বারগুলোতে বেশি জাঁকজমক অবস্থার সৃষ্টি হয়। কিন্তু সপ্তমটি চ্যাম্বারটির শার্সিগুলো দিয়ে আলো এমনভাবে ছড়িয়ে পড়ে যে পুরো ঘরটির মধ্যে বিবর্ণতা ছড়িয়ে পড়ে; যেই এতে প্রবেশ করে, তার মধ্যে একটা পাশবিকতা ছেয়ে যায়। একারণেই একমাত্র এই চ্যাম্বারটিতে সহজে কেউ পা রাখার কথা চিন্তা করেনা।
এই চ্যাম্বারটির পশ্চিম দেয়ালে আবলুস কাঠে তৈরি বিশাল একটা ঘড়ি দাঁড়িয়ে আছে। ঘড়িটার পেণ্ডুলাম সারাদিন ইতস্ততভাবে খুবই ধীরে কিন্তু একঘেয়ে ঝনঝনে শব্দে এদিক-ওদিক ঘোরে। তবে, ঘণ্টার কাঁটা নতুন কোন অঙ্কে পৌঁছালেই ঘড়িটি থেকে ভিন্ন একটি শব্দ উচ্চারিত হয়, যেটি বেশ জোরাল ও স্পষ্ট এবং অবশ্যই সুশ্রাব্য/সুরেলা। কিন্তু এর সাথে মজার ও উদ্ভট একটি ব্যাপার হল প্রতি ঘণ্টা অতিবাহিত হওয়ার সাথে সাথে বাদকদলকে তাদের সঙ্গীত-সাধনা থামিয়ে দিতে হয়, যাতে ঘণ্টার শব্দটা স্পষ্টভাবে সবাই শুনতে পায়। আর এই ঘণ্টার সাথে সবার প্রাণোচ্ছল ও আনন্দপূর্ণ সময়টাও যেন থমকে যায়, যতক্ষণ পর্যন্ত না সেটি আবার থেমে যায়। এটা লক্ষণীয় যে এই সময়ে সম্পূর্ণ বিবেচনাশূণ্য মানুষটিও পড়ে যায় হয় গভীর ধাঁধার মধ্যে, না হয় ধ্যানের মধ্যে। কিন্তু ঘড়ির ঘণ্টা থেমে যেতেই আবার অতিথিবৃন্দের মাঝে ছড়িয়ে পড়ে মৃদু হাসির খেলা। বাদকদলের একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে হালকাভাবে হাসে নিজেদের স্নায়বিক দুর্বলতা ও মূর্খতার কথা ভেবে। তারা একজন আরেকজনকে ফিসফিস করে এটাও আশ্বাস দেয় পরেরবার এমন অভিব্যক্তি আর তাদের মাঝে আসবে না। তারপর আবার সময় এগিয়ে যায়, তিন হাজার ছয়শ সেকেণ্ড পার হতেই আবার সেই নিস্তব্ধতা, আবার সেই পূর্বের ধ্যানে সবার হারিয়ে যাওয়া।
এরপরেও বেশিরভাগ সময় যে আমোদ-প্রমোদ অবস্থাটা বিরাজ করে সেটি অবশ্যই অন্য রকমের। ডিউকের চিন্তা-চেতনা ও পছন্দ একদমই আলাদা ধরণের। তার পরিকল্পনাগুলো সবসময়ই সপ্রতিভ ও অগ্নিসদৃশ। এবং তার চিন্তা-চেতনা হছে আদিমের মত দ্যুতিময়। অনেকেই ভাবতে পারে সে একটা পাগল। কিন্তু তাকে বুঝতে হলে একজনের প্রয়োজন সবসময় প্রিন্সকে সামনে থেকে দেখা, তার কথাগুলো শোনা, এমনকি তাকে স্পর্শ করে দেখা।
