নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

স্বপ্ন ও বাস্তবতাকে পাশাপাশি নিয়ে চলা নিতান্তই সাধারন একজন মানুষ।

ফাহাদ জুয়েল

ফাহাদ জুয়েল › বিস্তারিত পোস্টঃ

\'দেশে বিদেশে\' ; সৈয়দ মুজতবা আলীর প্রথম ও অন্যতম শ্রেষ্ঠ বই

২১ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৯ সকাল ১১:২৩



পড়লাম সৈয়দ মুজতবা আলী'র 'দেশে বিদেশে'।

বইয়ের নাম দেখে হয়তো অনেকে ধারণা করবেন- লেখকের নানা দেশ ভ্রমণের কাহিনি নিয়ে এই বই। অন্তত আমি তাই ধারণা করেছিলাম।

কিন্তু না, বরং তৎকালীন ভারতবর্ষ থেকে আফগানিস্তান পর্যন্তই এর ব্যাপ্তি। তবে দুই'শ সত্তর পৃষ্ঠার এই বইটি আপনাকে পরিচয় করিয়ে দিবে বেশ কয়েকটি জাতিগোষ্ঠীর সঙ্গে। স্বল্প পরিসরে তাদের ভাষা, আচরণ, সংস্কৃতি ও জীবনাচরণ সম্পর্কে ধারণা দিবে। বিস্তৃত পরিসরে রয়েছে আফগানিস্তানের কথা।

সৈয়দ মুজতবা আলী'র শান্তিনিকেতনে পড়ালেখার পর আফগানিস্তান সরকারের অনুরোধে ‘কাবুল কৃষি কলেজে’ ফারসি ও ইংরেজি ভাষার শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। মূলত আফগানিস্তান থাকাকালীন তার জীবন অভিজ্ঞতা নিয়েই 'দেশে বিদেশে' বইটি। অবশ্য আফগানিস্তানেও নানা ভাষার নানা জাতির যে সম্মিলন দেখা গিয়েছে তাতে করে 'দেশে বিদেশে' নামটা যথার্থতা লাভ করেছে।

'দেশে বিদেশে' সৈয়দ মুজতবা আলী'র প্রথম বই। এবং অনেক সাহিত্য সমালোচকের দৃষ্টিতে এটি তাঁর লেখা সর্বশ্রেষ্ঠ বই। সাপ্তাহিক 'দেশ' এ, ১৩ ই মার্চ ১৯৪৮ থেকে ১৮ ই সেপ্টেম্বর ১৯৪৮ পর্যন্ত মোট আঠাশ কিস্তিতে- 'দেশে বিদেশে' সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয়। এবং তা অনেকটা ইতিহাস সৃষ্টি করার মত।

শ্রীযুক্ত কানাইলাল সরকারের সনির্বন্ধ অনুরোধে মুজতবা আলী 'নিউ এজ পাবলিশার্স লিমিটেড'কে বইটি প্রকাশের অনুমতি দেন। এবং অবশেষে এপ্রিল ১৯৪৯ সালে বই আকারে প্রকাশ হল 'দেশে- বিদেশে'। শুরু হল মুজতবা আলী'র বাংলাসাহিত্যে জয়যাত্রা।

এ বিষয়ে এখানে রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য সান্যালের মন্তব্যটা উল্লেখ করা প্রয়োজন মনে করছি। তিনি বলেছিলেন-

"বাংলা সাহিত্যে খোশগল্প, মজলিসী এবং আড্ডা রসের একটি ধারা ছিল, কিন্তু খোশগল্প, আলী সাহেবের রচনায় শিল্পসুষমামণ্ডিত হয়ে দিল্ তর্ করা যে খুশবাই এনে দিয়েছিলেন- বাংলা সাহিত্যের কুতুব মিনার 'দেশে বিদেশে'র মাধ্যমে, তা ভগীরথের শিবের জটার থেকে গঙ্গা আনার মতই তুলনীয়। রসসাহিত্যের ধারা যখন ধীরে ধীরে শুকিয়ে আসছে- ঠিক তখনই “দেশ” পত্রিকায় ধারাবাহিক ভাবে এই লেখাটির আবির্ভাব। সাহিত্যের শুকিয়ে ওঠা নদী, খাল, বিল, হাওর ভরে উঠলো রসসাহিত্যের মিষ্টি জলে। খাবি খাওয়া মাছের মত পাঠককুল আবার চোখ মেলে তাকিয়ে সাঁতার কাটতে শুরু করলেন – এই জলে।"

