নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ভুলকে ভুল বলাটা সৎ সাহসের পরিচায়ক বরং নীরব থাকাটাই শয়তানি....

মোগল

মোগল › বিস্তারিত পোস্টঃ

৭৬ এর মন্বন্তর ছিল ব্রিটিশদের পরিকল্পিত গণহত্যা

১৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০২২ দুপুর ২:২৭



“আমি ভারতীয়দের ঘেন্না করি। ওদের যেমন জানোয়ারের মত জীবন তেমন জানোয়ারের মত ধর্ম। খরগোশের মত এতো সন্তান উৎপাদন করলে দুর্ভিক্ষ তো হবেই।” – উইনস্টন চার্চিল

ব্রিটিশদের ভারত সংক্রান্ত আর্থিক নীতিগুলি ছিল অত্যন্ত কঠোর আর নির্মম। এ ব্যাপারে তাঁরা ভারতীয় নেটিভ প্রজাদের প্রতি কোনও সহানুভূতি দেখানোর পক্ষপাতী ছিলেন না। ব্রিটিশরাজ- এর জমানায় ভারতকে একাধিকবার দুর্ভিক্ষের কবলে পড়তে হয়েছে। কিন্তু বাঙলার মত দুর্ভিক্ষ তাড়িত ফাটা কপাল বোধহয় আর কারুরই ছিলনা। এই ঘাতক দুর্ভিক্ষগুলির মধ্যে প্রথমটি হয় ১৭৭০ সালে, এবং তারপর ক্রমান্বয়ে ১৭৮৩, ১৮৬৬, ১৮৭৩, ১৮৯২, ১৮৯৭ এবং সর্বশেষ ১৯৪৩-৪৪ সালের দুর্ভিক্ষ। এর আগে, দেশে দুর্ভিক্ষ এলে স্থানীয় রাজা ও জমিদাররা তাঁদের সাধ্যমত দ্রুত আপতকালিন ব্যবস্থার মাধ্যমে বড়সড় মহামারী রোধ করবার চেষ্টা করতেন। কিন্তু ইংরেজ প্রভুদের এদেশে পদার্পণের পর পরই পরিস্থিতি অনেকটাই বদলে গেল। অনাবৃষ্টি ও খরার পাশাপাশি দুর্ভিক্ষের আরেকটি অবধারিত কারন হয়ে দাঁড়ালো ইংরেজদের মুনাফা লাভের উদ্দেশ্যে দেশের প্রাকৃতিক সম্পদে যথেচ্ছ হানাদারি। অথচ, একে তো তাঁরা নিজেদের এই কুকীর্তির দায় স্বীকার করে দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের সাহায্যে এগিয়ে এলই না, উপরন্তু দুর্ভিক্ষের ফলে অন্নবস্ত্রহীন প্রজাদের খাজনা আদায়ের ক্ষেত্রে যে ব্যাপক প্রভাব পড়লো তাতেও আবার তাঁদের বেজায় বিরক্তি দেখা দিল।

