![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমি উন্মাদ, আমি উন্মাদ!! আমি সহসা আমারে চিনেছি, আজিকে আমার খুলিয়া গিয়াছে সব বাঁধ!!
সেদিন পুর বিকেল টা কোথায় যাব তা ভেবেই কাটিয়ে দিয়ে ছিলাম আমি আর তাহিদুল। কোন কূল কিনারা করতে পারিনি। এদিকে শীতের ছুটিও ফুরিয়ে আসছিল। দূরে কোথাও গিয়ে ঘুরে আসব এমন সুযোগ ছিল না। প্রায় চুল ছিড়ে ফেলার উপক্রম হল। কোন রকম সিদ্ধান্ত ছাড়াই বাসায় ফিরলাম। ঘরে ঢুকেই মনে হল চার পাশ টা ছোট হয়ে আসছে। প্রায় দম বন্ধ হয়ে যাবে এমন অবস্থা। মনে হচ্ছিল আর কিছুক্ষণ ঘরের ভিতরে থাকলে দম বন্ধ হয়ে মারা যাব! জলদি ঘর থেকে বেরিয়ে গেলাম। যেন অক্সিজেন ফিরে পেলাম। মারুফ কে ডেকে তার সাথে এলাকায় ঘুরতে ঘুরতে তার সিলেট ভ্রমনের অভিজ্ঞতা শুনলাম। নিজে যেতে না পারলেও অন্যের বর্ণনা শুনে খারাপ লাগছিল না। নিজের মতো কল্পনা করে নিচ্ছিলাম। কিন্তু যেই মন একবার প্রকৃতির ডাক শুনেছে সেই মন কি সামান্য বর্ণনায় ভরে!
হাঁটতে হাঁটতে রাফির সাথে দেখা। কোথাও ঘুরতে যাওয়ার ইচ্ছা বলতেই সীতাকুণ্ড যাওয়ার ধামা চাপা ইচ্ছা টা উস্কে দিল। সাথে সাথে যেন মাথার পোকা টা নাড়া দিয়ে উঠল।যেতে আমাকে হবেই! দেরি না করে বাসায় ফিরে পরিকল্প না শুরু করলাম। যেভাবেই হোক দুই তিন দিনের মধ্যেই যেতে হবে। তা না হলে কলেজ খুলে যাবে।
নেট ঘেটে মোটামুটি একটা ধারনা নিলাম সেখানকার। ঢাকা থেকে মেইল ট্রেনে অর্থাৎ লোকাল ট্রেনে যেতে হবে। তাছাড়া অন্য কোন ট্রেন সীতাকুণ্ড স্টেশনে থামে না। সারাদিনে পাহাড় আর ইকো পার্কে ঝর্না দেখে রাতে ফেরত আসা যাবে। প্ল্যান জানিয়ে দিলাম তাহিদুল কে। দু জনের মধ্যেই উত্তেজনার ঢেউ খেলে গেল।
তবে একটা কিন্তু ছিল। এতোদূরে একাএকা বাসা থেকে ছাড়বে না। এর আগে এই অজুহাতে সিলেট যাওয়ার প্ল্যান ক্যানসেল হয়ে ছিল। তাই এতোদূর যাওয়ার আগে সাথে চাই একজন গার্জিয়ান। তাহিদুল তার বাবা কে বলল। পরদিন সকালে ওর বাসায় গিয়ে আংকেল কে আরেকটু বুঝিয়ে সুঝিয়ে পুর প্ল্যানিং বলে রাজি করালাম। ঠিক হল পরেরদিন রাতের ট্রেনে রওনা দিবো। এরপর আমাদের আর পায় কে! যেন সপ্তম আসমানে উড়ছিলাম। অবশেষে পাহাড়ে উঠার একটু নিসর্গের কাছে যাওয়ার সুযোগ হল! একট প্রান খুলে বুক ভরে নিশ্বাস ফেলার ফুসরত পেলাম যেন!
