নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
প্রিয় মেসি,
আর কতোবার ক্ষমা চাইব?
বিশ্বকাপ শুরুর পর থেকে আমি প্রতি দিন আপনার কাছে এবং আপনার দলটার কাছে হাত জোড় করে ক্ষমা চাই। আমি একজন অবিশ্বাসী হিসেবে বারবার মার্জনা চাই। কেন আপনার ওপর, আপনার কথার ওপর এবং আপনার এই লুকিয়ে থাকা বিস্ময়কর একটা যোদ্ধা দলের ওপর বিশ্বাস রাখতে পারিনি; সে জন্য আমি নিজেকে ক্ষমা করে উঠতে পারি না।
বিশ্বকাপ শুরুর আগে আমরা বলেছিলাম, আপনার এবং জনা তিনেক তারকার নাম বাদ দিলে এই আর্জেন্টিনা দলটা স্মরণকালের সবচেয়ে জঘন্য দল। আমরা বলেছিলাম, আপনিও এই দলে আছেন কেবল নামে; আপনাকে তো আর্জেন্টিনার কোনো কাজে লাগে না।
আপনি কথাটা কী শুনতে পেয়েছিলেন? কী ভয়ানকভাবেই না জবাব দিলেন!
প্রথম চারটে ম্যাচের প্রতিটাতেই ত্রাতা হয়ে আবির্ভূত হলেন। গোল করে করে বের করে আনলেন ম্যাচগুলো; গোল করিয়ে টিকিয়ে রাখলেন আর্জেন্টাইন মশাল। না, ২০১০ সালের মতো সেই জাদুকরী ফর্মে আসেননি আপনি।
তাতে কোনো সমস্যা নেই। আমাদের মতো মূর্খ, অবিশ্বাসীদের জন্য দরকার ছিল এই এই ম্যাচ জেতানো গোলগুলো। আপনি ২০১০ সালে যতই সেরা পারফরম্যান্স করুন, যতই আপনার পায়ে পোষা বেড়ালের মতো ভেল্কি দেখাতে থাকুক বল, যতই আপনি হিগুইয়েন-মিলিতোকে দিয়ে গোলবন্যা বইয়ে দেন; আমরা বলেছি–আপনি ব্যর্থ হয়েছিলেন। ম্যাজিক ফুটবল, গন্ডা গন্ডা আক্রমণের ম্যাচ দেখে খুশী হই না; আমরা আপনাকে যারা অবিশ্বাস করেছিলাম, আমরা চিনেছিলাম শুধু জয়। সেই জয় কিভাবে আনতে হয় আপনি এবার বুঝিয়ে দিলেন।
আপনি দেখিয়ে দিলেন, মেসি চাইলে সব পারে; চাইলে মনও কাড়তে পারে, চাইলে প্রাণও কাড়তে পারে। এবার সেই জয়মুখী খেলা দেখিয়ে আপনি বুঝিয়ে দিলেন, ঘৃনাকারীদের এবং অবিশ্বাসীদের কিভাবে বশে আনতে হয়!
কিন্তু আমাদের পাপের তো এখানেই শেষ নয়।
আপনি যখনই আর্জেন্টিনার নায়ক হয়ে উঠতে শুরু করলেন; আমরা বলতে শুরু করলাম–এই দলটি আসলে মেসি এবং ১০ জনের দল। সেই বাকী দশ জন থাকার চেয়ে না থাকাও ভালো। আমাদের মতো নাবালক, নির্জ্ঞানদের কথা কী বলবেন! আপনার সাবেক গুরু ম্যারাডোনা পর্যন্ত বললেন, এই দলে মেসি ছাড়া কিচ্ছু নেই। তারা এবং আমরা; সব পাপিষ্ঠরা বললাম–আপনাকে সঙ্গ দেওয়ার যোগ্যতা নেই হিগুয়েইন বা ডি মারিয়ার।
আপনি কী ওদের কানে কানে কিছু বলেছিলেন? দ্বিতীয় রাউন্ড ও কোয়ার্টার ফাইনালে ঝলসে উঠলেন ডি মারিয়া এবং কোয়ার্টার ও সেমিতে ঝলসালেন হিগুয়েইন। যে খেলাটা ভুলে মাদ্রিদে ও নাপোলিতে ফেলে এসেছিলেন; সেটাই যেন ফিরিয়ে আনলেন আপনার দেওয়া কী এক গুপ্তমন্ত্রে।
এখানেও শেষ হল না। আগেই আপনার প্রিয় বন্ধু আগুয়েরো ইনজুরিতে পড়েছিলেন। মাত্রই ফর্মে ফেরা ডি মারিয়াও ইনজুরিতে পড়ে বিদায় বললেন।
আমরা বললাম, এবার? এবার যদি মেসির জাদু কোনো কারণে বন্ধ থাকে; কী হবে?