এই প্রাণঘাতী দুর্ভিক্ষগুলির প্রথমটি হয় ১৭৭০ সালে যা ছিল একাধারে বীভৎস ও নৃশংস। এই রকম একটি বিরাট আকারের দুর্ভিক্ষ যে আসতে চলেছে তার পূর্বাভাষ আগের বছর অর্থাৎ ১৭৬৯ সালেই টের পাওয়া গিয়েছিল এবং পরবর্তী তিন বছর ধরে ১৭৭৩ সাল পর্যন্ত এই দুর্ভিক্ষ চলে। এই দুর্ভিক্ষের ফলে প্রায় ১ কোটি মানুষের মৃত্যু হয়। যে সংখ্যাটা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বন্দি হওয়া মোট ইহুদিদের সংখ্যার তুলনায় অনায়াসে কয়েক লক্ষ ছাড়িয়ে যাবে। এর ফলে বাঙলার সমগ্র জনসংখ্যার প্রায় এক তৃতীয়াংশ মুছে যায়। জন ফিস্ক তাঁর “দি আনসিন ওয়ার্ল্ড” গ্রন্থে লিখছেন যে ১৭৭০ সালের বাঙলার এই দুর্ভিক্ষ চতুর্দশ শতকের ইউরোপের ঘাতক বেবুনিক প্লেগের চেয়ে কয়েক গুণ মারাত্মক ছিল। মুঘল শাসনকালে কৃষকদের মোট সংগৃহীত অর্থকরী ফসলের ১০-১৫ শতাংশ রাজস্ব খাতে দিতে হত। এর ফলে একদিকে যেমন শাসকের রাজকোষে খুশির হাওয়া বজায় থাকতো, অন্যদিকে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ফসলের আকাল দেখা দিলে প্রজাদের জন্য রাজকোষে পর্যাপ্ত খাদ্য মজুত থাকতো। ১৭৬৫ সালে এলাহাবাদ চুক্তির মাধ্যমে রাজস্ব আদায়ের ক্ষমতা মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমের হাত থেকে চলে এলো ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে। ইংরেজরা বিদ্রোহের ভয়ে তাঁদের এই ‘রাজস্ব’ (Tax) আদায় কে লোক ভোলানোর জন্য নাম দিলেন ‘নজরানা’ (Tribute) আর মুঘল আমলের রাজস্ব বাবদ ১০-১৫ শতাংশের হার কে রাতারাতি বাড়িয়ে করে তুললেন পঞ্চাশ শতাংশ। অথচ অর্থের এই হাত বদলের খবর কিন্তু সাধারণ কৃষকরা জানতেও পারলেন না। তাঁরা নবাবের নামেই এই পাহাড় প্রমাণ রাজস্ব দিয়ে যেতে লাগলেন।

সেকালে একজন ভারতীয় কৃষকের কপালে ফলনের ঘাটতি ছিল নিত্য নৈমিত্যিক ঘটনা। আর ঠিক সেই কারণেই রাজস্ব দানের পরেও সঞ্চিত উদ্বৃত্ত ফসল তাঁদের জীবন ধারণের ক্ষেত্রে ছিল অপরিহার্য অঙ্গ। কিন্তু রাজস্ব বৃদ্ধির ফলে এই সঞ্চিত উদ্বৃত্তের পরিমাণও উল্লেখযোগ্য ভাবে কমে গেল। ফলে ১৭৬৮ সালে যখন যথারীতি ফলনের ঘাটতি দেখা দিল তখন এই সঞ্চিত ফসলের নিরাপদ আশ্রয়টি তাঁদের কাছে হয়ে উঠলো সুদূর পরাহত। আর গোদের ওপর বিষফোঁড়া স্বরূপ ১৭৬৯ সালের অনাবৃষ্টি অদূর ভবিষ্যতের অশনি সংকেত রূপে দেখা দিতে লাগলো। দুর্ভিক্ষের প্রাথমিক প্রকোপ আজকের পশ্চিমবঙ্গ ও বিহারের উপর পড়লেও ওড়িশা, ঝাড়খণ্ড এবং বাংলাদেশও এই সর্বগ্রাসী মৃত্যুদূতের হাত থেকে বাদ যায়নি। তবে বাংলাতেই এর প্রভাব ছিল সবচেয়ে প্রাণঘাতী। ক্ষয়ক্ষতির বিচারে বাংলায় বীরভূম ও মুর্শিদাবাদ জেলা ছিল সকলের উর্দ্ধে। হাজার হাজার মানুষ নিজেদের ঘর সংসার ছেড়ে প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে অন্যত্র চলে যেতে লাগলেন এবং অনাহারে মৃত্যুর মুখে পড়তে লাগলেন। আর যারা থেকে গেলেন তাঁদের অদৃষ্টেও, একটু দেরিতে হলেও জুটলো সেই একই রকম করুণ মৃত্যুর আলিঙ্গন। মাইলের পর মাইল চাষের জমি পড়ে রইলো শূন্য খাঁ খাঁ। এই সেদিনও যেখানে ছিল জমজমাট বসতি ক্রমে সেই সব জায়গায় গজিয়ে উঠতে লাগলো দুর্ভেদ্য গভীর জঙ্গল। বিহারের তীরহুত, চম্পারন ও বেত্তিয়া অঞ্চলেও এই দুর্ভিক্ষের প্রভাব হয়ে উঠলো প্রাণঘাতী।