পরদিন সকালে গেলাম এয়ারপোর্ট রেল স্টেশনে টিকেট কাটতে। কোথাও কোন সঠিক ইনফর্মেশন পেলাম না। এক কাউন্টারে গেলে অন্য কাউন্টারে পাঠিয়ে দেয়। চট্টগ্রাম মেইল যেন একটা বাপ মা হীন বেওয়ারিশ ট্রেন! কেউ এর দায়িত্ব নিবে না।
এক জায়গায় বলল কমলাপুর যেতে। ওখানে টিকেট দিবে। মাথায় তখন ভুত চেপে বসেছে। দ্বিতীয়বার না ভেবেই একটা ট্রেন ধরে চলে গেলাম। দুই বন্ধু তখন বিরাট খুশি। মাগনা এলাম আবার যাবও ফাউ ফাউ। কোন খরচ নাই। কিন্তু আমাদের এই খুশিতে মনে হয় কারোর নজর পড়ল। তখন আবার কপাল গুনে রেলওয়ে সপ্তাহ চলছিল। সব খুশির যবনিকাপাত করল টিটি সাহেব। স্টেশন গেটের সামনে যেতেই টিকেট দেখতে চাইল! টিকেট না পেয়ে সোজা চালান করে দিল ভিতরের এক কামরায়। কিছুক্ষণ পর বড় বাবু এসে জেরা শুরু করল। এর মধ্যে আমাদের মতো কিছু ক্রিমিনাল ধরা হয়ে গেছে। সেদিনের চা পানির ইন্তেজাম হয়ে যাওয়ায় ব্যাটা মনে মনে খাবি খাচ্ছিল মনে হয়। সবাই কে মামলা দেয়ার ভয় দেখাচ্ছিল। আর বিনা টিকেটে ভ্রমনের আইন শিখাচ্ছিল। আইন শুনিয়ে সুযোগ মতো প্রতি জনের কাছ থেকে ৪২০ টাকা করে হাতিয়ে নিচ্ছিল। এর মধ্যে তাহিদুল তার বাবা কে ফোন দিয়ে দিয়েছে। মোবাইল কানে ধরেই বাবু সাহেব খানিকটা দমে গেল। বুঝতে পারল খুব একটা সুবিধা করা যাবে না। তাই সেখানেও আইন ঝেড়ে দিল। ২২০ টাকা করে দাবি করল। এটাই নাকি সর্বনিম্ন জরিমানা। সে এই এমাউন্ট দিয়ে একজনের জরিমানা দেখাবে। অনেক মুলামুলির পর ১৬০ টাকায় বনিবনা করলাম। জরিমানার কাগজ চাইতেই মুখ টা কুইনাইন খাওয়ার মতো বিকৃত করল। বাংলা পাঁচের মতো মুখ নিয়ে রিসিট লিখে দিল। আমাদের মুক্তি!
এখানে এসে জানতে পারলাম এই ট্রেনের টিকেট সন্ধ্যার আগে ছাড়বে না। বাসায় ফিরলাম বাসে করে। স্টেশনমুখ আর হলাম না।
রাতে ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। সামনে কঠিন সময় অপেক্ষা করছে। সারা রাতের জার্নি শেষে সারাদিন ঘুরাঘুরি। সেদিনই আবার রিটার্ন! চাট্টে খানি কথা না! তবে মনে উৎসাহের কমতি ছিল না।
স্টেশনে এসে টিকেট কাটা হল। এগারো টা দশের ট্রেন। আমি আর তাহিদুল ট্রেনের অপেক্ষা করতে করতে প্ল্যাটফর্ম ধরে হাঁটছিলাম আর বছরের শেষ রাতের শেষ কিছু মুহূর্তে নস্টালজিক হয়ে যাচ্ছিলাম। এক সময় ক্লান্ত হয়ে বসে পড়লাম। সাথে করে ক্যামেরা আর OTG ক্যাবল এনেছিলাম। ক্যাবল মোবাইলে লাগিয়ে টেস্ট করছিলাম এমন সময় হুট করে ট্রেন এসে উপস্থিত! কোন আগাম বার্তা নাই! প্রথমে বুঝতে পারিনি। কিন্তু পরে যখন এক নারী কন্ঠে