নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

এজেডএম আলমগীর

এজেডএম আলমগীর › বিস্তারিত পোস্টঃ

মুরং

২৮ শে এপ্রিল, ২০১৩ রাত ১২:৩৩

১৯৭৮ সালের কথা। তখন ক্লাস এইটে পড়ি। ‘মৌচাক’ স্কাউটস জাম্বুরীতে যাব। সেটা ছিল প্রথম জাম্বুরী। যাবার আগে শুরু হলো প্রস্তুতি। স্কুলের মাঠে তাঁবু খাঁটিয়ে আছি। রান্না-নাওয়া-খাওয়া সব ক্যা¤েপই। পাহাড়ে হাইকিং করছি। রাতে ক্যা¤প ফায়ার। দারুণ সব ঘটনা। নুরুল ইসলাম স্যার নেতৃত্ব দিচ্ছেন। জাম্বুরীতে মুরং নাচ প্রদর্শন করবো। মুরং নাচ শিখবার জন্য মুরং পাড়ায় যেতে হবে। থাকতে হবে। নাচ শিখতে হবে।



বান্দরবান থেকে শুয়ালোক পর্যন্ত পরিচিত পাকা রাস্তা। গাড়ি যায়। তারপর হাঁটা পথে বাঁয়ে কিছুদুর গিয়ে শুরু হলো পাহাড়ী রাস্তা। পাহাড়ে-জংগলে যাচিছ তো যাচ্ছি। যেতে হবে ‘বসন্ত পাড়া’। সাথে অনেক লোকের মধ্যে আছে সেখানকার কারবারী-হেডম্যান ইত্যাদি। যেতে যেতে রাত হয়ে গেল। এমন সব পাহাড়ী রাস্তা - যে কোন সময় পড়ে যেতে পারি। টর্চের আলোতে চলছি। তবে, অনেক লোকের কারনে ভাগে আলো খুব কমই জুটছে। অনেকটা আন্দাজ করে অনেকের পিছনে পিছনে চলছি।



স্থানীয় কারবারি, হেডম্যান তারা অন্ধকারে কু দিয়ে যাচ্ছে। কু দেয়া তাদের সংকেত। অদূরেই কোন স্থান থেকে কু এর উত্তর আসছে। লোকজন আলো নিয়ে এগিয়ে আসছে। বেকায়দা এক পাহাড়ী রাস্তা বেয়ে অন্ধকার রাতে পৃথিবীর কোন এক নির্জন পাহাড়ের চূড়ায় উঠে এলাম।



রাতে থাকার আয়োজন চলছে। উইলিয়াম, নুচ প্র“ু, ইকবাল, অংছাই এদের নাম মনে আসছে। একটা ঘরে থাকার জন্যে উঠলাম। মাটি থেকে উপরে বাঁশের ঘর। নীচে শুকর গুলো আওয়াজ করছে।



রাতে চারিদিকে পাহাড়ী ঘরগুলোর মাঝখানে আগুন জ্বালিয়ে দীর্ঘক্ষণ চললো মুরং নাচ শেখার মহড়া। ইয়া বড় বড় সব বাঁশী। জীবনে প্রথম এ ধরনের বাঁশী দেখলাম। বাঁশীর সে কি উচ্চতা যেন পাহাড়ের সমান। আছে ঢোল-তবলা। ছেলেরা বাদ্য-যন্ত্রগুলো বাজাচ্ছে আর মেয়েরা নাচছে। হাতে ধরে ধরে অর্ধ বৃত্তাকারে নাচ। অনেক রাত অবধি চললো এ মহড়া। অনেক ক্ষিদে পেটেও কোন রকম চারটা খেয়ে অস্বস্থি নিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।



সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি পাশে কেউ নেই। জানতে পারলাম হাত মুখ ধুতে গিয়েছে। একজন পথ দেখিয়ে দিল। হেঁটে হেঁটে একটু নীচে ঝরণার দিকে যাচ্ছি। কোথাও কোন সাড়া শব্দ নেই। ত্রি-সীমানাও নেই। কেবল দূরের এবং কাছের কিছু পাহাড় থেকে কিছু বানরের ডাক শুনতে পাচ্ছি। সত্যিই বলছি আর কোন সাড়া শব্দ নেই। যেখানটায় দাঁড়িয়ে আছি সেখান থেকে অন্যান্য পাহাড়গুলো নীচু এবং সমান উচ্চতার মনে হচ্ছে। অনেক দূরে কিছু উঁচু পাহাড় আছে। চারিদিকে সবুজ আর সবুজ। পাহাড় আর পাহাড়। সমগ্র পৃথিবী থেকে এখন বিচ্ছিন্ন। কেমন যেন থমথমে নিরবতা। পৃথিবীর একত্রিত এ নিরবতা লিখে বুঝাতে পারবো না। এ নিরবতার শব্দ কানের ভিতরের গভীরতম কোন স্থানে অনুভব করলাম। ভাবছি, স্রষ্টা এত সুন্দর একটা সকাল উপহার দিল!!



আরো একটু সামনে এগিয়ে একটু নীচে তাকিয়ে দেখি একটা সুন্দর ঝরণা। ঝরণার পাড়ে গিয়ে মনে হলো, বিশাল বিশাল সব পাহাড়ের নীচে এখন দাঁড়িয়ে আছি। আবার এটাও মনে হলো, বিশাল বিশাল সব পাহাড়ের উপরে অবস্থান করছি। চারিদিকে পাহাড়ের কিনার ঘেঁষে ধুলোবালিহীন পরিচ্ছন্ন সবুজ সবুজ গাছপালা দাঁড়িয়ে আছে। গাছের পাতায় সকালের মিষ্টি রোদ পড়ে চিকচিক করছে। আপন মনে হাসছে। অনেক উঁচু থেকে ঝরণার পানি নেমে এসে অনেক নীচে চলে যাচ্ছে। ছোট ছোট পাথরের পাশাপাশি ঝরণার মাঝে মাঝে বড় বড় পাথর। একেক পাথরের উপরে বসে একেকজন হাতমুখ ধুচ্ছে আর গল্প করছে।



আজ অবধি জীবনের সবচেয়ে আশ্চর্য্যজনক দৃশ্যটি দেখলাম- এই ঝরণার পাড়ে। এ দৃশ্য কখনোই ভুলবার নয়। তিনটি পূর্ণ বয়স্কা যুবতী মেয়ে। স¤পূর্ণ নগ্ন। ঝরণার পানিতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গোসল করছে। একেবারেই চোখের সামনে। ঝরণার পানির উপর সকালের রোদের আলো-ছায়ায় এ দৃশ্য আরোও দর্শণীয় হয়ে উঠলো। তারা স¤পূর্ণ নির্বিকার। মনে হলো যেন, প্রতিদিনেরই এক স্বাভাবিক কর্ম তারা স্বাভাবিক নিয়মে স¤পাদন করছে। আমাদের উপস্থিতি ওদের মানসিক কিংবা ভাবনার জগতে এক চিলতে ঢেউও সৃষ্টি করলো না। গোসল শেষে নগ্ন অবস্থায় পানি নিয়ে বিনম্রভাবে হেঁটে চলে গেল। একেবারেই চোখের সামনে দিয়ে। চোখের দৃষ্টি তাদের নীচের দিকে। আমাদেরও দৃষ্টি নীচের দিকে। এ বিষয়টি নিয়ে কেউ কোন কথা বললাম না। হাতমুখ ধুয়ে উপরে উঠে এলাম।



একা বারান্দায় দাঁড়ানো। বারান্দাটা মাটি থেকে বেশ খানিকটা উঁচু। বাঁশের তৈরী। দেখি একেবারেই লাগোয়া সামনের ঘরের বারান্দায় স¤পূর্ণ নগ্ন একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চুল শুকোচ্ছে। চুল আঁচড়াচ্ছে। সকালের মিষ্টি রোদ তার শরীরের অর্ধেকটা দখল করে আছে। পাশে তার কোলের সন্তানটি বসা।



