![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
রাতের খাবার নিয়ে বসা হয়েছে। আমি আমার ঘরে। বারান্দায় রাসেল। লিটনের ঘরে সুমন ও লিটন। মেসের খাবার নিয়ে আমাদের সমস্যা আছে বলে আমরা সকলে মিলে একটা বাসা ভাড়া নিয়েছি। আমরা মানে স্কুলের সহপাঠীরা একসাথে কলেজে পড়েছি ও একসাথে অনার্স মাস্টার্স করার জন্য একসাথে রাজশাহী কলেজে ভর্তি হয়েছি। একটা বাসা ভাড়া করে একত্রে থাকি। এলাকার আর এক বন্ধু মাসুম বাবার বদলির জন্য রাজশাহীতে আছে। সেও প্রায় সারাদিন আমাদের মেসে পড়ে থাকে।
পরের সপ্তাহে অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ফাইনাল পরিক্ষা বলে সকলের টেবিলেই বই পত্র খুলে রাখা। সকলেই মোটামুটি পড়াশুনায় মন দিয়েছি। সারাবছর না পড়লে যা হয় আর কি।
যাই হোক, আমাদের খাবারের মাঝখানে মাসুম এসেছে। এত রাতে সাধারণত সে আসে না। আমরা ভাবলাম ওর বাবা-মায়ের কোন কিছু হল নাকি। এটা ১৯৯৫ সালের দিকের ঘটনা আর তখন মোবাইল ফোন ছিল না।
সে সাইকেল স্ট্যান্ড করে রেখে বারান্দায় বসা রাসেলকে বলল “কি রে খাওয়া শেষ হয়নি?” রাসেল উত্তর দেবার প্রয়োজনবোধ করল না।
লিটনের ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলল “দেখ আকাশে কত সুন্দর চাঁদ উঠেছে।“
আমি আমার ঘর থেকে চেঁচিয়ে বললাম “শালা পেটে জিনিষ পড়েছে নাকি, মুখ থেকে কাব্য বের হচ্ছে?”
লিটনের ঘর পার হয়ে আমার ঘরে ঢুকে বলল “দোস্ত কাল দোলপূর্ণিমা, চল লালনের আখড়ায় যাই।“
আমি বললাম “ক্ষুধা লাগলে ভাত খেয়ে বিদাই হ; সামনে আমার পরিক্ষা।“
মাসুম বলে “আরে বাবা তোর কেন আমারও তো পরিক্ষা; বলতে গেলে আমাদের সকলেরই পরিক্ষা। শোন আজ রাতে যাব কাল রাতে ফিরে আসব। মাত্র একটা দিনের ব্যাপার।“
আমি হাত নেড়ে বিদাই হতে বলে খাবারে মনোযোগ দিলাম।
রাসেলের খাওয়া শেষ। সে হাত মুছে পানি খেয়ে আমার রুমে এসে মাসুমকে বলল “চল দোস্ত, আমি রাজি। রেডি হয়ে রওনা দেই।“
সুমন বলে উঠল “তোরা গেলে দ্রুত বিদাই হ। এখানে হাউকাউ করিস না।“
লিটন বলল “ঠিক। তোরা ফোট এখান থেকে। সামনে পরিক্ষা।“
আমাদের সকলের খাওয়া ইতিমধ্যে শেষ হয়ে গেছে। রাসেল ওর রুমে চলে গেছে। মাসুম আমার রুমে বসে সিগারেট জ্বালিয়েছে।
রাসেল ফিরে আসলো। সে রেডি। সে বলল “চল, সময় গেলে সাধন হবে না।“
কথাটা আমার মাথায় লাগল। মনে হল ঠিকই হয়ত। কোনদিন প্ল্যান করেও হয়ত সাইজির আখড়ায় যেতে পারব না। বললাম “যাহ্ শালা, যা হয় হবে আমিও যাব। একদিন গ্যাপ গেলে এমন কিছু হবে না।“
লিটন ও সুমন বলল “আমরা তাহলে কি মেস পাহারা দেব? আমারাও যাব।“
ঘড়িতে তখন রাত ১১টা বাজে।
সকলে রেডি হয়ে নিলাম। এখন বিষয় হল টাকা তো দরকার। সকলের পকেট ঘেঁটে সব টাকা একত্র করে পাওয়া গেল মোট ২৬০ টাকা। মাসের প্রায় শেষের দিকে এরচেয়ে বেশি টাকা থাকবার কথাও নয়।
