![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আজ খুব ভোরেই ঘুম থেকে ওঠেছে আলম ডাঙ্গার রশিদুল আলম। আলম বাড়ির সবাই তখনো ঘুমে কাদা। ওদের বংশে পঞ্চাশ পেরোনোর আগে কেউ ভোরে ঘুম থেকে ওঠে না, কয়েক পুরুষ ধরেই এটা হয়ে আসছে। পঞ্চাশ পেরোলেই কেন এ বাড়ির পুরুষদের ভোরের আলো দেখার নেশা পেয়ে বসে, এ নিয়ে রহস্যের কিছু নেই। ওই বয়সে, ওদের রক্তে বংশানুক্রমিক শর্করার আধিক্য বেলা অব্দি বিছানায় গড়াগড়ি করার পক্ষে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। বাড়ির মেয়েদের অবশ্য ওঠে যেতে হয় ভোরেই। কয়েক পুরুষ ধরে এরা বড় গৃহস্থ পরিবার। কাজের লোক, রাখাল, চাষা, বাড়ির লোক ছোট বড় মিলিয়ে গোটা পঞ্চাশেক মুখ। ওদের মুখে সারাদিন খাবার জুটিয়ে যাওয়া সহজ কোন কাজ নয়। তবে এখন সিয়াম সাধনার মাস। এ বাড়ির পুরুষেরা জীবন জীবিকা বা ধর্মাচরনের অনেক অত্যাবশ্যকীয় কাজ এড়িয়ে গেলেও, রোজা পালন করে বেশ গুরুত্ব দিয়ে। বস্তুত, পুরো রোজার মাস জুড়েই আলম বাড়ি যেন একটা উৎসবের চাদরে ঢেকে থাকে। বাড়ির জোয়ান ছেলেরা কাছারি ঘরে তাস, লুডুর আসর বসায়। বিড়ি, সিগ্রেট আর জুয়ার খুচরো পয়সার ঝন ঝন শব্দে কখন সেহরির সময় হয়ে যায়, ওরাও বুঝতে পারে না। ভেতর বাড়ি থেকে জানালায় ঠক ঠক আওয়াজ আর রেশমি চুড়ির রিনিঝিনি শব্দে জুয়ার নেশা কাটে। সবাই সেহরি খেতে নিজ নিজ বাড়ি ছোটে। বুড়োরাও হুঁকো মুখে কাশতে কাশতে রাত পার করে, ঘুমিয়ে পড়ে সেহরি মিস করার সম্ভাবনা নেই। তাই আজকাল আর সকালে কাজ নেই। বাড়ির মেয়েরাও পায়ে রোদের তাপ না লাগলে বিছানা ছাড়ে না। রশিদুলের আজ অনেক কাজ, দম ফেলার ফুরসৎ পাবে না। বাড়ির উত্তরে পঁচিশ শতক নাল জমি গত সপ্তাহ দুয়েক ধরে মাটি ফেলে উঁচু করা হয়েছে। প্রথম দিকে গ্রামের ছেলেরা নিজেরাই স্বেচ্ছাশ্রমে ওটা করে দিবে বললেও, দিন দুয়েক মাটি টেনেই কেটে পড়েছে। কারো বাড়িতে কাজ, কারো কলেজ খুলেছে, কারো মা’র ব্যারাম। রশিদুল জানে, সব বানোয়াট। কিন্তু ওর হাতে ওর বাড়ির ইজ্জত, ওর গ্রামের ইজ্জত। ও তাই টাকা দিয়ে, দিন মজুর দিয়ে জমি ভরাট করেছে। চাচাত ভাই জমির অবশ্য শুরুতে গাঁইগুই করেছিলো, শীতকালীন আগাম সবজী করার জন্যে সে মাঠ তৈরি করেছে। চারপাশে নতুন বাঁশ কেটে বেড়া দিয়েছে। মাঠের এক পাশে ইতোমধ্যে মাচাঙে কিছু লাউ কুমড়োর ফুল আসা শুরু করেছে। তিন জন চাষা মাঠ তৈরি শেষ করেছে। এখন কেবল বীজ ফেলা বাকি। এর মধ্যেই বিশ্বকাপ হাজির। রশিদুল আগেই গ্রামে ঘোষণা দিয়ে রেখেছে, আর্জেন্টিনা ফাইনালে উঠলে, গ্রামের সবাইকে মেজবান খাওয়াবে। রোজার মাসে মেজবান সম্ভব না, তাই সামিয়ানা টাঙিয়ে সেহরির আয়োজন, সাথে টেলিভিশনে খেলা দেখা হবে এক সাথে। আর এই জন্য বাড়ির লাগোয়া জমিটা রশিদুলের প্রয়োজন। রশিদুল গ্রামের