![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
‘গত পরশু সন্ধ্যায় মা চলে গেলেন। বাহাত্তর বছর আগে শুরু হওয়া এক উপন্যাসের সমাপ্তি হলো। ভালোই হলো। শেষ দিকে এসে খুব কষ্ট পাচ্ছিলেন। আমিও যেন ক্লান্তির শেষ ধাপে পৌছে গিয়েছিলাম। গত দু’রাত নির্ঘুম কাটিয়ে, আজ ভোরে তোমাকে মেইল করবো বলে বসেছি। বিচিত্র এক অনুভুতিতে ছেয়ে আছে মন। মা চলে যাবার তীব্র একটা কষ্ট, শোক, নিদারুণ একাকিত্ব, পাশাপাশি বহুদিনের ক্লান্তি, পরিশ্রম আর দুশ্চিন্তা থেকে পরিত্রান পাবার শরীর অবশ করা এক প্রশান্তি। হাসপাতাল থেকে ফোনটা পাবার পর শরীরের প্রতিটা কোষ যেন স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলো। বেয়াল্লিশ বছর ধরে স্মৃতি জুড়ে, মন জুড়ে, শরীর জুড়ে ভালোবাসার আঁচড়, স্লেটের লেখার মতো কে যেন এক ঘষায় মুছে দিলো। পুরো শরীরজুড়ে লেপ্টে থাকা একটা মানুষের অস্তিত্ব এভাবেই এক ফুঁৎকারে নিভে যায়? টেলিফোন কানে চেপে বসে রইলাম অনেকক্ষণ। কোথায় যাবো? কাকে জানাবো? মরদেহ নিয়ে কি করতে হয়? আমিতো কিছুই জানি না।...’
ছুটির দিন সকালে নাশতা সেরে বিছানায় আধশোয়া হয়ে ল্যাপটপ কোলে নিয়ে ই মেইল খুলতেই শায়লার মেইলটা চোখে পড়লো আরিফের। শায়লার মা মারা গেলো, শায়লার জীবনে এতো বড় একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেলো, অথচ শায়লা ওকে জানালো না! পুরো স্ক্রিনজুড়ে শায়লার মুখ ভেসে ওঠে। কি ভীষণ একা হয়ে গেলো শায়লা। রফিক সাহেবের সাথে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে বছর সাতেক আগে। বাচ্চা হয়নি ওদের। সেই থেকে মা’কে জড়িয়ে ধরেই যেন শ্বাস নিচ্ছিলো ও। চোখ বন্ধ করলেই শায়লার যন্ত্রণাকাতর, পাণ্ডুর, ফ্যাকাসে মুখটা দেখতে পাচ্ছিলো আরিফ। ‘ভাবছিলাম তোমাকেই ফোন করে দেই, বলি, তুমি যা ইচ্ছে করো। বাসা থেকে বেরুতে ইচ্ছে করছিলো না। আমি কখনো লাশ দেখতে পারি না। একজন মানুষ, একটা জীবন কি অদ্ভুত নিয়মে ন্যাপথলিনে মিলিয়ে যায়, সাদা চাদরে মোড়া অচল একটা শরীর পড়ে থাকে দৃষ্টির সীমানা জুড়ে ... আমার খুব কষ্ট হয়। তুমি তো জানো বছর চারেক ধরে মা আলঝেইমারস’এ ভুগছিলেন। আমাকে চিনতেনই না। কখনো ছোট বোন, কখনো সিস্টার, কখনো ডাক্তার। কতো কথাই না বলতেন! আমি কেবল মাকে জড়িয়ে ধরে বসে থাকতাম। মা’র শরীরের গন্ধ নিতাম। কখনো বলতেন, ‘হ্যাঁরে রুমলি (মা’র ছোট বোন), তোর ছোট ছেলেটাকে আমাকে দিয়ে দে না, তোর তো তিনটেই ছেলে। আমি বুড়ো হয়ে গেলে আমাকে কে দেখবে বল? আমারতো সেই এক