নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ঢেউ টলোমল পদ্ম পুকুর

বাবুল অাবদুল গফুর

লেখক, চিত্রশিল্পী ও সরকারি চাকুরিজীবী

বাবুল অাবদুল গফুর › বিস্তারিত পোস্টঃ

উপন্যাস

০৮ ই আগস্ট, ২০১৭ রাত ১:৩০

কলাপাতার ঘোড়া
বাবুল আবদুল গফুর

চতুর্থ পরিচ্ছেদ
সমিরের পা পুরোপুরি সেরে গেছে। ফজুও মোটামুটি সুস্থ। মা এসেছেন। বাড়ি জুড়ে এক ধরনের স্বস্তি লক্ষ্য করলো সমির। মা এসে প্রথমে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন। নাতির প্রতি তীব্র টান তাকে বাঁধ ভাঙ্গা কান্নায় মাতিয়েছে। এসেই ফজুকে বুকে আগলে ধরলেন। মুখে কপালে চুমু খেতে লাগলেন অসংখ্যবার। দেখে সমিরের বুকের ভেতর এক ধরনের তৃপ্তি হয়।
মা বললেন, কি হয়েছে ভাই?
ফজু বললো, জ্বর।
ওষুধ খেয়েছিস?
ফজু হ্যাঁ বলে। মা সমিরের দিকে চেয়ে বললেন, মাছ তুলেছিস এ সপ্তাহে?
সমির বললো, তুলেছি।
মা বললেন, তোর বোনের শ্বশুড় বাড়িতে যাওয়া দরকার। তোর দুলাভাইয়ের অবস্থা ভালো না। পালা করে জ্বর আসে, সারারাত পিঠে বাতের ব্যথায় অস্থির থাকে। তোদের যেতে হবে একবার- বিপদে আপদে না গেলে মান থাকে না।
সমির বললো, আজই যেতে হবে মা?
না, কাল পরশু একবার গেলে হবে। তোর সময় করে যাস। ফজু আমার সাথে থাকবে। তুই আর শফু একসাথে যাস।
শফিকা বললো, ও আপনার সাথে থাকবে মা?
ফজুই উত্তর দিলো, থাকবো। তোমরা যাও। পঁচা।
শফিকা বললো, দেখেছেন মা কত বাড় বেড়েছে! চা খাবেন?
মা বললেন, দাও। আদা থাকলেও দিও কেটে।
শফিকা ভেতরে চলে গেলো, মা ফজুকে কোলে তুলে নিয়ে সমিরকে লক্ষ্য করে বললেন, কাছে আয়।
সমির কাছে এলো। মা গলার স্বর নিচে নামিয়ে বললেন, কি শুনতেছি এসব?
সমির অবাক হয়ে বললো, কি মা?
-মোতালেবের সাথে শফুর ব্যাপারে কি সব নোংরা কথাবার্তা! কি করিস বাসায়? শফুকে মানা কর। মায়ের চোখে স্পষ্ট আতঙ্ক দেখলো সমির।
সমির বললো, কি বলো মা? তোমার বউয়ের ব্যাপারে তোমার বিশ্বাস নাই?
-আরে আছে। কিন্তু আসার পর যেভাবে সবাই বলতেছে, সহ্য করা যায় না।
-কে বলেছে?
মা বলতে চাচ্ছিলো না। সমিরের জোরাজুরিতে শেষে বলতে বাধ্য হলো, তোর বড় চাচি। আনুর মা বলেছে নাকি তাকে!
সমির বিস্মিত হয়ে গেলো। ঘটনা এতদূর গড়াবে ভাবেনি সে। সাদিক মিথ্যা বলেনি- আনুর বাপ আসলেই ভালো নয়। বললো, মিথ্যা বলছে সে।
মা সমর্থনের সুরে বললেন, আমিও জানি বাপ। মানুষের মুখে তো আর আঁঠা নেই। যা ইচ্ছে বলতে পারে। বউকে মানা করিস।
সমির বললো, সেদিন আমাকে মেম্বার ডাকিয়েছিলো। শফিকাকে বলেছি, সে বলেছে- না।