মরুময়, উষর, প্রানহীন আফগানিস্তানকে তিনি যে রসবোধের মাধ্যমে আমাদের সামনে উপস্থাপন করেছেন, তাতে যেকোন রসহীন পাঠকও তৃপ্ত লাভ করবেন। মনে হবে লেখক যেন মরুভূমিতে মধুর চাষ করেছেন।

"গাড়ি ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই প্রথম যে ভাবনা আমার মনে উদয় হল সেটা অত্যন্ত কাপুরুষজনোচিত–মনে হল, আমি একা।"

সত্যি মানুষ খুব একা। বিশেষত যখন দেশ ত্যাগ করে, কিংবা বিদেশে অবস্থান করে তখন এ অনুভূতিটা অনেক শক্তভাবে জানান দেয়। লেখকের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়। বইয়ের শুরুতে লেখক যখন হাওড়া স্টেশন থেকে পেশওয়ারের দিকে ট্রেনযাত্রা শুরু করেন তখন আর সবার মতই তাঁরও মন স্বদেশের ভাবনায় আদ্র হয়ে ওঠেছিল। ভীষণ একা বোধ হচ্ছিল। ট্রেনের বাইরে তাঁকিয়ে তিনি খুঁজছিলেন চিরায়ত বাংলার কোন রূপ। হয়তো তিনি খুঁজছিলেন সুপারি গাছ কিংবা আম জামে ঘেরা ঠাসবুনুনির গ্রাম। সেরকম এক একাকীত্বের মুহূর্তেই লেখক উপরের উক্তিটি করেছিলেন।

দ্রুতবেগে ট্রেন চলছে। সাথে এগিয়ে চলছে মুজতবা আলীর দুলকি চালের বর্ণনা। তার কথার রসে কখনো উঠে এসেছে ভৌগলিক বর্ণনা, কখনো বা স্থানীয় মানুষের জীবনাচরণ, সংস্কৃতি, ইতিহাস। বিশেষত পাঠান জাতির কথা। একই সাথে তাদের বিভিন্ন গোষ্ঠি যেমন আফ্রিদী, শিনওয়ারী, খুগিয়ানী এদের কথাও লেখক বেশ রসময় ভাবে উপস্থাপন করেছেন পাঠকের সামনে। বলতে ভুলেন নি পাঠানরা গরীব জাতি হলেও মেহমানদারিতে তাদের কোনো কমতি নেই। গল্পগুজব করে সময় কাটানোতে এদের কোন আলসেমি নেই।

এরপর পেশওয়ার, খাইবারপাস হয়ে লেখকের যাত্রা চলতে থাকে আফগানিস্তানের কাবুলের দিকে। যাত্রাপথে নুড়িযুক্ত পথ, মরুভূমির মতো প্রান্তর, আফগান সীমান্তের শুরুতে এক দুর্গ, এক প্রাচীন সরাই, চমৎকার নিমলার বাগান কোন কিছুই লেখকের চোখ এড়ায়নি। আরবি-ফারসি যুক্ত সাবলীল হাস্যরসাত্মক ঢং ও নানা তথ্য দিয়ে তিনি কাবুল যাত্রা এমনভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন যাতে অচেনা কাবুল পাঠকের কাছে মোহনীয় দৃষ্টিতে ধরা দিতে বাধ্য হয়।

আফগানিস্তানের লিখিত ইতিহাস দুষ্প্রাপ্য বলে লেখক একে তুলনা করেছেন 'অরক্ষণীয়া মেয়ে' হিসেবে। এজন্য অবশ্য তিনি দায়ী করেছেন এর ভৌগলিক সীমান্তকে। এর ইতিহাস পর্যালোচনা করতে গেলে একই সাথে আরো কয়েকটি দেশের ইতিহাস নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে। বিশেষত ভারতবর্ষ আর আফগানিস্তানের ইতিহাস এমনভাবে মিলেমিশে রয়েছে যে এই দুই দেশকে আলাদা করে দেখাকে লেখক কুসংস্কার হিসেবে মন্তব্য করেছেন। এছাড়াও এর সাথে জড়িত রয়েছে তুর্কিস্তান, ইরান, রাশিয়া ইত্যাদি দেশসমূহ। সেজন্যই লেখক বলেছেন- "আফগানিস্তানের তুলনায় সুইটজারল্যাণ্ডের ইতিহাস লেখা ঢের সোজ। যদিও সেখানে তিনটে ভিন্ন জাত আর চারটে ভাষা নিয়ে কারবার।"