মেয়ে, ওর বিয়ে হয়ে গেলে, একা আমি কোথায় যাবো? আমার যে একা খুব ভয় করে! তোর দুলাভাইয়ের সাথে বিয়ে হলো সেই পনর বছর বয়সে, মানুষটা কখনো আমাকে একা থাকতে দেয়নি। দেশে থাকুক, বিদেশে, বাক্স প্যাটরার সাথে আমাকেও বগলে চেপে ধরে ছুটেছে। কি পাগল ছিলো লোকটা বল! কখনো বলতাম, দু’দিনের জন্যে যাচ্ছো, আমাকে কেনো? একা ঘুরে এসো। লোকটা বলতো, আমার ঘরের বাইরে যেতে ভালো লাগে না। তুমি গেলে, কাজ শেষে যখন ফিরবো, মনে হবে ঘরেই ফিরেছি। তোমার হাতের রান্না, তোমার পাশে বসে টিভি দেখা বা পেপার পড়া, গল্প করা... কোন দামে এদের ছাড়ি বলো? কখনোবা আমাকে সিস্টার ভেবে মুখ গোমড়া করে বসে থাকে। ঔষধ খাবে না। বলে, আমার মেয়ে আসুক! আমি অবুঝ শিশুর মতো বৃদ্ধা মা’কে জড়িয়ে ধরে বসে থাকি। আমার স্মৃতিতে জেগে থাকে আমার তরুণী মা আর চার বছরের আমি। মা’র একজোড়া নুপুর ছিলো। বাবা কিনে দিয়েছিলেন। বাবা অফিসে চলে গেলেই নুপুরজোড়া বের করে একটা মা পড়তেন, আরেকটা আমাকে পড়িয়ে দিতেন। তারপর শুরু হতো আমাদের লুকোচুরি খেলা। নুপুরের শব্দে একজন আরেকজনকে খুঁজে বের করার পালা। ছোট ছিলাম, বুঝতে পারতাম না, কার নুপুরের শব্দ কানে বাজছে, আমার নাকি মা’র। সেই ছুটোছুটিতে আমাদের সারা বাড়ি রিমঝিম রিমঝিম শব্দে যেন পরী রাজ্য হয়ে যেতো...’ তোমার এতো বড় একটা শোকের দিনে আমাকে কেন ফোন করলে না শায়লা? টুপ টুপ করে অভিমানের মেঘ জমতে থাকে আরিফের মনে। অথচ ওকি যোগাযোগ রেখেছিলো? মাস তিনেক আগেও দিনে কয়েকবার কথা হতো ওদের। কখন ঘুমোচ্ছে, কখন জাগছে, কি খাচ্ছে, কোথায় যাচ্ছে, কোত্থেকে আসছে...। আর তারপরই প্রতিটা সম্পর্কে যা হয়, আকাঙ্খার চারা গাছ নিজেদের অজান্তেই বাড়তে বাড়তে মহীরুহ, যার ভার বওয়া যায় না কিছুতেই। ছাঁটতে হয়। ছাটতে গিয়েই কষ্ট, যন্ত্রণা, অভিমান। সম্পর্কের গিঁট আলগা হয়ে যায়।
এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের সিনিয়র ইকোনোমিস্ট শায়লা আহমেদের সাথে আরিফের পরিচয় বছর পাঁচেক আগে হোটেল শেরাটনে রিহ্যাব মেলায়। মার্কেটিংয়ে এমবিএ করা আরিফ তখন সবে একটা ডেভেলপার কোম্পানিতে সেলসে জয়েন করেছে। শায়লা ওদের মগবাজারের জমিটা ডেভেলপ করার ব্যাপারে স্টলগুলো ঘুরে ঘুরে কথা বলছিলো। ছাত্রজীবনে তুখোড় বিতার্কিক আরিফ ততদিনে তার নিখুঁত উচ্চারণ, শব্দ চয়নে পারদর্শিতা আর সাবলীল রসবোধ দিয়ে বিপণন জগতে উদীয়মান তারকা খ্যাতি পেয়ে গেছে। যে কারো চোখে চোখ রেখে ওর কথায় সায় আদায় করে নেয়াটা ওর কাছে ছেলেখেলা। কিনতু শায়লার চোখে ছিলো অন্যকিছু। সেই টলটলে মায়াময় চোখদুটো যেন আরিফের ভেতরটা খোলা বইয়ের মতো পড়ে নিয়েছিলো। আরিফের মাথাটা ফাঁকা হয়ে গিয়েছিলো। ও কেবল বলেছিলো, ‘আপনার কার্ডটা রেখে যান, দুদিন পর আমাদের ইঞ্জিনিয়ার সহ আপনার কাছে আসছি। আমরা এটা নিশ্চিত করতে পারি যে বাজারের সেরা অফারটাই আমরা আপনাকে দেবো।