কেমন করে যাব এসব নিয়ে চিন্তা করে সময় নষ্ট করলাম না। সকলে ঠিক করলাম পথে নেমে যাই আগে তারপর দেখা যাবে। এরমধ্যে লিটন বলল হোস্টেল থেকে তুষারকে নিয়ে নেই। তুষার আমাদের এলাকার ছেলে নয় কিন্তু আমাদের সাথেই চলাফেরা করে।
রওনা দিলাম হোস্টেলের দিকে। হোস্টেলের গেট পেরিয়ে ওর রুমে গিয়ে দেখি তাস খেলছে। ওকে বললাম দ্রুত রেডি হয়ে নিতে। সে কোন কিছু জিজ্ঞাসা করল না। করার কথাও না। আমরা সকলে একসাথে এতরাতে মানে শিওর অ্যাডভেঞ্চার আছে। দ্রুত রেডি হয়ে তুষার আমাদের সাথে যোগ দিল। ওকে সুমন বলল তোর কাছে কত টাকা আছে বিপুর কাছে জমা দে। তুষার রুমে ফিরে গিয়ে আমার টাকা নিয়ে আসল। ৫০ টাকা। আমাদের সর্বমোট টাকা হল ৩১০।
আমাদের সিদ্ধান্ত হল যতটা সম্ভব কম টাকা খরচ করার। শুধু আমাদের খাবারের জন্য আমরা টাকা খরচ করব।
জয় সাইজি বলে রওনা হলাম রেলস্টেশনের দিকে। কারন ট্রেনে গেলে টিকিট কাটার টাকাটা বেচে যাবে। সেই মোতাবেক রেলস্টেশনে হাজির হলাম। বলাবাহুল্য আমরা হেঁটে হেঁটে গেছি। এত রাতে রিক্সা পাবার উপাইও ছিল না। আর পেলেও বেশ কিছু টাকা খরচ হয়ে যাবে। কিন্তু স্টেশনে গিয়ে দেখা গেল আপাতত কুষ্টিয়া লাইনের কোন ট্রেন নেই।
ষ্টেশন থেকে বের হতে ফুটপাথে আমরা চা খেতে বসলাম। কি করা যায় সেটা নিয়ে আলোচনা চলছে। তুষার বলল আমরা বরং হাইওয়ের দিকে যাই একটা না একটা বাস বা ট্রাক পেয়ে যাব। চা খাওয়া শেষে সকলে হাঁটা শুরু করলাম। তৎকালীন বিআইটি মোড়ে গিয়ে সকলে দাঁড়ালাম। রাত প্রায় একটার কাছাকাছি। মোড় থেকে খানিকদূরে বসে থাকা টহল পুলিশের দল আমাদের লক্ষ্য করছে। আমাদের গতিবিধি খেয়াল করছে। বোঝার চেষ্টা করছে আমাদের উদ্দেশ্য কি। আমরা সকলে তাদের কাছে গেলাম। সালাম দিলাম। তারা প্রতিউত্তর দিয়ে জানতে চাইল আমরা কারা এবং এখানে কেন এসেছি। আমরা সব কিছু খুলে বললাম। তারা বলল আপনারা বাস তো এত রাতে পাবেন না ট্রাকও আপনাদের নেবে না। ডাকাতি বিষয়ক ব্যাপার থাকার কারনে আপনারা যদি ট্রাকের সামনেও দাঁড়ান আপনাদের পিষে দেবে। আমরা বললাম আপনারা বললেই নেবে। তারা বলল আপনাদের চিনি না জানি না আমরা কেন এই রিস্ক নেব।
বিফল মনোরথে আমরা মোড়ে ফিরে আসলাম। একবারও কেউ ফিরে যাবার কথা বলছে না। দেখি কি হয় টাইপ মন নিয়ে মোড়ে আমরা দাঁড়ানো ট্রাক আসছে। হাত তুলছি। কিন্তু পুলিশগুলোর কথাই ঠিক। কেউ থামছে না। পুলিসগুলো আমাদের দেখছে। হয়ত হাসছে।
একটা মাইক্রো দেখা গেল। সাদা রঙের। হাত তলা হল। জানি থামবে না। তবে হাত তুলতে তুলতে অভ্যাস হয়ে যাবার কারনে হাত তোলা। আমাদের অবাক করে দিয়ে মাইক্রো আমাদের কাছে এসে থামল। পুরো মাইক্রোতে একজন ভদ্রলোক বসে আছেন।
ভদ্রলোক আমাদের বললেন “কি হয়েছে?”