ডিউক অনুষ্ঠানপর্বটি পরিচালনা করছেন একদম অন্যভাবে, সাতটি চ্যাম্বারে আধিপত্য বিস্তারের মাধ্যমে, নিজস্ব রুচির মাধ্যমে। এটা তার নিজস্ব দক্ষতা অনুষ্ঠানে আগত বল মাস্ক পরিহিতদের পরিচালনা করার। এবং অবশয়ই উদ্ভট প্রকৃতির। তাই এখানে সবধরণের গৃহসজ্জাই হচ্ছে চোখে লাগার মত, ঝলমলে মুহুর্ত, মনোরম তীব্রতায় ভরপুর পরিবেশ এবং দৃষ্টিভ্রমতা- যা শেষবার দেখা গেছিল ভিক্টর হুগোর ‘হেরনানি’তে। যেখানে ছিল ব্যালে নাচের ভঙ্গিতে বিশেষভাবে সাজান গৃহসজ্জার ছায়া, উন্মাদ মানুষের কল্পনাবিলাসী উন্মত্ততা; যার মধ্যে রয়েছে অধিক সৌন্দর্য, অধিক উচ্ছৃঙ্খলতা; কিছুটা অস্বাভাবিক, কিন্তু কখনই বিতৃষ্ণাকর নয়।
প্রকৃতপক্ষে এইকারণেই সাতটি চ্যাম্বারের সবগুলোতেই বিভিন্ন রকমের স্বপ্ন ইতস্ততভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আর এই স্বপ্নগুলোই প্রত্যেকটি চ্যাম্বারের রঙের সাথে বাদকদলের সঙ্গীত পরিণত করছে পদচারণার শব্দে। আর শীঘ্রই তখন আঘাত হানল ভেলভেট হলের আবলুস কাঠে নির্মিত ঘড়িটি। তারপর কিছুক্ষণের জন্য সবকিছু আবার নিস্তব্ধ, ঘড়ির ঘণ্টার সাথে সবাই নিশ্চুপ। আর সবপ্নগুলোও তখন কোন এক অদৃশ্য জালে আটকা। কিন্তু ঘণ্টার প্রতিধ্বনি থেমে যেতেই-তাৎক্ষণিক স্তব্ধতা সহ্যের বাইরে যেতেই-আবার আলো জ্বলে উঠল। মৃদু হাসির খেলা ছেয়ে গেল সবার মাঝে। আর এখন, আবার যখন সুরেলা ধ্বনি বেজে উঠল, স্বপ্নগুলোও জাল ছিড়ে ফেলল। ত্রিপদ থেকে বিচ্ছুরিত আলোর সাথে সাথে সবপ্নগুলোও ভেসে বেড়াতে শুরু করল রং-বেরঙ্গের চ্যাম্বারগুলোর মাঝে। কিন্তু রাত যত ফুরাচ্ছে, একদম পশ্চিমের চ্যাম্বারটিতে প্রবেশের ঝুঁকি কেউই নিতে চাচ্ছেনা, যখন রক্তমাখা শার্সিগুলো দিয়ে লাল আলোর শিখা আরও তীব্রতর হয়ে পড়েছে, কৃষ্ণবর্ণের আচ্ছাদনের কালিমা আরও আতংকিত করে তুলেছে; এবং যখনই কারো পা কালো গালিচায় এসে পড়ছে, তখন আরও সতেজভাবে, অন্য চ্যাম্বারের উল্লাসধ্বনির থেকেও বেশি জোরালভাবে সেই ঘড়ি থেকে একটা চাপা নিনাদ কানে এসে লাগছে।