‘ শরীর কিংবা মুখের ভাষা ছাড়িয়ে ওর চোখে নিদারুণ একটা আকুতি ঠিকরে বেরুচ্ছিলো, যেটা শায়লার দৃষ্টি এড়ায় না। শায়লারও জানার একটা আগ্রহ চেপেছিলো, ছেলেটা কি চায়! ওদের চলমান কিছু প্রজেক্ট নিয়ে কিছুক্ষণ আলাপ করে আরিফের হাতে কার্ড রেখে শায়লা বেরিয়ে পড়েছিলো মেলা থেকে।
দু’দিন পর আরিফ ওদের এক ইঞ্জিনিয়ার সহ শায়লার ঠিকানায় গিয়ে হাজির হয়। চাকুরী, সেমিনার, পাবলিকেশন্স, পড়াশোনা এসবের পাশাপাশি অসুস্থ মায়ের সেবায় শায়লার রাত দিন এক হয়ে গিয়েছিলো। অতোসব বাঁধা ডিঙ্গিয়ে আরিফদের সাথে দু’বার বসে শায়লা। মগবাজার-বাংলামটর সড়কের পাশে শায়লাদের জমিটার প্রতি অনেকেরই চোখ পড়েছিলো। বিষয়টা বুঝতে পেরে এমডি স্যার নিজে আরিফকে ডেকে ডিল’টার গুরুত্ব বুঝিয়ে দেয়, অথচ শায়লার ব্যস্ততার জন্য কিছুতেই সময় নিয়ে বসে কথা পাকা করতে পারছিলো না। একদিকে শায়লার ব্যস্ততা, অন্যদিকে এমডি সাহেবের চাপ, আরিফের পাগল হবার দশা। তবে একটাই আশার কথা, শায়লা এবং আরিফের সম্পর্কটা এখন অনেক কাছের। নিয়মিত কথা হচছে। একে অন্যকে ওর ‘তুমি’ বলেই সম্বোধন করে। নভেম্বরের শেষ তখন। শীতের শুরুতে ওদের কাজের ব্যস্ততা বেড়ে যায়। এমনি এক সময়ে আরিফের মোবাইলে শায়লার ফোন আসে, ‘হাতে কিছু সময় নিয়ে আজ সন্ধায় আমার বাসায় আসতে পারবে?’ সময়ের ফোয়ারা হাতে নিয়ে অপেক্ষমান আরিফ অস্থির অপেক্ষার কিছু ঘণ্টা পার করে সন্ধ্যার মুখেই শায়লার বাসায় চলে আসে। শায়লা পুবের বারান্দায় বসা। বারন্দার সামনে হাত দশেক চওড়া একটা বিদেশী ফুলের বেড। বাড়ির পুব পাশে একটা পুরনো কাঠ বাদাম গাছ। তার ঝাঁকড়া ডাল পালা বারান্দার কোনা অব্দি পৌঁছেছে। সন্ধ্যার অন্ধকার ঐখানটায় বেশ ঘন হয়ে জমেছে। শায়লা বাড়ির ভেতরমুখি দরজাটার পাশ ঘেঁষে বসেছে। আরিফ মূল গেট ঠেলে ঢুকতেই শায়লা আরিফকে ডেকে বারান্দাতেই বসায়। শায়লা নীলচে রঙের একটা শাড়ি পড়েছে, গায়ে পাতলা একটা চাদর। আরিফ চেয়ারে বসতেই শায়লা বললো,
‘খানিক পরেই মশার কামড়ে টেকা যাবেনা, উঠে পড়তে হবে, এখন একটু বসি। সন্ধ্যার মুখে এই হিম হিম ভাবটা আমার বেশ লাগে। তোমার অসুবিধে নেই তো?’