লিটন বলল “আমাদের জরুরিভিত্তিতে কুষ্টিয়া যাবার দরকার।“
ভদ্রলোক বললেন “তোমরা কি কর? কি জরুরি কাজ?”
সুমন বলল “আমরা রাজশাহী কলেজে অনার্সে পড়ি।“
আমি রাসেলকে দেখিয়ে বললাম “ওর বাবা গুরুতর অসুস্থ; অবস্থা খুব খারাপ। সেইজন্য আমাদের দ্রুত ওদের কুষ্টিয়া বাসায় যাওয়া দরকার।“
রাসেল আমার কথা শেষ হবার সাথে সাথে ফিচ ফিচ করে কাঁদতে শুরু করেছে।
ভদ্রলোক দরজা খুলে নেমে এসে বললেন “আমি তো নাটোর যাব। তোমরা নাটোর থেকে ট্রেন পাবে। সেটায় যেতে পারবে।“
সুমন বলল “আমাদের যদি নাটোর পর্যন্ত লিফট দেন তাহলেও হবে। আমরা সেখান থেকে ট্রেনে গেলেও আগে পৌছাতে পারব।“
উনি বললেন ঠিক আছে। আমাদের পিছনে বসতে বলে উনি ড্রাইভারের পাশের ছিটে বসলেন। আমরা দ্রুত গাড়িতে উঠে বসলাম। পিছনে আমি আর তুষার বসলাম। মাঝে বসল রাসেল, লিটন ও সুমন। গাড়ি রওনা দিলো নাটোরের উদ্দেশ্যে। আমরা বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না ভদ্রলোক এভাবে আমাদের বিশ্বাস করে গাড়িতে নেবেন। তাও আবার এমন মাঝরাতে রাস্তা থেকে। এখনকার সময় হলে অবশ্যই নিতেন না। মানুষের বিশ্বাসের স্তর এখন অনেক নিচে নেমে গেছে।
যাই হোক, সারারাস্তা রাসেল বিষণ্ণ হয়ে থাকল। কখনও হাল্কা কান্নাকাটিও করছে। আমরা তাকে সান্তনা দিচ্ছি। এভাবে আমরা নাটোর পৌছালাম। ভদ্রলোক আমাদের ষ্টেশনের কাছে নামিয়ে দিয়ে তারপর গেলেন। আমরা ওনাকে অনেক ধন্যবাদ দিলাম। তুষার তো পুরা কদমবুছি করে ফেলল। উনি রাসেলকে বললেন “চিন্তা করিও না। তোমার বাবার কিছুই হবে না।“
গাড়ি হুস করে চলে যাবার পরে আমরা স্বাভাবিক হলাম। এতক্ষণ শুকনা মুখ করে রাখতে রাখতে সবার মুখ ব্যাথা হয়ে গেছে।
আর রাসেল কোন কথা ছাড়াই আমার দিকে তেড়ে আসল। বলছে “তোর আর কিছু মনে হল না। তুই আমার বাবাকে হসপিটাল পাঠালি।“
মাসুম বলল “ আরে এটা না বললে আজ আমাদের সারারাত মোড়ে রাত কাটিয়ে সকালে মেসে ফিরে যেতে হত।“ ওরে ছাড় দে।
লিটন বলল “বাদ দে এসব। চল ষ্টেশনে আগে যাই। দেখি কোন ট্রেন আছে কিনা।“ সকলে বলল “ঠিক ঠিক, আগে ষ্টেশনে যাই।“
ষ্টেশন কাউন্টারে গিয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেল একটা ট্রেন আছে রাত ০৩-৩০টায়। আন্তঃনগর ট্রেন। সকলের মুখে যুদ্ধ জয়ের হাসি এলো। এখনও হাতে বেশ কিছু সময় আছে। সকলে বসে পড়লাম চায়ের স্টলে। অর্ডার দেয়া হল পাঁচ কাপ চায়ের। টিকিট কাটা হল না। কারন টিকিট কাটলে প্রায় সব টাকায় শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু আন্তঃনগর ট্রেনে টিকিট না কাটলে ঝামেলা হবে। মাসুম ও সুমন সেসব উড়িয়ে দিলো। বলল আমরা সব সত্য কথা বলব দেখবি কোন ঝামেলা হবে না।