আপনি কী হেসেছিলেন? নাকি আমাদের দিকে অবিশ্বাসের চোখে তাকিয়েছিলেন–এই নির্বোধেদের কবে জ্ঞান হবে?
না, আমাদের জ্ঞান হওয়ার আসলেই বাকী ছিল। নইলে গতকাল এসে কেন আমরা বুঝতে পারবো, আপনার দলে হ্যাভিয়ের মাচেরানো নামে একজন মায়েস্ত্রো আছেন।
আমি জানি, মাচেরানো আপনার প্রিয় এক বড় ভাই। ক্লাবে, জাতীয় দলে আপনাকে বুক দিয়ে আগলে রাখেন। ছিলেন অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার। দলের আর ক্যারিয়ারের প্রয়োজনে পেছাতে পেছাতে সেন্ট্রাল ডিফেন্ডারের রোলও পালন করেছিলেন একবার বার্সেলোনায়। তারপরও আমরা আপনার মাচেরানো ভাইকে বিশ্বাস করিনি।
এই বিশ্বকাপেই দেখুন না। প্রতিটা ম্যাচে যেভাবে মিডফিল্ড ধরে রাখছিলেন, যেভাবে বল উইন করে নস্যাত করে দিচ্ছিলেন আক্রমন; তাতেই তো আমাদের আর বলা উচিত ছিল না যে, এটা শুধু মেসির দল। আমরা তো সত্যিকারের অপদার্থ। তাই গতকাল আপনি যখন প্রথম নিষ্প্রভ হয়ে রইলেন, তখনই আমরা যেন বুঝতে পারলাম মাচেরানোর জাদু।
এবার নামে মিডফিল্ডার হিসেবে খেলছেন। কিন্তু কী করছেন মাচেরানো? আসলে বলা উচিত, কী করছেন না!
মাথায় আঘাত পেয়ে শুরুর দিয়েই অচেতন হয়ে পড়লেন। সাবেলা বুকে হাত দিয়ে বসে পড়লেন। পাশে সহকারী কোচ টিম লিস্ট নিয়ে দাড়িয়ে পড়লেন; বদলীর চিন্তা চলছে। মাচেরানো চোখ মেললেন। হেটে মাঠের বাইরে এলেন। বড় করে নিঃশ্বাস নিয়ে বদলী নামাতে নিষেধ করলেন। হাত দিয়ে ইঙ্গিত করলেন–আমি আছি।
কিভাবে থাকলেন? মাঝ মাঠ থেকে যে অল্প কয়েকটা আক্রমন তৈরী হল, তার প্রায় প্রতিটি তৈরী করে দিলেন, কয়েকবার করে ফরোয়ার্ড হয়ে গেলেন গোল এনে দেওয়ার আশায়। আবার নেমে এলেন ডিফেন্সে। অসাধারণ স্লাইড ট্যাবেকল করে নিশ্চিত গোলটা ঠেকালেন, একটার পর একটা ফেয়ার ট্যাকেল করে রীতিমতো সেন্ট্রাল ডিফেন্ডারও হয়ে উঠলেন। ধারাভাষ্যকার বলছিলেন–মাচেরানো শুধু গ্লাভস নেই বলে কিপিংটা করছেন না!