ট্রেনের নাম ভেসে এলো তখন তম্বিত ফিরে এলো। সব কিছু ব্যাগে রেখে দৌড়! সব কয় টা বগির দরজা বন্ধ। এতো বড় ট্রেনের মাত্র দুই টা বগি যাত্রীদের জন্য! বাকি সব রিজার্ভ। বগি দুই টা আর যাত্রি কুটি কুটি। কোন রকম উঠে পড়লাম। সিট পাওয়ার তো প্রশ্নই উঠে না! এমন অবস্থা হচ্ছিল যেন সামান্য শরীর মোচড় দেয়ার মতো অবস্থা নাই। মানুষ মানুষের পেটের ভিতর পারলে ঢুকে যায়! আমরা যখন এভাবে চিড়ে চ্যাপ্টা হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম তখন সিট ধারীরা নাক ডেকে ঘুমুচ্ছিল। মনে হচ্ছিল তারাই সে মুহূর্তে পৃথিবীর সব চাইতে সুখী মানুষ। আর আমরা এই শীতের রাতে ঘেমে নেয়ে একাকার হয়ে যাচ্ছিলাম। ট্রেন ছাড়তেই কিছুটা ঠান্ডা লাগা শুরু করল।
এভাবে প্রায় তিন ঘন্টা মতো দাঁড়িয়ে থাকলাম। ঘুম কোন ব্যাপার ছিল না। কিন্তু শরীর তো মানে না। পা আর কোমর বারবার বিদ্রোহ ঘোষণা করছিল। আর পারছিলাম না দাঁড়িয়ে থাকতে। সহ্য সীমা প্রায় ছাড়িয়ে যাচ্ছিল। আমার পাশের জন দাঁড়িয়ে চেয়ারের মাথায় হাত রেখে তাতে মাথা হেলান দিয়ে এক বিশেষ তরিকায় ঘুমাচ্ছিল। সে ভৈরব স্টেশনে নামতেই দ্রুত আমি জায়গা টা দখল করে নিলাম। এরপর তার দেখানো তরিকায় কায়দাকানুন করে চোখ বন্ধ করলাম এবং প্রায় সাথে সাথেই ঘুম! দাঁড়িয়ে খুব সম্ভবত পনেরো বিশ মিনিট মতো ঘুমিয়েছি। ট্রেনের সিট গুলোয় দুই জন আরাম করে বসা যায়। একটু চেপে বসলে থার্ড পারসন কোনভাবে বসতে পারে। আমার পাশের থার্ড পারসন মানে যে কোনভাবে বসে আছে সে উঠে গেল। আর প্রায় সাথে সাথে বসে পড়লাম সেই সিটে! যেন দীর্ঘ রিমান্ড শেষে মুক্তি পেলাম।
এভাবে বসে থাকার প্রায় এক ঘন্টার মধ্যে ট্রেন আখাউড়া এসে পৌছল। আমার পাশের পাশের জন অর্থাৎ যে জানালার ধারে বসে ছিল সে নেমে পড়ার জন্য উঠে দাঁড়াল। আর সঙ্গে সঙ্গে আমি সহ আরো দুইজন সেই সিট দখল করার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ল। শেষে ছোটখাটো একটা যুদ্ধ করে আর হালকা বাকবিতণ্ডা করে সিট টায় আমার অধিকার প্রতিষ্টা করলাম। প্রায় সাড়ে চার ঘণ্টা পর একটু আরাম করে গা এলিয়ে বসতে পারলাম! আহা... সে এক স্বর্গীয় অনুভূতী!
এরপর কী হয়েছে জানি না। শুধু ভোঁসভোঁস করে ঘুমিয়েছি। শুধু মনে আছে কুমিল্লা আর ফেনী স্টেশনে ট্রেন থেমেছিল তখন ঘুম ভেংগেছিল। এরপর একদম ভোরে; জানালা দিয়ে তখন পাহাড় দেখা যাচ্ছিল। শীতের কুয়াশা ভেদ করে সীতাকুন্ডের পাহাড় গুলো স্বগর্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে!