কিন্তু বাকি চ্যাম্বারগুলো অনেক লোকজনে ভরপুর, যাদের মধ্যে হৃদয়বান লোকের সংখ্যা খুবই কম। আর পানভোজৎসবও চলতে থাকবে, যতক্ষন না পর্যন্ত মধ্যরাতের ঘণ্টা না বাজে। আর তারপর আমি যেমনটা বলেছিলাম, গান-বাজনা থেমে যেতেই অতিথিদের আনোন্দৎসবটাও থেমে গেল। কিন্তু এখন যেহেতু ঘড়িতে বারটি স্পন্দন সম্পন্ন হওয়ার কথা, যেটার পরিসমাপ্তি এইমাত্র ঘটে গেছে; সবাই একটূ সময় পেল নতুন আগন্তুকের মুখোশের দিকে চোখ বুলানোর। তার উপস্থিতির কথা হলের সবার মাঝে ঝড়িয়ে পড়ল ফিসফিসানিতে। সেইসাথে হালকা একটা বিরক্তি, অননুমোদের প্রকাশ এবং বিস্ময়, তারপর শেষপর্যন্ত ভয়, আতঙ্ক, এবং ন্যাক্কার।
এই অপচ্ছায়ামুক্ত জনতার মাঝে, যেমনটা আমি বর্ণনা করেছিলাম, সাধারণ কোন ব্যক্তির উপস্থিতি অবশ্যই সংবেদনশীল করে তুলবেনা। তবে, এটা সত্য যে, এই বলমাস্ক অনুষ্ঠানের কোন শেষ নেই; কিন্তু নতুন এই আগন্তুকের উপস্থিতি এখন প্রিন্সের গৃহসজ্জার থেকেও বেশি নজর কাড়ছে। এমনকি সবচেয়ে বেপরোয়া ব্যক্তির হৃদয় স্পন্দনও এখন বেড়ে গেছে, যেটা কেবলমাত্র স্পর্শ দ্বারা বোঝা সম্ভব। এমনকি সেই ব্যক্তিও চিন্তায় পড়ে গেছে যার কাছে জীবন-মৃত্যু উভয়ই ঠাট্টা স্বরূপ। অতিথিবৃন্দের এখন সবাই গভীরভাবে অনুভব করছে এই অবাক করা বেশধারী ব্যক্তিটির মাঝে না আছে আক্কেল না আছে শোভনতা। অস্থিচর্মসার ব্যক্তিটি বেশ লম্বা এবং মাথা থেকে পা পর্যন্ত পুরো শরীরই কারবালার কাল পোশাকে ঢাকা। যে মুখোশটি দ্বারা তার মুখশ্রী ঢাকা, সেটি তার চেহারার এতটাই অনুরুপ যে একদম কাছে থেকেও সুবিবেচনার মাধ্যমে খুত ধরা সম্ভব নয়। তারপরেও লোকটিকে কেউই ভাল চোখে দেখছে না। কেননা, ‘রেড ডেথের’ মতই তার সবকিছুই ঠেকছে। তার পরনের পোশাকটি লাল রক্তে সিক্ত- এবং তার বড় ভ্রু দুটোও, যেগুলো চোখে পড়ার মত, ভয়ঙ্কর রাগে আরও চওড়া হয়ে আছে।
যখন প্রিন্স প্রস্পেরোর দৃষ্টি এই ভুতুড়ে অবয়বের উপর পড়ল, প্রথম মুহুর্তে হয় আতঙ্কে না হয় আক্রোশে তীব্র একটা চিৎকারে প্রকম্পিত হল সবকিছু । তারপরই তার ভ্রুদুটি লাল হয়ে রাঙ্গিয়ে উঠল প্রচণ্ড ক্রোধে।
“কার এত বর সাহস”- তিনি প্রশ্ন করলেন আগন্তুককে। “কার এত বড় স্পর্ধা এরকম শ্বরনিন্দাপূর্ণ উপহাস করার? একে ধরে এর মুখোশ টেনে খুলে ফেলো- যাতে আমরা জানতে পারি সূর্যাস্তের সাথে সাথে কাকে ফাঁসিতে ঝুলাতে যাচ্ছি!”