মা আবারও বিশ্বাসের ভঙ্গিতে বললেন, শফু আমার সতী, সে আমি জানি। তবু- মানুষের কাছে ইজ্জত রক্ষা করা হাতে আগুনের কয়লা নেওয়া সমান কথা। মানুষের ভুল হয়। হতে পারে। তুই শফুকে নিষেধ করে দিস, বাইরের কারও সাথে কথাবার্তা বলার সময় হুঁশ করে বলতে।
সমির প্রতিশ্রুতিতে মাথা নাড়ে। তার কাছে এসব অদ্ভূত লাগে। মানুষ কত নিচ হলে, বদনাম করতে দ্বিধা করে না! আনুর বাপের যথেষ্ট বয়স হয়েছে- এসব ওনাকে মানায় না। সমির স্থির করে, আজই আনুর বাপের সাথে কথা বলা প্রয়োজন। মিথ্যা ডালপালা ছড়ানোর আগেই, বন্ধ করতে হবে। মানুষ মিথ্যাতে আনন্দ পায় দ্বিগুণ।
মা বললেন, তোর কাছে হাজার পাঁচেক টাকা হবে?
সমির প্রথমে না বলতে যাচ্ছিলো, পরে ভাবলো বিশেষ কোন প্রয়োজন কিনা কে জানে! বললো, কেন মা?
-তোর দুলাভাইয়ের এমন অবস্থা, না মরবে, না বাঁচবে। টাকা পয়সাও হাতে নেই। ডাক্তার দেখানো জরুরি। তোর কাছে আছে কিনা জানতে চাইছিলো রুজি।
সমির বললো, মাছ বেচে যা পেলাম, তা এদিক ওদিক করে খরচ হয়ে গেছে। দেখি, আমি যাওয়ার সময় কিছু নিয়ে যেতে পারি কিনা।
মায়ের চোখ তৃপ্তিতে পরিপূর্ণ মনে হয় সমিরের। মা বললেন, তুই বাজারে যাবি?
সমির বললো, যাবো।
-আসার সময় পান নিয়ে আসিস।
সমিরের এতোদিন মনেই ছিলো না। প্রতিবার বাজার করার সময় মায়ের জন্য আলাদা করে পান আনতে হয়। মা ক’দিন বাড়িতে না থাকাতে ভুলে গেছিলো। বললো, ঠিক আছে। তবে জর্দা কম খাবে। এতো জর্দা খেলে এমনিতেই লিভার পঁচে মরবে।
মা হাসে, মরি না এটাই বেশি। জর্দা খাওয়া ছেড়ে দিয়ে কয়দিন আর বেশি বাঁচবো!
সমির মায়ের এ বিষয়টুকু বুঝতে পারেনি। তার খারাপ লাগে। বাবা মারা যাওয়ার পর মা প্রায় নিঃসঙ্গ। চারদিকে অভাব, অভিযোগ, অসুখ-এসব মাকে তিক্ত করে তুলছে নাতো? সমিরের ভয় লাগে। এর থেকেই মানুষের স্ট্রোক হয়। গত সপ্তাহে চেমন খালা মারা গেছেন স্ট্রোকে। ভিসা ছাড়া বিদেশ গিয়েছিলো তার ছেলে, ধরা খেলো- ছয় মাসেই। ছেলেকে দেখে চেমন খালা নিজেকে সামালতে পারেনি। মাথার উপর ঋণের বোঝা, কর্জ্জ আর জমিন বন্ধকে রেখে ছেলেকে বিদেশ পাঠিয়েছিলো। সে ছেলে ফিরে আসলে চেমন খালার মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ে। ভাবলেন, এতো দেনা শোধ করতে করতেই তার ছেলে বাঁচবে না- হঠাৎ স্ট্রোক করলো। হাসপাতালেই নিতে হয়নি, বাড়িতে মারা যায়। সমিরের বুকের মধ্যে অজানা ভয় মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়ে।
বাবা মারা যাওয়ার পর অনেকটা যুদ্ধ করেই এ সংসার গুছিয়েছে মা। তার চাচা শরিফ চাইছিলো, মাছের প্রজেক্ট তার নামে করতে। মা বাঁধা দেন। প্রচুর ঝগড়াঝাটি হয়। তখনই মা জিদ করে লোন নিয়ে সমিরকে মাছচাষে নামিয়ে দেয়। পড়ালেখা আর হয়নি তার। দক্ষ আন্তরিকতায় প্রথম বছরেই লোনের সমস্ত টাকা পরিশোধ করে দেয় সমির। আজ সে মোটামুটি স্বচ্ছল। দুমুঠো ভাতের জন্য চিন্তা করতে হয় না। গ্রামে সবাই সম্মানের চোখে দেখে।