ট্রেন থেকে নেমেই খোঁজ নিলাম রিটার্ন ট্রেন কখন আছে। ১১ টার একটা ট্রেন আছে। কিন্তু ওটায় যাওয়া সম্ভব না। তাই বাস ছাড়া গতি নাই।
পেটে তখন ইঁদুর ডাকা শুরু হয়েছে। জলদি স্টেশনের পাশের একটা ঝুপড়ি দোকানে ঢুকে পড়লাম। টিউবওয়েলের গরম পানিতে চোখ মুখ ধুয়ে সারা রাতের ক্লান্তি দূর হয়ে গেল। নান রুটি আর ভাজি দিয়ে নাস্তা সারলাম। এরপর এলো চা। আশেপাশের সবাইকে পিরিচে ঢেলে চা খেতে দেখে শহুরে ভদ্রতা ভুলে গেলাম। পিরিচে ঢেলে সুড়ুত সুড়ুত করে শব্দ করে চা খাওয়ার মজা শহুরে বাবুরা বুঝবে না।
খাওয়া শেষ হলে দোকানদারের কাছ থেকে সব ইনফরমেশন নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। উদ্দেশ্য চন্দ্রনাথ পাহাড়!
.
স্টেশন থেকে খুব একটা দূর না। তিন চার মিনিট হাটলেই পাহাড় চোখে পড়বে আর দশ পনেরো মিনিটের পথ গেলেই পাহাড়ের কাছে চলে যাওয়া যায়। এর মধ্যেই চোখে পড়বে জনবসতি। জায়গাটা হিন্দু অধ্যুষিত। এদেশের আর দশ টা এলাকার মতো দশ কদম হাঁটলেই মসজিদ নজরে পড়বে না। একটু পর পর মন্দির। কিছু নির্মাণাধীন। এর আগে কখনো এতো মন্দির এক সাথে দেখিনি। একটা শ্মশান ঘাটও আছে। কেউ মরেছিল হয়ত। সুর করে কান্নার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছিল।
এসব দেখতে দেখতে এক সময় পাহাড়ের নিচে এসে পৌছুলাম। এরই মধ্যে রাস্তা ঢালু হতে আরম্ভ করেছে। কিছুদূর যেতেই পাহাড়ের চূড়া নজরে এলো। কি সুন্দর বিশাল দেহ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে! মাটি কালো হয়ে শক্ত হয়ে গেছে। শীতের কারনে একটা উষ্কখুষ্ক ভাব এসে গেছে। সূর্য তখন কেবল কুয়াশা ফুঁড়ে পূর্ব আকাশে উঁকি দিচ্ছিল। শুধু পাহাড়ের উপরের দিক টায় আলো পড়েছে। দেখে মনে হয় সুর্যের আলো যেন পাহাড়ে কপালে সোনালি চুমু এঁকে দিয়েছে! নিচের দিকে পাহাড়ের ছায়া পড়ে অন্ধকার হয়ে আছে। মুগ্ধ দৃষ্টি তে তাকিয়ে রইলাম কিছুকাল। চোখের পলক ফেলা দায় এমন অবস্থা! হবে নাই বা কেন! এর আগে এই অপার্থিব দৃশ্য দেখার ভাগ্য ঘটে জুটেনি যে!