মুঘল শাসকদের থেকে ক্ষমতা দখলের পর ইংরেজরা দেশজুড়ে অর্থকরী ফসল উৎপাদনের উপর বাধ্যতামূলক ফতোয়া জারি করে। বলা বাহুল্য, এর একমাত্র কারন ছিল রপ্তানি। ফলে এতদিন যে সমস্ত কৃষকরা ধান ও অন্যান্য সবজী চাষ করতেন তাঁরা বাধ্য হয়ে নীল, পোস্ত ইত্যাদি চাষে নিযুক্তি হলেন, যার ফলে তাঁদের অর্থাগম হলেও আপৎকালে ত্রান ও খাদ্যের চাহিদা মেটানোর কোনও উপায় অবশিষ্ট থাকলো না। দুর্ভিক্ষের সময় সঞ্চিত খাদ্যশস্যের ভাণ্ডার হল শূন্য। যে স্বাভাবিক কারনগুলির ফলে দুর্ভিক্ষ হয় এক্ষেত্রে তা ছিল তুচ্ছ। বস্তুত ইংরেজদের অতিরিক্ত মুনাফা লাভের তীব্র বাসনার ফলেই বাঙলার ভাগ্যাকাশে নেমে এলো এই ভয়াবহ পরিণতি। দুর্ভিক্ষ পীড়িতদের জন্য কোনও প্রকার ত্রাণের ব্যবস্থা তো ছিলোইনা, উপরন্তু কর বাড়িয়ে রাজস্ব ঘাটতি পূরণের চেষ্টা করা হল। আর শ্লেষের কথা এই যে, ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৭৭১ সালের ভরা দুর্ভিক্ষের মরশুমে কর বাড়িয়ে যে পরিমাণ মুনাফা লাভ করেছিল তা ১৭৬৮ সালের মুনাফার পরিমাণকেও ছাপিয়ে যায়। যদিও বাঙলার হতভাগ্য মানুষ তখনও জানতেন না যে তাঁদের ভাগ্যাকাশের আরও কত দুর্ভিক্ষ ও মহামারীর কালো মেঘ ঘনিয়ে আসছে, যার একমাত্র কারন ইংরেজের লালসা আর যে লালসার ফলে গোটা গ্রাম বাংলায় নেমে এল মৃত্যুর মিছিল ও শ্মশানের নিস্তব্ধতা। যদিও এই প্রত্যেকটি দুর্ভিক্ষই ছিল ভয়াবহ, তবে ১৭৭১ সালের পর সবচেয়ে প্রাণঘাতী মহামারীটি ঘটে ১৯৪৩ সালে। এক লপ্তে প্রায় ৩০ লক্ষ মানুষ মৃত্যু মুখে পতিত হন। অনাহার ক্লিষ্ট মানুষকে প্রাণের তাগিদে ঘাস পাতা, এমনকি মৃত মানুষের মাংস খেয়েও ক্ষুদা নিবৃত্তি করতে হয়েছিল। এদিকে সমগ্র ইউরোপকে হিটলার নামক দানবের হাত থেকে রক্ষা করার অন্যতম নায়ক ব্রিটেনের স্বনামধন্য যুদ্ধবিশারদ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল কিন্তু বাঙলার এই প্রাণঘাতী দুর্ভিক্ষ রোধের ক্ষেত্রে অদ্ভুত উন্নাসিকতা ও অপরিণামদর্শিতার দৃষ্টান্ত রেখে গেলেন। দুর্ভিক্ষ পীড়িত মানুষের সাহায্যার্থে প্রেরিত ত্রাণের ওষুধ ও খাদ্যদ্রব্যকে তিনি বাংলায় না পাঠিয়ে তা ইউরোপে যুদ্ধরত সেনা বাহিনীর জন্য পাঠিয়ে দিলেন। যদিও সেই সময় ওই সেনাবাহিনীদের রসদের অভাব বা অতিরিক্ত প্রয়োজন- কোনটাই ছিল না। আর এই বিষয়ে তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করে অনুরোধ করা হলে উত্তরে তিনি বললেন, “দুর্ভিক্ষ হোক বা না হোক, ভারতীয়রা খরগোশের মতই বংশ বিস্তার করবে।” দিল্লীর সরকার যখন পরিস্থিতির গুরুত্ব সম্বলিত দুর্দশার বিস্তারিত চিত্র ও মৃত্যুর পরিসংখ্যান টেলিগ্রাম করে তাঁর কাছে পাঠান, তা দেখে চার্চিলের সংক্ষিপ্ত উত্তর ছিল, “তাহলে গান্ধী এখনো মরেনি কেন”?