এরপর লেখক আফগানিস্তানের মানুষের জীবনযাত্রা, শাসনব্যবস্থা, কৃষি ব্যবস্থা, ঋতু, ইতিহাস নিয়ে নানা তথ্য দিয়ে সমৃদ্ধ করেছেন বইটি।

তখন আফগানিস্তানের শাসক ছিলেন আমান উল্লাহ। তিনি ছিলেন ইউরোপ ঘেঁষা ও প্রগতিপন্থি। ইউরোপের ভালো দিকগুলো তিনি নিজ দেশে প্রয়োগের চেষ্টা করতেন। যদিও কিছু উদ্ভট নীতিও জনগণের উপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন। এহেন পরিস্থিতিতে মোল্লারা তার উপর ক্ষেপে গিয়েছিল। তাঁকে কাফির বলে ঘোষণা করা হয়েছিল। দূর্বল অর্থনীতি ও শিক্ষাব্যবস্থার কারণে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে মোল্লাদের বেশ বড় একটা প্রভাব ছিল। মোল্লারা জনগণকে ক্ষেপিয়ে তুলেছিল, বিশেষত উপজাতি গোষ্ঠীগুলোকে।

এরকমই অস্থিতিশীল অবস্থায় এক কুখ্যাত ডাকাত সর্দার বাচ্চায়ে সকাও কাবুল শহর দখল করতে এলো। গোলাগুলি, লুটতরাজ, অরাজক পরিস্থিতি তৈরি হল। আফগানিস্তানের এরকম চরম সংকটপূর্ণ সময়ে এসে শাসক আমান উল্লা সিংহাসন ত্যাগ করে পালালেন। শাসনভার দিয়ে গেলেন বড় ভাই ইনায়েত উল্লার হাতে। কিছুদিন পর ডাকাত সর্দারের আক্রমণে ইনায়েত উল্লাও আফগানমুলুক ছেড়ে পালালেন। সিংহাসনের দখল এলো ডাকাতদের হাতে।

এসময়ে ব্রিটিশ রাজদূত বিদেশিদের আফগানিস্তান থেকে সরিয়ে ফেলার বন্দোবস্ত করলেন। কিন্তু বৈষম্যের শিকার হল ভারতীয়রা। অথচ যে বিমানে তারা দেশত্যাগ করছিলেন, সেগুলোও ভারতীয় করের টাকায় কেনা, এমনকি পাইলটরাও ভারতীয় অর্থের বেতনভোগ করে। যদিও শেষ পর্যন্ত মুজতবা আলীর দেশে ফেরার ব্যবস্থা হল।

কিন্তু অনেকদিন থেকে সে দেশটার প্রতিও তাঁর একটা মায়া জন্মে গিয়েছিল। বিদায় অংশে পাঠকের মনে সবচেয়ে বড় দাঁগ কাটবে, পাঠকের হৃদয় আদ্র করে তুলবে আফগানিস্তান থাকাকালীন লেখকের চাকর আব্দুর রহমান। পুরো আফগানিস্তানের মধ্যে লেখকের সবচেয়ে কাছের লোক ছিল এই আবদুর রহমান। সুখে-দুঃখে, বিপদে-আপদে এই মানুষটি তাঁকে কখনো ছেড়ে যায় নি। বরং তাঁর সর্বোচ্চটা দিয়ে লেখকের সেবা করে গিয়েছেন। এমনকি যখন লেখক ভারতবর্ষে চলে আসছিল আবদুর রহমান কান্নাকাটি করে লেখকের সাথে আসার ইচ্ছা পোষণ করেছিল।

আব্দুর রহমানের এই আকুলতায় লেখকের হৃদয়ও আদ্র হয়ে ওঠেছিল। সেজন্যই বোধ করি লেখক বলেছেন- "চর্তুদিকের বরফের চেয়েও শুভ্রতর অবদুর রহমানের পাগড়ি, আর শুভ্রতম অবদুর রহমানের হৃদয়।"

লেখকের সাথে এই অচেনা দেশ ঘুরতে চাইলে পড়তে পারেন বাংলাসাহিত্যের অন্যতম সার্থক এই ভ্রমণকাহিনি।