মাকে একটু হালকা করার জন্য সমির বললো, মা রুজির ভাসুরের মেয়েটির বিয়ে হয়ে গেছে?
-বৃষ্টির?
-আমি নাম জানিনা। লম্বা-গোল চেহারা ছিলো।
-ও একটাই মেয়ে। বৃষ্টি। কি জন্য?
সমির মায়ের পাশ থেকে সরে মোড়ায় বসলো, করিমের জন্য। ভালো মেয়ে পেলে বলতে বলেছে। করিমকে দিবে মনে হয়?
করিম সমিরের ছোট বেলার বন্ধু হওয়াতে তার প্রতি মায়ের স্নেহসিক্ত টান ছিলো। বললেন, দেবে কি! হায়াত, মউত, বিয়ে এসব নিয়ে বড়াই করতে নেই। সব আল্লার হাতে। রুজিকে বলে দেখ। সে একটা বিহিত করতে পারবে। তাছাড়া করিম তো- পড়ায়। এরকম জানাশোনা ছেলে কে হাত ছাড়া করতে চায়? রুজির ওখানে গেলে তাকে বলে দিখিস।
সমিরের ভালো লাগে, মায়ের মুখে কালোভাবটা আর নেই। বললো, ওষুধ আছে?
-দুই পাতা আছে, লাগবে না।
মা জানতে চাইলেন, কখন বাজারে যাবি?
-অল্পক্ষণ পর।
শফিকা গরম চা নিয়ে এলো। মায়ের হাতে দিয়ে বললো, বিস্কুট দিবো মা?
মা না করলেন। সমিরকে দেখিয়ে বললেন, ওরে এককাপ দাও।
সমির বাঁধা দিলো, না মা থাক। এতো ঘন ঘন চা খেতে আমার ভালো লাগে না।
ফজু বললো, দাদু আমি খাবো।
শফিকা বললো, তুমি খাবে, সেটা জানি।
মা চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন, চিনি কম হয়েছে। ভালো। আদার ঘ্রাণটা ভালো লাগে।
মা ফজুকে চা দিতে বললেন। শফিকা বললো, ওর চা খেলে মাথা ধরবে মা। বাদ দেন।
-ধুর! তোমরা এক জাতের মেয়ে। এককাপ খেলে কি আর হবে! ছোট মানুষ খেতে চাইচে- দাও। না করো না।
শফিকা অনিচ্ছা সত্ত্বেও ফজুকে চা দিলো। তারপর সমিরকে বললো, বাজারে এক্ষুনি বের হবে?
সমির বললো, না। কেন?
শফিকা সমিরের হাতে একটা ওষুধের প্যাকেট ধরিয়ে দিয়ে বললো, আসার সময় মনে করে এনো।
ফজু বাঁধা দিয়ে বলে, আমি ওষুধ খাবো না। তিতা লাগে।
শফিকা ধমক দিলো, তোমার জন্য ওষুধ আনে কে! ও আমার জন্য। চুপ থাক।
ধমকের সাথে সাথে চিৎকার দিয়ে কেঁদে উঠলো ফজু, তুমি রাক্ষুসি। বাড়িতে থাকবে না। বের হও এক্ষুনি।
শফিকা বললো, দাদিকে দেখার পর সাহস বেড়ে গেছে? বেয়াদব।
মা বললেন, ধমকাও কেন? বাচ্চারা কখন ওষুধ খেতে চায়? সমিরকে ওষুধ খাওয়াতে আমার প্রাণ যাওয়ার মতো হতো- খেতেই চাইতো না।
মা ফজুকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন, ওর আজ বিচার করবো। তুমি কেঁদো না ভাই।
সমির বাড়ির ভেতর প্রবেশ করলো, তার কাছে মনে হলো- অনেকদিন পর বাড়িতে প্রাণের সন্ধান মিলেছে।