আবার হাঁটা আরম্ভ করলাম। কিছুদূর যাওয়ার পরই সিঁড়ি নজরে এলো। আগেই জানা ছিল ৬৪০ টা সিঁড়ি আছে মোট। উপরে শিব মন্দির আছে বলে সিঁড়ির ব্যাবস্থা করা আছে। শুরু করলাম সিঁড়ি ভাংগা। আমি আর তাহিদুল প্রতিযোগীতা শুরু করে দিলাম। কে কার আগে পৌছুতে পারে। এদিকে তাহিদুলের বাবা বারবার বলছিলেন ধীরেসুস্থে যেন উঠি। তা না হলে দ্রুতই কাহিল হয়ে যাব। অভিজ্ঞতার একটা ব্যাপার আছে যা আংকেলের মধ্যে ছিল। এই অভিজ্ঞ পরামর্শ না মানার ফলও পেলাম। কিছুদূর যেতেই শরীর ঝিমিয়ে যেতে চাইল। এক জায়গায় বাঁশ বিক্রি করতে দেখলাম। কিনে ফেললাম সাথে সাথে। থার্ড লেগ হিসেবে কাজে দিবে। তাছাড়া একটা ভাবেরও ব্যাপারস্যাপার আছে। অনেকের ছবিতে দেখেছি ট্রেকিং করার সময় হাতে লাঠি নিতে।
হাঁটছিলাম আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ বেয়ে। সিড়ি করা আছে বলে এটা ভাবা সমীচীন হবে না যে খুব সহজে তরতর করে উঠে যাচ্ছিলাম। বেশ কষ্ট হচ্ছিল। একেকটা সিড়ি প্রায় এক ফুটের কাছাকাছি। মাধ্যাকর্ষণ কে উপেক্ষা করে এতো খাড়া সিড়ি ভাংগা যথেষ্ট কষ্টসাধ্য।
কিছুদুর যেতেই একটা ছোট্ট ঝর্ণা নজরে এলো। এগুলো কে 'ছড়া' বলে। দেখে মনে হবে কেউ হালকা করে ট্যাপ ছেড়ে রেখেছে। তবে প্রথম দেখাতে বুঝতে পারিনি এটা আদৌ ঝর্না কিনা। এর পাশ দিয়েই মন্দিরে পানি সাপ্লাইয়ের জন্য পাইপ গেছে একটা। ভেবেছিলাম হয়তো পাইপ ফেটেই পানি বেরুচ্ছে। তাই খুব একটা নজর দিলাম না। কিছুদূর উঠতেই ব্যাপার টা খোলাসা হল। কোনোএক জায়গা থেকে অনর্গল পানি পড়ার শব্দ আসছে! নিশ্চয় ঝর্ণা। তবে চোখে দেখা গেল না। অনেকক্ষণ এদিকওদিক তাকানোর পর বুঝলাম ঝর্ণা পাহাড়ের গিরিখাদে ঝোপঝাড়ের নিচে ঢাকা পড়েছে। নিচ দিক থেকেই শব্দ আসছে। একদম বৃষ্টির মতো রুমুঝুমু শব্দ। আমাদের দেখা সেই ছোট্ট ঝর্না এই অদৃশ্য ঝর্নারই শাখা। নিস্তব্ধ পাহাড়ের মাঝে গম্ভীর এক কলতান। অদ্ভুত রকমের ভাল লাগা সৃষ্টি করছিল সেই শব্দ।
আবার পথচলা শুরু হলো। যতো উপরে উঠি সিঁড়ি ততোই খাড়া হয়। কয়েক জায়গায় একদম খাড়া উঠা লাগে। কিছু জায়গায় তখনো অন্ধকার ছিল। ঘন গাছপালার কারনে রোদ ঠিক মতো ঢুকতে পারে না। একটা বিষয় নজর কাড়ল। এই পাহাড়েও মানুষ বিদ্যুৎ এনেছে। একটু পরপর কারেন্টের পোল। মাটির নিচ দিয়ে পানির লাইন। সবটাই পাহাড়ের উপরের মন্দিরের জন্য। এতো উপরে এসব নিয়ে আসা কতটা জটিল তা ভাবতেই অবাক লাগে!