সকলে নিশ্চিন্তে চায়ের কাপে চুমুক দিলাম।
কিন্তু বিষয়টা এত সহজ ছিল না।
আন্তঃনগর ট্রেনের কামরা। আমাদের পাঁচজনের কারও কাছেই টিকিট নেই। টিটি সাহেব কোন টিকিট না পেয়ে প্রথমে অবাক ও পরে রাগ হলেন। আন্তঃনগর ট্রেনে কেউ টিকিট না করে উঠতে পারে এটা ওনার হজম হচ্ছিল না। ছাত্র হলেও সাধারনত কয়েকটি টিকেট কাটা হয় বাকিরা সেটার অযুহাতে মাফ পায়। কিন্তু আমাদের পাঁচজনের কাছে একটাও টিকিট নেই। টিকিট না কাটলে সাধারনত পাবলিক লুকিয়ে চুরিয়ে থাকে। অনেকে টিটি দেখে বাথরুমে ঢুকে পড়ে। আমরা তা না করে গান গাচ্ছিলাম। সাঁইজীর গান। কাজেই ওনার রাগ হওয়াটাই স্বাভাবিক।
টিটি সাহেব আমাদের গন্তব্যস্থল জানতে চাইলেন। মাসুম বলল কুষ্টিয়া। রাসেলের গানের তাল তখনও কাটেনি, সে গুনগুন করে গেয়েই যাচ্ছিল। উনি জরিমানাসহ মোট টিকিটের মূল্য বললেন। লিটন কিছু বলতে যাচ্ছিল; আমি বাঁধা দিয়ে টিটি সাহেবকে সংক্ষেপে বললাম,
" লালন শাহের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে যাচ্ছি। সবাই ছাত্র, বোঝেনই তো টাকাপয়সার টানাটানি, তাই টিকিট কাটি নাই"।
সাথে একটা মোলায়েম হাসি দিলাম। টিটি সাহেব কিছু না বলে চলে গেলেন। বুঝে গেলাম, আমার কথা এবং তেলতেলে হাসিতে কাজ হয়েছে। আমি নেতা টাইপ একটা চাহনী সহযোগে বাকিদের দিকে তাকিয়ে হাল্কা হাসি দিলাম। রাসেলের গানের গলা আরও উঠল। লিটন, সুমন তাতে যোগ দিলো। রেলগাড়ির গতি আর সুরের আনন্দে ভেসে গেলাম আমরা কজন।
কুষ্টিয়া ষ্টেশনে ট্রেন যখন পৌঁছাল তখন সকাল। সকলে আড়মোড়া ভেঙ্গে ট্রেনের কামরা থেকে নামতে যাব দেখলাম ট্রেনের দরজায় চারজন পুলিশ। প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে গেটের দু'পাশে দুজন করে দাঁড়িয়ে আছেন। আমরা প্রথমে তেমন গুরুত্ব না দিয়ে নামছি আর ওমনি ওনারা আমাদের হাত ধরে আলাদা করে ফেললেন। আমরা কিছু বোঝার আগেই আমাদের হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে থাকলেন। আমাদের নিয়ে আসলেন ষ্টেশন মাষ্টারের রুমে। এবার সেই টিটি সাহেবকে দেখলাম ষ্টেশন মাষ্টারের রুমে। আমাদের বুঝতে বাকি রইলো না কেন আমাদের এখানে নিয়ে আসা হয়েছে। আমাদের রেখে টিটি সাহেব ও চারজন পুলিশ চলে গেলেন।