ছেলেদের লেলিয়ে দিয়ে জমিরকে ঠাণ্ডা করেছে। জমি প্রস্তুত, সামিয়ানা লেগে গেছে। একপাশে ষ্টেজ বসবে। সারা গ্রামের কুকুর পরিবার সমেত আগাম দাওয়াতে হাজির হয়ে গেছে। এ বাড়ির কুকুর লালু আর ভুলুর অনুমতি নিয়ে এদিক সেদিক ঘুমিয়ে কাদা। রশিদুল পেছনে হাত দিয়ে লুঙ্গী উঁচু করে ধরে ওদেরই ফাঁকে ফাঁকে হাঁটছে। ওর মুখ গমভীর। ওর কাছে পাকা খবর আছে করিম ডাঙ্গার ছেলেরা আজ রাতে খেলার কোন এক সময় ওদের প্যান্ডেলে হামলা চালাতে পারে। আর্জেন্টিনা ফাইনালে খেলবে আর আলমডাঙ্গার ছেলেরা প্যান্ডেল লাগিয়ে আনন্দ ফুর্তি করবে করিমডাঙ্গার ছেলেরা সইবে কেন? ওরা যে ব্রাজিল করে!
আলম ডাঙ্গার ছেলেরা কেন আর্জেন্টিনা আর করিমডাঙ্গার ছেলেরা কেন ব্রাজিল, এর কোন কারণ নেই, কোন যুক্তি নেই। এটাই ভবিতব্য, এটাই নিয়তি, এটাই হবার কথা। অন্যথা হবার উপায় নেই। সত্তুরের দশকে ওরা একে অপরকে দাঁত দেখিয়েছে আবাহনি, মোহামেডান নিয়ে, তারও অনেক আগে ইষ্ট বেঙ্গল আর মোহনবাগান নিয়ে। ইতিহাস ঘেঁটে যতদূর জানা যায়, ষোড়শ শতকে, মোঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব বাবা সম্রাট শাহজাহানের কাছ থেকে জোরপূর্বক ক্ষমতা দখল করে নিলে, সম্রাট শাহজাহানের দ্বিতীয় পুত্র শাহ সুজা আওরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। তখন সম্রাট আওরঙ্গজেবের সিপাহশালার মীর জুমলার তাড়া খেয়ে শাহ সুজা চট্টগ্রাম থেকে আরাকানে পালিয়ে যাবার পথে আলমডাঙ্গার পাহাড় বেষ্টিত ছায়া ঘেরা নিসর্গে মুগ্ধ হয়ে এখানে যাত্রা বিরতি করেন। মোঘল সম্রাট শাহজাহান তনয় আলমডাঙ্গার মেহমান হয়েছেন, এই সংবাদে করিম ডাঙ্গার লোকজন ভীষণ ব্যথিত হয়। আলম ডাঙ্গার এই সম্মানে, ঈর্ষাকাতর করিম ডাঙ্গার লোকজন রাতের অন্ধকারে কয়েকবার শাহজাদা শাহ সুজাকে ছিনিয়ে আনতে যায়, কিন্তু আলম ডাঙ্গার লোকজনের সতর্ক পাহাড়ায় তারা ব্যর্থ হয়। আলম ডাঙ্গা এবং করিম ডাঙ্গার লোকজনের পারস্পরিক শত্রুতা শাহজাদা শাহ সুজার জানার বিষয় ছিলো না, তিনি ভেবেছিলেন মীর জুমলা বোধকরি তাঁর পিছু পিছু আলম ডাঙ্গায় পৌঁছে গিয়েছে। তিনি বেশীদিন বিশ্রাম নিলেন না, আরাকান রাজের আমন্ত্রনে আরাকান রাজ্যের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লেন। পরবর্তীতে সম্রাট শাহজাহানের রাজদরবারের অন্যতম শিক্ষক হযরত ইব্রাহিম খন্দকার শাহ সুজাকে অনুসরণ করে আরাকান সড়ক ধরে এগুতে থাকেন। এই সুযোগ করিম ডাঙ্গার লোকজন বিফলে যেতে দিলো না। তারা আগ বাড়িয়ে জনাব ইব্রাহিম খন্দকারকে পাকড়াও করে নিয়ে আসে। মোঘল সম্রাট মহামতি আওরঙ্গজেবের শত্রু, বিদ্রোহী শাহ সুজাকে আশ্রয় দিয়ে আলম ডাঙ্গার লোকজন রাষ্ট্রদ্রোহী কাজে লিপ্ত হয়েছে, এর একটা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবী করে তারা। জনাব ইব্রাহিম