মন্তব্য ৩ টি রেটিং +৪/-০

মন্তব্য (৩) মন্তব্য লিখুন

১| ২১ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৯ দুপুর ১২:০১

রাজীব নুর বলেছেন: বই নিয়ে আমি যে রকম পোষ্ট পড়তে আগ্রহী।
কারন আমি নিজেই বই পড়তে খুব ভালোবাসি।

আপনি খুব সুন্দর লিখেছেন।
এরকম পোষ্ট আপনার কাছে আরো চাই।

২| ২১ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৯ দুপুর ২:৪৫

বলেছেন: রাজীব ভাইয়ের মতো বলি, সুন্দর ও সাবলীল উপস্থাপনা করেছেন।।

৩| ২৩ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৯ রাত ৩:২৩

ডঃ এম এ আলী বলেছেন:
নির্বাচিত পাতায় গত দুইদিন ধরে জমে থাকা লেখাগুলির উপর চোখ রাখতে গিয়ে এই পোষ্টে এসে দৃষ্টি আটকে যায়। ভিতরে প্রবেশ করে নিবিষ্ট মনে কিছুক্ষন করি পর্যালোচনা পাঠ , কিছুক্ষন করি সৈয়দ মুজতবা আলী ও তাঁর কালজয়ী ভ্রমনকাহিনী নিয়ে স্মৃতিচারণ । একটি ভ্রমনকাহিণীকে রম্যের আঙ্গিকে লিখে পাঠকদের কাছে কিভাবে আকর্ষণীয় করে তুলতে হয় তা তাঁর দেশ বিদেশে ভ্রমনকাহিনীটি না পড়লে বুঝা যাবেনা । শুধু দেশ বিদেশই বা কেন, বিরল আঙ্গিকের লেখনী শক্তি দিয়ে তিনি তাঁর সকল লেখা গুলিকেই পাঠকের উপযোগী করে আনন্দ দানের পাশাপাশি জ্ঞানের পরিধি বিস্তারের গুরুদায়িত্বও পালন করেছেন । হিটলারের প্রেম থেকে শুরু করে ওমর খৈয়ামের কবিতা কোনোটাই বাদ যায়নি তাঁর সাহিত্য সমৃদ্ধ রসঘন লেখায়। বাংলা ভাষার প্রথিতযশা সাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলীকে একটিমাত্র শব্দ রম্যলেখক দিয়ে পরিচয় দিতে গেলে তার অগাধ পান্ডিত্যকে মুল্যায়ন অসম্পুর্ণ থেকে যায় । যার দখলে ছিল আঠারোটি ভাষা, রাশিয়ান ভাষার উপন্যাসকে করেছেন বাংলায় অনুবাদ, যার ঝুলিতে রয়েছে জার্মান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট, বিশ্বভারতী থেকে স্নাতক, মিশরের আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার অভিজ্ঞতা, গীতা থেকে গীতবিতান যার সম্পূর্ণ মুখস্ত তাঁর লেখার মুন্সিয়ানা নিয়ে কথা বলা চাট্টিখানি কথা নয়। তবে এখানে এই সংক্ষিপ্ত পরিসরে এই পোষ্টে তার অগাধ গুণপনার সাথে তুলে ধরা হয়েছে একটি সরস ভ্রমন কাহিনীর যাবতীয় বৈশিষ্টের কথা।

এটা বাংলা সাহিত্যের একটি প্রথম সার্থক ভ্রমণকাহিনী তাতে এখন আর কারো কোন দ্বিমত নেই। আফগানিস্তানের কাবুলে লেখকের ভ্রমনের অতি স্ংক্ষিপ্ত একটি প্রেক্ষাপট বর্ণনা দিয়ে তার পরে শুরু হযেছে মুল কাহিণী । পর্যালোচনাতে সুন্দরভাবে উঠে এসেছে গন্তব্যস্থল কাবুলের দিকে লেখকের যাত্রার বিবরণি, লেখকের এগিয়ে চলা। পথিমধ্যে নুড়িযুক্ত পথ, মরুভূমিসম প্রান্তর, আফগান সীমান্তের শুরুতে দুর্গ, প্রাচীন সরাই, সুন্দর নিমলার বাগানের চমৎকার বর্ণনা। লেখকের চোখে কিছুই এড়ায়নি। বাসের মধ্যে যাত্রীরা কে কী রকম জামা পড়েছিল, কত অদ্ভুত এবং বাংলার লোকদের থেকে তা কত পৃথক, কত পুরনো সংস্কৃতি ধারণ করে আছে সে জামা সবই তাঁর লেখায় ধরা পড়ছিল। সাথে সে অঞ্চল সম্পর্কে বিস্তর কথাবার্তা তো রয়েছেই। চমৎকার করে ইতিহাস, ভূগোল এবং বাস্তব গল্পের মিশেল, কোথাওবা গরুগম্ভির প্রবন্ধের ভাষায়, আবার কোথাও বা আনন্দঘন রম্য কথনে উঠে এসেছে সৈয়দ মুজতবা আলীর পান্ডিত্যময় লেখায়।