‘নাহ, ধানমন্ডি থেকে মগবাজার অব্দি জ্যাম ঠেলে এসেছি, বাইরেই খানিক বসি।‘
তারপর খানিক কুশল বিনিময় শেষে আচানক শায়লা বলে,
‘আজ রফিকের সাথে আমার ডিভোর্সের আইনগত ব্যাপারটাও মিটে গেলো... কেমন একটা অবাক করা শুন্যতায় ছেয়ে আছে মনটা। যদিও রফিক আর আমি দু’বছর আগেই আলাদা থাকা শুরু করি। তারপরেও মনে হতো কোথাও অদৃশ্য কোন সুতোর গিঁট রয়ে গেছে। হাত পা ছড়াতে গেলেই কেমন যেন টান পড়তো। আজ সব শেষ হয়ে গেলো, ভাবলাম কারো সাথে বসে খানিক আড্ডা দিই। আমারতো চেনা জানা তেমন কেউ নেই, তাই তোমাকেই ফোন দেয়া... আমার জীবনটা জানো, কেমন করে যেন যন্ত্রের মতো হয়ে গেলো। চাকরি, পড়াশোনা আর এর পাশাপাশি মা’র অসুস্থতা। নিজের জন্যে, একান্ত নিজেকে নিয়ে কবে ভেবেছি আজ বোধকরি ভুলেই গেছি।‘
অন্ধকার জমে এসেছে। দূর থেকে আসা রাস্তার বাতির আলোয় শায়লার মুখের এক পাশটা ফ্যাঁকাসে, হলদেটে দেখাচ্ছে। ও কেমন বিষণ্ণ, গম্ভীর। কথাগুলো মনে হচ্ছে অনেক দূর থেকে ভেসে আসছে, ক্লান্ত স্বর। আরিফ চুপচাপ শুনছে।
‘রফিকের সাথে আমার পরিচয় বছর দশেক আগে... এল এস ই তে, লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্স এ। ও ছিলো আমার মাস্টার্স ও পি এইচ ডি সুপারভাইজর। চল্লিশ বছর বয়সেই দু’বার ডিভোর্সড, সুদর্শন, অসাধারণ মেধাবী রফিক ম্যাক্রো ইকোনমিক্সে বিশ্বে বেশ নাম কামিয়ে ফেলেছিলো। টিপিকাল প্রফেসরগোছের উদাসিন রফিক আমাকে কখনো পড়াশোনার বাইরে কোন কথা বলেনি বা কোন ইঙ্গিত করেনি, কখনো কারো সাথে করেছে বলেও কানে আসে নি। ওর সম্মোহনী দৃষ্টি, ভারি কন্ঠস্বর আর অর্থনীতিতে... আমার সাবজেক্টে ওর অগাধ জ্ঞান, আমি নিজের অজান্তেই কেমন করে যেন ওর প্রতি দুর্বল হয়ে পড়লাম। ওর নির্লিপ্ততা আমাকে আরও মেরে ফেলছিলো। আমার সবকিছু নিয়ে ভেসে যাবার মতো এক অন্ধ আবেগে পি এইচ ডি শেষ করেই ওকে বিয়ের প্রস্তাব দিলাম। বাবা তখন বেঁচে নেই, মা’কে জানানোরও প্রয়োজন অনুভব করলাম না। আমার প্রস্তাব শুনে ও কি করলো জানো? ওর অদ্ভুত মায়াবী চোখ দুটো তুলে আমার দিকে চেয়ে রইলো কিছুক্ষণ। তারপর বললো, ‘দেখো, মাইক্রো ইকোনমিক্সে চাহিদা এবং জোগানের যে চারটা মূল তত্ব আছে, তার একটা হচছে চাহিদা অপরিবর্তিত অবস্থায় জোগানের বৃদ্ধি দ্রব্যের মুল্য কমিয়ে দেয়। তুমি কি ওটা ভেবে দেখেছো? নাকি আমার লেকচারের কোন একটা পর্যায়ে তোমার মনে হয়েছে, আমার চাহিদার উল্লম্ফন ঘটেছে?’ আমার তখন অর্থনীতির ছকচিত্র কিংবা গণিতের সমীকরণে কিছু যায় আসে না। অনেকটা আমার পিড়াপিড়িতেই বিয়েটা হলো। নিয়তির কি পরিহাস দেখো, ওর চোখের যে নির্লিপ্ততা বা উত্তাপহীনতা বিয়ের আগে আমাকে ওর প্রতি ব্যাখ্যাহীনভাবে টেনেছে, সেই একই জিনিষ বিয়ের পরে আমাকে তিল তিল করে মারতে লাগলো। ওর উদাসীনতা আমার সারা গায়ে অপমানের চাদর জড়িয়ে রেখেছিলো। মনে হচ্ছিলো, এ আমার নিজের অক্ষমতা। আমারই ঘাটতি। বুঝতে পারছিলাম না কি করবো। কি যে অস্থিরতায় কাটছিলো দিনগুলো! বছর চারেক আগে এল এস ই’তে এক কলিগের সাথে তুচ্ছ বিষয় নিয়ে মনোমালিন্য হওয়াতে রফিক অধ্যাপনা পেশাই ছেড়ে দিলো। একটা বিদেশী গবেষণা প্রতিষ্ঠানে চাকুরী নিয়ে বাংলাদেশে চলে আসে। মা’র শরীরটাও খারাপ হচ্ছিলো দিন দিন। তাই আমরা আমাদের এই বাসায়ই এসে উঠলাম। মা আমার চেহারা দেখেই বুঝে নিলেন, কোথাও একটা সমস্যা চলছে। আর আমি মা’কে জড়িয়ে ধরেই বুঝতে পারি, আমাকে সিদ্ধান্তটা নিতেই হবে। কিছুদিন পর, রফিককে বলতেই, ও আমার দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে অফিসে চলে যায়। লাঞ্চের সময় ও ড্রাইভার পাঠিয়ে ওর জামা কাপড় নিয়ে যায়।‘
‘তোমার কি কখনো মনে হয়নি তুমি কখনো রফিক সাহেবের প্রকৃতি বুঝতে চেষ্টা করোনি? কিংবা রফিক সাহেবের প্রতি অন্যায় হয়েছে?’
