নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

খেরোখাতা

বিপ্লব রহমান

পাহাড়, ঘাস, ফুল, নদী খুব প্রিয়। পেশা সাংবাদিকতা। লিখতে ও পড়তে ভালবাসি। টোটেম গৌতম বুদ্ধ। [email protected] *কপিরাইট ©: লেখক কর্তৃক সংরক্ষিত

বিপ্লব রহমান › বিস্তারিত পোস্টঃ

জুম চাষ: একটি সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা...

২৫ শে মে, ২০০৯ বিকাল ৩:১৭

জুম চাষ হচ্ছে পাহাড়ের ঢালে এক বিশেষ ধরণের চাষাবাদ পদ্ধতি। পাহাড়ি মানুষের ঐতিহ্যবাহি এই 'জুম' শব্দটি থেকে চাকমা ভাষায় 'জুমিয়া' (জুম চাষী) ও জুম্ম (পাহাড়ি জনজাতি) শব্দটির উৎপত্তি। রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান-এই তিন জেলা নিয়ে গড়ে ওঠা পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রায় ৯০ শতাংশ পাহাড়িই জুম চাষী।



এদেশের পাহাড় ও বনাঞ্চল হচ্ছে সরকারি খাস জমি। যুগ যুগ ধরে বংশপরম্পরায় সেখানে বসবাসরত পাহাড় ও অরণ্যচারী মানুষের এ সব জমির বন্দোবস্ত কোনো সরকারের আমলেই দেওয়া হয়নি। তাই পাহাড় ও বনাঞ্চলের ওপর আদিবাসী মানুষের এখনো কার্যত জন্মেনি কোনো অধিকার।



এক সময় নেত্রকোনা ও শেরপুর অঞ্চলের গারো পাহাড়ে মান্দি (গারো) ও হাজং এবং শ্রীপুর, কুলাউড়া ও মৌলভীবাজার সীমান্তের খাসিয়া পাহাড়ে খাসি বা খাসিয়ারাও জুম চাষ করতেন। কিন্তু প্রায় একশ বছর আগে বৃটিশ আমলে বন বিভাগ গারো পাহাড় এবং মধুপুর-গাজীপুর ভাওয়াল গড় এলাকার প্রাকৃতিক বনাঞ্চলকে সংরক্ষিত বনাঞ্চল (রিজার্ভ ফরেস্ট) হিসেবে ঘোষণা করে। একই সঙ্গে তারা বন ও পরিবেশ সংরক্ষণের নামে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে জুম চাষ ও শিকার।



এ কারণে গারো পাহাড়ে জুম চাষ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। খাসিয়া পাহাড়েও সাধারণ জুম চাষ অনেক আগেই বিলুপ্ত। তবে নানা প্রতিকূলতার ভেতরেও খাসিয়ারা পানজুম চাষ করছেন।



এদিকে ১৯৬২ সালে বন বিভাগ রাঙামাটিতে সদর দফতর করে কৃষি প্রধান অঞ্চল পার্বত্য চট্টগ্রামে 'জুম নিয়ন্ত্রন প্রকল্প' চালু করে। এর উদ্দেশ্য ছিলো, জুমিয়াদের জুম চাষে নিরুৎসাহিত করে সমতলের জমিতে বনজ ও ফলজ চাষে তাদের উৎসাহিত করা। এক দশক আগেও বন বিভাগের এই প্রকল্প খাতে সরকারি অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হতো। কিন্তু বাস্তবতার কারণেই এই প্রকল্প কখনোই সফল হয়নি। এখন এই প্রকল্পখাতে সরকারি অর্থ বরাদ্দও নেই।



*

..

জুম চাষের ইতিহাস কয়েক হাজার বছরের পুরনো। পার্বত্য চট্টগ্রাম, গারো ও খাসিয়া পাহাড়ের বাইরে ভারতের অরুণাচল, আসাম, মেঘালয়, মনিপুর, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড ও ত্রিপুরা--'সেভেন সিস্টার্স' খ্যাত এই সাতটি রাজ্যে জুম চাষ ব্যাপকভাবে প্রচলিত। এছাড়া চীন, নেপাল, মায়ানমার, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ডসহ বিভিন্ন মঙ্গোলিয় জনগোষ্ঠির পাহাড়ি অঞ্চলে জুম চাষের প্রাচীন ঐতিহ্য রয়েছে।



পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়িদের নিজস্ব শাসনরীতি ও ঐতিহ্য অনুযায়ী কার্বারি (গ্রাম প্রধান) ও হেডম্যান (মৌজা প্রধান) নির্ধারণ করেন কোন পাহাড়ে কোন কোন জুমিয়া পরিবার কখন জুম চাষ করবেন। এ কারণে এ চাষাবাদ নিয়ে বিরোধ হয় না।



পাহাড়ের এই চাষ পদ্ধতি বেশ কষ্টসাধ্য। জুম চাষে একটি পরিবারের পাহাড়ি নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোর সকলেই অংশ নেন। আবার কোনো একটি বড় পাহাড়ে কয়েকটি গ্রামের জুমিয়ারা ঐক্যবদ্ধভাবে জুম চাষ করে থাকেন।



চাষের মৌসুমে প্রথমে নির্বাচিত পাহাড়টির জঙ্গল ও আগাছা বিশেষ কৌশলে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। কৌশলে আগুন ধরানো হয় বলে বনাঞ্চলে এই আগুন যেমন ছড়িয়ে পড়ে না, তেমনি টিকে থাকার স্বার্থেই পাহাড়িরা জুম চাষ করতে গিয়ে বন ও চাষ এলাকার কোনো বড় বা দামি গাছের ক্ষতি করেন না।



বৃষ্টির পর নির্বাচিত জুমের জমিতে পুড়ে যাওয়া জঙ্গল ও আগাছার ছাই সারের কাজ করে। এর পর বিশেষ ধরণের ছোট দা'এর মাধ্যমে ছোট্ট ছোট্ট গর্ত করে একই সঙ্গে কয়েক ধরণের ফসল বোনা হয়। ধান, গম, ভূট্টা, আলু, কলা, তরমুজসহ জুমের জমিতে প্রায় সব ধরণের খাদ্য শষ্য ও শাক-সব্জি চাষ করা হয়। জুমের ফসলের বীজ সমতলের চেয়ে ভিন্ন। এসব ফসল উৎপাদনে কোনো ধরণের সার ও কীটনাশক ব্যবহার করা হয়না। আর জুমের শষ্য, ফল-মূল ও তরি-তরকারির আকার-আকৃতি সমতলের উৎপাদিত কৃষিজ পণ্যের চেয়ে ভিন্ন; এগুলো খেতে খুবই সুস্বাদু।



জুমের ফসল পরিচর্যার জন্য চাষাবাদের পাহাড়ে জুমিয়ারা গড়ে তোলেন অস্থায়ী মাচাং ঘর (চাকমা ভাষায়, মোনঘর)। এই মনঘরে চাষাবাদের মৌসুমে জুমিয়ারা একই সঙ্গে যেমন ফসলের দেখভাল করেন, তেমনি বুনো শুকর বা অন্য জীব-জন্তু ও পাখ-পাখালি যেনো ফসলের ক্ষতি করতে না পারে, সেদিকেও তারা লক্ষ্য রাখেন। জুমের জমি ঘিরে এ জন্য 'কাবুক'সহ নানা ধরণের ফাঁদ পাতা হয়। তঞ্চঙ্গা জুমিয়াদের আবার এসব ফাঁদ পাতার সুখ্যাতি রয়েছে।



জুম চাষ নিয়ে পাহাড়ি লোকগাঁথা, গান ও ছড়া গান, প্রবাদ-প্রবচনও খুব সমৃদ্ধ। মোনঘর নিয়েও চাকমাদের নানা স্মৃতিকথা জড়িয়ে আছে জীবন-যাপনে।...



*

..

পাঁচ-ছয় দশক আগেও একবার কোনো পাহাড়ে জুম চাষ করার পর অন্তত ১৫-২০ বছর সেখানে আর জুম করা হতো না। সেখানে এই দীর্ঘ সময়ে প্রাকৃতিক বনাঞ্চল গড়ে ওঠার সুযোগ দেয়া হতো; রক্ষা পেতো পাহাড়ি জমির উর্বরতা।



কিন্তু ৬০ দশকে কাপ্তাই বাঁধের কারণে বিপুল সংখ্যক পাহাড় পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় সংকুচিত হয় জুমের জমি। আর ৮০ র দশক থেকে এখনো পাহাড়ে সমতল অঞ্চল থেকে অপরিকল্পিতভাবে বাঙালিদের অভিবাসন গড়ে উঠছে।



