![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
জেরিন লেডিস টেইলারস। নতুন গড়ে ওঠা আবাসিক এলাকাটায় ঢোকার মুখে বড় রাস্তার ধার ঘেঁষে দোকানটা। দোকান অনুপাতে সাইনবোর্ডটা বেশ ছোট। কারণ, ওটার প্রয়োজন হয় না। স্বত্বাধিকারী হারুন তালুকদার এই পেশায় বেশ পুরনো। ছেলেদের শার্ট প্যান্ট দিয়ে তাঁর টেইলারিং এর হাতেখড়ি হলেও, ধীরে ধীরে মেয়েদের কাপড় সেলাইয়ে তাঁর আগ্রহ এবং প্রতিভা, দুইই বুঝতে পেরে লেডিস টেইলারিংয়ে ডেরা গেড়েছেন। কিছুদিন থ্রি পিস আর বোরকার কাজ করেছেন। একসময় তাঁর ডিজাইন করা সৌদি বোরকা এই শহরের ঘরে ঘরে মহিলাদের পছন্দের তালিকায় এক নাম্বারে ছিলো। তবে, ব্লাউজের কাজ শুরু করার পর আর কিছুতে হাত দেননি। গত বছর পনেরো তিনি এই এলাকার সবচেয়ে নামী এবং ব্যস্ত ব্লাউজের কারিগর। আজকাল নিজে কাজ করেন না। তাঁর নিজের হাতে তৈরি দুজন টেইলার মাস্টার আছে। ফরহাদ এবং রানা। ওরাই কাজ করে। দুজনেরই তরুণ বয়স। ব্লাউজের কাজ ওরা বেশ আগ্রহ নিয়েই করে। কাস্টমারদের শারীরিক গঠন কিংবা শাড়ির সাথে মিলিয়ে ব্লাউজের ডিজাইন নিয়ে মনকাড়া মতামতও দেয়। হারুন তালুকদার দোকানের ক্যাশে বসে নিজের হাতে তৈরি কারিগরের মুন্সিয়ানা উপভোগ করেন। ওদের কাজে তিনি বেশ খুশী। এতদিনের কাজের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি নারী মনের অলিগলি চিনে ফেলেছেন। তাঁর কারিগরেরাও সেই পথে হাঁটছে। তাদের উন্নতি দেখে তাঁর আনন্দ হয়।
আজ বৃহস্পতিবার। হারুন তালুকদার রোজা রেখেছেন। সপ্তাহের এই দিনে তিনি রোজা রাখেন। গত মাসে তাঁর ছাপ্পান্ন বছর পূর্ণ হলো। বার্ধক্যের দোরগোড়ায় দাঁড়ানো বলে নয়, বেশ তরুণ বয়স থেকেই জীবনাচরণে তিনি ধর্মীয় রীতি রেওয়াজ বেশ নিষ্ঠার সাথে পালন করেন। বেশীর ভাগ সময়ে সেলোয়ার কুর্তা পরেন। জামায় কালচে রঙের আধিক্য থাকে। মাথায় কালো টুপি থাকে। যত্ন করে ছাঁটা সাদা কালো চাপদাঁড়ীতে তাঁকে ভীষণ অভিজাত মনে হয়। তিনি কথা বলেন নিচু স্বরে। আচরণে অমায়িক। তবে, আজ কিছুতেই মেজাজটা ধরে রাখতে পারছেন না। তাঁরই বন্ধু জলিল জোয়ারদারের মেয়েটা সকালে দোকান খুলতে না খুলতেই এসে গতকাল ডেলিভারি নেয়া ব্লাউজটা ফেরত দিয়ে গেছে। ব্লাউজের ডিজাইন পছন্দ হয়নি। ব্লাউজের ডিজাইন পছন্দ কিংবা অপছন্দে ওদের কিছু যায় আসে না, কারণ ওরা সব সময় কাস্টমারের দেয়া ডিজাইনে সেলাই করে থাকে। সমস্যা হয়েছে, এই মেয়েটার ডিজাইন দিয়েছে ওরই কারিগররা। ওরাই আগ বাড়িয়ে ডিজাইন ঠিক করে দিয়েছে। মেয়েটা খানিক দ্বিধা নিয়ে রাজি হয়েছিলো, তবে, ব্লাউজ রেডি হবার পর গায়ে দিয়ে দেখে ওটা ওকে ঠিক মানাচ্ছে না। এখন কাপড় কিনে দিতে হবে, নতুন করে সেলাই করতে হবে। ওদের দোকানে এমনিতেই অর্ডার জমা হয়ে থাকে। এর মধ্যে এসব ঝামেলা হলে সময়ের কাজ সময়ে দেয়া যায় না। হারুন তালুকদার তাঁর দোকানের সম্মানের ব্যাপারে ভীষণ স্পর্শকাতর। যে কোন অভিযোগ বেশ গুরুত্ব দিয়ে দেখেন।
‘আচ্ছা! তরা কি ইচ্ছা কইরা এই ইতরামিটা করলি?’