একটা বেশ বড় এরিয়া জুড়ে সমতল পেলাম। তার একটু উপরেই সর্বোচ্চ চূড়া। এখানে এসে ব্যাগপত্র এক জায়গায় রেখে চারিদিক টা ঘুরেঘুরে দেখলাম। মন কেড়ে নেয়ার মতো পরিবেশ! সেখানে কিছু সময় থেকে আবার চূড়ার দিকে রওয়ানা দিলাম। অল্প কিছু সিঁড়ির পরই পৌঁছলাম চূড়ায়।
সে এক দেখার মতো দৃশ্য! একদিকে সীতাকুণ্ডের ঘরবাড়ি আর মন্দির। আরেকদিকে পাহাড়! যতো দূর নজরে আসে! সব পাহাড়! কোনটা ছোট আবার কোনটা বড়ো। দেখে মনে হবে বিশাল সমুদ্রে ঢেউ খেলে যাচ্ছে! শীতকাল বলেই এতোটা সবুজ ছিল না। কিছুটা ধূসর রং। এর মধ্যেই আলো আর এক পাহাড়ের ছায়া আরেক পাহাড়ের উপরে পড়ায় অদ্ভুত সুন্দর দৃশ্য তৈরি হয়েছে। মুগ্ধ হয়ে না তাকিয়ে থাকতেই পারবেন না!
সেখানে কিছু সময় কাটিয়ে আর এক গাদা ছবি তুলে নিচে নেমে এলাম। নামার সময় কোন কষ্ট নাই। তবে ভয় হচ্ছিল। পা একদম অসাড় হয়ে আসছিল। সাথে কাঁপুনি। সামান্য বেখেয়াল হয়ে নামলেই ব্রেকফেল করে একদম চিতপটাং!
সাবধানে নেমে এলাম। আসার পথে সেই ছোট্ট ঝর্নাটা পেলাম। যেটাকে পাশ কাটিয়ে চলে গিয়েছিলাম। পরে ভুল ভেঙেছিল। সামান্য যেই প্রবাহ ছিল তাতেই সামান্য মুখ ভিজিয়ে নিলাম। বরফ শীতল পানি! নিমিষেই যেন সব ক্লান্তি ভুলে গেলাম! দুদন্ড শান্তি ছড়িয়ে দিল।
এবার যাত্রা ইকোপার্ক!
সীতাকুণ্ড ইকোপার্ক এদেশের প্রথম এবং খুব সম্ভবত একমাত্র ইকোপার্ক। ইকোপার্ক বলতে এমন এক বনজ পরিবেশ বুঝায় যা মানুষের নিয়ন্ত্রনে থাকে। সোজা বাংলায় মানুষ নিয়ন্ত্রিত প্রাকৃতিক পরিবেশই হচ্ছে ইকোপার্ক। এই পার্কটা চন্দ্রনাথ পাহাড় থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার মতো দূরে। সিএনজি নিয়ে প্রথমে সীতাকুণ্ড বাজার যেতে হবে। এরপর রিকশায় করে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক দিয়ে কিছুদূর যাওয়ার পর হাইওয়ে থেকে বামদিকে প্রায় এক কিলো রাস্তা গেলেই ইকোপার্ক।
পার্কটা মুলত পাহাড়ি এলাকাতেই। পাহাড় কেটে পিচ ঢালা রাস্তা করা আছে। রাস্তার দুই ধারে বিভিন্ন রকম গাছপালা। পার্কের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত হেঁটে পার হব এমন শক্তি ছিল না শরীরে। তার চেয়ে একটা সিএনজি ভাড়া করে নিলাম। তাছাড়া ইকোপার্কের গাছপালা দেখার কোনরকম ইচ্ছাই ছিল না। সেই উদ্দেশ্যে যাইওনি। সেখানে যাওয়ার একমাত্র লক্ষ্য ছিল ঝর্না দেখা। শুধু দেখাই না, সাথে ঝর্নার ঠান্ডা পানিতে একটু গোসল করব এমন একটা চিন্তা ভাবনা ছিল।