ষ্টেশন মাষ্টার আামাদের সাফ জানিয়ে দিলেন জরিমানাসহ টিকিটের দাম দিলেই শুধুমাত্র আমাদের উনি ছেড়ে দিবেন অন্যথায় আমাদের কোর্টে চালান করে দেবেন। আমাদের জরিমানাসহ সর্বমোট মূল্য এসেছে ১,২০০ টাকা। আমাদের কাছে আছে ৩০০ টাকা। আমাদের পাঁচজনের সকালের নাস্তা ও দুপুরের খাবারের জন্য এটা বরাদ্দ। সকলে কিছুটা চিন্তিত হয়ে পড়লাম কারন আগামী পরশু আমাদের সকলেরই পরীক্ষা। মিস করলে এক বছর লসে পড়ে যাব। কোর্ট-হাজতের চক্করে পড়লে কবে ছাড়া পাব কে জানে।
একজন একজন করে ষ্টেশন মাষ্টারের কাছে অনুরোধ করতে লাগলাম। কথা বলে ওনাকে কনভিন্স করার চেষ্টা করছি। আমাদের অবস্থাটা বোঝাতে চেষ্টা করছি। আমাদের অবস্থা ও অবস্থান বুঝে উনি মোট মূল্য থেকে পঞ্চাশ টাকা কখনও একশ টাকা কমাচ্ছেন। তুষারের আকুতি শুনে একবারে দুইশ টাকা কমিয়ে ফেললেন। লিটন, মাসুম হাত পা নেড়ে নিজেদের অসহায়ত্ব তুলে ধরছে। তাতে পঞ্চাশের বেশি কমছে না। আমিও আঁকুপাঁকু করে বলছি আমাদের কাছে একদমই টাকা নেই। তাতে পঁচিশ টাকা কমলো। এভাবে মূল্য যখন পাঁচশ টাকায় এসেছ ঠিক তখন ঝড়ের বেগে রুমে রাসেল প্রবেশ করল। উত্তেজনায় আমরা এতক্ষণ খেয়ালই করি নাই যে রাসেল আমাদের সাথে নাই।
রাসেল রুমে ঢুকেই আমাদের লম্বা সালাম দিল এবং কুশলাদি জিজ্ঞাসা করল এবং সেটা আপনি সম্বোধন করে। আমরা কিছুটা বিভ্রান্ত হয়ে গেলাম। রাসেল আমার দিকে ইশারায় চোখ টিপে দিল। আমি বুঝে গেলাম আমাদের এখন রাসেলকে ফলো করতে হবে। রাসেল আমার কাছে এসে বলল,
"আপনাদের কি সমস্যা? আপনারা কোথায় পড়াশুনা করেন? ইত্যাদি"। আমি পুরো ঘটনা তাকে খুলে বললাম। ততক্ষনে বাকিরাও বুঝে গেছে যে এখন জাষ্ট চুপ থাকতে হবে আর নাটকের দর্শক হতে হবে।
রাসেল ষ্টেশন মাষ্টারের দিকে ঘুরে বলল
--- "মাষ্টার সাহেব এই সামান্য কারণে আপনি এনাদের আটকে রেখেছেন!" এবার ষ্টেশন মাস্টার সরু চোখ করে রাসেলের দিকে তাকিয়ে বলল,
--- "আপনি কে?"।
--- "আমার বাসা আপনার ষ্টেশনের পাশেই। আমি ওনাদের কলেজের প্রাক্তন ছাত্র। আর কুষ্টিয়া ( ----- ) দলের সহ-সভাপতি।"
ষ্টেশন মাষ্টারের মুখ এবার তেলতেলে হয়ে গেল।
--- "আপনি দাঁড়িয়ে কেন বসেন।"
আমাদেরও ততক্ষণে বসতে বলছেন। রাসেল বলল,
--- "না না তার দরকার নেই। ওদের যেতে দিন"। ষ্টেশন মাষ্টার বললেন
---"ঠিক আছে, ঠিক আছে, অসুবিধা নেই।"
রাসেল আমাদের দিকে ফিরে বলল,
--- "আপনারা নাস্তা করেছেন?"
