নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

রাসেল আহমেদ

একজন গাঙ্গচিল

লেখলেখি করি একটু আধটু যদিও লেখার হাত ভালো না। অবশ্য লেখালেখির চেয়ে বড় পরিচয় আমি একজন বড় পাঠক। মুক্তিযুদ্ধ আমার সবচেয়ে বড় অহংকার। সবসময় স্বপ্ন দেখি একটা সুন্দর বাংলাদেশের। ইমেইল[email protected]

একজন গাঙ্গচিল › বিস্তারিত পোস্টঃ

বাবা !!

১৯ শে এপ্রিল, ২০১৭ রাত ২:২২

টাকাটা শেষ পর্যন্ত চুরি হয়ে গেলো।

হাবিবুর রহমান দশ হাজার টাকা মানিক এর কাছে রেখে বলেছিলো তুই বাসা যাবার সময় টাকাটা নিয়ে মায়ের হাতে দিস। হাবিব তার এলাকার বড় ভাই, একটা ছোটোখাটো চাকুরী করে। হাবিব টাকাটা দিয়েছে তার মায়ের চিকিৎসার জন্য। টাকাটা হারিয়ে বেশ মুশকিলেই পড়ে গেলো মানিক। এতগুলো টাকা হারিয়ে গেলো বাসা থেকে। শুধু যে তার ক্ষতি হয়েছে তা না। এই মেসে যারা থাকে তাদের সবারই কমবেশী ক্ষতি হয়েছে। কিন্ত এতগুলো টাকা সে কিভাবে ম্যানেজ করবে ভাবতেই কেমন গা শিউরে উঠছে। সে চিন্তাই করতে পারছেনা এখন কি হবে।

কাল রাতেই টাকাটা গুনে রেখেছিলো। সকালে যখন মেসে কেউ ছিলোনা, আর যারা ছিলো তারা বেহুশের মত ঘুমাচ্ছিলো। আর সেই ফাকেই বাসা পুরো সাফ হয়েছে। ল্যাপটপ, মোবাইল, ঘড়ি, কাথা, নগদ টাকা সহ যা ছিলো সবই নিয়ে গেছে। এর আগেও একবার বাসা থেকে চুরি হয়েছে। তখন মানিকের এতটা খারাপ লাগেনি। তখন তার চুরি হওয়া বলতে তার হাত ঘড়ি, ব্যাগ, মানিব্যাগে থাকা কিছু টাকা আর একটা কাঁথা চুরি হয়েছিলো। কিন্ত এবার সেই একই জিনিসই তার চুরি হলো তার সাথে শুধু যোগ হলো হাবিব ভাইয়ের দশ হাজার টাকা।

আজ কেবল মঙ্গলবার, বৃহস্পতিবার মানিক বাসায় যাবে।
মানিকের জন্য এই ক্ষতির পরিমান টা বেশ বড়ই। টিউশানি করে সে নিজে চলে। বাবার যে আহামরি উপার্জন তা না। ক্ষেতে চাষ আবাদ করে যা টাকা আয় করে তা খেয়ে পরে চলতেই শেষ, মাস শেষে কিছু জমাতে পারেন না। তার উপর ছোটো ভাই মামুন এবার মাধ্যমিক দেবে, তার প্রাইভেট পড়ানো বাবদ অনেক খরচ। অনেক সময় দেখা যায় মামুনের টিউশানির টাকা প্রায় বাঁকি থেকে যায়।