আগেই ইউটিউব আর গুগলে জায়গাটা সম্পর্কে কিছু পড়ালেখা করেছিলাম। পার্কে দুইটা ঝর্না আছে। একটা সুপ্তধারা আরেকটা সহস্রধারা। প্রথমেই গেলাম সহস্রধারায়। এটা একটু দূরে। ঠিক করেছিলাম ফেরার পথে সুপ্তধারা দেখে যাব।
সিএনজি পাহাড়ি পিচ ঢালা রাস্তা বেয়ে উপরে উঠতে লাগল। এতোই ঢালু রাস্তা যে ইঞ্জিন বন্ধ হলেই সিএনজি গড়িয়ে গড়িয়ে নিচে নেমে পড়বে। মোটামুটি মহাকর্ষ আর ইঞ্জিনে একটা লড়াই শেষে সহস্রধারায় পৌঁছলাম। সেখান থেকে আবার ১৮০ টা সিঁড়ি ভেংগে নিচে নামতে হবে। অগত্যা দেহকে কওন ভাবে বশে এনে নামতে লাগলাম। সিঁড়ি দিয়ে নামতে কোন বেগ পেতে হলো না। অনেকটা তরতর করে নেমে গেলাম। ঝর্ণার কাছে এসেই আশা ভংগ! পানির ধারা ক্ষীণ। অনেক উঁচু থেকে পানি পড়ছে। একটা জায়গা পর্যন্ত ভালভাবে পড়লেও একদম নিচ পর্যন্ত আসতে আসতে পানি চুইয়ে চুইয়ে আসছিল। যথেষ্ট হতাশ হলাম। নিজের উপর রাগ হতে লাগল। কেনই বা লাগবে না! এই শুকনো মৌসুমে ঝর্ণার আসল রূপ দেখার কল্পনা করাও ক্রাইম। তবে মন্দের ভালো হল যে একটা শিক্ষা হল। আর কখনো শীতকালে ঝর্না দেখার আশা করব না। একদম হাতে কলমে শিক্ষা হয়েছে। ১৮০ টা সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে শিক্ষাটা মনে রাখার মতো একটা উদাহরণ নিয়ে গেলাম।
আমরা এই সিঁড়ি ভাংগা নিয়ে যেরকম কাহিল হয়ে পড়েছিলাম তাহিদুলের বাবার মধ্যে তার ছিটেফোঁটাও নজরে আসেনি। উনি দিব্যি অভিজ্ঞ লোকের মতো সব কিছু ঘুরে বেড়াচ্ছেন। কোন অভিযোগ নাই। চোখেমুখে তরুনদীপ্ত তেজ। মিলিটারি ম্যান বলে এসবে উনার অভ্যাস আছে। আর আমরা হচ্ছি আনাড়ি পাবলিক। গরম রক্তের ঠুনক তেজে সব কিছু করতে গিয়ে হাঁপিয়ে উঠি।
সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে এলাম। এবার যাব সুপ্তধারায়। ইউটিউবে ভিডিওতে দেখেছিলাম ঝর্ণা টা। বেশ গহীন একটা জায়গায় তার অবস্থান। যেতে গেলে অনেকটা পথ একদম এডভেঞ্চারের মতো যাওয়া লাগে। একসাথে তিন চারটা ধারা। উচ্চতা কম হলেও ঠিকমত পানি পড়লে সৌন্দর্য কম হওয়ার কথা না। তবে এখানেও হতাশা! স্থানিয়দের কাছে শুনলাম শীতকালে এই সুপ্তধারার প্রবাহ বন্ধ থাকে। শুধু বর্ষাকালে একে দেখতে পাওয়া যায়। এজন্যই এমন নাম করন। এই খবর শুনে হতাশের চূড়ান্ত হলাম। এই সুপ্তধারার ভিডিও দেখেই মুলত ইকোপার্কে আসার জন্য এতো আগ্রহ বোধ করছিলাম। আর সেই কিনা ঘাপটি মেরে বসে আছে!