এছাড়া পাহাড়ে ছয়টি সেনা নিবাস ও প্রায় সাড়ে চারশ অস্থায়ী সেনা ছাউনি এবং বিডিআর, ড়্যাব, পুলিশ, আনসার, ভিডিপি, বন বিভাগসহ নিরাপত্তা বাহিনীর অসংখ্য স্থায়ী এবং অস্থায়ী ছাউনির কারণেও বিপুল সংখ্যক পাহাড় ও বনাঞ্চল অধিগ্রহণ করা হয়েছে।



এমনিভাবে দিন দিন জনসংখ্যার চাপে ও বন বিভাগের নানা নিয়ম-কানুনের ফলে সংকুচিত হচ্ছে জুমের জমি। তাই জুমিয়ারা অনেক জায়গাতেই এখন বাধ্য হয়ে মাত্র পাঁচ-ছয় বছরের ব্যবধানে একই পাহাড়ে আবারো জুম চাষ করছে। এতে প্রাকৃতিক বনাঞ্চলের স্বাভাবিক বৃদ্ধি কমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কমে যাচ্ছে পাহাড়ের উর্বরতাও। তাই বিচ্ছিন্নভাবে অনেক জুমিয়া এখন চাষের জমিতে ধুপ সার বা ইউরিয়া ব্যবহার করছেন; যা আগে কখনোই দেখা যায়নি।



বলা ভালো, জুম চাষীরা হচ্ছেন সকলেই প্রান্তিক চাষী ও সাধারণতভাবে হত দরিদ্র। তাই জুম চাষ করা ছাড়া অন্য কোনোভাবেই তাদের টিকে থাকার উপায় নেই।



অন্যদিকে বহুবছর ধরে পাহাড়ে কল-কারখানা গড়ে না ওঠায় সৃষ্টি হয়নি বিকল্প আয়ের পথ।



*



আগেই বলা হয়েছে, বহিরাগতদের অব্যহত জনসংখ্যার চাপ, জুমের জমি সংকুচিত ও পাহাড়ের উর্বরতা নষ্ট হওয়া, বিকল্প আয়ের অভাব, চার দশক ধরে জুম নিয়ন্ত্রনের নামে বন বিভাগের মিথ্যে মামলাসহ নানা হয়রানী --- এসব কারণে অর্থনৈতিকভাবে মার খেতে খেতে প্রান্তিক চাষী জুমিয়াদের জীবন এখন বড়ই বিপন্ন।



রাঙামাটির বিশিষ্ট পরিবেশবিদ, পার্বত্য চট্টগ্রাম বন ও পরিবেশ সংরক্ষণ কমিটির নেতা গৌতম দেওয়ান এ বিষয়ে এই লেখককে বলেন, জুম নিয়ে জনমনে তো বটেই, এমন কি সরকারি মহলে রয়েছে নানা ভ্রান্ত ধারণা। এরমধ্যে জুমের আগুনে পাহাড়ের বনজ ও প্রানীজ সম্পদ ধ্বংস, জুমের কারণে পাহাড়ের ভূমি ক্ষয় বৃদ্ধি, জুম একটি পরিবেশ বিরুদ্ধ অবৈজ্ঞানিক চাষ পদ্ধতি --- ইত্যাদি প্রধান।



তিনি বলেন, কিন্তু গবেষণায় দেখা গেছে, প্রকৃতির সন্তান জুমিয়ারা নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থেই জুমের আগুনে কখনো আগাছা বাদে কোনো বনজ বা প্রাণীজ সম্পদ নষ্ট করে না। এ ছাড়া জুম চাষে লাঙ্গল বা কোদাল ব্যবহৃত হয় না। জুমিয়ারা পাহাড়ে একটি ছোট্ট গর্ত খুঁড়ে একই গর্তে নানা রকম বীজ এক সঙ্গে বপন করেন বলে ভূমি ক্ষয় হওয়ারও প্রশ্ন আসে না।



গৌতম দেওয়ান বলেন, বরং এখন পাহাড়ে অপরিকল্পিত নির্মাণ ও পাহাড় কাটার ফলে ভূমি য় তথা পাহাড় ধ্বসের হার অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশী। কিন্তু জনসংখ্যার চাপে জুমের জমি কমতে থাকায় অন্তত পাহাড়গুলোকে ১৫ -- ২০ বছর অনাবাদী রাখা হচ্ছে না বলে প্রাকৃতিক বনের সংখ্যা হৃাস পাচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে চাষযোগ্য সমতলভূমির সংখ্যা খুবই কম বলে পাহাড়ে জুম চাষের বিকল্প এখনো গড়ে ওঠেনি।



