![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
সুখের আশায় ছুটতে ছুটতে মানুষ অসুখে পড়ছে। আর আমি তখন সত্যের সন্ধানে ছুটছি।
হুইল চেয়ারে বসা লোকটা বেঁচে আছে কিনা; বেশ ভালোভাবেই পালস পরীক্ষা করে দেখছে রিফাত। লোকটা ওর জন্মদাতা পিতা। না বেঁচে নেই। মরে শক্ত হয়ে বসে আছে হুইল চেয়ারে। চশমার ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে চোখ দুটি হালকা খোলা। মনে হয় একদিন আগেই মারা গেছে। কিন্তু সে টের পায়নি। মা বাবা মরে গেলে সন্তানরা মুলত হাউমাউ করে কান্না শুরু করে দেয়। কিন্তু রিফাত তা না করে সোজা বাথরুমে গিয়ে ব্রাশ করলো, তারপর দাঁড়ি শেভ করা হলে গোসল সেরে জামাকাপড় পরে অফিসে যাওয়ার জন্য রেডি হওয়ার পর ফ্রীজ হতে খাবার বের করে খেয়ে ফ্ল্যাটে দরজায় তালা মেরে অফিসে জন্য বের হলো। আজ তাঁর অফিসে খুব জরুরী মিটিং আছে। মিটিং শেষে অফিসে পার্টি হবে। আসতে আসতে বেশ রাত হতে পারে। তাই যাওয়ার সময় দারোয়ানকে বলে গেলো মামা আমার আজ আসতে ১ টা বাজতে পারে। ফোন দিলে গেটটা খুলে দিও।
রিফাত একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীতে বেশ ভালো পদেই জব করে। বিয়ে থা করেনি। ছোট বেলায় এতিম খানায় মানুষ এই ছেলেটি জীবন সংগ্রামে বেশ যুদ্ধ করে আজ এই পর্যায়ে এসেছে। গত বছর এই ফ্ল্যাটে ওঠে রিফাত। দুই রুমের এই ফ্ল্যাটে একাই থাকে সে। বন্ধু-বান্ধব বলতে কেউ নেই। শুধু অফিসের কলিগরাই যা। ফ্ল্যাটে ওঠার পরে ১ মাস পর গ্রাম হতে ওর চাচারা কিভাবে যেন ওর খোঁজ পায়। এতবছর কোন খোঁজ নেয়নি। হঠাত ওর জেলখাটা আসামী পঙ্গু বাবাকে হুইল চেয়ারে করে নিয়ে এসে ওর বাসায় গছিয়ে দেয়। যাতে নিজেদের ঘাড়ে লোকটার দেখাশোনার দায়িত্ব না পড়ে। প্রথমে সে রাজী না হলেও আল্লাহর দোহাই, ধর্ম কর্মের দোহাই ইত্যাদি দেখিয়ে লোকটাকে রেখে যায়। সেই থেকে গত প্রায় একটি বছর লোকটি ওদের বাসায় আছে কিন্তু কখনও কোন বিশেষ ধরনের কথা হত না।শুরুতে লোকটি অনেক চেষ্টা করেছিল কথা বলার কিন্তু রিফাত সাফ জানিয়ে দিয়েছিল “আপনি প্রয়োজন ব্যাতীত কোন কথা বলবেন না আমার সাথে। আপনার কিছু দরকার হলে আমাকে বলবেন আমি এনে দিব’’। সেদিন লোকটি বেশ কেঁদেছিল। কিন্তু রিফাতের এমন কর্কশ আচরণে লোকটি আর এগোতে সাহস পাননি। কিন্তু নিজের সন্তানকে সে লুকিয়ে লুকিয়ে সবসময় দেখত। এই যেমন রিফাত ঘুমিয়ে পড়লে তাঁর রুমে যেয়ে কিংবা খাবার খাচ্ছে তখন বিভিন্ন অজুহাতে তাঁর সামনে আসতো। কিন্তু নির্দয় রিফাতের একবারের জন্যও এই বুড়ো লোকটার প্রতি বাবা সুলভ দৃষ্টিতে দেখেনি। সারাদিন লোকটা