মানিকের ছোট বোন সুমির বিয়ে হয়েছে প্রায় ৩ মাস হলো। সে অনেক খরচের ব্যাপার। কৃষক বাবার পক্ষে এতগুলো টাকা ম্যানেজ করাও ছিলো প্রায় অসম্ভব। নিজের সামান্য আবাদী জমি, সেখান থেকেও ১০ কাঠা বিক্রি করেই বিয়ের বন্দোবস্ত হয়েছিলো। মানিকের মা গ্রাম সমিতি থেকে ঋণ নিয়েছিলো গরু কেনার জন্য। তার জন্য প্রতি মাসে ৫০০ টাকা করে দিতে হয়। এত কিছুর পরেও মাস শেষে মানিকের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচের কিছুটা দিতে হয়। ধার দেনা সবখানেই বেড়ে যাচ্ছে। আজ এখানে ধার তো কাল ওখানে ধার। ধারগুলো সব সময়মত শোধ করতে না পারার জন্য অনেকেই আর ধার দিতে চায়না। তবুও ছেলের পড়াশোনার দিক চেয়ে এখানে লজ্জা শরমের বালাই না রেখে ধার করে বেড়ায়। ধার না পেলে অনেক সময় এটা সেটা বিক্রি করে চলতে হয়েছে। বিক্রি করার মত যা ছিলো আপাতত সবই শেষ। ঋণে কেনা গরুটার দুধ বেঁচে সংসারে কিছু অবদান রাখতে পারতো মা, হয়তো মানিকের দিকে চেয়েও গরুটা বেচে দিতে হবে একদিন।

মানিক যে বোঝেনা তা ঠিক না, সেও সব বোঝে। এজন্য সে বাসা থেকে টাকা নেয় না। নিজে কষ্ট করে টিউশানি করে চলে। নিজের অনেক ইচ্ছাই সে বিসর্জন দিয়েছে। টিউশানি করে যা পায় তাতে কোনরকম কষ্ট করে চলা যায়। দশ টা টাকা খরচের আগে দশবার ভেবে নিতে হয় তাকে। পরে আবার হাতে টান পড়ে এই ভয়ে। বন্ধুরা এখানে ওখানে ঘুড়তে যায়, তারও সাধ হয় কিন্ত টাকার জন্য হয়ে উঠে না। তবুও বন্ধুদের বলতে হয় নারে স্টুডেন্ট এর পরীক্ষা আছে এখন আর টিউশানি ফাকি দেওয়া যাবেনা। একটা ভালো মোবাইলও তার নেই। সব বন্ধুদের ভালো মোবাইল আছে, বন্ধুরা তাকে খোটা দেয় কিরে কবে ভালো মোবাইল নিবি এই মোবাইলে আর কতদিন। তবুও সে হাসিমুখেই উত্তর দেয় ক্যানো এই মোবাইলে কি কথা হচ্ছেনা।

মানিক রাতে ঘুমাতে পারেনা। শুধু ছটফট করে। টাকাটা সে কিভাবে ম্যানেজ করবে। নিজের যা গোছানো টাকা আছে তা সব মিলিয়ে কুড়িয়ে কাড়িয়ে হাজার খানেক টাকা হবে। সারা রাত তার এদিক ওদিকে পাশ ফিরতে ফিরতে গেলো। সকালে উঠে আর ভালো লাগেনা। শুধু টাকাটার কথা মাথায় ভাসছে। খেতে গিয়েও খাওয়া হচ্ছেনা। ক্লাশে গিয়ে আনমনা হয়ে থাকছে। দুপুরে বাসা এসে খেতে পারছে না, পড়ায় মনোযোগ দিতেও পারছেনা।

সামান্য কয়টা টাকার জন্য টানা ২ দিন সে স্থির হতে পারছেনা, শুধু তার বাবার কথা মাথায় আসছে। মাস শেষে তার ভার্সিটির টাকা, ছোটো ভাইয়ের টিউশানি, সংসার চালনো, বোনের নতুন বিয়ে সেখানেও আত্মীয় সজনের কিছু খরচ, মায়ের ঋণ এর টাকা, জমিতে চাষাবাদ। আর কিছু ভাবতে পারছেনা মানিক। দারিদ্রক্লিষ্ট সংসারে এত কিছু ম্যানেজ করে মাথায় হাজার টা চিন্তা নিয়ে তার বাবা কিভাবে ঘুমায় এই প্রশ্নের উত্তর খুজে পেলো না মানিক। বাবার কথা ভেবে তার বুকের ভেতর টা ফেটে যাচ্ছে। বাবাকে জড়িয়ে খুব কাদতে ইচ্ছে করছে তার। আগে সে কখনোই এভাবে চিন্তা করেনি। আজ দশ হাজার টাকা তাকে যে নতুন শিক্ষা দিয়ে গেলো, নতুন করে ভাবতে শিখিয়ে গেলো তা হয়তো তার আজীবনের শিক্ষা হয়ে থাকবে।