কি সুন্দর রম্য, তবে নিখাদ সত্যের বাতাবরনে তুলে ধরেছেন আফগানদের ইতিহাস। আফগানিস্তানের ইতিহাসকে তিনি ‘অরক্ষণীয়া মেয়ে’র সাথে তুলনা করেছেন তার ইতিহাস লেখা হয়নি বলে। বলেছেন গরীব দেশ বলে প্রত্নতত্ত্ব খোঁজার উদ্দেশ্যে তাদের মাটির নিচে খোঁড়াখুঁড়ি হয়নি। আর তার সাম্প্রতিক ইতিহাস বিভিন্ন পান্ডুলিপিতে কয়েকটি দেশে ছড়িয়ে রয়েছে। তিনি একটি অতি তাৎপর্যময় কথা বলেছেন তার দেশ বিদেশের ভ্রমন কাহিনীতে । বলেছেন আফগানিস্তানের ইতিহাস না জেনে ভারতবর্ষের ইতিহাস সম্পূর্ণ করার কোনো সুযোগ নেই। তবে এই ইতিহাস না লেখার কিছু কারণও রয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন। তার মতে আফগানিস্তানের ভৌগোলিক সীমান্ত এমনই জটিল যে নিজেদের ইতিহাস নিয়ে মাথা ঘামাতে হলে তাদেরকে আরো কয়েকটি দেশের ইতিহাস নিয়ে পর্যালোচনা করতে হবে।

তবে এটাও বলেছেন যে আফগানিস্তানের মেরুদণ্ড তৈরি হয়েছে তাদের উপজাতিদের নিয়ে অথচ কোথাও তাদের নিয়ে কোনো কথা বলা হয় না, কেউ আগ্রহ প্রকাশ করেনা। আফগান পণ্ডিতদের জিজ্ঞেস করলে তারা ঠিকঠাক উত্তর দিতে পারে না। বিষয়টিকে অতি সুন্দরভাবে তিনি তুলে ধরেছেন এই বলে ইতিহাস আলোচনা করতে গিয়ে কাবুলীরা প্রায়ই বলেন, তারপর শিনওয়ারীরা বিদ্রোহ করল, কিন্তু যদি তখন প্রশ্ন করেন, বিদ্রোহ করল কেন, তবে উত্তর পাবেন, মোল্লারা তাদের খ্যাপালো বলে, কিন্তু তারপরও যদি প্রশ্ন শুধান যে, উপজাতিদের ভিতরে এমন কোন্ অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক উষ্ণ বাতাবরণের সৃষ্টি হয়েছিল যে, মোল্লাদের ফুলকি দেশময় আগুন ধরাতে পারল, তাহলে আর কোনো উত্তর পাবেন না।

তৎকালীন ব্রিটিশ শাসন দ্বারা ভারতীয়দের শোষণ ও বঞ্চনার একটা ছোট, তবে পরিস্কার ধারণাও পাওয়া যায় সৈয়দ মুজতবার ভ্রমনকাহিনী হতে ।তিনি বেশ কড়াভাষায়ই তা বর্ণনা করেছেন: ইংরেজের জাতিভেদ বড় ভয়ঙ্কর জিনিস। তার দেশে যেরকম কাগজে কলমে লেখা, আইনে বাঁধা কন্সটিটুশন নেই ঠিক তেমনি তার জাতিভেদ প্রথা কোনো বাইবেল-প্রেয়ার বুকে আপ্ত বাক্য হিসেবে লিপিবদ্ধ করা হয়নি। অথচ সে জাতিভেদ রবীন্দ্রনাথের ভূতের কানমলার মত, সে কানমলা না যায় ছাড়ান, তার থেকে না যায় পালানো, তার বিরুদ্ধে না চলে নালিশ, তার সম্বন্ধে না আছে বিচার। দর্শন, অঙ্কশাস্ত্রে সুপণ্ডিত হোন, মার্কসিজমের দ্বিগ্বিজয়ী কৌটিল্যই হোন, অথবা কয়লার খনির মজুরই হোন, এই কানমলা স্বীকার করে করে হাউস অব লর্ডসে না পৌঁছানো পর্যন্ত দর্শন মিথ্যা, মার্কসিজম ভুল, শ্রমিকসঙ্ঘের দেওয়া সম্মান ভণ্ডুল। যে এই কানমলা স্বীকার করে না ইংরেজের কাছে সে আধপাগল। তার নাম বার্নাড শ।