‘আমি জানতাম, তুমি এই প্রশ্নটা করবে। ইন ফ্যাক্ট, এই প্রশ্নটা আমার আরও দু’জন অফিস কলিগ করেছে। যখনই কোন ব্রোকেন রিলেশনশিপের কথা আসবে, পুরুষ মাত্রই এই কথাটা জিজ্ঞেস করবে।‘
‘দেখো, আমি কিছু মীন করে কথাটা বলিনি।‘
‘আমি জানি, তুমি কিছু মীন করে কথাটা বলোনি। তুমি একজন পুরুষ, ওটা অবচেতন মনেই কাজ করবে। তুমি যেভাবে প্রশ্নটা করলে, একজন পুরুষের প্রতি অন্যায় হলো কিনা বা একজন পুরুষকে চেনার অপারগতাকে তোমার কাছে যেভাবে অন্যায় মনে হচ্ছে, ঠিক উল্টোটা কেন তোমার মাথায় আসে নি? কেন তোমার মাথায় আসেনি একটা মেয়ে কি চায়? ও কতটুকু পেলো? জেনে বা না জেনে একটা ভুল সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেলে, ওটাকেই টেনে নিতে হবে সারাজীবন? মেয়েদের জীবন এতই ফেলনা? ওদের স্বপ্ন নেই? ভালো লাগা নেই? চাওয়া পাওয়া নেই?
‘দেখো, তুমি আগেই জানতে, রফিক সাহেব উদাসীন, উত্তাপহীন, নির্বিকার। তুমিই জোর করে ওনার সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছো। তুমিই সম্পর্ক ভাঙলে। এসবের মাঝখানে রফিক সাহেবের শরীরে বা মনে কি এলো বা গেলো ভেবেছো?
‘তোমার কি ধারণা আমি ভাবিনি ওটা? তুমি ভাবছো আমি নিজের ভালোলাগা থেকে সম্পর্কে জড়িয়েছি, আবার ভালো লাগছে না বলে সম্পর্ক ভেঙ্গে দিয়েছি? জীবন কি পুতুল খেলা? এর মাঝখানে বছর ছয়েকের বোঝাপড়া, টিকে থাকার চেষ্টা, মানিয়ে নেয়ার সংগ্রাম, তিল তিল করে ভালোবাসার মৃত্যু, এসবের কি কোন ভুমিকা নেই?
‘দেখো, আমাকে ভুল বুঝো না। তোমাদের সম্পর্কের অতো ডিটেল আমি জানি না। তুমি যা বলছো তা থেকেই প্রশ্ন করছি।‘
‘তা ঠিকই বললে। একটা সম্পর্কের ভালোলাগা-মন্দলাগা, ত্রুটি-বিচ্যুতি, ছোট খাটো বোঝাপড়া... এতোসব খুঁটিনাটি বাইরের কারো পক্ষে জানা সম্ভব নয়, বোধ করি আমার নিজের মনেও কোথাও কিছু একটা খচখচ করছিলো, তাই তোমার সাথে এতো কথা বললাম।‘
সেদিন ওরা সেই বারান্দায় বসেই অনেক রাত অব্দি কথা বলে। মাঝে শায়লা কয়েকবার উঠে গিয়ে ওর মাকে দেখে আসে। ঔষধ, খাবার এসব দেখার জন্য নার্স আছে দু’জন, বার ঘণ্টা করে পালা করে ডিউটি করে। ওকে দু’বার কফি করে খাওয়ায়। শায়লা রাতে কিছু খাবে না। ওকে খেতে জোর করেছিলো, একা একা বসে খেতে হবে বলে আরিফ এক আত্মীয়ের বাসায় খাবার দাওয়াত আছে বলে বেড়িয়ে পড়ে।