এটা হচ্ছে পূর্বের অর্থাৎ নীল চ্যাম্বারটি, যেখানে প্রিন্স প্রস্পেরো গর্জন করে যাচ্ছেন। খুব জোরালো ও স্পষ্টভাবেই সেই প্রতিধ্বনি ছড়িয়ে পড়ছে সাতটি চ্যাম্বারেই; যেহেতু প্রিন্স প্রস্পেরো একজন বলিষ্ঠ ও উদ্ধত ব্যক্তি, যার হাতের এক ইশারাতেই সমস্ত গান-বাজনা থেমে গেছে।
এটা হচ্ছে সেই নীল চ্যাম্বারটি। যেখানে প্রিন্স প্রস্পেরো দাঁড়িয়ে আছেন, সাথে একপাল হতবুদ্ধকর রাজসভাসদ। প্রথমে যখন প্রিন্স কথা বলা শুরু করেছিলেন, তখন সামান্যই এগিয়েছিলেন আগন্তুকের দিকে। প্রিন্স যত সতর্ক ও মহিমান্বিতভাবে পা ফেলছেন, তত তার কাছে এগিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু এই নামহীন ব্যক্তিটি অনুষ্ঠানের সবার মাঝে আলাদা একটা অনুভুতি নিয়ে এসেছে। কেউই এগিয়ে যাচ্ছেনা তাকে থামানোর জন্য। সে একের পর এক প্রিন্সের রক্ষীদের পার করে এগিয়ে আসছে; আর যত এগিয়ে যাচ্ছে তত বেশি অতিথিরা সরে যাচ্ছে চ্যাম্বারের মাঝে থেকে দেয়ালের দিকে। লোকটা এগিয়ে যাচ্ছে দৃঢ়প্রতিজ্ঞভাবে। যেমনভাবে সে প্রথম চ্যাম্বার পার করেছিল- নীল থেকে লাল,-লাল থেকে সবুজ-সবুজ থেকে কমলা-তারপর সাদা-তারপর বেগুণী, কেউই তাকে অ্যারেস্ট করার কথা চিন্তা করেনি। আর তখনই প্রিন্স প্রস্পেরো রাগে ও নিজের রক্ষীদের ভীরুতায় লজ্জা পেয়ে ছয়টা চ্যাম্বারের একটির পর একটি পার করে এগিয়ে আসতে শুরু করলেন, কিন্তু তাকে কেউই অনুসরণ করল না। মাত্র তিন-চার ফুট দূরে থাকতেই তিনি তার নকশা করা খঞ্জরটি বের করলেন, এবং তখনই উপস্থিত হলেন ভেলভেট চ্যাম্বারে। কিন্তু তারপরেই একটা তীক্ষ্ণ আর্তনাদ- কৃষ্ণ গালিচার উপর শব্দহীনভাবে আছড়ে পড়ল খঞ্জরটি। এরপর প্রথম হাটুর উপর ভর করে, তারপর সম্পূর্ণ আছড়ে পড়ে মৃত্যুকে আলিংগন করলেন প্রিন্স প্রস্পেরো। একটু আগে যেই ব্যক্তিগুলো যখন সরে গেছিল দেয়ালের দিকে, এখন সেই কালো চ্যাম্বারে এসে, সেই বুনো সাহসিকতা উপলব্ধি করে, মাথা নত করল লম্বা দেহধারী ব্যক্তিটির সামনে। যে এখনও ভাবলেশহীনভাবে দাঁড়িয়ে আছে ঘড়ির ছায়ার নিচে; হা করে শ্বাস নিচ্ছে বারবার
এখন সবাই টের পেয়ে গেছে ‘রেড ডেথ’এর উপস্থিতি। সে এসেছিল রাতের বেলায় একদম চোরের মত। কিন্তু এখন একজনের পর একজনকে রক্তসিক্ত করতে শুরু করল পানভোজৎসবের সবাইকে; এবং তার পদচারণার সাথে আছড়ে পড়তে শুরু করল একে একে। কিন্তু ঘড়িটির জীবনীশক্তি চলতে থাকল এই শেষ উৎসবটির সমাপ্তির পরেও। তারপর ধীরে ধীরে নিভে গেল ত্রিপদের আলোগুলো একসময়। এবং এক ‘রেড ডেথ’ এর কালিমা ছড়িয়ে পড়ল সবকিছুর উপরেই।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.