বাসায় থাকত আর বিভিন্ন ধরনের বই পড়ত। রিফাত বাহির হতে খাবার কিনে রেখে যেত ডাইনিং টেবিলে; সেখান হতেই উনি খেয়ে নিত। রিফাত না আসা এবং ঘুমানো পর্যন্ত উনি ঘুমাতেন না। কিন্তু গত রাতে ও যখন ফ্ল্যাটে ঢুকে তখন লোকটি অন্যান্য দিনের মত উঁকি মেরে দেখেন নি। যেটা উনি প্রায় করতেন। রিফাত ভেবেছিল হয়তো বই পড়ছেন। কিন্তু ভোরে ফজরের নামাজের পর কুরআন তিলওয়াতের শব্দে রিফাতের ঘুম ভেঙ্গে যেত কিন্তু আজ লোকটি কুরআন পড়েনি। গত ১ বছরের নিয়মের নড়চড় আর রাতের খাবার যেমনটা টেবিলে রেখেছিল তেমনটা দেখেই তাঁর মনে সন্দেহ হলো এবং রুমে গিয়ে দেখলো উনি বেঁচে নেই।
বাসে করে রিফাত অফিসে যাচ্ছে। পাশের সিটে একলোক তাঁর ছোট্ট ছেলেকে নিয়ে শিশুপার্কের দিকে যাচ্ছে দেখে বুঝা গেলো। বাস হতে নামার সময় ড্রাইভারের ভুলে ছেলেটি পড়ে যাওয়ায় লোকটি বেশ হইচই বাঁধিয়ে হেলপারের গালে একটা চড় বসিয়ে দিল। ঘটনাটা দেখে বেশ অস্বস্তি বোধ করছে রিফাত। এই শীতের দিনে বেশ ঘাম জমে গেছে তাঁর কপালে। একই ঘটনা আজ প্রায় ২২ বছর আগে ঘটেছিল। সে তখন ২য় শ্রেনীর ছাত্র। সাইকেলের পিছনে বসে বাবার সাথে সে বাজারে যাচ্ছিল। রিফাতের নিজের অসাবধানতার জন্য সে সাইকেল হতে পড়ে যায়। এবং পাকা রাস্তায় পড়ে মাথাটা বেশ ফেটেছিল। পাগলপ্রায় ওর বাবা যখন ওকে দ্রুত ছুটে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল তখন ডাক্তার ওকে দেখতে অবহেলা করায় ওর বাবা ডাক্তারের গালে চড় মেরে বসেছিল। এমন স্নেহপ্রিয় বাবার প্রতি তাঁর এখন কোন ফিলিংস নেই।
২০ বছর আগের ঘটনা – ৭ মাস হয়ে গিয়েছে ওর বাবার কোন খোঁজ নেই। চাকরী নেই বলে ওর হতাশ বাবা চিটাগাং গিয়েছে চাকরীর খোঁজে। বিকালের দিকে রিফাত ঘরের ভিতর হোমওয়ার্ক করছিল। আর ওর প্রেগনেন্ট মা রান্নাঘরে রান্না করছিল। এমতাবস্থায় ওর বাবা হঠাত ঘরে ঢুকে রিফাতকে জিজ্ঞেস করে ‘তোর মা কই’? রিফাত এতদিন পর বাবাকে “বাবা” বলে লাফিয়ে জড়িয়ে ধরে। কিন্তু ওর বাবা ওকে সরিয়ে দিয়ে বেশ রাগান্বিতভাবেই জিজ্ঞেস করে ‘তোর মা কই’? রিফাত বলে “রান্নাঘরে”। ওর বাবা দ্রুত রান্নাঘরে ছুটে যায়। আর ওর মায়ের চুলের মুঠি ধরে মাটিয়ে শুইয়ে ফেলে পেটে লাথি মারতে থাকে। রিফাত বাবার এমন রুপ কখনই দেখেনি। সে ভয়ে দরজার পর্দার আড়ালে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখছিল। ততক্ষনে ওর মার চিৎকারে আশে পাশের মানুষ ছুটে এলেও ওর মার রক্তাক্ত নিথর দেহটা পড়ে থাকতে দেখে। অতঃপর সবাই ওর বাবাকে ধরে বেঁধে পুলিশে শোপর্দ করলে আদালত তাকে যাবত জীবন শাস্তি দেয়। কিন্তু জেলখানার ছাদ হতে পিছলে পড়ে যেয়ে পা ভাঙ্গায় আর ওর বাবার আচার আচরণে সন্তুষ্ট হয়ে বাবাকে জেল কর্তৃপক্ষ সাজা শেষ হওয়ার আগেই রেহাই দেয়। কিন্তু সেদিনের সেই অপরাধীকে রিফাত আজও মাফ করতে পারেনি। আর জীবনেও মাফ করতে পারবেনা। সে লোকটাকে ঘৃনা করে।