সেদিনের পরে আরিফ এবং শায়লা মানসিকভাবে আরও কাছাকাছি চলে এলো। শায়লার ছুটির দিনে আরিফ নিজেও ছুটি ম্যানেজ করে নিয়ে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ায়। শায়লাকে সঙ্গ দেয়। উজ্জ্ল ফর্সা চেহারার দির্ঘাঙ্গি শায়লা চল্লিশের কাছাকাছি এসেও অত্যন্ত আকর্ষণীয়া। ঘাড় অব্দি কাটা চুল আর চোখে পুরু ল্যান্সের চশমা ওর আবেদন আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। আরিফ বোধকরি এখন অস্বীকার করতে পারবে না শায়লার সঙ্গে ওর সম্পর্কটা ঠিক অফিসিয়াল পর্যায়ে নাই। বলাই বাহুল্য, এম ডি প্রদত্ত অফিসিয়াল ডিলটা শিকেয় উঠে গেছে। উত্তরবঙ্গের কিছু জেলায় শায়লাদের বিভিন্ন প্রজেক্টের কাজ চলছে। শায়লা প্রজেক্টের কাজ দেখতে গেলে, আরিফ শায়লার অনুরোধে ওর মা’র খোঁজখবর করে। শায়লা ওর মা সম্পর্কে খোলামেলা সব আলোচনা করেছিলো আরিফের সাথে, যদিও আলঝেইমার্স রোগটা বেশ আমোদপুর্ন মনে হচছিলো আরিফের কাছে। এই যেমন, সাক্ষাতের প্রথম দিনেই দীর্ঘাঙ্গী, ফর্সা, হালকা প্রিন্টের আকাশী রঙের সদ্য ভাঁজভাঙ্গা শাড়ি পড়া, রাশভারী চেহারার শায়লার মা’র সাথে খুব সহজেই ঘনিষ্ঠ হয়ে যায় আরিফ। উনি তাঁর রুমে, জানালার পাশে একটা ইজি চেয়ারে বসে কি যেন একটা বই পড়ছিলেন। আরিফ রুমে ঢুকে বেশ চেনা গলায় বলে,
- খালা, আমি আরিফ। কেমন আছেন আপনি?
শায়লার মা খুব মনোযোগ দিয়ে বই পড়ছিলেন। আরিফের কথাটা কানে যায় না। আরিফ দ্বিতীয়বার বলতে বই থেকে মুখ তুলে আরিফকে দেখেন। তাঁর মুখে হাসি ফুটে উঠে। আরিফকে বলেন,
- আরে দিপু! এতোদিনে খালাকে মনে পড়লো? আয় বোস... বলে হাত দিয়ে তাঁর পাশেই বিছানায় বসতে বলেন। উনি কথা বলেন খুব ধীর, নিচু স্বরে। আলাপের খানিক পরেই আরিফ বুঝে গেলো তিনি ওকে উনার ছোট বোন রুমলি’র ছোট ছেলে দিপু ভেবে নিয়েছেন। তা হোক, আরিফের কাজ খোঁজ খবর নেয়া, উনি ওকে কি ভাবলেন ওটা ধর্তব্য নয়।
এইসব যাওয়া আসা, ছোট ছোট আলাপ, ছোট ছোট হাসি, ছোট ছোট উদ্বেগ, চোখে চোখে তাকানো... আরিফ ডুবে যেতে থাকে অচেনা এক ভালোলাগায়। এই ভালোলাগার তীব্রতা আরিফের চেনা হিসেবী জীবনের ছক আমূল পাল্টে দেয়। এই ভালোলাগার উজ্জ্বলতায় আরিফ ওর ক্যারিয়ার, শায়লার সঙগে বন্ধুত্বের মর্যাদা, ওর আত্মবিশ্বাস সব বিসর্জন দিয়ে হঠাৎ করেই শায়লার বাসায় গিয়ে শায়লার হাত ধরে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে বসে। শায়লা স্তব্ধ হয়ে বসেছিলো কিছুক্ষণ। ওর ব্যথায় কাতর চোখদুটোতে ধীরে ধীরে একটা আহত, একটা অপমানিত দৃষ্টি ফুটে উঠে। আরিফের পুরো জগত, ওর সমস্ত ভালোলাগার ভিত টলমল করে উঠে। ‘তোমরা আমাদের মানুষ বলে ভাবতে পারো না কেন বলতে পারো? শুধু একজন মানুষ! হাড় মাংস, হৃদয়, দৃষ্টি, ভালোলাগা মন্দলাগা নিয়ে কেবল একজন মানুষ! কেন একটা মেয়ে প্রথাগত মা, বোন বা স্ত্রীর সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না? তুমি এতো গুছিয়ে কথা বলো, এতো পড়াশোনা করো, আমি মেয়ে বলে আমাকেও সম্পর্কে না জড়ালে তোমার চলছিলো না? তোমাদের অধিকারবোধ এতোটাই তীব্র? যা কিছু ভালো লাগে সব নিজের অধিকারে রাখতে হবে? তোমার চোখের দিকে তাকাতেই ভালো লাগছে না আমার। তুমি আমার সাথে আর যোগাযোগ রাখবে না প্লিজ।