আমরা ক্ষুদ্র মানুষ। প্রকৃতির উপর কিছু করারও নেই। তাই কোন পথ না পেয়ে এক ঝর্না হতাশা নিয়ে ইকোপার্ক থেকে বেরিয়ে এলাম।
সারারাত আর সারাদিনের ক্লান্তিতে শরীর ভেংগে পড়ছিল। সামন্য একটু বিশ্রামের জন্য হাহাকার করছিল। তাই আর দেরি না করে কোন জায়গায় গোসল করা যায় কিনা খুঁজতে লাগলাম। কোন আবাসিক হোটেল পাওয়া গেল না। শেষমেশ এক কলেজের পুকুরে গোসল সারলাম। এখানে এসে আরেক কান্ড। বাঁধাই করা ঘাট। শেওলা জমে পিচ্ছিল হয়ে আছে। মাত্র পাঁচটা সিঁড়ি পার করতেই তাহিদুল গুনেগুনে দুইটা আছাড় খেল। বেচারা এতো মানুষের সামনে আছাড় মানে উষ্টা খেয়ে যারপরনাই কিছুটা অস্বস্তিতে পড়ল।
পানি দেখলে আমার মাথা ঠিক থাকে না। শরীরের জয়েন্টে জয়েন্টে বেথা করছিল। পেট ভর্তি ক্ষুধা। তাও আধ ঘন্টা মতো সাঁতরালাম। পানি থেকে উঠেই ক্ষুধা তার জানান দিচ্ছিল। তাকে জলদি বিদায় করতে হবে।
সীতাকুণ্ড বাজারে গিয়ে ওখানকার সবচেয়ে ভালো হোটেলটায় ঢুকে গেলাম। কোড়াল মাছ আর মুরগি দিয়ে খেতে খেতে প্রায় দুপুর দুইটা বেজে গেল। হাতে তখনো অনেক সময় ছিল। কিন্তু আশেপাশে আর দেখার মতো তেমন কিছু ছিল না। আংকেল না থাকলে হয়ত সাহস করে দুই ঘন্টার পথ পাড়ি দিয়ে পতেঙ্গা সী বিচে গিয়ে সুর্যাস্ত দেখে আসা যেত। কিন্তু আর ইচ্ছা হলো না উনাকে কষ্ট দেয়ার। তাই সিদ্ধান্ত হলো যেকোন সময়ের একটা বাসে ঢাকা ফিরে যাব।
হোটেল থেকে বেরিয়ে মনে পড়ল কিছু একটা মিস করে যাচ্ছি আমরা। লাঠি! আমাদের পাহাড় জয় করা লাঠি! গোসল করার সময় ফেলে এসেছি। আমি দৌড়ে গেলাম লাঠি আনতে। হাজার হোক আমাদের কঠিন সময়ের পথচলার সাথী! তাকে ফেলে আসি কিভাবে?
টিকেট কাউন্টারে গিয়ে সাড়ে তিনটার টিকেট পাওয়া গেল। কেটে নিলাম তিনটা টিকেট। বাসে ধুকলাম লাঠি সহ। সবাই তাকাচ্ছিল কেমন কেমন করে যেন। যেন এরকম দৃশ্য এই প্রথম!
গাড়ি চলছিল হাই স্পিডে। জানালা দিয়ে হুহু করে বাতাস ঢুকছিল। সুর্যের তেজ ফুরিয়েছে। শেষ বেলার দীপ্তি দিয়ে অস্তাচলকে রাঙিয়ে চলছিল সে। তার খানিকটা ছটা এসে ঢুকছিল জানালা দিয়ে। আমিও খানিকক্ষণের জন্য হারিয়ে গেলাম যেন। মনে হচ্ছিল বাস এভাবেই চলতে থাকুক। জীবনটা এভাবেই কেটে যাক। আজ এখানে কাল ওখানে। সকালে বিশাল পাহাড় তো বিকেলে পথ হারা সাগরে। ক্ষতি কী? চলুক না!
কিন্তু না। জীবন এতো ছোট না। জীবনের অর্থ এতো সীমাবদ্ধ না। জীবন পাহাড়ের মতো বড়। সমুদ্রের মতো সুবিশাল। আর ঝর্ণার মতো বহমান। ঘুরাঘুরি করাটা শুধুই অবসর কাটানো হয়ে যাবে যদি আমরা এসব থেকে শিক্ষা না নেই। জীবনের গূঢ় অর্থ এখানেই ধূমায়মান।
আবার দেখা হবে কোন এক বাঁকে।
©somewhere in net ltd.