রাত ১ টায় রিফাত ফ্ল্যাটের তালা খুলে প্রবেশ করলো। সে অনেকটা অপ্রকৃতিতস্থ। অফিসের পার্টিতে খুব বেশী মদ্যপান করেছে। করবেই বা না কেন? জীবনে যাকে সে সবচেয়ে বেশী ঘৃনা করে সেই লোকটি আজ আর বেঁচে নেই। আজকে তাঁর খুশির দিন। মাতাল অবস্থায় রিফাত সোজা তাঁর বাবার রুমে গিয়ে ঢুকলো। হুইল চেয়ারটাকে টেনে এনে বিছানার সামনে রেখে সে মাটিতে পা রেখে বিছানায় বসলো। এখন সে আর তাঁর বাবা মুখোমুখি। রিফাত ওর হুইল চেয়ারের দুই হাতলে হাত রেখে ওর বাবার দিকে তাকিয়ে আছে। তারপর সে নিথর দেহটার মুখের কাছে মুখ নিয়ে চিৎকার করে বললো, “তুমি আমার শৈশবটাকে নষ্ট করে দিয়েছিলে, আমার কোমলমতি মা আর তাঁর পেটে থাকা আমার সহোদরকে তুমি তুমি খুন করেছিলে! আর আমাকে করেছিলে মা হারা এতিম। তোমার জন্য আমি কখনই বাবা মায়ের স্নেহ পাইনি। তোমার জেলে যাওয়ার পর তোমার ভাইয়েরা আমাকে এতিমখানায় দিয়ে দিল। আমার কি এতিমখানায় মানুষ হওয়ার কথা ছিল? আমি তোমার এমন কি ক্ষতি করেছিলাম? কেন তুমি আমার সাথে এমন করলে? আমিও তোমাকে শাস্তি দিয়েছি। তোমাকে জীবনে ‘বাবা’ না বলে ডেকে। তোমার মনের ভিতর আমার মুখ হতে বাবা ডাক না শোনার জন্য যে ব্যাকুলতা তা আমাকে গত একটা বছর আমাকে আনন্দ দিয়েছিল। এত সহজে তুমি মরতে পারোনা। এত সহজে তোমার মৃত্যু হতে পারে না। “মা! মাগো দেখো তোমার খুনি! কতটা অসহায় অবস্থায় আমার সামনে বসে আছে। আমি চাইলে তোমাকে পেটে লাথি মেরেছিল যে পা তা কেটে নিতে পারি। কিন্তু মা সেই পা তো আল্লাহ আগেই নিয়ে নিয়েছে। রিফাত হুইল চেয়ারটিকে ধাক্কা মেরে পিছনে সরিয়ে দিল। সেটি দেওয়ালে ধাক্কা খেলো আর দেহটি নিচে উপুর হয়ে পড়ে গেল। এক পর্যায়ে মা মাগো বলে বিড়বিড় করতে করতে একসময় রিফাত বিছানায় ঘুমিয়ে পড়ল। সকালে ঘুম হতে উঠে রিফাত নিজেকে বাবার রুমে আবিষ্কার করলো। নিচে দেহটি পড়ে থাকতে দেখে অবাক হলো অতঃপর ওর রাতের সব কথা মনে পড়লো। রিফাত দেহটি মাটি হতে তুলে বিছানায় শোয়ালো। লাশের সৎকারের ব্যবস্থা করতে হবে। অতঃপর ওর চাচাকে ফোন করে জানালো ওর বাবার মৃত্যুর কথা তারা যেন কবর খুঁড়ে রাখেন। তারপর এ্যাম্বুলেন্সকে ফোন করে এনে লাশ নিয়ে সোজা রওনা হলো গ্রামের উদ্দ্যেশে। রিফাত তাঁর বাবার কবরে মাটি দেয়নি। লাশটাকে রেখে সৎকারের জন্য যা যত টাকা প্রয়োজন তা দিয়ে চলে আসে জরুরী কাজের অজুহাতে। কবরে মাটি না দেওয়াও তাঁর বাবার প্রতি প্রতিশোধ নেওয়ার একটা অংশ।