কোর্টেসি: Sankha Ganguly

মন্তব্য ৯ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (৯) মন্তব্য লিখুন

১| ১৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০২২ বিকাল ৩:০২

জুল ভার্ন বলেছেন: গুড পোস্ট।

২| ১৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০২২ বিকাল ৩:০৭

বিটপি বলেছেন: এতবড় বড় দুর্ভিক্ষের পরেও ভারতের মানুষ কিন্তু খরগোশের মত জনসংখ্যা বাড়িয়েই চলেছে। ২০২৮ সাল নাগাদ তারা জনসংখ্যায় চ্যাম্পিয়ন দেশ হতে যাচ্ছে। আমাদের দেশেও দেখা যায়, কামাই করুক বা না করুক, পেটে খাবার পড়ুক বা না পড়ুক, বয়েস হলেই বিয়ে করার জন্য ব্যস্ত হয়ে যায়। এর একটা আশু সমাধান দরকার। যতদিন ভারতের জনসংখ্যা ১০০ কোটির নিচে না নামছে - ততদিন এই জনগোষ্ঠিকে বিশ্বের লাথিগুতা আর অপমান সহ্য করতেই হবে।

৩| ১৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০২২ বিকাল ৪:০১

আহলান বলেছেন: খুবই তথ্যপূর্ণ পোষ্ট। ধন্যবাদ!

৪| ১৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০২২ বিকাল ৫:৪৩

কামাল৮০ বলেছেন: ভারতের সর্বশেষ পরিসংখ্যান হলো মুসলিম জননসংখ্যা তুলনামূলক বেড়েছে হিন্দু কমেছে।মুসলমানদের এক কথা,খাওয়ানোর মালিক আল্লাহ।

৫| ১৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০২২ সন্ধ্যা ৬:৫৭

মোঃ মাইদুল সরকার বলেছেন: ধনে জনে একটি সমৃদ্ধ দেশকে ইংরেজরা শ্মশানে পরিণত করেছিল। চার্চিলের প্রতি ঘৃণা।

৬| ১৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০২২ রাত ৮:১১

শেরজা তপন বলেছেন: তথ্য সমৃদ্ধ পোস্ট পড়ে -কষ্ট পেলেও খুশী হলাম এই ভেবে যে, সামু সমৃদ্ধ হচ্ছে!

৭| ১৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০২২ রাত ৮:২৩

ক্ষণ-পূর্বক্ষণ বলেছেন: কমনওয়েল েএর নামে আমাদের শাসক শ্রেণী এখনো লন্ডনকে তাদের পরোক্ষ রাজধানী মনেন করে ,এই মনস্তত্ব থেকে আমরা কি বের হতে পারবো না ?

৮| ১৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০২২ রাত ৯:১১

সত্যপথিক শাইয়্যান বলেছেন:



শুধু উইনস্টন চার্চিলকে দিয়ে যুক্তরাজ্যকে চেনা যায় না,
যেমন যায় না জারকে দিয়ে রাশিয়াকে চেনা! ;)

৯| ১৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০২২ রাত ৯:২৭

সাড়ে চুয়াত্তর বলেছেন: ভালো লেখা। ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষ সম্পর্কে খুব সামান্য আমার বাবার মুখে শুনেছি। দেশে দুর্ভিক্ষ হলে শাসকদের কিছু দায় দায়িত্ব থাকে। ব্রিটিশরা সেটা পালন করেনি। চার্চিলের বক্তব্য দুঃখজনক।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.