কারিগর দুজন কোন কথা বলে না। চোখ নামিয়ে নিজেদের কাজ করতে থাকে।
‘তরা কি মনে কইরা এইরাম পাতলা দুর্বল মাইয়াডারে সিঙ্গল শোল্ডার ডিজাইনটা দিলি? এখন ব্লাউজের ফাঁক দিয়া কাঁধের হাড্ডি বাইরাইয়া থাকলে কার ভাল লাগব?’
‘দিপিকা পাডুকোন পড়তাছে...’ সেলাই করার ফাঁকে বিড়বিড় করে রানা বলে।
‘কি কইলি?’ ধমকে ওঠেন হারুন তালুকদার।
‘হেইতো কইল নতুন কোন ডিজাইন থাকলে কইরা দেওনের লিগা...’ ফরহাদ কথা বলে।
‘অরা আইজ কাইলকার মাইয়া। সখ কইরা শাড়ি ব্লাউজ পরতাছে, মাথার ভিতরে ক্ষণে এইডা, ক্ষণে ওইডা। সে বলছে, তাই বইলা এই ডিজাইনটা দিবি? এইরাম শুকনা মেয়েছেলেরে দিবি থ্রি কোয়ারটার হাতা, ওগো দিবি কলার স্টাইল ব্লাউজ, চায়না কলার দিবি কি ব্যান্ড কলার দিবি সেইটা তার ইচ্ছা... এখনো কি তগো হাতে ধরায়া কাম শিকাইতে হইব?’
কারিগর দুজন চুপ করে থাকে।
‘তরা জানস সে আমার বন্ধুর মাইয়া, জানস না? অল্পক্ষণ পরেই ওর বাপে আইসা দোকানে বইব। ঘ্যানঘ্যান কইরা আমার মাথা খাইব। এদিকে এই কাপড় আমাগো ইস্টকেও নাই। এত অর্ডার জমা হইয়া আছে, এর মধ্যে এইসব ভাল্লাগে? কামতো তরাই করবি, ডাবল কাম করার মাইনে কি?’
আরও খানিক বকাবকি করে, কারিগর রানার হাতে টাকা দিয়ে ব্লাউজের কাপড় কিনতে ওকে মার্কেটে পাঠিয়ে দেয় হারুন তালুকদার। রানা বেরিয়ে গেলে, তিনি দোকানে থাকা কাপড়ের থানগুলোর দিকে তাকিয়ে একটা ব্লাউজের কাপড় পছন্দ করার চেষ্টা করেন। মেরুন রঙের একটা কাপড় পছন্দ হয়। ওটা থেকে একটা ব্লাউজের জানা মাপে কাপড় কেটে নেন। থ্রি কোয়ারটার হাতায় গলায় কুঁচি দিয়ে একটা ব্লাউজ বানাবেন। এই কাজটা তিনি নিজে করবেন। তাঁর একমাত্র সন্তান, তাঁর মেয়ে জেরিনের জন্য। বছর বিশেক বয়সী মেয়েটা বুদ্ধি প্রতিবন্ধী। প্রতিদিন রাতে দোকান বন্ধ করে তিনি যখন বাড়ি ফিরেন, হাতে করে একটা নতুন ব্লাউজ নিয়ে যেতে হয়। জেরিন এসে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকে। ব্লাউজটা হাতে পেলেই দারুণ আনন্দে ওর চোখ মুখ জ্বলজ্বল করে ওঠে। ব্লাউজটা হাতে নিয়ে খানিক নাকে চেপে ধরে। নতুন কাপড়ের গন্ধ নেয়। তারপর সারারাত ওটা গায়ে দিয়ে থাকে। সকালে উঠে, ওটা গা থেকে খুলে ছিঁড়ে কুচিকুচি করে ফেলে দেয়। দিনের শুরুতেই মেয়েটার সে এক অদ্ভুত খেলা। বাবা মা দুজন দরজার পাশে দাঁড়িয়ে বিষণ্ণ তাকিয়ে তাকিয়ে