‘ এই বলে শায়লা বাসার ভিতরে চলে যায়। মাথা নিচু করে অনেক্ষণ শায়লাদের বারান্দায় বসেছিলো আরিফ, তারপর একটা ঘোরে পাওয়া মানুষের মতো হাঁটতে হাঁটতে মগবাজার থেকে এলিফেন্ট রোডে ওর বাসায় চলে আসে। এরপর আছে একজন বিধ্বস্ত মানুষের গল্প, একজন ভেঙ্গে পড়া মানুষের গল্প, একজন পরাজিত মানুষের গল্প। দিনের পর দিন ঘরে নিজেকে আবদ্ধ করে রাখা, বিষণ্ণ, অগোছালো আরিফের হাতে হাত রাখে শায়লা, ওকে উদ্ধার করে। প্রেমিকা নয়, বন্ধু হিসেবে, শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে, কর্তব্যে, ভালোবাসায়। পুরনো চাকরিটা ছেড়ে দেয় আরিফ। এম ডি সাহেবের চাপ অসহ্য হয়ে উঠছিলো, তাছাড়া শায়লার সাথে লাভ ক্ষতির কোন সম্পর্কে জড়াতে চায় না ও। শায়লার পরামর্শ, সেলসে নিজের অভিজ্ঞতা, সাথে বিল্ডিং মেটেরিয়ালস মার্কেটে ওর জানাশোনা বিবেচনায় নিয়ে ও এলুমিনিয়াম প্যানেল আমদানি এবং ইন্ডেন্ট শুরু করে। জীবন-জীবিকার এই পরিবর্তন, কাজের এই নতুনত্ব ভীষণ দরকার ছিলো আরিফের জন্যে, ওর আত্মবিশ্বাস ফিরে পাবার জন্যে, নিজের উপর আস্থা ফিরে পাবার জন্য। ওর প্রোডাক্ট মার্কেট করতে গিয়ে রাতদিন ছুটোছুটি, সংগ্রাম, চ্যালেঞ্জ ওকে ধীরে ধীরে স্বরুপে ফিরিয়ে আনে, খোলা তরবারির মতো ক্ষুরধার করে তোলে। শায়লার সঙ্গে ওর সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়ে আসে। শায়লার প্রতি আরিফ কৃতজ্ঞ, ভীষণ কৃতজ্ঞ। ওকে বন্ধু হিসেবে গ্রহন করেছে বলে, ওর আনাড়িপনাকে ক্ষমা করেছে বলে, ওর উপর আস্থা রেখেছে বলে। তবে, সম্পর্কের প্রথমদিকে যোগাযোগের যে বাড়াবাড়ি ছিলো, যে তীব্রতা ছিলো, তা কমে গেছে। ওটা স্বাভাবিক। আরিফ এবং শায়লার ব্যস্ততা বেড়েছে অনেক। মাসখানেক আগে শায়লা জানিয়েছিলো ওর মা’র ফুসফুসে পানি জমেছে, শরীর দ্রুত খারাপের দিকে যাচ্ছে। হলি ফ্যামিলিতে রেখেছে। আরিফ এর মধ্যে দুবার হাসপাতালে গিয়েছে। শায়লা মা’কে নিয়ে খুব উদ্বিগ্ন। এই বয়সে নিউমোনিয়ার ধকল ওর মা বোধহয় কাটিয়ে উঠতে পারবে না। ঠিক তাই হলো। মনটা হু হু করে উঠলো আরিফের। এই শোকের সময়, এই কষ্টের সময় ও কেন শায়লার পাশে থাকতে পারলো না? ওর একাকিত্বের সময়, ওর কষ্টের সময় শায়লাতো পাশে দাঁড়িয়েছিলো, সাহস দিয়েছিল। ও কেন রোজ খবর নেয় নি? অপরাধবোধের নিদারুণ কালো মেঘ আরিফকে গ্রাস করে ধীরে ধীরে। আনমনে স্ক্রল করে ইমেইলের বাকি অংশ পড়তে থাকে,