বাড়ি থেকে নয়াহাট দূরে নয়। মাইল তিনেক হবে। শুক্রবার আর সোমবার হাট বসে এখানে। ক্ষেত খামারিরা আলু পটল মরিচ মাছ- তৈজসপত্র নিয়ে স্কুল মাঠের দুদিকে লম্বা লাইন করে বসে। হাটের দিনগুলোতে বাজারে প্রচুর মানুষ হয় । অনেকের সাথে দেখাও মিলে।
সমির বাজারে এলো দুপুরের পর। এসময়টায় বাজার জমজমাট থাকে । লোকজন কাজকর্ম সেরে হাটে আসে। কেউ কেউ সপ্তাহের বাজার একদিন করে নিয়ে যায়। বারবার বাজার করা বিরক্তিকর তাদের। হাটে বিশেষ পরিচিত বলতে সমিরের- মিজান। মুদির দোকান দিয়েছে সে। মিজানের বউ আবার সমিরের দূর সম্পর্কের শালী। হাটে আসলে মিজানের দোকানে একবার হলেও বসে সমির। তারপর কখনো কখনো সলিমের ওখানে গিয়ে গল্প করে। আজও বাজারে ঘুরাঘুরি করলো অনেক্ষণ। নতুন ঢেঁড়শ উঠেছে। এসময়টাতে ঢেঁড়শ পাওয়া যায় না, সমিরের মনে হলো হাইব্রিড। লোভ হয়। আলু দিয়ে ভাজি করলে খেতে মন্দ হবে না।
সমির বললো, কেজি কত?
আধ বয়সী ছেলেটা বললো, সত্তর টাকা।
সত্তর? সমির দাম শুনে বিস্মিত হলো। জিনিসপত্রের দাম যে হারে হু হু করে বাড়তেছে- সামনে বেঁচে থাকা দায় হয়ে পড়বে। বললো, কম রাখো। পঞ্চাশ হবে না?
ছেলেটা বিরক্ত হয়ে বললো, হবে না।
একদরে কেউ জিনিস বেচে নাকি? কম রাখো।
ছেলেটা বললো, দশ টাকা কম দেন।
সমির ঢেঁড়শ নিলো। ভাবলো, ভাজি ছাড়াও চিংড়ির সাথে খুব যায় তরকারিটা। একপোয়া চিংড়ি নিলে মন্দ হতো না। কত কে জানে?
যে লোকটা চিংড়ি বিক্রি করতেছে, তার মুখে অসংখ্য মেছতার মতো গোল দাগ। দেখতে খুবই খারাপ লাগছে। লোকটা একটা বুড়ো বয়সী লোকের সাথে জোরে জোরে কথা বলতেছে। আশে পাশে উৎসুক জনতার ভিড় লেগে আছে রীতিমতো।
মাছওয়ালা লোকটি বললো, চাচা মিছা কথা কও ক্যা? আপ্নার বয়স অইছে। আপ্নে এই একশ টাকার নোটখান দিছেন।’ লোকটি ক্যাশ খুলে দেখায়।
বুড়োটাও নাছোড়বান্দা, না আমি পাঁচশ টাকা নোটই দিছি। পকেটে হাত দিয়ে একশ টাকার নোট বের করে দেখায়, আসার সময় ছয়শ এনেছি। বাকিটা গেল কই? জ্বিনে নিছে?
-সেইটা আমাকে বলি লাভ আছেনি। জিনে নিছে, না ভূতে নিছে। আপ্নে আমাকে একশত টাকার নোটই দিছেন।
বুড়ো লোকটি প্রতিবাদ করে, মিছা কতা বন্ধ কর। আমি পাঁশত টাকাই দিছি।
মাছওয়ালা লোকটি বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেলো, আপ্নে যান। আমার বেচাবিক্রির ক্ষতি কইরেন না। আপ্নার টাকা আমি নিইনি।
বুড়ো লোকটি সরলো না। দাঁড়িয়ে অনর্গল কথা বলে যাচ্ছে। মাছওয়ালা লোকটি আরেক জনের দিকে তাকিয়ে বললো, আপনার কত?
-দেড় কেজি। কম রাখেন। তিনশে হলে বেশি হয়।
মাছওয়ালা লোকটি হঠাৎ কণ্ঠস্বর খাদে নামিয়ে বললো, চাষের মাছ না ভাই। পাল্লা ধরি কেজিতে কিইনতে অয়। আসন-যাওন, গাড়ি-ভাড়া, কিনা- সব মিলি পুষায় না। জানি তো একটাই- নাঅয়ইলে কত আগেই ছাড়তাম। চাম বেচি পেট চালনের ব্যবসা করে কে?
মাছ কিনতে আসা লোকটি আর কথা বাড়ায় না। গুনে গুনে সাড়ে চারশ টাকা দিয়ে দেয়।
সমির বুড়ো লোকটিকে বললো, চাচা একটু সাইড দেন। মাছ কিনবো।
বুড়ো লোকটি আরও রাগান্বিত হয়ে উঠে, দেখেছো বাজান, আমার টাকাটা নিই কেমন মিথ্যা কথা বলতেছে সে? চোর।
মাছওয়ালা লোকটি ক্রোধে অগ্নিশর্মা হয়ে যায়, বাপের বয়সি বলি অনেক্ষণ ইজ্জত দিছি। আপ্নি যান।
সমির ভিড় ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করে। মাছওয়ালাকে দেখিয়ে বললো, কোথাকার?
নাপিতখালী। ঘেরের মাছ। রাইতে ধইরছে।
তাজা?
মাছওয়ালা লোকটি যেন অপরাধ করলো, কি কন! যে জিনিস আমি খাইতে পারি না, মানুষকে খাওয়াবো কেমনে? কত দিবো?
আধাকেজি ।
লোকটি কালো পলিথিনে মাছ ওজন করতে করতে বললো, বুড়োদের এক দোষ। খালি সন্দ করে।
সমির বললো, চাচা কি টাকা এখানে হারিয়েছে?
জানিনা দাদা। অনক্ষণ থেইকা আসি চিল্লাচিল্লি করতাচে। বেচাবিক্রি সুদ্ধ বন্ধ। কেমুন লাগে!
সমির কথা বাড়ালো না। মাছের টাকা দিয়ে ভিড় ঠেলে বের হয়ে আসলো।
পানের দোকান থেকে পান কিনতে গিয়ে দেখলো, পানে লালচে দাগ।
সমির দেখিয়ে বললো, দাগ কেন?
রোদের। অসুবিধা হবে না। কত গণ্ডা দিবো?
সমির পান বিক্রেতা ছেলেটিকে বললো, বিশ গণ্ডা দাও। গাছপানা নাকি?
না, মিষ্টি পান।
সমির বাজার নিয়ে মিজানের দোকানের দিকে পা বাড়ালো। মিজান আছে কিনা কে জানে? থাকতেও পারে। হাটের দিনে সাধারণত কোথাও যাবার কথা নয়। এই বাজারে বড় মুদির দোকান বলতে মিজানেরটা। সব পাওয়া যায়।
দোকানের সামনে এসে দেখলো, করিম পায়ের উপর পা তুলে চোখে চশমা দিয়ে চা খেতে খেতে পেপার পড়তেছে। করিমকে চশমায় অদ্ভূত লাগছে। এর আগে তাকে চশমা পরা অবস্থায় কোনদিন দেখেনি সমির।
করিম সমিরকে দেখে, চশমার ভেতর দিয়ে অদ্ভূতভাবে বললো, তুই?
ওষুধের জন্য আসলাম। থাকবি কিছুক্ষণ?
ঘন্টা দেড়েক থাকবো। টিউশনি আছে।
মিজান কই?
বাইরে গেছে।
সমির করিমের পাশে বাজার রেখে বললো, দেখিস- ওষুধ নিয়ে এক্ষুনি আসতেছি। কথা আছে- থাকিস।
করিম আগের মতোই পেপার পড়তেছিলো,উত্তর দিলো না।