আমরা সমস্বরে বললাম,
---"না ভাই"
--- "চলেন নাস্তা করি"
ষ্টেশন মাষ্টার বললেন,
--- "আপনারা বসেন, আমি এখানে নাস্তা আনাচ্ছি।"
---"আপনি নাস্তা করেছেন?" ষ্টেশন মাষ্টারকে আমি জিজ্ঞাসা করলাম। উত্তরে উনি না বললেন।
--- "তাহলে চলেন আমরা একসাথে নাস্তা করি" ষ্টেশন মাষ্টারকে বললাম।
ষ্টেশন মাষ্টার পিয়নকে রুম লক করতে বললেন,
---"চলেন অনেকদিন হোটেলে নাস্তা করি নাই।" আমরা ছয়জন রুম থেকে বেরিয়ে হোটেলের দিকে হাঁটতে শুরু করলাম...
নাস্তা করে ষ্টেশন মাস্টারের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমরা আবার রাস্তায় নামলাম। উদ্দেশ্য ছেউড়িয়া। ইতিমধ্যে নাস্তা বাবদ ৭০ টাকা খরচ হয়ে গেছে। হাতে আছে ২৩০ টাকা। এই টাকায় পাঁচজনের দুপুরের খাবার, রাতের খাবার আবার রাজশাহী ফিরে যাওয়া। দই রিক্সা নিয়ে আমরা বাস ধরার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। রাস্তায় বাস মিলল। সে বাস তো নয় মুড়ির টিন। গাদাগাদি করে লোকজন দাঁড়িয়ে আছে। আমরাও সেই গাদাগাদিতে সামিল হলাম। মাসুম আর তুষারকে বললাম তোরা ছাদে চলে যা। আর ভাড়া চাইলে বলবি নিচে আমরা ভাড়া দিব। ওরা ছাদে চলে গেল। আমি, লিটন ও রাসেল বাসের ভিতরে উঠলাম। লোকজনের চাপে দিশেহারা অবস্থা। বাস চলতে শুরু করেছে। রিক্সা ভাড়া দিয়ে হাতে আর ২২০ টাকা আছে। যেহেতু অ্যাকাউন্টস আমি পরিচালনা করছি তাই টেনশনটা আমার।
যাই হোক কিছু পরে কন্ট্রাক্টার আসল, বলল “ভাড়া”।
আমি বললাম “উপরে লোক আছে তারা দেবে।“
কন্ট্রাক্টার নিচের ভাড়া কালেন্ট করে উপরে চলে গেছে। যথারীতি ওরা বলেছে নিচের ওরা ভাড়া দেবে। এভাবে তাঁতের মাকুর মত কন্ট্রাক্টার চলছে। ইতিমধ্যে ছেউড়িয়া এসে পড়েছে। কন্ট্রাক্টার ছাদে। আমরা দ্রুত বাস থেকে তিনজন নেমে গেলাম। কন্ট্রাক্টার ওদের সাথে তৃতীয়বারের মত কথা বলে ফুঁসতে ফুঁসতে নিচে নেমে এসেছ। ততক্ষনে ছাদের দুজন দ্রুত নেমে এসে আমাদের সাথে যোগ দিয়েছে। আমরা সাঁইজীর মাজারের দিকে হাঁটা শুরু করলাম।
মাজারে আমাদের প্রথম আসা। ভক্ত-সাধুতে পুরা ভরপুর অবস্থা। সাধুরা কেউ একাই, কেউ ভক্ত নিয়ে বসে সাঁইজীর গান গাচ্ছে। পুলিশের বেশ কিছু সদস্য ছোট ছোট গ্রুপে বিভক্ত হয়ে টহল দিচ্ছে। পুরা এলাকা গাঁজার ধোঁয়ায় আর গন্ধে একাকার হয়ে আছে।