পার্বত্য আঞ্চলিক পরিষদ চেয়ারম্যান ও জনসংহতি সমিতির সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় (সন্তু) লারমা বলেন, ৬০ দশকে কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণ করে প্রথম আঘাত হানা হয় বনাঞ্চলের ওপর। এই বাঁধের কারণে প্রায় ৫৪ হাজার একর জমি পানিতে তলিয়ে যায় বলে চাষের জমিও হয়ে পড়ে সংকুচিত। বাংলাদেশ আমলে পাহাড়ে জনসংখ্যা বেড়েই চলেছে।



তিনি বলেন, এছাড়া শান্তিচুক্তির (১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়) যথাযথ বাস্তবায়ন হয়নি বলে পাহাড়ে এখনো হয়নি ব্যাপক ও বড় ধরণের অর্থনৈতিক উন্নয়ন। আড়াই দশকের অশান্ত পাহাড়ে কৃষির বিকল্প কোনো আয়ের ব্যবস্থাও গড়ে ওঠেনি। তাই ভূমিহীন দরিদ্র মানুষ জীবন বাঁচাতে বাধ্য হয়ে জুম চাষ করছে।



সাবেক গেরিলা নেতা সন্তু লারমা বলেন, আসলে যে ভাবে পাহাড়ে দিন দিন জনসংখ্যা বাড়ছে, ভবিষ্যতে এখানে হয়তো আর জুম চাষ সম্ভব হবে না। প্রায় সাত লাখ ভূমিহীন এসব জুম চাষীদের এখনই পুনর্বাসনের জন্য সরকারি উদ্যোগ প্রয়োজন। এ জন্য প্রাথমিকভাবে তাদের কিছু অর্থনৈতিক সহায়তা দিয়ে এবং হর্টিকালচার, ফিসারিজ, কি ছোট ছোট প্রকল্প খাতে সুদমুক্ত ঋণ দিয়ে পুনর্বাসন করা জরুরি। শান্তিচুক্তি অনুযায়ী জমির বন্দোবস্তি দিতে হবে এই সব বিপন্ন জুম চাষীদের।



বান্দরবানের পরিবেশ কর্মি জুমলিয়ান আমলাইয়ের রয়েছে জুমচাষের নিজস্ব অভিজ্ঞতা। বম জনজাতির এই নেতা বলেন, পাহাড়ি এলাকায় জুম চাষের এই বিজ্ঞান সম্মত চাষাবাদ নানা দেশেই প্রচলিত। এসব দেশের তুলনায় আমাদের দেশের পাহাড়গুলো অনেক উর্বর। আমাদের জুম চাষীরা শত শত বছর ধরে শুধুমাত্র প্রকৃতির ওপর নির্ভর করে ফলিয়ে আসছেন পুষ্টিকর ও সুস্বাদু ফসল, সাক-সব্জি, ফল-মূল। নিতান্ত নিরুপায় হয়ে এখন তারা জুমের জমিতে ব্যবহার করছেন রাসায়নিক সার।



---

ছবি: জুম চাষ ও মোনঘর, গড়ে উঠেছে কলাবাগান, রাঙামাটি, লেখক।

---

তথ্যসূত্র: নিজস্ব সরেজমিন অনুসন্ধান, জুমলিয়ান আমলাই, বান্দরবান এবং সত্রং চাকমা, রাঙামাটি।।



মন্তব্য ৫ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (৫) মন্তব্য লিখুন

১| ২৫ শে মে, ২০০৯ বিকাল ৩:১৮

বিপ্লব রহমান বলেছেন: কোনো কারণে ছবিটি আসছে না! :(

২| ২৫ শে মে, ২০০৯ বিকাল ৩:২১

জেনন বলেছেন: ধন্যবাদ লেখাটির জন্য।

২৫ শে মে, ২০০৯ বিকাল ৩:৪৪

বিপ্লব রহমান বলেছেন: :)

৩| ২৫ শে মে, ২০০৯ বিকাল ৪:০৫

মাহবুব রনী বলেছেন: বিপ্লব ভাই কেমন আছেন? লেখাটির জন্য ধন্যবাদ।

২৫ শে মে, ২০০৯ বিকাল ৪:১২

বিপ্লব রহমান বলেছেন: ভালো আছি বস। একদিন আমাদের অফিসে বেড়াতে চলে আসুন প্লিজ। আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ। =p~

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.