খন্দকার একজন শিক্ষক, সিপাহশালার নন। তিনি পাশাপাশি এই দুই গ্রামের বিনা ওজরে শত্রতা বুঝতে পারেন। এটাও বুঝতে পারেন, শাহ সুজাকে অনুসরণ করে তিনি ঠিক পথেই এগুচ্ছেন। সম্রাটের আদেশে তাঁকে শাহ সুজার পিছু ধাওয়া করতে হবে বলে করিম ডাঙ্গার লোকজনকে বুঝিয়ে তিনি আরাকান সড়ক ধরে বেরিয়ে পড়েন। ষোড়শ শতকে সম্রাট শাহজাহানের দ্বিতীয় পুত্র শাহ সুজাকে আশ্রয় এবং আপ্যায়ন নিয়ে সৃষ্ট রেষারেষিই আলম ডাঙ্গা এবং করিম ডাঙ্গার লোকজনের ঐতিহাসিক কোন্দলের সুত্র বলে ঐতিহাসিকগণ স্বীকৃতি দিয়েছেন। আর আমরা দেখেছি, ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় প্রতিটা সুযোগে আলম ডাঙ্গা এবং করিম ডাঙ্গার লোকজন একে অন্যের ওপর চড়াও হয়েছে। এই দু’গ্রামের প্রতিটা শিশুই বুদ্ধি হবার পর থেকেই বুঝে নেয়, আলম ডাঙ্গার লোকে যা করে, করিম ডাঙ্গার লোকে তা করতে পারে না বা করিম ডাঙ্গার লোকে যা করে তা আলম ডাঙ্গার লোকে করতে পারে না।
‘কাকা, আইজ নাহি মেসি খেলতে পারবো না, অর পায়ে জানি কি হইসে! তাইলে তো কাম সারছে, জারমানি না জানি কেমুন বেইজ্জতিটা করে। ’ ঠাট্টার ঢঙে কথাটা বলে দাঁত দেখিয়ে হে হে করে হাসতে থাকে হাঁটুর ওপরে লুঙ্গী ওঠানো স্টেজের জন্য বাঁশ কাটতে থাকা ছেলেটা। ঠাস করে মাড়ি ভাঙ্গা এক চড় খেয়ে পাশেই গড়িয়ে পড়ে মুহূর্তেই। ‘হারামজাদা! আইছস কামলা দিতে, মেসি খেলবো কি খেলবো না, অইডা তর চিন্তার কাম কি? সক্কাল বেলাতেই অলক্ষইনা কথা না কইলে তর ভাত হজম হইতাসে না!’ চড়টা দিয়ে দাঁত মুখ খিঁচিয়ে কথাটা বললো রশিদুল। লুঙ্গী উঠিয়ে মাজা বরাবর কষে একটা লাথি মারবে, এই সময় ওকে জাপটে ধরে ওদের পাড়ার নাসির। ‘আরে করেন কি, করেন কি রশিদ ভাই! অর মাজা ভাঙলে স্টেজ খাড়া করবো কে? এখনো গোটা বিশেক বাঁশ জোগাড় হয় নাই, বাঁশের চিন্তায় মাথার চুল খাড়া হইয়া আছে আমার!’ কথাটা বলতে বলতেই চোখের ইশারায় ছেলেটাকে সরে যেতে বলে নাসির। ‘শুয়োরের বাচ্চা...গুলি কইরা মাইরালামু!’ তখনো রাগে ফোঁস ফোঁস করছে রশিদুল। নাসির রশিদুলকে জাপটে ধরে প্যান্ডেলের এক পাশে নিয়ে আসে। ‘আপনে মাথা ঠাণ্ডা করেন রশিদ ভাই, একটা বুদ্ধি দেন। বাঁশ না পাইলে ষ্টেজ হইব না, স্টেজ না হইলে বক্তৃতা বন্ধ।‘ ‘না!’ এবার আর চিৎকার নয়। অনেকটা আর্তনাদ করে ওঠে রশিদুল। ‘বক্তৃতা বন্ধ করা যাইব না। প্রধান অতিথি করব বইলা ফরিদ জ্যাঠার কাছ থেকে টাকা নিয়া সব আয়োজন করছি। দুই সপ্তাহ ধইরা ঘরের দরজা বন্ধ কইরা তিনি বক্তৃতা মুখস্ত করতাছেন। স্টেজ না হইলে জ্যাঠা বন্দুক দিয়া নিজের হাতে আমারে গুলি করবো।‘ ‘তাইলে বাঁশের ব্যবসথা করেন।‘ ‘তরা কেমন ছোড পোলা পানের মতন কাম করস, এই শেষ বেলায় আইসা কস বাঁশ কম পড়ছে, কাইল কই ছিলি? কাইল কইতে পারলি না?’ ‘বাঁশ কম পড়তো না, আপনেই শেষ বেলায় আইসা কইলেন, মেয়েরাও ফাইনাল খেলা দেখবো, অগো লাইগা আলাদা প্যান্ডেল বানাও। অইডা করতেই বাঁশ কম পইরা গেল।‘ ‘তরা এত্তগুলান পোলাপান আছস, সামান্য কয়ডা বাঁশের ব্যবস্থা করতে পারলি না।‘ ‘বাঁশ আছে এক জায়গায়, কিন্তুক আপনের অনুমতি ছাড়া যাই কেমনে?’ ‘কই আছে?’ ‘গেরামের সীমানায়। করিম ডাঙ্গার পোলাপান নাঙ্গা দাও নিয়া পাহারায়। বাঁশ কাটতে গেলে, কল্লা নামাইব কয়।‘ রশিদুল লম্বা করে শ্বাস ফেলে। ‘আমি কই যাই ক। আইজকা ফাইনালে নামতাছে আমার আর্জেন্টিনা। আছরের নামাজের পর মিলাদের ব্যবস্থা করছি। মিলাদের পরে মুসল্লিগণরে জিলাপি খাওয়ানোর পিলান আছে। গরু লাগবো তিনটা, জোগাড় হইছে দুইটা। রান্নার মসলার বাজার হয় নাই। তুই ক আমি কয়দিক সামলাই। গরু জোগাড় করি, নাকি মসলার বাজার করি, নাকি তগো বাঁশের ব্যবস্থা কইরা দেই। এদিকে জিলাপি কিনতে এহনি হাটে যাওন দরকার, দেরী হইলে জিলাপি পাওন মুশকিল হইব। না জানি করিম ডাঙ্গার পোলাপান জিলাপি সব খাইয়া হজম কইরা বইসা আছে!’ ‘আপনে তাইলে আপনের ছোড ভাই জুম্মনরে বন্দুক লইয়া আইতে কন, আমরা ফায়ার কইরা করিম ডাঙ্গার পোলাপান দাবড়াইয়া দিলে পরে কামলারা গিয়া বাঁশ কাইটা নিয়া আসতে পারব।‘ ‘পাগলামি করিস না। করিম ডাঙ্গার নিজাম কান খাড়া কইরা বইসা আছে গুলির আওয়াজ হুননের লাইগা। গজব নামাইয়া দিব। বন্দুক অগো নাই? মাঝখান দিয়া এই হুজ্জতে আমাগো ফাইনাল খেলা দেহন মাডি হইব। আহারে আমার মেসি ফাইনালে খেলবো, আমার দুই চক্ষু দিয়া ওরে দেখুম না! তুই নয়া বাজারের হাটে যা, টাকা দিতাছি, বাঁশ কিনা আন। আমি পোলাপান দুইটা লইয়া হাটে যাই, বাজার সারি।‘
করিম ডাঙ্গার বিখ্যাত তাল দীঘির ঘাটলায় জনা পাঁচেক ছেলে পেলে নিয়ে বসে আছে গ্রামের গোড়াপত্তনকারী করিম বাড়ির নিজাম। সবার মুখ গম্ভীর। ব্রাজিল জার্মানির কাছ থেকে সাত গোল খাবার পর থেকে ওদের বিষণ্ণতা রোগে পেয়েছে। পুরো গ্রাম এক অদ্ভুত হতাশায় নিরব হয়ে গেছে, গ্রামের শিশুরা পর্যন্ত কাঁদতে ভুলে গেছে। সে এক ভীষণ ‘মন ভালো নেই’ ‘মন ভালো নেই’ সুর বেজে চলেছে সারা গ্রামজুড়ে। গ্রামের জীবনাচরণ থেমে নেই যদিও, হাট বাজার সবই চলছে, তবে সে এক নিদারুণ উদাসীনতায়। নিজাম অস্থির ভাবে ঘন ঘন ওর মোবাইলের দিকে তাকাচছে। ‘হারামজাদা তফজইলারে আলম ডাঙ্গার প্যান্ডেলে কামলা খাটতে পাঠাইলাম, কিছুক্ষণ পর পর আমারে খবর করণের লাইগা। অরতো কুন খবর নাই, আমি ফোন দিলাম আর কয়, ভাইজান, রশিদ মিয়া প্যান্ডেলে ঘুরাঘুরি করতাসে, অহন কথা কওন যাইব না! হেয় নাকি আমারে পরে সুযোগ মত মিস কল দিব।‘ ‘ভাইজান, আপনে অর মিস কলের আশায় চুপচাপ বইসা আছেন? দিন কিন্তু গরাইতাছে, রাইতে অগো পগ্রাম। কেমুন পগ্রাম, কয়জনের আয়োজন, কিছুই কইলাম জানি না এহনতরি। আমি কই কি আমাগো শাহেদা’র জামাইরে জামাল মিয়ার লগে হাটে পাডায়া দেই। শাহেদার জামাইরে ওরা চিনব না। হেয় আলম ডাঙ্গার পোলাপান হাটে আসলে অগো পাছ পাছ ঘুইরা খবর জোগাড় কইরা দিতে পারব।