ভ্রমন কাহনীটিতে শুধু ভ্রমন স্থানের কথাই নয় উঠে এসেছে বিশ্ব ব্রম্মান্ডের অনেক কথাই, উঠে আসে আফগানিস্তানের সাথে পুরা ভারত বর্ষের ইতিহাসের কিছু কথা , চলে আসে বৃটিশ রাজতন্ত্রের গুঢ় কথা, উঠে আসে ইতিহাস বিথ্যাত দেশী বিদেশী সাহিত্যিকদের প্রসঙ্গ কথা যথা আমাদের রবিন্দ্রনাথ ঠাকুর ও বিলাতের রবার্ট বার্নার্ড শ । ভ্রমন কাহিনীটি পাঠে নির্মল মননশীল বিনোদনের পাশাপাশি পাওয়া যায় নীজেদের জ্ঞানের জগতকে প্রসারিত করার জন্য অনেক অজানা তথ্য সমৃদ্ধ উপাদান।

অপরদিকে বিবিধ ধরনের প্রচার মাধ্যমে মুদ্রিত আকারে আসা বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আসা ইদানিংকার বেশীর ভাগ ভ্রমনকাহিনীই দেখা যায় গদবাধা নিরস ভ্রমন বিররণীতে ঠাসা । একটি ভ্রমনকাহিনীতে যেখানে ভ্রমন স্থানের ইতিহাস লোক সংস্কৃতি, ঐতিহ্য , শিল্প সাহিত্য , সমাজ ব্যবস্থা , রাজনীতি , ধর্মনীতি, অর্থনীতি প্রভৃতি থাকার কথা বৃহত অংশ জুরে, সেখানে লেখাটির সিংহভাগ জুরেই উঠে আসে প্রায় সকলের জানা কতগুলি কমন ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ কথা। যথা টিকেট কাটা, টেক্সি ডাকা , পুটলা পুটলী বান্ধা, হোটেল বুকিং আর দামী আদামী কিছু খানা পিনার কথা মালার সাথে অপ্রাসঙ্গিক ব্যক্তিগত বিষয়াদি , যদিও এগুলি একটি ভ্রমনকাহিনীর অঙ্গিভুত বিষয় , তার পরেও এই সমস্ত কথামালা লেখাটির সিংহভাগ জুরে থাকলে লেখাটি পাঠের সময় একটি সরস ভ্রমনকাহিণী পাঠের তৃপ্তি পাওয়া যায়না , পাঠক হিসাবে কিছুটা অতৃপ্তি থেকে যায়, মনে হয় লেখাটি যেন নিছক একটি ভ্রমন বিবরনী, ভ্রমন কাহিনী নয়। তাই একটি সরস ভ্রমন কাহিণী কেমন হবে তা বুঝতে হলে বিশেষ করে যে সমস্ত নবীন লেখক ভ্রমন কাহিণী লিখে প্রকাশ করতে চান তাদের জন্য সৈয়দ মুজতবা আলীর দেশে বিদেশে ভ্রমন কাহিনীটি একটি আদর্শমুলক শিক্ষনীয় পুস্তক হতে পারে।

ধন্যবাদ একটি কালজয়ী ভ্রনকাহিনীর উপর চমৎকার ও প্রাঞ্জল পর্যালোচনা এই পোষ্টের মাধ্যমে উপস্থাপনের জন্য ।

অতি পছন্দের এই ভ্রমনকাহিনীর মুল্যবান পর্যালোচনাটিকে যাবার বেলায় প্রিয়তে নিয়ে গেলাম ।

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর বিখ্যাত উপন্যাস 'কাঁদো নদী কাঁদো’ বিষয়ক আপনার পোষ্টে একটি ছোট মন্তব্য রেখে এসেছি , গিয়ে দেখতে পারেন ।

অনেক অনেক শুভেচ্ছা রইল

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.