আমরা গিয়ে বসলাম হুমায়ুন শাহ্ সাধুর আখড়ায়। একতারা, দোতারা, খোল, খঞ্জনি, বেহালা বাজছে। সাথে ভক্তরা গান গাইছে। “ও প্রেম যে করে সে জানে, আমার মনের মানুষেরও সনে; আমার মনের মানুষেরও সনে।“ মহিষের শিং এ হুমায়ুন শাহের জন্য কল্কি সাজানো হচ্ছে। উনি কালো আলখেল্লা পড়ে আছে। গায়ের রং খুব ফর্সা। গানের মাঝে উনি গানের বিষয়ে বয়ান করছেন। আবার গান চলছে। ভক্তরা কেউ কেউ নাচছে। এবার গান হচ্ছে... “বড় আশায় বাঁধা এ ঘর, পড়ে রবে কোথায় কখন ঠিক নাই তারি। তোমার পিছে পিছে ঘুরছে সমন, কোনদিন হাতে দেবে দড়ি। দেখনা মন ঝাঁকমারি এই দুনিয়াদারী।“ আসলেই তাই। ভক্তরা কাঁদছে। মনটা আমাদেরও কাঁদছে।
আসর থেকে উঠে মাজারে ঘুরতে লাগলাম। তাবু করে কোন কোন সাধু বসে আছেন। হিরু শাহ্ সাথে দেখা হল। বিদেশীদের দেখলাম ভিডিও করছেন। সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন। আমরা এই আসর থেকে ঐ আসর ঘুরে ঘুরে দেখছি, শুনছি ... “অনাসে দেখতে পাবি কোনখানে সাঁইর বারামখানা, আপন ঘরের খবর নে না।“
দুপুর হয়ে গেছে সবারই ক্ষুধা লেগেছে। আমি বললাম আকাউন্টসের অবস্থা ভাল না সকলে মিলে হালকা পাতলা খাব। খাবার জন্য বের হব এমন সময় দেখি মাইকে সবাইকে লাইন করে বসার জন্য বলা হচ্ছে। সেচ্ছাসেবকরা লাইন ঠিক করে সকলকে ঠিকমত বসায় সাহায্য করছে। আমরা বুঝলাম না কেন লাইনে বসানো হচ্ছে। এক স্বেচ্ছাসেবককে জিজ্ঞাসা করলে সে বলল খানা দেয়া হবে। আমরা তো মহাখুশি। পাঁচজন এক লাইনের সাথে পাশাপাশি বসে পড়লাম। আমাদের সামনে কলাপাতা চলে আসল। কিছু পরে দেয়া হল খিচুড়ি আর সাথে ইলিশ মাছের ভাজা এক টুকরা। আমি যখন এই লেখা লিখছি সেই স্বাদের অনুভুতি পাচ্ছি। অসাধারন ছিল সেই খাবার। আমরা দ্বিতীয়বার খিচুড়ি নিলাম। পেটপুরে খেয়ে পাশের টিউবওয়েলে গিয়ে হাত ধুয়ে পানি খেয়ে নিলাম। বিকেল পর্যন্ত চলল আমাদের মাজারে ঘোরাফেরা।
এখন ফিরতে হবে। দুই রিক্সা নিয়ে আবার গেলাম স্টেশনে। কিছু পরেই একটা ট্রেন পেলাম। আমার ঠিক মনে পড়ছে না সেই ট্রেনেই নাকি সেই ট্রেন দিয়ে রাজশাহীর কানেক্টিং ট্রেনে ফিরেছিলাম। ট্রেনটা ছিল লোকাল ট্রেন। আমরা সকলেই সিট পেয়েছিলাম। রাজশাহী ষ্টেশন এসে মনে হল সাম্থিং ইস রং। আমরা ট্রেন থেকে নামলাম। ষ্টেশন বেশ ফাঁকা ফাঁকা। আমরা বুঝতে পারছি কিছু একটা ব্যাপার আছে কিন্তু ব্যাপারটা কি সেটা ধরতে পারছি না। বাহির হবার গেটের কাছে বেশ কিছু পুলিস আর চেয়ার টেবিল পাতা। চেয়ার টেবিলের সামনে বেশ কিছু মানুষ আর চেয়ারে বসা মানুষগুলো কি যেন লিখছে।