আহ! আমরা নির্বোধের দল নির্বোধ এতোটাই নির্বোধ যে, আপনি সংবাদ সম্মেলনে বারবার বলা স্বত্তেও আমরা মনে রাখতে পারিনি এই মাচেরানোর কথা।
আমরা আসলে তো কিছুই বুঝতে পারিনি। স্রেফ বিভিন্ন লিগের কতোগুলো ফালতু পরিসংখ্যান আর তথ্যের ভরসায় খুব পন্ডিত সেজে বসেছিলাম। আমরা বুঝতে পারিনি, একজন ফুটবল জগতের রাজা যখন দেবদুতদের নিয়ে মর্তে নেমে আসেন; সেখানে এই তুচ্ছ জাগতিক পরিসংখ্যানের মূল্য থাকে না।
আমরা বলেছিলাম আর্জেন্টিনার ডিফেন্স কাঁচা মাটির দেয়ালের চেয়েও ভঙুর। বাড়ির পাশের ন্যাংটা ছেলেটাও ওই ডিফেন্স ভেঙে ঢুকে যেতে পারবে। আমরা বলেছিলাম, গ্যারে-ডেমিকেলিস-রোহো-জাবালাদের মাঠে থাকার চেয়ে না থাকাও ভালো।
আপনি বারবার বলেছেন, এদের ওপর আস্থা রাখুন। এরা তরুন, অনভিজ্ঞ; কিন্তু এরা জীবন দিতে জানে।
আহ। কী বর্শার ফলার মতো সত্যি কথা, কী অমোঘ বানী। সেই ভঙুর, বাজে, যাচ্ছেতাই ডিফেন্স; নকআউটপর্বে এসে হয়ে উঠলো এবারের বিশ্বকাপের সবচেয়ে ক্লিনিক্যাল ডিফেন্সিভ গ্রুপ! উল্লেখযোগ্য ফাউল না করেই ম্যাচের পর ম্যাচ ইউরোপ কাপানো হ্যাজার্ড, লুকাকু, রোবেন, ফন পার্সিদের হতাশ করে রাখলো সেই ডিফেন্স দল। সেই ডিফেন্স দলের অফসাইড ট্রাপে পড়ে ঝানু ঝানু স্টাইকারদের প্রাণ ওষ্ঠাগত!
তারপর আমরা বললাম, এরা হয়তো কোনোক্রমে গোল ঠেকাতে পারে, ওভারল্যাপ করতে পারে না।
আহারে সব পন্ডিতের দল। আপনার জায়গায় আমি হলে এসব সমালোচকের নাক মাটিতে ঘসে দিতাম। আপনি নিতান্ত ভদ্রলোক বলে ছেড়ে দিলেন। রোহো আর জাবালেতার এমন অসাধারণ ওভারল্যাপ দেখার পরও আমরা এইসব কথা বলার সাহস পেলাম কী করে?
কাকে ছেড়ে কার কথা বলবো? এই যে লুকাস বিগিয়া হাতে ব্যান্ডেজ নিয়ে, জাবালেতা মুখের ভেতরে দৃশ্যমান ব্যান্ডেজ নিয়ে এবং মাচেরানো মাথায় ঝুঁকিপূর্ন চোট নিয়ে খেলে গেলেন; এদের কাকে নিয়ে আলাদা করে মহাকাব্য লিখবো আমরা? সেই মুখ কী আছে আর? আমরা তো এদের আগে গোনাতেই ধরিনি।
সবচেয়ে বেশী গননার বাইরে রেখেছিলাম ওই ছেলেটিকে।
হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন সার্জিও জার্মান রোমেরোর কথা বলছিলাম। বালখিল্য, ছেলেমানুষ, বোকা, সবচেয়ে খারাপ গোলরক্ষক, ব্লান্ডার করায় পারদর্শী, ক্লাব ক্যারিয়ার বলে কিচ্ছু নেই; এই রোমেরোকে নিয়ে কতো কথাই না বলেছি আমরা। আমরা তাকে ‘স্যার’ বলে ট্রলও করেছি।
আমরা ভুলে গিয়েছিলাম, প্রতিপক্ষ নেদারল্যান্ডস কোচ লুই ফন গলেরই প্রিয় শিষ্য ছিলেন এই রোমেরো। এই ফন গলই তার প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে ডাচ দেশে নিয়ে গিয়েছিলেন তাকে। কপালের ফেরে আজ মোনাকোতে সাইড বেঞ্চে বসে থাকতে হয় বলে কতো না রসিকতা তাকে নিয়ে।
আপনার রোমেরো কিন্তু হাসি হাসি মুখ করে এই রসিকতাগুলো শুনেছে। শুনেছে আর ভেবেছে মনে হয়। ভেবে একদিন হঠাৎ করে আমাদের দু গালে দুটো, হ্যাঁ গুনে গুনে দুটো চপেটাঘাত করে দিলো। আমরা সম্বিত ফিরে পেয়ে দেখলাম হৃদয়, ফুসফুস জিতে নেওয়া ওছোয়া, এনেইমা, এমনকি নয়্যারদেরও ছাপিয়ে এই
বিশ্বকাপের এখন পর্যন্ত সেরা গোলরক্ষক সেই রোমেরো!