এর সাতদিন পর রিফাত একটা জরুরী বই খুঁজতে ওর বাবার রুমে ঢুকতেই টেবিলে পেপার ওয়েট দিয়ে ঢাকা খামটার দিকে ওর নজর যায়। সে খামটা খুলে। একটা চিঠি।
রিফাত, বাবা আমার। আমি জানি তুই আমাকে অনেক ঘৃনা করিস। করাটাই স্বাভাবিক। আমি তোর মার খুনি। সেই খুনিকে তুই শেষ বয়সে এসে আশ্রয় দিয়েছিস সেইজন্য আমি তোর কাছে চিরকৃতজ্ঞ বাবা। আমি তোর শৈশব কেড়ে নিয়েছি। কেড়ে নিয়েছি তোর মাকে। একজন বাবা হয়ে সন্তানের প্রতি যা যা করা তাঁর কিছুই আমি করিনি। কিন্তু সত্যি বলছি আমি সেজন্য অনেক অনুতপ্ত রে। তোর মুখ হতে বাবা ডাকটা শোনার জন্য আমি যে পিপাসিত, কিন্তু আমি জানি সেটা হয়তো সেটা আমি আর জীবনেও শুনতে পাব না। আমার বুকটায় কেউ বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে মারে যখন আমি দেখি আমার সন্তান আমার সামনে কিন্তু আমার সাথে কথা বলেনা। আমি কথাটা তোকে কোনদিন বলতে চাইনি কিন্তু তোর জানা দরকার।
সেদিন আমি চট্টগ্রাম হতে গ্রামে ঢুকতেই গ্রামের এক ভাবী আমাকে টিটকারী মেরে বলে যে তোর মা গর্ভবতী। অথচ আমি গত ৭ মাস ধরে এখানে নেই। তখনই আমার মাথা গরম হয়ে যায়। আর আমি নির্বোধের মত রাগের মাথায় তোর মাকে মেরে ফেলি। আমি জেলে যাওয়ার পর বুঝতে পারি যে আমি ৭ মাস তোদের একা ফেলে রেখে গিয়েছি। সংসার চালাতে তোর মাকে কতই না কষ্ট করতে হয়েছিল। যদি সে কোন অনৈতিক কাজ করে থাকে তাঁর জন্য আমি দায়ী বাবা। এই উপলব্ধি আমার জেলে যাওয়ার পর হয়। তখন আমি আত্মহত্যা করতে জেলের ছাদ হতে লাফ দেই কিন্তু বিধাতা আমার মৃত্যু দিলেন না। বাঁচিয়ে রাখলেন তোর হাতে শাস্তি পাওয়ার আশায়। তোর হাতে শাস্তি পাওয়ার আগে আমার মৃত্যু কেন হলোনা সেদিন। তোর মুখে বাবা ডাকটা না শোনাটাই আমার সবচেয়ে বড় কষ্ট। কিন্তু তোর জায়গায় থাকলে আমিও তাই করতাম।
আমার শরীরটা বেশী ভালো যাচ্ছেনারে বাবা। তোকে বলতেও পারছিনা। একেই তোর কাছে এসে বেশ ঝামেলায় ফেলে দিয়েছি। আল্লাহর কাছে এখন শুধু মৃত্যু কামনা করছি। তোর প্রতি আমার কোন অভিযোগ নেই বাবা। তুই সুখে থাক এই কামনা। পারলে এই হত্যাকারী বাবাকে মাফ করে দিস।
রিফাতের হাত কাঁপছে। চোখ দিয়ে অশ্রুর ধারা বইছে। রুমের কোনে পড়ে আছে ওর বাবার হুইল চেয়ার। ওটাকে জড়িয়ে চিৎকার করে উঠলো ‘বাবা’। আমাকে মাফ করে দাও বাবা। আমাকে মাফ করে দাও।
রিফাতের বাবা কি শুনতে পেয়েছে?
মসজিদ হতে ভেসে আসছে কুরআন তিলয়াতের মধুর কন্ঠ। যেমনটা ওর বাবা পড়ত।
©somewhere in net ltd.