ওষুধ নিয়ে যখন সমির আসলো, ততক্ষণে মিজান দোকানে এসেছে। মিজান বললো, কি খবর সমির দা? কখন এলেন? ভাবি কেমন আছেন?
সমির ওষুধের প্যাকেটটা বাজারের থলেতে ঢুকাতে ঢুকাতে বললো, ভালো। আমার শালী কেমন আছে সেটা বল।
গিয়ে দেখে আসেন। এখান থেকে কেমন করে বলবো?
সমির হেসে বললো, তুমি দেখোনি?
করিম পেপার থেকে চোখ তুলে বললো, ফ্যামিলি টকিং?
সমির বললো, তোর তো আর বিয়ে করা হবে না। আমাদের কথাবার্তা শুনে অন্তত বুক জুড়া।
মিজান খল খল করে হেসে উঠলো, একটা ব্যবস্থা করে দেন না।
সমির বললো, সংসার কি আমি করবো? তার বউ সে দেখবে। পছন্দ হলে, আমরা এনে দেবো-!
মিজান ক্রেতার সাথে কথাবার্তায় ব্যস্ত হয়ে পড়লো। এই ফাঁকে সমির বললো, মা এসেছেন। তুই আজকে বাড়িতে আসতে পারবি?
করিম বললো, কোন কাজ আছে?
তোর ব্যাপারে সম্বন্ধ আছে। রুজির ভাসুরের মেয়ে।
দেখেছিস?
ছোট বেলায় দেখেছিলাম। মা সব জানে। তুই আসিস।
পেপার পড়া পুরোপুরি বন্ধ করে দিলো করিম, বললো, খালাকে বলতে যাবো আমি? তোর বুদ্ধি কি হাঁটুর নিচে চলে গেছে? মুখ ফুটে এসব কথা বলা যায়?
সমির বললো, ধুর! আমিই বলবো। তুই আসিস। অবশ্য তোর মা থাকলে ভালো হতো- তিনি বলতেন সব।
করিম হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেলো। সে জানে এসব বিষয়ে মুরুব্বি থাকা আবশ্যক। তার মা-বাপ কেউ নেই। একমাত্র চাচা আছে- সেও মাতাল। তাকে বলা না বলা সমান। করিমের বুকটা আসন্ন ব্যথায় ভারি হয়ে গেলো। সমির আন্দাজ করে বললো, তুই আগে আয় । চিন্তা করার কি আছে? আমি থাকবো।তুই আসলে মা বুঝবে।
মিজান ক্রেতা বিদায় করে বললো, দোকান মানে সারাদিন খাটুনি। সেই সকালে আসা, রাত এগারোটা আগ পর্য়ন্ত বন্ধ করার উপায় নেই। তারচেয়ে সমিরদার মতো মাছের খামার করলে ভালো হতো। চা খাবেন?
সমির মাথা নাড়ে, চা খুব কম খায়। করিম খাবে কিনা দেখ।
করিম বললো, একটু আগে খেলাম। ঘন ঘন চা খেলে ঘুম হয় না।
তারপরও মিজান চায়ের অর্ডার দেয়। সাথে বিস্কুটও ।সমির বারবার না করেও, মিজানের জোরাজুরিতে খেতে হলো।
চায়ে চুমুক দিয়ে বললো, ঠাণ্ডা।
মিজান বললো, ফজলের চা খারাপ হয় না, দোকানের ছেলেটা নাই মনে হয়।
সমির বললো, চা জিনিসটা গরম হলেই, চা। নতুবা শরবত।
করিমকে চিন্তিত দেখে সমির বললো, দুঃশ্চিন্তা বাদ দেয়। রাতে বাড়িতে আসিস।
করিম উত্তর দেয়নি। বললো, টিউশনির দেরি নেই। যেতে হবে।
করিম চলে যেতেই মিজান বললো, মেয়ে টেয়ে দেখেতেছেন নাকি?
সমির বললো, বড় আপুর ভাসুরের মেয়ে।
মিজান বললো, করায়ে দেন, আর কত বছর একা রান্না করে খাবে?
সমির বললো, দেখি। ওপর ওয়ালার ইচ্ছা। আমি বললে তো আর হবে না।’ সমির হঠাৎ অনুনয় করে বললো, শালীকে নিয়ে গরীবের বাড়িতে একদিন আসো!
মিজান বলে, ধুর! সমিরদা- ধনী গরীব কিসের। আসলে সময় হয় না।