‘ সুচিন্তিত মতামত দেয়, নিজামের পাশে বসা ওর চাচাতো ভাই ফারুক। কথাটা মনে ধরে নিজামের। ‘তুই ঠিকই কইছস। জামালরে গিয়া ক, আমি ওরে হাটে যাইতে কইছি, লগে আমগো শাহেদার জামাইরে দে। ওরা হাটে অপেক্ষায় থাকবো। আলম ডাঙ্গার কাউরে দেখলে, জামাল ওরে ইশারা দিলে, জামাই অগো পাছ পাছ ঘুইরা, ওরা কি কেনে, কি কথা কয়, সব যেন শুধু আমার মোবাইলে ফোন কইরা জানায়।‘ ফারুক গুরুত্বপুর্ণ একটা কাজ পেয়ে ঘাটলায় দাঁড় করিয়ে রাখা সাইকেলে জোর প্যাডেল মেরে ঝড়ের বেগে বাড়ির দিকে ছুট দেয়। ফারুক বেরিয়ে যেতেই নিজাম ইশারায় বাকি সবাইকে কাছে আসতে বলে। ‘হুন, এতখন ফারুইক্কা আছিল তাই কিছু কই নাই। জামাইল্লার কাছে দুইডা বন্দুক রাখা আছে। কলিম আর রশিদ লাডি আর সড়কি যোগার কইরা রাখছে। নয়াবাজারে ব্রাজিল সমর্থক গোষ্ঠীর সভাপতি আসলাম ভাই এর লগে আলাপ হইছে। হের মাথা আমগো থিকা বেশী খারাপ। হেয় দশ বারোজন পোলা পাঠাইব কইছে। আমরা দক্ষিণ পাশ দিয়া আলম ডাঙ্গায় ঢুকুম। পোলাপান বেশী না, বিশ জন হইলেই হইব। তফজইলার লগে আলাপ করনের দরকার খুব। জেনারেটর কই বসাইব, কারেন্টের লাইন কই দিয়া নিব, বক্তৃতা কে কে দিব, ঠিক কয়টায় অনুষ্ঠান শুরু, এইসব খুব খুব জরুরী জিনিষ। এইসব না জানলে পিলান ঠিক মতন করা যাইব না। তরা এহন যা, মাগরিবের নামাজের পর ঘাটলায় আহিছ, সব ফাইনাল কইরা লমুনে।‘ ‘নিজাম ভাই, ও সি সাবরে এট্টু জানায়া রাখলে কিন্তু ভালো হইত।‘ কথাটা বলে করিম ডাঙ্গার সবচেয়ে সাহসী ছেলে, হাটে হাতাহাতি করে বার তিনেক চৌকিদারের লাঠির বাড়ি খাওয়া জাহাঙ্গীর। ‘ও সি সাবের সাথে কথা হইছে, হেয় জার্মানি’র সাপুর্টার। হেয় কয়, আর্জেন্টিনা যতই ফাল পারুক, কমের পক্ষে চাইরটা গোল খাইব।‘ আর্জেন্টিনা গোল খাবার কথা শুনে এবার হাতে তালি দিয়ে হো হো করে হেসে ওঠে সবাই। ‘ও সি সাবে কইছে আর্জেন্টিনা ব্রাজিলের মারামারিতে সে নাই...’ ছেলেদের নিশ্চিন্ত করে নিজাম।
আলম ডাঙ্গা জামে মসজিদের খতিব মাওলানা মইনুদ্দিনের স্ত্রী পোয়াতি। গ্রামের একমাত্র ধাই জমিলার মা, মাস তিনেক আগে এসে, পেটের এদিক সেদিক হাত দিয়ে টিপেটুপে বলেছে, এইবার জমজ সন্তান এসেছে পেটে, এই কাজ সে পারবে না, বিপদ আছে। সদর হাসপাতালে নিতে বলেছে সে। সেই থেকে দৈনিক পাঁচওয়াক্ত নামাজের সাথে আল্লাহর দরবারে দুই রাকাত করে শোকরানার নামাজ আদায় করছেন খতিব সাহেব। আল্লাহ্ তাঁকে জমজ সন্তানের পিতা করবেন! আল্লাহ চাইলে কি না করতে পারেন! আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতার শেষ নেই ইমাম সাহেবের। তিনি একজন হত দরিদ্র, পিতৃ-মাতৃহীন অনাথ। অনাহারে, অর্ধাহারে এক এতিম খানায় কিছুটা লেখা পড়া করার সুযোগ পেয়েছিলেন। সেই কিশোর বয়স থেকে মসজিদে আযান দিয়ে, কারো ঘরে ছোট বাচ্চাকে আরবি শিখিয়ে দু’বেলা খাবার ব্যবস্থা করে আসছিলেন। রোজগার যাই হোক, আহার যাই জুটুক, আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতায় বিনীত শুকরিয়া আদায় করতে কখনো ভুল করেন নি। শহরে, গ্রামে, এই মসজিদ, সেই মসজিদ ঘুরতে ঘুরতে তিনি আজ আলম ডাঙ্গা জামে মসজিদের খতিব। কত সম্মান তাঁর! মসজিদের পাশে এক টুকরো জমিতে তাঁকে ভিটে করে দেয়া হয়েছে, দু’কামরার একটা ঘর করে দেয়া হয়েছে। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়িয়ে, গ্রামের ছেলে মেয়েদের আরবি শিখিয়ে যেটুকু সময় বাঁচে, তিনি আর তাঁর স্ত্রী মিলে সে ভিটে ফুল ফলের বাগান করে তুলেছেন। আজ যখন তিনি ঘরের দাওয়ায় পিঁড়ি পেতে বসেন, চারপাশে চোখ মেলে দেখেন, তাঁর চোখ ভিজে আসে। তাঁর প্রতি আল্লাহর এই অযাচিত স্নেহে, কৃতজ্ঞতায় তাঁর অজান্তেই মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে ‘আল্লাহু খাইরুরাজেক্বুন’। এদিকে তাঁর স্ত্রীর জীবন বাঁচে না। একে রুগ্ন শরীর, তার ওপর জমজ সন্তানের ভ্রূণ টেনে নিয়ে বেড়ানো, সাহায্য করারও কেউ নেই। এতদিন যাও সহ্য করেছে, এই শেষ দিকে এসে যেন আর পারছে না। পায়ে পানি জমে গেছে। দাঁড়াতে বা হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে খুব। পেট বড় হতে হতে বিছানায় শুলে মনে হয় ঘরের ছাদ ফুঁড়ে বেরিয়ে যাবে। কিছুই খেতে পারছে না, বমি হয়ে যাচ্ছে। আজ সকাল থেকে পরিস্থিতি আরও খারাপ মনে হচ্ছে। হাসপাতালে নেয়া দরকার। হাতে টাকাও নেই। মাওলানা সাহেব সকালে একবার আলম বাড়ির প্যান্ডেলে রশিদের সাথে কথা বলার চেষ্টা করেছিলো, রশিদ বলেছে, আছরের নামাজের পরে মিলাদ আছে, তখন কথা বলবে, এখন সময় নাই। তিনি দুশ্চিন্তায় মাথা নিচু করে ফিরে এসেছেন। স্ত্রী বিছানায় ব্যথায় কাতরাচ্ছে, তিনি স্ত্রীর মাথায় হাত রেখে, পাশে বসে কোরআন তেলাওয়াত করছেন। কিছুক্ষণ পর পর তাঁর চোখ ভিজে আসছে, তিনি আছরের নামাজের অপেক্ষায় আছেন।
- ‘আরে, রশিদ সাহেব যে! আসেন, আসেন!’ সহাস্যে অভ্যর্থনা জানালেন রুপগঞ্জ থানার ও সি জহির সাহেব।
- স্যার, বেশিক্ষণ বসবো না আজ। হাতে সময় একবারেই নাই। আজ রাতে কিন্তু আপনে বিশেষ অতিথি। আমরা অনুষ্ঠান রাত আটটা নাগাদ শুরু কইরা দিব। আপনে তো আর সেহরি খাবেন না। আপনাদের জন্য স্পেশাল রাতের খাবার ব্যবস্থা আছে।
- বলেন কি! আমি আবার বিশেষ অতিথি কেন? আমি বক্তৃতা দিতে পারি না। তবে আমি একবার আপনাদের অনুষ্ঠান দেখতে যাবো।
- স্যার, করিম ডাঙ্গার ছেলেরা আমাদের অনুষ্ঠানে হামলা চালাবে বলে পাকা খবর আছে আমাদের কাছে।
- নিজামের সাথে আমার কথা হইছে। আমি ওরে নিষেধ করে দিছি, যেন এইরকম কিছু না করে।
- স্যার যদি কিছু ফোর্স লাগায়া দিতেন...
