![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমি একজন সাধারন মানুষ। এবং পেশায় স্টুডেন্ট, পড়া লেখার পাশাপাশি বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বিশ্লেষণ করতে ভালবাসি।
পিলার ধরে নাড়াচাড়া করেছিল হরতাল আহ্বানকারীরা, তাই রানা প্লাজা ধসে পড়ে থাকতে পারে!
এই কথা একজন মন্ত্রী বলেছেন। কোন মন্ত্রী বলতে পারেন, শোনার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষ একবাক্যে বলে উঠবে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী! স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর গদিটা কাঁটায় ভরা, ওই মন্ত্রী পদে বসতে তিনিই রাজি হবেন, কেবল তাঁর পক্ষেই সম্ভব এমন কথা বলা! মাটি খুঁড়ে সন্ত্রাসীদের বের করব, আল্লাহর মাল আল্লায় নিয়ে গেছে, লুকিং ফর শত্রুস থেকে শুরু করে ‘পিলার নাড়ায় ভবন পড়ে’ তত্ত্বের উদ্গাতারা সবাই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন! ব্যাপারটা নিয়ে পরিসংখ্যানবিদদের গবেষণা করা উচিত।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে সার্টিফিকেটপ্রাপ্ত ইঞ্জেনিয়ার, হোক না সে খুব বাজে স্টুডেন্ট ছিল
এ কথা সে গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারবে কোনো নয়তলা ভবনের একটা কলাম দশজনে মিলে সর্বশক্তি দিয়ে ধাক্কা দিলেও কোনো ভবন ভেঙে পড়বে না,তবে এটা বলতে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক হতে হয় না যে এ ধরনের উক্তি করলে সরকার পড়ে যেতে পারে।
আমি পলায়নবাদী মানুষ। প্রথম দিন ওই দুর্ঘটনার খবর শোনার সঙ্গে সঙ্গে কাঁদতে শুরু করি। ভবনটিতে পোশাক কারখানা ছিল! হায় হায়, না জানি কত হাজার মানুষ ধুলায় মিশে গেছে রক্ত-মাংস-অস্থিসমেত! তারপর দুশ্চিন্তা, ওই গহ্বরের মধ্যে নড়তে পারছে না, চড়তে পারছে না, হয়তো হাত-পা চাপা পড়ে আছে কংক্রিটের নিচে, এমনভাবে একটা মানুষ অন্ধকারে, আলো-বাতাস, খাদ্য-পানি ছাড়া কেমন করে বেঁচে আছে। আমি নিজেকে ওই জায়গায় ভাবি, একটা বিছানায় ৭২ ঘণ্টা বালিশ চাপা দিয়ে রাখলেই আমি বাঁচব না, কোনো লিফটে আধা ঘণ্টা আটকে থাকলেই আমি আতঙ্কে মরে যাব। আমি ভাবতে পারছি না, ভাবতে গেলেই মনে হয়, আমি পাগল হয়ে যাই, রাস্তায় ছোটাছুটি করি, বিষপান করে মরে যাই। আমার শোক কোনো সান্ত্বনা মানে না, যখন ভাবি, ভবনটি পতনের আগে সংকেত দেওয়া সত্ত্বেও এতগুলো মানুষকে জোর করে কাজে ডেকে আনা হলো। এ কোন বিশেষজ্ঞ, যিনি বললেন, একটা কলাম ভাঙলে ভবন ভাঙে না।কার জমি কে দখল করেছিল? কে পুকুর ভরাট করেছিল কী দিয়ে? জলাশয় ভরাট করা না বেআইনি? কে তাদের ভবন বানানোর অনুমতি দিল? কোন স্থপতি তার নকশা করল? কোন কাঠামো প্রকৌশলী তার কাঠামোর নকশা করল? কে তার নিরীক্ষা করে দিল? ওই ভবন বানানো হয়েছিল কোন উদ্দেশ্যে? কেন একটা দাপ্তরিক ভবনে কারখানা বসানো হবে? তাও এই রকম শ্রমঘন ও অত্যন্ত তাপ-উৎপাদনকারী কারখানা? শ্রম মন্ত্রণালয় কী করল? রাজউক কী করল? আমরা বহুবার বলেছি,
