![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
একটা সময় ছিল, নগদের যুগ। দোকানে দোকানেও লেখা থাকত--আজ নগদ, কাল বাকি। এখন যুগটাই চেঞ্জ হয়ে গেছে, ক্রেডিট কার্ডের যুগ, আগে খাও, সারা মাস খাও, মাস শেষে বিল পে কর। মানুষের চিন্তা-ভাবনাতেও পরিবর্তন এসেছে। এমনকি ধর্ম ভাবনাতেও ’এন্ড ব্যালেন্স’ দর্শন ঢুকে গেছে।
প্রকৃতই ধর্মভীরু মানুষের সবসময় একটা ভয় থাকে, একট পাপ কাজও সারা জীবনের সঞ্চিত পূণ্য ভাসিয়ে নিতে পারে। আর এন্ড ব্যালেন্স মেথডলজিস্টদের ধারণা, পাপের খাতায় পাপের হিসাব জমতে থাকবে, পূণ্যে খাতায় পূণ্যের হিসাব। একাউন্টিং পিরিয়ড শেষে যোগ-বিয়োগ টানা হবে। যেটার ব্যালেন্স বেশী সেটাই ধরিয়ে দেওয়া হবে। এই ভাবনায় আর যাই হোক একটা স্বস্তি থাকে। একটা ভুলেই সব শেষ নয়। মোট পাপের চেষে মোট পূণ্য বেশী হলেই হল।
এই স্বস্তিকর ভাবনা নিয়েই আমরা তৃপ্ত। এবং এই তৃপ্তি থেকেই আমরা রোজার দিনে তারাবীহ নামাজতো বাদই এমনকি ফরজ নামাজও এক ওয়াক্ত না পড়েও কেবল মাত্র সারাদিন উপোস থেকেই যে রোজা রাখেনি তার থেকে নিজেকে উন্নততর ভাবি, তার মুসলিমত্ব নিয়ে সন্দিহান হয়ে পড়ি। নিজেকে আস্তিক দাবি করি, যে নাস্তিক, তাকে নিজ হাতে শাস্তি দিতে উদ্যত হই।
তবে ধর্মের ক্ষেত্রে যে Comparative Analysis চলে না তা আমরা আমলে নেই না। আমি ওর চেয়ে ভালো, ও এক ওয়াক্ত নামাজও পড়ে না, আমি জুমআর নামাজ পড়ি, অতএব আমি ওর চেয়ে শ্রেয়--এ ধারণা হয়তো ধর্মে চলেনা। এই ব্যাপরটা হয়ে যায় এমন যে, ও সতের পেল, আর আমি পচিশ পেলাম। কিন্তু তেত্রিশ-এ পাশের বেলায় তো দুজনই ফেইল। ধর্মে ফাস্ট সেকেন্ড নাই, গ্রেডিং সিস্টেম। যার যার কাজটুকু ভালোমতো করে গেলে শতভাগই এ প্লাস হতে পারে।
যার যার কাজ ভালোমতো করার ’ভালোমতো’ কথাটা নিয়েও আমাদের একটু অস্বস্তি আছে। নামাজ পড়তে গেলেই দুনিয়ার চিন্তা ভাবনা মাথায় আসে। সাতদিন যাবৎ যে হিসাব মেলেনা, নামাজে দাড়ানো মাত্রই তা মিলে যায়। এটিএম-এর পিন নাম্বার কিছুতেই মনে হচ্ছে না। নামাজে দাড়ানো মাত্রই মনে পড়ে যায়। এই রকম ব্যাপার। মাঝে মাঝে আমরা একটু হতাশই হয়ে যাই। আমাদের ধর্ম-কর্মই বৃথা। আবার নিজেই নিজেকে বোঝাই। প্রার্থনার স্পিরিচুয়াল পার্টে হয়তো আমরা ফেল্টু, কিন্তু প্রার্থনার ফিজিক্যাল পার্টে তো কিছু ন্বান্তনা পুরস্কার পাওয়া উচিৎ।
তবে পুরস্কার যাই হোক, ধর্ম সম্পর্কে জানাটা জরুরি। প্রার্থনা করার জন্য তো বটেই, যে না করে তার জন্যও। কারণ অনেক স্মার্ট ছেলেপেলেকেই দেখা যায় যে নাস্তিক হতে চায়। কিন্তু কেন হতে চায় তা জানে না। জানতেও চায় না। কারণ, এই জানার চেষ্টাটাই সবচেষে কষ্টের। যে যত কম জানে সে তত সুখি। বেশী জানা বেশী কষ্টের। আর জানার চেষ্টা আরও কষ্টের। আপনি ওলামা-মাশায়েখদের কাছে যাবেন, তাদের কাছে জামায়াতী ইসলাম কেবল রাজনৈতিক সিদ্ধিলাভের হাতিয়ার। জামায়াতী ইসলাম বলে তাবলিগওয়ালাদের দৌড় কেবল বক্তৃতা পর্যন্তই। তাবলীগওয়ালারা বলে হিজবুত তাহরীর জঙ্গীবাদ ছাড়া আর কিছু না। হিজবুত তাহরীর বলে খেলাফতই ইসলাম। এসবের মাঝেও আনন্দের বিষয় হলো, এরা সবাই ইসলাম চায়। আর বিষাদের বিষয়, এদের প্রত্যেকেরই প্রথম কথা, আমরাই একমাত্র সত্য, বাকিরা সব বাদ।
এতসবের মাঝে যদি আপনি দুর্ভাগা হন তাহলে এদের কোন একটার মাঝে জড়িয়ে যাবেন এবং সুখী হবেন। আর যদি সৌভাগ্যবান হন তাহলে আরও সমস্যা। আপনি গণজাগরণ মঞ্চের কাছাকাছি এসে দাড়িয়ে থাকবেন। কিন্তু জনতায় যোগ দিতে পারবেন না। আপনি ভাবতে থাকবেন এটা কি প্রকৃতই গণজাগরণ মঞ্চ নাকি আওয়ামী জাগরণ মঞ্চ? এরা কি প্রকৃত রাজাকারের বিচার চায় নাকি জামায়াতী ইসলাম তথা বিরোধীদলীয় রাজাকারের বিচার চায়?
এক্ষেত্রে একটা কাজ করা যায়, নিজে নিজে পড়াশোনা করা যায়, জানার চেষ্টা করা যায়। যদিও বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসের আওয়ামী ভার্সন এবং জাতীয়তাবাদী ভার্সনের মতো কিছু ব্যাপার আছে, তবুও মনে হয় বইতে তুলনামূলক কম অসত্য থাকে। কারণ সত্যের অপলাপ হতে থাকে উৎস থেকে তা যত দূরে যেতে থাকে তার উপর। সমান দুরত্বে মুখের কথার চেয়ে লিখিত কথার বিকৃতির সুযোগ কম থাকে। নিজে নিজে জেনে কারো সাথে আলোচনা করা যেতে পারে। তার পর মন যেটুকু চায় গ্রহণ করা এবং যেটুকু না চায় বর্জন করা।
এখানে এসে হয়তো অনেকেই বলবে, আমার মন যদি সবটুকুই বাদ দিতে চায়?
এর উত্তর একটু কঠিন। মানুষের জ্ঞান যেখানে কাজ করে না সেখানে তা স্রষ্টার কাছে রেফার করাই ভাল। তিনি সর্বজ্ঞানী, তিনিই ভালো জানেন।
এখানেও সমস্যা। এখানেও জনতা দ্বিধা-বিভক্ত। কেউ বলবে তার হুকুম ছাড়া যেহেতু গাছের একটা পাতাও নড়ে না, কাজেই মানুষের ভাল মন্দ সব কর্মের গৌরব এবং দায়-দায়িত্ব তারই। আবার কেউ বলবে, মানুষকে বুদ্ধি বিবেচনা দিয়ে পাঠানো হয়েছে। মানুষ যা মন চায় করবে, তাই কর্মফলও মানুষেরই।
দুইটাই দুই এন্ড থিওরি। তবে আমার মনে হয় ইন-বিটুইন কিছু আছে। বিধাতা নিয়তি ঠিক করেই দিয়েছেন, আমরা যা-ই করি ঘুরে ফিরে যা পূর্বলিখিত তাই করব, কিংবা বিধতা পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছেন, যা মন চায় সেটাই করব, আামর তা মনে হয় না। আমার মনে হয়, বিধাতা আমারদের নিয়ন্ত্রিত স্বাধীনতা দিয়েছেন। একটা বৃত্তের মধ্যে ছেড়ে দিয়েছেন, যত খুশি দৌড়াও। আমার মনে হয়, বিধাতার হিসেব হচ্ছে If then…লজিকের মতো। বিধাতা ইফ এবং দেন সেট করে দেন, মানুষ যা মন চায় তাই করতে পারে না, কেবল বিধাতার ইফ থেকে বেছে নিতে পারে এবং সেই ইফ অনুযায়ী দেন পায়। ইফ মক্কা, দেন; ইফ লাস ভেগাস, দেন। যিনি ইফ থেকে মক্কা নেন, তিনি ইফ-দেন এর পরবর্তী স্টেজএ চলে যান, এবং পরবর্তী ইফ-দেন নিয়ে ব্যাস্ত হয়ে পড়েন। যিনি লাস-ভেগাসে যান তিনিও একইভাবে ইফ-দেন এর পরবর্তী স্টেজ-এ চলে যান।