নির্ঘুম রাত কাটিয়ে ভোর বেলায় বাসায় ফোন দিলো সে। বাবার সাথে কথা হলো তার। বাবাকে সব বললো মানিক। একা একা আর সে পারছেনা। গুমরে গুমরে মরে যাচ্ছে সে। বাবা তাকে বললো বাসায় আসো ব্যাবস্থা একটা হবে।

বাবাকে ব্যাপারটা বলে তার খুব হালকা লাগছে। বাবা যে একটা ছায়াবৃক্ষ তার অনুধাবনে আগেও এসেছে । আর আজ এলো নতুনভাবে। মানিক নিজেকেই প্রশ্ন করলো আচ্ছা আমি কখনো জানতে চেয়েছি যে বাবা তুমি এত কম হাসো ক্যানো? আসলেই তো বাবা কম হাসে। হাসিমুখ কবে দেখেছে মানিক ঠিক মনে করতে পারলো না। কখনো তো সে জানতে চায়নি বাবা আজ রাতের ঘুমটা কেমন হলো তোমার। কখনো কি বসে বাবার সাথে বসে বাবাকে জানতে চেয়েছি?

বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় মানিক বাসা চলে আসলো। বাবা আর কিছুই জিজ্ঞেস করলো না এই ব্যাপারে। রাতে যখন মা তাকে খাবার জন্য ডাকছে তখন বাবা বারান্দায় শুয়ে আছে। মানিক ভাতের থালাটা যখন এগিয়ে নিলো তখন বাবার চেহারাটা ভেসে উঠলো। ডাক দিলো বাবা খাবেনা? খেয়ে নাও আসো। বাবা বলে উঠলে না খেতে ইচ্ছে করছেনা, সন্ধ্যায় তো রুটি খেলাম। মানিকের আর খেতে ইচ্ছে করছেনা। বাবার কন্ঠটা শুধু কানে বাজছে। "খেতে ইচ্ছে করছেনা" বাক্যটা যে খুব পরিচিত তার।

খুব ভোরেই মানিকের ঘুম ভেঙ্গে গেলো। ঘুম ভেঙ্গেই দেখে বাবা উঠোনে বসে আছে, সাথে আরো দুজন লোক। তারা গরুর ব্যাপারী। গরু টা নিতে এসেছে। বাবা টাকা গুনে নিচ্ছে।

ব্যাপারী যখন গরু নিয়ে চলে গেলো, মানিকের বুকের ভেতর টা হু হু করে উঠলো। সে বাবার দিকে আর তাকাতে পারছেনা। টপটপ করে চোখ দিয়ে তার পানি পড়ছে। বাবা হাত বাড়িয়ে টাকাটা দিয়ে বল্লো যা টাকাটা দিয়ে আয়। মানিক স্পষ্ট দেখতে পারছে বাবার হাত কাঁপছে। থরথর করে কাঁপছে। খুব ইচ্ছে করছে বাবাকে জড়িয়ে ধরতে, বাবার বুখে একটু মাথা রাখতে, বাবার একটু স্নেহ পেতে। হাত বাড়িয়ে টাকাটা নেবে সে ক্ষমতা তার হচ্ছেনা, তার হাত আগাচ্ছে না, ঠোঁট কাঁপছে।

অনেক কষ্টে অস্পষ্ট স্বরে শুধু উচ্চারণ করতে পারলো "বাবা"।
কিন্ত বলতে পারলোনা বাবা তোমাকে অনেক ভালোবাসি।

মন্তব্য ২ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ১৯ শে এপ্রিল, ২০১৭ সকাল ১০:১৫

করুণাধারা বলেছেন:
মন ছুঁয়ে যাওয়া গল্প। ++++

২১ শে এপ্রিল, ২০১৭ দুপুর ২:৩৫

একজন গাঙ্গচিল বলেছেন: ধন্যবাদ ভালো লাগার জন্য।
ভালো থাকবেন।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.