লিটন বলে উঠল “খাইছে রে, মোবাইল কোর্ট বসেছে।“
আমরা থেমে গেলাম।
সুমন বলল “ভুলেও সামনে যাওয়া যাবে না। চল ট্রেনে ফিরে যাই। সামনের ষ্টেশনে নেমে যাব।“
আমি বললাম “ঠিক বলেছিস। দ্রুত ব্যাক কর”। না হলে পুলিশগুলো আমাদের খেয়াল করবে।“
আমরা দ্রুত ফিরে আবার ট্রেনে চড়লাম। ট্রেন ছেড়ে দিল। স্টেশন পার হবার সাথে সাথে মাসুম বলল এখন নেমে যাই। ট্রেনের স্পীড বেশি নাই। আমরা রিস্ক নিয়ে পাঁচজন ট্রেন থেকে প্রায় ঝাঁপ দিয়ে নামলাম। রেললাইন পার হয়ে রাস্তায় আসলাম। রাত বাজে দশটার মত। পকেটের টাকা বের করে গুনে দেখি ১৯০ টাকা রয়ে গেছে। বললাম চল রাতের খাবার হোটেলে খেয়ে একবারে মেসে ফিরে যাই। জান ভরে পাঁচজন খেলাম। বিল এসেছে ১৪০ টাকা। রাসেল হাঁকল কোল্ড ড্রিংক্স লে আও। কোল্ড ড্রিংক্স খেয়ে হোটেল থেকে বের হলাম। বাকি টাকায় পান ও সিগারেট কেনা হল।
সিগারেট ধরিয়ে পাঁচজন একসাথে মেসের উদ্দেশ্যে হাঁটা শুরু করলাম। রাসেল গান ধরল “ সেথা এক পড়শি বসত করে, একঘর পড়শি বসত করে, আমি একদিনও না আ আ আ দেখিলাম তারে।“ গতকাল রাত সাড়ে এগারোটায় আমরা মেস থেকে বের হয়েছিলাম আজ ঠিক রাত সাড়ে এগারোটায় মেসে ফিরলাম।
২৩ শে জুন, ২০১৮ দুপুর ২:৩২
পয়েন্ট-ব্লাংক বলেছেন: ধন্যবাদ রানা ভাই।
এসব কম বয়সের পাগলামি।
২| ২৩ শে জুন, ২০১৮ বিকাল ৫:০৬
রাজীব নুর বলেছেন: আপনার পোষ্ট পড়ে অতীতের অনেক পাগলামীর কথা মনে পড়ে গেল।
২৩ শে জুন, ২০১৮ রাত ৮:৩৫
পয়েন্ট-ব্লাংক বলেছেন: আমারও হঠাৎ অতীতের পাগলামীটা মনে পড়ল নুর ভাই।
বয়েস হবার লক্ষন।
৩| ২৩ শে জুন, ২০১৮ বিকাল ৫:৪৯
মোঃ ফখরুল ইসলাম ফখরুল বলেছেন: সুন্দর
২৩ শে জুন, ২০১৮ রাত ৮:৩৬
পয়েন্ট-ব্লাংক বলেছেন: ধন্যবাদ ফখরুল ভাই।
৪| ২৫ শে জুন, ২০১৮ বিকাল ৪:০৮
আঁধার রাত বলেছেন: ১৯৯৫ সালে সরকারী প্রথম শ্রেনীর কর্মকর্তার বেতন ছিল ১৬০৫ টাকা। পাঁচজন খেয়ে ১৪০ টাকা বিল দিয়েছিলেন। কি খেয়ে ছিলেন মাছ মাংশ দুধ ডিম কলা আমিষ নিরামিষ মিনারেল স্নেহ শর্করা সব?
©somewhere in net ltd.
১|
২৩ শে জুন, ২০১৮ দুপুর ২:২৫
মাফুজ রানা বলেছেন: প্ল্যান তো একটা করতে হচ্ছে দেখছি!!