- আমার হাত টাইট। প্রটোকল ডিউটি আছে, ফোর্স এমনিতেই কম।
- ঠিক আছে স্যার। তবে আমাদের ওপর হামলা হলে, আত্মরক্ষার অধিকার কিন্তু আমাদের আছে।
- আপনারা অনুষ্ঠান করেন, কিছু হবে না। আমি দেখছি।
রশিদ থানা থেকে বেরিয়ে যাবার খানিক পরেই করিম ডাঙ্গার নিজামের ফোন আসে ও সি সাহেবের মোবাইলে।
- স্লামালিকুম স্যার...
- ওয়ালাইকুম সালাম, নিজাম সাহেব... কেমন আছেন?
- আমি ভালো স্যার... খবর পাইলাম আপনে আলম ডাঙ্গা যাইতাছেন?
- হুম... একবার যাবো। অনেক করে ধরছে রশিদ সাহেব।
- কয়টা নাগাদ যাবেন?
- আটটা নাগাদ যাবো... রাতের খাবার অইখানেই খাবো, দশটা নাগাদ চলে আসবো।
- স্যার কি ফোর্স পাঠাচ্ছেন নাকি আলম ডাঙ্গায়?
- নাহ, সম্ভব হচ্ছে না। রশিদ সাহেব চাইছিলো, আমি না করে দিছি।
- ঠিকই করছেন স্যার। মানুষের ঘরোয়া অনুষ্ঠানেও যদি সরকারি ফোর্স পাঠাইতে হয়, তাইলে জনগনের জরুরী নিরাপত্তা লঙ্ঘন হবার সম্ভাবনা থাকে।
- আমি আইনের মানুষ, আমাকে আইনের ভাষা শিখানোর দরকার নাই। আমি শুনছি আপনার ছেলেরা আলম ডাঙ্গার অনুষ্ঠানে হামলা করার প্ল্যান করতেছে, ওইটা করবেন না।
- আপনে স্যার খামাকা অন্য একজনের কথা শুইনা আমাদের ওপর ভুল ধারণা করে বসে আছেন। আমাদের এখন বিশ্বকাপ নিয়ে কোন আগ্রহ নাই। আমাদের খেলা শেষ। আলম ডাঙ্গার কারো ঘরের দেয়াল উই পোকায় ফেলে দিলেও ওরা বলে করিম ডাঙ্গার ছেলেরা এই কাজ করছে। আমরা শান্তি চাই, কারো পাকা ধানে মই দেয়া আমাদের কাজ না। কেউ নিজেরা দলাদলি করবে, নিজেরা মারামারি করবে, আর অভিযোগ করবে আমরা করছি, এইটাতো হইতে পারে না। আমি আপনারে জানায়া রাখতে চাই, কারো মিথ্যা, বানানো অভিযোগে আপনে আমাদের গ্রামের ছেলেদের হয়রানি করবেন না। আমাদের পার্টির সেক্রেটারি মোজাম্মেল ভাইও আপনারে ফোন দিবে, উনিও জানেন, করিম ডাঙ্গার ছেলেরা শান্তি চায়।
সারাদিন পুরো গ্রাম জুড়ে নিরবচ্ছিন্ন কান বধির করা মাইকিং, গ্রামের ছেলে বুড়ো সবার ক্লান্তিহীন ছুটোছুটি আর উৎসাহ উদ্দীপনায় রাত আটটা থেকেই আলম বাড়ির প্যান্ডেলে অনুষ্ঠান শুরু হয়ে যায়। পুরো গ্রাম যেন ভেঙ্গে এসেছে। ছেলে বুড়ো, তরুণ-তরুণী কেউ বাকি নাই। প্যান্ডেল লোকে লোকারণ্য। মুহুর্মুহু করতালির মধ্য দিয়ে বক্তারা বক্তব্য রাখছেন। গ্রামের ছেলেমেয়েদের শারীরিক খেলাধুলা, শারীরিক কসরত বৃদ্ধির দিকে নজর দিতে বলছেন। খেলাধুলা কিভাবে ভাত্রিত্ববোধ বাড়ায়, কিভাবে একতা বাড়ায়, কিভাবে শারীরিক ও মানসিক বিকাশ করে তা নিয়ে কথা বলছেন। গ্রামের লোকের