নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
পারস্য উপসাগর বিশ্বের অন্যতম প্রধান গুরুত্বপূর্ণ জলপথ। এ উপসাগর কৌশলগত দিক থেকেও বিশ্বের অত্যন্ত স্পর্শকাতর অঞ্চলে অবস্থিত হওয়ায় পরাশক্তিগুলো সব সময়ই এ জলপথে তাদের উপস্থিতি জোরদারের প্রচেষ্টা চালিয়ে এসেছে। এ উপসাগরটির সুবিস্তৃত উত্তরাঞ্চলীয় উপকূল ইরানের অংশ। এর পশ্চিমে রয়েছে ইরাক ও কুয়েত, দক্ষিণে রয়েছে সৌদি আরব, কাতার, বাহরাইন, ওমান ও সংযুক্ত আরব আমিরাত। পারস্য উপসাগরের মোট আয়তন দুই লাখ ৪০ হাজার বর্গকিলোমিটার। মেক্সিকো উপসাগর ও হাডসন উপসাগরের পর পারস্য উপসাগরই পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম উপসাগর। এ উপসাগর লম্বায় ৯০০ কিলোমিটার এবং চওড়ায় প্রায় ২৪০ কিলোমিটার। ইরান সংলগ্ন পারস্য উপসাগরীয় উপকূলের দৈর্ঘ্য ৮০০ কিলোমিটার। পারস্য উপসাগরের গভীরতা কম এবং সাধারণত: তা ৫০ মিটার, আর সর্বোচ্চ গভীরতা প্রায় ১০০ মিটার। পারস্য উপসাগর হরমুজ-প্রণালীর মাধ্যমে ওমান সাগর ও মুক্ত মহাসাগরের সাথে যুক্ত হয়েছে।
খার্গ, আবু মুসা, বড় তুন্ব, ছোট তুন্ব, কিশ, কেশম ও লাভান পারস্য উপসাগরে অবস্থিত ইরানের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দ্বীপ। পারস্য উপসাগরের গুরুত্বের কারণেই এখানকার হরমুজ-প্রণালী বিশ্বের অন্যতম প্রধান গুরুত্বপূর্ণ বা কৌশলগত প্রণালী হিসেবে বিবেচিত হয়। এ প্রণালী লম্বায় ১৫৮ কিলোমিটার এবং চওড়ায় ৫৬ থেকে ১৮০ কিলোমিটার। আন্তর্জাতিক নৌ-পরিবহনের সংখ্যার দিক থেকে হরমুজ প্রণালীর স্থান বিশ্বে দ্বিতীয়। প্রতিদিন প্রায় এক কোটি ৭০ লাখ ব্যারেল জ্বালানি তেল বয়ে নিয়ে যাওয়া হয় এ প্রণালী দিয়ে। বিশ্বের অপরিশোধিত জ্বালানি তেলবাহী তেলট্যাংকারগুলোর শতকরা ৪০ ভাগ যাতায়াত করে এ সাগর দিয়ে এবং এ জলপথ দিয়েই রপ্তানি করা হয় বিশ্ববাজারের শতকরা প্রায় ২৫ ভাগ জ্বালানি তেল। পারস্য উপসাগরের ব্যাপক গুরুত্ব তুলে ধরার জন্য এটাই জানা যথেষ্ট যে, বিশ্বে এ পর্যন্ত আবিস্কৃত জ্বালানি তেল ও গ্যাসের শতকরা প্রায় ৬৮ ভাগই রয়েছে এ উপসাগরের নিচে ও আশপাশের দেশগুলোতে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর বিশ্বের বহু দেশের বা অঞ্চলের গুরুত্ব কমে গেলেও পারস্য উপসাগরের গুরুত্ব আগের চেয়েও বেড়েছে। বিশ্ব-অর্থনীতির মূল প্রাণ-প্রবাহ হল এই উপসাগর। আর এ জন্যই এর ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা মার্কিন সরকারের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পাশ্চাত্যের সেবাদাস প্রকৃতির কয়েকটি আরব সরকার পশ্চিমা প্রভুদের উস্কানি পেয়ে ইরান-বিরোধী তৎপরতায় জড়িত হয়েছে। এ লক্ষ্যে তারা রাজনৈতিক মহল ও গণমাধ্যমে পারস্য উপসাগরকে এই নামে অভিহিত না করে শুধু উপসাগর বা "আরব উপসাগর" বলে অভিহিত করছে। তারা আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোয় ও এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়সহ জ্ঞান-বিজ্ঞান সংক্রান্ত নানা প্রতিষ্ঠানেও এই ভুয়া ও মিথ্যা নামটি চালু করার চেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু রাজনৈতিক মহল ও ইন্টারনেট মাধ্যমসহ নানা গণমাধ্যমে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের সরকার ও জনগণের ব্যাপক প্রতিবাদের মুখে এসব বিকৃত নাম স্বীকৃতি পাচ্ছে না। মানবজাতির লিখিত ইতিহাসের প্রথম থেকেই বিশ্বের চারটি সনাক্তকৃত সাগরের মধ্যে পারস্য উপসাগর ছিল অন্যতম। গ্রীকরা মনে করত এ চারটি সাগরই উৎসারিত হয়েছে একটি মহাসাগর থেকে যে মহাসাগর বিশ্বের সব জলভাগের সমমাত্রায় বিস্তৃত। তাই এটা স্পষ্ট যে ইরানের প্রাচীন হাখামানেশীয় সম্রাট দারিুয়ুশের শিলালিপিতে "পার্স বা পারস্য সাগর" হিসেবে উল্লেখিত হওয়ার বহু বছর আগেই অ-ইরানি জনগোষ্ঠীও এই বিস্তৃত জলভাগকে পার্স নামেই চিনত।
এ উপসাগরের নাম এত প্রাচীন যে অনেকে মনে করেন, পারস্য উপসাগরই মানব সভ্যতার উৎস বা লালনভূমি। এ অঞ্চলের প্রাচীন বাসিন্দারাই প্রথম জাহাজ তৈরি করেছিল। এসব জাহাজে চড়ে তারা অন্যান্য দেশে যেত। খ্রিস্টের জন্মের ৫০০ বছর আগে সম্রাট প্রথম দারিউশের শাসনামলে ইরানি নাবিকরা তাদের নৌ-অভিযান শুরু করেছিল। জেনোফেন , Ktzyas, স্ট্রাবন ও হেরোডটাসের মত খ্রিস্টপূর্ব যুগের গ্রিক ভূগোলবিদ ও ইতিহাসবিদদের বর্ণনা অনুযায়ী গ্রিকরাই প্রথম এই সাগরকে পার্স সাগর ও ইরানকে পার্স, পার্সি, পার্সিপলিস নাম দিয়েছিল। গ্রিক ভাষায় পার্সিপলিস শব্দটির অর্থ হল পারসিকদের দেশ বা বাসস্থান।
দিগবিজয়ী সম্রাট আলেক্সান্ডারের জেনারেল Nyarkhus খ্রিস্টপূর্ব ৩২৬ সালে তার সম্রাটের নির্দেশে সিন্ধু নদ পার হয়ে মুকরান সাগর বা ওমান সাগর ও পারস্য উপসাগর জাহাজ বা নৌকাযোগে পার হয়েছিলেন। তিনি এর মোহনা পর্যন্ত অগ্রসর হয়েছিলেন। ভূগোল শাস্ত্রের জনক নামে পরিচিত প্রাচীন গ্রিক ভূগোলবিদ Hecataeus খ্রিস্টপূর্ব ৪৭৫ সালে পারস্য সাগর শব্দটি ব্যবহার করেছেন। জেনোফেন ও হেরোডটাসের মতে প্রাচীন মানচিত্রগুলোতে এই সাগরকে পারস্য সাগরই বলা হত।
খ্রিস্টিয় দ্বিতীয় শতকের ভূগোল ও গণিতবিদ টলেমি "বিশ্বের ভূগোল" শীর্ষক ল্যাটিন ভাষার বইয়ে অঙ্কিত মানচিত্রে পারস্য উপসাগরকে "পার্সিকুস সিনুস" বলে উল্লেখ করেছেন। খ্রিস্টিয় প্রথম শতকের রোমান ইতিহাসবিদ Kevin Tus Kurvsyus Rufus এই সাগরকে পারস্য সাগর বা পারস্য জলাধার বলে উল্লেখ করেছেন। ল্যাটিন ভাষায় লিখিত ভূগোলের প্রাচীন বইগুলোতে দক্ষিণ ইরানের জলরাশি তথা মাকরান সাগর ও পারস্য উপসাগরকে "মারেহ পার্সিকুম" বা পারস্য সাগর বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ইংরেজি, জার্মান, মার্কিন, ফরাসি ও তুর্কি ভাষাসহ বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় লিখিত অভিধানগুলোতেও পারস্য উপসাগর শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। আরবী ভাষায় সবচেয়ে বিখ্যাত বিশ্বকোষ নামে খ্যাত " আলমুঞ্জেদ"ও এই সাগরকে পারস্য উপসাগর বলে উল্লেখ করেছে।