সমির যাওয়ার জন্য উদ্যত হতেই মিজান ডাক দিলো, একটু দাঁড়ান।
কি?
মিজান দুইটা চিপসের প্যাকেট জোর করে বাজারের থলেতে ভরে দেয়, মেয়ের জন্য।
সমির বাঁধা দিলো, আরে লাগবে না। রাখো। বাদ দাও।
মিজান শুনলো না।
সমিরের বুকটা কৃতজ্ঞতায় ভরে যায় হঠাৎ। মিজান এমনিতেও যখন যা লাগে- দেয়। টাকা দিলো কি, দিলো না-হিসেব করে না। আজ এই সামান্যটুকু সেই উপকারকে বহুগুণ কৃতজ্ঞতায় ভরিয়ে দিলো। কখনও কখনও সামান্য আতিথেয়তা মানুষকে এতই দুর্বল করে দেয়, রক্তের সম্পর্ক সেখানে তুচ্ছ হয়ে যায়। এসব সামান্য ঘটনা নিতান্ত ক্ষুদ্র, কিন্তু এগুলোই মানুষকে বাঁচিয়ে রাখতে বছরের পর বছর প্রেরণা যোগায়। উৎসাহ দেয়।
সমির রাস্তায় দাঁড়িয়ে বললো, এসো কিন্তু-
মিজান বললো, আগে আপনি আসেন। তারপর আমরা যাবো।
সমির বাড়ির পথে পা বাড়ায়। রান্নার জন্য চিংড়ি আর ঢেঁড়শ নিয়ে দ্রুত যেতে হবে- শফিকা আবার সন্ধ্যার আগেই রাতের রান্না শেষ করে নামাজ দাঁড়ায়!

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.