ঢাকা বা তার আশপাশে জমি যেখানে সোনার চেয়ে দামি, জীবনযাত্রা যেখানে ব্যয়বহুল, সেখানে কেন বহুতল ভবনে পোশাক কারখানা হবে? পোশাক কারখানার কাঁচামাল আসে বিদেশ থেকে, পণ্য চলেও যায় বিদেশে, তাহলে কেন এটা সমুদ্রবন্দরের কাছাকাছি এলাকাজুড়ে আনুভূমিকভাবে বেড়ে উঠবে না? এত টাকা আয় হচ্ছে, আপনারা ঢাকা শহর থেকে, বাণিজ্যিক ভবন থেকে, আবাসিক এলাকা থেকে পোশাকশিল্প সরিয়ে নিয়ে যান। কে শুনবে কার কথা? সোনার ডিম পাড়া হাঁস, একে মারা যাবে না। এখন লোভ আর পাপ নিজেই নিজের সোনার ডিম পাড়া হাঁসটাকে জবাই করে চলেছে। আর বলি হচ্ছে গরিব শ্রমিকেরা। আহা রে আমার শ্রমিক ভাইয়েরা, শ্রমিক বোনেরা। কৈশোর-তারুণ্য-যৌবন তিলে তিলে বিসর্জন দিচ্ছে প্রচণ্ড আলোর নিচে, অহোরাত্র একাগ্র পরিশ্রম, কয় টাকা বেতন তাদের, কোথায় থাকে তারা, কী খায়, স্বাস্থ্যসুবিধা কতটুকু পায়? আমরা কোনো দিন খোঁজ নিতে যাইনি, শুধু চাকা ঘুরেছে, ববিন ঘুরেছে, সুচ ওঠানামা করেছে, বৈদেশিক মুদ্রা এসেছে, আমরা ঢাকার রাস্তায় মার্সিডিজ দেখি, বিএমডব্লিউ দেখি, আর যেসব গাড়ির নাম জানি না, সেসব দেখি। তারই চুয়ে পড়া টাকার ভাগ পাই। নিজেও গাড়ি চড়ি। বৈষম্য বড় বেশি। অবহেলা, অন্যায়, অনৈতিকতা বড় বেশি। আমরা বারুদের স্তূপের ওপরে বসে আছি। পোশাকশ্রমিকেরা একযোগে বেরিয়ে এসে এত দিনের বঞ্চনার প্রতিশোধ নিতে চাইলে সেদিনই আমাদের সাজানো বাগান শেষ হয়ে যাবে। তেমনি ভাবে সমাজের গরীব এতিম রাস্তায় পড়ে থাকা ছেলে মেয়েরা যাদের সামাজিক কোন মূল্য নেই, তারা কি করছে, কি খাচ্ছে কোন কিছুরই খবর রাখিনা।
তারা যখন বখাটে রূপ ধারন করে ইভটিজিং, চাঁদাবাজি, মাস্তানি, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করে বেড়ায় তখন আমাদের টনক খানিকটা নড়ে ,
কিং বা আদৌ নড়েনি। আর সবকিছুর মূলে দেখতে পাই দলীয় রাজনীতি, গণতন্ত্রের পরিণত হওয়া লুণ্ঠনতন্ত্রে, আইনের শাসনের চির-অবসান, সীমাহীন লোভ, অর্থগৃধ্নুতা, মানবিক মায়া-মমতার অবলোপ, দখলবাজি, ঘুষ-দুর্নীতি, কর্তব্যে অবহেলা, এককথায় নৈরাজ্য!
এই চাপ আর নিতে পারছি না। যে মায়ের কাছে ফোন এসেছে—‘মা, আমরা চারজন চাপা পড়ে আছি, আমাদের উদ্ধার করো’—তাঁর কেমন লাগছে? এসব খবর আর পড়তে চাই না, টিভি থেকে চোখ সরিয়ে নিই। আর কত কাঁদব! আর কত চুল ছিঁড়ব! অনেক কেঁদেছি, আর কাঁদতেও পারছি না।
এই যখন দেশের সব মানুষের অবস্থা, তখন আসছে অমৃতবচন, খুঁটি ধরে ঝাঁকানোর অভূতপূর্ব বৈজ্ঞানিক তথ্য, যা সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মহা মহা আবিষ্কার হিসেবে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
তবু আশা দেখি, ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা নিজের জীবনের মায়া ত্যাগ করে ঢুকছেন সুড়ঙ্গে, ঢুকছেন সাধারণ মিস্ত্রিমানুষ! বের করে আনছেন জীবিত মানুষকে! কতজন রক্ত নিয়ে, অক্সিজেনের সিলিন্ডার নিয়ে বা ওষুধযন্ত্র নিয়ে ছুটে যাচ্ছেন ওখানে। কতজন অর্থসাহায্য করার জন্য সূত্র খুঁজছেন!
এই মানবিক বোধটুকু এখনো সাধারণ মানুষের ভেতর থেকে উবে যায়নি বলেই হয়তো এখনো সূর্য ওঠে, এখনো ভোর হয়, পাখি ডাকে!
©somewhere in net ltd.