পারস্য উপসাগর শব্দটির ক্ষেত্রে প্রথমবারের মত "আরব উপসাগর" শব্দটি ব্যবহার করেছেন এ অঞ্চলের স্যার চার্লস বেলগ্রেভ নামের একজন ব্রিটিশ কূটনীতিক। পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলে তিন দশক ধরে ব্রিটিশ কূটনীতিক হিসেবে দায়িত্ব পালনের পর তিনি স্বদেশে ফিরে ১৯৬৬ সালে পারস্য উপসাগরীয় দক্ষিণ উপকূল সম্পর্কে একটি বই লেখেন। তিনি এ বইয়ে ভুয়া ও মিথ্যা নাম "আরব উপসাগর" শব্দটি ব্যবহার করেন। বেলগ্রেভ পারস্য উপসাগরীয় দক্ষিণ উপকূলকে "চোরদের উপকূল" বলে উল্লেখ করেন এবং দাবি করেন যে, আরবরা পারস্য উপসাগরকে "আরব উপসাগর" বলতে আগ্রহী। আর এ বইটি প্রকাশিত হওয়ার পর থেকেই আরব পত্র-পত্রিকায় পারস্য উপসাগরকে "আরব উপসাগর" লেখা শুরু হয়। আরও কিছুদিন পর পারস্য উপসাগরের দক্ষিণাঞ্চলের আরব দেশগুলোর সরকারি লেখালেখিতেও "আরব উপসাগর" লেখা হতে থাকে। ইরানের তৎকালীন সরকার এই উদ্যোগের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখায়। ইরানের শুল্ক ও ডাক বিভাগ "আরব উপসাগর" লেখা চিঠি-পত্র ও অন্যান্য প্যাকেট গ্রহণ করত না। ইরান বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সমাবেশ ও সম্মেলনেও এই জাল বা ভুয়া নাম ব্যবহারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে থাকে।
পারস্য উপসাগরকে "আরব উপসাগর" শীর্ষক জাল বা ভুয়া নাম দেয়া ও তার প্রচলনের জন্য কোনো কোনো আরব সরকার বিদেশী পত্র-পত্রিকাকে বিপুল অংকের অর্থ দিচ্ছে। ইরানে ইসলামী বিপ্লব সফল হওয়ার পর ইসলাম-বিদ্বেষী পশ্চিমা সরকারগুলো পারস্য উপসাগরের পরিবর্তে "আরব উপসাগর" বা শুধু "উপসাগর" নামটিকে আরও ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করে। তারা বিভিন্ন সংবাদ ও গণমাধ্যমে এবং রাজনৈতিক মহলে এই ভুয়া নাম ব্যবহার করছে। ১৯৯০'র দশকে জাতিসংঘের প্রধান সম্পাদক ইরানি প্রতিনিধিদের অব্যাহত প্রতিবাদের কথা তুলে ধরে এ সংস্থার নানা দলিল-পত্রে পারস্য উপসাগরকে "আরব উপসাগর" লেখার ব্যাপারে ইরানিদের প্রতিবাদের কথা সব সময় স্মরণ রাখতে সংশ্লিষ্ট কর্মীদের উপদেশ দেন। আসলে পশ্চিমারা পারস্য উপসাগরকে "আরব উপসাগর" বলে তুলে ধরার মাধ্যমে এ অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করতে চায়। জ্যাঁ জ্যাক পিরিনি তার "পারস্য উপসাগর" শীর্ষক বইয়ে লিখেছেন: "পারস্য উপসাগরের উপকূলে বহু জাতি কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিল। কিন্তু তাদের সেসব দিন শেষ হয়ে গেছে। কেবল পারসিক বা ইরানি জাতি দূরদর্শিতা ও বিচক্ষণতা নিয়ে এখানে টিকে রয়েছে এবং এ পর্যন্ত সার্বভৌমত্বের ঐতিহ্য ধরে রেখেছে।" #
©somewhere in net ltd.