কাছে এ এক নতুন অভিজ্ঞতা। আলম বাড়ির রশিদ না থাকলে কে এসব করতো? রশিদুল আলমের প্রতি গ্রামবাসীর কৃতজ্ঞতার শেষ নাই। এ শ্রদ্ধা, এ কৃতজ্ঞতা রশিদকে যেন ছুঁয়ে যাচ্ছে না। ও গম্ভীর হয়ে ষ্টেজের এক কোণায় বসে আছে। কিছুকষণ পরপর মোবাইলে কথা বলছে। আলম ডাঙ্গার সেনাপতি ও। আলম ডাঙ্গার মানুষগুলোর নিরাপত্তা ওর হাতে। গ্রামের গুরুত্বপুর্ন পয়েন্টে ছেলেদের দাঁড় করিয়ে রেখেছে। ওর কাছে খবর আছে করিম ডাঙ্গার ছেলেরা গ্রামের উত্তর পাশ দিয়ে ঢোকার সম্ভাবনা বেশী। ঢুকুক। গ্রামের সীমানায় ওদের লাশ পড়ে থাকবে।
সেহরির ঠিক আগে আগে, ইমাম সাহেবের স্ত্রী অজ্ঞান হয়ে গেছেন। মাওলানা সাহেব দিশাহারা হয়ে জমিলার মাকে খুঁজতে গেছেন, জমিলার মা বাড়িতে নাই, আলম বাড়ির প্যান্ডেলে আছেন। হাসপাতালে নেবার জন্য একটা ভ্যান গাড়ি দরকার। ভ্যান গাড়িওয়ালারা সবাই সারাদিন আলম বাড়ির প্যান্ডেলে এটা সেটা টেনেছে। এখন গাড়ি বন্ধ করে খেলা দেখছে। কেউ যেতে রাজি হচ্ছে না। অনেক অনুনয় করার পর, একজনের দয়া হয়। সে ইমাম সাহেবকে নিজের ভ্যান গাড়ি দিয়ে দেয়। ইমাম সাহেব পাঁজাকোলা করে স্ত্রীকে ভ্যানে শুইয়ে দেন। নিজেই ভ্যান টেনে টেনে এগুতে থাকেন। ঠিক তখুনি গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি শুরু হয়ে যায়। গ্রামের রাস্তায় খানা খন্দে পড়ে ঝাঁকুনিতে, গায়ে বৃষ্টির ফোঁটা পড়ে, ইমাম সাহেবের স্ত্রীর জ্ঞান ফিরে আসে। সে প্রচন্ড ব্যথায় কোঁকাতে থাকে। অনভ্যস্ত শরীরে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির মধ্যে ভ্যান টানছেন ইমাম সাহেব। আসন্ন বিপদের আশঙ্কায়, স্ত্রীর যন্ত্রণাকাতর গোঙানিতে, ভ্যান টানার কষ্টে, প্রতিবার প্যাডেল মারার সময় ফুঁপিয়ে উঠছেন তিনি। ওদিকে আলম ডাঙ্গার উত্তর সীমানা দিয়ে গুঁড়ি মেরে এগিয়ে আসছে করিম ডাঙ্গার ছেলেরা।
২| ০৫ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৪ বিকাল ৩:১৬
আসাদ কাজল বলেছেন: ধন্যবাদ।
৩| ০৫ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৪ রাত ৯:৩০
কলমের কালি শেষ বলেছেন: গল্পটা পড়তে পড়তে ভালোই লাগছিল কিন্তু হঠাৎ পরিনতি ছাড়া কাহিনীর ইতি ।
ভালো লিখেছেন ।
৪| ০৫ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৪ রাত ১০:১৯
আসাদ কাজল বলেছেন: ধন্যবাদ...
©somewhere in net ltd.
১|
০৫ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৪ দুপুর ১:০১
নিরব জ্ঞানী বলেছেন: গল্পটা ভাল লাগলো।++++