হায়রে আমাদের পাপ!
আমি জানি, এই পাপের নিস্তার নেই। অবিশ্বাসের চেয়ে বড় পাপ আর হয় না।
তাই আমি বিশ্বাস রাখলাম প্রিয় লিওনেল আন্দ্রেস মেসি।
আমি জানি, জার্মানদের যে কোনো তিনটি খেলোয়াড়ের ফর্মের সমান অবস্থায় নেই আপনার পুরো দল। আমি জানি মুলার, ক্রুস, ক্লোসাদের নয়া তরিকা এব পুরোনো মেশিন মিলিয়ে পিষে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে আপনাদের। আমি জানি, ব্রাজিলের ৭-১ কেলেঙ্কারির পর আর্জেন্টিনা আরও বড় কেলেঙ্কারির শিকার হতে পারে ফাইনালে। হিসাব বলে তাই হবে।
কিন্তু মেসি, আমি এও জানি, এসব হিসাব হলো মর্তে বসে আমাদের খাতা-কলম পেষা হিসাব। এসব হিসাব আমাদের মূর্খের স্বান্তনা। এই হিসাবের মধ্যে আপনার জাদুকে যোগ করা হয়নি, আপনাদের যোদ্ধাদের পরিণত হয়ে ওঠার বিস্ময়কে যোগ করা হয়নি, আপনার বন্ধুদের প্রাণ বিলিয়ে দেওয়ার প্রবণতাকে হিসাব করা হয়নি। আর এসব আবেগ, জাদু হিসাবের খাতায় লেখাও যায় না।
আমি তাই আজ থেকে আর কোনো হিসাব করবো না। আর কখনো টাইব্রেকার ফেলে ছাদে পালাবো না। আমি এখন থেকে আপনার এবং আপনার বাহিনীর ওপর শুধুই বিশ্বাস রেখে যাবো। আপনি বিষ বা অমৃত, যাই দিন না কেন, বিশ্বাস করে আকণ্ঠ পান করবো।
আমি বিশ্বাস করবো, আপনিই মুছিয়ে দেবেন ম্যারাডোনার নব্বই সালের সেই চোখের জল। আমি বিশ্বাস করবো, আপনিই ঘোচাবেন ভেরন-জানেত্তিদের সোনালী প্রজন্মের হতাশা। আমি বিশ্বাস করবো, আপনি নিজের দু দুবারের হতাশা নিজেই ঘোচাবেন।
আমি বিশ্বাস করবো, আপনার চোখ বেয়ে নেমে আসা আনন্দ অশ্রুর প্রতিটা ফোটায় ধুয়ে মুছে যাবে আর্জেন্টাইনদের দুই যুগের কান্না।
আপনি ট্রফি আনতে পারুন আর নাই পারুন; আমি আপনাকে বিশ্বাস করবো।
আমি আজ আপনাতে বিশ্বাস আনলাম।
ইতি
আপনার গুনধর ভক্ত
©somewhere in net ltd.