যতই লোকজন ইকুয়েশন দিয়ে প্রমাণ করুক-
প্রার্থনা + কাজ = ফল
আবার, কাজ = ফল
অতএব, প্রার্থনা = শূণ্য, প্রথম লাইনটাই আমার পছন্দ, প্রার্থনা + কাজ = ফল।
শুধু কাজ করলে ফল হতে পাওে, আবার নাও হতে পারে। আবার শুধু প্রার্থনা শূন্য হওয়ার সম্ভবনাই বেশী। তবে প্রার্থনা এবং প্রচেষ্টা একসাথে থাকলে ফল হবেই।
আমার ধারণা মানুষ আছে তিন ধরনের-
১. যাদের প্রার্থনার প্রয়োজন নেই। বিধাতা নিজেই এদের বিশেষভাবে তৈরী করেছেন। যেমন- ভিঞ্চি, আইনস্টাইন, রবীন্দ্রনাথ।
২. প্রার্থনায় যাদের কোন লাভ নেই। যতই প্রার্থনা করুক ফলাফল শূণ্য। এই উদাহরণ দেয়া একটু কঠিন। তবু যদি দিতেই হয় তবে বলা যায়-ফিলিস্তিনি জনগন, আফগান জনগন, বাংলদেশী বিরোধী দল। এরাও বিধাতার বিশেষ সৃষ্টি।
৩. আর তৃতীয় যে দল আছে তারা হলো এর মাঝামাঝি, যাদের প্রার্থনার প্রয়োজনও আছে, এবং প্রার্থনায় যাদের কাজও হয়। আমরা আমজনতা সাধারণত এই গ্র“পে পড়ি। মেয়েটার বাড়ির সামনে সারাদিন দাড়িয়েও থাকি, আবার প্রার্থনাও করি। অবশেষে প্রেমটা হয়ে যায়। একটু আধটু পড়ালেখা করি, আবার প্রার্থনাও করি। একটা চাকরি পাওয়া যায়। এই রকম হাজারো উদাহরণ দেওয়া যায়।
যদিও আমাদের মধ্যে কোন কিছু চাওয়ার ব্যাপাওে একটা ভদ্রতা কাজ করে। যেখানে চাইলেই পাওয়া যায়, সেখানে কি বারবার চাওয়া যায়? লোকে কী বলবে? তাই একান্ত বিপদে না পড়লে আমরা চাইতে চাইনা। বিপদে পড়লেই বসে যাই চাইতে। বিধাতা সবাইকেই যে দেন তা না। তবে অনেককেই দেন। যাদের দেন না আমরা নিজেরা সান্তনা খুজে নেই, হয়তো ঠিকমতো চাইতে পারিনি।
তবে আমাদের এই পরিমিতি বোধ বিধাতার কাছে ঠিক ভদ্রতা হিসেবে পৌছায় না, তার কাছে এটা পৌছায় উদাসীনতা হিসেবে। তবু তিনি ক্ষমাশীল, তার বান্দাকে দূরে ঠেলে দেন না। একজন আরেক জনকে দূরে ঠেলে দেয় আমাদেরই মাঝে যারা Comparatively Better, তারাই।
কিছুদিন আগে একটা স্প্যানিস মুভি দেখেছিলাম--মার আদেন্ত্রো (The Sea Inside)। যার থেকে অনুপ্রানিত হয়ে সঞ্জয় লীলা বানসালী বানালেন তার গুজারিস। র্যামন স্যামপেড্রো তার অচল শরীর নিয়ে ত্রিশ বছর ধর্মীয় আদালত এবং সামাজিক আদালতে লড়াই করে যায় একটা সম্মানজনক জীবনাবসানের জন্য। সিনেমার শেষের একটা সংলাপ--Life is a right, not an obligation.
আমারতো মনে হয় প্রার্থনার ক্ষেত্রে একথা আরও সহজ-সরল এবং জোরালো ভাবে প্রযোজ্য।
©somewhere in net ltd.