ওদের বেহেশতী সমাজে মনে হলো এটা কোন সমস্যা নয়। ওদের চোখে ও মনে এবং ওদের চিন্তার জগতে এমন এক পর্দা স্রষ্টা দিয়ে রেখেছেন যার জন্যে কাপড়ের প্রয়োজনীয়তা ওরা বোধ করছে না। কাপড় ব্যবহার করে আমরা যা করি, ভাবনার জগতে-ই ওরা সেটা থেকে বিচ্ছিন্ন থেকে তা’ স¤পন্ন করছে। বিষয়টাকে যেভাবে ভাবছি, তারা সেটা তাদের নির্মল চিন্তার মধ্যেও আনতে পারছে না। তারা যে নগ্ন এটা তারা বুঝছেই না। এটা তারা ভাবছেও না। মনে হলো নগ্ন শব্দটা যেন শুধু আমাদের জন্য প্রযোজ্য, আমরা যারা কাপড় পরি। গন্ধম খাওয়ার কারণে হয়তো এমনটা বোধ করি। সমাজ সহজভাবে মেনে নিলে কোথাও কোন সমস্যা নেই। আর সবচেয়ে বড় সমস্যাটাই হচ্ছে মনের জগতে। হয়তো তাই বলা হয়েছে -



“O Children of Adam! We have revealed unto you raiment to conceal your shame, and splendid vesture, but the raiment of restraint from evil, that is best. ...”

(Sura: Al-Araf, Ayat: 26)



সে সময়ে মুরং-দের দেখতাম শহরে প্রবেশ করার সময় পাহাড়ে কিংবা জংগলে দল বেঁধে দাড়িয়ে সর্বনিম্ন পরিমান কাপড় কেবল নির্দিষ্ট কিছু স্থানে জড়িয়ে একটা অস্বাভাবিক অবস্থায় যৌথ খামার প্রকল্পের টাকা নিতে আসতো। তারপর কাজ শেষে আবার সেই জংগলে কাপড়টি খুলে স্বাভাবিক হয়ে ফিরে চলে যেত।



একদিন সকালে বাসার দোতলার বারান্দায় দাড়ানো। দেখি নেংটি পরে দল বেধে কিছু মুরং লোকজন রাস্তা দিয়ে এগিয়ে আসছে। হাতে ছোট খাটো ধরনের লাঠি। আদিমতম হাতিয়ার। তারা অফিসের দিকে যাচ্ছে। হঠাৎ শহরের ভিতর থেকে চট্টগ্রামগামী দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকালীন সময়ের একটি বাস ছুটে এলো। অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখি, মুরং লোকগুলো দলভেঙ্গে দৌড়ে চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পরলো। গাছের আড়ালে জংগলে শুয়ে তারা আত্মরক্ষার চেষ্টা করছে।



ভাবছি - কি সৌভাগ্য নিয়ে জন্মেছি! বিংশ শতাব্দিতে বসে আদিম যুগকে লাইভ দেখতে পাচ্ছি! পৃথিবীকে দেখতে মানুষ কত দুর-দুরান্তে যাচ্ছে, টাইম মেশিন আবিস্কারের চিন্তা ভাবনা করছে অথচ নির্দিষ্ট স্থানে দাড়িয়েই বিভিন্ন সময়কে দেখছি! এটি স্রষ্টার আরেকটি উপহার!! বহুরুপি পৃথিবীর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নমুনা দেখছি জানছি একই অবস্থানে অবস্থান করে।



অন্য আরেকটি সকাল। ডাইনিং টেবিলে নাস্তা করছি। অফিসের কিছু লোকজন এলো। সাথে মুরং-দের বড় একটি দল। আব্বা দ্রুত নাস্তা স¤পন্ন করে বারান্দার দিকে এগুচ্ছে। চায়ের কাপ হাতে আব্বার পিছু নিলাম।



বারান্দায় আসতেই দেখি- মুরং লোকগুলো সবাই আব্বাকে সামনে রেখে মাঠে ক্ষাণিকক্ষন সেজদায় পরে রইলো। আব্বার বারন তারা কর্ণপাত করলো না। হালকা শীতের সকালে গরম চায়ের কাপের ধোঁয়ার পিছনে দাড়িয়ে দেখছি। ভাবছি- এস এম হলে থেকে আব্বা যেখানে লেখাপড়া করেছে, এ লোকগুলো যদি সমসাময়িক সময়ে সেখানে লেখাপড়া করতো, তবে কি তারা আজ এ আচরন করতো? মনে হলো- কখনো কখনো ভক্তি প্রকাশের ভঙ্গির সাথে স্বার্থ ছাড়াও, জানার সীমাবদ্ধতারও স¤পর্ক আছে।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.