‘রফিককে ফোন করেছিলাম। ওরতো কেউ নেই, আমরা লন্ডন থেকে এই বাসায় এসে উঠলে, মা’কে কেমন করে যেন খুব আপন করে নেয়। তোমাকে বলেছিলাম, ও হাসপাতালে মা’কে দেখে যেতো। কেবল আমাকেই এড়িয়ে যেতো। ভীষণ অভিমান আমার প্রতি। ওই অবস্থায় ওর কথাই মনে হলো। বোধকরি আমাদের ভালোবাসার, ভালোলাগার মানুষগুলো আমাদের অবচেতন মনে গাঁথা থাকে। আমাদের বিপদের সময়ে, আমাদের কষ্টের সময়ে, আমাদের একান্ত প্রয়োজনে, আমাদের নিজেদের অজান্তেই ব্যাখ্যাহীনভাবে আমাদের মন ওদের ডেকে নিয়ে আসে। ও অনেক খাটাখাটি করলো। হাসপাতাল থেকে মা’র মরদেহ বাসায় নিয়ে আসলো। মা’র দূর সম্পর্কের কিছু আত্মীয় ছিলো, ওই ফোন বুক থেকে ঠিকানা নিয়ে, ফোন নাম্বার নিয়ে খবর দেয়। মা’কে ধোয়ানো, জানাজা পড়ানো, কবর দেয়া ... সব ওই ব্যবস্থা করে। আমার কিছু করতে ইচ্ছে করছিলো না। নিজের রুমে দরজা লাগিয়ে শুয়েছিলাম। মা’র এই চলে যাওয়া বিশাল এক পাথর হয়ে আমার বুকে চেপে বসেছিলো যেন। উঠে দাঁড়াতেও কষ্ট হচ্ছিলো। রফিক চাকরিটা ছেড়ে দিচ্ছে। কানাডাতে, ইউনিভার্সিটি অব ব্রিটিশ কলম্বিয়াতে অধ্যাপনার চাকরি নিয়ে চলে যাচ্ছে। আমিও ওখানে পোস্ট ডকটোরাল’টা করে ফেলবো বলে ভাবছি। আর ভালো লাগছে না এ বাড়িটায়। প্রতিটা মুহুর্ত আমাকে নিংড়ে নিচ্ছে। তুমি একবার দেখা করতে পারবে? আমি দেশ ছেড়ে যাবার আগে আমাদের জমিটার পাওয়ার অব এটর্নি তোমাকে দিয়ে যাবো ভাবছি। তুমি যা ভালো হয়, যেভাবে ভালো হয় করো। ...‘ ই মেইল পড়া শেষ করে অভিমানের মেঘ মাথায় নিয়ে চুপ করে বসে রইল আরিফ। শায়লার সাথে ওর সম্পর্কের এই সমীকরণে ভাবগত লাভের যোগফল শূন্যই রয়ে গেলো, অথচ নিবিড় বস্তুগত লাভের ইঙ্গিতে অদ্ভুত এক দহনে ওর সারা শরীর পুড়তে লাগলো।
২| ০৮ ই জুলাই, ২০১৪ বিকাল ৫:৫৭
পাজল্ড ডক বলেছেন: চমৎকার লিখেছেন
৩| ০৯ ই জুলাই, ২০১৪ রাত ১২:০৭
জাহাঙ্গীর.আলম বলেছেন:
সুন্দর লিখেছেন ৷ তবে মাঝে আরিফ আর লায়লার সম্পর্কের সূচনাটি বেশ গতি ছিল তা খানিকটা বিস্তৃতি দিতে পারতেন ৷
ভাল থাকুন ৷
৪| ০৬ ই আগস্ট, ২০১৪ ভোর ৬:৫৪
প্রবাসী পাঠক বলেছেন: খুব ভালো লাগল আপনার লেখা।
৫| ০৭ ই আগস্ট, ২০১৪ রাত ৯:৫৭
নাভিদ কায়সার রায়ান বলেছেন: খুব ভাল লাগলো। অনেকে পাঠককে ধরে রাখার জন্য শর্টকাট এ গল্প শেষ করে। আপনি সেই পথে যান নি, দয়া করে যাবেন ও না। প্লাস দিয়ে গেলাম।
©somewhere in net ltd.
১|
০৮ ই জুলাই, ২০১৪ সকাল ১১:২৫
সত্যের পথে আরিফ বলেছেন: একজন মানুষ, একটা জীবন কি অদ্ভুত নিয়মে ন্যাপথলিনে মিলিয়ে যায়