দেখেন। প্রতিদিন হারুন তালুকদার দোকানে আসেন। দোকানে বসতে না বসতেই তাঁর ব্যস্ততা শুরু হয়ে যায়। কাস্টমারের অর্ডার বুঝে নেয়া, কারিগরদের অর্ডার বুঝিয়ে দেয়া, ডেলিভারি দেয়া, পেমেন্ট নেয়া, দোকানের অত্যাবশ্যকীয় স্টক চেক করা, এসব প্রচন্ড ব্যস্ততার মধ্যেও, ভীষণ মমতা নিয়ে, নিজের হাতে নতুন ডিজাইনে নতুন আরেকটা ব্লাউজ বানান। জেরিন প্রচণ্ড উচ্ছাস নিয়ে রাতে ওটা গায়ে দেবে। তিনি জানেন, মেয়েটা সকালে উঠেই ওটা ছিঁড়ে কুচিকুচি করবে। করুক। হারুন তালুকদারের চোখে কেবল মেয়ের উচ্ছাসটাই লেগে থাকে।
৩০ শে নভেম্বর, ২০১৯ বিকাল ৪:২১
আসাদ কাজল বলেছেন: আমি একটা বুদ্ধি প্রতিবন্ধি মেয়ের বাবার ছবি আঁকতে চেয়েছি এখানে। একজন স্বশিক্ষিত মানুষ। কনভেনশনাল একাডেমিক শিক্ষা তিনি পাননি। তারপরেও নিজের মতো করে সমাজে দাঁড়িয়েছেন। বুদ্ধিপ্রতিবন্ধি একমাত্র মেয়েটাকে প্রচন্ড স্নেহ করেন। ভালোবাসেন। প্রতিদিনকার হাজার কাজের চাপেও ভালোবাসাটা জিইয়ে রেখেছেন, অনুভব করছেন। মেয়েটার এরকম আচরণের পেছনে স্নায়বিক এবং মানসিক নানা ব্যাপার জড়িত আছে। সেটা গল্পে টানলে মেডিকেল টার্ম চলে আসতো অনেক। অনুগল্পের স্বাদটা থাকতো না। অনুভবটাও পালটে যেতো। ধন্যবাদ।
২| ৩০ শে নভেম্বর, ২০১৯ বিকাল ৪:০৮
রাজীব নুর বলেছেন: টেইলার্স কাহন পড়ে আমি অভিভূত!
প্রতিটা টেইলার্সে এরকম একজন করে হারুন তালিকদার আছেন।
৩০ শে নভেম্বর, ২০১৯ বিকাল ৪:২৩
আসাদ কাজল বলেছেন: ধন্যবাদ। একজন ভালো এবং দক্ষ লেডিস টেইলারের মূল্য ভোক্তারা ছাড়া কেউ জানে না।
৩| ৩০ শে নভেম্বর, ২০১৯ বিকাল ৫:৩৩
রাজীব নুর বলেছেন: লেখক বলেছেন: ধন্যবাদ। একজন ভালো এবং দক্ষ লেডিস টেইলারের মূল্য ভোক্তারা ছাড়া কেউ জানে না।
মেয়েরা কোনো টেইলার্সে জামা বানিয়ে শান্তি পায় না। এই সমস্যা, সেই সমস্যা।
৩০ শে নভেম্বর, ২০১৯ সন্ধ্যা ৭:৫৬
আসাদ কাজল বলেছেন: পোশাকের ব্যাপারে ওরা খুঁতখুঁতে তাই।
৪| ৩০ শে নভেম্বর, ২০১৯ বিকাল ৫:৪০
চাঁদগাজী বলেছেন:
সাধারণ, আপনি কি নারী ব্লগার?
৩০ শে নভেম্বর, ২০১৯ সন্ধ্যা ৭:৫৭
আসাদ কাজল বলেছেন: উঁহু।
©somewhere in net ltd.
১|
৩০ শে নভেম্বর, ২০১৯ বিকাল ৪:০১
মেহরাব হাসান খান বলেছেন: শেষ এমন ভয়ানক এন্ডিং করবেন, আমিতো ভাবিনি! আশ্চর্য!
এহেন আচরনের কারনটা কিছু লিখলেও পারতেন। চেষ্টা করবেন নাকি?